নাহার তৃণা
উপন্যাসের পাতায় যখন ইতিহাস নেমে আসে পাঠক তখন বাড়তি কিছুর খোরাক পাবেন এমন আশায় বুক বাঁধেন। আর সে উপন্যাসের ব্যাপ্তি যদি হয় 'একাত্তর থেকে পঁচাত্তর' সময়কাল, তবে আগ্রহের পালে লাগে বিপুল হাওয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, অনেক রক্ত অনেক ত্যাগ, অন্তরালের অনেক জটিল সমীকরণের মারপ্যাচ পেরিয়ে আসা এক বাস্তব আখ্যান। একাত্তর পরবর্তী একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের উঠে দাঁড়াবার নিরন্তর প্রাণান্তকর চেষ্টায় বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত ছিল বড়বেশি জটিল আর কুটিল সময়ের ঘূর্ণি।
সে ঘূর্ণির নীলনকশায় দেশ বিদেশের নানান কুশিলবেরা নিজ নিজ স্বার্থের বৃত্তে থেকে স্বাধীনতার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে চেয়েছে। মুছে দিতে চেয়েছে দেশটির কপালের জ্বলজ্বলে নবীন অহংকার। ঠেলে দিতে চেয়েছে সেই তিমির অন্ধকারে, যেখানে থাকবেনা দুর্জয় তর্জনীর সগর্জন উপস্হিতি। থাকবেনা ভুট্টোর চিন্তার কারণ হওয়া 'লিটল নটোরিয়াস ম্যান উইদ দ্য ফাইল' হাতের একজন নিপাট মানুষের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে নিরন্তর যুঝে যাবার ব্যাকুলতা। ষড়যন্ত্রীদের সে চেষ্টা সফলও হয় অনেকাংশে। তাদের ইশারা তামিল করা কিছু ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় বাংলাদেশকে বিশ্বেরবুকে মাথা তুলে দাঁড় করবার যুদ্ধের প্রধান স্হপতি এবং তাঁর চার সহযোদ্ধার জীবন। ইতিহাসের পাতায় সেই কুটিল সময়ের সব ষড়যন্ত্রীর স্পষ্ট মুখ ফুটে না ওঠলেও বাংলাদেশের বুক জুড়ে তৈরি হওয়া অপূরণীয় ক্ষতের ভার আজো সে বহন করে চলেছে। একাত্তর থেকে পঁচাত্তরের সেই ঘূর্ণায়মান সময়কালের ইতিহাস কমবেশি আমাদের জানা। সেই জানা ইতিহাসের আরো অনেক অজানা গল্প, বিশেষত উপন্যাসের মূল চরিত্র তাজউদ্দীন আহমদের কথা অত্যন্ত দক্ষতায় সুহান রিজওয়ান আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর প্রথম মলাটবন্দী উপন্যাস 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' এ।
সে ঘূর্ণির নীলনকশায় দেশ বিদেশের নানান কুশিলবেরা নিজ নিজ স্বার্থের বৃত্তে থেকে স্বাধীনতার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে চেয়েছে। মুছে দিতে চেয়েছে দেশটির কপালের জ্বলজ্বলে নবীন অহংকার। ঠেলে দিতে চেয়েছে সেই তিমির অন্ধকারে, যেখানে থাকবেনা দুর্জয় তর্জনীর সগর্জন উপস্হিতি। থাকবেনা ভুট্টোর চিন্তার কারণ হওয়া 'লিটল নটোরিয়াস ম্যান উইদ দ্য ফাইল' হাতের একজন নিপাট মানুষের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে নিরন্তর যুঝে যাবার ব্যাকুলতা। ষড়যন্ত্রীদের সে চেষ্টা সফলও হয় অনেকাংশে। তাদের ইশারা তামিল করা কিছু ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় বাংলাদেশকে বিশ্বেরবুকে মাথা তুলে দাঁড় করবার যুদ্ধের প্রধান স্হপতি এবং তাঁর চার সহযোদ্ধার জীবন। ইতিহাসের পাতায় সেই কুটিল সময়ের সব ষড়যন্ত্রীর স্পষ্ট মুখ ফুটে না ওঠলেও বাংলাদেশের বুক জুড়ে তৈরি হওয়া অপূরণীয় ক্ষতের ভার আজো সে বহন করে চলেছে। একাত্তর থেকে পঁচাত্তরের সেই ঘূর্ণায়মান সময়কালের ইতিহাস কমবেশি আমাদের জানা। সেই জানা ইতিহাসের আরো অনেক অজানা গল্প, বিশেষত উপন্যাসের মূল চরিত্র তাজউদ্দীন আহমদের কথা অত্যন্ত দক্ষতায় সুহান রিজওয়ান আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর প্রথম মলাটবন্দী উপন্যাস 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' এ।
