চাঁদের নগর, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, সোপান, ২০১৮, ১৭০/-টাকা
যাযাবর পাখিদের রূপকথা; সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমা, জানুয়ারি ২০১৮, ১৫০ টাকা
--------------------------------------------------------------------------------------------------
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

।।১।।
চাঁদের নগর—চন্দননগর। সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘চাঁদের নগর’ উপন্যাসটি বিন্যস্ত করেছেন চন্দননগরের প্রেক্ষাপটে। চন্দননগর এই উপন্যাসে শুধু প্রেক্ষাপট হিসেবেই থাকেনি। প্রাচীন এই শহরটি তার সমস্ত নিজস্বতা নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। যেকোনো শহরের একটি ইতিহাস থাকে। বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ঐতিহ্য থাকে। চন্দননগরেরও আছে ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর স্বাধীনতার আগেও যেমন ছিল দেশের অন্যান্য প্রাচীন শহরগুলির তুলনায় স্বতন্ত্র, তেমনি স্বাধীনতার পরেও। উল্লেখ করা যেতে পারে ইংরেজ কলোনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতালাভ আর ফরাসি কলোনি চন্দননগরের স্বাধীনতা প্রাপ্তি এক নয়। সমগ্র ভারতবর্ষ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন হলেও চন্দননগর স্বাধীন হয়েছে তার অনেকটা পরে। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটিকে সর্বাণী বিশ্বস্তভাবে তুলে ধরেছেন এই আখ্যানে।
চন্দননগরের গা ঘেঁসে পূর্ব দিকে বয়ে গেছে গঙ্গা। পশ্চিমে সরস্বতী। যদিও এক সময়ের প্রবল স্রোতস্বিনী সরস্বতীর অস্তিত্ব প্রায় নেই। চন্দননগরে কত কত প্রাচীন ঘাট রয়েছে। প্রাচীন মন্দির, মসনিদ, গির্জা... এসব নিয়েই শহরের বিন্যাস। উপন্যাসে এই অনুষঙ্গগুলি গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। বিশেষ করে গঙ্গার ঘাটের প্রসঙ্গ। এই উপন্যাসের বিনোদ রিটায়ারের পর গঙ্গার ঘাট সংস্কারের কাজে মেতেছেন। নানান রকম পৌরাণিক আখ্যানের মূর্তি তৈরি করে ঘাটে স্থাপন করেন। পরে তাঁর কাজে সঙ্গী হয় স্থানীয় লোকজন। কর্পোরেশনও।
আবার ভূপেনবাবু রিটায়ার্ড অধ্যাপক। অবসর জীবনে তিনি চন্দননগরের ইতিহাসচর্চা করেন। চন্দননগরের প্রাচীন ইতিহাস রচনায় মগ্ন এখন। এই চরিত্রটির সূত্রেই আখ্যানে এসেছে শহরটির ঐতিহ্য ও ইতিকথা। তাঁর ডায়েরি থেকেই সর্বাণী তুলে ধরেছেন নানান প্রসঙ্গ—“চন্দননগরের গঙ্গা নদীর তীরটি দূর হইতে লক্ষ করিলে অর্ধাচন্দ্রাকৃতি বলিয়া বোধ হয়। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ওই নদীর তীর বরাবর নির্মিত হইয়াছে ‘স্ট্র্যান্ড’। শব্দগত অর্থে ‘স্ট্র্যান্ড’ বলিতে বুঝায় নদীর তীর বা সাগরের তীর। পণ্ডিচেরিতে বঙ্গোপসাগরের তটভূমিতেও ফরাসিরা স্ট্র্যান্ড নির্মাণ করে। দুটি স্ট্র্যান্ড প্রায় একইভাবে নির্মিত। শুধুমাত্র দুটির স্থাপত্য দেখিলে ফরাসিদের রুচি সম্বন্ধে শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। ১৭৮৯ সালের চোদ্দোই জুলাই ফরাসি বিপ্লবের সময় চন্দননগরেও বিদ্রোহ ঘটিয়াছিল...”। এরকম অনেক অজানা ঐতিহাসিক তথ্য পাঠক জানতে পারবেন আলোচ্য উপন্যাস পাঠে। আর এগুলিকে শুধু চন্দননগরের ইতিহাস বলা ঠিক হবে না। এতো আমাদের দেশের ইতিহাসও।
