
পরীর মেয়েরা অতোটা নষ্ট নয়। তারা হাবাগোবা পেলে মাথার স্ক্রু ঢিলা করে দেয়, সারাদিন টিলার উপর ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে। সন্ধ্যাকালে এই পথে যেতে যেতে যদি কারো চক্করে পড়ে যায় একবার, সারারাত গ্রামের ভেতর সাতপাক দেবে তবু বাড়ির পথ খুঁজে পাবেনা, হয় ফজরের আজান হতে হবে অথবা কোনো গোরস্থানে গিয়ে পড়লেই রক্ষা।
পুববাড়ির হাসনাহেনার মাথা খারাপ। উদানমাদান, পিঙ্গলা টিলা, ফেওলা টিলা, বরইটিকি কোথায় না তারে দেখতে পাওয়া যায়। তার ভাঙ্গাচোরা সোনার গহনার মতো সোনালী ত্বকের বরণ, শনপাপড়ির মতো চুল, ময়লা দাঁত, ময়লা নখ, তীক্ষ চাহনীতে সারাক্ষণ তীব্র একটি হাসি নিস্পাপ মানুষের ভেতরও কাঁপিয়ে তুলে। ইতোমধ্যে যার মাথা নষ্ট, বরইটিকিতে যে কোনো সময়ই সে যেতে পারে।
‘হাসনাহেনা নি? কই যাছ?’
হাসনাহেনাকে হাসনা অথবা হেনা ডাকাই দস্তুর। এতো লজ্জত লাগিয়ে কাউকে কেউ ডাকেনা। ভাল নাম রাখা হয় পাঠশালাতে নাম তুলতে গেলে বা বিয়ের কাবিন নামায়। কেউ কাউকে পুরা নাম ধরে ডাকাডাকিতে নাই। কিন্তু হাসনাকে পুরো নাম ধরে ডাকতে হয়। হাত খালি থাকলেও ডাকতে হয়, আর এখন তার বাম কাঁখে বেতের ডালা আর ডান হাতে শাবল।
পাশের লুকটি বন থেকে মটাৎ করে একগুচ্ছ ফুল ছিঁড়ে কানের পাশে গুঁজে আরেকটি ডাল থেকে পাকা একটি ফল পাড়ে হাসনাহেনা। আঙ্গুল দিয়ে টিপে মাছের ডিমের মত অগুনতি ডিম ভরা বেগুনী ফলটি মুখে চালান করে পাশের ধানখেতের আইলে নেমে যায়। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে গিয়ে ঠাশ করে মাথায় বাড়ি লাগে মজনুর, ‘শাউয়ার গাছ!’
এই এক মনফলের গাছ বড়বাড়ির পেছনের বাল্লায়, কতোবার কতোজন দাদাজীকে বললো, তবু গাছটি আর কাটা হয়না। মজনু নিজেই বছরে দুই তিনবার ডাল ছেঁটে দেয়। পেছনের পথ, ভিন গাঁয়ের কেউ কেউ কোনাকুনি মারে, কিন্তু এক মজনু ছাড়া কেউ বোধ হয় খোঁচা খায়না এর লম্বা লম্বা কাঁটায়। গাছে ফল আসে শীতে। সোনালী বলের মতো গোল গোল হাল্কা মিষ্টি ফল, কিশোরী মেয়ে ছাড়া কেউ ছুঁয়েও দেখেনা, তবু কেউ জোট বাঁধেনা কাটার জন্য।
