একেবারে মাপমতো আধখানা জীবন পেরিয়ে রবিবার সকালে দাড়ি কামাচ্ছি। আমি কল্যাণ পালিত, আবিষ্কার করলাম আমি একটি জলহস্তী হয়ে গেছি। বিশাল। শুধু মাংস। ভোঁতা।
অফিস সুপার সান্যাল পরামর্শ দিয়েছিল, ‘স্যার, গরম জলে পাঁচ ড্রপ মধু খান রোজ। ছিপছিপে হয়ে যাবেন।’ ফলম? আরও মুটিয়েছি। দোতলার বেশি সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। নিচু হয়ে পয়সা কুড়োতে গেলে পেটে আটকায়। রক্ত নেমে মুখ লাল করে দেয়। কপালের দু’পাশের রগ দপদপায়। ব্লাড সুগার, মিষ্টি খাওয়া বারণ। বহুদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাইনি।
গামা অ্যাডভার্টাইজিং-এর তিনের মধ্যে এক ডিরেক্টর। সব মুখ, সব ছবিই বিজ্ঞাপনে লাগে। লেটারিং, লে-আউট, কম্পোজ, নেগেটিভ, ক্লায়েন্ট, ডেলিভারি। গত বিশ বছরে এই আমার ভুলভুলাইয়া।
নিজে শেষ ছবি এঁকেছি সম্ভবত— গতজন্মে। আর্ট কলেজের চৌকাঠ আদৌ পেরিয়েছিলাম কিনা, রীতিমতো সন্দেহ হয়। এখন ক্যানভাসের সামনে তুলি ধরলে হাত কাঁপবে।
মায়ের হাতের পোস্ত আর বিউলির ডালের স্বাদ ভুলে গেছি। বড়ি-আলুর ঝোল। ওপরে অল্প তেল ভাসবে, উঃ।
বাড়িতে দু’বেলার রান্না সকালে সেরে দিয়ে যায় এক মহিলা। রবিবারে ছাপানো রঙিন রান্না দেখে রকমারি এক্সপেরিমেন্ট রাণুর। বাড়িতে শুঁটকি হয় না। কাছিমের মাংসের নো এন্ট্রি।
বাবা ছেলেবেলায় সজনেডাঙার সব গাছ, সব পাখি চিনিয়েছিলেন আমাদের দুই ভাইকে। জ্যৈষ্ঠের গোড়ায় ফলসা। আমের মুকুল। উঠোনে ফেলে নারকেল ছাড়ানোর কায়দা শিখিয়েছিলেন।
আমার ছেলেমেয়েরা এসবের ক, খ কিছুই জানে না। গড়িয়াহাটের এই ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে যে কলকাতা তাতে ধোঁয়া, ধুলো নেই— ক্যালেন্ডারের কলকাতা।
গত ছ’বছরে সজনেডাঙায় যেতে পারিনি। বিয়ের পর, গোড়ায় ফি হপ্তায় সজনেডাঙা একদিন। তারপর মাসে, আরও পরে বছরে দু’বার। রাণু, আমার বউ এসব পাত্তা দেয় না। মা কি এখনও উঠোনের রোদে আচার শুকোতে দেয়! কমল আছে কেমন? বেঁটে ডুমুরগাছটা?
রাণুর মামাতো বোনের বিয়ে। বুবুন, পাপাইকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলেছে। আজ আমার জন্মদিন। ওদের মনে নেই। মনে করাতে চাইও না। পঞ্চাশে এসে মানুষ কি ঠান্ডা হয়ে যায়? ভিজে ভিজে। ন্যাতানো।
এসব ভাবতে ভাবতে আমি দাড়ি কামিয়ে ফেললাম। আফটার শেভ, স্নান, খাওয়া। ভেঁপু বাজাচ্ছে অফিসের গাড়ি।
রোজকার রুট বদলে রাণুদের নামিয়ে দিতে হল। ‘টা টা বাপি।’ হাত নাড়ল মেয়েটাই। ছেলেটা বড় হচ্ছে। গম্ভীর। এমনটাই হয়। ছেলের সঙ্গে মায়ের ভাব বেশি। মেয়েদের উলটো। শুধু কোথাও একটা অদৃশ্য সুতোর টান থাকে।
আমিও সহজ ছিলাম মায়ের কাছেই।
আসলে বাবা তো শুধু বাবা ছিলেন না। ভুবনমোহিনী স্কুলের বাংলার মাস্টারও। অন্য ছেলেরা খ্যাপাত—‘তুই বাড়িতে বাবাকে কী বলিস রে, স্যার?’
