৫১ পীঠ দর্শন
সোহিনী সেন
‘যোগেনের মেছুনি বউ ইলিশ কাটতে পেরে খুব খুশি। তাকে ডাক দিচ্ছে,দেখে যাও কী রক্ত,ডিম আছে পেটে।... ডিমঅলা মাছে স্বাদ থাকে না। বলেই চমকে ওঠে যোগেন। গা সিরসির করে ওঠে যে কেন তা যোগেন ধরতে পারে না। বাথানিয়াটোলার খবরটি মনে পড়ে গেল। অণিমাকে বলবে? মেয়েরা খুন হয়েছে বেশি। এক প্রেগন্যান্ট মহিলাকে ধর্ষণ করে গলা কেটে--। না, না ওসব কথা অণিমা শুনবে কেন ?... রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বটির ধারালো গা দিয়ে কলতলায়। তিন আঙুল দিয়ে ডিম বের করতে করতে অণিমা বলল, ডিমঅলা মাছও তো ছাড় না,তোমাকে খুব জানি পাজি!’
প্রেগন্যান্ট মহিলা, ধর্ষণ, ডিমঅলা ইলিশ, বটি দিয়ে গড়ানো রক্ত— এসব অন্ধকার দৃশ্যকল্পের ব্যারিটোন যখন দমবন্ধ করে দিচ্ছে, তখনই খেয়াল হল, ৫৬০ পাতার বইটার এইটা প্রথম গল্প। ‘স্বদেশপ্রেম। অমর মিত্রর ‘গল্প ৫১'-এর উদ্বোধনী সংগীত।
গল্পটি ভূমিহার রাজপুত, জমিদারদের পোষা রণবীর সেনার সঙ্গে নকশাল ও নকশাল পরিচালিত হরিজন সম্প্রদায়ের সংঘাতের কথা শোনায়। বিহারের ভোজপুরের বাথানিয়াটোলা। কৃষক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনায় সেখানকার ভূস্বামীদের পোষা গুণ্ডারা চাষিদের উপর হাঙ্গামা চালিয়েছে। বিহারি চাষি লছমন। কলকাতার মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেথরও সে। খবরের কাগজে বেরনো এক প্রতিবেদনের সূত্রে কর্পোরেশনের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার যোগেনবাবুর সঙ্গে তার কথোপকথন চলে। এবং সেই কথোপকথনের কর্ড লাইন ধরেই নিজেকে ছড়িয়ে দিতে দিতে যায় আশু বিপদের রক্তবীজ।
বিহারের আকাশে মেঘ ঘনায়। মেঘে মেঘে ঘন কালো হয়ে ওঠে। লছমনের মাথার আকাশ। তার ঝিমিয়ে পড়া চোখের ঘোলাটে সাদাতেও অসহায়তার ধূসর মেঘ। অ-মৌসুমি সেই মেঘ রাজমহল, ভাগলপুর, মুঙ্গের, নালন্দা, বৈশালী, পাটনা, ছাড়িয়ে কিছুটা কি আসে কলকাতায়? আসে আদতে বিহারের সন্তান যোগেনের বুকে ? না কি ডিমঅলা ইলিশের ঢেকুরের মতোই তার বায়বীয় অস্তিত্ব মিলিয়ে যায় সুখী নাগরিক জীবনে ? মন্দ্রমুখর যাপনে?
