ইকবাল হাসান'এর গল্প : পবন মাঝির নাও

ঘাডেই তো বান্দা আছেলে। তয় গেলে কোম্মে ? 

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে পবন। 

ঘাটে দু’একটি নৌকোর সাক্ষাৎ মিলল বটে, এবং চোখ রগড়ে সে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। এর মধ্যে তার নৌকাটিও তো থাকার কথা। কিন্তু নেই।

কুয়াশা এমন নেমেছে যে, খাল পার থেকে একটু দূরে, যদিও নদী আছে কি নেই তাই বা কে জানে, পবনের স্মরণ হয় যে, এই বাদুরতলা ও ওপাড়ে নলবুইন্না গ্রাম, যেখানে তার ইষ্টিকুটুমসহ মোট বারোটি পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল একদা, তাদের অন্নদাতা বিশখালি নদী, এখানেই ছিল, এবং এখনো যদি থেকে থাকে তবে তা দৃষ্টির অগোচরে ঘন কুয়াশার তলদেশে পলায়নরত; আর এ অবস্থায় তার নৌকাটির বন্ধনহীন ভেসে যাওয়ার একটা অশুভ সম্ভাবনা পবনকে কিঞ্চিত বিভ্রমের দিকে ঠেলে দিলে সে সহসাই অস্থির হয়ে ওঠে। 

ডানে বায়ে তাকিয়ে দেখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে আশপাশে কারো উপস্থিতির কিন্তু চারদিকে কুয়াশার দেয়াল আর এই কুয়াশাপ্লাবিত ভোরবেলা, মানুষের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে তারা আধা-আন্ধা পবনকে সঙ্গ দিতে আসবে, এবং এখন কাউকে না দেখতে পেয়েও তার ধারনা হয় যে, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আছে আশেপাশে কুয়াশার ভিতর, ডাক দিলেই সাড়া পাওয়া যাবে, অতএব সে যখন ‘ও হাতেম, আইছো নাহি’-- বলে ডেকে ওঠে, না বাম দিক থেকে, না ডান দিক থেকে, তখনো কারো সাড়াশব্দ আসে না। কিছুক্ষনের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় পবন। 

কেউ আছো নাহি ধারে কাছে ? মোর নাওডা নেলে কেডা ? 

পবন গলা চড়ায় কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয় না। 

কুয়াশার দেয়ালে আছড়ে পরা শব্দেরা তার কাছেই ফিরে আসে। 

তখন সন্দেহ হয় পবনের, এখন কি তাহলে ভোর বেলা নয়? এখন কি তাহলে রাত ? অই যে একটু দূরে নদীর উপর ফরফর করে উড়ছে ওগুলো কি কুয়াশা নয় তাহলে ? ওগুলো কি জ্যোৎস্না তবে ? কিন্তু আজ আসমানে তো চাঁদ নাই, চাঁদ ছাড়া জ্যোৎস্না হয়তো আছে, সে দেখছে না। চোখ রগড়ে সে দেখার চেষ্টা করে যদিও, এবং যদিও অই চেষ্টা নিরর্থক কেননা তখনো তার চোখের সামনে কালো কালো পোকামাকড় সদৃশ্য মৃতছায়ারা নৃত্যরত, এমত দৃশ্যে উপর্যুপরি হতাশ পবন ঘোরের ভিতর ক্ষনকালের জন্য হলেও নৌকার কথা বেমালুম ভুলে যায়। 

আছমানে তো চানেরই দেহা নাই, জোছনা আইবে কোম্মিদ্দ্যা ! অনর্থক আকাশের দিকে তাকায় পবন। কিছুই দেখে না সে যদিও কিন্তু টের পায়, কুয়াশা জ্যোৎ¯œা সকাল রাত নদী খাল নিয়ে পুরো বাদুরতলা গ্রাম যেন সহসা জাপটে ধরে তাকে। 

মোর নাও নেছে কেডা -- বলে সে হঠাৎ আসমান জমিন কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে। 


২. 

