আমি কোনো সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠিনি। যে সামাজিক কাঠামোতে বড় হয়েছি আমি; আমার বেড়ে ওঠার সেই শৈশব, কৈশোরে অনেককিছু বলা সম্ভব হতো না।
বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে অর্থকষ্ট আর পারিবারিক বিপর্যয়ে পড়া একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের চিরায়ত জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে গিয়ে অনেককিছু দেখেও কিছুই বলা হতো না-তখন থেকেই মূলত গল্প লিখতে শুরু করা। গল্পচ্ছলে নিজের কথাগুলো বাঙময় করার পথ বেছে নেয়াই তখন সহজ মনে হয়েছিল।
এরপর বড় হয়ে দেখলাম বলার জায়গাগুলো সংকুচিত হতে হতে একেবারে শূন্যের কোঠায় চলে গেছে। একেবারে মুখ বন্ধ রাখার মতো দীর্ঘ ছয়টি বছর লেখালেখি থেকে দূরে থাকলাম। গল্প বলতে ভুলে গেলাম। তারপর ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আবার শুরু করলাম গল্প লিখতে। এক অর্থে বলা যায়, জীবনের সাথে নিজের লুকোচুরি খেলার মাধ্যম হিশেবেই এখন গল্প লেখার তাগিদটা জারি আছে।
গল্পপাঠ ২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
এখন সর্বশেষ লেখাটাও কিছুই হয়নি বলে মনে হয়। তবু শুরুর লেখাগুলো সেই অর্থে একেবারে বাতিল করতে পারি না। স্কুল-কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে যা যা দেখতে পেতাম, প্রায় সবকিছু নিয়ে লিখে ফেলতাম। কখনো গল্পাকারে, কখনো দিনলিপিতে; দেয়াল আঁকড়ে থাকা টিকটিকি, বিছানায় লেপটে থাকা অসুস্থ আত্মীয়, একজন ভিক্ষুক থেকে শুরু করে রাস্তার সেই নোংরা লোকটা-সবকিছু নিয়ে। একদম শুরুর সেই লেখাগুলোতে হয়তো আমার অকৃত্রিম আবেগ, ক্ষোভ, ইচ্ছে সবই থাকতো।
গল্পপাঠ ৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
প্রস্তুতি নিয়ে তো গল্প লেখা শুরু করিনি কখনো। হয়তো বাবাই তার সংগ্রহে থাকা বইগুলোর মাধ্যমে লেখালেখির মঞ্চটা প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন। আমরা পাঁচ ভাইবোন প্রচুর বই পড়তাম, বাবাহীন পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েনের ভেতরেও একেঅন্যকে বই উপহার দিতাম, পাঠাগারের সদস্যও হতাম। বইপাঠের সেই অভ্যাসই অলক্ষে আমার ভেতরে লেখার যৎসামান্য বীজ রোপণ করেছিল।
গল্পপাঠ ৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
আমি শিখছি প্রতিদিনই। এখনো এমন কোনো কুশলী গল্পকার হতে পারিনি। তবে এটা ঠিক আমি গল্পলেখার একমাত্র কৌশল হিশেবে এখন ধৈর্যকেই অবলম্বন করেছি। একটা গল্প শুরু করে মাঝপথে এসে বা গল্পটা লেখা শেষ করে আমি ফেলে রাখি দীর্ঘদিন, দীর্ঘমাস। মনে হয় কিছুই হয়নি। এরপর বিভিন্ন গল্পকারের গল্প পড়ি, জানতে চাই প্রকৃতঅর্থেই আমার লেখাটা পাঠযোগ্য গল্প হয়ে উঠেছে কিনা।
আমি গল্প লিখতে লিখতে কবিতা পড়ি, প্রিয়সব গল্পকার বা ঔপন্যাসিকের বইগুলোও পুনঃপাঠ করি। দেখি তারা কীভাবে সংলাপ নির্মাণ করেছেন, এক প্যারা থেকে অন্য প্যারাতে গেছেন। গল্পকে মেদহীন করেছেন, কখনো কখনো মেদবহুল গল্পকেও পাঠের জন্য উপভোগ্য করে তুলেছেন।