ভয়াবহ এক প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাড় করায় ‘স্বদেশযাত্রা'। গল্পটির জন্য ১৯৯৮-এ সর্বভারতীয় ‘কথা’ পুরস্কার পান অমর মিত্র। অমরবাবুর লেখা কোনও অদৃশ্য কেন্দ্রাতিগ বলে যেন ধরে-বেঁধে রেখেছে নগর ও গ্রামের বিবিধ কৌণিক বিন্দুগুলিকে। দেশ-বিদেশ, ইতিহাস-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব একই ছাদের
তলায় হাজির হয়ে যায় তার গল্প বলার প্রতিসাম্যে। টানটান উত্তেজনায় দৃষ্টি আটকে রাখে বিষয়বৈচিত্রের চুম্বক।
‘গানের ভিতর গান' গল্পে শহরের মেধাবী ছাত্র ও কর্পোরেট হাউসের উচুতলার কর্তা শুভম ও জেলার রেকর্ড কালেক্টর মতিন মিয়াকে দেখি। দু'জনেই গানের মধ্য দিয়ে ছবি বোনে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গান যেন তাদের কাছে অন্তহীন প্রাণের উৎস। আর প্রাণহীনতাই গানহীনতা। ভাইসিভার্সা বলা চলে। গানের দ্যোতকে তারা কীভাবে যেন আবিষ্কার করে ফেলে পৃথিবীর প্রাণ শুকিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বেলগাছিয়ার টালা পার্কের জলাশয়, তার চিরহরিৎ পারিপার্শ্ব যেমন কনস্ট্রাকশনের পর হয়ে যায় মৃতপ্রায়, আফ্রিকান গায়কের গানে ছোট দেশ মালির তেমন অবস্থার কথাই ধরা পড়ে। অর্থাৎ গান ও প্রাণহীনতার সূত্রে বাঁধা পড়েছে দু’টি দেশ। ভারতের গায়ত্রী বসুর গানের সুর, আফ্রিকার আলি ইব্রাহিম ফরকার জলদগম্ভীর স্বর, ড্রাম বাঁশির মিশেল নিজেদের অজান্তেই যেন এক করে দেয় দু’দেশের ক্রাইসিস। বকেরা সব শকুন হয়ে যায়। গাছে গাছে শকুন। দুর্ভিক্ষের দেশটায় শকুন অপেক্ষা করে মানুষ মরার। টালা পার্কের মরা নাগকেশর গাছও যেন ছেয়ে যায় শকুনে! এখানেই জাদুবাস্তব ঝুপ করে নেমে পড়ে সাদা কালো হরফে। হাঁটতে থাকে গল্পের স্রোতের টানে-‘গানের ঘর আবার স্তব্ধ হল। কিন্তু আলি ফরকার কণ্ঠস্বর যেন বেঁচে থাকল। শূন্যে ভাসতে লাগল। সেই শূন্য থেকে শকুনরা পাখা ঝাপটে নেমে আসছিল সেই পৃথিবীতে, যেই পৃথিবীতে একদিন ভেসে বেড়াত বকের পাখা।’
অমরবাবুর লেখা মানচিত্রের জমির আল-কে অদৃশ্য করেছে। ইতিহাস-পুরাণের পাতার মৃত ঘুণকে দিয়েছে চলচ্ছক্তি। বাতাসে শূন্যতায়, মটুকবনির পাহাড়ে, ইজরায়েলে, গাজায়, ওল্ড টেস্টামেন্টের পাতার, মোজেসের এক্সোডাস পর্বে, ফুলবনিতে, ন’পাহাড়িতে কোথায় সিধ কাটেনি তার কলম? ‘যুদ্ধে যা ঘটেছিল’ গল্পে তিনি শোনান অঙ্গারপোতা, মশালডাঙ্গা, দহগ্রাম, বাতৃগাছি প্রভৃতি অসহায় ছিটমহলের কথা। সেখানকার নাগরিকত্বহীনতার কথা। যুদ্ধের ফলে রাজারাজ ও সরকারের পাশার একচালেই ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় এই অঞ্চলগুলোর। সেখানকার মানুষগুলোর। নিয়তির এই অমোঘ পরিণাম তারা হারাতে পারেনি। এটি পুরুষানুক্রমে নেমেসিসের মতো সঙ্গে রয়ে গিয়েছে তাদের।
৫১টি গল্প যেন আলাদা স্বাদের ৫১ পীঠ দর্শন। নানা সময়, এবং সেই সময়ের সঙ্গে লেখকের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার নির্যাস বহন করছে তারা। বিভিন্ন সমাজের ও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ব্যাপ্ত জীবন,তাতে নেমে আসা প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, নিয়তিপূর্বক খাঁড়ার ঘা দগদগে হয়ে ফুটে আছে যেন। নির্দিষ্ট সময়ের পাণ্ডুলিপি হয়েও সেগুলি সময়ান্তরের পরিব্রাজক। গল্পগুলির উপস্থাপনা-বৈচিত্র বিস্মিত করে। জমে যাওয়া অ্যান্টাসিড গুঁড়োর মতোই খুব আস্তে আস্তে তা হজমের চোয়া ঢেকুর তোলায়। ‘আস্তে আস্তে’ বললাম, কারণ, প্রতিটা গল্পের গভীরতা ধারণ করার জন্য যেন অনেকক্ষণ ধরে মন ও মননকে প্রস্তুত করতে হয়। গল্পগুলিতে উঠে এসছে বিপন্ন মানবতার করাল ছবি। সেই ছবি যেন তর্জনী তুলে প্রশ্ন শানাচ্ছে পাঠককে। জিজ্ঞেস করছে, সেই বিপন্নতার জন্য দায়ী কি তিনিও নন? স্রেফ পাঠক বলেই হয়তো এই কৃতকর্ম থেকে তিনি ছাড় পাচ্ছেন। বা পাচ্ছেন না।
গল্প ৫১ অমর মিত্র
মিত্র ও ঘোষ পাবলিকেশন।
৫৫০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