পবনের এই আর্তচিৎকারে, যা এখন অনেকটাই ‘নাড়ি ছেড়া নবজাতকের প্রথম চিৎকারের’ মতো শোনায়, আড়মোরা ভাঙে গাছের পাতারা, সহসা জেগে উঠে স্থান বদল করে হতচকিত পাখিরা। একটা তক্ষক ডেকে উঠে পরমুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়ে যায় দূরে কোথাও। 

ও পবন বিরবির কইরা কার লগে কতা কও ? কোন রকম জানান না দিয়ে হরিহর সামনে এসে দাঁড়ায়। 

যেন সে এতোক্ষন বিলীন ছিল নিশ্ছিদ্র কুয়াশার অন্তপুরে। 

ও হরি, মোর নাওডা নেলে কেডা ? ইট্টু দেহো দেহি, ঘাডেই তো বান্ধা আল্হে। 

কী যে কও পবন ! হেই একই কতা তিনকাল ধর্ইরা কইতাছো। তোমার নাও আছেলে কবে? 

এর উত্তর কি হবে অজানা নয় হরিহরের, পবনকে রাগাতে ভালোলাগে তার। 

হালার পো হালায় কয় কি? তোর মাইয়্যা শিবানীরে যে বিশখালিতে ভাসাইয়া দিলি হেইডা কার নাও ছিল ? তোর বাফের? শিবানীর কথাটা আসলে সে বলতে চায়নি কিন্তু রাগের মাথায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। 

নৌকা তার কোনোদিনও ছিল না -- এমন ডাহা মিথ্যা কথায় মাথায় রাগ চড়ে যায়, আজো চড়ে গেল এবং হরিহর যেন কিছু বলতে চাইলো, আর তখন-- চোপ হালার পো হালা, নাইলে চোপরাইয়া দাঁতের পাজরা হালাইয়া দিমু-- বলে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো পবন। {সেকেন্ড ব্রাকেটের মতো }বাকানো শরীরটকে অতিকষ্টে দাঁড় করাতে পারে বটে এবং অতঃপর তার অতি কৃশকায় হাতখানি যখন হরিহরের দিকে লম্বমান হয়, দূর থেকে এমত দৃশ্যে ভ্রম হ’তে পারে যে, সে আসলে একটা অবলম্বন খুঁজছে শরীরটাকে খাড়া রাখার, এবং সহসা দেখে যে, তার সামনে হরিহর বলে কেউ নাই। হালকা একটু বাতাস বইছে শুধু। কোথাও কেউ নাই। অতএব লম্বমান হাতখানা তার কাছেই ফিরে এসে মাচানের চিচিংগার মতো ঝুলতে থাকে যেন। 

তক্ষকটা আবার ডেকে ওঠে দূরে কোথাও। আর তখনই পবনের স্মরণ হয় যে, হরিহর কোথা থেকে আসবে ? সে তো স্বাধীনের পরপরই নিখোঁজ। 

হরিহর যদি নাই থাকবে তাহলে, তোমার নাও আছেলে কবে -- এই কথা কে বলল ? সেই বা কাকে বলল, ...হালার পো হালা, চোপরাইয়া দাঁতের পাজরা হালাইয়া দিমু! ময়লা শাদা লুঙ্গি আর ছেঁড়া গেজ্ঞি গায়ে কাকে সে দেখল তবে, কুয়াশা কিংবা জ্যোৎস্নার ভিতর ? 

বিভ্রান্তির অতলে তলিয়ে যায় পবন। 

৩. 

বিভ্রান্তি থেকে তাকে রেহাই দেয় শিবানী, সে বলে হঠাৎ, ও কাকু, যা অবার তা তো অইছে। এহন মোর লাশের পাশে বইয়া বাফের লগে কুয়াইল দিয়া কান্লে মোরে কি ফেরত পাবা ? মোরে ভাসাইয়া দাও, মুই সাগরে যাইয়া ঘুম দি। 

মাগো, আর একটুহানে থাক মোগো লগে। তোরে আর একটুহানে দেহি। শিবানীর মাথায় হাত রেখে বলে সে। 

তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে পবন, আর তখন আবার সামনে এসে দাঁড়ায় হরিহর। 

