প্রবন্ধ : অদ্ভুত আঁধারের গল্প

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা 

অদ্ভুত আঁধার এক ঘনিয়েছে এখন আমাদের চারপাশে। সকলেই সকলের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। মানুষের উপর মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে। সকলেই কমবেশি বিপন্ন এখন। ফেসবুক, হোয়াট্‌স অ্যাপ, খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেল রক্তাক্ত হয়ে আছে। গণ-প্রহার, হত্যা, খুন, রক্ত...। আর এর কারণ কী ? একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই সমস্তকিছুর মূলে সক্রিয় একটাই কারণ - সন্দেহ, সন্দেহ আর সন্দেহ। শুধু মাত্র সন্দেহের বসে, গুজবে কান দিয়ে গণহত্যায় শামিল হচ্ছি আমরা। এখন আর সবসময় গুজবেরও দরকার হচ্ছে না। সন্দেহটুকুই যথেষ্ট। কখনও বা মোবাইল চোর সন্দেহ, কখনও গরু পাচারকারী সন্দেহ, কখনও বা শিশু চোর সন্দেহ, কখনও খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে বলে সন্দেহ...। তাছাড়া রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সংক্রান্ত হত্যা তো রয়েইছে। 

ডাক্তার চিকিৎসা করতে ভয় পাচ্ছেন। শিক্ষক ক্লাসে যেতে ভয় পাচ্ছেন। কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেও দ্বিধা। ভালোবেসে পাড়ার কোনও বাচ্চাকে চকলেট দেওয়ার পর আপনি ছেলেধরা সন্দেহে গণরোশে রক্তাক্ত হতে পারেন। কোনও মেয়ের ব্যাগ বা কিছু মাটিতে পড়ে গেছে। আপনার মনে হয়তো জেগে উঠল আপ্তবাক্য-'Dont allow any women to bend before you'। সৌজন্যবশত আপনি এগিয়ে তা তুলে ধরলেন ভদ্রমহিলার সামনে। ইব্‌টিজার সন্দেহে খুনও হতে পারেন। আপনি অটো চালক। আপনার পাশে বসা মেয়েটির ওড়না বা শাড়ির আঁচল হয়তো উড়ছে। উড়ে এসে আপনার চোখমুখকে আড়াল করল। বা চাকায় জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল। আপনি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সরিয়ে দিলেন। সাবধান! আপনি একা নয়, সকল অটোচালকই শ্লীলতাহানির দায়ে অভিযুক্ত হবেন। খবরের শিরোনামেও চলে আসতে পারেন ধর্ষক হিসেবে। আর তখন হয়তো আপনি হাসপাতালের বিছানায়। হয়তো আপনি শারীরশিক্ষার শিক্ষক। আপনার সহকারী কোনও ম্যাডাম নেই। আমাদের এখানকার স্কুল-কলেজে তার ব্যবস্থাও নেই। কোনও সময়ে ছাত্রীটির হাত ধরে ব্যায়ামের কৌশল শিখিতে দিতে সাহায্য করছেন। সাবধান! মুহুর্তে ধর্ষকের তক্‌মা উঠতে পারে আপনার গায়ে। বা আঁকার ক্লাসে ছাত্রীটির হাত ধরে ড্রয়িং-এ সাহায্য করছেন। সাবধান! মুহুর্তে আপনার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আড়চোখে তাকাবে। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হবে না। উন্মত্ত অভিভাবকদের সামনে নিমেষে শেষ হয়ে যাবেন। বা আপনি ডাক্তার। মৃত্যু পথযাত্রী বিপন্ন কোনও রোগীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলেন না। আপনি নিজেই বিপন্ন হয়ে যাবেন। আপনি আর সেবক ডাক্তার নন। ব্যবসায়ী, খুনী বলে দেগে দেবে আপনার বন্ধুজন। আর খুনী ধর্ষক হলে তার শাস্তি তো পেতেই হবে। রাস্তাঘাটে গণবিচারকরা আপনার বিচার করতে সর্বদা প্রস্তুত। 

