এক.
মাকুর প্যায়দাইশি মাথা খারাপ। মুখ থেকে অবিরত লালা ঝরে। লালা শুকিয়ে যায়। শুকিয়ে ঠোঁটের পাশেই জায়গা করে নেয়। খসখসে সাদা দানাদার প্রলেপের মত দেখায়। মাকুর মাথার আকারটা ঠিক—কেমন যেন! গিঁট পাকানো বাসি
চুলে নোংরা অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর মাকু দু হাতের আঙুলগুলো গলিয়ে দেয়। ঘস ঘস
করে মাথা চুলকায়। খালের ধারে অশত্থ গাছের
তলায় ও পড়ে থাকে। হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে ঝিমোয়। চোখের কোণে শুকনো লঙ্কার রঙটা তখন
আর দেখা যায় না। সেই চোখ খোলা থাকলে ড্যাব ড্যাব করে তাকায়
গবেটের মত। মুখে তখন লালাময় হাঁ। মাকু কথাটথা তেমন বলতে পারে না। দুঃখ পেলে
গোঙায় আর খুব আনন্দে গোঁ গোঁ শব্দ করে কিন্তু কী কারণে ওর আনন্দ আর কিসেই বা ওর দুঃখ তা বুঝতে পারে বস্তিপাড়ায় এমন সাধ্যি কার!
বাইপাশের পাশে তিনকোণা পুকুর । পুকুরটার একটা লিকলিকে লেজ গিয়ে মিশেছে পাশেরই
বিচ্ছিরি একটা খালে। খালের জলে তেল আলকাতরা আর বাইপাস থেকে উড়ে আসা গ্যাস মিশে
বিষাক্ত আস্তরন। অদ্ভুত এই জলের রঙ! এই রঙ
প্যালেটে সৃষ্টি করতে দুঁদে শিল্পিকেও ঠোঁটে আঙুল রেখে বিস্তর ভাবতে হবে। কোথাও
কোথাও এই আস্তরণ ফুটো করে অবশ্য জলের স্বাভাবিক রঙটা উঁকি মারে।জলে কত রকম কাগজ ভাসে । চুপসে যাওয়া প্লাস্টিক ভাসে। সবেতেই নাকটেপা দুর্গন্ধ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুচরো
কচুরিপানাও দেখা যায়। খালের জল যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে
অবশ্য সবুজ ঘাস আর কিছু জংলি আগাছার সমাহার চোখে পড়ে। তার ওপর বালি, পাথরকুচি, আলকাতরা তৈরির কালো ধুমসো এক যন্ত্র। রাত হলেই
যন্ত্রটা জেগে ওঠে।ওটার পেটের ভেতর তখন গনগনে আগুন আর পিচকালো ধোঁয়া। ঐ যন্ত্রটার
পাশ দিয়েই খালের পার ধরে পায়ে হাঁটার একখান ছিঁচকে পথ আপনা থেকেই তৈরি হয়েছে
বস্তিবাসীদের ঘন যাতায়াতে। বস্তিপাড়া থেকে হঠাৎ বেরিয়ে রাস্তার ঝাঁ চকচকে গাড়িগুলোর উজ্জ্বল হেডলাইটের পারস্পরিক
অভিঘাত চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেয়। ইদানিং রোডরোলার চষে এই রাস্তা আগের থেকে অনেকটাই চওড়া।এখন অনেক বেশি গাড়ি আঁটে। ভবিষ্যতে নাকি আরও চওড়া হবে। উন্নয়নের স্বার্থে অঙ্ক কোষে সবকিছুই
পরিকল্পনামাফিক। অডি জাগুয়ার মার্সেডিজের চাকার ধুলোয় ধন্য হয় এই সরণী প্রতিদিন।ওদের
চাকার তলায় ঘেয়ো কুকুর টুকুর মরলে কিছুদিন বেওয়ারিশ লাশের মত পড়ে থাকার পর পেটফোলা
পচা মৃতদেহটা চালান হয়ে যায় খালের জলে। শোনা যায় এই খালেরই জল এক সময় দূরে কোথাও
একটা নদীর সাথে মিশত। সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা। খালের দুপাশ জুড়ে তখন বাবলা
