এখানে একটাই আসমান, এই আসমানের নিচে একটাই গ্রাম, যাকে লাউডগার মতো পেঁচিয়ে ধরেছে দুই পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দুইটা নদী, যার বুকের উপর দিয়ে গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইন, যাকে বলে ‘লক্কর-ঝক্কর মোমিসিং আইতে-যাইতে ঢাকা দিন’, তার পাশে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকে একটা মাঠ, মাঠের মাঝখাটের প্রাচীর, প্রাচীরের বুক ঘেঁষে ক্যাঁত ক্যাঁত করে কয়েকটি বাঁশ।
এই বাঁশগুলো দেখে লোকজন বলে, ‘শালার এইরকম রাস্তার পাশে এইরকম সমান মাঠে কেউ উবাঁশঝাড় লাগায় নাকি !’ অবশ্য তাদের অনেকে অনেক কিছু জানে না, জানে না যে, এই বাঁশগুলো আসলে পুঁথি তসরের হৃদয় থেকে ওঠে এসেছে, জানে না যে, রাতের বেলা এই পথ দিয়ে গেলে বাঁশ থেকে রক্তের ফোঁটা পড়ে অথবা ঝুরঝুরা মাটি পড়ে, হাতে, পায়ে, চোখে, মুখে, মাথায়।
এই বাঁশগুলোর দুইটা এক সাথে গজিয়েছে, তার পরের বছর আরো দুইটা। পুঁথি তসরের হৃদয় থেকে এক এক করে এই চারটা বাঁশ গজানোর পরে নতুন কোন বাঁশ গজায় নাই। কিন্তু চারটা বাঁশের মধ্যে দুইটা বাঁশ ক্যাওড়াক্যাওড়ি করে উঁচু হয়ে আছে। এই দুইটার মধ্যে একটার খোঁজ পাওয়া যায় ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে। আরেকটার খোঁজ পাওয়া যায় ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে।
কিন্তু কয়েকদিন যাবত পুঁথি তসরের হৃদয়ে জোঁকের মতো লেগে থাকা বাঁশগুলো সরিয়ে ফেলার পায়াতারা চলছে, তবে একটা ভয় খাব্লা দিয়ে ধরে, নাকে-মুখে-মগজে। ছয় ছেলে তোড়জোড় শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত কারো সাহসে ধরে না। কারণ, একদিন এক নিশুতি রাতে এক পাশে ঘুমিয়ে থাকা বামন বাঁশটা কাটার জন্য যায় পাতাইল্লা। বউকে রান্না ঘর বানিয়ে দেয়ার জন্য একটা বাঁশের দরকার ছিলো তার। তাই তাকে নিশুতি রাতে পা টিপে টিপে হাঁটু সমান ঘাসের বুক চিরে যেতে হয়। এইরকম ভয়ের পরিবেশকে আরো ভয়ময় করে চারদিকে থেকে আসা ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। জোনাকিরা উড়াউড়ি করে আউলাঝাউলা হয়ে। আঁধারের উপর আঁধার, তার উপর আঁধার। এই আঁধার রাতে নিজেকেই আজর আজর লাগে তার। নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখা যায় না। মনে হয় পথ ঘুমিয়ে আছে, গাছ ঘুমিয়ে আছে, আসমান ঘুমিয়ে আছে, বামন বাঁশটাও মৃতের মতো ঘুমিয়ে আছে। এই ঘুমন্ত সময়ে পাতাইল্লা বাঁশটাকে ধরার সাথে সাথে বাঁশটা সজাগ হয়ে যায় যেন, আর সাথে সাথে ঝুরঝুর করে মাটি পড়তে থাকে তার মাথার উপর। তার সাথে উত্তর থেকে দমবন্ধ বাতাস আসে, হাত পা শীতল হয়ে আসে, নাকে আসে আগরবাতির ঘ্রাণ। পুঁথি তসরের নাক থেকে শিস আসে যেন। পাতাইল্লা আর নড়তে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। মনে হয় তার বুকের মধ্যে পাহাড়ের মতো একটা কালো ছায়া বসে তার নাকে-মুখে বিরাট এক জিহ্বা দিয়ে চাটছে। আর পরের দিন সকালে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। তার নাক মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। বাড়িতে তিন দিন কাব্দা লেগে পরে থাকার পরেও জ্ঞান আর ফিরে আসে না। তাকে গোসল করানোর সময় দুইটা সাবান খরচ করেও শরীর থেকে ফেনা ফেনা ভাব উঠানো যায় না।
এই মৃত্যুর পরে পুঁথি তসরের কবরের পাশ দিয়ে যেতে চায় না কেউ। অবশ্য পুঁথি তসর মরে যাবার আগে আঁধার ঘরে পড়ে ছিলো মাসের পর মাস। তখন হাঁপাতে হাঁপাতে তার জান বের হয়ে যায় যায় অবস্থা ছিলো। বউতো মরে গেছে কবেই, তাই এই অসুস্থ শরীর নিয়ে শেষ বয়সে একা একা সময় কাটে না। পশ্চিমের ঘরে পড়ে থাকে তার বেগুনপোড়া দেহখানা, ঘরের আনাচেকানাচে আঁধার আর আঁধার। তার সাথে ৩ গর্ত বাতারি ইঁদুর, ১ কলস তেলাপোকা, ৪ কোণা কুনোব্যাঙ আর ১ চাল টিকটিকি। এইসব সঙ্গী-সাথীর সাথে নিশুতি রাতে কাশতে কাশতে কুঁকড়া হয়ে ছেলেদের ডাকে, কিন্তু ছেলেদের বউদের গায়ে খাব্লায়া ধরে চুতরাপাতা : বুইড়ার প্যাঁচালে বাড়িতে থাকা যায় না, মরার রাইতবিরাইতে বুকের মইধ্যে ঠাডা পড়ছে ক্যায়া?
