বাজারে যুতসই জুতো নেই; প্রচন্ড শীতে পা ভিজবেনা, বাতাস ঢুকবেনা, আঙ্গুলগুলো উষ্ণতায় ভরে থাকবে, এমন জুতো। এলডো, ফুট লকার, নাইকি,
সব দোকান ঘোরাঘুরি শেষ। দোকানীরা বললো,
শীতের সব জুতো তুলে নিয়েছে। এদিকে পুরনোটার তলা খসে পড়েছে। পাশের বাড়ির সবিতাদি বললো; ‘আরে ভাই কী কিনবে বলো? সবকিছুরই চারগুণ দাম। ফিফটি পারসেন্ট ছাড় বললেই হলো? শালারা বদমাশ। অরিজিনাল দামেই বিকিয়ে নিচ্ছে।’
এসব শুনেটুনে মনটাই কেমন দমে গেছিল শিউলীর। তারপরও আবার নতুন উদ্যমে বাজারে বেরুল। ডাক্তার বলেছে একা একা বাড়িতে বেশীক্ষণ থাকা যাবেনা। এ দোকান সে দোকান ঘুরে টুরে শেষমেশ ‘সফট ম্যকে’ গিয়ে আটকে গেল চোখ। বে...শ পছন্দ হলো একজোড়া বাদামী জুতো। জেনুইন লেদার,
ফ্লিচে মোড়ানো তল,
আর ওয়াটারপ্রুফ! পা গলে গিয়ে আরামে ঝিমুবে।
কিন্তু একি! একটানা তাকিয়ে থাকতে দেখে ওরা যেন হা হা করে হাসতে শুরু করেছে...। বাতাস আসছে কি করিডোর দিয়ে? ফিতেগুলো নড়ছেনা? ওমা!
ওরা হাসছে কেন! মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল শিউলীর।
কদিন ধরেই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাচ্ছে সে। সবিতাদির চাপেই মামুন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল। তিনবেলা অসুধও খাচ্ছে। কিন্তু জুতোর হেসে ওঠাটা দেখে কেমন যেন অপ্রস্তুত আর বিব্রত বোধ করল শিউলী। এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো, কেউ দেখে ফেললো কিনা। একরকম হাঁপাতে হাঁপাতেই বাড়ী ফিরেছিল সেদিন। মামুনকে জুতোর গল্পটা বলতেই হেসে উড়িয়ে দিল সে। ‘এসব কেউ বলে? যত্তসব গুলমারা কথা!
হতে পারে ওটা অসুধের রিয়েকশন। ডাক্তারকে বলে নতুন প্রেসক্রিপশন লিখিয়ে নিও’।
ডাক্তার শিবপ্রসাদ রায় বাঙালী কমিউনিটিতে বেশ নাম করেছেন। শিউলীর ঘন ঘন সমস্যা দেখা দেয়ায় জরুরী ডাকে সময় দিতে হল আজ। মামুনকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ড.শিবপ্রসাদ চেম্বারে ঢুকে গেলেন। শিউলী তখন জানালার ধারে সোফায় বসে বাগানের বদলে যাওয়া দেখছিল। মনে হলো কেউ প্রশ্ন করছে; ‘ক’দিন ধরে এই কুকুরগুলো দেখছো?’
চমকে গিয়ে উত্তর দিল; ক’দিন? হঠাৎ কিছুই মনে পড়ছিলনা শিউলীর। তবু মুখে বললো, ‘প্রায় ছ’মাস হবে...সময়টা ঠিক মনে নেই...’
‘ঠিক আছে,
অসুবিধা নেই। তা কি করে ওরা?’
‘বেরুলেই দৌঁড়ে দৌঁড়ে ধাওয়া করে। মনে হয় পেছন থেকে কামড়ে ধরবে...’ বলার সময় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল ওকে।
‘স্বামীকে বলোনি?’
