ডা. মনোজ দাশ :
ফুকো ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তাঁর শ্রেষ্ঠ বই Discipline & Punish: The Birth of the prison-এ ক্ষমতার তিনটি পদ্ধতির কথা বলেন। সার্বভৌমত্ব, ডিসিপ্লিন এবং গভর্নমেন্টালিটি বা প্রশাসনিকতা। ক্ষমতার সার্বভৌমত্বের পর্বে জনসমক্ষে দৈহিক নির্যাতন করা হতো।
এর ফলে তথাকথিত অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি অন্য ব্যক্তিকে আইনের ভয়ংকর ক্ষমতার আগাম সতর্কজ্ঞাপন করা সম্ভব হতো। এরপর এলো আলোকপ্রাপ্তি ও সংস্কারের যুগ। শাস্তি প্রদানের ধরন সম্পর্কে ভিন্নমত তৈরি হলো। এই ধারণা এলো- শুধু দৈহিক শাস্তি দিয়ে বিদ্রোহী প্রজার অপরাধ প্রবণতা দমিয়ে রাখা যাবে না। অন্যদিকে প্রকাশ্য শাস্তি জনমনে বিরূপ ধারণা জন্ম দিতে শুরু করলো। আইন শুধুমাত্র রাজার সার্বভৌমত্ব রক্ষার উপায় নয়, আইনকে সমাজের শৃঙ্খলাবিধানের উপায় হিসেবেও গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হলো। দৈহিক শাস্তিকে আর কার্যকর অস্ত্র মনে করা হলো না। সমাজের ক্ষমতার প্রতি নতজানু হতে বাধ্য করার জন্য শাস্তির অন্য ধরনের কথা ভাবা হলো। বেছে নেওয়া হলো মানুষের মনকে। শাস্তিকে প্রথমে অপরাধীর কাছে যুক্তিযুক্ত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন হলো। সমকালীন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শ্রেণিকরণের মত করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিভিন্ন ধরন ও মাত্রার অপরাধের মধ্যে পার্থক্যগুলি চিহ্নিত করে, সে অনুযায়ী বিভিন্ন ধরন ও মাত্রার শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্তের মনে যেন কোনও সময় একথা মনে না হয়, রাষ্ট্র তার ওপর অত্যাচার করছে, বা প্রতিশোধ নিচ্ছে। সে যেন ভাবে, এই শাস্তি তার ভালোর জন্যই। আতঙ্ক নয়, তার মনে যেন অনুতাপ জাগে।
এর ফলে তথাকথিত অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি অন্য ব্যক্তিকে আইনের ভয়ংকর ক্ষমতার আগাম সতর্কজ্ঞাপন করা সম্ভব হতো। এরপর এলো আলোকপ্রাপ্তি ও সংস্কারের যুগ। শাস্তি প্রদানের ধরন সম্পর্কে ভিন্নমত তৈরি হলো। এই ধারণা এলো- শুধু দৈহিক শাস্তি দিয়ে বিদ্রোহী প্রজার অপরাধ প্রবণতা দমিয়ে রাখা যাবে না। অন্যদিকে প্রকাশ্য শাস্তি জনমনে বিরূপ ধারণা জন্ম দিতে শুরু করলো। আইন শুধুমাত্র রাজার সার্বভৌমত্ব রক্ষার উপায় নয়, আইনকে সমাজের শৃঙ্খলাবিধানের উপায় হিসেবেও গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হলো। দৈহিক শাস্তিকে আর কার্যকর অস্ত্র মনে করা হলো না। সমাজের ক্ষমতার প্রতি নতজানু হতে বাধ্য করার জন্য শাস্তির অন্য ধরনের কথা ভাবা হলো। বেছে নেওয়া হলো মানুষের মনকে। শাস্তিকে প্রথমে অপরাধীর কাছে যুক্তিযুক্ত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন হলো। সমকালীন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শ্রেণিকরণের মত করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিভিন্ন ধরন ও মাত্রার অপরাধের মধ্যে পার্থক্যগুলি চিহ্নিত করে, সে অনুযায়ী বিভিন্ন ধরন ও মাত্রার শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্তের মনে যেন কোনও সময় একথা মনে না হয়, রাষ্ট্র তার ওপর অত্যাচার করছে, বা প্রতিশোধ নিচ্ছে। সে যেন ভাবে, এই শাস্তি তার ভালোর জন্যই। আতঙ্ক নয়, তার মনে যেন অনুতাপ জাগে।
