অভিজিৎ সেন'এর গল্প : মানুষের পিছন দিক

রাধিকার এখন কাঁদার পালা। চিৎকার চেঁচামেচি করে সে কাঁদছে না বটে, কিন্তু কান্নার তার যেন আর বিরাম ছিল না। গত দুদিন ধরে সে খালি কেঁদেই যাচ্ছে। বিশ বছর আগে সে যখন অবনীর চোখের সামনে উদয় হয়েছিল, তখন কিন্তু তার চোখে জল ছিল না। তার চোখে তখন কোনও প্রত্যাশাও ছিল না, আবার হতাশাও ছিল না।

কিন্তু সে সময়ে তার চোখে শূন্যতা ছিল না, এটা ঠিক। আবার যদি কেউ সে সময় তার চোখমুখে কিছু প্রাপ্তি খুঁজত, তাও কি পরিষ্কার খুঁজে পেত? সত্যি কথা বলতে কি, সেই বিশ-একুশ বছর আগে অবনী যেন সে রকমই কিছু তার চোখে খুঁজতে চেষ্টা করেছিল। তাকে সে গোপনে লক্ষ্য করছিল। রাধিকাকে সে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল না। সে একটা অদ্ভুত সময় তাদের জীবনে। কেননা, রাধিকার চোখেমুখে কোনও প্রাপ্তি ধরা না পড়লেও শরীরে তা সাড়ম্বর ছিল। শরীরে তো লুকোবার কোনও ব্যবস্থা নেই। অবনীর সঙ্গে বিবাহিত জীবনের ছ-সাতটা বছরে একবারও তো শরীর এভাবে বিকশিত হয়ে ওঠেনি তার। হতাশায় নিজেকেই সে অভিশপ্ত ভেবেছিল। নিজেকেই দোষারোপ করেছিল রাধিকা। সে তখন খুব বোকাও ছিল। সে জানতই না, এই দোষের ভাগীদার, এমনকি পুরো কারণটাই অবনী হাতে পারে। সেই অদ্ভুত সময়ে, যা আসলে ছিল দারুণ দুঃসময় মানুষ নিজের থেকেই অনেক কিছু বুঝে যায়। রাধিকাও বুঝে গিয়েছিল দোষটা সম্পূর্ণ অবনীরই। সেই দুঃসময়ে সমস্ত নিয়মকানুনও ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। তাই যায়। স্বাভাবিক সময়ে যা মনে হতে পারে ভীষণ অন্যায়, মনে হতে পারে এমন ভাঙন, যা আর জোড়া লাগার কোনও উপায়ই নেই, এমন বিপর্যয় যা থেকে আর উদ্ধারই নেই, কালক্রমে সব ঠিক হয়ে যায়। আসলে ঠিক হওয়া ছাড়া মানুষের তো কোনও উপায়ই থাকে না কিনা। তোমার যদি একখানা অঙ্গ কাটা যায়, তুমি কী করবে? অঙ্গ ছাড়াই তো বেঁচে থাকার অভ্যাস করবে? কিন্তু রাধিকা এখন আর এসব বুঝছে না। সে কেবল কেঁদে যাচ্ছে। তার কান্না দেখে মনে হচ্ছে, কোনওদিনই এ কান্না সে থামাতে পারবে না। আরও বিস্ময়ের যে অবনী তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করছে না। দাওয়ার এক কোণে সে আড়ার সঙ্গে বাঁধা একগাছা জাল বুনতে নিজেকে যেন অনন্তকালের জন্য নিযুক্ত করে রেখেছে। চোখে পড়ে, কি পড়েনা, এ রকম এক চিলতে হাসিও কি ঠোঁটের পাশে লেগে আছে তার? 