সত্যিই তো, শালার বুড়ো মরে না কেন? এতো মানুষ মরে প্রতিদিন, অথচ এই বুড়োটা যেন মরবে না। যে বুড়োর জমি আছে ২১ বিঘা সেই বুড়ো একটা আঁধার ঘরে শুয়ে মরণের সাথে পাশা খেলে। শালার মরণ এমন চাল দেয় একেকটা। তবু পাশা খেলা জমে বেশ। সে এতিমের মতো আল্লাহ্র দিকে চেয়ে থাকে আর কাউকে কাছে পেলে বিলাপ পারে : বাবা আমি মইরা গ্যালে তোমরা আমারে মানিকের ভিডায় কব্বর দিয়ো; রাস্তা দিয়া মানুষ যাইবো আর আমার জন্য দুআ করবো; এই হেয়ালকুত্তারা আমার কথা হুনে না; আমারে ডাক্তরের কাছে নিয়া যায় না; আমারে খাওন দ্যায় না; আমি এই হেয়াল-কুত্তা জন্ম দিয়া ভুল করছি।
এই আব্দার শুনে শ্রোতার মনে আসে পুঁথি তসরের পুঁথির কথাটা, ‘বয়স কালে হয় জুত; নয়তো পুত।’ পুঁথি তসর বয়স কালে জুত ও পুত দুইটাই কামাই করেছে। তবু তাকে থাকতে হয় ইঁদুর-ফিদুরের সাথে, সাপ-ব্যাঙের সাথে। তবু তাকে মুতের উপর ঘুমাতে হয়, গুয়ের উপর পড়ে থাকতে হয়।
অবশ্য গু-মুত পরিষ্কার করার জন্য নাতনি হেলেনা আসলে সে বলে : এই হেলু তরে আমি মানিকের ভিডা কাউলা কইরা দেম; বোইন তুমি আমার দিকে একটু চাও।
হেলেনা পুঁথি তসরের কথা শুনে মিটমিট করে হাসে আর বলে : আর কবে দিবা বুইড়া? তোমার এক পাওতো কব্বরে গ্যাছেগা।
পুঁথি তসর ঝিম মেরে থাকে; হঠাৎ করে বলে ওঠে : তুই আমারে ছিরিপুর লইয়া যাইতে পারবি? তরে আমি সব লেইখ্যা দেহালবাম।
অবশ্য শ্রীপুর যাবার আগেই যায় কবরে, কিন্তু মরে যাবার আগেই গণ্যমান্য ব্যক্তিকে বলে গেছে, সে মরে গেলে তার কবর যেনো রাস্তার পাশের মাঠে দেয়া হয়। তাই ৯১ বছর বয়সে পুঁথি তসর মরে যাবার সময় তার ৬ ছেলে অনেক চেষ্টা করেও উত্তরের ভিটাতে কবর দিতে পারে নাই।
রাস্তার পাশে এতো দামি জমিতে কবর দেয়ার জন্যে ৬ ভাইয়ের ভেতরে জ্বলে। তারা অবশ্য অনেক ফন্দিফিকির করে। কিন্তু সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তির এক কথা এক জবান : এই নুরু হুন, তোর বাপ মইরা যাইবার আগেই কইয়া গ্যাছে আমরা য্যানো মানিকের ভিডায় তারে কব্বর দেই; তা তুই ভালো কইরাই জানস; বাপের শ্যাষ ইচ্ছা পূরণ করবার চাস না; ক্যামন পুতাইন হইছস তোরা? খালি জায়গাডাই চিনলি; বেডা কি কম থোইয়া গ্যাছে? সমাজের মানুষ হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হইলো তোর বাপকে এই জায়গায় কব্বর দেওয়া।
এই কথা শুনার পরে ছেলে নুরুর কী আর করার থাকে? তাই রাস্তার পাশে সমান জমিতে একটা বুড়োর লাশ কবর দিয়ে মজা পায় অনেকে। কিন্তু ৬ ছেলের কলিজার মধ্যে খেজুর কাঁটা বিঁধে যেনো। যে জায়গাটা নেয়ার জন্য ঢাকায়ারা এক পায়ে খাড়া, যে জায়গাটা বিক্রি করে মাটির ঘর ভেঙে ৬ ভাইয়ে বিল্ডিং দিতে পারে, বুড়ো মরে যাবার পরে সেই জায়গাটার সব ঠিকঠাক করে দিতে কয় দিন আর লাগতো? কিন্তু এই অবস্থায় কবরসহ জমি বেচে দিলে সমাজের মানুষ আটক রাখতে পারে। শালার বুড়ো, মরবি তো মর, কিন্তু রাস্তার পাশে মাঠের মধ্যে তোর কবর নেবার শখ হলো কেন?