সামনে গাড়ির প্যারেড, গাড়ির শোভাযাত্রা। সেদিকে দেখতে দেখতেই হঠাৎ কল্যাণের মনে হল, আজ যদি সে সজনেডাঙা যায়? বিনা নোটিশে। রাণু নিজের বাড়ি গেছে। সেও যেতে পারে। ঝপ করে দরজা খুলে নেমে পড়ল। ড্রাইভার ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী হল স্যার!’
‘অফিসে যাব না। তুমি চলে যাও। আমার অন্য একটা কাজ আছে।’ টাই খুলে পিছনের সিটে ফেলল কল্যাণ। ‘ওটা তোমার কাছে রেখো, আর ফিরে গিয়ে বলবে, আমার শরীর খারাপ।’
পিছনের গাড়িগুলোর ভ্যারাইটি হর্ন। যেন হর্ন দিয়েই কল্যাণের গাড়িটাকে ফুটপাথে তুলে দেবে ঠেলে।
হতভম্ব গাড়িটা চলে গেল। অন্য গাড়িগুলোর প্যাঁচ কাটিয়ে ওপারে যেতেই শিয়ালদার বাস পেল একটা কল্যাণ। অভ্যেস তো নেই। তবু আজ, এখন সে সজনেডাঙা যাচ্ছে। ঘাম, বিরক্তি, গা-জোয়ারি ঝগড়া, ঘষাঘষি। সব মিলিয়ে চেনা-অচেনা বাসটা তাকে ভেতরে টেনে নিল।
স্টেশনে গোনাগুনতি পাঁচজন। একটা ছোট চায়ের স্টল। কাচের বয়ামে সস্তা বিস্কুট। কাউন্টারের সামনে একটা পাগল। একটা ভবঘুরে। গুমোট ঝিমধরানো ভাব। সজনেডাঙার ছবি মফস্সলের আর পাঁচটা স্টেশনের মতোই।
সুপুরিবাগানের ভেতর দিয়ে পথ। ছ’বছরের ব্যবধানে কুড়ি মিনিটের সেই রাস্তা পেরিয়ে এল কল্যাণ।
কনকপ্রভার চশমার পাওয়ার বেড়েছে, কমেছে চোখের। দূরের জিনিস আবছা দেখেন। পায়ে হাত পড়তেই তাঁর হাত উঠে এল কল্যাণের চিবুকে। ‘তুমি? বাড়ির সব খবর ভালো তো? শরীর কেমন আছে?’
‘হ্যাঁ, বাড়ির সব ভালোই।’
‘আর কেউ আসেনি?’
মা, কেন এসব জিজ্ঞাসা কর? সামনে দাঁড়িয়ে তো নির্লজ্জ আমি, একা।
‘আর কেউ আসেনি। আমিই এলাম।’ দাওয়ায় বসে পড়ল কল্যাণ।
‘এখান বসলে কেন? চলো, ভেতরে চলো।’
কনপ্রভার ‘তুমি’তে নিজেকেই অচেনা লাগে কল্যাণের। ‘বসি একটু। যাচ্ছি।’ জুতোর ফিতে খুলতে গিয়ে কল্যাণ দেখল-- তার ওপর ধুলোর ময়াম। ছ’বছরের ধুলো?
‘কমল নেই, না?’