শুধু মাত্র আপনার পছন্দের কোনও মাংস খাওয়া, পছন্দের পোশাক পরা বা পছন্দের কারো সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর জন্যও আপনি গণপিটুনির শিকার হতে পারেন। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পদবী, নাম, জাত, ধর্ম, গোত্রের জন্যও মার খেতে পারেন জনগণের হাতে। আর গণতন্ত্রে 'গণ' (গণপিটুনি, গণধর্ষণ, গণহত্যা...)-কোনও কিছুই এখন অপরাধের মধ্যে পড়ে না। বরং ক্ষমতা এগুলিকে প্রশ্রয় দেয়। জনতা জনার্দন বলে কথা। অতএব সাধু সাবধান! সবাই উন্মত্ত এখন! সকলেই অরক্ষিত! হয়তো শুধু গরুরাই সুরক্ষিত। কারণ দেশজুড়ে গোরক্ষকরা সদা জাগ্রত এখন। 

এটাই এখন আমাদের দেশের মানবিক মানচিত্র। কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এগুলোকে সরিয়ে রাখা ঠিক হবে না। সবসময় নানাভাবে সকলকে উন্মত্ত করে রাখার চেষ্টা চলছে। গণপিটুনি এখন খুব সংগঠিত ভাবে হচ্ছে। শিকার মুহুর্তের মধ্যে শিকারি হয়ে যেতে পারে। শিকারিরাও যে শিকার হয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে অধিকাংশ সময়ে আমাদের হুঁশ থাকে না। আমাদের প্রাত্যহিকতায় এরকম কত উদাহরণ সঞ্চিত হচ্ছে। এখানে আলাদা করে উল্লেখ বাহুল্য হবে। ধীরে ধীরে এটাই যেন জীবনের শর্ত হয়ে উঠছে। 

সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। সমাজ থেকেই উঠে আসে সাহিত্যের বিষয়। এই খুন -হত্যাআতঙ্ক-উন্মত্ততা-বিপন্নতার চিত্র স্বভাবতই সাহিত্যে উঠে আসবে। এসেওছে আগে। 

উল্লেখ্য নবারুণ ভট্টাচার্যের 'চাঁদের চোয়াল' গল্পের পটভূমি একটা বাসস্টপ। বাসস্টপের শেডের পিছনে একটা হলদে কালো হোর্ডিং। সেখানে গামছায় জড়ানো একটা কাতান আর ভোজালি নিয়ে দুজন মাস্তান অপেক্ষা করছে। নির্দিষ্ট প্যান্ট-পাঞ্জাবি পরা বেঁটে লোকটি ব্রিফকেস নিয়ে বাস থেকে নামার পরই আক্রান্ত হয়। লোকটার মাথা-বরাবর কাতান। সেই সময় উল্টো দিকের রাস্তায় একটা পুলিশ ভ্যান। ভ্যান থেকে নেমে পা ঠুকে ঠুকে ইন্সপেক্টার এগিয়ে আসে। 'ইন্‌স্পেক্টর ডান হাত দিয়ে দেখায়। আঙুল দিয়ে। নিয়নের আলো দপ করে উঠলে পড়া যায়। হোর্ডিং। -কি লেখা, ওটা ? 

প্রকাশ্য রাস্তায় মাংস কাটা ও বিক্রি করা আইনতঃ অপরাধ 

-কলকাতা পুরসভা 

ইন্‌স্পেক্টর গট্‌ গট্‌ করে হেঁটে, রাস্তা পেরিয়ে, ভ্যানে গিয়ে ওঠে। আপন মনে বলে-কোনো সিভিকসেন্স নেই। পুলিশ ভ্যানটা চলে যাওয়ার পরে কাতান আর ভোজালি বেঁটে লোকটাকে হিঁচড়ে হিঁচড়ে, বাস স্ট্যান্ডের শেডটার পেছনে, ভেজা চাপ চাপ অন্ধকারের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল।' 