হেলেনাও পেলো না মানিকের ভিটাটা। কিন্তু না পাইলে কী হবে; হেলেনার চেত কিন্তু আসমনা সমান; ৬ মাসের মধ্যে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে মায়ের ওয়ারিশি বুঝে নেয়। তার মনে হয়েছে মামাদের কাছ থেকে যতো তাড়াতাড়ি ওয়ারিশি আদায় করা যায় ততোই শান্তি।
হেলেনা মানিকের ভিটা না পেলে কী হবে, ওয়ারিশির জমিতে বাড়ি করে দিব্যি থাকতে থাকে। জামাইয়ের ঘর থেকে ফেরত আসলেও নিজের ছেলেকে নিয়ে দারুণ সময় কাটে তার। পুঁথি তসরের কবরের পাশে মুদি দোকান দেয়, তার দোকানে সালেহা-জুলেখা-মালেকার ছেলেরা এসে বসে; বসে বসে কবরের বাঁশ দেখে আর আলাপ করে। হেলেনাও নানার আলাপ করে, নানা বেঁচে থাকলে মানিকের ভিটা আজ তার থাকতো। তার নানাতো তাকে কতোবার বলেছিলো শ্রীপুর গিয়ে জমিটা লিখে নিতে। সে-ই তো যায় নাই। তাছাড়া নানা বেঁচে থাকলে তাকে এতো কষ্ট করতে হয় নাকি? তার নানার মতো কামেল লোক দুই-চার গ্রামে আছে ! যে ব্যক্তির পুঁথির সুর শুনে পরিরা পর্যন্ত পাগল হয়ে যেতো সেই ব্যক্তির কবর থেকে যে বাঁশগুলো গজিয়েছে তা শুধু ক্যাঁত ক্যাঁত করে।
হেলেনা তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তির ছেলের সাথে মাখামাখি করলে মামিরা নানান কথা তুলে। কিন্তু মামিদের বায়ে ঠ্যাঙেও মানে না সে। নানা আঁধার ঘরের মধ্যে পড়ে থাকার সময় হেলেনাই তো নানার গু-মুত সাফ করে চিড়ার মাড় খাওয়াতো। তখন এসব দেখে মামিরা বলতো : হইছে হইছে আর করুন লাগতো না; আমরা বুঝি আর সেবাযতœ করতে পারি না।
এসব ঠেস মারা কথা শুনে হেলেনা মামিদের সাথে চুলে-বালে লেগে পড়তো। মামিরা তার সাথে পারে নাই কখনো। আর পারবে কেমনে? তার মতো হাতের কব্জি মোটা পায়ের গোছা মোটা মাগির সাথে জোয়ান জোয়ান পোলারাও পারে না !
আর এখনতো সারা দিন শুধু খায়-দায় আর বুক উঁচু করে দুই পা চ্যাগিয়ে মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে : খাইতে পারি না; ক্যামন টাওয়া টাওয়া লাগে।
তুই না খাইলে হাতির মতো শরীর হলো কেমনে? এতো এতো মাছ-মাংস কোথায় যায়? মামিরা তোরে কোন জিনিসটা না দিয়ে খায়? মামিদের তো কিছু দেয়ার নাম নাই। সারা জীবন তুই চ্যাপার ভর্তা দিয়ে খাস নাকি? আর সাথে সাথে পুঁথি তসরের কবরের বাঁশ ক্যাঁত ক্যাঁত করে বলে : সিনাল মাগির বাইল রান্দে মোরগ কয় ডাইল।
মামিরা না চাইলে কী হবে অনেকে দোকানের বেে বসে তার সাথে ডলাডলি করতে চায়। অনেকে ভাবে, হেলেনার শরীর এমন থলথল করে কেন? জামাই ছাড়া মাগি ইঞ্জিন ছাড়া গাড়ীর মতো থুম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? এই মাগি থাকে কেমনে? হাসের বাচ্চার মতো বাচ্চা নিয়ে কেমনে চলে?
এই পরিবেশ-পরিস্থিতিতে হেলেনার মোবাইল নম্বর নিতে চায় অনেকে। অনেকে নম্বর পেয়ে খুশিতে গদো গদো হয়। হেলেনা নাকি সারা রাত ফোনে কথা বলে। তার উপর আবার গণ্যমান্য ব্যক্তির ছেলে ফেইসবুক খুলে দিয়েছে একটা। সেই ফেইসবুকে সে তার ছেলের ছবি আপলোড করে অথবা সারারাত ফেইসবুকিং করে অথবা ভিডিও চ্যাট করে। এবং অল্প দিনের মধ্যে সে চরম মাত্রার ফেইসবুকার হয়ে যায়।
হেলেনার এসব কার্যকলাপ দেখে কিংবা শুনে মামিদের পিত্তি জ্বলে, তারা হেলেনাকে পাত্তা না দেয়ার ভান করলেও ভেতরে ভেতরে যমের মত ভয় পায়। বলা তো যায় না, কার উসিলায় কার কী হয়; মানুষ কী এমনি এমনি বলে নাকি : আগের হাল যেমনে যায় পিছের হালও তেমনেই যায় : ঘরে আছে উপযুক্ত বউ-ঝি। হেলেনার সাথে গেলে যদি ওর মতো জামাইরে কিলায়া বাচ্চাটাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি এসে পড়ে। ওর তো বাপের বাড়ি নাই। মামার বাড়ির ওয়ারিশির জমিতে ঘর বেঁধে থাকে। বাপের বাড়ি থাকলে কী জানি করতো মেয়েটা।