‘অফিস থেকে ফিরতে রাত হয় ওর।’
কমল কলকাতায় যে বাংলা খবরের কাগজে কাজ করে তাতে কল্যাণদের লে-আউটে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। কমলের কাগজে যায় না কল্যাণ। কমলও আসেনি তার অফিসে কোনওদিন।
‘রাণু ওরা কোথায়, বাড়িতে?’
‘না, রাণুর মামাতো বোনের বিয়ে। ওরা সব ওখানে।’
‘ও। পাপাই, বুবুন কেমন আছে? রাণু?’
‘ভালো। সবাই ভালো।’
জুতো চৌকাঠের পাশে রেখে, ছেলেবেলার নিয়ম মেনে ঘরে ঢোকে কল্যাণ। খাটটা সরেছে। নতুন টেবিল-চেয়ার। আলনাটা আগে বাবা-মায়ের ঘরে ছিল। দেওয়ালে নতুন তাক। গোছালো-অগোছালো বই।
‘তোমার শরীর কেমন আছে?’
‘আমার!’ কনকলতা হাসলেন যেন। ‘ভালোই আছি। তুমি বসো। আমি তোমাকে একটু লেবুর জল করে দিই।’
‘আমি বিকেলে চলে যাব কিন্তু।’
‘বিকেলে? যেও। তোমার কি আপিস ছুটি?’
‘না। ছুটি নিয়েছি। কমল কেমন আছে মা?’
‘ভালোই তো।’
কল্যাণ সেই ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কমল-কল্যাণ। আমরা দুই ভাই। কাঁধে কাঁধে হাত। পিছনে আউট অব ফোকাস গাছপালা, আমাদের বাড়ি। বাবা তুলেছিলেন ছবিটা। ভুরু কোঁচকানো কমল। বাইশের আমি তখন ট্রেনে-বাসে ছবি আঁকার কলেজ আর বাড়ি করি। মাঝে রাণুর সঙ্গে প্রেম, বিরহ। চোখা চিবুক। গালে রোম রোম দাড়ি। হালকা গোঁফ। কৈশোর আর যৌবনের মাঝে ফালি রাস্তাটা পেরোচ্ছি।
রাণুকে ছবি আঁকা শেখাতে শুরু করলাম। গামা অ্যাডভার্টাইজিং-এ রাণুর বাবার যে কোনও কথার তখন সোনার দর। দুই পার্টনারের একজন। ভিশুয়াল আর্টিস্ট কল্যাণের ডেস্ক থেকে করিডর ঘুরে ঠেকল ডিরেক্টর মিস্টার পালিতের ঘরে। সে পথে হারিয়ে গেল জলরং, তুলি, ক্যানভাস, স্টিল লাইফ। কল্যাণ তখন ব্যস্ত রিয়েল লাইফ স্টাডিতে।
মাঝারি, ছোট, বড় কাগজে কমলের কবিতা ছাপা হয়। দুটো বইমেলায় দুটো বই পরপর। কবি হিসেবে কমলকে অনেকেই চেনে। তার কি এখনও গালে ঘন দাড়ি? চেহারায় তেমনই ধার? কমলের প্রেম ছিল। নারী ছিল। সে কোথায়? কমল বিয়ে করল না কেন?
‘চলো, কিছু খেয়ে নেবে।’
‘কমল এখনও সেইরকম আছে মা?’
‘ছবির মতো নেই আর।’
‘তা কী করে থাকবে! আমাকে দেখছ না। কী মুটিয়েছি!’
‘তোমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। শরীর আর মন ভালো থাকলে মোটা-রোগাতে কী যায়-আসে।’
কল্যাণ কী বলবে? কলকাতার কোনও লোকই ভালো নেই। ভালো থাকে না। তাদের হয় মন নয় শরীরে গোলমাল। তা কি জানেন কনকপ্রভা! কল্যাণ এখন সেই কলকাতার লোক।
‘কমল বিয়ে করল না, না মা?’