শুধু ভূপেনবাবু নয়, অন্যান্য চরিত্রগুলিও কোনও না কোনও ভাবে এই শহরের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। উপন্যাসের কাহিনিকে চন্দননগর প্রভাবিত করেছে।
সুগত সুজাতার প্রেম, দাম্পত্য খুব সুন্দরভাবে এসেছে। সুগতর স্ত্রী অমিতার বন্ধু ও সহকর্মী ছিল সুজাতা। কম বয়সে বাবা মারা যায়। তারপর মা ও অসুস্থ ভাইকে নিয়েই সময় কেটেছে তার। অমিতার মৃত্যু পর্যন্ত সে পাশে ছিল। পরে সুগতর উৎসাহে সুগতকে বিয়ে করে। তা নিয়ে সুজাতার স্কুলের সহকর্মীদের অপমান, অসহযোগিতা প্রসঙ্গে সমাজের বাস্তব চেহারাটাকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লেখিকা। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও যে কত রকম সংকীর্ণতা থাকে!
ভূপেনবাবুর বাবা-মা হারা নাতনি টিয়া আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রায় একাই সে প্রমোটারের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। ধীরে ধীরে তার পাশ থেকে লোকজন সরে গেছে। প্রমোটার তাকে অপহরণ করে খুন করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি তাকে উদ্ধার করা যায়। এই ছটফটে তরুণীটিকে সহজে ভোলা যায় না।
শুধু ফরাসি কলোনি রূপে নয়, এখানকার স্ট্র্যান্ড, ফ্ল্যাট কালচার, প্রমোটারদের বেপরোয়া ক্ষমতা, পরিবেশ আন্দোলন, রাজনীতি... সব, সবই গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে আখ্যানে। পরিবেশবাদী আন্দোলনকে প্রমোটাররা কীভাবে ধ্বংস করে দেয়, তা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।
এতো শুধু আর একটি শহরের কথা নয়। প্রতিটি শহরেই এখন প্রমোটার, দূষণ, মাস্তানরাজ, রাজনীতি... ইত্যাদির স্বরূপ কমবেশি একই। সর্বাণী চন্দননগরকে পটভূমি করলেও বৃহত্তর বাংলার শহরগুলির আলো-আঁধারি বৈশিষ্ট্যগুলিকে অসামান্য পর্যবেক্ষণে, পরম যত্নে তুলে ধরেছেন। তাই শেষ পর্যন্ত এই কাহিনি চন্দননগরেই আটকে থাকে না। এই শহরের পাশাপাশি অন্যান্য শহরের মানুষদের যাপনের কথকতা হয়ে যায়।
।।২।।

লন্ডন, প্যারিস, মিউনিখ, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ভেনিস, রোম, ইটালি, জার্মানী, বার্লিন...। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরে ঘুরেছে তারা। কাহিনিও ঘুরেছে। পাঠকও। মাদাম তুসোর মিউজিয়াম, প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়াম, সারোভাস্কি ক্রিস্টাল মিউজিয়াম, ইংলিশ চ্যানেল, টিটলিস, পিসা টাওয়ার, ভাটিক্যান সিটি...। প্রত্যেকেই একই জিনিসকে দেখেছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে। ফলে পাঠকেরাও জায়গাটি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা করে নিতে পারেন। প্রতিটি পরিবার ও চরিত্রের ভাবনা অনুযায়ী বিন্যস্ত হয়েছে উপন্যাস। প্রতিটি অধ্যায়ে একেকটি পরিবারের কথা এসেছে। তাদের ভাবনায় বর্ণিত হয়েছে আখ্যান।
