গ্রাম ডাক হয়েছে, নবরা ভিন্ন হবে । নব, খোকা আর সাধন তিন ভাই। তিন ভাইয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেপুলে আছে, অনেকদিন একসঙ্গে একঅন্নে থকলো, আর কী ! সারা জীবন কি ভায়ে-ভাজে বনিবনা থাকে !
খট-খুট মনোভাবটা ভেতরে-ভেতরে সে আজ সাত-আট বছর ধরে চলে আসছে। তখন সংসারের মাথায় একজন মালিক ছিল, কেউ বেশি বাড়তে পারেনি, মারা যাবার পর থেকেই সেটা জোর করেছে। বড়ো বউ একটা পেটিভাজা কাপড়ের আঁচলে ঢেকে নিয়ে ছেলের হাতে গুঁজে দেয়—যা খড়গাদার পিছনে লুকে-লুকে খেয়ে লিবি যা !
মেজোবউ আবার অতশততে নেই, সে নিজে যখন যা পাচ্ছে—দুধসর, ছোটো বউয়ের কচি মেয়েটার জন্য কৌটোয় বিস্কুট থাকে তার এক টুকরো, কিছু না পেলে দু’ গালে দু’ ফাঁক সুপারিই মুখে পুরে রেখে দিলো সারাদিন !
বড়ো বউ বলে মেজো বউয়ের হিংসা, ও-ই সংসারটা জ্বালিয়ে দিলো। মেজো বউ বলে—তোরা দু মাগীই সমান, ছোটকিও কম নয় ! ওর বাপ-ভাই নাকি কানের করে দিয়েছে, ওলো জানি লো সব !
এটাই ছিল নব-খোকা-সাধনদের পরিবারের শেষ ঝগড়া । বাপের বাড়ির নাম তুলতেই ছোটো বউ কোমরে কাপড় জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে এসেছে, সে খুকুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল, তার ওই একটিই মেয়ে, খুব ভালোবাসে মেয়েকে, খুক করে একটু কাশলেই সাধনকে গালাগাল দিয়ে থামতে দেবে না—হোমিওপ্যাথি হলেও কারো কাছ থেকে দু’পুরিয়া ওষুধ এনে দাও। আমাদের তো একটা মাত্র মেয়ে, ওদের চারটে করে । আমি আরও তিনটে ছেলের ভাগ পাই !
চেঁচিয়ে বলছে—হিসাব করে দ্যাখ ভাগ পাই কি পাই না !
মেয়ে যে বুকটা খাচ্ছিল সেটা জামার বাইরে ছিল, ভিজে লালামাখা, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঘাড় নেড়ে চিৎকার করছে আর সেফটিপিন দিয়ে ব্লাউজ আঁটছে ।।
তিন ভাই যে যেখানে ছিল ছুটে এলো, যে-যার বউকে টেনে নিয়ে এলো ঘরের মধ্যে। নব তার বউকে বলছে—বেশি কথা বললে মুখ ছিঁচে দেবো, একি ইতর- ছোটেলোকের ঘর নাকি, যে যা পারবে বলে যাবে, বংশের একটা মান সম্মান নাই!
খোকা তার বউকে কখন চড় মেরেই বসলো, আর কোথা ছিল মেজো।
বউয়ের কাঁদা ! মেজো বউ কাঁদছে আর তার দেখাদেখি তার চার ছেলে সমানে চিৎকার করছে। কান্নার সময় সব দোষ ছাড়, মেজো বউ এই সুযোগে যা মুখে আসছে বাখান করে যাচ্ছে। বাখানগুলোর সবটাই হয় বড়ো সংসারকে ঠেস দিয়ে, না হয় ছোটোর সংসারকে।
শুনে লাফ খেয়ে বেরিয়ে এলো সাধন। ছোটো বউ কিছু অনেয্য বলেন, তার সংসার এদের অর্ধেকও নয়, আর দু বছর বাদে ওদেরকে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে ।।
ছোটো বউও তদ্দণ্ডে বেরিয়ে এলো।
সাধন বললো—কাউকে আর কিছু বলতে হবে না ; আমি কালকেই গ্রাম ডাকছি, আমরা পৃথক হয়ে যাবো।
তোমরা মাগ-ভাতার দু’দিন ছাড়া কি পৃথক হবার ধমক দেখাও গো ! তোমার একটা ছেলে, আমাদের না হয় চারটা ছেলে, তা বলে কি বানে ভেসে যাবো !