‘বলেছিলাম, বিশ্বাস করেনি। বলেছে,
গুল মারছি..... জিজ্ঞেস করেছিল;
আমাদের বংশে কোন পাগল টাগল আছে নাকি...আমি তখন আন্নার গল্প করেছিলাম। একটা অন্যরকম মানুষের গল্প। লোকটা পাগল নয়। অথচ সবাই ওকে পাগল বলে ঠাট্টা করতো। আমার কোন কথাই বিশ্বাস করে না মামুন। সেদিন জুতোর কথা বললাম। হেসেই উড়িয়ে দিল’।
....ডাক্তার ঠোঁট দুটোতে একটু হাসি দিয়ে বললেন,‘তোমার কি মনে হয়? জুতোগুলো সত্যিই কথা বলতে পারে?’
মুহুর্তেই শিউলীর চোখে ভেসে ওঠে ফুপুবাড়ির সেই পুকুরঘাট। বড়ই গাছের কাঁটা,
পাড় ঘেষা সারি সারি কলাগাছ। জলে ভাসা মাগুর মাছ,
উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে সে;
‘আচ্ছা বলুনতো,
পৃথিবীর সব মানুষ জুতো পায়ে হাঁটে কেন?
দু ফিতের স্যান্ডেল,
চকচকে বুট, ... এদেশে কিন্তু কেউ খালি পায়ে নেই। তাইনা?
বলে শিউলী মৃদু হাসে। সাদাসিদে চেহারায় ওর ভাসা ভাসা চোখগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে।
‘এদেশে নেই কারণ এখানে শীত বেশী। কিন্তু অন্য দেশে কি নেই?’
‘আছে। রসুলপুরে আছে। আন্নার পায়ে জুতো ছিলনা। কিন্তু রিজিয়া বেগমের পায়ে খড়ম ছিল। মাঝরাতে সেই খড়ম খট খট বাজতো। উঠোন জুড়ে শীমগাছগুলো কান পেতে সেই শব্দ শুনতো, জোনাকী পোকারা আলো মেলে দিতো উঠোনে, আর ধূসর বাদামী আর লালচে-হলুদ রঙের রাতচরা পাখি অন্ধকারে বাজপাখির মত ছোঁ মেরে মেরে উড়ন্ত পতঙ্গগুলোকে গিলে খেতো...ওদের সাই সাই উড়ার শব্দে রিজিয়া বেগম থেমে যেতেন...;
খট...খট...খট...
‘রিজিয়া বেগম’ কে?
‘আমার ফুপুআম্মা’
‘আর,আন্না?’
‘ফুপুআম্মার ফুট ফরমায়েশ খাটা সেই লোকটা। কী যে কুচকুচে কালো ছিল দেখতে!’ ওর একটা কুকুর ছিল। সরাইল কুকুর। সবাই বলতো সরাইলের দেওয়ান সাহেব হাতির পিঠে চড়ে শিকারে যাচ্ছিলেন। সাথে ছিল দেশী জাতের মাদী কুকুর। জঙ্গলে শিকারের সময় কুকুরটা হারিয়ে যায়। আবার কিছুদিন পর গর্ভাবস্থায় ফিরে আসে। এ কুকুরটি তারই বংশধর। আন্না অন্তত তাই বিশ্বাস করতো।
‘ও’..
বলে প্রসঙ্গে ফিরে আসেন ডাক্তার।
‘তুমি যে কুকুরগুলোর দেখো সেগুলোর সাথে কি এই সরাইল কুকুরের মিল আছে?
‘না, এগুলো আরো বড়,
হিংস্র’
‘শোন মেয়ে,
এসবই আসলে ডিপ্রেশন। কনফিডেন্সের অভাব। তুমি বুঝতে পারছো শিউলী?
কী ভীষণ নেগেটিভ চিন্তা করছো তুমি?
এটা কিন্তু করা যাবেনা। ঘুম হয় ঠিক ঠিক?