মেয়েটা পুরুষ মানুষের সাথে উঠাবসা করে। অবশ্য কোনো পুরুষ তাকে ইঙ্গিতে কিছু বললে তার শরীরে খাউজানি উঠে : শালার পুরুষ, তুমগর ক্ষ্যামতা যে কতো তা আমি জানি; এই হেলেনার পিছে ঘুইরা দেখো ক্যামন মজা।
আল্লাগো আল্লা, কতো রঙ কতো ঢং জানে এই মাগি। মাগির মাথায় নাই চুল। যে কয়টা ফেপরি চুল আছে তাতে ক্লিপ মেরে জরি ফিতা লাগিয়ে খোঁপা বেঁধে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আর সাথে সাথে কবরের বাঁশ ক্যাঁতক্যাঁত করে বলে : চুল নাই মাগি, চুলের লাগি কান্দে, কলা পাতার ডিব্লা দিয়া ভুইত্যা খোঁপা বান্দে।
কথা ঠিক, হেলেনা ভুইত্যা খোপা বেঁধে গণ্যমান্য ব্যক্তির ছেলের সাথে আলাপ করে। কেন, হেলেনা এমন করে আলাপ করবে কেন? এই ছেলেটা তাকে ফুপু বলে ডাকে না? ছেলেটাকে আব্বা আব্বা করে ডাকতে গেলে ছেলেটাও ফুপি ফুপি করে ঢলে পড়ে। আর সাথে সাথে কবরের বাঁশ ক্যাঁতক্যাঁত করে বলে : হরি হরি করি কাপড়ও তুলি।
কাপড় তুলার সময় কোথায়? দুই দিন ধরে হেলেনা দোকানই খুলে না। কই, হেলেনা কই? হেলেনা নাই। ইহকালেও নাই। পরকালেও নাই। তবে ইহকালের মানুষ তাকে খোঁজে। সাথে সাথে বাঁশ ক্যাঁতক্যাঁত করে বলে : বাডি ভইরা দিছি কুড়া চপচপাইয়া খাইছোরে; ও আমার হাঁসের ছাও রে; ঐ মিয়ারা কে নিছে? হেয়ালে না; কুত্তায় না; মুখপোড়া গুইলেরে; ও আমার হাসের ছাও রে।
দুই দিন পরে পাছা দোলায়া দোলায়া হেলেনা দোকান খুলে আর বলে : অসুখ আছিন; ছিরিপুর হাসপাতালে বর্তি আছিলাম।
তাকে দেখে অসুখে পড়ার মতো লাগে না। তাই সালেহা-জুলেখা-মালেকার ছেলেরা এই কথা বিশ্বাস করে না। তাদের সন্দেহ হয়। তাই তারা গণ্যমান্য ব্যক্তির ছেলের খোঁজ নেয়। সাথে সাথে হেলেনা ঠেলা মেরে বলে : কি মিয়ারা, মুখটারে এরুম কুত্তার পুটকির মতন কইরা রাখছো যে।
এই কথা শুনে কেউ কেউ ভ্যাবাচেকা খেলে সে রাক্ষুসীর মতো হাসে। কিন্তু তার এতো ঠমক দেখার পরেও তাকে দেখার মানুষ বাড়ে। অনেকে এসে খোঁজে; কই, হেলেনা কই? সে তার ছেলেকে কোলে করে আসে না কেন? এসে বুক টানা দিয়ে দাঁড়ায় না কেন? আরে শালা, তার মোবাইল এতো ব্যস্ত থাকে কেন? সারা রাত ফেইসবুকে কী করে সে? তাকে দেখতে না পারার কারণে কারো কারো বুকের ভেতরে গেঁথে ধরে। শালি হেলেনার বাচ্চা হেলেনা; ধরা দিয়েও ধরা দেয় না। তখন কবরের বাঁশ ক্যাঁতক্যাঁত করে বলে : উড়াত দ্যাখাইতে নাই সরম; হেলেনা বিবির এই ধরম।
হেলেনার ধরম যা-ই হোক পুরুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারলে তার বুকের ভেতরে জবর শান্তি লাগে। কিন্তু তার গতর গতর শুনে দোকানে বসা কেউ কেউ দাঁত কিড়মিড় করে কথা বলে। কী বলে? কী আর, তার ঠমক দেখে তারা কবরের দিকে চেয়ে থাকে; সাথে সাথে কবরের বাঁশ ক্যাঁতক্যাঁত করে বলে : আল্লাদিগো ডেপের খই; এতো ঠমক রাখুম কই।
অবশ্য তার ঠমক দেখে অনেকের কলিজার মধ্যে ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে। কিন্তু বাতির আযানের সাথে সাথে দোকান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয় সবাই; কারণ, হেলেনা তার দোকান বন্ধ করে দেয়, আর একটু পরেই শুরু হবে কান্না আর কান্না অথবা কবরের বাঁশগুলো সুর করে বলবে : মিছা কথা; সব মিছা কথা।
রাত নিশুতি হলে শোনা যাবে : ভাত দে, পানি দে।
রাত আরো নিশুতি হলে শোনা যাবে : গা জ্বইল্যা গ্যালো রে, গা জ্বইল্যা গ্যালো।
