২০১৮ সালে লেখা রুখসানা কাজল'এর সেরা গল্প : অক্টোবর বিপ্লব : মুখোমুখি নয়া অক্টোবর

গল্পপাঠ :
গল্পটি কখন ও কোথায় লিখেছেন— 
রুখসানা কাজল : 
মূলত ঢাকাতে বসেই লিখেছি। তবে কিছু অংশের নোট কলকাতায় বসে করেছি। ওখানকার গণশক্তি পত্রিকাতে রাজনৈতিক আর্টিকেল লেখা এক সাংবাদিকের সাথে আলাপ চলা কালে।

গল্পপাঠ :
গল্পটি লেখার সময়ে কি কাজ করছিলেন, কি পড়াশুনা করছিলেন বা কি লিখছিলেন—
রুখসানা কাজল : 
গল্পটি লেখার সময় কলেজ স্ট্রীট , কলকাতা থেকে সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদ সম্পর্কে অনেকগুলো চটি বই, ইশতেহার কিনেছিলাম। সেগুলো কিছু পড়ছিলাম, কিছু দেখে নেড়েচেড়ে রেখে দিয়েছিলাম এবং এগুলো আর কখনো পড়বো না বলে আমি শঙ্খ ঘোষের কবিতা সমগ্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। 

গল্পপাঠ :
গল্পটির বীজ কীভাবে পেয়েছিলেন – 
রুখসানা কাজল : 
উত্তরাধিকার সূত্রে। 


গল্পপাঠ :

এই বীজ নিয়ে কাজ গল্প লিখতে আগ্রহী হলেন কেন। কেন মনে হলো এই বিষয় নিয়ে গল্পটি লিখবেন?
রুখসানা কাজল : 
ক্রমশ বীজটা চিটা হয়ে যাচ্ছিল। ঝেড়ে ফেলে দিতে গিয়ে দেখি ঝাড়া যায় না। নিজেও বহন করতে অনিচ্ছুক এবং ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম । তাই মনে হলো, উগরে দিই সময়ের সাথে, কারো মাধ্যমে কোনো উপায়ে। 

গল্পপাঠ :
গল্পটি কতদিন ধরে লিখেছেন? কতবার কাটাকুটি করেছেন? – 

রুখসানা কাজল : 
দুই হাজার পনেরোতে প্রথম নোট রেখেছিলাম। কাটাকাটি আনলিমিটেড। এখনো বাকি আছে বলে মনে করি।

গল্পপাঠ :
লিখতে লিখতে কি মূল ভাবনা পালটে গেছে?—

রুখসানা কাজল :

হ্যাঁ । একদম। যে নায়ক ছিল বা ছিলাম সে বদলে গেছে বা গেছি। সময়ের সাথে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের একজন গল্পের নায়ক হিসেবে আপনাআপনি এসে গেছে। মূল নোট এ ছিল, লাল ঝান্ডা অটুট রহে। সেটিরও আশ্চর্য আর অবশ্যম্ভাবী বদল হয়ে গেছে লিখতে না চাইলেও। অত:পর সত্যটাকেই লিখে নিয়েছি।

গল্পপাঠ :

গল্পটি লেখার পরে প্রথম পাঠক কে ছিলেন?— 

রুখসানা কাজল : 

মহা তার্কিক অশেষ অর্ণব ইসলাম এবং বন্ধু ডঃ তপতী বর্মণ। 


গল্পপাঠ :

লেখার পরে কি মনে হয়েছে, যা লিখতে চেয়েছিলেন তা কি লিখতে পেরেছেন।– 

রুখসানা কাজল : 

কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু পারিনি বলেই মনে হয়েছে। মনে হচ্ছে, আবার লিখতে হবে। কিন্তু যা চেয়েছি তা কি লিখতে পারবো? বিভ্রম থেকেই যাচ্ছে। 



গল্প
অক্টোবর বিপ্লব : মুখোমুখি নয়া অক্টোবর
রুখসানা কাজল

কত নিদ্রা যাও রে পুত্র কত নিদ্রা যাও, দেখো কলার মান্দাসে ভাসি তোমার ডার্লিং চলি যায়— 

ছেলের রুমের ভেজানো দরোজায় মনের সুখে নক করতে করতে আমি হেসে ফেলি। শেষ লাইনটা জব্বর বানিয়েছি ত ! নাহ এবার কবিই হয়ে যাব মনে হচ্ছে । আর ঠেকানো গেল না নিজেকে ! এই বয়সে প্রতিভার এমন মহা স্ফুরণ ! ভাবা যায়! মনের ভিত্রে যখন তখন ঝিলিক মেরে উঠছে প্রতিভা আর প্রতিভা ! 

কত নিদ্রা যাও রে পুত্র --মুখের ভেতর এক টুকরো পেয়ারা পুরে দিয়ে আবার নক করি। আমার বান্দর ছেলেটা বেশিভাগ সময় কানে এয়ার ফোন গুঁজে বসে থাকে। তাও দুই কানে। প্রথমদিকে তাই কিছুই শুনতে পায় না। এটা জানি বলে দমাদ্দম দোর দাবড়ানি জারি রেখে জোরসে চেঁচাই, অশেষ অশেষ, এই অসি! হনুমান ছেলে, বের হ এখুনি--- অসিইইই— 

সামান্য শব্দ হয় এবার। যাক শুনেছে তাহলে ! আধখানা দরোজা খুলে বিরক্ত হতে গিয়েও কোনো মতে সামলে নিয়ে বেরিয়ে আসে, ব্যাপার কি মা ফাটাইয়া ডাকতাসো। দরোজা মনে হইতাসে ভাইঙ্গা ফালাইবা—হইছে কি—আর্থকুইক ? 