দেড় দশকেরও বেশি আগে লেখা এই গল্প বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এখন। আমরা যে সময়ের ভিতর দাঁড়িয়ে স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারি সেই সময়েরই ছবি। সেই সমাজেরই ছবি নবারুণের এই গল্প। লেখককে বেশি কিছু বলতে হয় না। শুধু ঘটনাটাকে এমনভাবে তুলে ধরেন যাতে করে আমাদের অভ্যস্ত ঠুলিটা মুহূর্তে সরে যায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের সমাজ-বাস্তবতার কিছু অমোঘ চিহ্ন। টিভির পর্দায় দেখা, কখনও-বা ট্রামে-বাসে রাস্তাঘাটে দেখা অভ্যস্ত চলচ্ছবি আমাদের তেমন নাড়া দেয়নি। কিন্তু সেই দৃশ্য গল্পটিতে পড়ে শিউরে উঠতে হয় বইকী। নবারুণের কৃতিত্ব এখানেই। নেতা মন্ত্রী আমলা প্রশাসন এসব দেখেও দেখে না। চুপচাপ থাকে। প্রশাসনের মৌনতা যেমন অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়, তেমনি উসকানিও দেয়। তাই দিনদিন এরকম ঘটনা বাড়ে। আদালতে প্রায়শই সরকার ভর্ৎসিত হয়। রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সরকার উভয়েই। কিন্তু এতে হুঁশ ফেরে না। অনেককিছুর মতো আমরাও এসবে অভ্যস্ত। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, নেতা মন্ত্রীরা অপরাধ করে ছাড় পেয়ে যান, আদালত শুধু ভর্ৎসনা করে । এইটুকুই। এসবই যেন চিরন্তন সত্য। ইটারনাল ট্রুথ! 

প্রশাসন কখনও নিষ্ক্রিয়। কখনও অতি সক্রিয়। কিছু কিছু ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটলেও তাদের নজর এড়ায় না। আবার কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও প্রশাসনের চোখে পড়ে না। অর্থাৎ অন্য কারো চোখে পড়বে না স্বাভাবিকভাবে। তাই নির্দ্বিধায় মাস্তানরাজ চলে। নেতারা দাদারা চাকরি দিতে না পারলেও কাজ দিতে পারেন। 

শমীক ঘোষের 'একটি অতিলৌকিক কথন অথবা নিছক কইমাছ' গল্পে এরকম কাজ করে সুবল। সুবল বুড়োদার হয়ে কাজ করে। কাজ বলতে মানুষখুন, চমকানো ইত্যাদি। খুনেরও কত রকমফের। অদ্ভুত এক হত্যাকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে। নৃশংস ও অভিনব। গল্পে দেখছি একটা লোককে সুবল ও তার দলবল ট্রেনলাইনের ধারে টেনে নিয়ে গেল। সুবল জ্বলন্ত সিগারেট বসিয়ে দিল লোকটার কপালে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে একটা জ্যান্ত কই মাছ বার করে দু-দিক থেকে মাথা চেপে রেখে ঢুকিয়ে দিল মুখে। তারপর খুব জোরে চেপে মুখটা বন্ধ করে রাখল। জিভের লালায় জলের আর্দ্রতায় টাকরায়, গলায়। বোকা কই মাছ জলের সন্ধানে কানকো মারতে মারতে, আলজিভ-গলা-পাকস্থলীর উপরিভাগ ছিন্নভিন্ন করতে করতে নামতে লাগল। ততক্ষণে মুখে লিউকোপ্লাস্টের আঁটোসাঁটো বাঁধুনি লেগে গেছে। সাদা লিউকোপ্লাস্ট লাল হয়ে উঠছে ভলক ভলক রক্ত। লোকটার চোখ মুখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। 

ছেড়ে দেওয়া লোকটা উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো টলতে টলতে, পাক খেতে খেতে, গোঙানিতে, রক্তে ভাসতে ভাসতে, রেললাইনের পাথর ছিটকোতে ছিটকোতে রেললাইনে মাথা ঠুকতে লাগল। 'মৃত্যু তার কাছে এলানো তাকিয়ায় মাথা রাখা নরম হিম নয়। মৃত্যু আসলে বহুক্ষণ ধরে প্রবল যন্ত্রণায় মাথা খোঁড়া সুনিশ্চিত।' 