বড়ো বউদি, বানে ভেসে যাবার কথা আমি কিন্তু বলিনি।
তোমাদের তো সেইরকম মতলব !
নব বললো—সকলে চুপ কর ! ছোটোলোকের মতো দুদিন ছাড়া এ রকম লোক হাসাহাসি ভালো নয় !
তারপর তিন ভাই তিনটে ঘরে বসে সিদ্ধান্ত করে ফেললো, তারা পৃথক হচ্ছে।
গ্রামের লোকজন এসে গেছে সকাল-সকাল। যে-কোনো আলোচনা-মিটিং, বিচার-পঞ্চায়েত, সাধারণত সন্ধের দিকে মজলিস বসে। শুধু পৃথক ব্যাপার আছে বলে গ্রামের লোকেদের এতো সকাল-সকাল আসতে হলো।
সকলে এক-এক করে এসে বসছে। তিন ভাই ঝটপট সতরঞ্জি-মাদুর-চ্যাটাই লম্বা করে পেতে দিয়েছে। এমনিতে আজ একটু বেশি জায়গার দরকার, এরই ওপরে শাড়ি, সোনারুপো, তৈজসপত্র সবকিছু রেখে ভাগ করা হবে।
সত্যি সত্যি ভিন্ন হবি তাহলে, কি রে খোকা ?
খোকা প্লেটে করে বিড়ি-দেশলাই বের করে এনে রাখলে।–আমি অনেক চেষ্টা করেছি কাকাবাবু, আপনারা আর আমাকে ওইটি বলবেন না। বিশ্বাস করবেন, আমি আমার স্ত্রীকে মেরে পাঁকাল মাছের মতো ফুলিয়ে দিয়েছিলাম ওইদিন। কিন্তু কী হলো! আর কেউ তার স্ত্রীকে কিছু বললো?
আসলে মেয়েরাই তো ঘরে ভাঙে রে, চিরদিনের কথা হয়ে আসছে।
কেন কৈকেয়ী, কৈকেয়ী কী করলো, এমন-করা অযোধ্যাপুরী তাকে ওই একটা মেয়েমানুষ এক্কেরে তছনছ করে দিয়ে গেলো।
ধান ভানতে এসে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে, এবার কাজের কাজ করো তো !
রোদ উঠে গেলে জমি ভাগ করা যাবেনি।
আজ কি জায়গা-জমিও ভাগ করে লিবি, না কি রে সাধন ?
হ্যাঁ-হ্যাঁ, হচ্ছে যখন একেবারে একহাতে সব করে নিই, ফের আপনাদের ডাকবো, আপনারা ফের কাজ কামাই করে আসবেন !
এক বাণ্ডিল বিড়ি খোলার সঙ্গে সঙ্গে সকলের হাতে হাতে চলে গেলো। প্লেটে আর দুটো মাত্র পড়ে আছে । রবি দাদু বললো—নাতবউকে দুটো পান-টান দিতে বলো হে, যারা ধোঁয়া খায় না তাদেরও একটু মুখ চলুক ! রবি দাদু বিড়ি খায় না।
হচ্ছে-হচ্ছে, বড়ো বউকে পান সাজতে বলে এসেছি । খোকা বললো—তার আগে একটু চা হচ্ছে, মেজো বউ চা করছে ।
চায়ের কথা শুনে সকলে খুব খুশি, একমাত্র গোষ্ঠ নাকি ওষুধ খাচ্ছে, সে ডাকলো খোকাকে—খোকা শোনো, আমি ভাই ওষুধ খাচ্ছি, আমার জন্য লেবু দিয়ে গিন্নিকে বরং একটু সরবৎ করে দিতে বলো।
চা-পান খেয়ে সকলে গুছিয়ে বসলো । ঘরে যেখানে যা ছিল, কুলো-পালি-চালা -হাতা-চাটু, বাক্স-পেটরা, বাসন-কোসন । ছেলে-মেয়ে-বউভাই সকলকেই উঠে পড়ে লাগতে হয়েছে, একটা গোটা সংসারের দীর্ঘকালের জিনিস । তুনকো-তুনকো ভাগ হবে, তিনটে কুমড়োর ফালি থাকলেও প্রত্যেকের একটা করে ।
একদিকে ধান মাপা হচ্ছে—রাম দুই তিন, আর একদিকে কাঁসা-পেতলের শব্দ হচ্ছে—ঠনঠন ঝনঝন !