ফুকোর মতে, আলোকপর্বে শাস্তির মানবিক পোশাকের আড়ালে রয়েছে আরো ভালোভাবে শাস্তি প্রদান, সমাজদেহের আরো গভীরে ক্ষমতা পুঁতে দিয়ে আইন ও শাস্তিকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। ফুকোর মতে, আধুনিক এ ক্ষমতাতন্ত্র আদৌ সার্বভৌমত্বের ছক অবলম্বন করে চলে না। তা চলে ডিসিপ্লিনের ছকে। ব্যক্তি আইন ভঙ্গ করছে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যক্তির ওপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থাও গৃহিত হয়। ফুকো মনে করেন, আধুনিক মানুষ আইনের নিশ্ছিদ্র বেড়ার ভেতরে জন্মগ্রহণ করে। বিচিত্র বিধি-উপবিধি, সন্দেহপ্রবণ পরিদর্শনের আওতায়, স্কুল, ব্যারাক, হাসপাতাল, ওয়ার্কশপের অবয়বে নজরদারির মধ্যে চলে আসে ব্যক্তির জীবন। মানুষের দেহ ও মন দুটোই সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে, আইনি নিয়ন্ত্রণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সাবেকি রীতির অন্ধকার কুঠুরি ও মাটির নিচের সুড়ঙ্গে অপরাধীদের বন্দি রাখার প্রথা বাতিল করা হয়। কারাগার বানানো হলো আধুনিক স্থাপত্যরীতি মেনে। গোল করে নির্মিত জেলখানার বাড়িটি, মাঝখানে একটি আলোকস্তম্ভ। সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে সার্চলাইট ঘুরিয়ে সারা জেলখানার ওপর নজর রাখা হতো। এই আলোকস্তম্ভের নাম ‘প্যান-অপটিকন’। আলোকপ্রাপ্তির যুগে কয়েদিরা বন্দি হলো শিকলে নয়, প্যান-অপটিকন-এর আলোর ফোকাসে। ফুকো দেখালেন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তের ওপর নজর রাখার জন্য, নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তোলে। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের ব্যক্তিক ও সমাজ-রাজনৈতিক সমস্ত আচরণের কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়। সেই মাপকাঠি লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হয়। বিধিগুলি মেনে চলার শিক্ষা শুরু হয় শিশু বয়স থেকেই। শিক্ষাদানে অংশগ্রহণ করে বিদ্যালয়, ধর্মালয়, সামরিক বাহিনী, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। ফুকোর দৃষ্টিতে ক্ষমতার তৃতীয় একটা মাত্রা আছে। ফুকো তার নাম দিয়েছেন গভর্নমেন্টালিটি বা প্রশাসনিকতা। এর মূল কথা হচ্ছে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে জনগণের কল্যাণের জন্য। এখানে ক্ষমতা প্রয়োগ মানে সার্বভৌম শক্তি প্রয়োগ নয়, বরং জনগোষ্ঠীর এক-এক অংশের ব্যবহার, প্রবণতা, চাহিদা, স্বার্থ ইত্যাদি যাচাই করে তার মাধ্যমে জনকল্যাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা। বল প্রয়োগ নয়, কৌশলেই উদ্দেশ্য হাসিল করা এবং তা কার্যকর করছে শুধু রাষ্ট্র যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের বাইরেরও বহু প্রতিষ্ঠান, যারা এই ব্যাপক প্রশাসনিকতার অংশ।