সারাদিন বাড়িতে একা থাকো বুঝি? আচ্ছা,
তুমি কাজ করোনা কেন? কিছুতো একটা করতে পারো। এদেশেতো কেউ বসে থাকেনা’।
‘কাজতো করতেই চাই, কিন্তু মামুন বলে আমি নাকি কিছু করতে পারবোনা। ইংরেজীটা আমার ঠিক অনর্গল আসে না’।
‘সে তো অনেকেরই আসেনা। তাই বলে কি তারা কাজ করছেনা?’
‘মামুন চায়না। ও চায় আমাদের আগে একটা বাচ্চা হোক।’
‘ও,আচ্ছা। তোমার কি আর কোন প্রবল্যাম আছে? আই মিন, ফিজিক্যাল? ’
‘জ্বী না।’
‘তা... মামুন সাহেব কাজ থেকে ফেরেন কখন’?
‘ভোর পাঁচটায়। তখনই আমার ঘুম ভাঙ্গে’।
‘রাতে কাজ করে আর ভোর বেলায় বাড়ি ফিরে তোমার ঘুম ভাঙায়?
আমি কি ঠিক বলছি?’
‘হ্যা।’
‘তাতে কি তোমার খারাপ লাগে ?’
শিউলী চুপ করে থাকে। শক্ত হয়ে যায় চেহারাটা
। কিন্তু কিছু বলেনা। জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘরটা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকে। বাইরে ঝিরঝির বরফ পড়ছে...ঐযে মিস স্টিফেন্সন ই,এস,এল,
ক্লাসে গানটা শুনিয়েছিলেন,
‘আকাশটা ছিল মাটি আর মাটিটা আকাশ’...সেই গানটি কানের মধ্যে বাজতে থাকে...ডাক্তার রেডিও চ্যানেলটা ঘুরিয়ে দেন। খবরে বলছে কাল ঝড় হবে। বরফ ঝড়।
শিউলীর খুব ইচ্ছে ছিল, আবার পড়তে যাবে। বিদেশের ইস্কুলগুলো নাকি অন্যরকম হয়। ছবি আঁকার খুব শখ ছিল ওর। গ্রামের ইস্কুলে সেসব শখটখ বেড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। মামুন বলেছে ছবি এঁকে কি হবে? ‘আরলি চাইল্ডহুড এডুকেটর’ প্রোগ্রামে ভর্তি হলে ডে-কেয়ারে চাকরীর অভাব হবেনা। আর তাছাড়া বাড়িতে বসেও বাচ্চাদের দেখাশুনা করলে ম্যালা টাকা পাওয়া যায়। মামুনের বুদ্ধিতেই ‘ই-এস-এল’ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ভালো লাগেনি বলে ছেড়েও দিয়েছে। মামুন নাইট ডিউটি শেষে দিনের বেলা একা ঘুমোতে চায় না। বউ ঘরে থাকতে হবে। একথা সকলকে বলতে লজ্জা হয় শিউলীর, এমনকি ডাক্তারকে বলতেও কেমন নির্লজ্জ্ব লাগে। কিন্তু কি যেন হোল আজ। অকপটে বলে ফেললো সব।
ডাক্তার নির্লিপ্ত ভংগীতে জানালার পর্দাটা আরো খুলে দিলেন। দুজনেই চুপচাপ।
তারপর আবারও প্রশ্ন
করলেন, ‘তুমি কি সত্যিই মা হতে চাও?’
খুব শান্ত আর স্থির গলায় উত্তর দেয় শিউলী, ‘জানিনা’...।
‘কেন? একটা বাচ্চা হলে তোমার ভাল লাগতো, না?’