হোগলা কাশের বন । জলে চড়ে বেড়াত বুনো হাঁসের দল আর ঐ নদীতে রুপোলী
আঁশওয়ালা মাছ।
কথার ফাঁকে যে বস্তির কথা এসে পড়ছে সেইটির কথায় আসা যাক এবার। খালের এপার জুড়ে
গজিয়ে উঠেছে গায়ে গা লাগানো ঝুপড়ি ঘরগুলো । বাঁশের খুঁটির ওপর কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদ বলতে
ইঁট চাপা দেওয়া বস্তা রেক্সিন। নুন্যতম
তীব্রতার ভূমিকম্পে ঘরগুলো যেকোনো সময় ঝুরঝুরিয়ে তলিয়ে যেতে পারে খালের গভীরে । ঘরগুলো
দেখতে মোটামুটি একইরকম। মাকু আর ওর বাবা রঘুনাথ এখানেই থাকে। রঘুনাথ
দিনমজুর। যখন কাজ থাকে তখন রাত তিনটের সময় বাইপাসে মালিকের লরি আসে। তারপর যে যার
রুটে চলে যায়। পুরনো বাড়ি ভেঙে এখন ফ্ল্যাট হচ্ছে। বাড়ি ভেঙে গেলে পাথর , বালি ,
রাবিশ কোদাল আর ঝুড়ি দিয়ে রঘুনাথ লরিতে তুলে দেয়। পার ট্রিপ নব্বই টাকা। রঘুনাথের ঘরটা খালপারের একেবারে শেষ প্রান্তে। ঘরের দেওয়ালে ইঁটের গাথনির ভেতর থেকে সিমেন্ট
বেরিয়ে থাকে।ওপরে কালচে টালি হাত দিয়ে
ছোঁয়া যায়। তারই ওপরে গুটলি পাকানো তারে একটা বাল্ব গামছার পাশে ঝুলছে। পেরেক
পোঁতা দরজায় পর্দা বলতে কাউরিনির ছেঁড়া শাড়ি। রঘুনাথের পাশের ঘরে শম্ভুর বউ
কিছুদিন হোল বিষ খেয়েছে। শশুরকে দু চক্ষে সহ্য করতে পারত না কিনা। শম্ভুর সাথে সারাদিন শশুরকে নিয়ে খিটির পিটির
লেগেই থাকত। বিষ খাবার কারণ এটাই। মধু বউদি ছেঁড়া ম্যাক্সি পড়ে চুল পাকাতে পাকাতে বস্তির
আনাচ কানাচ ঘুরে বেড়ান। রঘুনাথকে দেখতে পেলেই বলে,আমার
বরটা জানো কোন শালি মাগীকে বিয়া করে আন্দামান পালায় গেছে। তোর বউটাও তো নাই। ঝুলে
পড়লি কেমন হয়? এই নিয়েই তো সেদিন বস্তিপাড়ায় ভীষণ শোরগোল। রঘুনাথ শুনতে পেয়েছে মধু
বউদিকে কে নাকি বলেছে, তুই শালী রঘুর সাথে ভাউরামি করে বেরাবি আর আমি তোর মেয়েকে
বাইকে চড়ালে দোষ হল। মধু বউদি উত্তর দিতে দেরি করে নি। বলল,চোপা হয়েছে তোর বড় না
পাছাফুটা নবাবের বাচ্চা, পুদে তোর ঐ বাইক ঢুকিয়ে দিব। তোর ঐ হাড্ডি বিচি টিপে ধরলি তো দুটা পাদও বেরোবে না, চোপা
মাড়াতে এসছে। রঘুনাথের এসব গা সওয়া। ও জানে মধুই শেষ কথা বলে বস্তি মাত করবে। বস্তির
লোক ফোকতাই তামাশা দেখে। মধু
বউদির গর্জনে বিকেলের বস্তি যখন গুলজার হয়ে ওঠে মাকু তখন অশত্থ গাছের ছায়ায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে।ওর সামনে ছটফটে প্রজাপতি। অপুষ্ট ঘাসের ডগায়
বসে প্রজাপতিটা পাখা দুটোকে খুব কাছে এনে আবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। মাকুর চোখের
পাতা প্রজাপতির পাখা দুটোর তালে তালে নামছিল আর উঠছিল। ঠোঁটের কোণে সকালবেলার লালা
এখন শুকিয়ে চিমসে। প্রজাপতিটা উড়ে গেল। মাকু
তাকিয়ে থাকল সেদিকেই। তারপর
মুখ নামিয়ে দেখল ঘাসের খাঁজে খাঁজে কালো কালো দানা। আজিজুলের ছাগলগুলো তখন খাল পাড়