১৯৭৭ সালে ‘মাইক্রোফিজিক্স অব পাওয়ার’ শিরোনামে ফুকোর একটা বক্তব্য সংকলন বের হয়। এখানে ক্ষমতা ব্যাখ্যায় দুটি ধারণা ফুকো বিবেচনায় আনলেন। প্রথমটিকে তিনি বললেন, দমনমূলক তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুযায়ী ক্ষমতার প্রধান কাজ দমন করা। ফুকোর দৃষ্টিতে উদার সংস্কারবাদ এবং মার্কসবাদে এই তত্ত্বের প্রয়োগ দেখা যায়। ক্ষমতার অন্য ধারণাটি হচ্ছে নিটশীয়। এখানে ক্ষমতা হলো কোনো বিশেষ সমাজের অভ্যন্তরে অঘোষিত যুদ্ধ, এক নীরব অনুচ্চারিত গণযুদ্ধ। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে, অর্থনৈতিক বৈষম্যে, ভাষায়, এমনকি প্রতি মানুষের মধ্যে এই যুদ্ধ অব্যাহতভাবে ক্রিয়াশীল। ক্ষমতা ব্যাখ্যায় ফুকোর এই নিটশীয় ধারণাকে গ্রহণ করেন।
ফুকো ক্ষমতার সাথে জ্ঞান ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেছেন। ফুকোর মতে জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়া ক্ষমতার প্রকাশ হয় না। ক্ষমতা প্রয়োগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে শৃঙ্খলিত চৈতন্য। ফুকোর মতে ক্ষমতা জ্ঞানকে বৈধতা দেয়, আর জ্ঞান এই ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে। ক্ষমতা ও জ্ঞান একটি আরেকটির সাথে মিশে আছে। কোনো বিশেষ সময় বা সমাজে কতকগুলি ধারণা বা বাচনকে আমরা ‘সত্য’ বলে মেনে চলি। যদিও সেই ‘সত্যগুলি’ ইতিহাসগত পরস্পরা অনুযায়ীই নির্মিত, তবু সেই ‘সত্যে’র ছদ্মবেশে প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ধারণা ও বাচনই ‘ক্ষমতা’য় পরিণত হয়। ফুকোর মতে–পুঁজিবাদী সমাজ যা কিছু তার ক্ষমতা বা জ্ঞানের বাইরে, তাকেই অসুস্থতা বা বিকৃতি বলে আখ্যায়িত করে লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্বাসিত করে। পুঁজিবাদী সমাজ শুধু সেটুকুই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে আনে বা সুস্থ বলে স্বীকার করে, যার থেকে মুনাফা লাভ সম্ভব। এখন প্রশ্ন এই যে, ক্ষমতার এই অনুশীলনে লাভবান হচ্ছেন কে? কার এই ক্ষমতা? বলা হয়ে থাকে এ-প্রশ্নের জবাবে ফুকো যা বলেছেন সেটাই তাঁর শেষ জীবনের মূল ও প্রধান বক্তব্য। ফুকোর মতে আধুনিক জগতে ক্ষমতা এমনভাবে কেন্দ্রচ্যূত হয়েছে যে, তার আর কোনো বিশেষ মালিক নেই; সমাজের সকলেই এই যন্ত্রের মধ্যে এক একটি অংশ। যদিও ফুকো শ্রেণিগত ক্ষমতার কথা বলেছেন, কিন্তু ফুকোর দৃষ্টিতে ক্ষমতা কোনোভাবেই কেন্দ্রীভূত নয়। ফুকোর মতে ক্ষমতার যন্ত্রের বিশেষ কোনো মালিক নেই, ক্ষমতা কোনো বিশেষ শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত নয়। মার্কসের শ্রেণিতত্ত্বকে ফুকো নাকচ করে দিলেন। ‘যৌনতার ইতিহাস’-এ ফুকো বলেছেন কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণিকে সরিয়ে দিয়ে এই ক্ষমতা যন্ত্রের বিলুপ্তিসাধন সম্ভব নয়। ফুকোর মতে, ক্ষমতা বিরাজ করছে সর্বত্র। এটি অজেয়, এর কর্তৃত্ব অনতিক্রম্য। ‘পাওয়ার-নলেজ’ এ ফুকো লিখেছেন ‘বাম অথবা ডান, কোথায় যে ক্ষমতার প্রশ্নটি ঠিকভাবে তোলা যেতো তা দৃষ্টিগোচর হওয়া কঠিন। কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগের নিজস্ব ‘মেকানিক্সটি’ কখনোই এদের দ্বারা বিশেষিত হয় নি।’