সেই সাথে আশেপাশে থাকবে আগরবাতির ঘ্রাণ। পাশ দিয়ে কেউ একা গেলে তার মাথার মধ্যে পড়বে ঝুরঝুরা মাটি অথবা হাতের মধ্যে পড়বে রক্ত। ফজরের আযানের আগে আগে শোনা যাবে গোঙানির শব্দ।
এই সময় রাস্তা দিয়ে একা গেলে রক্ষা নাই। চার-পাঁচ জন এক সাথে আগুন, বল্লম, ট্যাডা, লাঠি নিয়ে গেলে কিচ্ছু পাওয়া যায় না। কিন্তু যেই সময় তারা বাড়ির দিকে ফিরে সেই সময় একটা বিড়াল তাদের সামনে দিয়ে দৌড় দেয়। আর সাথে সাথে উত্তরের দিক থেকে আতরের ঘ্রাণ আসে অথবা আগরবাতির ঘ্রাণ আসে।
পাতাইল্লা মরে যাবার পরে চার-পাঁচ জন মানুষেও যাবার সাহস পায় না অথবা যায় না। পুঁথি তসরের কবর ও তার বাঁশগুলোর কথা শুনার পরে রেলের এই পাড় ও রেলের হেই পাড়ের খেলা এই মাঠে হয় না আর। কারণ, ক্রিকেট খেলার বল কবরের দিকে গেলে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না; ফুটবল গেলে তা ফুটা হয়ে যায়। তাই রেলের এই পাড় ও রেলের হেই পাড়ের খেলোয়াড়রা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে খেলে অথবা খেলা ফেলে ফেইসবুকে পড়ে থাকে অথবা এইসব খেলোয়াড়ের মা-বাপেরা এই মাঠে খেলতে নিষেধ করে অথবা তারা তাদের ছেলেদের দামি মোবাইল কিনে দিয়ে ঘরের ভেতরে বন্দি রাখে।
কিন্তু পুঁথি তসরের কবর ও তার বাঁশগুলোর জন্যে এতো ভয় থাকলেও হেলেনা মাঠের সামনে রাস্তার সাইডে মুদির দোকান চালাতে সাহস পায়। অনেক সময় সে নানার গাওয়া পুঁথি গায়। আবার নানার মতো পুঁথি বানায় : পুরুষ মানুষের পিরীতির ধরন কচু পাতার পানি; পিরীতি বুঝে নাতো বুঝে খালি কামখানি; উপরে দিয়া যেমন তেমন ভিতরে যে শয়তানি।
নানা বেঁচে থাকলে তার এই পুঁথি শুনে মাথায় হাত দিয়ে বলতো : গিন্নী হইছে আমার বাপ; পুঁথি হইছে খাপেখাপ।
নানার কথা মনে পড়ে খুব; নানা যৌবন কালে কতো মানুষকে কতোভাবে সাহায্য করেছে; এখনো তাকে নিয়ে রাতে আলাপ উঠলে ঘরের বউ-ঝিরা পর্যন্ত কাঁথার মধ্যে হাগামুতা করে দিতে চায়। এইরকম একটা আজোইরা ব্যাপার নিয়ে নানা বেঁচে থাকলে বিরাট পুঁথি বানাতে পারতো। সংগ্রামের সময় কতো পুঁথি বানিয়েছে সে।
সেই সময় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে পুঁথি বানানোর কথা সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এতে জমির মোল্লা ও তার সহযোগী আরফান উদ্দিন শুনে উত্তেজিত হয়েছিল। তাই পুঁথি তসরের নিস্তার ছিলো না। একদিন তার মনে হয় আজ রাতেই তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। কারণ, সে শুনেছে জমির মোল্লারা জেনে গেছে; তাকে আস্ত রাখবে না ওরা। ওরাতো পাকিস্তানি ভাইদের খেদমতে আছে, খেদমতে না থাকলে কি চলে?
পুঁথি তসরের মতো ভোদাই দেখে নাই ওরা। তুই বেডা পুঁথি গেয়ে বেড়াছ; গা; পুঁথি গেয়ে বেড়া; তরে কে বলছে এইসব পুঁথি বানাতে : এই দ্যাশের কথা আমি করিবো বর্ণন; নরপশু সোনার বাংলা করছে যে তছনছন; হাজার মাইল দূর থেইকা আইছে যে জানোয়ার; মসজিদ মন্দির ইস্কুল ঘর হইছে যে ছারখার; লাঠি মুগর লইয়া তোরা মার পাক শালায়; বাঙ্গালিগর চুরুন খাইয়া বিহারি পালায়; কুত্তার মতন লেছুর পাইরা বাড়ি যাইবি তোরা; রক্ত দিয়া রক্ষা করমু সোনার বাংলা মোরা।
শালা বেকুরের বাচ্চা, এইভাবে বিহারি ভাইদের পুটকির মধ্যে আঙুল দিতে বলছে কে? তাই নিশুতি রাতে পুঁথি তসর বাড়িতে তালাতুলা মেরে মোজাই গাঙের দিকে ছুটে। এক লাফে পড়ে দাঁড়ের মধ্যে। সাথে সাথে মোজাই গাঙ গাঙের মতো উথালপাতাল করে। শালার কূলকিনারা পাওয়া যায় না। তবে এক সময় দাঁড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মোড়লদের ঘাটে ওঠে সে, শাওন মাসের রাতে ঘাটে বসে চিন্তার বস্তা খুলেও কোথায় যাবে বুঝতে পারে না। তবু আল্লাহ্র নাম নিয়ে বিড়ালের মতো লেয়ুর দেয়, লেয়ুর দিতে দিতে সামনে পড়ে লাল সুন্দরীদের বাড়ি।