সর্ষেঝাল মাখা পেয়ারার বাটিটা ওর দিকে তুলে দিয়ে একগাল হাসি, খেয়ে দেখো হেব্বি টেস্ট। খাইলে পর অনেক ইনিস্পিরেশন পাইবা আনে । আমি ত খাতি খাতি এক লাইন কবিতাও বানায়া ফেলাইসি, শুনবা বাবু ? 

ওয়াও মা – থ্যাংকু, থ্যাংকু। কবিতা ? আরিব্বাস, ইউ আর রিয়েলি জিনিয়াস মাম। এখন কবিতা থাক। ফিল্ম কেমন দেখলা তোমরা ? খুব ভয়ের ? মিষ্টিরিয়াস ? মেলা হাউকাউ হইতাসে এইডা নিয়া। কি কি মেসেজ আছে এই ফিল্মের ভিত্রে ? 

অর্ধেক ভাঙ্গা টুথপিক দিয়ে টুকরো পেয়ারা গেঁথে অশেষ জানতে চায় । 



ছেলের আজ বেশ গাল্পিক মুড ! অন্যদিন ত দরোজা খুলেই বিরক্ত মুখে চেঁচামেচি শুরু করে। রোজ রোজ ওর চেঁচানি শুনে কে বলবে আমি কাকবন্ধ্যা নারী ! মনে হয় দশটা ছেলেমেয়ে চড়াও গলায় প্রাইভেসি ল জানিনা বলে ধুমছে প্রতিবাদ জানাচ্ছে ! 

আজকাল তাই সরাসরি ওকে ডাকাডাকি করি না। দরকার হলে মোবাইল করি। তাও বার কয়েক রিং না করলে বুঝতেই পারে না কেউ কল করছে। কান বন্ধ বলে ভাইব্রেটিং মোডে রাখে মোবাইল। কাঁপুনি গায়ে লাগলে বা চোখে পড়লে তবে বোঝে কেউ কল দিয়েছে। 

খুব বেশি দরকার হলে ইনবক্সে মেসেজ ছেড়ে দিই। প্রেজেন্ট পিক টাইমে এটাই ওকে ডাকার সবচেয়ে সফল কার্যকরী পদ্ধতি। সর্বক্ষণ নেট এ থাকে বলে মেসেজ দেখলেই দ্রুত রিপ্লাই আসে, হাই রুখসানা ! বলো কি দরকার ? নুন আনতে হবে ? রেড চিলি নাকি পটোটো ? তেল আছে নাকি শেষ ? লিস্টি করো মা। বার বার যেতে পারবো না কিন্তু। ওহো পোচ্চুর মশা মা। তোমার চেয়েও খতরনাক এরা। শান্তিতে কাজ করতে পারছি না। মাসকুইটো কয়েল লিস্টে রাখো। 

কি ডিজিটাল জীবন আমাদের ! একই ফ্ল্যাটের এক রুম থেকে অন্য রুম ! মা ছেলের অবস্থানভূমি দশ থেকে পনেরো ফিটের আওতার ভিত্রে । কিন্তু দূরত্ব ? মুঠো মুঠো ! অগণন। ল্যাপটপ আর মোবাইলই এখন আমাদের যোগাযোগের শেষ কথা। 

যদিও প্রায় প্রতিদিন ইনবক্সে ছবি পাঠায়। হাসির, মজার আবার পৃথিবীর কোথাও ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো না কোনো খবরের। দরকার হলেই অন লাইন শপিং এ নেমে পড়ে। খাবার থেকে শুরু করে ঘরের নানান এটা সেটা কিনে আনে। এতে অবশ্য রান্নাবান্নার ঝামেলা বেশ কমে যায় আমার। সময় বাঁচে হাতে। এছাড়া ভুতপ্রেতে আমি ভয় পাই বলে যাবতীয় ভয়ের ছবি আর মাঝে মাঝে মমির ছবি সেন্ড করে শয়তানটা। সাথে আবার লিখে দেয়, মাম মাম, তুমি মরে গেলে তোমাকে এরম মমি করে রাখবো হাহাহা। 

আমি রাগ, চড়, ঘুষি, বন্দুক, পিস্তলের ইমো পাঠিয়ে লিখি, ছিঃ ভ্যাক ! এমন বিদ্ঘুটে মা হয়ে আমি কিছুতেই থাকতে চাইনা। ওয়াক থুঃ ! 