মার্কসবাদীদের সম্বন্ধে ফুকোর এ অভিযোগ একেবারেই সত্য নয়। Eighteenth Brumaire সহ আরো কিছু রচনায় মার্কস ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এঙ্গেলস স্থূল অর্থনীতিবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে মার্কসের দ্বান্দ্বিক চিন্তাকে অগ্রসর করে নিয়ে গিয়েছেন। মার্কসের তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা বিশ্লেষণের একটা চমৎকার ধারা গড়ে উঠেছে। লেনিন মনে করতেন–মেহনতিদের ক্ষমতার মূল লক্ষ্য শ্রেণিশত্রুদের দমন নয়, বরং এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে–নির্মাণ, মানুষ কর্তৃক মানুষের ওপর শোষণ, আধিপত্য ও সব ধরনের খবরদারির অবসান। আর গ্রামসি মার্কসীয় ধারায় উল্লেখযোগ্য অনেক কিছু সংযোজন করেছেন। ক্ষমতা বিশ্লেষণে গ্রামসির এই অবদানকে ফুকো এড়িয়ে গেছেন। ফুকোর মতো গ্রামসি ক্ষমতাকে অজেয়, অভেদ্য ও অচূর্ণ হিসেবে দেখেননি। গ্রামসির ক্ষমতা বিষয়ক ধারণা ফুকোর ধারণা থেকে আরো বেশি স্পষ্ট, আরও বেশি রাজনৈতিক এবং তা বিকল্প সমাজ প্রতিষ্ঠার এক দিক নির্দেশনাও বটে। মার্কসবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্র, অর্থনীতি এবং ওই দু’য়ের অন্তর্গত সামাজিক ব্যবস্থাটাই হচ্ছে ক্ষমতার প্রধান আশ্রয়স্থল। সেই ব্যবস্থার কেন্দ্রে আঘাত না করে উত্তর-আধুনিক ফুকো ক্ষমতাকে সমাজের ভেতরে ছড়ানো ছিটানো নানা জায়গায় খুঁজতে গিয়ে মূল ব্যবস্থাটাকে অক্ষত রাখতে চান। কেন্দ্রীয় বিপ্লবকে প্রতিহত করতে চান। ফুকো চান মানুষ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অসংখ্য স্থানীয় ও খণ্ডখণ্ড লড়াই করবে। কিন্তু ফুকোর ধারণা একধরনের শোষণ ক্ষমতার বদলে আসবে আরেক ধরনের শোষণ ক্ষমতা। মূল দুর্গ, মূল ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র থাকবে অক্ষত। এভাবে সমাজে ছড়িয়ে থাকা উপেক্ষিত ক্ষমতার জালকে বিবেচনায় আনতে গিয়ে ফুকো প্রত্যক্ষ ক্ষমতাতন্ত্রকে অস্পষ্ট করে দিয়েছেন। মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুযায়ী সব ধরনের ক্ষমতাতন্ত্র থেকে ‘শ্রমের মুক্তিই’ মানুষের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত সৃষ্টি করে। মানুষের স্বাধীনতার প্রকৃত বাস্তবায়ন হয় তখনই যখন তার সামাজিক মুক্তি অর্জিত হয়, অবসান হয় সব ধরনের শোষণের এবং যখন মানুষের সৃষ্টিশীল শ্রম অপরের স্বার্থে নিয়োজিত হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মের অমোঘতা থেকে মুক্তি ও সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি–এই দুই প্রকারের মুক্তি একত্রে মানুষকে দিতে পারে প্রকৃত মুক্তি, প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ। আর এই প্রক্রিয়ার বিকাশের মধ্যেই সব ধরনের ক্ষমতাতন্ত্রের শুকিয়ে মরার ভিত্তি তৈরি হয়। পুঁজিবাদে এটা সম্ভব নয়। সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে এর শুরু, আর মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ সাম্যবাদে অবসান হবে সব ধরনের ক্ষমতাতন্ত্রের, মানুষের স্বাধীনতা পাবে পরিপূর্ণতা।
