নভেরা। ভাস্কর নভেরা আহমেদ। সূর্যের সুপার নোভা’র মত যিনি এসেছিলেন এক অলৌকিক আলো হাতে। লড়াইটা চালিয়ে গেলে যিনি হতে পারতেন বাংলার সিমোন দ্য বোভোয়ার। জীবন সম্পর্কে যিনি বলেছিলেন 'আই হ্যাভ নট ফেইলড সো ফার ইন লাইফ, পারহ্যাপস নেভার উইল।' মৃত্যু সম্পর্কে নির্বিকার উদাসীন ছিলেন নভেরা। তিনি বলতেন 'যেখানে জীবন শেষ, বাঁচা শেষ,সেখানেই মৃত্যু।' ---
গ্রেটা গার্বো বা ইনগ্রিড বার্গ্ম্যানের চোখ যাকে বলে দিত 'জীবনের পরিনতি আছে ট্রাজেডিতে।' আর তাই বোধ করি এই বোহেমিয়ান নক্ষত্র শহীদ মিনারের প্রথম স্থপতি, ভাস্কর নভেরা আহমেদ বেছে নিয়েছিলেন চুড়ান্ত অভিমানী এক নির্জন জীবন। তুলেছিলেন আড়ালের দেয়াল।
যদ্দুর মনে পড়ে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ এর দিকে প্রথিতযশা লেখক হাসনাত আবদুল হাই এর লেখা 'নভেরা' প্রথমে আনন্দ বিচিত্রা ও পরে বই আকারে বের হলে, সাথে সাথেই আমি তা পড়ে ফেলি। ঘোরলাগা এক মুগ্ধতা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। ওঁর দ্রোহে, প্রেমে, ভালোবাসায়, প্রজ্ঞায়, দৃঢ়তায়, দীপ্ত হই আমি। পাশাপাশি অপমানে, অবিচারে, প্রতারনায়, শঠতায় স্তব্ধ নভেরার বেদনাগুলো এর অভিমানী সন্ধ্যা হয়ে এসে আঁধার ছড়িয়ে দিয়েছে মনে। যখনি কোন ভাল বই পড়ি, সে বইয়ের সকল চরিত্রের সাথে এমন একাত্ম হয়ে উঠি যেন সেই মানুষজন, ঘরবাড়ী, আকাশ বাতাস, সবার সাথে একাত্ম। যেন নিখিলের সাথে আমি একাত্ম। বই পড়া শেষ করে তাই গাড়ী নিয়ে ছুটে গেছি পরিচয়ের সূত্র ধরে পুরানো এয়ারপোর্ট রোডে, র্যাংসের রউফ চৌধূরীর বাড়ীতে। দেখে এসেছি নভেরার করা কিছু ভাস্কর্য। ছুটে গেছি শহিদ মিনারে, সেখানে বসে থেকে অপলক চেয়ে চেয়ে ভেবেছি সেই ১৯৫২ – ৫৩র কথা। পরদিন গেছি জাতীয় যাদুঘরে, পাবলিক লাইব্রেরীতে চোখ দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছি না দেখা এক রহস্য ঘেরা মানবীকে।
'নভেরা' তে এক নিঃশ্বাসে পড়েছি অসামান্যা এই মানুষটির কথা। একটি একটি করে পাতা উলটে গেছি আর এই ঘুনে ধরা অন্ধকার সমাজের প্রতি আমার সমস্ত হৃদয়ভরা অভ্রভেদী দ্রোহ নিয়ে জ্বলে উঠেছি। কখন কখন বা ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়, সমবেদনায় জড়িয়ে ধরেছি সেই দুর্লভ মানবীকে। এই সেই নারী, যিনি ১৯৩০ এর দিকে জন্ম নিয়েও কেবল নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে পেরেছিলেন। তাঁর শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তা তাঁর জীবনাচরনে এনে দিয়েছিল প্রচলিত সমাজ ভাঙ্গার বিপ্লব। কাস্তে, কোদাল, হাতুড়ি, ছেনী তাঁর হাতেই ছিল।
নভেরা বেড়ে উঠেছেন কোলকাতা, কুমিল্লা ,ও চট্টগ্রামে। শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হিসেবে মুক্ত মনে আত্মমর্যাদা নিয়ে বড় হয়েছিলেন আর তার ভেতরকার স্বাধীন চেতনা তাঁকে সমুন্নত মস্তকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সকল বিপরীত স্রোতের সামনে।
১৯৪৫ এর পরে পড়াশুনা করেছেন লন্ডন, ফ্লোরেন্স, ভিয়েনা সহ নানান দেশে। পরিচিত হয়েছেন এবং কাজ করেছেন অসাধারন সব পন্ডিত, শিল্পী ও ভাস্করের সাথে। তিনি অনেক পশ্চিমা আধুনিক সেলিব্রিটি ভাস্করের কাছে পেয়েছিলেন শিল্পের প্রতি অনুরাগ ও উৎসাহ। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বৃটিশ ভাস্কর Jacob Epstein চেকোস্লোভাকিয়ার Karel Vogel, ফ্লোরেন্স ও ভিয়েনাতে Venturino Venturi আর তার প্রেরনার বড় উৎস ছিলেন Henry Moore.