সে স্পষ্ট দেখে যে, চোখ কোটরাগত, ভাঙা চোয়াল, দাঁত আছে কি নেই, খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি নিয়ে হরিহর এখন তার চোখের সামনে মানুষরুপে কংকাল যেন, যেন চিতার আগুন সহ্য করতে না পেরে শরীরের হারমাংশঅস্থিমজ্জা বিসর্জন দিয়ে এইমাত্র উঠে এসেছে পোড়ামংশের গন্ধ নিয়ে। মানুষ পোড়ার গন্ধ বড় তীব্র হয়, পবনের নাকে লাগে খুব। 

স্বাধীনের সময়ও হরিহর খুব যে তাগড়া ছিল তা নয়, বরাবরই কৃশকায় শরীর তার, এবাড়ি ওবাড়ি কামলা খেটে আর মা মরা মেয়েটাকে বুকের ভিতর আকড়ে ধরে দিন কেটে যেত কিন্তু শেষতক আর আকড়ে রাখতে পারলো কই ! একদিন ঈমান আলী মাতুব্বর এসে বললো, ও হরি, তোর মাইডা মোরে দিয়া দে। কামকাইজ করবে। মোর মাইয়ার লগে থাকবে আনে। 

হরিহরের মনে হ’ল, এ যেন ভগবানের অশেষ কৃপা, মা যেন স্বয়ং মুখ তুলে তাকিয়েছেন। 

কিন্তু ভগবানের এই কৃপাই কি কাল হ’ল শেষতক, হরিহর ঈমান আলীর পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে, বলে, মোর মাইডারে ক্যাম্প ইদ্দ্যা আইন্না দ্যান মাতবর সাব, আর ঈমান আলী যখন বলে, এহোন বাড়ি যা, কাল তোর মাইয়া ফেরত পাবি-- হরিহরের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। 

শিবানীকে রাজাপুর ক্যাম্প থেকে ফেরত নিয়ে আসে ঈমান আলী, আর মরা মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মা ভগবানকে খুঁজতে থাকে হরিহর, সাহস করে যে সান্তনা দিতে আসবে আশেপাশে এমন কেউ নেই, পবনের দেখাা মেলে শুধু। সে বলে, ও হরি, করবি কি এহোন? পোড়াবি না ভাসাইয়া দিবি? 

হরিহরের হাতে আজ মা কালীর রামদা, অন্ধকারেও যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছে। সে বলে, জোরে চালা পবন, রাইতের মধ্যে বাকী কামডাও হারতে অইবে। 

নদীর জল আরো কালো করে তুলেছে অমাবশ্যার তেলচিটচিটে অন্ধকার, আর নৌকার ভিতর একজন মৃতসমেত তারা তিনজন এখন একে অপরের কাছে মূলত অন্ধকার ছায়ামাত্র, আলোর চিহ্ন নেই কোথাও-- ভুল করে একটি কুপিও জ্বলে না, পবন আন্দাজ করতে পারে তবু যে, নৌকা তার চল্লিশকাউনিয়া, বেতাগী, আমুয়া, বরগুনা পেড়িয়ে সমুদ্রের কাছাকাছি প্রায়। 

শিবানীকে তারা এখানেই ভাসানোর সাব্যস্ত করে। 

৪. 

পুরো পথ অন্ধকারের মতোই যথাযথ স্থির থাকে হরিহর, তবে সহসা ঢুকরে কেঁদে ওঠে যখন পবন বলে, ‘শিবানীরে এহানেই ছাইড়া দিমু, কি কও হরি’ এবং নদী এখানে যথেষ্ট স্থির শব্দহীন বলে হরিহরের কান্না ব্যাপ্তি লাভ করে। হরিহর বুজতে পারে যে, পবনও কাঁদছে। 

খোলা পাটাতনে বুকের উপর আড়াআড়ি হাত রেখে শুয়ে থাকা শিবানী হঠাৎ বলে ওঠে : ও কাকু, বাবারে একটু দেইখ্কা রাইক্খো। মোরে এহানেই ভাসাইয়া দাও, মুই সাগরে যাইয়া ঘুম দি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