এই বিশ-বাইশ বছর ধরে কান্নাটাকে লালন করলেও রাধিকা বোধহয় শেষ পর্যন্ত আশ্বস্তই হয়ে গিয়েছিল যে এ জীবনে নতুন করে আর ওসব কথা উঠবে না। সে নিজেও ওঠাবে না, ওঠাবে না অবনী। ওঠাবে না অন্য কেউ। এই অন্য কেউ বলতে একমাত্র নন্দাই গিরিন ছাড়া, আর তো বিশেষ কেউ ছিলই না। আর তারা সবাই জীবনের কাছ থেকে কিছু নতুন বন্দোবস্ত শিখেছিল। না হলে মানুষের বাঁচার আর কোনও উপায়ই যে থাকে না। 

সে রকম একটা নতুন কথা দিন পনের আগে রাধিকা তার ছেলেকে বলেছিল। রাধিকা বলেছিল, বুঝলু আনন্দ, মানুষ তার পিছনটা বেশি জানে না। যদি জানত, তা হলে খাওয়াখাওয়ি, মারামারি বোধহয় অ্যানা কমই করত। 

রাধিকা কুসুমপুর থেকে আনন্দকে প্রায় ধরেই নিয়ে আসছিল। কুসুমপুর থেকে জীবনসাগর দশ মাইল রাস্তা টাঙায় করে আসতে হয়। রাধিকা এবং আনন্দ আরও কয়েকজনের সঙ্গে টাঙায় বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল। শেষ পর্যন্ত দশজন লোক নিয়ে টাঙাটা চলতে শুরু করেছিল। ভিড়ের মধ্যে গাদাগাদি করে কোনওমতে বসা। তারা বসেছিল টাঙাটার পিছনদিকে পা ঝুলিয়ে। নানারকম কথা বোঝাতে বোঝাতে রাধিকা ছেলেকে ওই কথাটা বলেছিল। 

আনন্দ মায়ের এত সব কথাতে খুবই বিরক্ত হচ্ছিল। আসলে মা যে তাকে ধরে নিয়ে আসছিল, এ ব্যাপারটা তার আদৌ ভাল লাগেনি। কিন্তু করবেই বা কী? মাকে যে সে ভীষণ ভালবাসে। তবুও তার মনে হচ্ছিল এইসব মেয়েমানুষেরা আসলে কিছুই বোঝে না। কুসুমপুরে একটা আশ্রম আছে। আনন্দ বেশ কিছুদিন ধরে সেখানে যাতায়াত করছে। সেখানে একটা বড়সড় যাত্রার আয়োজন হচ্ছিল। আশ্রমের কর্মকর্তারা এবং বাইরের দু-চারজন লোক কোনও একটা বিশেষ অভিযানের প্রস্তুতি করছিল। সেই যাত্রা বা মিছিল যেন একটা ক্রুদ্ধ প্রতিবাদের, লড়াইয়ের প্রস্তুতি। আনন্দ নিজের মধ্যে উন্মাদনা টের পাচ্ছিল বেশ কিছুদিন যাবৎ। সে ঠিক করেছিল, এই মহাযাত্রায় সেও যাবে। তাতে যদি শেষ লড়াইতেও তাকে অংশ নিতে হয়, নেবে সে। আশ্রমের এক স্বামীজি তাকে বলেছিল, ঠিক রামচন্দ্রের মত চেহারা তোমার। পদ্মপলাশের মত চোখ, আজানুলম্বিত বাহু, বীরত্ব সারা শরীরে। অযোধ্যা মুক্ত করতে তো তোমাকেই যেতে হবে, বাবা। 

আশ্রমে রামচন্দ্রের ছবি দেখেছিল আনন্দ। বীর, দর্পহারী রাম। হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। ধনুকে আকর্ণ জ্যা টেনে অগ্নিমুখী বাণ ছেড়ে দিয়েছে সে শত্রুদের দিকে। দেখলে গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সন্ন্যাসীর কথা শুনে একসময় সত্যি সত্যিই নিজেকে তার রামচন্দ্র বলেই মনে হতে শুরু করেছিল। সে-ই রামচন্দ্র! ইস্ ভাবা যায় না! যাবে সে অযোধ্যায়! 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার যাওয়া হয়নি। রাধিকা দুদিন ধরে তার সঙ্গে লেগে বসেছিল যেন। ছেলেকে অনর্গল বুঝিয়ে গেছে সে। বুঝিয়েছে, ওসবে আমাদের কোনও দরকার নেই। কারুর কোনও কাজ নেই ওসব ব্যাপারে। সে বলছিল, বুঝলু আনন্দ, মানুষ তার পিছনটা বেশি জানে না--, এইসব কথা। বলেছিল, এ মানুষগুলো কোথায় নিয়ে যাবে তোদের? কী চায় এই মানুষগুলো? 