সাতটা থালা তিন ভাই।
রবি দাদু জিগ্যেস করলো—কি করবি রে ?
পরী ঘোষ গুণ করলো—তিন দুগুণে ছয় ।
ওটা আমার ছোটো বেটাকে আপনারা দয়া করে দিয়ে যান গো, ওই থালাটা ছাড়া ছেলেটা খেতে বসতেই চায়নি ।
গোষ্ঠ বললো-বড়ো গিন্নি যখন এরো করে চাইছে, তখন বেশি থালাটা নবর নামেই লিখো !
তাহলে নব কিন্তু জগের ভাগও পাবেনি, গামলার ভাগও পাবেনি, ও দুটো ওদের দুজনকে দিয়ে দিচ্ছি।চ
বড়ো বউ ভাগের বাইরে গ্রামের লোকের কাছে এমনি-এমনি চাইছিল , দিলো না। উল্টো সাঁড়াসি হয়ে গেলো। সে নবকে ফিসফিস করে কি করলো—হ্যাঁ গো কাঁসার দাম বেশি না পিতলের দাম বেশি ?
চুপ করো !
সবকিছু এক-দুই করে লেখা হচ্ছে, ধীরেন লিখছে । রবি দাদু বললো—দ্যাখ, তোর হাতে কলম আছে বলে যেন এর ভাগ তার ঘাড়ে, তার ভাগ এর ঘাড়ে না পড়ে যায় !
ধীরেনের পাশের দু-তিনজন সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে কাগজটা দেখলো, সকলেই বিড়বিড় করে পড়ে বললো—না ঠিক আছে !
হু, এবার হার্ড ক্যাশ কী আছে বলো ?
সাধন বললো—দাদা মালিক, দাদা জানে।
আমি এই পঞ্চনারায়ণের আসন ছুঁয়ে বলছি...
একটা চাবি দেওয়া ছোটো টিনের বাক্স এনে সকলের সামনে বসিয়ে দিলো। এর ভেতরে যা আছে এই আমাদের জমা !
ধীরেনের দু’ নম্বর চলছে। এক নম্বর গেছে বাসন-কোসন, চাষীদের বাড়িতে নগদ টাকাকড়ি আর কোথায়, সবচেয়ে বেশি হলো বাসন-কোসন। এদের প্রত্যেকে শ্বশুর বাড়িতে যে-সব জিনিসপত্র পেয়েছে তার সঙ্গে ভাগ-বাঁটোয়ারার কোনো সম্পর্ক নেই। পিতৃদত্ত সম্পত্তি বউয়েরা যে-যার অনেক আগে থেকেই। সরিয়ে রেখেছে।
ঘুনসির দড়িতে চাবি বাঁধা ছিল, পাঁচজনের সামনে খুলে ফেলে দিলো ।
সাধন বললো—বাক্সে কত টাকা আছে আমরা সকলে জানি ! সাড়ে সাতশো টাকা, আর দেখতে হবে না।
আমার পাই-পয়সা সব লিখে রাখা আছে। খুদি, তোর অঙ্ক খাতাটা লিয়ে আয় তো।
মেজোবউ দরজার ফাঁক থেকে বললো—আমাদের কি শুধু কপি বিক্রি হয়েছে, সারা বছর আর কিছু চাষ হয়নি ? মুলা-বেগুন-টমেটোর...।
লেডি ডাক্তারের কাছে তিন মাস ধরে ওষুধ খাওয়ানো চলছে, গাছের মতন এক-একটা ভিটামিনের বোতল, আমাদের তো আর কারো কোনো রোগ-অসুখ নাই।
নব রেগে গেলো, সে ঘরের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে হাসপাতালের একটা রসিদ বের করে নিয়ে এলো।
আপনারা দেখুন, ছোটো বউ আমাকে পাঁচজনের সামনে এ রকম করে বললো। বড়ো বউর হাসপাতালে সরকারী অপারেশন হয়েছিল, সেজন্য তাকে এই একশো চল্লিশ টাকা দিয়েছে । গোষ্ঠদা, আপনারা দেখুন, দেখলেই বুঝতে পারবেন। আমি বউকে গৃহস্থের টাকা ভেঙে...