কই মাছটা নিজেও ছটফট করতে করতে মরছে। এই মানুষটাও। নৃশংসতার সমস্ত সীমাকে অতিক্রম করে গেছে এহেন হত্যালীলা। এই হত্যা পদ্ধতির নাম 'কইকরা'। 

এরপর সুবলের মনে হয় মুখে তার রক্ত লেগে আছে। সে বুড়োদাকে গিয়ে বলে এই কাজ আর করবে না । কিন্তু চাইলেও ছাড়া পায় না। সে ছাড়তে চাইলেও স্বাভাবিক নিয়মেই বুড়োদা ছাড়তে দেয় না। কারণ বুড়োদার মতো মানুষদের আশ্রয় তো সুবলদের মতো বেকার দরিদ্র ছেলেরা। এই সমাজ ভালো করে বাঁচতে দেয় না। একবার ভুল পথে পা দিলে সেখান থেকে ফেরার উপায় থাকে না। সেই পথটাকে সঠিক পথ বলে প্রমাণ করতে চায় ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষেরা। নেতা-দাদারা। রাজনীতির রঙিন আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে তথাকথিত সমাজবিরোধীরা সমাজসেবীর শিরোপা পায়। এই ঘোষিত সমাজসেবী দাদারাই ছড়িয়ে দেয় গুজব। সন্দেহের বিষ। 

সন্দেহের বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের দেশের সর্বত্র। অপছন্দ হলেই তাকে সরিয়ে দেওয়া যায়। অপছন্দ হওয়ারও বিশেষ কোনও কারণ থাকে না। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আর ব্যক্তিবিদ্বেষকে আলাদা করার উপায় থাকে না সবসময়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে সংখ্যালঘু মুসলমানরা ও দলিতরা বেশি করে আক্রান্ত হচ্ছেন। 

পশ্চিমবঙ্গের বহু দরিদ্র মুসলমান কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। আর এখন তো মাঝে মাঝেই দেখা যায় প্রবাসী বাঙালি মুসলমানদের হিন্দুত্ববাদীদের হাতে আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এরকম ঘটনা থেকেই উঠে এসেছে নীহারুলের 'খোদাতালার কান্না' গল্পটি। মুকিমনগরের বেলালের চায়ের দোকানে সন্ধেবেলা টিভি দেখার ভিড় জমে। চা খেতে খেতে টিভিতে দেশ-দুনিয়ার খবর দেখার মজাই আলাদা। গ্রামের সব চেয়ে বৃদ্ধ মানুষ কাসেম আলিও আসেন কতদিন আগে বিদেশে কাজে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে হয়ে যাওয়ার ছেলের যদি খোঁজ মেলে। অন্ধ তিনি। চোখে দেখতে না পেলেও টিভির দৌলতে কানে শুনে দেশ দুনিয়ার সবকিছু জানতে পারেন। এরকম এক সন্ধেবেলা হঠাৎ রাকিব হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে জানাল মৌলবির জামাই মাজু রাজস্থানে কাজ করতে গিয়েছিল। সেখানে খুন হয়েছে। সে বিদেশে গিয়েও গ্রামের কথা ভোলেনি। বিপদে আপদে টাকা পাঠিয়েছে। কারো অসুখের কথা শুনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। নিজে পড়তে পারেনি বলে গ্রামে কেউ পড়লে তার খরচ দিয়েছে। সেই মাজুই খুন হল! 