তাতে আনন্দ আরও উত্তেজিত হয়েছিল। বলেছিল, তুমি কী বুঝবে? কী বুঝবে তুমি, আমাদের যত অভাব অভিযোগ, সবকিছুর জন্য ওরাই দায়ী। ওদের জন্যই আমাদের এত দুঃখকষ্ট। অথচ ওদের-- 

সেই টাঙার দশ জনের মধ্যে ছ'জনই আনন্দর 'ওরা'। আসলে তাদের জীবনসাগর থানায় ওদের সংখ্যাই বেশি কিনা। রাধিকা চাপাগলায় জিজ্ঞেস করেছিল, ওই লোকগুলো তোর শত্রুর? ওই মেয়াদুটা, ওই চেংড়াটা? আর ওই টাঙাওয়ালা? 

এইভাবে আনন্দকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল রাধিকা। কিন্তু আনন্দ শান্ত হয়নি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে, যেন তার আরব্ধ কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে, প্রতিজ্ঞা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। তাতে তার ক্রোধ বাড়ল, অস্থিরতা বাড়ল। সে যা সত্য বলে জেনেছিল, তার বাইরে আর সে কিছুই দেখতে পায় না। তার অসাধারণ চেহারা তাকে আরও অহঙ্কারী করেছিল। এক সময়ে তার সত্যি সত্যিই ধারণা হয়ে গেল যে সে-ই রাম! অযোধ্যায় তাকে যেতেই হবে। 

রাধিকা তার অস্থিরতা দেখে রাত্রে অবনীকে বলল, ও কী পাগল হয়ে গেল? কোথায় কোন্ বিপদে গিয়া নিজের আর পরের সব্বোনাশ করবে! 

অবনী বলল, কত কথা শুনছি চারদিকে। কিন্তু এ সবের মধ্যে ও গিয়া পড়বে, এ কথা ভাবতে ভাল লাগে না। একবার গিরিনকে খবর দি, কি বল ? 

সেই ভাল। 

গিরিন রাধিকার নন্দাই। কৃষক আন্দোলন, পঞ্চায়েত, পার্টি ইত্যাদি করা শক্ত লোক সে। গিরিন অবনীর বাল্যবন্ধুও। সে থাকে পাশের থানায়। বিশ-বাইশ বছর আগের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সে-ই। বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান মানুষ। আসুক সে, এসে বোঝাক আনন্দকে। 

খবর পেয়ে বউ গৌরীকে নিয়ে গিরিন এসে হাজির হল। ওপরে শক্ত লোকটার ভিতরটা তরল। সে শুধু দু-একজনই জানে। তার মধ্যে রাধিকা একজন। গিরিন বলল, আবার কি হল? 

রাধিকা বলল, সে হবে'খন। আগে বসো, জিরাও, খাওয়া-দাওয়া কর, তাবাদে কথাবার্তা হবে। 

গিরিন বলল, যা বাব্বা! এ দেখি গম্ভীর ব্যাপার। আমি ভাবলাম ব্যাটার বিয়াটিয়া। লাগাবে, সেই তংকে ডাকা। 

কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কথায়বার্তায় বেরিয়ে পড়ল আসল কথাটা। রান্নাঘরের সামনের দাওয়ায় উবু হয়ে বসে গিরিন সেই পুরনো রসিকতাটা আরেকবার করল। বলল, অংকাই হয়, অংকাই হয়। হাতের কাছে আমরা এতজনা থাকতে মোছলমান দিয়া ছাওয়াল বানাতে গেল! 