এই দলে বাঙালিদের সংখ্যাই বেশি। প্রতিটি মানুষের বয়স, পেশা, মেজাজ, রুচি সম্পূর্ণ আলাদা। সমস্যাও আলাদা। বেড়াতে গেলেও স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমস্যা, অনুভুতি, স্মৃতি কোনও কিছুই পিছু ছাড়ে না। পিছু ছাড়ে না অসুস্থতা। এই সমস্ত চেনা অনুষঙ্গ অচেনা জায়গায় কতটা প্রকট হয়ে ওঠে লেখিকা তা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। যেহেতু একই পরিবারের একাধিক সদস্য একসঙ্গে বেড়াতে গেছে তাদের মধ্যে মনকষাকষিও হয়েছে। অনেকগুলো দিনের ভ্রমণে দাম্পত্য সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক স্বরূপটিও উঠে এসেছে। আমরা প্রতিদিনই অতি যত্নে কোনও কোনও গভীর গোপন কথা অন্যের থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোপনীয়তা বৃথা চেষ্টা মাত্র। দাম্পত্যকে আপাত সুখী ও সুন্দর করে তোলার জন্য এই চেষ্টা যেমন, তেমনি জেনেও না জানার ভান করে থাকার মধ্যেও একই উদ্দেশ্য আছে। এই উপন্যাসে বিষয়টি চমৎকার ভাবে এসেছে। বিদেশের মাটিতে, এক চরম সংকটময় অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী নতুনভাবে নিজেদের আবিষ্কার করেছে। ফটোগ্রাফার সৌরভ আর তার স্ত্রী মীনার সম্পর্কের মধ্যে যে গোপনীয়তার পর্দা ছিল তা উঠে গেছে।
বেড়াতে এসে একসঙ্গে থাকতে থাকতে কেউ কেউ নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে। ডাক্তার সাগ্নিকের সঙ্গে ডাকসাইটে সুন্দরী, রুপোলী পর্দার অভিনেত্রী উর্মিমালার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এখানেই। উর্মিমালা জীবনের চাপা বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে নতুন জীবনে পা দিতে প্রস্তুত সে।
আবার কেউবা ইউরোপিয়ান ড্রাইভারের সঙ্গে সাময়িকভাবে শরীরী সম্পর্কেও জড়িয়েছে। এই সমস্ত কিছু নিয়েই আখ্যানে চরিত্রদের উপস্থিতি। মনে রাখতে হবে প্রাসঙ্গিকভাবে বিদেশি চরিত্ররা এলেও উপন্যাসের প্রধান চরিত্ররা সকলে কলকাতার।
চেনা জায়গা থেকে দূরে গেলে নিজেকেও কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখা যায়। অন্য পরিবেশে নিজেদের সমস্যাগুলোকে বোধ হয় আলাদাভাবে চিহ্নিতও করা যায়। পিছনে ফেলে আসা বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতির অনুষঙ্গে চরিত্রদের অতীত সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। লেখিকা মুনশিয়ানার সঙ্গে এই কাজটি করেছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত তা উপন্যাসের গোত্রচ্যুত হয়ে কেবল ট্রাভেলগ হয়ে থাকেনি।
একই আবহে প্রতিমুহুর্তে কাটানো চরিত্রগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এখানে। প্রত্যেকের পৃথক সমস্যা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন লেখিকা। আলাদা করে কোনও চরিত্র বা পরিবারকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। সেই অর্থে কাউকে কেন্দ্রীয় চরিত্রও বলা যাবে না। কেন্দ্রে আছে সমগ্র দলটি। যাযাবর পাখিদের মতো যারা ঘুরে বেড়িয়েছে। দলে থেকেও প্রত্যেকে একা এবং একক। উপন্যাসের এটাই মূল সুর। বিদেশের বিভিন্ন জায়গা যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মানুষগুলো। এই দুইয়ের চমৎকার সম্মেলন এই আখ্যান।
পরিচিতি
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
0 মন্তব্যসমূহ