ছেলে বাচ্চাহাতির ছবি সেন্ড করে হাহা ইমো পাঠিয়ে মজা করে। 



একেবারে ডিজিটাল ছেলে আমার। টপ টু বটম যান্ত্রিক ছাঁচে ঢালা। কথা বললে কেমন একটা ঝিম শীতলতা ঝন্নাৎ করে অন হয়ে যায় ওর গলার সুরে । কখনো কখনো দুচোখে হাং হয়ে থাকে বরফ স্থিরতা। রাত জেগে কাজ করে বলে রক্তিম থাকে দুচোখ। কোনো কোনো দিন ঘুম পুরিয়ে যখন জাগে সেদিন ওর নীল নীল পদ্মপলাশ মণিদুটো খেলা করে চোখের স্বাভাবিক পটভূমিতে। 

প্রায় প্রতিদিনই আমি রাগারাগি করি, ওরে শয়তান তোর চোখ নষ্ট হবে । হাত প্যারালিসিস হয়ে যাবে। আন্ধা ত হবিই। আর স্পাইন্যাল কর্ড বেঁকে শ্রিম্প হয়ে থাকবি সারা জীবন। সবাই বলবে, অই যে অষ্টবক্র অশেষ অর্ণব ইসলাম যাচ্ছে। আচ্ছা তোরা কি রে ! দিনকে দিন মেরুদন্ডলেস মানুষ হয়ে যাচ্ছিস। কোনো প্রেম নেই, আড্ডা নেই, টান নেই বন্ধু নেই ! এই চ্যাপ্টা বাক্সোই তোদের সবকিছু ! 

আমার কথায় একটুও পাত্তা না দিয়ে ছেলে হাসতে হাসতে মজাক করে, হ্যালো হ্যালো হাই ডার্লিং শ্রিম্পের মা ! মাই সুইটহার্ট মেরুদন্ডি আম্মুজি হাউ আর ইউ ! 

আমি রেগে মেগে নিজেও ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ি। মুচকি হেসে অই অত বড় ধাড়ি ছেলে আমার ছোট্ট কাঁধে মাথা রেখে অপার স্বস্তিতে বলে, আমরা এখন অনেক হ্যাপি আছি তাই না মা। বাসায় কোনো নয়জি নেই। ভয় নেই। অল কোয়াইট অন দ্য হোম ! 

আমার হাতের ভেতর মাউসটা গরম হয়ে ওঠে। নিজেই ভয়াবহ লজ্জিত হয়ে উঠি ওর কথাগুলো শুনে । প্রতিটি শিশুই চায় স্বস্তি, শান্তি আনন্দ। মা বাবার স্নেহসিক্ত আহলাদিত গৃহকোণ। অথচ সামান্য সামান্য স্বার্থে সংসারটাকে আমরা কেমন যুদ্ধক্ষেত্র করে তুলি ! চেয়ে চেয়ে দেখি আমাদের সন্তানরা কেমন শরণার্থী হয়ে ভেসে যাচ্ছে ! অথচ সময় থাকতে, বুঝেও বুঝতে চাই না কিছু! 

দেবি কেমন লাগলো মাম ? কেমন অভিনয় সবার ? 

ভাল। জয়াই জয়া। চঞ্চল টাইপড। টিস্যু পেপার । ইরেশ অযথা মুগাম্বা। একমাত্র অনিমেষ আইচ গুড। অতি সুন্দরী আর গুণবতী মেয়েদের স্বামিরা যেমন হয় আর কী। ভাঙ্গাচুঙ্গা কিন্তু অতি ভালো মানুষ। শক্ত মেসেজ আছে। ফিল্মের প্রথম সিন ১৮৫৭ সাল কেন যে দেখালো তা ভালো করে বুঝতে পারিনি রে। 

এইটিন্থ ফিফটি সেভেন ? ইট ইজ রিমার্কেবল ডিজিট ইন হিস্ট্রি । বাট হোয়াই, হোয়াই – কান্ট রিমেমবার--- কান্ট রিমেমবার – মাথাটা এদিক সেদিক দোলাচ্ছা অশেষ । যেনো ওর মাথাটা মনিটর। ব্রেনের হলুদ স্ক্রিনে মাঊস চালাচ্ছে হালকা আলোর, অহো ইয়েস , ইয়েস মাম – দ্যাট মাঙ্গল পান্ডে—দ্য হিরো—রিবেল—কিন্তু এই ছবির সাথে--- মাই গড এটা কি তবে সিপাহি মিউটিনি নিয়ে মেক করেছে নাকি ! 

ডাইনিং টেবিলে জমিয়ে বসে আমি হাসি, আরে নাহ্‌। মেসেজটা “মি টু” সম্পর্কিত। ভাল ফিল্ম। বন্ধুদের নিয়ে দেখে এসো। ভালো লাগবে। 

এক কথায় রাজি হয়ে যায় আমার সদা ব্যস্ত ছেলে। তাই দেখে অতি উৎসাহে বলে ফেলি, টিকিট কেটে দি ? আমার কলেজ থেকে কাছেই ত বসুন্ধরা সিনেকমপ্লেক্স ! 

এবার হেসে ফেলে ছেলে। নর্মাল প্রাণ জুড়ানো মন মাতানো সেই হাসি। ওর অই থ্যাবড়ানো মুখে হাসিটুকু যা অমলসুন্দর। এই হাসির জন্যে আরো কত শত জীবন যে আমি বাঁচতে চাই ! 

তুমি রাস্তা পেরুতে পেরেছিলে মা ? 