মোজাই গাঙের এই পাড়ে এখনো বিহারি আসতে পারে নাই। শাওন মাসের পানি ভেঙে বিহারিরা এইখানে ঢুকতে পারে নাই বলে আরাম আরাম লাগে। শালার জমির মোল্লার জন্যে তাকে আজ মওতের মুখে পড়তে হয়েছে। শালা বেইমানের বাচ্চা, দাঁড়া, মুক্তিরা তোকে বেঁধে মোজাই গাঙে ফেলবে। তবে এটাও সত্যি যে, সে যুবকদের পুঁথি শুনিয়ে মুক্তিতে যেতে উসকানি দিতো। যাকে কাছে পেতো তাকেই শুনাতো : কুত্তার মতন লেছুর পাইরা বাড়ি যাইবি তোরা; রক্ত দিয়া রক্ষা করমু সোনার বাংলা মোরা।
সংসারে চার ছেলে ও সুন্দরী বউ থাকা সত্ত্বেও যেখানে সেখানে এইসব পুঁথি পড়তো সে। তার বউ এই পুঁথি শুনে তাকে অনুরোধ করতো এই সময়ে এইসব না করতে, কে জানে কখন কোন বিপদ আসে ! কিন্তু সে কথা শুনতো না, আরো বেশি বেশি পুঁথি বানাতো বলে বউ চিল্লাতো : আল্লাহ্র কিরা; আপনের গীত থামাইন; চাইরটা ছেরা লইয়া আমি কই যাইয়াম? এইতা কতা মাইনষে হুনলে আপনের কল্লা থাকতো না লগে।
বউয়ের ঠাডানির পরেও সে পুঁথি ছাড়েনি কখনো। মোহাম্মদ আব্দুল সামাদরা যখন রেললাইন উঠায়া ফেলায় যখন গাঙের সব পুল ভেঙে ফেলায় যখন গাঙের সব সাঁকো ভেঙে ফেলায় যখন বিলের সব সাঁকো ভেঙে ফেলায় তখন সে-ও তাদের সাথে সাথে ছিলো। আর সাথে সাথে নতুন নতুন পুঁথি বানাতো : নাও ডুবাও কোন্দা ডুবাও ডুবাও সাধের ডিঙ্গি; পাকিস্তানি ধইরা ধইরা দাও না বাঁশের চেঙ্গি; পুল ভাঙ্গো সাঁকু ভাঙ্গো ভাঙ্গো রেলের লোহা; ভুট্টোহিয়ার মাথা ভাঙ্গো ভাঙ্গো লোহার মুহা; মারো ঠ্যালা হেইয়া আরো জোরে হেইয়া; এই ঠ্যালাতে গদি ভাইঙ্গা পড়বো ইয়াহিয়্যা।
এসব করে বেড়ানোর সময় তার পোয়াতি বউ চার ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। তখন সে নিরালা জীবন নিয়ে এক একটা পুঁথি বানায় আর চেঙরা চেঙরা পোলাপানকে মুক্তিতে যাবার রাস্তা দেখায় অথবা মুক্তিদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় অথবা মুক্তিদের জন্য চিড়ামুড়ি নিয়ে যায়।
এভাবে ভয়কে জয় করার স্কুল খুলে সে। কিন্তু সেই পুঁথি তসর মরার পরে তার বুকের মধ্যে বেড়ে উঠা বাঁশগুলোর ভয়ে লোকজন এই পথ দিয়ে যেতে চায় না। তবে সংগ্রামের আগে থেকেই সে এই গ্রাম সেই গ্রাম কতো গ্রামে গিয়ে এইসব পুঁথি পড়ে আসছে তার হিসাব কে রাখে। অবশ্য বই দেখে পুঁথি পড়তে হয় নাই কোন দিন। কবিদের মতো সাথে সাথে পুঁথি বানাতে পারার দুর্দান্ত ক্ষমতা। আর এই কারণেই তার নাম পুঁথি তসর। জীবনে কতো গাঙ কতো বিল কতো খাল পাড়ি দিয়ে পুঁথি পড়তে গেছে, তার হিসাব সে-ই জানে না।
পুঁথি গাওয়া এক মজার কাজ, যার বাড়িতে পুঁথি গাইতে যাও তার বাড়িতে ইদের দিনের মতো নানান পদের রান্না চাই, চায়ের পরে চা চাই, বিড়া বিড়া পান চাই, নানা জাতের জর্দা চাই।
রাত নিশুতি হলে কণ্ঠ বেয়ে নামে মরণ সুর। কারো কারো সুরে আসমান থেকে নেমে আসে পরি। সেই পরি পাগল হয়ে নাচে পুঁথির সুরে সুরে। বউ-ঝিরাও পর্যন্ত পুঁথির সুরে পাগল হয়ে যায়।
অথচ আজ তাকে জমির মোল্লার ভয়ে মোজাই গাঙ পাড়ি দিয়ে মোড়লদের বাড়ি আসতে হলো। এই বাড়িতে গত বছর পুঁথি পড়ে গেছে। সেই সময় এই বাড়ির লাল সুন্দরী তার পুঁথির সুরে মাতাল হয়ে ভাইসাব ভাইসাব করেছে। তাই লাল সুন্দরীর বড়ো ভাইয়ের বউ লাল সুন্দরীকে খেপিয়ে বলেছে : নানিগো নানি; মোজাই গাঙ্গে কি পানি; আমারেনি লইয়া যাইবা ভাইসাবের বাড়ি।