বড়ো বউ ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠলো—কানের ফুলটা কোথায় পেলি লো, চাল বিচে-বিচে বাপের ঘরের নাম করে কানের ফুল কিনেছে !
রবি দাদু থামিয়ে দিলো সকলকে। ক্রমশ একটু করে করে তিন বউ-তিন ভাই সকলের গলার স্বর চড়ে যাচ্ছিল। তারা অন্যায়টা বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। তারা প্রথম থেকেই প্রাণপণ চেষ্টা করছে কেউ কারুর বিরুদ্ধে কুৎসায় যাবে না। তারা মিলেমিশে ভিন্ন হচ্ছে, একসঙ্গে থাকার চাইতে যে-যার সংসার দেখবে, নিজের সুখ-শান্তি দেখবে, সেটাই ভালো। তবু থেকে থেকে কী হয়ে যাচ্ছে, একজন আর একজনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষে ফেটে পড়ছে।
ছোট বউ বললো—কোন্ ঘরটা আমাদের দিবেন দিয়ে দিন, আমি উনান। খুলবো ! ওদের-বা জোয়ান-জোয়ান ঝি আছে, এখুনি তাদেরকেই কুলবে নি, আমাকে একলাকেই তো করতে হবে !
আজ দুপর থেকে পৃথক রান্না হবে, ছেঁড়া চুলে আর খোঁপা বেঁধে লাভ নেই।
হ্যাঁ রে সত্যি কথা, ভিজা উনান শুকবে, তবে রো রাঁধা বাড়া ।
দুটো কোঠা ঘর, লম্বা তিন পাশ ঘেরা দুয়ার, একটা ওপর ।
ওপরটা তিন ভাইয়েরই থাক, বর্ষাকালে ধান শুকনা করবে কোথা ?
সকলে ঠিক করলো দুটো ঘর আর দক্ষিণের দলিজটা দুজনে নিক, পুব আর উত্তরের দলিজটা বাকি একজনের ।
ধীরেন জিগ্যেস করলো—কার নামে কোনটা লিখবো ?
হঠাৎ মেজো বউ বলে ফেললো—আমাকে দলিজ দিন, আমি আমার একধারে থাকবো ! আমার ঘরের দরকার নাই !!
—এই তো, তোরা বলু মেজো বউমা নাকি ঝগড়া করে, দেখ সে ঘর ছেড়ে দিল তোদেরকে। মেজো বউ ফ্যাস-ফ্যাস করে কেঁদে উঠলো। সকলে তো আমার দোষটা দেখে, জা’রা বলে, দেবর-ভাশুর বলে, এমন কি নিজের মানুষও...
–কেঁদো না বউমা, এ সংসার লয় গো,সঙ-'সার ! এখেনে দিবারাত্র সঙের খেলা ! অথচ আজ চোখ মুদলে কোথায় থাকবে তুমি, তখন তোমাকে পরনের বস্ত্রটাও অঙ্গে করে লিয়ে যেতে দিবেনে গো বউমা...আমরা আসছি লেংটা, যাবো লেংটা...
ধীরেন বললো—তুমি বাপু বড়ো আজেবাজে কথা বলো, , তোমার কথা শুনতে গিয়ে আমার লেখাটা ভুল হয়ে গেলো।
না রে লিখ-লিখ, ঘর ভাগটা ঠিক করে লিখ ।
নিম গাছের তলায় উঠে গেলো সকলে । কুয়োপাড়ে বিশাল নিমগাছ। বড়ো বড়ো ছ’খানাই ডাল ছিল, কিন্তু গত বছর একটা ডাল গেছে বাপের জন্যে। না হলে আজকে ভাগ করতে সুবিধে হরো।
নব বললো—এক কাজ করুন, আমি যখন বড়ো ভাই, আমার জন্য একটা ডাল রেখে দিন, আর ওই ছোটো ডালটা বড়ো বউয়ের জন্য, বাকি তিনটা তিন ভাইকে দিয়ে দিন ! গোড়াটা যখন চেরাই হবে তখন ভাগ হবে !