নিজেকে সাঁতারু ব্রজেন দাশের মত কৃতবিদ লাগে সেই মুহুর্তে। 

ঠা ঠা রোদ্দুরে, ঢাকার মহাব্যস্ত একটি রাস্তা একা পেরিয়ে যেতে পেরেছি বলে আমি ক্রেডিট নিই। ছেলে শুনতে চায়নি তবু কিভাবে পার হলাম সোৎসাহে তার অণু বর্ণনা শোনাই ওকে, বুঝলে ত বাবু, রিক্সা থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে গেলাম। দাঁড়িয়ে থাকলাম বসুন্ধরা সিটির উল্টোদিকে পান্থপথের ফার্নিচার পয়েন্টে। তারপর একজন দুজন করে অনেকে জমে গেলো। তখন ওদের সাথে একাই রাস্তা পেরিয়ে চলে গেলাম ওপারে। এক্কেবারে সোজ্জা ! 

হিহি করে আমি হাসি। যেনো আমার ফ্রক বয়েস। যেনো আমি খাটরার পলু ভাইজানের কাঁটাওয়ালা কদবেল গাছে চড়ে ঠিকই কদবেল পেড়ে আনতে পেরেছি। 

আমার উতসাহে সাহস দিয়ে ছেলে বলে, এই ত পেরে যাচ্ছো মা। এভাবে শিখে যাবে সবকিছু। বি ব্রেভ এন্ড কুল রুখসানা। 

ছেলের এই গলাটা শুনলেই কেঁপে উঠি। তবে ভেতরে ভেতরে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে সজারু কাঁটার মত। চেতনার চ্যাপ্টা বুকে ঢং ঢং করে বেজে ওঠে ঘন্টা। 

মনে পড়ে যায় সেই কুখ্যাত বছর। সদ্য কিশোর বেলা। সন্ধ্যা ঘিরে ফেলেছে উঠোনের কৃষ্ণচূড়া গাছের হলুদ শরীর। ঘরের কোণে ধূপ জ্বলছে নিভন্ত আঁচে। মা হাঁটুর উপর মুখ রেখে পাথর হয়ে বসে আছে। বাপি খুব শান্ত, ধীর গলায় আমাকে একটি আধকাঁচা ভবিষ্যত দিয়ে বলছে, সেভেন এইট প্রায় এক সিলেবাস মামনি। ও তুমি এক বছরে পেরে যাবে। ইংরেজিটা আমি দেখিয়ে দেবো। দিলীপ মাষ্টার এসে অঙ্ক শিখিয়ে যাবে। বি ব্রেভ মেয়ে। 

কথা শেষে বাপির চোখ ছুঁয়ে গেছিল মায়ের নতমুখ। সেখানে সন্তাপ আর দুঃখ হাহাকার করছিল। কিন্তু ভরপুর খুশি ছিলাম আমি। এ শহরটা যত তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারি ততই ভালো। পড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি সূচীপত্র দেখে ক্লাশের স্যার ম্যামদের অনেক আগেই বই শেষ করে ফেলি। কেবল অঙ্ক আর ইংরেজি গ্রামার পারিনা। বুঝিও না। তবু খুব খুশি হই। 

গেলো এক বছর ধরে আমাদের প্রায় একঘরে করে দিয়েছে আত্মীয়রা। এবার ঈদে আমার ফুপা সেধে এসে শ্লেষ ছিটিয়ে বলে গেছে, হযরত মুহাম্মাদের সাথে ব্রম্মা ভগবানও আপনাদের আত্মীয় হয়ে গেলো বড়ভাবি। বেচারা যিশুখিস্টো আর কেনো বাদ যাবে ! এ মেয়েটাকেও খিস্টানের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন !         

রাগে ক্ষেপে গেছিলাম আমি । ফুপার চকচকে বাটার জুতা ইঁদারায় ফেলে দিতে ছুটে গেলে মা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে কড়কড়ে গলায় ফুপাকে বলেছিল, রাজনীতির রঙ পাল্টেছো বলে কি লেখাপড়াও ভুলে গেছো ? যিশু ত আমাদের আত্মীয় হয়েই আছে। তুমি কি ঈসা নবীর কথা জানো না ? নাকি মানো না ? 

আমি আমার তরুণ ছেলেকে দেখি। আমার আলোকস্তম্ভ। এ পর্যন্ত জীবনে পাওয়া সবগুলো কাঁটা তুলে ফেলে নতুন এক রাস্তা বিছিয়ে দিয়েছে আমার সামনে। সে রাস্তায় চলতে চলতে চকিতে মনে হয়, অশেষ কি পাভেল ভ্লাসভ ? আমিও কি নিলভনা ছিলাম না কোনো জীবনে ? 

স্নেহার্দ্র হাতে আমার হাত ধরে অশেষ কি শেখায়নি, মাম দিস ইজ মাউস। পুট হিয়ার ইয়োর ফিঙ্গার। ওহ, নো। নট দ্যাট ফিঙ্গার মাম, গুড ভেরি গুড, নাউ স্লোললি প্রেস ইট---ওয়াও এই ত পেরে গেছো, ভেরি গুড মাম----কিশোরের গলায় যেনো খখলের নিষ্ঠা বেজে উঠত ! আমিও তবে ডিজিটাল জগতে ঢুকে গেলাম। 

চল্লিশের শুরুতে। ডিজিটাল মা ! মন্দ কি ! ভালোই ত লাগছে এখন। 

পেয়ারার বাটিটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে ছেলে, মা শোনো তোমাকে একটা কথা বলি । আমরা কজন বন্ধু একটা অফিস দেবো বলে ভেবেছি। ইনফ্যাক্ট ধানমন্ডিতে একটা রুম দেখেও ফেলেছি। নভেম্বরে কাজ শুরু করবো। 