‘নাঃ। আর করবেও না। আমি একা আর কত বলব। বয়সও তো পেরিয়ে এল।’
আমার ঈর্ষা হয়। কমল শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছেই থাকতে পারবে। কত বয়স হল মায়ের? সত্তরের কাছে।
রান্নাঘরেই খেতে বসে কল্যাণ। পিঁড়িতে। বাবু হয়ে বসতে কষ্ট হয়, তবুও। মাটিতে থালা, লেবু, নুন, কাঁসার গেলাসে জল।
‘তুমি খাবে না এখন?’
‘না। তুই খেয়ে নে। একটু কাঁটা রাখিস। ভাত দিয়ে মিনিটাকে দেব একটু।’
এখন মাকে চেনা লাগে। সবাইকে খেতে দিয়ে মা বসতেন। মায়েপোয়ে আমরা তখন অনেক কথা বলতাম। এক একটা সকাল, বিকেল পৃথিবীর গায়ে যে লেপ্টে থাকে। সেসব কি খুঁটে তুলে নেওয়া যায়? রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে কলকাতার রাস্তা, মানুষ, ভিড়, আলো, অন্ধকার সব ছবির মতো কথায় আঁকতে পারতাম। সে আসরে বাবা, কমল কেউ থাকত না।
এ বাড়ির ডুমুরগাছে একটা কাক অনেকক্ষণ ধরে তিড়িং তিড়িং লাফাচ্ছে। রোদের চাদর বিছানো উঠোনে কয়েকটা চড়ুইয়ের ফুড়ুত ফুড়ুত ওড়াওড়ি।
‘কমল কত রাতে ফেরে?’
‘সাড়ে এগারোটা-বারোটা।’
‘একলা থাক এত রাত পর্যন্ত। ভয় করে না তোমার?’
‘না। একলা থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে। তাছাড়া চারপাশে কত লোকজন। চেনা মানুষ। কাজের মেয়েটা আসে দু’বেলা।’
একলা থাকা কথাটা কানে লাগে কল্যাণের। একটা বয়সে সব মানুষকে একলা থাকতে হয়। কিন্তু কনকপ্রভার বোধহয় তেমন হওয়ার কথা ছিল না। মাকে কয়েকবার বলেছিল কল্যাণ তার বাড়িতে যেতে। কনকপ্রভা রাজি হননি। এখন আর কল্যাণ সে কথা বলতে পারে না।
‘হ্যাঁ রে, পাপাই লম্বা হয়েছে? ওর কোন ক্লাস হল রে?’
‘এইট। আমার মাথায় মাথায়।’
‘তাই! বুবুনও বড়সড় হয়ে গেছে তাহলে।’
‘হবেই তো মা। সবাই ছোট থেকে বড় হয়। বুবুনের ক্লাস ফোর।’
‘পাপাই আর ঘুমোবার সময় বুড়ো আঙুল চোষে না, না রে?’