গোরী বলল, ইস্ সারাদিন চাষাভুষার সঙ্গে থাকতে থাকতে মুখটাও চাষাদের মত হয়ে গেছে। বুড়া হল, তবু আক্ষেপ গেল না। 

রাধিকা গিরিনকে তীব্র কটাক্ষ করল। মুখে বলল, আবদার! 

গিরিনের আক্ষেপ কি শুধু রসিকতাতেই? মানুষ বড় হতভাগ্য। আর কোনও জানোয়ারের মুগ্ধতা নেই। মানুষের মুগ্ধতা আর কিছুতেই যায় না। সে বলল, মরে গেছি। বউ, তবু আরও একবার ওইভাবে চোখ ঠারো। রাধিকা বলল, না জামাই, হাসিঠাট্টার কথা নয়। আনন্দর ভাব ভাল বুঝি না। 

গিরিন বলল, ও ঠিক হয়ে যাবে। ও তো আর বোকা, কি বজ্জাত চেংড়া নয়। আমি কথা বলব ওর সঙ্গে। তুমি আরও একটু চা খাওয়াও তো। 

কিন্তু অবনী একসময় বলল, গিরিন, সেই সময়টা এসেছে। গিরিন তখন চমকে উঠে তার চোখে চোখে তাকাল। 

—কোন সময়টা? 

—বিশ বছর ধরে আমরা যা শিখেছি, আনন্দকে এখন আচমকাই শিখাতে হবে। জালের ফাঁদ একটার পর একটা আটকাতে আটকাতে অবনী বলল, রেহাই নাই, মানুষের রেহাই নাই। 

প্রায় তক্ষুনি আনন্দ বাড়িতে ঢুকল। রাগী, বিরক্ত, সুন্দর, দৃপ্ত আনন্দ। 

গিরিন অনেকদিন বাদে ভাল করে তাকিয়ে দেখল তাকে। খুব ছোট থেকেই পিসার সঙ্গে খুব ভাব আনন্দর। খুব অত্যাচার করত গিরিনকে। তাতে বিরক্ত না হয়ে মজা পেত গিরিন। খেপাবার জন্য বলত, তুই তো মোছলমানের ছাওয়াল। রাস্তা থিকা আমরা তোক কুড়ায়ে আনিছি। হাসপাতালের সামনে কোন্ মোছলমান যেন ফেলায়া গিছিল তোক্‌। 

শিশু আনন্দ খুব রেগে যেত। 'শালা, শুয়ারের বাচ্চা', বলে পিসার চুল ধরে ঝুলে পড়ত। 

গিরিন খুব ভাল মানুষের মত বলত, আমার কথা বিশ্বাস না হয় নিজের মা-বাপকেই জিজ্ঞেস কর। 

খুব রেগে যেত আনন্দ। কেঁদে, চেঁচিয়ে, দুমদাম করে কিল ঘুষি মারত গিরিনের পিঠে, বুকে। গিরিন বলত, থাম্ থা—আরে থাম্। তারপর যেন অকাট্য প্রমাণ হাজির করত। 

প্রতিবেশী মুসলমান শিশুদের তুলনা তুলে গিরিন বলত, এই দেখ, তোর নংকু হামিদ, লতিফের মত, আগাকাটা। বিমল, রতনের তো এংকা নয়! 

সেই পাঁচ-সাত বছর বয়সেই আনন্দ এ সব জানত। তার সত্যি সত্যিই দ্বন্দ্ব লেগে যেত। প্রতিবেশী শিশুদের শিশ্নের সঙ্গে নিজের শিশ্ন মিলিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখত। 

এতকাল পরে গিরিনের হঠাৎ মনে হল, সেই নির্বোধ রগড় থেকেই কি আনন্দের মনে সে বিরোধের বীজ রুয়ে দিয়েছিল! অথচ এই বিশ বছরে সে, অবনী, রাধিকা, এমনকি গৌরীও কি অন্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়নি? মানুষ তার পিছনকে কতখানি জানে? কতখানি পিছন সে দেখতে পায় বা দেখা সম্ভব? 