আমি চুপ থাকি। বাড়িতে নিয়ম করে নিয়েছি আমরা, কেউ কথা বললে আগে তার কথাটা শোনা হবে। তারপর হবে কথকতা। দরকারে কাটাকাটি , তর্ক বিতর্ক, ঝগড়া অতঃপর মেনে নেওয়া বা না নেওয়া অথবা সমঝোতা করা। 

ছেলের কথায় অবাক হই না। আমি জানি আমাদের দু পরিবারের মধ্যে আমার ছেলে ব্যতিক্রম। ওর বড় কাজিন ভাইবোনেরা কেউ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ডাইরেকটর, কেউ ফরেন সার্ভিস, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, আর্কিটেক্ট, সাধারণ চাকুরে। আমার ছেলে শিল্পী। শিক্ষাগত যোগ্যতায় চার্টার্ড একাউন্টটেন্ট। মনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের এসিসিএ করেছে। মন ও মননে ও জাত শিল্পী। 

দু বছর আগেও এভাবে একবার ছেলে তার মনের কথা বলেছিল, আমি শুধু তোমার জন্যে সিএ করছি মাম। কিন্তু সিএর চাকরি আমি করবো না। আমি ক্রিয়েটিভ কাজ করবো। আই এম এ ক্রিয়েটার। জাস্ট আই প্রে ইউর সাপোর্ট প্লিজ মা। 

আমি সে সময় আঁতকে ওঠে বলেছিলাম, বাবু সিএ রা জানো চল্লিশ বছর বয়সে কোটি কোটি টাকা ইনকাম করে ফেলে। কত বড়লোক হয় ওরা। শিল্পী হয়ে কি হবে বাবা। গরীব হয়ে থাকবে ত ! এই যে খর্চার ভয়ে গাড়ি ছেড়ে দিতে হলো দেখলে ত তুমি। 

টাইম আপগ্রেড হচ্ছে মা। এভরি ডে সময় বদলাচ্ছে। মানুষের চাহিদা আর কাজের বদল হচ্ছে। তোমরা আমাকে এনিমেশন পড়তে পাঠাতে পারতে। প্রীনীতা পড়ে এলো। আমি ত অমুক ভাইয়ার মত নই যে ইংল্যান্ডে স্টাডি ছেড়ে ড্রাইভিং করতে নেমে পড়তাম! 

ছেলের গলায় অভিমান বেজে উঠতে নিজেই আবার দ্রুত গিলে ফেলেছিল সেদিন। 


সে ছিল এক ক্রান্তিকাল । একটি কঠিন পারিবারিক ধাক্কায় ছেলেটা নিজের আবেগ, চাওয়া , ইচ্ছাগুলো বদলে ফেলেছিল। ষোল বছরের ছেলে অসীম স্থিরতায় বাঘা বাঘা পারিবারিক ব্যক্তিত্বের সাথে আলোচনায় বসেছিল। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে মাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল যৌথ পারিবারিক সিদ্ধান্তের বাইরে। এই দশ বছরে ঠিকই আদায় করে নিতে পেরেছে ছেড়ে আসা পরিবারের সম্ভ্রম। ফেলে আসা মায়া ভালোবাসা। 

কিন্তু নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে এই রিস্ক নেওয়া কি ঠিক হবে ? 

ছেলের কাঁধ চওড়া। বৃষস্কন্দ। মাঝারি হাইট। ওর পিতামহী এমন ছিলেন। শুধু কি এমন ? প্রচুর সহ্য শক্তি ছিল আমার শাশুড়িমার। তিন তিনটে সন্তান প্রসবকালে জরায়ু থেকে প্রথমে পা বের করে দিয়েছিল শিশুরা । তিন তিনবার তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে তাদের স্বাভাবিক জন্মদান করেছেন। শ্বশুরসাহেব তবু আরো সন্তান চেয়েছেন। হয়েছেও। শিউরে উঠেছি সেই গল্প জেনে। তবু শাশুড়িমার মুখে স্নেহ রঙে আঁকা ছিল মাতৃত্বের চিরন্তন চিত্ররূপ। 

মা বিরক্ত লাগত না ? রাগ হতো না আপনার ? দেশে ত পঞ্চাশ সাল থেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালু ছিল ! 

তোমার শ্বশুরসাহেব চাননি। আর একজন সরকারি অফিসারের বউএর লুকিয়ে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহন করা তখনকার দিনে অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আমি জীবনের ঝুঁটি ধরে বেঁচেছিলাম মা। কষ্ট হয়েছে। পেয়েছি তারও বেশি। তবু সন্তানদের বাঁচিয়েছি, নিজেও বেঁচেছি। 

শাশুড়িমার ঝুরি নামা হাতদুটো ধরে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, আমার যে ভেঙ্গেচুরে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে মা। এই আদর্শচ্যুতি অসহ্য ! কিছুতেই মানতে পারছি না। এ ত জীবনের সাথে জীবনের বিশ্বাসঘাতকতা। 

আমার হাত ধরে উনি কথা দিয়েছিলেন। যৌথ সিদ্ধান্তের বাইরের একটি জীবন উনি আমাকে দিতে চেষ্টা করবেন। তুমি কি পারবে মা ? 