টিভিতে নয়, তার সেই খুনের খবর মোবাইলে মোবাইলে দুনিয়া জাহানে ঘুরছে। রাকিবের মোবাইলেও আছে। সে সেই ছবি দেখায় সকলকে - সাদা প্যান্ট, লাল জামা পরা একটা লোক মাজুকে কোপাচ্ছে। মাজু কোপ খেত খেতে জিজ্ঞেস করছে-'বাবু মারছো কেনে-ও বাবু আমি তোমার কি করনু...'। আর কিছু বলতে পারল না। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ল। লোকটা মাজুর শরীরে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মাজুর শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। 'না, শুধু মাজুর শরীর দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে না, বেলালের চায়ের দোকানে বসে যারা রাকিবের মোবাইলের পর্দায় সেই দৃশ্য দেখছে প্রত্যেকেরই অন্তর কেঁপে উঠছে। মাজুর সঙ্গে প্রত্যেকেই যেন কোপ খাচ্ছে। পুড়ে মরছে। মাজু ওই অবস্থায় পড়েও কিছু কথা বললেও এরা কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবার মুখে আশ্চর্য এক কুলুপ। শুধু বৃদ্ধ কাসেম, সেই ছোটবেলায় বসন্তরোগে যে অন্ধ হয়ে গেছিল, বহুদিন আগে যার ছেলে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল, সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তবে শুনতে পাচ্ছে। না, মাজুর আর্তনাদ নয়। সে শুনতে পাচ্ছে কারো কান্না! কে কাঁদছে তবে ?...বৃদ্ধ কাসেম আলি যখন ঠিক ঠাওর করতে পারছে না, তখন তার মনে হচ্ছে তাহলে নিশ্চয় খোদাতালা কাঁদছেন। আর খোদাতালার সেই কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে দুনিয়াজাহানে।' 

নীহারুলের আলোচ্য গল্পের ঘটনার কেন্দ্রে আছে কয়েকমাস আগের একটি ঘটনা। বর্বর, নৃশংস, বীভৎস ঘটনার জীবন্ত এই ছবি আমরা দেখেছি সকলে। মরতে মরতে মানুষটি হাতজোড় করে কাতর আবেদন করছে বাঁচার। একজন এই ঘটনা ভিডিও রেকর্ড করছে। খুনী নিরুত্তাপ। গর্বিত সে। সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত না হলে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে না। আড়ালে আবডালে নয়। প্রকাশ্যে ঘটেছে এই হত্যলীলা। আক্রান্ত মানুষটির অপরাধ কী ছিল ? না সে মুসলমান। আমরা কোন্ দেশে বাস করছি! এই ঘটনার কথা ভাবলে শিউরে উঠি এখনও। লজ্জা হয় বইকি! 

একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে নীহারুল বলেছেন তাঁর এলাকার প্রায় পঞ্চাশজন মানুষ বাইরে কাজ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তাদের খবরও পাওয়া যায়নি। বাড়ির লোক ছাড়া এলাকাবাসী যে তা নিয়ে খুব ভাবিত তাও নয়। কারণ দারিদ্র। প্রতিদিন রুটিরুজির জন্য যেভাবে তাঁদের লড়াই করতে হয়, এর বাইরে সমাজ-রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনও পরোক্ষ আক্রমণ তাঁরা আঁচ-ই করতে পারেন না। 

বস্তুত বাংলায় বিপন্নতা, সন্ত্রাস ইত্যাদি নিয়ে যত গল্প লেখা হয়েছে তার অধিকাংশ লেখায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমানদের বিপন্নতাই এবঙ্গের গল্পে বার বার বিষয় হয়ে উঠেছে। তার আলোচনা এখানে বাহুল্য হবে। সংখ্যাগুরুদের বিদ্বেষ এখন আর প্রচ্ছন্ন নয়। কখনও কখনও এই বিদ্বেষ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে। আর সেখান থেকেই চারপাশে তৈরি হচ্ছে অবিশ্বাসের বাতাবরণ। সংখ্যা লঘু, সংখ্যা গুরু নির্বিশেষে কমবেশি সকলেই এখন ধর্মীয় মেরুকরণের শিকার। শুধু মানুষ নয়, দেশের স্থাপত্য, ঐতিহ্য ইত্যাদিকেও ধর্মের রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ধর্মীয় মেরুকরণের শিকার হচ্ছে তারাও। নতুন করে ইতিহাসের ব্যাখ্যা হচ্ছে। প্রয়োজন মতো ইতিহাস বদলে দেওয়া চলছে। কদর্য কাল্পনিক উপাদান নির্ভর করে ইতিহাস রচনা হচ্ছে। নতুন দেশের নতুন ইতিহাস! তাই 'তাজমহল' হয়ে যাচ্ছে 'তেজঃমহল'। এরকম আরও কত উদাহরণ আমাদের সামনে। 

