সেলিম জাহানের ব্যক্তিগত জার্নাল : ব্রজমোহন বিদ্যালয়

স্কুল-কলেজের সারাটা জীবন একটা তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে ছিলাম আমি। বিশেষ করে একজন সহপাঠীর সঙ্গে। পড়াশোনার সে প্রতিযোগিতার কিছুটা ছিল আমাদের দু’জনের স্ব-প্রণোদিত, কিছুটা আমাদের নিজ নিজ পরিবার চালিত, কিন্তু এর একটা বড় অংশই বরিশাল শহরবাসী আরোপিত। আমাদের সেই তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতা ছিল প্রায় বছর দশেক ধরে।
কিন্ত দু’জনের মধ্যে ভালো সখ্যতা ছিল, পারিবারিক পর্যায়েও আমাদের মাতা- পিতাদের মধ্যেও বন্ধুত্ব ছিল। আমারা প্রতিদ্বন্ধী ছিলাম, শত্রু ছিলাম না। আর তা’ ছাড়া আমি ভাবতাম, আমার প্রতিযোগিতা তো আমার সঙ্গেই, আমার চেয়ে আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদন্দ্ধী আর কে আছে?

কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারে দু’জন প্রতিদ্বন্ধী কিশোরের জন্য একটা পুরো শহর দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যাবে এবং দশ বছরের জন্য দ্বিধা-বিভক্ত থাকবে, এমন বিষয় বড় একটা দেখা যায় না। আমাদের চতুর্থ থেকে দশম শ্রেনী পর্যন্ত সারা বরিশাল শহর উদ্বেলিত হয়ে উঠতে লাগল জিলা স্কুলে আমাদের প্রতিটি পরীক্ষাকে ঘিরে - কে এবার প্রথম হবে? ভুলেও তৃতীয় কোন সম্ভাবনার নাম-গন্ধও উচ্চারিত হয় না। এখন ভাবতেও অবাক লাগে কেমন ছিল শহরের সে বিভাজনের তীব্রতা।

সে বিভাজন তুঙ্গে উঠল আমাদের স্কুল-সমাপনী মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে। সারা শহর ভাগ হয়ে গেল দু’টো দলে - আমার সমর্থনে এবং আমার সহপাঠীর সমর্থনে। অবস্হটা এমন দাঁড়াল যে, আমাদের বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা তে বটেই, আমাদের বয়োজৈষ্ঠ্যেরাও এ ব্যাপারে বাজী ধরতে শুরু করলেন। সাইকেল করে কাজের জায়গায় যেতে যেতে আনাম ভাই আমার সহপাঠীকে চিৎকার করে বলেন, ‘১০০ টাকা বাজী ধরেছি শাকিল শয়তানটার সাথে। জিতিয়ে দেবে তো আমাকে?’ পাশের বাড়ীর অনিতা’দি আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘নাজমার সঙ্গে ওর নাকফুলটা বাজী ধরেছি। যা সুন্দর নাকফুলটা আর যা মানাবে না আমাকে!’ তারপর খপ করে আমার হাতজোড়া ধরে মিনতির সুরে বললেন, ‘আমাকে ডোবাস্ নি লক্ষ্মী ভাই আমার’।

পরীক্ষার প্রথম দিনে সিকি বরিশাল ভেঙ্গে পড়ল বি.এম. স্কুল পরীক্ষা কেন্দ্রে। ঐ স্কুলের বিরাট হল ঘরে আমাদের আসন পড়েছে। আমাকে ঘিরে আমার সমর্থক বিরাট জনতা - শুভেচ্ছা, শুভ কামনা, দোয়া, আশীর্বাদ, মাথায় হাত, পিট চাপড়ানোর বৃষ্টি বয়ে যেতে লাগলো। আমার সহপাঠীকে ঘিরে তেমনি আর এক উদ্বেলিত গোষ্ঠী। এক সময়ে প্রাথমিক ঘন্টা পড়ল। ভীড় পাতলা হ’তে শুরু করল। আমার সহপাঠীর পিতা আমার কাছে এসে দেয়া করে গেলেন, আমার বাবাও আমার সহপাঠীকে শুভ কামনা জানিয়ে আসলেন। চূড়ান্ত ঘন্টা পড়ল - শুরু হয়ে গেল বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা।