আমি কি পারবো ? আমার সকল অক্ষমতা রে রে করে ঘিরে ফেলেছিল আমাকে। প্রথম ধাক্কায় আমি উচ্চবিত্ত শ্রেণী চ্যুত হবো। নুন আনতে পান্তা ফুরাবে আমার। 

আমার হয়ে সেদিন লড়ে গেছিলো অশেষ। সেদিন থেকে ওর হাড় চিনেছি। ওর জাত আলাদা। ইদানিং ভয় হয়। ছেলেটা পুরুষ হয়ে উঠছে। কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না বা বুঝতে চায় না। কিছুটা আত্মমগ্নও বটে। এমন পুরুষ কি কোনো মেয়ে পছন্দ করবে ? মেনে নিবে ? 

ও নিজেও বোঝে এই ব্যাপারটা। তাই অকপট বলে দেয়, প্রেম ঝামেলার লাগে মাম। আর বিয়েটা ত স্রেফ লস্ট প্রজেক্ট। তোমরা কি করে যে এত এত প্রেম করো--- উফফ্‌ হোলি শিট্‌ ! 

নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে থেমে যায় ছেলে, আজ কত তারিখ মা ? কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন ত— 

এঁটো বাটি গুছোতে গুছোতে আমি হাসি। সকালে দুটি ছোট্ট গোলাপ ফুটেছে দেখে ছিঁড়ে এনে পরিয়ে দিয়েছি কার্ল মার্কসের ছবিতে। এটা অক্টোবর। ছেলের জন্ম মাস। বাপির মৃত্যু মাস। এ মাসেই শতবর্ষ আগে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা কেরেনস্কিকে হটিয়ে কম্যুনিস্ট সমাজব্যবস্থা গঠন করেছিল রাশিয়ায়। এ মাসের প্রতিটি দিন রাত আমার প্রিয় ও পবিত্র। 

বই গুছোতে গিয়ে “শতবর্ষে মহান অক্টোবর বিপ্লব” নামে কতগুলো স্যুভেনির পেয়েছিলাম সকালে। কেনো যে এমন মায়া লাগে এসব স্যুভেনির, বই, ফিল্ম দেখতে। কেন যে এত দুলে ওঠে বুক ! কেন যে কেঁদে ফেলি দেশে দেশে লেনিনের ভাঙ্গা স্ট্যাচুর টুকরো আর বিলীয়মান লাল পতাকা দেখে ! 

ঘর বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে আবার মেপে নেই। যে কোনো ফোকাস থেকে বহু দূরে থাকি আমি। ঘন আম্রপল্লবের নিচে একটুকরো নরম আলোর মত আমার অবস্থান। মাঝে মাঝে কিছু লিখি। পড়ি তার চেযে শতগুণ। পরাজয় বলে কোনো শব্দকে আমি মানিনা। জয় শব্দটাও মালা থেকে ছেঁড়া ফুলের মত আমার কাছে। আমি নীরবতায় আমার মত করে বেঁচে আছি। নীরবে খুঁজে চলেছি ভুলটা ঠিক কোথায় ছিল যে মার্ক্স লেনিনে উইপোকা ধরে গেলো! 

দু রুমের মাঝখানে ফয়্যার । ছায়াছন্ন আলোময়। বৃষস্কন্দ তরুণটি হাত তুলেছে। খোলা মুঠি। সামান্য বেঁকে যাওয়া একটি ফুল ঠিক করে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। চকিতে মনে হলো, ও কি কোনো শ্লোগান দিতে হাত তুলেছিলো আমাদের সেই উত্তাল নব্বুইয়ের মত ! ও কি বলতে চেয়েছিল, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক !! 

ইনবক্সে লাল আলোর ফুটকি ভেসে ওঠে, হাই মাম! লাভ য়ু মা। 

লাভ লাভ ইমো দিয়ে ল্যাপটপ ছেড়ে বেরিয়ে আসি বারান্দায়। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। অলকানন্দা ফুলগাছ চারটি ফুল দিয়ে নিজেকে আবার গুটিয়ে নিয়েছে পাতার আড়ালে। থাই কামিনী ফুটছে ঝরছে। ফুলছেঁড়া গোলাপগাছের পাশে গিয়ে বসে থাকি। ধানরঙ রোদ্দুর খোপ খোপ আল্পনা এঁকেছে বারান্দার ফ্লোরে। পাতারা সেই খোপে দুলে দুলে নানা রকম ছায়া রং দিয়ে ছবি বানাতে ব্যস্তসমস্ত। ছবিগুলো দুলছে, ভাসছে হঠাত হঠাত মুছে যাচ্ছে। 

মা জানো একটা বিগ ক্লায়েন্ট পেয়েছিলাম। আমরা নতুন বলে ওরা সময় নিচ্ছে। কাজটা হয়ত আমরা পাবো না। ব্যাড লাক। হাতে হাত ঘষে বারান্দার কালো দরোজায় ঠেস দিয়ে এসে দাঁড়ায় অশেষ। গালের প্রশস্ততায় নরম দাঁড়ির যথেচ্ছাচার, কফি বানাবে মা ? লং ব্লাক কফি ! টেনশন হচ্ছে। এনার্জি লাগবে আমার। 

বারান্দার দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আরামসে বসে থাকি, তুমি বানাও না প্লিজ । আমাকেও দিও। শর্ট ব্লাক। চিনি মাস্ট । 

ওহ সিওর। 

শোন পানিচুনি ফেলবে না কিন্তু। আর চুলো মুছে রাখবে। 

হিটলারের ভাগ্নি বলে টিজ করে চলে গেল কিচেনে। 

শীতকাল আসে এক বোঝা বিষণ্ণতা সাথে করে। সন্ধ্যাগুলো ভেজা স্যাঁতসেঁতে হয়ে ঝুলে থাকে ঘরের আনাচ কানাচ, সোফার হাতলে, ডিভানের শোল্ডারে, ভাঁজ করা শাড়ি জামাকাপড়ের ফাঁক ফোঁকরে। সবকিছু পুরনো আর বাতিলযোগ্য বলে মনে হয়। দিনগুলো ছোট আর রাতগুলো দীর্ঘ বিরক্তিকর ! 