তাকে শাওন মাসের নিশুতি রাতে পেয়ে লাল সুন্দরী আহ্লাদে আটখানা হয়। আনন্দে টুবুটুবু হয়ে তার বাপ কালু মোড়ল বলে : সুন্দরী, ম্যাসাবরে ভাত দে।
মোজাই গাঙের খড়া দিয়ে ধরা চাপিলা মাছের সানের সাথে কড়কড়া ভাত পেয়ে খাব্লায়া খায় সে। খাওয়ার পরে কতো কথাই না হয়। গত বছর পুঁথি গাওয়ার সময় লাল সুন্দরী আসমানের পরিদের মতো নাচতে চেয়েছে।
লাল সুন্দরীর স্বপ্নে আসে এক রাজকুমার, যে রাজকুমার গান গাইতে পারে, পুঁথি পড়তে পারে, মিটমিট করে হেসে তার মাথায় বিণী করে দিতে পারে, তাকে নিয়ে পঙ্খিরাজ ঘোড়াতে চড়ে আসমান-জমিন সব দেখাতে পারে, সেই রাজকুমারের সাথে পুঁথি তসরের খাব্লাখাব্লি মিল। পুঁথি তসরের চাহনির ইশারাতে হাসির ভঙ্গিতে বাবরি চুলের দুলনিতে এক মায়াবি টান অনুভব করে সে।
আজ সেই স্বপ্নের রাজকুমার যেন তার ঘরের বারান্দায় চকিতে শুয়ে থাকে। কারণ, কালু মোড়ল অনেক সাধাসাধি করেও তাকে দুইটা শুয়ার ঘরের একটাতেও শুয়াতে পারে নাই। লাল সুন্দরীর ঘরের সাথে বারন্দায় বেড়া দিয়ে যে ঘরটা আছে তাতে পাতা আছে একটা চকি, এই চকিতে শুয়ে পুঁথি তসর গড়াগড়ি খায়।
দাদার আমলের খাটে শুয়ে লাল সুন্দরীও গড়াগড়ি খায়, তাদের চোখে ঘুম না আসলে লাল সুন্দরী বলে : ভাইসাব গুমাইয়া পড়সুইন? একটা পুঁথি কইতাইন যুদি।
এই মধুর আব্দার শুরে পুঁথি তসরের কলিজাটা ছ্যাৎ করে ওঠে। সে মিনমিন করে বলতে থাকে : আরে জীবন হইলো আজব পাতা; কইবো সেই পাতার কথা; পানি ছাড়া ছাতার মাথা; জমে যখন পানিপাতা পাতায় পাতায়; লরে তখন জীবনপাতা মাথায় মাথায়; ঝরাইয়া নাও আছে যতো জমায় জমায়; আরে শুকাইয়া গ্যালে পানিপাতা; সুখ পান করতে গিয়া পাইবা তুমি ছাতার মাথা; তাইতো শুধাই সকলেরে; সময় থাকতে সময় করো খরচ; ঝরাইয়া নাও আছে যতো জমা ফরজ।
এই পুঁথি শোনার পরে লাল সুন্দরী কিছু বুঝে অথবা বুঝে না। তাই সে জানালার কাছে মুখ এনে বলে : ভাইসাব কিছুইতো বুঝলাম না; কী পুঁথি গাইলাইন।
পুঁথি তসর এইবার মজা পায়। আঁধার রাতে শব্দ না করে মিন মিন করে হাসে। লাল সুন্দরী আরো লাল হয়ে বোল পাল্টায় : গাজিকালুর কিস্সা কইতাইন যুদি ভাইসাব; হুনছি আপনি সুর কইরা অনেক সুন্দর কইরা কিস্সা কইতে পারেন।
বারান্দার চকি থেকে জবাব আসে : কিস্সা যায় কিচকিচাইয়া সতী নারীর ভয় তুমি থাকো ঘরে শুইয়া আমি থাকি বাইরে শুইয়া কিস্সা ক্যামনে হয়।
আসমানে চলে মেঘের মাতম এবং ঘর থেকে জবাব আসে : কিস্সা যায় কিচকিচাইয়া সতী নারীর ভয় তুমি থাকো খাটে শুইয়া আমি থাকি নিচে শুইয়া কিস্সা ক্যামনে হয়।
আসমানে লর লর করে মেঘ এবং খাট থেকে জবাব আসে : কিস্সা যায় কিচকিচাইয়া সতী নারীর ভয় তুমি থাকো ওইদিকে ফিইরা আমি থাকি এই দিকে ফিইরা কিস্সা ক্যামনে হয়।
আসমান চুয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় মেঘ পড়ে এবং ওইদিক থেকে জবাব আসে : কিস্সা যায় কিচকিচাইয়া সতী নারীর ভয় তুমি থাকো নিচে শুইয়া আমি থাকি উপরে শুইয়া কিস্সা ক্যামনে হয়।
নিচ থেকে জবাব আসে এবং আসমান থেকে নামে মেঘের ঢল। ঠা-া হয় পথ-ঘাট-মাঠ সব। মোজাই গাঙে ঢল বয় গাঙের মতো।
এই গাঙের টানেই রেললাইন, তার পাশেই মাঠ, মাঠের নাকের ডগায় পুঁথি তসরের কবর, কবরের বুকে বাঁশ চারটা ক্যাঁত ক্যাঁত করে।