দু’দিন পরেই হল ইংরেজী পরীক্ষা। গোল বাঁধল অঙ্ক পরীক্ষার দিন। প্রায় সব ক’টি অঙ্ক করার পরে ভাবছি, এরপর কোনটা ধরব। পাশে এসে দাঁড়ালেন পরিদর্শক সাবের স্যার। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমার অনিশ্চয়তা দেখে প্রশ্নপত্রের ৯ নম্বর অংকটির ওপরে আঙ্গুল রেখে বললেন, ‘এটাই তো করতে পারো’। ঐ টুকুই! কিন্তু তারপরেই শুরু হয়ে গেল অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রবাহ এবং তৈরী হল ইতিহাস।

পরের দিন সমাজ পাঠ পরীক্ষা। আমার ঘরে বসে আমি পড়ায় মগ্ন। রাত আটটার দিকে বাবা ডেকে পাঠালেন বসার ঘরে।ঘরে ঢুকে দেখি, বসে আছেন বি.এম. স্কুলের ঋষিতুল্য প্রধান শিক্ষক জয়ন্তবাবু এবং সুদর্শন তরুন শিক্ষক নরেনবাবু। জয়ন্তবাবু আদর করে আমাকে তাঁর পাশে বসালেন। জিজ্ঞেস করলেন পরীক্ষা কেমন হচ্ছে। নরেন স্যার আমাকে একটা থালায় খাবার তুলে দিলেন। জয়ন্ত বাবু আমাকে জানালেন এতো রাতে তাঁদের আসার কারন।

আজ বিকেলে অঙ্ক পরীক্ষার পরে আমার প্রতিদ্বন্ধী সহপাঠীটি এবং তার এক বন্ধু লিখিতভাবে কতৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছে যে সাবের স্যার আমাকে সাহায্য করেছেন নীতিবহির্ভূতভাবে - তিনি আমাকে কি করে একটি অঙ্কক রতে হবে তা বলে দিয়েছেন। অভিযোগের সবচেয়ে খারাপ ইঙ্গিতবহ দিকটি হচ্ছে এই উল্লেখটি যে তিনি আমার বাবার ছাত্র। সুতরাং পরীক্ষা কতৃপক্ষ সিদ্বান্ত নিয়েছেন আমাদের তিনজনকেই সাধারন পরীক্ষা হল থেকে এবং অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের কাছ সরিয়ে নেয়া হবে এবং আগামী কাল থেকে জয়ন্তবাবুর তত্ত্বাবধানে তাঁর অফিস কক্ষের বাইরে দর্শনার্থীদের অপেক্ষার জায়গায় আমাদের পরীক্ষা দেবার ব্যবস্হা হবে।

জয়ন্তবাবু আরো বললেন যে, এ ব্যবস্হার কথা আমাদের প্রধান শিক্ষক এবং আমার বাবাকে জানানো হয়েছে। আমার কি মতামত? কোনদিকে না তাকিয়েই বুঝলাম, ঘরের ছ’জোড়া চোখই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেয়াল ঘড়িতে টিক্ টিক্ শব্দ। এক মুহূর্ত, চুপ করে থাকলাম, তারপর খুব শান্তভাবে বললাম, ‘যে কোন জায়গায়, যে কোন সময়ে, যে কোন ব্যবস্হায় পরীক্ষা দিতে আমি প্রস্তুত’। দেখলাম, গর্বের একটা উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে গেল তিন বয়োজৈষ্ঠ্যের মুখে। ‘কিন্ত, আমি এটা বলতে চাই যে, সাবের স্যারের বিরুদ্ধে যে হীন কথা বলা হয়েছে তা’ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’, জয়ন্ত বাবুর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলি আমি, ‘এবং আমারই সহপাঠীরা একজন শিক্ষককে অপমান করেছে - তার জন্য আমি আমার সব স্যারের কাছে ক্ষমা চাইছি’। ঘরের মধ্যে নেমে এলো এক ঘন নিস্তবদ্ধতা - তা’ এতো ঘন যে মনে হচ্ছিল ছুরি দিয়ে কাটা যাবে।