সকলেই নব-র চালাকিটা ধরতে পেরেছে, সে মরার কথা এতোটুকুও ভাবছে না, শুধু ডাল দুটো নেবার জন্যে মরার নামে ধান্দাবাজি করছে ।
সাধন ধমক দিলো—এখনও ঢের টাইম আছে ।
হ্যাঁ রে ইউপটাস না কি গাছ বেরিয়েছে, দু তিন বছরে গাছ হয়ে যায়, সদর হাসপাতালের ধারে ধারে দেখবি লাগানো আছে, তার দুটো হলে....
এ সব ফালতু কথা বাদ দিয়ে বলে দাও তো কার নামে কোনটা লিখবো ?
নব তবু ছাড়লো না, তিন দেড়ে সাড়ে চার, পাঁচখানা ডালের মধ্যে বাকি থাকছে আধ, ওই আধটা সে নিলো তার দাহর জন্য ।
খোকা জায়গা-জমির কাগজপত্র একটা চিকচিকি কাগজের ভেতরে মোড়া ছিল--সকলের সামনে এনে ফেলে দিলো ।
দেখে নিন অঞ্চলের রসিদটি পর্যন্ত আমার গুছিয়ে রাখা আছে ।
একটা-একটা করে দলিল, রেকর্ড, চেক সব বের করে করে পাঁচজনকে দেখাচ্ছে।
—এই হলো সাতশো ঊনষাট দাগ, আমাদের বড়ো জোত। ধীরেন দলিল থেকে পড়লো জমির পরিমাণ—দু’ একর পঁচাত্তর, উত্তরে নিজ, বাৎসরিক খাজনা তিন টাকা এগারো আনা দু পয়সা, রায়বাহাদুর সুচাঁদ নন্দীর সেরেস্তায় জমা দিতে হয় ।
পরী ঘোষ দু' একর পঁচাত্তরকেও মুখে মুখে ভাগ করে দিলো, সাতে একানব্বই ডিসমেল ।
অতো হিসাব-টিসাবে দরকার কি, চলো তো প্লটে চললা, দড়ি ধরে তিন ভাগ করে দেবো। ঝামেলা চুকে যাবে।
মোট জমি আঠারো বিঘা সাড়ে বারো কাঠা। ছবিঘা এক পোয়া এ রকমই প্রত্যেকের ভাগে পড়বে ।
তোদের এই জমিতেই সুখে চলে যাবে।
এমনি-এমনি কি চলবে, পরিশ্রম করতে হবে !
খোকা বললো—এরোদিন তো আমার খাটনিতেই সংসারটা ছিল, এবার দেখবো কে-কতো শুয়ে বসে থাকে !
সাধনের সহ্য হলো না, বলে ফেললো—যাদের বেশি লোকের সংসার তারা বেশি খাটবে, এবারে কে কতো সুখে থাকে দেখা যাবে !
চুপ কর—চুপ কর,শেষকালটায় আর ঝগড়াঝাঁটি-মনোমালিন্য করিস না !
সুলি-চাকুলি-বাঁকি বিল এ রকম বড়ো বড়ো খেতগুলোকে চোখ বন্ধ করে তিন ভাগে ভাগ করে দিলো গ্রামের লোক। সরেস-নিরেস নিয়ে নইলে ভাইয়ে-ভাইয়ে ফের গণ্ডগোল হবে । ছোটোখাটো খেতগুলোকে আপাতত গুনতি হিসাব, পরে আমিন নিয়ে এসে কাচ্চা-ছটাক পর্যন্ত ভাগ হয়ে যাবে ।
এবার আর হিংসা-হঠ কার উপরে করবে রে, এবার দেখবি বউ-ছেলাপেলা সকলে কোমরে কাপড় বেঁধে লেগে পড়েছে।
রবি দাদু বললো—কিন্তু ভাই কি আর হিংসার জিনিস রে, মা’র পেটের ভাই, ছেলেবেলায় নবা কোলে করে ঘুম পাড়িয়েছে খোকাকে,খোকা অ্যানটুল-ব্যানটুল করেছে সাধনকে বুকে নিয়ে ।
রবি দাদু খুব ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেললো কথাটার শেষে । মানুষ ভীষণ স্বার্থপর, শুধু নিজেরটা দেখে!