সেই শৈশবের মতই আনন্দকে ডাক দিল সে। বলল, 'এই শালার বেটা শালা, মোছলমানের ছাওয়াল, সামনে খাড়া হ'! 

আনন্দ দাঁড়াল বটে কিন্তু তার রক্তাভ চোখদুটিতে ঘৃণা ও ক্রোধের আগুন ধিক্‌ধিক্‌ করে উঠল। ভু কুঁচকে গেল তার। রৌদ্রতপ্ত আরক্ত দৃপ্ত চেহারাতে অসম্ভব অহঙ্কার তার। পিসি-পিসার আসা টের পাওয়া মাত্রই সে বুঝতে পেরেছিল, এ সব ব্যবস্থা তার জন্যেই। আরেকটা অস্বস্তিকর বোঝাপড়ার দিন। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে আচমকা ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ করে উঠল। বলল, এ রকম চাষার মত কথা বল কেন? 

অবনীর গলা থেকে বিস্ময়ের একটা অস্ফুট আর্তনাদ চমকে উঠল। হাত থেকে বোনার কাকই-কাঠিটা ছিটকে দাওয়া থেকে সূতো খুলতে খুলতে গড়িয়ে উঠোনে নামল। গুটনো সূতো খুলে যাচ্ছে। এমন হওয়ার কথা নয়! সে গিরিনের মুখের দিকে তাকাল। বিশ্বাসে আচমকা চিড় ধরা, মুখের ওপর সরাসরি থাবড়া খাওয়া চেহারা। বিস্মিত, হতবাক, অপমানিত এবং আহত। 

কিন্তু তার স্নায়ু অনেক ঘাতসহ। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। আনন্দের মনোজগতে বিপর্যয় অনেক বড় মনে হচ্ছে। বাপ-মায়ের থেকে পিসার কাছেই না আবদার এতকাল বেশি করে এসেছে সে? 

উঠোনে আনন্দর অবস্থান রান্নার ঘরের থেকে অপেক্ষাকৃত কাছে। রাধিকার হাতের কাছে উনান খোঁচাবার বাখারিটা। আনন্দর কথাটা শুনে ওই বাখারিটা হাতে নিয়েই লাফ দিয়ে নিচে নামল সে। মুখে বলল, হারামজাদা, কাক্‌ কি কবার হয়, আজ তোমকো শিক্ষা দিয়া দিমো! 

গৌরী পিছন থেকে জাপটে ধরল তাকে। 

—অ্যাই, অ্যাই বৌদি! 

বাপরে! বিশ বছরের জোয়ান চ্যাংড়ার গায়ে হাত দেবে নাকি বউ! 

আনন্দ কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে পিছন ফিরল। ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে গিরিন। দাওয়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসে ধরে ফেলল আনন্দকে। 

—আয় আমার সঙ্গে। 

—না, আমি যাব না। 

—তুই যাবি না তোর বাপ যাবে। চল! 

আনন্দর কাছে এই ভঙ্গি এই মুহূর্তে অত্যন্ত নির্বোধ ও স্থূল লাগে। সে বলল, আঃ, ছাড় পিসা। 

কিন্তু গিরিন তাকে ততক্ষণে দুহাতে ধরে ফেলেছে। সে বলল, আমি তো চাষাই। চাষের কাম করি, চাষাদের কাম করি। তুইও তো চাষা, চাষার বেটা চাষা। আমরা চাষা হলে, তুই কি বাবু হবি? কিন্তু তোর হয়েছে কি? 

—আমি অযোধ্যা যাব! 

—অযোধ্যা যাবি? কেন সেখানে কী? 

আনন্দ চুপ করে থাকে। 

গিরিনই আবার বলল, আমি সব জানি। কুসুমপুরের আশ্রমে কি হয়, কারা আসে, কারা কি বলে, কি চায় তারা আর কেনইবা চায়, সবই জানি। তোরা কি জীবনসাগরে একটা দাঙ্গা লাগাবি নাকি রে, আনন্দ? 