পরের দিন শুনি সারা শহর এ ঘটনায় তোলপাড়। এমন ব্যবস্হার কথা কেউ কখনো শোনে নি। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তির ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে। আমি পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে সোজা নির্ধারিত জায়গায় চলে গেলাম। প্রধান শিক্ষকের অফস কামরার বাইরে দর্শনীর্থীদের জন্য রক্ষিত সোফা-চেয়ার সরিয়ে তিনটে টেবিল দে’য়া হয়েছে। জয়ন্তবাবু ব্যতীত অন্য কারো প্রবেশাধিকার সেখানে নিষিদ্ধ।আমার সহপাঠীরা এলো। কথাবিহীন ভাবে যে যার আসনে গিয়ে বসলাম। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজল। জয়ন্ত বাবু প্রশ্নপত্র দিলেন। শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা।

মনটা খুব ভালো হয়ে গেল যখন দেখলাম আমার আসন থেকে বি.এম. স্কুলের দিগন্ত জোড়া মাঠ দেখা যায়। আকাশ উঁকি মারে। অনেক দূরে সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শান্তি’দির সাদা বাড়ীটা চোখে পড়ে। প্রশ্নপত্রে চোখ রেখে আমি খাতায় কালির আঁচড় টানতে শুরু করি। হঠাৎ দেখি মাঠের দিকটাতে গন্ডায় গন্ডায় ছোট-বড় নানান মানুষ জমা হয়েছে।উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে কি হচ্ছে এখানে। তাদের উপস্হিতি টের পেয়ে জোর ধমক লাগান জয়ন্ত বাবু। আবার মাঠ হেসে ওঠে আমার চোখে। মৃদু হেসে আমি কলম চালাই - সময় বয়ে যাচ্ছে।

এমনি করেই ঐ ছোট্ট ঘরে বিশেষ ব্যবস্হায় জীবনের একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার এক এক পত্র দিতে থাকি। বলি না কাউকে কিছু।তারপর একদিন সে পরীক্ষা বৈতরনী পার হওয়াও শেষও হলো।

শেষ দিন তিনটে কাজ করি।পরীক্ষর খাতা জমা দেয়ার পরে আমার দু’ সহপাঠীর কাছে গিয়ে মিষ্টি করে বলি, ‘দ্যাখো তো কেমন একটা জেলখানার মধ্যে পরীক্ষা দেয়ার অভিজ্ঞতা হল।’ হাসি একটু, তারপর যোগ করি, ‘কলেজে দেখা হবে’। তারপর সাবের স্যারকে খুঁজে বার করি বড় হলঘরে। দু’হাতে খাতা-পত্র নিয়ে বেসামাল অবস্হা তাঁর। আমি পা ছুঁয়ে সালাম করি। মুখে কিছুই বলি না, তিনিও বলেন না। আসলে কখনও কখনও নিশ্চুপতাও তো কথা বলে, নীরবতাই তো তখন সবচেয়ে বাঙ্ময়।

সবশেষে যাই জয়ন্ত বাবুর কাছে। প্রণাম করার জন্যে নীচু হতেই দু’হাত দিয়ে ধরে ফেলেন আমাকে দীর্ঘদেহী জয়ন্ত বাবু। নরম করে হাত রাখেন আমার মাথায়। তারপর খুব কোমল কণ্ঠে বলেন, ‘ জগতের কাছে তুমি আমি বড় ক্ষুদ্র।সেটা পাল্টানো যায় না। কিন্তু জীবনের ক্ষুদ্রতা তোমাকে যেন কখনো গ্রাস না করে।’ তাঁর কণ্ঠের আবেগ টের পাই - টের পাই আমার চোখের সজলতা।

তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়াই। একবার পেছন ফিরি - দেখি তিনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সাদা ধুতি, সাদা ফতুয়া, সাদা উড়ুনি, বিদ্যাসাগরী চটি আর গোল চশমায় তাঁকে আমার পুরোনো যুগের এক ঋষির মতো মনে হচ্ছিল। হাত তুললেন তিনি। আমি চোখ মুছলাম জামার হাতার উল্টোপিঠে। দেখা হয়নি আর - না সাবের স্যারের সঙ্গে, না জয়ন্ত বাবুর সঙ্গে। জানি, হবেও না এ জীবনে আর কখনও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