এই কবর ও বাঁশের দিকে চেয়ে বড়ো ছেলে কাতিমায়া কুত্তার মতো জিহ্বা বের করে হাঁপায়। শালার এতো এতো জমি নিয়ে যাচ্ছে পার্টিরা। এই গ্রামের মধ্যে মিল বানাবে, ফ্যাক্টরি বানাবে, এই সুযোগে মানিকের ভিটা বেচতে না পারলে আর বেচা যাবে না, গ্রামের মানুষ অর্ধেক দাম দিয়েও নিবে না, এই কবর ও আজোইরা বাঁশের জন্যে কেউ নিবে না। জায়গাটা বেচতে পারলে বাড়িতে দালান দেয়া যেতো। কিন্তু এইসব কবর এইসব আজোইরা বাঁশ ঢাকায়াদের কাছে কিছুই না।
এইসব চিন্তা করে ৬ ছেলে। তবে কোনো কূলকিনার পায় না। এই কবর ও বাঁশের কথা মনে হলে পাতাইল্লার কথা মনে হলে তাদের গলা শুকিয়ে যায়। কিন্তু এতো টাকাতো পাওয়া যাবে না অন্য কোথাও।
ভয় করলেও ৬ ভাই সিদ্ধান্ত নেয় এই জমি ঢাকায়া পার্টির কাছেই বেচে দিবে। কবর নিয়ে পার্টিরা বলেছে : আপনারা টাকা নিবেন, জমি দিবেন, কবর কোন সমস্যা না, এই চিন্তা আমাদের।
আসলে জমিটা পার্টির খুব পছন্দ হয়েছে। যা একটু ঝামেলা আছে তা হলো এই কবরটা। অবশ্য কবর ও বাঁশ সাফ করা ঢাকায়া পার্টির জন্য এক রাতের ব্যাপার। কতো কবরওয়ালা মাটি দিয়ে ভরে প্লট বানিয়েছে তার শেষ নাই।
হেলেনা গণ্যমান্য ব্যক্তিকে ধরে এই ভিটা বেচার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণ্যমান্য ব্যক্তি বলে : তোর বাপের কব্বরসহ এই ভিডা যদি বেইচ্যা দেস তাইলে ঢাকায়ারা এই কব্বর কি আস্ত রাখবো? এক দিনের মইধ্যে সব মিশায়া দিবো; তোরা যদি কব্বরসহ এই জমি বেইচ্যা দেস তাইলে তোদের ছয় ভাইরে আটক রাখবো সমাজের মাইনষে; বেচতে হইলে কব্বর বাদ দিয়া বেচ।
গণ্যমান্য ব্যক্তির সাথে হেলেনাও লাফ পাড়ে। ৬ ছেলেও কাওলাকাওলি করে। হেলেনাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সিনালডার জায়গামতো ৪ টা বাঁশই ভরে দিতে। শালি মেম্বারের সাথে তাল চুদায়। যে করেই হোক তাদেরকে এই জায়গাটা বেচে দিতে হবে। এতো টাকা দিয়ে এইরকম কবরওয়ালা কেনার লোক দুই চার গ্রামে নাই। তাছাড়া তারা এই জমি দিয়ে কী করবে? কবরের পাশে আজোইরা বাঁশের পাশে না করা যাবে ঘরবাড়ি না করা যাবে কিছু। ঢাকায়াদের কাছে জমিটা ছাড়তে পারলে সব দিক দিয়েই লাভ।
অবস্থা বুঝে ৬ ছেলে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তির বাড়িতে যাওয়া আসা শুরু করে এবং হেলেনারে দেখে নাকসা ফুলিয়ে চেয়ে থাকে। এই যাওয়া আসা বাড়তে থাকলে হেলেনার দিকে চেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে তারা।
অবশেষে গভীর রাতে ঢাকায়ারা কোদাইল্লা লাঙল নিয়ে আসে। কোনো মানুষ জানার আগেই রাতে রাতে সব শেষ করে দেয়।
সকাল বেলা সবাই চেয়ে থাকে, আঁধার রাতে পুঁথি তসরের কবরের বুক থেকে বাঁশগুলো তুলে ফেলা হয়েছে এবং তার কবর মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
তখন হেলেনার দোকান বন্ধ থাকে কেন? তার ঘরে তালা দেয়া থাকে কেন? তবে পরের দিন খবর আসে : ঢাকায়া পার্টিদের মাইক্রোবাস এক্সিডেন্ট করে দুই জন মারা গ্যাছে।
পুঁথি তসরের বাড়ি থেকে বিলাপের শব্দ আসে : বড়ো পুতের ছোট পুত বাড়ির পাশের ডুবাতে পইড়া মইরা গ্যাছে।
ছোট ছেলের বড়ো ছেলে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে রেললাইনে আর সাথে সাথে ইন্টাসিটি ট্রেন তার উপর দিয়ে যায়।
তার পরের দিন আরো ৬ জন মারা যায়। তার পরের দিন ১১ জন মারা যায়। তার পরের দিন ২১ জন। তার পরের দিন ৫২ জন। তার পরের দিন ৭১ জন। তার পরের দিন ৯১ জন।
এভাবে মানুষ মরতেই থাকে।
লেখক পরিচিতি
মেহেদী ধ্রুব
জন্ম. ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯
গাজিপুর, ঢাকা। এখন কর্মসূত্রে সিলেটে থাকেন।
পেশা : শিক্ষকতা।
1 মন্তব্যসমূহ
মেহেদী ভাই বরাবরই ভালো বলেন। এবার তাই আরো দুর্দান্ত হয়েছে লেখা। শুভ কামনা।
উত্তরমুছুন