ধরে অনেকটা এগিয়ে গেছে। একটু আগে ওরা এখানেই ছিল। একটা দানা মুখে পুরে চেবায় মাকু। দানাগুলো পিষে গিয়ে ওর জিভে দাঁতে ঠোকর মারে তারপর গালের
ভেতর আস্তে আস্তে ঘনীভূত হয়। এ স্বাদের মহিমা কেবল মাকুই বোঝে। মাকুর খেতে খুব ভালো লাগল। হাসি ফুটল। আরও একটা কালো দানা মুখে পুড়ে হাঁটুতে মুখ
গুঁজে গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকল আহ্লাদে।
দুই
তখন মাকু জন্মায়নি । রঘুনাথের
ছিল দুধের ব্যবসা। ও থাকত কাউরিনির সাথে আমড়াই গ্রামে। গ্রাম পেরিয়ে বড় রাস্তার ওপারে টাউনশিপে পাকা বাড়িগুলোয় রঘুনাথ
দুধ বেচতে যেত। মিস্টার ডি এন দত্তর পরিবার গরুর দুধ খেতে ভারি
পছন্দ করত। উনার বড় ছেলে অনির্বাণ তখন কলকাতায়
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। কলকাতা থেকে মাঝেসাঝে বাড়িতে এলে বাবা ছেলেকে গরুর দুধ
খাওয়াতেন। কলকাতা যাওয়ার আগে তো ও গরুর দুধই খেত। রঘুনাথের এনে দেওয়া খাঁটি গরুর
দুধ।
গাইঘাটা খাটালের পেছনে ছিল রঘুনাথের ঘর । ঘরের চারপাশে বিচিত্র আবর্জনা, গোবর,বর্ষার কাদা, পচা খড়ের গাদা কাউরিনির খুব ভালো লাগত। রঘুনাথ
দুধ বেচতে গেলে কাউরিনি খাটালের গোবর মাখা মাটিতে থপ থপ করে হাঁটত আর রঘুনাথ ফিরে
এলে রাতে খড়ের গাদায় রঘুনাথকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ করত। গরু বাছুর বিচালি ঘেরা সংসারে ওরা সুখেই ছিল।
কাউরিনির মেয়ে হল। আদর করে নাম রাখল মাকু। মাকু ছোটবেলায় খুব কাঁদত। যখন তখন কাঁদত। খাটালে গরু মোষের হাম্বার
সাথে ওর কান্না মিশে যেত। কাউরিনি মাকুকে শান্ত করতে কাঁখে
বসিয়ে আঁচলে বেঁধে পুতুল খেলত। আর বলত, ওলে মাকু ওলে মাকু। ধায় মাকু ধায় মাকু।
অত্যন্ত ব্যক্তিগত ছিল মা মেয়ের এই ভাষার আদান প্রদান। যে কারণেই হোক মাকু কিন্তু
চুপ করে যেত।
মাকুর যখন বছর চারেক বয়েস তখন ওর কান্নার বাতিক থামল, নতুন খেলার স্বাদ পেল। গোবর
লেপে তার ওপর গড়াগড়ি খেতে শিখল। গোবরের
সাথে কাদা মাখিয়ে ঘর বাড়ি গড়ত। গোবরের
দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারত বাছুরের গায়ে।ঐ খাটালটার পাশেই ছিল ধাবার খাল। শহরের জঞ্জাল এসে জমত ওই খালে। পলিথিন।
পচা কাগজ। মরা কুকুরের গলে যাওয়া মৃতদেহ। খালের জল জঞ্জালের ভারে আর বইতে পারত না।খালটা কেমন গুম মেরে থাকত। কাউরিনি মাকুকে জড়িয়ে ধরে গোবর কাদায় খেলতে খেলতে মজে
উঠত। তারপর ওই খালের জলে মাকুর ময়লা
গা ধুইয়ে দিত। রঘুনাথ তখন দুধ বেচতে গেছে শহরে।
কাউরিনির একদিন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। টেপুসাধুকে ডাকা হল। টেপুসাধু ছিল খাটালবাসিদের ডাক্তার। খুব নামডাক।চড়ক পুজোর সময় কপালে তিলক কেটে আকাশে বন বন করে ঘুরত পিঠে বরশি