কল্যাণের বোকা বোকা লাগে। সে নিজে চোখের সামনে ছেলেমেয়েদের বড় হতে দেখছে। কিন্তু তা কনকপ্রভার নজরের বাইরে।
‘না। বড় হয়ে গেছে তো, ওসব নেই।’
‘জানিস, তুই—’ কনকপ্রভা মাথা নিচু করে হাসলেন— ‘তিন-চার বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খেতিস। কিছুতে ছাড়াতে পারিনি।’
জানে কল্যাণ। আগেই শুনেছে।
কাত হয়ে গালের নীচে হাত রেখে, দুটো পা অল্প কুঁকড়ে ঘুমোতেন হেমাঙ্গও। তবে তাঁর চেহারা এত ভালো ছিল না। কনকপ্রভা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছেলেকে ভালো করে দেখতে চাইলেন একবার। খাওয়ার পর ঘুমোচ্ছে কল্যাণ।
এই সেই বুড়ো। ভোর ভোর উঠে নিমের ডালে দাঁতন করত। বিদ্যাসাগর পালা দেখে এসে কনকপ্রভাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘মা, আমি তোমায় বিদ্যাসাগরের মতো ভালোবাসি।’ ছেলের কপালে চুমু খেয়ে মা সেদিন বলেছিলেন, ‘তাই নাকি!’ চোখে জল এসেই গেল কনকপ্রভার।
দূরত্বটাকে সহজ করে নিয়েছেন তিনি। এই ক’বছরে কল্যাণ তার কাছে একবারও আসেনি। তা হোক। তাতে কিছু মনে করেননি তিনি। আজ ভালো লাগছে। এই ছবিটাই অনেকদিন তার কাছে ঝকঝকে হয়ে থাকবে।
বিকেল বিকেল চারপাশ হলুদ আলোয় মাখামাখি করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। হাওয়ার দেওয়ালে ঢুঁসো মারছে গাছগুলো। ইলেকট্রিক তারে কাকভেজা হতে থাকে কয়েকটা কাক। গাছের পাতা রং পালটে দু-তিনরকম সবুজ হয়ে গেল। গাছের শরীর কালচে খয়েরি। কনকপ্রভার মিনি কোত্থেকে ভিজে একশা হয়ে দাওয়ায় উঠে গা ঝাড়া দিয়ে গুটিয়ে বসল।
কতদিন পর এমন বিকেল! কল্যাণ বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে।
‘উঠেছিস! আমি ভাবলাম ডাকি এবার। এখানে ছাঁট আসছে তো। ঘরে বস না।’
‘এখানেই একটু বসি। বৃষ্টি দেখি। তুমি জান না মা, কলকাতায় বৃষ্টিও বদলে গেছে আজকাল।’
‘তাহলে এই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বস।’
‘তুমিও বসো না। কতদিন শিলাবৃষ্টি হয় না, না মা? মনে আছে তোমার? আমি আর কমল উঠোনে শিল কুড়োতে নেমেছি—
‘এইবার মার খাবি কিন্তু।’ কনকপ্রভা চেঁচাতেন। ‘ভিজে জ্বরে পড়বি, উঠে আয়।’
হেমাঙ্গ দাওয়ায় বসে, চেয়ারে। ‘মাটি থেকে শিল কুড়োনো যায়? ওরে গাধা। গামছা পেতে ধর। দাঁড়া আমি আসছি।’
অঝোর বৃষ্টি। হুড়মুড়িয়ে উঠোনে নেমেই ধড়াস করে আছাড়। কনকপ্রভা হেসে কুটিপাটি। কাদায় থেবড়ে বসে ভিজছেন হেমাঙ্গ। হাসছেন। হাসছে কমল আর কল্যাণ।
দাওয়া থেকে বাঁদিকের পুকুরটা দেখা যায় বাগানের মধ্যে দিয়ে। বৃষ্টি জলরঙের ওয়াশ ছবি আঁকছে তাতে। এই আছে, এই নেই।
এতদিন এখানে আসেনি কেন কল্যাণ? উত্তরটা জানা। তাগিদ ছিল না। আজ আচমকা এসে সে অনেক পেল। তার জন্মদিনের কথা মায়ের মনে নেই। থাক, কল্যাণ চলে যাবে চুপচাপ। যেমন এসেছিল তেমন।
‘এই নে।’ কনকপ্রভার হাতে ছোট বাটি।
‘কী এটা?’
‘পায়েস।’
‘পায়েস! করলে এমনি এমনি?’
কনকপ্রভা হাসলেন। ‘করা ছিলই। এমনি নয়। আজ তো তেরোই আষাঢ়। তোর জন্মদিন নয়!’
কল্যাণের বুক কেঁপে উঠল।
‘কী রে উঠলি যে? ধর। এখানে বসেই খেয়ে নে না।’
সামনের পুকুরে অনেকগুলো ছেলে দাপাদাপি শুরু করেছে। বৃষ্টি থামেনি। কল্যাণের বুকের ভেতরে অন্য বৃষ্টি। ‘তুমি ওটা এখন রেখে দাও মা।’
‘কেন?’ কনকপ্রভার মুখ আঁধার হয়ে আসে। ‘খাবি না?’