'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস হলেও এটি কখনই ইতিহাসের বই নয়। তবে এটি উপন্যাস হলেও ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহের ব্যবহার কিংবা বর্ণনায় লেখক যথেষ্ট সৎ থাকবার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে 'কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে আমাদের গৌরবময় ইতিহাসে যেন আঁচড় না পড়ে- সে বিষয়ে ছিলাম সর্বোচ্চ সর্তক' লেখকের এ বক্তব্যের সত্যতা পাঠক পাবেন সন্দেহ নেই। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো হবে(হওয়া উচিৎও)। কিন্তু কেন জানিনা, মুজিবের ছায়া ধরে যে মানুষটি নিরলস হেঁটে গেছেন, একাত্তরের যুদ্ধাবস্হায় ভীষণ জটিল সব পরিস্হিতি প্রায় একা হাতে সামাল দিয়েছেন, তাজউদ্দীন আহমদ নামের সেই মানুষটিকে সেভাবে সামনে আনা হয়নি। অন্তরালের মানুষ হয়েই থেকে গেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। এতটা অবহেলা, এতটা নিঃসঙ্গতা এই মানুষটির পাওনা না হলেও আমরা র্নিলজ্জভাবে তাঁকে অকাতরে তাই দিয়েছি। বিস্মৃতির কৃষ্ণবিবর থেকে নিস্পৃহতার ধুলো সরিয়ে সুহান রিজওয়ান, একজন বিরল মানুষ, যাঁর নাম তাজউদ্দীন আহমদ, তাঁকে আমাদের সামনে অত্যন্ত মমতাভরে উপস্হিত করেছেন। সেজন্য লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চাই।
পূর্ব খণ্ড এবং উত্তর খণ্ড এই দুটি পর্বে গড়িয়েছে 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ'এর আখ্যান। পূর্ব খণ্ড, একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনির অপারেশন সার্চলাইট থেকে শুরু হয়ে বিজয় দিবসে সমাপ্তি। উত্তর খণ্ড, বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরে স্বপরিবারে শেখ মুজিব হত্যা, চার নেতার জেলহত্যা এবং ক্ষমতালোভী মোশতাক ও সেনাবাহিনির কিছু অংশের ক্ষমতা হস্তগতের যুযুৎসু বর্ণনার পরে ইতি ঘটে। দু'খণ্ডের অধ্যায়গুলির সময়কাল আবার বিভিন্ন হৃদয়গ্রাহী শিরোনামে সাজানো। পূর্বখণ্ডের শুরুতে পাঠক স্বাধীন বাংলাদেশের দু'জন প্রতিনিধির প্রাথমিক বিবরণ পড়া শুরু করেন, এখানে লেখক অকপটেই একজন প্রতিনিধি আমীর-উল ইসলামের নাম পরিচয় প্রকাশ করলেও দ্বিতীয় প্রতিনিধিকে যেন একটু আড়ালে রাখেন। যা চরিত্রটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে খুব মানান সই। আজীবন এই চরিত্রটি নিজে আড়ালে থেকে তাঁর প্রিয় মুজিব ভাইকে সামনে রেখে হাঁটতে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেননি। বেতার ঘোষণার আকস্মিক সুযোগে সেনাবাহিনির কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে থাকা জিয়াউর রহমান যেখানে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণায় বিন্দুমাত্র সংকোচ কিংবা দ্বিধা দেখাননা, সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ নামের মানুষটি নিজেকে শেখ মুজিবের ডেপুটি হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করতেন। তাই যখন উসখুস করতে থাকা পাঠকের সামনে 'সীমান্তের সন্ধ্যা'র আড়াল ভেঙে অন্তরালের মানুষটির স্বনামে প্রথম আর্বিভাব ঘটে, "আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একজন প্রতিনিধি মাত্র। আমার নাম তাজউদ্দীন আহমদ।’' তখন আবেগপ্রবণ পাঠকের বুকের কোথাও অনুভূতিতে কোলাহল শুরু হবে, যা গড়াবে বাকিটা সময়ও।