গেঁথে। চেঁচিয়ে বলত, জয় বাবা মহাদেব, রক্ষা কর কলির শিব। চারদিকে তখন গ্রামবাসীদের ঠেলাঠেলি ভিড়।সবার চোখ তখন চড়ক
গাছ। সেই ভিড়ে কাউরিনিও মিশে থাকত। মাকুকে কোলে নিয়ে ড্যাব ড্যাব করে দেখত
টেপুসাধুর কাণ্ড কারখানা। বসন্তের দাগ আর এলোমেলো গর্তে ভরা ওর মুখে তখন ভরপুর
বিস্ময়। চড়ক পুজো শেষ হলে আবার টেপুসাধু ডাক্তার। নাড়ি টিপে টেপুসাধু কাউরিনিকে শেকড় দিল। বলল, তাতজ্বর। শেকড় পিষে রস খেতে হবে। রঘুনাথ কাউরিনির মুখে শেকড় পিষে রস খাইয়ে দিত।মাকুকে কোলে নিয়ে রঘুনাথ ওখানে
বসেই ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আলগোছে হাতের কড়া পড়া আঙুল দিয়ে কাউরিনির খরখরে গালে হাত
বোলাত। কাউরিনি তখন প্রায় বেহুঁশ। মাঝে
মাঝে গোঙাত। একদিন ভোরে রঘুনাথ দেখল কাউরিনির হাঁ করা মুখে কিছু মাছি ভন ভন করছে। কাউরিনির
রক্তে একটা মশা প্রটোজোয়ান প্যারাসাইট ঢুকিয়ে দিয়েছিল বেশ কদিন আগে। টেপুসাধু ধরতে পারে নি। ম্যালেরিয়া। কাউরিনির মৃত্যুতে রঘুনাথের খুব রাগ হোল টেপুসাধুর ওপর। মাকুর ওপর। নিজের ওপর। সবার ওপর।
কাউরিনি মরে গেলে মাকু একা একা গোবর
কাদায় খেলত। পা ডুবিয়ে বসে থাকত ধাবার খালে। রঘুনাথ ওর দিকে তাকাত না। মাকু কী খায়,
কোথায় যায় রঘুনাথের তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। মরলে মাকু মরুক গে।
মিস্টার ডি এন দত্ত একদিন
রঘুনাথকে বললেন, তুমি আর এসো না রঘুনাথ। গরুর দুধে সবার অরুচি। আমার ছেলেটা ওই প্যাকেটে মাদার ডেয়ারির দুধ
খাচ্ছে। ও কলকাতায় চাকরি পেয়েছে।ওখানেই থাকবে। এখানে আর আসবে না।
রঘুনাথ
খালের পাশে হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে কতকিছু ভাবল। ভেজা চোখে দেখল খালের জলে মাদার
ডেয়ারির ছেঁড়া প্লাস্টিক। ওর ভেতর দু ফোঁটা রিফাইন্ড দুধ। মাকু ঠিক পেছন দিকেই তখন
বাছুরের লেজ ধরে টানছিল। ওর হাঁটু অব্দি কাদা। খাটালের ওপারে অনেক দূরে বিস্তৃত
টাউনশিপে স্ট্রিট লাইটগুলো তখন একটার পর একটা জ্বলে উঠছে।
রঘুনাথ
মাকুকে নিয়ে কলকাতায় এল। বস্তিপাড়ায় এসে প্রথমে খইনির ব্যবসা ধরল।তারপর এখন সে
দিনমজুর। রঘুনাথের কাকার ছেলে এখানেই থাকত। ওর ছিল পানের দোকান।রঘুনাথকে কম দামে
একটি বস্তিবাড়ি পাইয়ে দিয়েছিল।
বস্তিপাড়ার সবাই জানে মাকু একা একা মত ঘুরে বেড়ায়। খালি নোংরা ঘাটে। নাক খোঁটে। স্নান করে না।
চুলে খটখটে জট।। রুপা পূর্ণিমা ওরা কেউ মাকুর গা ঘেঁষে
না। ওকে দেখতে পেলে খিলখিলয়ে বলে, মাকু তুই পাগলি, কাঁথা ভরে হাগলি। মাকুর মাথায়
ওসব ঢোকে না। আশ্চর্যের কথা হল মাকুর মাথা খারাপ কিন্তু
পেট খারাপ হয় না। ধুলো
বালি ও কত খেয়েছে। জল তেষ্টাতে একদিন খালের জল চোঁ চোঁ করে টেনেছিল।নিজের হাতেই ঘা করেছিল বস্তি পাড়ার নর্দমা
হাতের আঁচড়ে খুঁচিয়ে । তারপর বিড়ালের মত চেটে সেই ঘা নিজেই পরিস্কার করে নিয়েছিল। মাকু