খুব সহজেই আমরা এসব বিশ্বাসও করে ফেলছি। প্রশ্ন করতে ভুলে যাচ্ছি। আর বিশ্বাসের উল্টোপীঠে আছে অবিশ্বাস। এক ধরনের বিশ্বাস জন্ম দিচ্ছে আরেক রকম অবিশ্বাসের। সুকৌশল উপস্থাপনের ফলে কিছু মানুষের কথা, অলিন্দ থেকে ভেসে আসা কথা বিশ্বাস করছি। আর কিছু মানুষের প্রতি প্রকট হয়ে উঠছে। অবিশ্বাস। বড় সহজেই আমরা চিহ্নিত করতে পারছি শত্রুকে। এরকম অন্ধকার আবহে স্বাভাবিকভাবেই ভুল হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। নিজেদের অজান্তে নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠি। 

উল্লেখ করা যেতে পারে সোহারাব হোসেনের 'ছায়া প্রলম্বিত' গল্পটির কথা। অযোধ্যার বাবরী মসজিদ ভাঙার ঘটনার অমোঘ প্রভাব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেও পড়েছিল। বহুদিন ধরে একসঙ্গে বসবাস করা দুটি ভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ রাতারাতি পরিণত হয়েছিল শত্রুতে। অধিকাংশ মানুষই না বুঝে মেতে উঠেছিল রক্তখেলায়। গল্পে সেই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ছবি ফুটে উঠেছে। এ গল্পের সত্তর বছরের রাকাছতুল্লা ছেলে আব্দুর রহিমের রেডিওতে শোনে - 'কোথাকার এক মসজিদ ভাঙার নাম করে সমগ্র দেশে মানুষের মাথা-মাজা-মেরুদণ্ডের হাড়গুলোকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে।' রাজ সকালে তার কানে খবর আসে আশপাশের গ্রামে-তাবৎ পৃথিবীর মানুষ খুন হচ্ছে। জীবনের সত্তরটা বছর একসঙ্গে এক আবহাওয়ায় কাটানোর পর মানুষ কীকরে মানুষের শত্রু হতে পারে সে বুঝতে পারে না। 

এরকম একটা সময়ে শীতের রাতে তাকে একা আসতে হয় মাঠে ধান পাহারায়। অধিকাংশ মানুষই ফসল কেটে বাড়ি নিয়ে চলে গেছে। কয়েকজনের ধান এখনও পড়ে আছে মাঠে। রাতে পাহারা না দিলে চুরি যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। টোঙঘরে নিদ্রাহীন কাটে তার। সঙ্গে আছে লাঠি আর ধারালো দা। পাশের গ্রাম থেকে। মাঝরাতে শব্দ আসে দাঙ্গার। মানুষজনের মারামারির। বাইশ বছরের সদ্য বিয়ে করা ছেলের জন্য মন খারাপ হয় । তার উপর কোনও আঘাত এলো কিনা কে জানে! এরই মধ্যে কানে এল দাঙ্গার ধ্বনি। তার নিজের গ্রাম থেকে 'নারায়ে তকবির-আল্লাহ আকবর।'মেটের হাটের পশ্চিমপার থেকে-'জয় শ্রীরাম।' সঙ্গে আগুনের শিখাও দেখা যায়। এরপর আর বসে থাকা যায় না মাঠে। রাকাছতুল্লা বেরিয়ে পড়ে টোঙ ছেড়ে। কিছুটা এগোনোর পর মনে হয় একটা আবছায়া মূর্তি ধানগাছের মধ্যে দেহ ডুবিয়ে বসে আছে। ভয় করে তার। সময় নষ্ট না করে দ্রুত টোঙের ভিতর ঢুকে সাদা চকচকে ফলাযুক্ত দা-গাছাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। মানুষটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। চোয়াল ও পেশি শক্ত করে প্রতিরোধ শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করে। এই শীতেও গলগল করে ঘামে সে। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরে রাকাতুল্লা সিদ্ধান্ত নেয় শত্রুকে আক্রমণ করার। অস্ত্র বাগিয়ে এগিয়েও যায়। দেখে, শত্রুটা পিছিয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে তাড়া করতে গেল। দেখল, লোকটাও সমগতিতে পিছিয়ে গেল। আরও জোরে ছোটার চেষ্টা করল সে। আর তখনই ধানগাছে পা জড়িয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র গোঙানির শব্দে উত্তর-বিল। কেঁপে উঠল। 