আনন্দ চুপ করে থাকল। কিন্তু ভঙ্গিটা হল, এসব বক্তৃতা সে পছন্দ করছে না। পিসা রাজনীতি করা লোক এবং পিসাদের দলকে তার ভালই চেনা হয়ে গেছে। সবাই স্বার্থপর, সবাই ধান্দাবাজ। সবার ওপরে উড়ন্ত চুল, পূর্ণ তূণ, শত্রুসংহারক রাম তার মনশ্চক্ষে। 

সে বলল, ছাড় আমাকে। মালদায় কি হয়েছে তুমি জান? মুর্শিদাবাদে? অযোধ্যায়, মথুরায়? সে ক্ষিপ্তের মত আরও কি সব বলে যেতে লাগল। লাগামছাড়া, বানানো, শেখানো, অতিরঞ্জিত সব অভিযোগ। তুমুল মিথ্যার অন্ধকার প্রচার সে আবিষ্টের মত গিলেছে, সে কথা বোঝা যায় তার আবেগে। তার চোখ ছবির ধনুর্ধারী রামের মতো অপ্রেমময় এবং ঘূর্ণিত। 

রাধিকা ননদকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফের গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছিল। আচমকা আবার বেরিয়ে এসে সরোষে বলল, ওক্‌ বল, জামাই, ওক্‌ সব বল! ওক্‌ জানবা দেও যে অঁয় কে! কান্নায় তার কণ্ঠস্বর বিকৃত। সে আরও খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, জামাই মানুষকে তার পিছন দেখাবাই লাগে। মানুষ কি জানে কে তার বাপ, কে তার ঠাকুরবাপ, আর তার কর্তা বাপই বা কে? কিন্তু জামাই, মানুষের জানা উচিত। ওই হারামজাদের জানা উচিত ওর বাপ কে? 

আনন্দ খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল। কি বলছে এরা? কে তার বাপ? এ সবের মানে কী? ওই যে অর্ধেক বোনা জালগাছা ধরে বসে আছে, ওই লোকটা তার বাপ নয়! 



বিশ বছর আগে অবনী তার ভগ্নিপতি গিরিনকে নিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে জলা স্টেশনের প্ল্যাটফরমের ওপর দাঁড়িয়েছিল। স্টেশনের কাছে পাকিস্তানি বাংকার খুব মজবুত ছিল। সেই একাত্তরের যুদ্ধের কথা। হিন্দুস্থানি মিলিটারি টনটন মরটার দেগেও সেই বাংকার ভাঙতে পারেনি। যুদ্ধের শেষ দিকে হিন্দুস্থানিরা বাংকার অবরোধ করে ফেললেও খানেরা আত্মসমর্পণ করল না। মাইক নিয়ে হিন্দুস্থানি অফিসার বারবার আত্মসমর্পণ করতে বললেও বাংকার ছিল নীরব। তারপর পাশের একটা পুকুরে পাইপ লাগিয়ে দিয়ে বাংকারে পাম্প করে জল ঢোকাবার ব্যবস্থা হল। অবনীর ধারণা হয়েছিল, রাধিকা, যাকে মাস ছ-সাত আগে খানেরা লুট করে নিয়ে গিয়েছিল, যদি কোথাও থাকে তো ওই বাংকারে। তারা শুনেছিল বাংকারের ভিতরে অনেক মেয়েমানুষ আছে। গিরিনের বাড়ি ছিল সীমান্তের এপারে আর তার ছিল ওপারে। মাঝখানে মাইল দশেকের ফারাক। শালা-ভগ্নিপতি দুজনে থম ধরে স্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়েছিল। খানেদের মারণক্ষমতা তখন শেষ। 