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানী আক্রমণের ভয়াবহতার মুখে বাঙালীদের বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ যখন গুড়িয়ে যাচ্ছিল, ফুরিয়ে আসছিল সীমিত শক্তির গোলাবারুদ, তখন ভারতে আশ্রয় নেয়া নেতাকর্মীদের কেউ কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দীর্ঘ এক গেরিলা যুদ্ধের। কেউ জানে না এই যুদ্ধ কতদিন চলবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো দশক পারও হয়ে যেতে পারে। অত দীর্ঘকাল যুদ্ধ চালাবার মতো মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল অনেকেই। সেই অনিশ্চিত দূর্দিনে শেখ মুজিবের প্রিয় ছায়াসঙ্গী তাজউদ্দিন অদ্ভুত এক স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন এবং ভারত সরকারের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর সবটুকুর কৃতিত্ব তাঁর নিজস্ব মেধা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা। সে দক্ষতার পরিচয় শেখ মুজিব পেয়েছিলেন বলেই প্রিয় তাজকে নিজের সেনাপতির পদে অলংকৃত করার সুযোগ দিয়েছিলেন যা অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথেও আলোর মুখ দেখায়। কেমন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ নামের মানুষটি? এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে হলেও পাঠককে দ্বারস্হ হতে হবে 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' এর।
বঙ্গবন্ধুর আরো অনেক সহচরের মাঝে তাজউদ্দিন ছিলেন একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যিনি একটা সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বাকীদের চেয়ে তাঁর জীবনযাপন কতটা আলাদা ছিল, সেটা আমরা বইটির পরতে পরতে পেয়েছি। এখানে ইতিহাস যতটুকু, উপন্যাসও ততটুকু। কোথাও বাড়তি মেদ নেই। সাদাসিদে মানুষটি অতি ব্যতিক্রম বলেই নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমি সংসারজীবন পালন করবো না। অথচ একই কলকাতা শহরের ভিন্ন রাস্তায় তাঁর প্রিয় পরিবার, যাদেরকে এমনকি ঈদের দিনও তিনি সময় দেননা। কেননা তাঁর কর্মমগ্ন চৈতন্যেও সেইসব হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা থাকতেন, যারা পরিবার ছেড়ে কাদামাটি মেখে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রক্ত বিলিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির সূর্যকে ডেকে আনছিল, তিনি তাদের রেখে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবতে পারেন না, ভাবেনওনি। কিংবা সম্পর্কের গর্বে উদ্ধত শেখমণির ঔদ্ধত্যে অপমানিতবোধ করলেও, পরিস্হিতির স্বার্থে নীরবেই হজম করে যান। তাঁর অধীনস্হ আর্দালির অসুস্হতায় নিজেই সেবার হাত বাড়িয়ে দেন। এসব অংশ পড়ে-জেনে, খুব কষ্ট হয়, যখন মনে পড়বে পরের অধ্যায়ে মুজিব ভাই তাঁর এইসব আত্মত্যাগ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেন না, তাঁকে জানতে দেয়া হয়না। এবং না জেনেই তিনি পৃথিবী ত্যাগ করবেন। একজনের অতি আবেগ-ব্যস্ততা, অন্যজনের অতি আত্মসম্মানবোধ-অভিমান, মাঝে কিছু ক্ষমতালোভীর বিষাক্ত কুটকাচালীর কারণে দু'জন সুহৃদের পথ দুটি দিকে বেঁকে গেলো। সেসব নিয়েই তাঁরা চির অজানার পথে পাড়ি দেন। জননী বাংলাদেশের বুকে তার এই দুই সুযোগ্য সন্তানের অধ্যায়টি পাঠক হৃদয়ে ‘বড় বেদনার মত' বেজে যাবে নিরন্তর।