বাংলাদেশে নভেরাকে চিনতেন, নভেরার গুণমুগ্ধ ছিলেন, বন্ধু ছিলেন যারা তাদের অনেকেই আজ আর নেই আমাদের মাঝে, তবু তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই স্বনামধন্য, কিংবদন্তীতূল্য। ভাস্কর হামিদুর রহমান, নাট্যজন অধ্যাপক সাঈদ আহমদ, খান আতা, কবি শামসুর রাহমান, নাজির আহমেদ, আমিনুল ইসলাম, মূর্তজা বশির, জয়নুল আবেদিন, সুচরিত চৌধূরী, মাহবুব, আহমেদুল কবির, কবির চৌধূরী এবং আরো অনেকেই।
১৯৯৫ -৯৬ এর দিকে বাংলাদেশে নির্বাচন শেষ হয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করেছে। দেশে আনন্দধারা বইছে। সেই সময়ে শিল্পী হিসেবে, মানুষ হিসেবে নানাবিধ কারনে তখন বড় মনকষ্টের সময় গেছে আমার। ঠিক যেমন ভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম তেমন্টি কিছুতেই হচ্ছিল না। একটি জানা বা জানাতে চাইনা এমন, শিরোনামহীন কষ্ট আর বুকভরা অভিমান নিয়ে ভাবছি দেশ ছেড়ে যাব। ভাবছি জানা অজানা আত্মীয় বন্ধু, পরিবার পরিজন সব ছেড়ে চলে যাব, ছেড়ে যাব আমার ঢাকা, ছেড়ে যাব ক্রিসেন্ট লেকের জল, আকাশ আলো করা কৃষ্ণচূড়া, শান্তিনগর, বেইলি রোড, ছেড়ে যাব মহিলা সমিতি,পুরানো ঢাকা, বই মেলা, শহিদ মিনার। বুকের ভেতর এমনতর যাই যাই হারানোর সুর বেজে চলেছে যখন, তখন বৈশাখের এক দুপুরে শিল্পকলা একাডেমীতে বসে আছি অধ্যাপক সাঈদ আহম্মদ এর রুমে। অধ্যাপক সাঈদ আহমদ ছিলেন ভাস্কর হামিদুর রহমানের আপন ভাই। ওনারা ছিলেন অনেক গুলো ভাই। বইতে এতোবছর আগে যা পড়েছিলাম, অস্পষ্ট মনে পড়ছে ওনাদের বাসা ছিল সম্ভবত পুরানো ঢাকার আশেক লেন বা আওলাদ হোসেন রোডের দিকে। সেখানে নভেরা আর হামিদ এসে ছিলেন। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে কাজ কর্ম শুরু করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিছু কিছু কাজ তখন কমিশনের ভিত্তিতে করলেও ঠিক যেভাবে নভেরা চেয়েছিলেন তা হয় নি। তিনি চেয়েছিলেন আর্ট কলেজে একটি আলাদা বিভাগ খুলে পড়াবেন। কিন্তু নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় সেটাও সম্ভব হয় নি।
সেদিন সাঈদ আহমদের মুখে শুনছি নভেরার কথা। আর প্রচন্ড কৌতুহলে জানতে চাইছি হামিদুর রহমান, সাঈদ আহম্মদের মায়ের কথা। যিনি সেই সময়ের পুরান ঢাকার সমাজকে তোয়াক্কা না করে দৃঢ়তার সাথে ছেলে ভাস্কর হামিদ ও নভেরাকে একসাথে থাকতে দিয়েছিলেন। নভেরার স্লিভ্লেস ব্লাউস পরা , বা হামিদের সাথে একত্র বসবাস করা বা স্বাধীনচেতা ওই মেয়েটিকে মেনে নিতে সেই ১৯৪৫-৫০ সালে যে মায়ের এতটুকু দ্বিধা হয় নি। অসাধারন এই মায়ের সংস্কারমুক্ত মনে কোনো প্রশ্ন আনেনি। আমার ইচ্ছে হয়েছিল কেবল নভেরা নয়, সাঈদ আহম্মদ বা হামিদূর রহমানের মায়ের পায়েও মাথা ঠেকাই।
ওনাদের মা আজ আর নেই তবু কথা ছিল সাঈদ আহম্মদ ভাইয়ের সাথে একদিন যাব ওনাদের পুরানো ঢাকার বাড়ী দেখতে।সে আর হয়নি আমার নিজের দেশ ছাড়ার কারনে।
কিন্তু কত জনাকে যে বলেছি এই অসাধারন বইটি পড়তে। কত আত্মীয় স্বজনকে বলেছি তাদের বাচ্চাদেরকে ছোট্টবেলায় মাটির পুতুল বানানো শেখাতে যেমনটি শেখাতেন নভেরার মা নভেরাকে। যাতে মাটি থেকে শুরু হয় স্কাল্পচারের প্রতি ভালোবাসা। কত বাচ্চাকে নাম দিতে চেয়েছি নভেরা। আর সেই যে ১৯৫৯ -৬০ সালের দিকে সে দেশান্তরী হল কাউকে আর জানালো না তাঁর অভিমান,সেই বেদনায় কত না রাত কেঁদেছি আমিও। আমারো দেশান্তরী হবার পেছনে সেই রকম একটা অভিমান কাজ করেনি কি! আমিও কি দেশ ছাড়ার আগে নভেরা পড়িনি!
আজ সেই পলাতকা, আজ সেই আলো হাতে আঁধারের যাত্রী চলে গেলেন চিরঅন্ধকারে। গেলো বছর প্যারিসে আইফেল টাওয়ারের সামনে থেকে দিনের শেষে, চন্দ্রালোকে সেই নৌকা বা বাতোমুশ ভ্রমনের সময় মনে মনে বলিনি কি নভেরার নাম! পারিসের দিন গুলোতে আমার দু' চোখ কত বার যে খুঁজেছে তাঁকে। আজ কেবল মনে হচ্ছে ওরা যারা ‘আলোহাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি
– তুমি কি তাদের মত সত্য নও!’
লুতফুন নাহার লতা
গল্পকার, অনুবাদক, অভিনয় ও আবৃত্তি শিল্পী
1 মন্তব্যসমূহ
ভালো লাগল অনেক.....
উত্তরমুছুন