খেতের আইল হাত চল্লিশেক, চক্ষের পলকে পেরিয়ে টিলার নীচে চলে গেছে হাসনাহেনা। এখন পায়ে হাঁটা সরু পথ দিয়ে তরতর করে উঠে যাবে উপরে। আসলেও মাথা নষ্ট মেয়ে। সে নিজে দুপুরে ভাত খেতে শর্টকাটে এই পথ ধরে, কিন্তু ডানপাশের টিলার দিকে ভুলেও তাকায় না। ঘরে বউ পোয়াতি, কিসের সাথে চোখাচোখি হয় আর সাথে করে বাড়ি নিয়ে যায়। বিয়ের আগে বাড়ির ফিরতো না এই সময়ে সে।
‘তুই হর, দেখি শাবইল দে।’
হাসনাহেনা শাবলখানা দিয়ে দেয় সন্জীবের হাতে। তারপর মাটির উপর থেকে শুকনো ঘাস পাতা সরিয়ে দিয়ে নিজে লেটা মেরে বসে মাটির উপর। সন্জীব যাচাই বাছাই করে একটি লতা আলাদা করে তার গুড়া পর্যন্ত গিয়ে শাবল চালায়। আধহাত যেতেই আলুর মুখ খুঁজে পায় সে। হাত দিয়ে, শাবল দিয়ে আলগোছে ঝুরঝুরা বালু সরিয়ে দেড়হাত লম্বা আলুখানা বের করে আনে। কিশোরি হাতের মত সরু লম্বা আর ধবলরঙ্গা আলু। কখনো সন্জীব, কখনো হাসনাহেনা, দুপুর গড়াবার আগেই ডালা ভরে ওঠে হাসনাহেনার। এতোটা দরকারও নাই, মনে মনে ঠিক করেছে সন্জীবকে আধাআধি দেবে সে। বরাবর দিতে হয়না। হয়তো সেদিন সন্জীবও তুলতে যায় কোনো টিলায়। কখনো কখনো বড়বাড়ির চাচিদের দিয়ে আসে কিছুটা। বড়বাড়ি সবাই খুব মাছ মাংশ খায়, কখনো এই আলু পেলে আয়েশ করে মাছে শুঁটকিতে রাঁধে। ফিরতি কিছুর তোয়াক্কা করেনা হাসনাহেনা, তারাই জোর করে হাত ভরে এটাওটা দেয়। ‘বংশেরই তো মেয়ে, কারো কোনো কথায় নেই, নিরাই নিরাই থাকে, মুচকি মুচকি হাসে, মাথা নষ্ট না হলে এই মেয়ে এতোদিন বিলাত আমেরিকায় সংসার করতো। কতজন শতগুণ মলিন চেহারা নিয়েও রাজরাজড়ার সংসার করতেছে! দুর্ভাগার এক পুত অথবা এক কন্যা থাকে। মানুষ থেকে জ্বীন পরীরও বদনজর থাকে এদের উপর। পাঁচ ভাইয়ের পরে একবোন হাসনাহেনা, নিহাতী গরীবও নয়, তবু কোনো মতিগতি হলোনা মেয়েটার!’
‘বাঘ বাঘ!’
‘ও মাই গো!’
সন্জীবকে জাপটে ধরে হাসনাহেনা। ধরেই ছেড়ে দেয়। সন্জীবদা পাগলছাগল হলে কি হবে, মিটিমিটি হাসি দেখলে হাসনাহেনা বুঝে ফেলে কোনটা মিথ্যা। আর সন্জীবদা তাকে হেনা ডাকলে রাগ হয়না তার, হাত ধরে টান দিলেও ব্যথা লাগেনা। অন্য কেউ হাত ধরলে ব্যথা লাগে। বহু বছর থেকে হাতে তাই একখানা ছোট রামদা রাখে সে। সেই রামদা দিয়েই বনবাদাড় থেকে ফল পেড়ে খায়, কারো বাল্লা থেকে কুড়িয়ে বেল, জাম্বুরা, কাঁঠাল কেটে খাওয়া, শুকনা ডাল ভেঙ্গে বাড়ি নিয়ে যাওয়া আর কেউ কাছ দিয়ে যাবার সময় দায়ের ধার পরখ করা…
‘তুই ডরাইছত? ধুর, আমি আছি নায়নি!’
‘আমার খালি ডর লাগে সন্জীবদা!’