বিরানব্বুয়ের এক শীতসন্ধ্যায় শেষবার অক্টোবর বিপ্লবের উপর একটি ফিল্ম দেখেছিলাম আমরা। বরফ বরফ বরফ। বিস্তীর্ণ সেই বরফের আড়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল বিশাল এক লাল পতাকা। সাথে উল্লসিত বলশেভিক বাহিনী । মাথায় ভারি টুপি। দীর্ঘ ওভারকোট ঢেকে রেখেছে তাদের শীতার্ত শরীর। যারা সেদিন ফিল্মটি দেখছিল তারা চেঁচিয়ে উঠেছিল বিশুদ্ধ আবেগে, কমরেড! কমরেড ! লাল সালাম কমরেড। আহ রাশিয়া! ওহো সোভিয়েত ! 

গর্বাচভকে গালাগাল করে যারা সেদিন মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল তাদের কেউ কেউ এখন শিল্পপতি, ধর্মীয় দলের উপদেষ্টা, এনজিও সংগঠক, লালসালিপ্ত মদ্য ধনকুবের, বামাতি আর সময় সুযোগ বুঝে যে কোনো সরকারের পদ চাটুকর। যারা এসব পারেনি হতাশায় তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর কোলে। আর কেউ কেউ স্বপ্ন ভাঙ্গার বেদনায় জারিত হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনস্রোত থেকে। তবু ভালবাসাটা হারায়নি কারো কারো । দুর্বলতম ঘুমের ভেতর তাদের কেউ কেউ এখনো স্বপ্ন দেখে হাত মুঠো করে থমকে যায় ! শত শত খন্ড লেনিন, টুকরো টুকরো মার্ক্স এঙ্গেলস আর ছেঁড়া খোঁড়া লাল পতাকা সিল্যুট হয়ে আছে স্বপ্নের দেয়ালে। 

য়ুনো মা, হান্ড্রেড আনিভার্সারি অফ দ্য অক্টোবর রেভিলিউশন নিয়ে রাশিয়াতে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। 

আমি কাপে মুখ ডুবিয়ে মাথা নাড়ি। জানি। বিশ্বের কে না জানে এ খবর ! এতো সাড়ম্বরে প্রচারিত হট এন্ড হেট নিউজ। অবশ্য বাংলাদেশে পালিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাম দলগুলো শতবর্ষজীবী অক্টোবর বিপ্লবকে মন থেকে ভোলেনি। 

কজ এখানে ক্যাপিটালিজম ফুললি কাজ করছে। বলা যায় ক্যাপিটালিজম পেকে উঠছে বাংলাদেশে। কর্মক্ষেত্র বেড়েছে। ম্যক্সিমাম পিপল মোটামুটি আছে। ধনীদের সংখ্যাও প্রচুর। বকধার্মিকরা কা কা করছে। তবে অনিবার্যভাবে এটা থেকে কখনো সমাজতন্ত্র আসবে না। 

আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাতে ছেলের মুখ দেখি। ডাবরের মত গোল মুখের আধাখানা দেখা যাচ্ছে। প্রাচীন মঙ্গোলিয়ান ছাঁদ। সামনের নিউরোলজি ক্লিনিকের লাল বিল্ডিং বেয়ে ওঠে যাওয়া মাধুরীলতা আর বোগেনভিলিয়ার সন্মিলিত উর্ধ্বচলন দেখছে নিবিষ্ট অনিমিখে। গলগলিয়ে ধোঁয়া উড়ছে কালো কাপের অগভীর গহ্বর থেকে। তাতে ড্রাই কফির সুগন্ধ। 

মুখের কাছে কাপটা নিয়ে অশেষ জানায়, তুমি আমাকে অপরচুনিস্ট বললে বলতে পারো মা। বাংলাদেশের এই অবস্থাকে আমি ক্যাশ করতে চাই। কর্মযজ্ঞের এই সুযোগ আমি ছাড়বো না। টাকা বানাবো। অনেক টাকা। মানুষকে কাজ দেবো। শিক্ষাব্যবস্থার গণতান্ত্রিক অধিকার আর সরকারি সুযোগ নিয়ে যারা উঠে আসতে পারবে তারা আসবে ! দশজনকে যদি কাজ দিতে পারলেও মনে করবো আমি কিছু করতে পেরেছি। 