হেয়ালী সুরে বলে শিউলী; ‘কী জানি!’। ওর বলাতে এমন একটা একাকীত্বের ছাপ ছিল যে এরপর ডাক্তার আর কোন প্রশ্ন করেন না। অসুধ লিখে দিলেন তিনি। তারপর মামুনকে ডেকে বললেন; ‘একটু বাইরে থেকে ঘুরে টুরে আসুন,
মশাই। বিদেশে নতুন এসেছে, মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখছেন না মোটেই। সারারাত আপনি কাজে থাকলে মেয়েটা কি করে বলুনতো? কাজ করতে দিলেতো পারেন,ও ভাল থাকবে’।
মামুন মনে করার চেষ্টা করে;
শিউলী বলেছিল, ‘শোনো, ফুট লকারে না সেল দিয়েছে। একটা জুতো আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে’। স্ত্রীর এসব বাড়াবাড়ি ভালো লাগেনি তখন। বিরক্ত হয়েই বলেছিল, ‘জুতোতো আছেই। কয় জোড়া জুতো লাগে তোমার?
মাসে মাসে জুতো। সারাদিন সব উদ্ভট চিন্তা! একার কামাইয়ে এত শখ কি মেটানো যায়?
এসব বাদ দিয়ে নামাজ পড়’। শিউলী ঠিক বুঝতে পারেনি,
জুতোর সাথে নামাজের কি সম্পর্ক!
মামুন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে
দিন দিন। বড় বড় ডিগ্রী থাকার পরও ভালো কোন চাকরী জোটাতে পারেনি বলে তার হতাশার শেষ নেই। সিকিউরিটি গার্ডের নাইট শিফটের চাকরীটাই দীর্ঘদিন ধরে করছে। ভোরবেলা বাড়ি ফিরে সব রকম উত্তেজনা শেষ হয়ে গেলেই ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমোয়
সে। শিউলীর দিকে ঠিক মতন তাকাবার সময় নেই তার। কথায় কথায় খিটমিট করে আর ধর্মীয় উপদেশ দেয়। মামুনকে এখন আর মানুষ মনে হয় না। মনে হয়,
আস্ত একটা শয়তান আল্লার নামে উপদেশ দিচ্ছে। আর সেদিন নিয়ে এলো একটা বিশাল মসজিদ আঁকা ইসলামিক আজান ক্লক। একদম সঠিক সময়ে আজান দেয়। গভীর ঘুমের
নিমগ্নতাকে শাষন করে বেজে ওঠে ...‘আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম...আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম...ঘুম থেকে নামাজ উত্তম,ঘুম থেকে নামাজ উত্তম।.....
লুকিয়ে লুকিয়ে ঘড়িটা পাশের ঘরের ওয়ারড্রোবে আটকে রেখে এসেছিল শিউলী। আজান শুনলেই কেমন ভয় হয়। মনে হয় হিংস্র কুকুরগুলো আবার কামড়াতে আসবে। সারারাত দুঃস্বপ্নে কাটবে....বুকের ভেতর হীম হয়ে জমে থাকবে আরবী শব্দমালা। অথচ আগে কখনো এমন হয়নি। ফুপু আম্মাওতো নামাজ পড়তেন। তাঁর কন্ঠে নামাজের সুরা কত যে মধুর লাগতো!
২.