সব হজম করে নেয়। আজব ওর পেট। বস্তির ছেলেদের ক্রিকেট বল নর্দমায় পড়লে মাকুর ডাক
পড়ে। মাকু তুলে আনে সেই বল । এই তো সেদিন রঘুনাথ গলা অব্দি মদ খেয়ে মাকুর চুলের
মুঠি ধরে পিঠে ঘা কতক দিয়ে বলেছিল, রাক্ষসী মাগি। আমার বউটাকে মেরেছিস এবার শালি আমায় মার। মাকু তখন ভাতের থালার
ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। কটমটিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে গুঙিয়ে ছিল মাত্র।
এ পুরো ডাইনি মেয়ে। আমাদের সোন্দরবনে থাকলে নি এ ডাইনিকে পুড়িয়ে মেরি দিত অ্যাদ্দিনে। মধু বউদি চেঁচিয়ে পরের দিনই রঘুনাথকে বলেছিল এ কথা।
তিন
সন্ধ্যে বেলায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বস্তিবাড়ির রেক্সিন ছাদগুলোয় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার হাড় জিরেজিরে শব্দে পাড়া
কেঁপে উঠল। খালের জল তখন উথাল পাথাল। বাইপাসের
ব্যানারের বিনা পয়সার আলোয় বৃষ্টির জলে চকচক করছিল ভেজা তেরপল গুলো । মাকু খালপাড়ে
একা বসে ভিজছিল।
আমরা সবাই জানি স্থান কাল ঋতু নির্বিশেষে মশার উৎপাতে শহরবাসী হামেশাই নাকাল।
কিছু মানুষ মশক প্রক্ষালক যন্ত্র নিয়ে ফ্যাচ ফ্যাচ করে অলিতে গলিতে স্প্রে করলেও
বস্তি পাড়ার তাদের পা পড়ে না। খালের জলে কিলবিল করতে থাকে ঝাঁক ঝাঁক পোয়াতি মশা। বৃষ্টিপাত বন্ধ হওয়ার পরেই একটা মশা খাবারের খোঁজে একটু আগে
উড়ে গেছে বাইপাসের দিকে।
বাইপাসে অসহ্য ট্রাফিক জ্যামের সাথে মিশেছে বৃষ্টি পরবর্তী ভ্যাপসা গরমের
অস্বস্তি। রাত প্রায় এগারোটা।আটকে থাকা গাড়ি গুলোর ভেতর মানুষগুলোর ঘাম চটচটে ভুরু
বিরক্তিতে কুঁচকেই রয়েছে।তাদের
বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে।
ঘামের গন্ধ বাতাসে ভাসে।
মশারা কিন্তু ঠিক বোঝে। মশাটা তখন শিকার খুঁজছে। উদ্দেশ্য রক্ত থেকে প্রোটিন শুষে নেওয়া।সেও একদিন ডিম পাড়বে। শত সন্তানের মা
হবে।
বাইপাসে
বেশ কিছুক্ষণ চক্কর খাওয়ার পর সে উড়ে গেল সামনের বহুতল আবাসনের দিকে।
মিস্টার
ডি এন দত্তর ছেলে অনির্বাণ এখানেই ফ্ল্যাট কিনেছে। কাকতালীয় বটে।তবে এমন আশ্চর্য
ঘটনা পৃথিবীতেই ঘটে। ওদের এসিটা আজ খারাপ হয়ে যাওয়ায় আজ জানলা খুলে শুতে হচ্ছে।
অনির্বাণ আর ওর স্ত্রী শুয়ে পড়েছে। গরমে ঘুম আসছেনা। ছটফট করছে। অনির্বাণের মেয়েটা
কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছে।ওর জন্য আলাদা রুম।
মশাটা
কিছুক্ষণ আগেই ওদের ঘরে ঢুকেছে। অনির্বাণের স্ত্রীর পার্লার লালিত গালে নাকি উন্মুক্ত
নির্লোম হাতের ঠিক মাঝে? কোথায় ঘাঁটি গাড়বে সেটাই ভাবছিল ক্ষুধার্ত মশাটা।আধো ঘুমঘোরে ওর স্ত্রী, উফফ দিস ব্লাডি ব্লাডসাকারস, বলেই