‘ডরাইলেউ আমারে কইবে, মাথা ফালাই দিমু।’
হাসনাহেনা জানে সন্জীবদা আসলেও মাথা ফেলে দেবে যে কারো। সন্জীবদার খুব রাগ, তারও খুব রাগ। সন্জীবদার রাগ তার মাথা কেনো আউলাজাউলা, হাসনাহেনারও। সন্জীবদার বাবা নাই, হাসনাহেনার মা। সন্জীবদা কম ঝালওয়ালা তরকারী খেতে পারেনা, তার বড়বৌদি ঝাল দেখতেই পারেনা। হাসনাহেনার বাপের আলসার, ভাইদের হুকুমে ভাবীরা কম ঝালে রাঁধে। হাসনাহেনা ভেবে রেখেছে আর কিছুদিন গেলেই সে আলাদা রেঁধে খাবে, তখন সন্জীবদাকেও খেতে ডাকবে। বড়বাড়ির মেজচাচীর রান্না বেহেস্ত ফেইল। সন্জীবদা হামেশা চেয়ে মেজচাচীর রান্না খায়, হাসনাহেনাও না করেনা, বললেই খেতে বসে। সন্জীবদাদের নিজেদের পুকুর নেই। বড়বাড়ির বিশাল পুকুরে এক ডুবে এপার ওপার করতে পারে সে। হাসনাহেনা ডুব দিয়ে অনেক্ষণ থাকতে পারে পানির নীচে।
হাসনাবেনা দূরে বসে আলু ভাগ করে,
‘অউ নেও, তোমার ভাগ।’
‘যা ভাগ কইলাম।’
‘না, নিতায় অইবায়।’
‘ধাক্কা দিয়া লামাত ফালাই দিমু, ভাগ…’
সন্জীব আলুর তোয়াক্কা করেনা, টিলার উল্টো দিকের বনের পথ ধরে নীচে নামতে থাকে। দক্ষিণের দিকে কোনো বাড়িঘর নেই। পাশের গ্রামের শুরু কম হলে দেড় মাইল। মাঝখানের টিলার পর টিলা। একপাশে বিশাল একটি পাহাড়। সন্জীবদা বলেছে ঐ পাহাড়ের মাথায় উঠলে বহু দূর দুরান্তের গ্রামও দেখা যায়। সেই পাহাড়ে এতো ঘন বন যে পেটে অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে শুয়ে থাকা একটা বাঘিনী তাকে দেখতেই পায়নি সেদিন। আবার যেদিন গেলো বাচ্চা বিইয়েছে কিনা দেখতে, বাঘিনী যেনো তার অপেক্ষায়ই ছিলো বাচ্চা তিনটে নিয়ে! পরেরবার যখন দুধ আর লোফ নিয়ে গেলো, কোথাও কেউ আর নেই। সন্জীবদা যেতেই থাকলো, যেতেই থাকলো। গ্রামের লোকেরা বলতে থাকলো ‘দানবের হাতে থাপ্পড় খেয়ে এবার মরবে পাগলা’। তবে সেই পাহাড়ে এক বেহেস্তের বাগান খুঁজে পেলো সন্জীবদা। পরপর চারদিন গোপনে হাসনাহেনাকে দুইটা তিনটা করে পাঁকা ছাগললেদি দিয়ে যেতে থাকলো সে। কবে নাকী গ্রাম থেকে নাই হয়ে গেছে এই ফল। বড়বাড়ির দাদাজী যখন এই ফলের গল্প করেন, মনে হয় বেহেস্তে গিয়ে এই ফল খুঁজে না পেলে সারাজীবনের সব দান খয়রাত, নামাজ হজ্ব বিফল হয়ে যাবে তার! সন্জীবদা নাকী দাদাজীকেও সমান সমান খাইয়েছে এই ফল, আর প্রত্যেকবার হাত তুলে দোয়া করেছেন দাদাজি ‘আল্লাহ তরে বেহেস্তো নেইন যেনো রে ভাই’। সন্জীবদা বলেছে ‘সরগো কও দাদাজী, আমার বেহেস্তো কিলা যাইমু!’
কমলার মতো গোল গোল আর সোনালী বলের মতো ফল, মুখের ভেতর পুরলে ঘ্রাণ আর স্বাদে নাভীর ভেতর পর্যন্ত হীম হয়ে ওঠে। পরের শীতেও খুঁজতে যাবে সন্জীবদা, তখন হাসনাহেনাও যাবে, দূরদূরান্তের সবুজ সবুজ গ্রাম দেখবে। আবার যদি বাচ্চা বিওয় বাঘিনী, গাছের নারকেল, চিনি মাখিয়ে মাখিয়ে পায়েস রেঁধে নিয়ে যাবে হাসনাহেনা।
দাদাজী মরে বেহেস্তে চলে গেছেন, সন্জীবদা স্বপ্নে দেখার পর হুবহু হাসনাহেনাও এই স্বপ্ন দেখলো। তাকে আর ছাগললেদি খাওয়ানো হবেনা। তবে এরপর থেকে সন্জীবদা বলে হাসনাহেনার গায়ের বরণ ছাগললেদির মতো হলুদ হয়ে গেছে। আগে বলতো গেন্ডা ফুলের মতো। বলে মানুষ মারা যাবার আগে গায়ের বরণ এমনই হয়, যদি তারা স্বর্গে যাবার মতো মানুষ হয়।
‘আমি মরি যাইমু?’