চারদিকে সাদা বরফ। রাস্তার দুপাশে বরফের স্তুপ। পা পিছলে পড়ার আশংকা বেশ। সব ভয়কে তুচ্ছ করে বাইরে যাচ্ছে শিউলী। জলের বৃষ্টির সাথে বরফ বৃষ্টির কত তফাত! অতীতটা স্পষ্ট মনে পড়ে শিউলীর। রসুলপুরের সেই বৃষ্টিটা ছিল উদোম,
একেবারে অন্যরকম। হঠাৎ হঠাৎ সজোরে বাতাস গায়ে ধাক্কা দিতো, আর ভিজে চুপচুপে হয়ে উঠোনে ছি-বুড়ি খেলতো ওরা। তারপর পাটশলার ডগা দিয়ে কোনোমতে কানে ঢিবি দিয়ে পুকুরে ঝাপ।
ফুপুর বাড়ীর পুকুর পাড়ে ছিল জল ছুঁই ছুঁই বিশাল একটা বড়ই গাছ। বড়ইগুলো ভারী টক আর বাইল্যা। জিভে দিলে যেন সুজির দানা গলে পড়তো। কাঁটা ভর্তি গাছের ডাল ধরে ঝাকুনি দিলে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টির মতন বড়ই পড়তো। মাথায়,
কানে, শরীরে সেই শব্দ ঝিনঝিন বাজতো। আন্নাভাই দিনের অর্ধেকটা সময় এই পুকুর পাড়েই বসে থাকতো। ওর পাতিলের তলার মতন কালো মুখ কেউ দেখতে চাইতোনা। সবাই তাকে ঘেন্না করতো ,আর কাজেও নিতোনা
কেউ। আন্নাকে শিউলী্র ঘেন্না লাগতোনা কখনো। ফুপুও কোনদিন তাকে দূর দূর করেননি। বরং উনি তাকে নিয়ম করে খেতে দিতেন। বদলে আন্না টুকটাক ফুট-ফরমায়েশ খাটতো আর সরাইল কুকুর সাথে নিয়ে শিউলীকে পাহারা দিতো।
আমন ধানের বাড়ন্ত সময়েও চারদিকে যখন এত কাজের ভীড় তখনও আন্নারই কোনো কাজ নেই। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো পুকুর পাড়ে। পাহারা দিতো রিজিয়া বেগমের ঝোপঝাড় ভরা বিশাল বাড়ি আর পুকু্র। কড়া নির্দেশ, মেয়ের পায়ে যেন কাঁটা না ফোঁটে, কানে যেন জল না ঢোকে। অর্ধেক জলে ডুবে শিউলী চিৎকার করে ডাকতো;
‘আন্নাভাই,
ও আন্নাভাই, কতক্ষণ বইস্যা থাকবা?
যাও, হিদল ভর্তা দিয়া ভাত খায়া আসোগা। ফুপুআম্মা ভাত বসাইসে।’ আন্না এক ফোঁটা না নড়েই চিৎকার করে উত্তর দিতো; ‘আফনি উইট্টা আসুইনযে আম্মাজান,
জুতা ফরুইনযে, হেরফরে যাইতাম পারবাম। বড় আম্মা কল্লা কাট্টাইলত্যনা নাইলে।’ আন্নার ঐ কালো ঠোট গলে ‘আম্মাজান’ শব্দটা
মধুতে আর মায়াতে মাখামাখি হয়ে যেত।
বাদামী এক জোড়া প্লাস্টিকের জুতো পুকুর পাড়ে জ্বলজ্বল করছিল। রঙটা ম্যারম্যারে বলে কোনদিন ভাল লাগতো না শিউলীর। কিন্তু ঐ মূহুর্তে রোদের ছ’টায় বাদামী রঙটা যেন ঘোলা গুড়ের মতন গলে পড়ছিল। ফিতের উপর ফোঁটা ফোঁটা জল সূর্যের আলোয় চিকচিক করছিল। পাশে চিত হয়ে শুয়ে থাকা আন্নাভাইকে যতই অন্যমনস্ক দেখাক না কেন, জলের দাপাদাপিতে পিছলে পড়া জুতোগুলোকে খপ করে ধরে ফেলছিল সে। যেন কিছুতেই শিউলীর জুতো হারিয়ে ফেলা যাবে না। ঘর সংসার কিচ্ছু নেই
লোকটার! পুকুর পাড়ের স্যাঁতসেঁতে মাটিটাকেই আকঁড়ে পড়ে থাকে সে। রিজিয়া মা জননীর ঋণ এ জীবনে শোধ হবেনা তাঁর। কত মায়া মানুষের!