‘খাব। কমল ফিরুক। দুজনে একসঙ্গে খাব, রাতে।’
‘তুই যে বললি চলে যাবি!’
‘আজ যাব না।’
কনকপ্রভা একটু চুপ করে রইলেন। ‘তাহলে একটু নে।’
মায়ের হাত থেকে বাধ্য ছেলের মতো পায়েসটা খেয়ে নেয় কল্যাণ।
‘একটা গামছা দিতে পার?’
‘গামছা? কেন, কী হবে?’
‘চান করব।’ জামা খুলে ফেলে কল্যাণ। ‘আচ্ছা থাক। গামছা লাগবে না। কমলের আর পাজামা আছে তো? এটা ভিজিয়ে ফেলছি।’
‘বৃষ্টিতে ভিজবি?’
‘পুকুরে চান করব।’
‘ঠান্ডা লেগে যাবে। তোর অভ্যেস নেই।’ কনকপ্রভা তবু জোর দিয়ে কথাগুলো বলতে পারেন না। থাক। ভিজুক ছেলেটা।
ভিজে ঘাস। নরম মাটি। আকন্দ ঝোপের গোড়ায় জমে থাকা জল ছপছপিয়ে কল্যাণ বাগান পেরিয়ে পুকুরের দিকে চলে এল। সামনে ওই রূপকথার সেই মায়াপুকুর। এক এক ডুবে ওখানে দশটি করে বছর কমে যায়। ওই পুকুরে চান করতেই হবে আমাকে।
বৃষ্টির ফোঁটা ঠান্ডা আর পুকুরের জল গায়ে সেঁক দেয়। জ্বর জ্বর লাগে। হাড়ের ভেতরে শিশিরের শিরশিরানি। ডুবসাঁতার মেরে উঠে আমি স্পষ্ট দেখলাম-- পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রাণু, বুবুন, পাপাই। গামা অ্যাডভার্টাইজিং-এর অন্য দুই ডিরেক্টর। লেডি স্টেনো। অফিস সুপার সান্যাল।
আমি আবার ডুব দিলাম। জলের তলায় মায়ের গর্ভের আঁধার লগন। এখানে ফেরা যায়?
‘এসব কী হচ্ছে কল্যাণ?’
‘মিস্টার পালিত!’
‘স্যার!’
‘বাবা!’
‘সাঁতার হচ্ছে। সাঁতার।’ চেঁচালাম জোরে। ‘তোমরা বুঝবে কচু। বুঝতে হলে এইখানে নামতে হবে। মায়াপুকুরে। এক এক ডুবে দশ বছর।’ দশ আঙুল দেখাল কল্যাণ।
অঝোর বৃষ্টিতে দুরে গাছপালা আবছা।
আরও দুটো ডুব দিতে হবে তাকে। তিনটে। চারটে। কল্যাণ এবার একটা এজেন্সি খুলবে। পালিত ডুবসাঁতার এজেন্সি। ছেলেবেলা হারিয়ে ফেলা লোকগুলোকে শেখানো হবে কীভাবে, ক’টা ডুবে কোন কোন বয়েসের স্টেজে ফিরে যাওয়া যায়। ব্রাঞ্চ থাকবে গ্রাম আর মফস্সলে।
বুঝদার হাসি হেসে কল্যাণ পালিত হাত দিয়ে জল কাটল। কয়েকটা ডুব বাকি আছে তার নিজের।
3 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর উপলব্ধির চলচ্ছবি।
উত্তরমুছুনএরকম নির্ভার নির্জর কথনে অবগাহন বড় মধুর।
উত্তরমুছুনমনের মাঝে ছেলেবেলার হাতছানি ,
উত্তরমুছুনবারে বারে ফিরে ফিরে যাওয়া !
মন ছুঁয়ে গেল ।