‘ধুর, ইতা বউত দেরি আছে।’
‘তুমিও তো ধলা।’
‘আমার ঠাকুমা ধলা আছলা।’
‘তুমি সরগে যাইবায়?’
‘ধুর, ইতা বউত দেরি আছে, আগে ছাতলা পাহাড়ো যাইমু।’
‘আমারে নিবায়?’
‘ইতা বউত উচা আর ডেন্জারাস।’
‘বাঘ আছে।’
‘না মনো অয়।’
‘তে?’
‘তর বাড়ি থাকি দিতা নায়।’
‘আমি কইলে তো।’
গ্রামের একেবারে উত্তরে ছাতলা পাহাড়। হাসনাহেনা ভাবতো এই পাহাড়ের পর পরই পৃথিবী শেষ, আর কোথাও কিছু নাই। সন্জীবদা জ্ঞানী মানুষ, সে বলেছে পাহাড় মাত্র দুইটি গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে, কোথাও কোথাও এতোটা উঁচুও নয়। সেখানে বাড়িঘরও আছে, একেবারে শেষ মাথায় হাসপাতাল, তার পরেই গ্যাস ফিল্ড। তবে মাঝামাঝি এখনো কিছুই নাই। গহীন গভীর বনের উঁচু চূড়ায় কেউই যেতে পারেনা। তবে সন্জীবদা ভিন্ন, মানুষ ছাড়া কারো সাথে কোনো বিবাদ নাই তার।
এই যে তারা ছাতলা পাহাড়ে চলে যাবে, পাহাড়ের যে অংশে ঘন বন, প্রতিদিন সেখানে লুকিয়ে লুকিয়ে যায় সন্জীবদা। বন কেটে উঁচু চূড়ায় ছোট্র উঠান বানিয়ে নিয়েছে সে। এই যে বনের ভেতর আসা যাওয়া করে, পশুপাখিও কিছু বলেনা তাকে। কিন্তু মানুষ দেখলে দুই কথা বলবে। সন্জীবদার আর মানুষ ভাল লাগেনা, খালি মনে হয় মাথা ফেলে দেয়। হাসনাহেনারও আর বাড়ি ভাল লাগেনা, ঝাল ছাড়া তরকারী খেতে ইচ্ছা করেনা। বনবাদাড়ে ঘুরতে গেলে ভাইয়েরা চুলের মুঠি ধরে মারে। সন্জীবদা বলছে তার ভাইদের মাথা ফেলে দেবে একদিন।
খুব শীতের সন্ধ্যায় একখানা কাঁথা দিয়ে বালিশ আর গোটা দুই শাড়ি পেছিয়ে গোপনে গোপনে বাড়ি থেকে নেমে আসে হাসনাহেনা। মসজিদের কোনায় সন্জীবদা কাঁথাবালিশ আর টর্চলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেছে। টিমটিমে এক বাতি জ্বলছে মসজিদের উঠানে। বাতিটা এতোটা টিমটিমে নয়। কুয়াশার কারনে মনে হচ্ছে পায়েসের ভেতর পড়ে গেছে বাল্বটি! সন্জীবদা বলছিলো হারামী বাতিটার মাথা ফেলে দেয়া দরকার। সেই বাতি আড়াল করে দ্রুত হাঁটে হাসনাহেনা, সেখান থেকে আধঘন্টা হাঁটলেই ছাতলা পাহাড়। আর কোনোদিন বাড়ি ফিরবেনা সে আর সন্জীবদা।
2 মন্তব্যসমূহ
ভীষণ ভালো লাগলো। যতক্ষণ পড়েছি মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা। মনে হচ্ছিলো আমি নিজেই হাসনাহেনা। আমারো ইচ্ছে করছে সন্জীবদার সাথে ছাতলা পাহাড়ের চলে যেতে।
উত্তরমুছুনবাহ। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম
উত্তরমুছুন