বাংকারের ভিতর থেকে প্রথমে বেরিয়ে এল কিছু অস্ত্রশস্ত্র। কেউ ভিতর থেকে সেগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলছিল। জল ঢোকানো তখন বন্ধ হল। তারপর খানিক চুপচাপ। তারপর বেরলো একটা মেয়েমানুষ। লজ্জার জায়গা আর বুকে কোনওমতে চেপে ধরা। একটা ছেড়া সবুজ মিলিটারি কুর্তা। 

তার পিছনে আরেকজন, পিছনে সার দিয়ে আরও অনেক। অনেকের অঙ্গেই সূতোগাছাও নেই। জীর্ণভগ্ন চেহারা অধিকাংশের। পেটে বাচ্চার অস্তিত্ব অনেকের উলঙ্গতাকে বড় বেশি করে প্রকট করে তুলেছিল। অনেকের শরীরে অসম্ভব অত্যাচারের চিহ্ন। মোট একশ সাতাশ জন। অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে গিরিন এবং অবনীও তাদের গুনেছিল। 

সেই একশ সাতাশজনের মধ্যে একজন রাধিকা। খাকি কুর্তাটা তার উঁচু পেট আড়াল করতে পারেনি। সবশেষে মাথার ওপরে হাত তুলে বেরিয়ে ছিল খানেরা। সিনেমার ছবির মত দৃশ্য। 

রাধিকা তড়কালাগা রোগীর মত হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচাতে লাগল। তার গলায় চির ধরে স্বর বিকৃত হয়ে গেল। গিরিন আনন্দকে মাঝ উঠোনে রোদ্দুরের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে সরে এসে উত্তর দিকের একটা বাঁশ ধরে স্থির হয়ে রইল। হে ভগবান, মানুষ তার পিছনটাকে কেন জানবে! যদি তাকে জানাতেই হয়, তবে সে কাজ তার মা-ই করুক। 

আনন্দ অসহায়ের মত তিনদিকের দাওয়ায় বসা তার স্বজনদের দিকে ফিরে ফিরে দেখতে থাকে। দম ফুরিয়ে আসছে তার। কোন্ ঘাট দিয়ে উঠবে সে? কে ওঠাবে তাকে হাত ধরে? সে প্রথমে তার মায়ের দিকে এগলো। 

চিৎকারে রাধিকার গলা দিয়ে রক্ত উঠে এসেছিল। সে যেন উন্মাদ। থু করে একদলা রক্তমাখা থুতু উঠোনে ফেলে সে বলল, শুনে রাখ আনন্দ, শুনে রাখ, শুনে রাখ চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষলতা, কেন কি আজ পর্যন্ত কেও জানে না এই চ্যাংড়ার বাপ কে! কেউ সাক্ষী নাই! অন্ধকার গুহার মধ্যে এই চ্যাংড়াক্‌ আমি প্যাটে ধরিছি। 

এরপর সে থেমে থেমে প্রত্যেকটি কথা পৃথক পৃথক করে উচ্চারণ করল, এই চ্যাংড়ার বাপ হইল পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরজনা খান মিলিটারির একজনা, আর সেই একজনা যে কে তা আমিও কবার পারমো না! 

হেঁসোর এক কোপে কাটা কলা গাছের মত আনন্দ উঠোনের মাঝখানে ভেঙে পড়ল দুহাতে মুখ ঢেকে। রাধিকার গলা কাঁপা গোঙানো স্বরে আক্ষেপের কান্না ভেসে আসছিল। সে তার ননদের দেহের উপরে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে হু হু করে কেঁদে যাচ্ছিল। সে স্বগতোক্তির মত নিচু সুরে কান্নার একটা রোল তুলে বলতে লাগল, সারাটা জীবন আমার নিজেকে অশুচি লাগিছে, আর সারাটা জীবন তোকে বুকে জড়ায়ে নিজেকে শুচি করিছি— সারাটা জীবন আমি পাপপুণ্যের ধন্দে ফালা ফালা হইছি—আর তুই! 

সেই থেকে রাধিকার কাঁদার পালা শুরু। তার কান্না আর কিছুতেই শেষ হয় না। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