ফুকো মানব সমাজে ক্ষমতার বৈচিত্র্যময় দিক ও প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করেছেন, একথা ঠিক। কিন্তু মানুষ কোন পথে এধরনের ক্ষমতার অধিকারী হয়, কীভাবে এই ক্ষমতা খাটায়, কীভাবে এই ক্ষমতা ধরে রাখে, এ থেকে বের হয়ে আসার কার্যকর পথ কী, তার সন্ধান ফুকো করেননি, ফুকো এখানে একেবারেই নীরব। এজন্য এডওয়ার্ড সায়িদ বলেছেন–‘ফুকোর চরম হতাশাবাদী দৃষ্টি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিরোধের ক্ষমতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায় নি।’ মিশেল ফুকোর এই ঘাটতির অন্তত দুটি কারণ এডওয়ার্ড সায়িদ নির্দেশ করেছেন। প্রথম কারণ–মার্কসের চিন্তাধারার সাথে ফুকোর মতের মিল না হওয়া। ফুকোর চিন্তার হতাশাবাদী বিপজ্জনক সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে মার্কসের সাথে তার এই বিচ্ছিন্নতার জন্যই। দ্বিতীয় কারণ–ইতিহাসের গুণগত পরিবর্তন নিয়ে ফুকোর আগ্রহের অভাব। মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতত্ত্বে সমাজে গুণগত পরিবর্তনের কোনো নির্দেশনা নেই। আবার ফুকো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনা করা সত্ত্বেও মার্কসের অনেক কিছুই গ্রহণ করেছিলেন। মার্কসের অনেক গবেষণা, অনেক কথা ফুকো তাঁর লেখায় সরাসরি কাজে লাগিয়েছেন। মাঝে মাঝে অস্থির চিত্তের মতো যাই-ই বলেন না কেন ফুকো কখনই তার চিন্তার ওপর মার্কসের প্রশ্নাতীত প্রভাবকে অস্বীকার করেননি। আসলে মার্কসের পরবর্তী সময়ে মার্কসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নতুন কিছুই সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, ফুকো এটা ভালভাবেই জানতেন। ফুকোর মৃত্যুর কিছুকাল আগে জেরাল্ড রুলেট (Gerald Raulet) ফুকোকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- মার্কসবাদ কি শেষ হয়ে গিয়েছে? উত্তরে ফুকো বলেন, ‘It is clear, even if one admits that Marx will disappear for no,w that he will reappear one day’।
ফুকোর বেশ কিছু ধারণা মাকর্সবাদের সাথে সাংঘর্ষিক। ফুকোর ক্ষমতাতত্ত্বের সাথে মার্কসীয় ক্ষমতাতত্ত্বের দ্বান্দ্বিকতার মৌলিক পার্থক্য আছে। কিন্তু এটাও সত্য ফুকোর ‘ক্ষমতাতত্ত্ব’ প্রথাগত ধারণার বাইরে আমাদের প্রয়োজনীয় আরো কিছু ভাবতে শেখায়। মার্কসবাদের সৃষ্টিশীলতা সত্যানুসন্ধানের সম্ভাব্য সব সুযোগকেই কাজে লাগায়। একটা সৃষ্টিশীল দর্শন হিসেবে তা মানবজাতির বিকাশমান জ্ঞানের জগৎ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টা চালায়। মার্কস নিজেও এরিস্টটল থেকে শুরু করে মার্কসের পূর্ববর্তী সময়ে সমাজ গবেষণায় যত জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছিলো সমালোচনার দৃষ্টিতে সৃষ্টিশীলভাবে তা সংশ্লেষণ করেছিলেন। মার্কসবাদের অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতা ও বিপ্লবী অন্তর্বস্তুর আলোকে ফুকোর ক্ষমতাতত্ত্বের বিরোধিতা যেমন করতে হবে তেমনি ফুকোর ক্ষমতাতত্ত্ব থেকে প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় শিক্ষা নেওয়ার সাহসও দেখাতে হবে।
লেখক: সভাপতি, খুলনা জেলা কমিটি, সিপিবি
0 মন্তব্যসমূহ