নিজের গালে মারল মৃদু একটা থাপ্পড়। মশাটা নির্ঘাত মৃত্যু এড়িয়ে লিভিং রুমে ডাইনিং
টেবিলের ওপর রাখা টাটকা ফলগুলোর ওপর কিছুক্ষন ঘুরঘুর করল। কলাটার ওপর বসল। আপেলটার ওপর বসল। তারপর উড়ে গেল ওদের মেয়ের ঘরে। ওর গাল দুটো
লালচে। ফোলা। নরম। তুলতুলে। রক্তে ঠাসা। মশাটা ওর গাল জাঁকিয়ে বসল। ওর
মুখের বাদামি রঙের প্রোবোসিস ছুঁচটা চামড়া ফুঁড়ে লোহিত কণিকা খুঁজছে।এখানে বিরক্ত করার কেউ নেই।অতএব নির্ঝঞ্ঝাট
রক্ত শোষণ প্রক্রিয়া চলবে সারা রাত।
খালপাড়ের
বাও টয়লেটটার পাশে সোঁদা দুর্গন্ধ আর অন্ধকারে মোড়ানো জায়গাটাতে মাকুকে ঠিক দেখা
যাচ্ছিল না। বাসি পেচ্ছাব আর বৃষ্টির তাজা জলে ভেজা পচা
পাতার ওপরেই মাকুর শরীরটা পড়ে ছিল।
পিচ
রাস্তার জমা জল শুকিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। একটু পরেই ভোর হবে।
আলো
ফুটতেই মাকুকে দেখে রঘুনাথের খটকা লাগল। ওর ঘরের পেছনই তো বায়ো- টয়লেট। মাকু কেমন মুখ
হাঁ করে পড়ে আছে। শ্বাস কিন্তু চলছে। ওর শরীরটা ধরে বার কয়েক ঝাঁকুনি দিল
রঘুনাথ। কপালে হাত দিয়ে বুঝল মাকুর গা বেশ গরম।
গোঙানির একটা হাল্কা শব্দও কান খাড়া করলে শোনা যাচ্ছে। রঘুনাথ ভয় পেল । হাজার রাগ থাকুক ও বেটির বাপ। ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে।
ক্লাবের পেছনে ছোট একটি বাড়িতে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার থাকে। বস্তিপাড়ায় সে কেলাবের
ডাক্তার নামে পরিচিত। কেলাবের ডাক্তার এসে মাকুর নাড়ি দেখল। বলল, শরীরে তো একদম
রক্ত নাই গো। এনিমিয়া এনিমিয়া। পেটের অবস্থাও তো ভালো না । ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আর ওকে মাংস ফাংস খাওয়াও।
সবুজ শাক সবজি কলা আপেল এসব একটু খাওয়াও। তবে তো রক্ত হবে।
মাকু
চোখ খুলেছে । চোখ আটকে আছে ওর নিজেরই হাতে। ওখানে একটা মশা। মশাটার পেটে অনির্বাণের
মেয়ের গালের তাজা রক্ত। মাকুর চোখের কোণায় শুকনো লঙ্কার রংটা
এখন আরও অনেক বেশি গাঢ়। গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মারল এক চাটি। মশাটা থেঁতলে গেল। পেট ফেটে রক্ত ছিটকে বেরিয়েছে হাতের ওপর।
জিভটা
বার করল মাকু। সবটুকু চেটে নিল।
3 মন্তব্যসমূহ
চারবার পড়েছি গল্পটা,গল্পপাঠের সৌজন্যে আবার পড়লাম।অসম্ভব ভাল একটি গল্প।যেমন ভাষার শৈলী, তেমনি গল্পকারের চোখ।
উত্তরমুছুনDurdanto detailing! Aro lekha hok "maku"-der nie...
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো লেখাটি। সুন্দর বর্ণনা। শুধু পরম্পরা কেন নাম হল? সেকি "মাকুর গা বেশ গরম" - মাকুর শেষ অসুখের জন্য? যা তার মায়ের মত? নাকি মাকু সব পরম্পরার হিসাব উলটে দিতে চলেছে বলে? লেখক এ বিষয়ে আলোকপাত করলে পাঠক হিসাবে খুব সুবিধে হয়। আমার বোঝার কিছু ভুল থাকলে মার্জনা করবেন।
উত্তরমুছুন