আবার কোনো কোনো গল্প টানা লিখে শেষ করতে পারি। তখন মস্তিষ্কে কোনোপ্রকার চাপ প্রয়োগ ছাড়াই গল্প লেখা হয়ে যায়, যদিও পারিবারিক আর পেশাগত দায়িত্বের কারণে লেখালেখির জন্য নিবিড় সময় বের করা আমার জীবনে দুর্লভ একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই খুব কম গল্পই আমি এক টানা লিখতে পারি।
কর্মক্ষেত্রে আমাকে নানান ধরণের মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় আর কর্মঘন্টার পুরোটা সময় আইন পড়া বা লেখার ভেতরেই থাকতে হয়, সেখানে ছাড় দেবার কোনো উপায় থাকে না। এটা যেমন আমার লেখার নিরবচ্ছিন্ন ভাবনাকে ব্যাহত করে তেমনি এর একটা ইতিবাচক দিকও আছে। আমি দিনরাত মানুষের গল্পের মধ্যে বিচরণ করি বলে গল্পের থিম নিয়ে কোনো সংকটে পড়ি না।
গল্পপাঠ ৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
আমার গল্পগুলো আদতে গল্প হয়ে উঠছে কিনা, কোনো মাপকাঠিতে দাঁড়াচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে আমি সংশয়ের ভেতরে থাকি। কেবলই মনে হয়ে যে জীবন আমি যাপন করি তাতে আমার আঙুলকে বড় বেশি সাবধানে চালাতে গিয়ে আমি মূলত নিজের সাথে এক ধরণের প্রতারণা করছি। যা নিয়ে লিখতে পারি, তা লিখি না; যা বলা উচিত, তা বলি না। তাই যতো দিন যাচ্ছে আমি ক্রমশ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হচ্ছি।
গল্পপাঠ ৬. আপনার প্রিয় গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে প্রিয় মনে করেন?
আমার প্রিয় গল্পকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, নাসরীন জাহান। কেন তাদের প্রিয় মনে করি তার কারণ প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ভিন্নতর। ছোটগল্পের প্রকৃত রস পাই বলে আমি বার বার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প পড়ি, আমার মনে হয় জীবনকে খুঁটে খুঁটে দেখেছেন তারা। মাহমুদুল হক আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গদ্যশৈলী আমার খুব ভালো লাগে। নাসরীন জাহানের গদ্যের কাব্যময়তা আর বিষাদময়তার প্রতি আমার অন্ধ মুগ্ধতা কাজ করে। ইদানিং জাকির তালুকদারের কিছু গল্প পড়েছি, মুগ্ধ হয়ে দেখেছি, চমৎকারভাবে তার কলম সময়কে ধারণ করে চলছে।
গল্পপাঠ ৭. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
কার জন্য লিখি সেই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় ‘কেন লিখি’ তাতেই চলে এসেছে। লেখার সময় পাঠকের কথা তো সেভাবে মাথায় রেখে লিখি না। পাঠক পড়ে আনন্দ পাবে, বেদনার্ত হবে, অনুপ্রাণিত হয়ে রাতারাতি দিন বদলে ফেলবে তেমন কিছু তো লেখার সময় কখনো মাথায় আসে না। তবে আমি নিজে পাঠক হলে কীভাবে বা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের বর্ণনা পড়ে সাচ্ছন্দ্যবোধ করবো বা উদ্ভট, অবাস্তব কিছু পড়ে বিরক্ত হবো সেই বিষয়টা লেখার সময় মাথার ভেতরে কাজ করে। আমার মনে হয়, পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হলে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিটা জানা জরুরি, পাঠকের চাহিদা না।
গল্পপাঠ ৮. এখন কি লিখছেন?
এখন কয়েকটা গল্প লিখছি, লিখছি না বলে বলা যায়-লিখে রাখা গল্পগুলো পুনঃলিখন করছি। আর বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে ছেলে ও মেয়ে দুটি পৃথক চরিত্র নিয়ে দুটো লেখা পাশাপাশি লিখছি, ইচ্ছেঘুড়ি ও ইচ্ছেডানা শিরোনামে।
0 মন্তব্যসমূহ