রাকাছতুল্লার রক্তাক্ত দেহ থেকে উঠে আসা শব্দ ছড়িয়ে পড়ে সারা মাঠে। নিজের হাতের চকচকে ফলাযুক্ত দা-গাছাটা বুকের ঠিক মাঝখানে আমূল প্রবিষ্ট হয়ে গেছে তার। গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে। সেই অবস্থায় মাথা তুলে দেখল লোকটা, শত্রুটা উধাও হয়ে গেছে তার পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। 

আসলে রাকাছতুল্লা এতক্ষণ যুদ্ধ করেছিল নিজেরই ছায়ার সঙ্গে। নিজের ছায়াকেই শত্রু ভেবেছিল সে। আতঙ্ক থেকে নিজের ভাবনায় প্রতিমুহুর্তে জন্ম নেয় অজানা অচেনা শত্রুর। আর সেই শত্রুকে মারতে গিয়ে নিজেকে নিজেই মেরে বসে মানুষ। দাঙ্গা জনিত আতঙ্ক থেকেই এরকম হয়। বিশেষত আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের চেতনায় আতঙ্ক জেগে থাকে সারাক্ষণ। ভয় থেকে আতঙ্ক থেকে অলৌকিক বিভ্রমের জন্ম হয়। আর সেই বিভ্রমে বিপন্ন হয়ে যায় মানুষের জীবনও। 

এখন আর শুধু সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিপন্ন হতে হয় না। দল-মত-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই বিপন্ন। গণঘৃণার শিকার। 'এই ঘৃণার আগুন আজ আর কেবল 'আক্রমণকারী', 'দেশদ্রোহী', মুসলমানেই সীমাবদ্ধ নেই। মহিলা, দলিত, ট্রান্সজেন্ডার, দিনমজুর, টিউশন পড়িয়ে বেঁচে থাকা যুবক, গুজবের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া সমাজকর্মী- পুড়ছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠীই। আপনার, আমার সবার দিকে লেলিয়ে দেওয়া এই উন্মত্ত জনতা জানে একটাই কথাঃ 'আই ওয়ান্ট টু হেট।' সেই ঘৃণায় পুড়ে যাওয়া আপনিও, এই নয়া ভারতের পরিকল্পিত রাজনীতির কাছে কেবল কোল্যাটারাল ড্যামেজ।' (রোহন ইসলাম, পিটিয়ে মারার ব্যস্ত শ্মশানে, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯/০৭/২০১৮) সারা দেশে ব্যাপ্ত এই হিংস্রতার দায় ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে স্বীকার করতে হবে। দেখেও না দেখার ভান করে গেছিলাম আমরা। গা বাঁচিয়ে চলেছিলাম। এভাবেই প্রশ্রয় দিয়েছি। পরোক্ষভাবে উসকানিও। আগুন জ্বলছিল অনেকদিন ধরে। তা নেভানোর চেষ্টা করিনি। তাই এখন সেই জ্বলন্ত আগুনে বড় সহজে ঘৃতাহুতি করতে পারছেন সুবিধাবাদী নেতারা। উন্মত্ততার আবহে বসবাস করেও নিজেকে স্থির রাখতে হবে। ক্ষমতা বা আইন দিয়ে নয়, মানুষের শুভবুদ্ধির বিকাশই পারবে এই আঁধার দূর করতে। নেতা মন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে থেকে এর সমাধান হবে না। হয়তো বা জনস্বার্থে আদালতে গিয়েও না। যে জনতারা এখন মনে মনে অস্ত্র শানাচ্ছে সেই জনতারাই পারবে বিষাক্ত সমাজ সভ্যতাকে মুক্ত করতে। অন্ধকারে আলো জ্বালাতে। শেষ পর্যন্ত মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