মাটির মায়া, সম্পর্কের মায়া।
শিউলীর কোন কথাই শুনছিলোনা আন্না। পুকুরের অন্য ধারে কচু ক্ষেত। প্যাচপ্যাচে কাঁদায় সেখানে হাঁসদল ছুটছিল। পুটলী আর শিউলী,
দুই বান্ধবী, কলাগাছের ভেলায় উঠছিল আর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল জলে। কত আর বয়স হবে ওদের!
বড়জোর দশ! শিউলী চিৎকার করে চোখ রাঙিয়ে বলেছিল ‘আন্নাভাই, জুতা ফরতাম না,
তুমি যাও, ওইগুলান লয়া যাও।’ আন্না রাগে গজ গজ করতে করতে জুতো জোড়া ফেলে রেখেই উঠে চলে গিয়েছিল। যেন এক্ষুনি রিজিয়া বেগম কে অভিযোগ করতে হবে। ঠিক তখনই কাদার গর্তে ডুবে যেতে যেতে ভেসে উঠেছিল এক পাটি জুতো। আরেকটা বিচ্ছিন্ন শ্যাওলার সাথে জড়িয়ে ভেসে গিয়েছিল জলে।
এক ক্রুশ থেকে আরেক ক্রুশ
করে ফুপুআম্মা নানা রঙের শব্দ বুনতেন; আর
মাঝে মাঝে রাগ করতেন শিউলীর উপরে, বলতেন,‘এইযে সারাদিন টো টো করিস,
কি হবেরে তোর?
‘স্বামীর বাড়ীতে রাঁধতে হবে, রান্নাটা শেখ...। আদব কায়দা শিখতে হবে,
নামাজটা পড়... সুরাটা মুখস্ত কর... পাটশাক, কচুর লতি, শিমকুচি ভাজি, ছোটমাছের চর্চরী, ঘুঘু পাখি, রুই মাছ, করলা ভাজি; যা পাস, তাই খা...; অভ্যাস করতে হবেরে মেয়ে...।’ কী খায়নি শিউলী। তেতো গলা দিয়ে নামতো না তাও গিলে খেতে হতো। পাটশালার দাউ দাউ আগুনে সব
রান্না জ্বলে পুড়ে খাঁটি হতো। জীবনটা তেমনই খাঁটি ছিল তখন।
৩.
পুটুলিকে একটা চিঠি লেখা দরকার। ওর হাতের লেখাটা লতানো নরম,
লাউ ডগার মতন। অল্প আঘাতেই ছিড়ে যায়। শব্দগুলো তাই যত্ন করে পড়তে হয়। ডাক্তার বলেছিল নিয়মিত ডায়রী লিখলে মন ভাল থাকবে। যা মনে আসে তাই লিখতে হবে, এত ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন নেই। বিষন্নতার কথা,
কোণায় পড়ে থাকা জীবনের কথা,
যা খুশী...কিন্তু আসলেই কি সব কথা লেখা যায়?
কত কথা অলিখিত থেকে যায়। সেসব মনে করতে করতেই পুটুলির ফোন আসে।
কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন করে সে,‘শুনলাম তুই নাকি হাত পুড়িয়েছিস? এই নিয়ে ক’বার পুড়ালি বলতো?
‘ন’বার’।
‘যা ভাল লাগেনা তা জোর করে করিস কেন’?
‘জোর করিনি। তীব্র বাতাস এসে বললো,
‘করো’। তোর মনে আছে, বাতাস আমাদের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যেত? ‘ঠিক তেমনি,
আগুনটা এসে শরীরে লাগলো। পুড়ে গেল’!
‘কাজ করছিস না কেন? ওদেশে কি কাজ নেই?
‘করছিনা না, ও চায় আমি বাড়িতেই থাকি......বাচ্চা ফোটাই...’