ফুল না ধরা রঙ্গনগাছ পেঁচিয়ে উঠে যাচ্ছে অপরাজিতা গাছের ডগাগুলো। গেলো দুটো বছর ওর উপর রাগ জমেছিলো মনের ভেতর। নাম করা কোম্পানীর স্বাস্থ্যবান বেতনের কয়েকটি অফার ছেড়ে দেওয়ায় চিন্তিত ছিলাম ওর উদ্দেশ্য নিয়ে। আজ প্রকাশ্য হলো জীবন নিয়ে ওর উইশ। 

বাংলাদেশের ব্যবসা জগতের কয়েকটি কালো নাম উল্লেখ করে আমি জানাই, তুমিও তাহলে --- 

ব্যবসায় অনেস্টি দরকার মাম। ব্যবসায়ী আর কালোবাজারি এক নয়। আর জানো ত এখন চাকরিজীবীরাও কালো টাকায় পোষমানা ময়না। 

ঘটনা সত্যি। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে টাকা। প্রতিটি সরকারের ছোট বড় মন্ত্রী, আমলা তাদের সমর্থক, কাছের, দূরের লতায় পাতায় আত্মীয়রা সামান্যতম সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বাড়তি টাকা আয় করে নিচ্ছে নির্লজ্জ সহাস্যে। অর্থনীতির মাত্রাছাড়া উল্লম্ফন। কম্যুনিস্ট নীতিবাগীশ পরিবারগুলোও কোন না কোন তেলালো সূত্রে জুড়ে যাচ্ছে টাকাবাগীশদের সাথে। কমিউনিস্ট দল বলে কিছু নেই এখন। যারা আছে তারাও সুযোগসন্ধানী ঘাগু ময়না। তারা শ্লোগান দেয়, মিটিং মিছিলে সরকারের বিরোধীতা করে। তার বদলে ঘরে বাইরের মোটা টাকা পকেটে পুরে বিপ্লবী হয়ে এনজিও চালায়। মধ্যবিত্তের স্থায়ী ব্র্যান্ডের একটি তরুণ এর বেশি আর কি এমন স্বপ্ন দেখতে পারে এই মাৎস্যন্যায় সময় কালে ! 

ছেলের দিকে করুণা নিয়ে তাকাতে দেখি দৃঢ় চোয়ালে নরম আত্মবিশ্বাস ছায়া ফেলেছে। বাঙালী বধু হয়ে আসা রাশান মেয়ে স্তালিনাভাবি বলেছিলো, মনের মুক্তি ছিল না সোভিয়েত রাশিয়ায়। পদে পদে পাহারা। রাতদিন শ্রম শিবিরের আতঙ্কে কাঁপত প্রাণ। মানুষের মনের অতলান্তে ক্ষোভ জমেছিল। বিশাল ক্ষোভ। মানুষ ত স্বভাবত স্বাধীন তাই না ! কাজেকর্মে, শিল্প সাহিত্য বোধে, খেয়ে পরে বাঁচতে বাঁচাতে সে ত নিজের মত করে থাকতে চায়। মার্ক্সের থিওরি কি মানুষের প্রাণের মুক্তি খুন করার থিওরি ছিল ? 

কাপদুটো গুছিয়ে উঠে আসতে গেলে ছেলে হাত বাড়িয়ে দেয়, আমায় দাও। ধুয়ে রাখি। 

গভীর কষ্টে হাসি, তুমি যাও। তোমার কাজ করো। 

দুপা এগিয়ে গেলে আমার পা জড়িয়ে ধরে আশ্রিতের নম্রতায়, প্রে ফর মি মা। আমি শুধু মানুষ হয়ে থাকতে চাই। অনেক অনেক কাজ করার আছে এখন। মানুষ কাজ চায়। রাজনীতি নয়। 

আমি হাতের কাপদুটো দেখি। কাপ না থাকলে গ্লাস কিম্বা বাটিতেও পানিজল, চা, কফি দুধ শরবত খাওয়া যায় কিন্তু যদি পানিজল, চা, কফি, দুধ শরবত না থাকে ? 


লেখক পরিচিতি
রুখসানা কাজল 
জন্মস্থানঃ গোপালগঞ্জ।
 জন্মতারিখঃ ২৩ নভেম্বর।
 বর্তমানে ঢাকা বাসি। 

প্রকাশিত বই--
১। তোমার জন্যে মেয়ে, অনুপ্রাণন প্রকাশনী ঢাকা 
২, আহা জীবন, চিত্রা প্রকাশনী ঢাকা 
৩। নুনফল গল্পগুলী, রসেবশে প্রকাশনী, কলকাতা 
৪। জলের অক্ষর নালন্দা প্রকাশনী, ঢাকা । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. গল্পটির শেষ নিয়ে একটু ভাবা যেত। একটু গতানুগতিক হয়ে গেল যেন। কিন্তু এই গল্প আরম্ভ থেকে অনেক দূর অসামান্য। মা ও ছেলের ডিজিটাল জীবন, ছেলের আর্টিস্ট হওয়ার লক্ষ্য, সোভিয়েত ভেঙে যাওয়া......সবই চমৎকার। কিন্তু শেষে কেন 'এখন মানুষ কাজ চায়, রাজনীতি নয়' এমন কথা......কেমন হয়ে গেল সবটা। অথচ এত ভালো লাগছিল প্রথম থেকে বহুদূর। আপনি ভাবুন। আপনার লেখা সুন্দর।

    উত্তরমুছুন
  2. দুর্দান্ত গল্প! অন্য সবার মত আমারও মত শেষটা নিয়ে।

    উত্তরমুছুন