উপন্যাসে, মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে তাজউদ্দীনের ভূমিকার প্রায় সবটুকুই এসেছে বলে জানি। তবে তাঁর শৈশবকে আরেকটু হাত-পা ছড়ানোর সুযোগ দেয়া গেলে মন্দ হতো না। তাজউদ্দিনের যেটুকু ইতিহাসে আসেনি সেটুকু লেখকের কল্পনার অংশ হয়ে এসেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে যা খুব স্বাভাবিক। তথ্যের যথার্থতা রেখে উপন্যাসকে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ববোধ লেখক সুচারুরূপেই পালন করেছেন। লেখক যদিও এটাকে উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করেছেন তবু আমরা এখানে যেটুকু ইতিহাস পাই তাতে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালের জটিল সমীকরণের ধোঁয়াশাগুলো কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। ইতিহাসের ওই সারাংশটুকু বিচার করতে গেলে বাংলাদেশের রাজনীতির কুটিল চরিত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন জাগবে পাঠকের মনে। যে প্রশ্নের উত্তর বইটিতে পাওয়া যাবে না। উপন্যাসে এসব উত্তর খোঁজাও অবান্তর। কিন্তু পাঠক তার নিজস্ব ভাবনার চক্রে ইতিহাসের ওই জটিলতার সমীকরণগুলোকে খেলাতে পারেন। পাঠকের মনে উদ্রেক হওয়া প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আগ্রহী জনেরা সুনিশ্চিতভাবেই দ্বারস্হ হবেন আরো কিছু বইয়ের। যার জন্য 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' ধন্যবাদার্হ।
বইটি পাঠের এক পর্যায়ে পাঠক হিসেবে প্রথমে যে ভাবনাটা আসে, সমগ্র জাতি 'জয় বাংলা' শ্লোগান নিয়ে ঐক্যবদ্ধ বিজয় অর্জন করলেও মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিভক্তির পাগলা ঘোড়া ছুটিয়ে দিল কে? স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী চক্রের যখন মরণদশা, সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রগতিশীল শক্তি কেন বিভক্ত হতে শুরু করলো? যে বিভক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিকে অন্ধ গলিতে ঠেলে দেবে দীর্ঘ সময়ের জন্য।
বলা বাহুল্য, এই বিভক্তির সুত্রপাত যারা করেছিলেন, তাজউদ্দিন তাদের একজন নন। এটা বাংলাদেশের সৌভাগ্য। এটাই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের অন্যতম কারণ। তিনি যদি যুদ্ধকালীন সময়ে সুত্রপাতকৃত সেই বিভক্তির অনুঘটক হতেন তাহলে আজ বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হয়ে যেতো, হয়তো এই স্বাধীনতা পেতে নয় মাসের জায়গায় নয় বছরও লাগতো। সেটা হয়নি, কারণ বঙ্গবন্ধুর এই প্রধান সেনাপতি প্রবল ধৈর্য্যশক্তির পরিচয় দিয়ে, সকল বিরুদ্ধ প্রতিকূলতা সহ্য করে, মুক্তিযুদ্ধের সকল পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টায় প্রাণপণে যুঝে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যে কয়টি প্রতিকূল শক্তি সরকারের ভেতরে ও বাইরে কাজ করেছে আমরা এখন তাদের স্পষ্ট দেখতে পাই। যাদের একদল রাজনীতিবিদ, আরেকদল সেনাবাহিনীর সেক্টর কমাণ্ডারের একাংশ, অন্য একটা দল খোদ মুজিব নগর সরকারের অংশ। রাজনীতিবিদ অংশের মধ্যে শেখ মনি এবং সিরাজুল আলমের দল, আরেকদল জিয়াউর রহমান এবং ডালিম ফারুক গং, অন্য দল মোশতাক আর তাহের ঠাকুর গং। এই তিনটি দল যতটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশী করেছিল মুজিবনগর সরকারের বিপক্ষে, বলা চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। এর মধ্যে শেখ মনি ও সিরাজুল আলমদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও তাজউদ্দীন বিরোধীতার যে বীজ তাঁরা বপন করেছিলেন, তার মূল্য বাংলাদেশকে আরো অনেক রক্ত দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে। যে রক্তদানের অংশীদার হতে হয়েছিল খোদ বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি তৈরী করার সুত্রধর হিসেবে এই মুক্তিযোদ্ধা অংশকে কিছুতে ছাড় দেয়া যায় না। একজন তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি যাবার সুযোগ পাওয়া গেলেও সমগ্র বাংলাদেশকে অরক্ষিত করে ফেলা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের এত বড় সাফল্যের নায়ক তাজউদ্দীনকে মুজিবনগরের পাঁচ বছর পূর্তিতেও যখন আমন্ত্রণ জানাতে দেখি না, তখন এত বছর পরেও বুকের ভেতর খচ করে আঘাত লাগে। সেই আঘাত কতখানি বেজেছিল তাজউদ্দীনের বুকে সেটা আমাদের ধারণারও বাইরে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাজউদ্দীনকে মন্ত্রীসভা থেকে যখন বিদায় করে দেন বঙ্গবন্ধু, তখন আমরা দেখি একজন মহান নেতা তাঁর আত্মরক্ষার অন্যতম একটি বর্ম খুলে রাখলেন। কিন্তু যাঁর শিরস্ত্রাণ খুলে নেয়া হলো, সেসব নিয়ে মানুষটি তখনও নীরব, তখনও তাঁর ভাবনায় প্রাণ প্রিয় মুজিব ভাই এবং বাংলাদেশ, তখনও তিনি বুদ্ধি পরামর্শের হাত গুটিয়ে না নিয়ে প্রসারিতই রেখেছেন। একজন নিঃসঙ্গ তাজউদ্দীনের গল্পের সমান্তরালে 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' শেখ মুজিব নামের আরেক মানুষের নিঃসঙ্গতার গল্পও বলে আমাদের। কেননা বাংলাদেশ-শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন এঁরা প্রায় একই সমান্তরালে উচ্চারিত বলে মনে করি।
যে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর ইশারায় সমগ্র বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষ একত্রিত হয়েছিল, সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই বঙ্গবন্ধুর দিকে যখন ঘাতক বুলেট ছুটে গেল তখন তিনি কী মর্মান্তিক রকমের নিঃসঙ্গ! এই সবকিছুর জন্য নিঃসন্দেহে দায়ী একাত্তরের ওই বিভক্তির কারিগরেরা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবান্তর দলবাজির যে নজির সৃষ্টি হয়েছিল সেই দলবাজির কুশীলবদের আমরা এই বইতে আবিষ্কার করে ক্রুদ্ধ হই। যারা এই বিবাদ বিভক্তির উদ্যোক্তা ছিল তাদের একজন শেখ মনি নিজেও প্রাণ দিলেন ঘাতকের হাতে। যুদ্ধদিনের আরো তিন সারথীর সাথে কারান্তরীণেই প্রাণ দিলেন সেই মানুষটি যিনি সমস্ত মুক্তিযুদ্ধকে বুকের ভেতরে নিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন করেছিলেন, সেই -তাজউদ্দীন আহমদও! তাজউদ্দীন আহমদ, মিথের পাতা থেকে নেমে আসা কোনো চরিত্র নয়। তিনি এই মাটিরই একজন মানুষ, অনন্য সাধারণ এক মানুষ। দরদরিয়া গ্রামে যে মানুষটির জন্ম। যিনি সততার যে বিরল উদাহরণ রেখে গেছেন, রেখে গেছেন শেখ মুজিব কে ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত, তাকে টপকে যাবার সাধ্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। মুকুট নামের মানুষটির শিরস্ত্রাণ খুলে নেয়া সম্ভব, কিন্তু যিনি নিজেই মুকুট তাঁকে মুছে ফেলা সম্ভব কী? বিস্মৃত হলেও তাজউদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা যায় না। তিনি বঙ্গজননীর মুকুট হয়েই থেকে যাবেন চিরকাল তাঁর বুকে, পাঠকের আগ্রহে। এ উপন্যাস সেকথাও প্রমাণ করে, তারই এক প্রামাণ্য দলিল 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ'।