‘কি সব বলছিস,
বিদেশে কেউ আবার এমন চায় নাকি? তুই তোর ফুপুর মতন হয়েছিস। জাবর কাটছিস’।
‘তা কাটছি। কি করবো? কেউ শোনেনা পুটু...তুইও শুনছিসনা!
‘কি জানি, বাবা। তোর ফুপা-ফুপুওতো সন্তানহীন ছিলেন। কিন্তু তোকে কী ভাবে যত্ন করে পালতেন,
সেটাতো দেখেছিস?’
‘কিন্তু ফুপু কতবার চুলোয় হাত পুড়িয়েছিলেন, সেটা জানিস?’
‘তোরতো ওভেন আছে। কোথায় মাটির চুলা আর কোথায় ওভেন। তোর মনটা কোথায় ছিল,
বলতো?
‘আকাশে উড়ছিল।...সেকারনেই হাত পুড়ে,
মন পুড়ে ছাই’।
‘তোর মাথায় গোলমাল হয়েছে নাকি? কি সব আবোল তাবোল বকছিস!’
‘গোলমাল কেন হবে?
তবে ওসব ছবি দেখলে কেমন যেন বমি বমি ভাব হয়। পেটে বাচ্চা নেই,
তাও বমিটা এসেই যায়...। জানিস এ বাড়ীর কম্পিউটারটা খুললেই ওসব ছবি পপ আপ করে’।
‘বিদেশ থাকিস, এখনো ওগুলো ধরছিস?
তুইনা একটা গাধা। পুরুষমানুষ একটু আধটু এরকম হয়। এত সব ধরলে চলে?’
‘কিচ্ছু ধরিনি। কিন্তু ভয় করে পুটু... বাচ্চা না হলে মামুন হয়তো মরেই যাবে...’
‘তোর সত্যিই মাথাটা গ্যাছে। এত যে ডাক্তার দ্যাখালি,
কি ফল হলো,
বলতো?’
৪.
মামুন আর শিউলী সংসার করে।
ডিমচাঁদ ভার হয়ে ঝুলে থাকে। কথামালার লাল-নীল সুর এলোমেলো উড়তে থাকে,
শিউলী ভক ভক বমি করে...
মামুন নামাজে বসে কলেমা পড়ে।
শিউলী ভেলায় চড়ে পুকুরে ভাসে,
মামুন সুরা ইখলাস বারবার পড়তে পড়তে থেমে যায়।
শিউলী কচুরীপানায় গুণে গুণে বড়ইয়ের বিচি ফেলে,
মামুন আত্তাহিয়াদু তরজমা করে বাতাসে ফুঁ দেয়।
শিউলী এক পাটি বাদামী জুতো ভেসে যেতে দেখে থমকে তাকায়,
3 মন্তব্যসমূহ
'কচুরীপানায় গুণে গুণে একজন বড়ইয়ের বিচি ফেলেবে, আরেকজন 'আত্তাহিয়াদু' তরজমা করে বাতাসে ফুঁ দেবে; একজন এক পাটি বাদামী জুতো ভেসে যেতে দেখে থমকে তাকাবে ... তারপর বাতাসে সাতসুরে উড়ে যাবে কলেমার বাহার।'- অনুচ্চারিত দ্বন্দ্বময় এক জীবনযাপন; অথচ, কি অদ্ভুত সমান্তরালে বয়ে যাচ্ছে। গল্পটা যেন পড়লাম না; শুনলাম, ভায়োলিনের অচেনা সুরে। অসাধারণ!
উত্তরমুছুনগল্পটি পড়ে ভাল লাগল।
উত্তরমুছুনহুম!! এক দমে পড়লাম!! একদম ভিন্ন রকমের একটা গল্প পড়লাম -কবহুদিন পর!!! গল্পের ভেতরের বর্ণনা খুবই নিঁখুত!!! সত্যিই শিউলীর জন্য খুব খারাপ লাগছে!!! তার অতীতটাই ভাল ছিল!!!
উত্তরমুছুন