হয়ত অতি মাত্রায় মুগ্ধতা নিয়ে পড়া বলে ভুল ত্রুটি সেভাবে চোখে পড়েনি। তবে যেকথা না বললেই না, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট, বাংলাদেশের সবচে' সুযোগ্য সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড পর্বটি আরেকটু মনোযোগ পাওয়া দরকার ছিল। এ পর্বে তাড়াহুড়োর ছাপ চোখে লাগে। আর পাঠক হিসেবে আমার কাছে শেষের অংশটুকু বাহুল্যই মনে হয়েছে। প্রথম উপন্যাস হিসেবে এটি সুহান রিজওয়ানের বেশ ভালো একটি কাজ বলে মনে করি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস খুব একটা লেখা হয়নি। এ বইটি সেই অবাক সময়ের পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য না হলেও মোটামুটি অনেক বিষয়ই এতে উঠে এসেছে, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থ তালিকায় এটি স্হান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে বলেই বিশ্বাস।
---------------------
লেখক পরিচিতি
নাহার তৃণা
শিকাগোতে থাকেন।
নাহার তৃণা
শিকাগোতে থাকেন।

6 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর আর সমৃদ্ধ আলোচনা। নাহার তৃণার জন্য অনন্ত শুভকামনা।
উত্তরমুছুনদারুন সুন্দর বিশ্লেষানাত্মক পাঠপ্রতিক্রিয়া |
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হলেম !
সুহান রিজওয়ানের উপন্যাস ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’সমসাময়িক কালের।
উত্তরমুছুনসুহান রিজওয়ান তরুণ উপন্যাসিক। পাঠ প্রতিক্রিয়াও লিখেছেন একজন তরুণ সমালোচক। এ তরুণরা বাংলাদেশের সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে লেখাটি পড়ে তাই মনে হলো।
এই বইটা প্রথম প্রকাশের সময় বইমেলা থেকেই কিনেছি। আমার কাছে চমৎকার লেগেছে সব মিলিয়ে। এই পাঠ প্রতিক্রিয়াও অত্যন্ত চমৎকার, সমৃদ্ধ।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনপ্রিয় সব মানুষেরা লেখাটা পড়ে মন্তব্য করেছেন, আর আমি জানতেও পারিনি! দারুণ বিব্রত হচ্ছি এরই মধ্যে দীর্ঘ সময় চলে গেছে বলে। আশা করি লেখিয়ের সীমাবদ্ধতা ক্ষমা করা হবে। নতুনদের উৎসাহ দেবার বিষয়ে প্রিয় গল্পকার সাদিয়া সুলতানা সব সময় এগিয়ে থাকবে। তোমার উৎসাহ আর পরামর্শে নিজেকে আরো ঋদ্ধ করতে পারবো আশা রাখি। ভালোবাসা থাকলো।
উত্তরমুছুনগৌতমদা, আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। দেরীর বিষয়ে বলেছি উপরে, আশা করি বিষয়টা ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন। আপনি নিয়মিত আমার লেখা পড়েন, মন্তব্য করেন বিষয়টা আমার জন্য আনন্দের। ভবিষ্যতেও এমন আনন্দের সঙ্গ পাবো আশা রাখি।
গীতাদি, প্রিয় দিদি, লেখাটা পড়ে মন্তব্য করেছেন সে জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। আমার জন্য এমন মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রেরণামূলক। লেখালেখি এই যাত্রায় ভবিষ্যতেও আপনাকে সঙ্গে পাবো নিশ্চয়ই। ভালোবাসা থাকলো দিদি।
দেবদ্যুতি, হে প্রিয় বালিকা, তোমার/দের উৎসাহ অনুপ্রেরণা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। এইভাবে সঙ্গে থেকো। লেখাখানা পড়বার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা জানাচ্ছি।