মাঠ থেকে ফিরে আসছে সকলে। মাথার টিকরি গরম হয়ে গেছে রোদে । পরী ঘোষ দুয়ারে পা দিয়ে না দিয়েই চিল্লাচ্ছে—নব আর খোকার মেয়েদের—কোথা গেলি রে শালীরা, জল দে, পাখা দে !
খোকা আগের কথার রেশ টেনে বললো, আমি তো এখনও বলছি, বড়ো বউ আর ছোটো বউ যদি বদমাইসি না করে তাহলে কাউকে বুঝতেই দিবোনি যে আমরা পৃথক হয়েছি।
বড়ো বউ জল নিয়ে বেরিয়েছিল, সে শুনতে পেয়ে বললো—নিজের মাগকে
আগে সামলাবে যাও!
রেগে চিৎকার করে উঠলো খোকা—কেনে, আমাদের কি দুটা রক্ত ? মআমাকে কেউ কাটতে এলে তুমি কি দাদাকে আটকে রাখবে !
বড়ো বউ হি-হি করে হেসে উঠলো । আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করলম গো !
তোমাদের আর কিছু বাকি রইলো না কি হে ? আমরা থাকতে থাকতে তোমরা বরং একবার চারদিকটা দেখে নাও । ধীরেন, নম্বরগুলো গোড়া থেকে একবার শুনিয়ে দাও না। কোনোটা বিস্মরণ হলে মনে পড়ে যাবে।
বাসন-কোসন, নগদ টাকা, ঘর-দুয়ার, ধান-চাল, সোনা-রুপা, লেপ-বালিশ লাঙ্গল-জোয়াল, গাছ-পালা, জমি-জায়গা...ধীরেন বললো হাঁস ছিল, দুটো করে হাঁস ভাগে পড়েছে।
নব-র বড়ো মেয়ে জিগ্যেস করছে হাঁসের যে অনেকগুলো ডিম ছিল ?
পরী ঘোষ ঠাট্টা করে—তোর কতগুলো ডিম আছে নিয়ে আয় না শালী,ভাগ করে দিচ্ছি।
কি গো তাহলে আর কিছু পড়ে নেই তো?
তিন ভাই-ই ঘরের মধ্যে দৌঁড়ে যায়। গ্রামের লোকজন চলে গেলে তারপর আর কেউ কিছু মানবে না।
চালের বাতা খোঁজে, ঘরের কোণ হাতড়ায়, কেউ কেউ পুরনো কলসিগুলোও উল্টে-উল্টে দেখছে। বাড়ির বউ-ছেলেমেয়ে সকলে মরীয়া হয়ে খুঁজতে লেগে পড়ে।
আর কি থেকে গেলো ? খুঁজছে আর সকলে মনে মনে ভাবছে।
বড়ো বউ ডাকলো—হ্যাঁ গো, কতকগুলো শন ছিল যে, গোরু বাছুরের দড়ি করবে কিসে ? ছোটো বউ বললো—হ্যাঁ তো, মধুর শিশিটা ! তার কচি মেয়েকে মাঝে-মধ্যে মধু খাওয়ায়। যাও শিশিটা নিয়ে এসো, তুমিই তো চাকটা ভেঙে ছিলে!
বড়ো বউমা, ও ছোটো বউমা, আর ওসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে গণ্ডগোল করোনি মা, ঘোড়া থাকলে কি চাবুকের জন্য কারো আটকায় !
আমরা চলি গো !
অনেক বেলা হয়ে গেছে, সকলে বাড়ি যাওয়ার জন্য উসখুস করছে।
গোষ্ঠ আসন ছেড়ে উঠতে-উঠতে বললো—আমার ভালো হলো, মেজো গিন্নিকে এসে বলবো সরবৎ দাও, বড়ো গিন্নির কাছে দোক্তা পান নেবো, ছোটো গিন্নির কাছে বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে বাড়ি চলে যাবো। গোষ্ঠ হেসে উঠলে। হো-হো করে ।
খোকা এসে বললো—না আর কিছু নেই, যা আছে তা যে-যার লুকানো। শুধু আমি শালা সব দিনের বোকা বলে...
হঠাৎ নব-র ছোটো ছেলে য়ার খোকার ছোটো ছেলে, দুজনে একটা ভাঙা পালি ভর্তি তাদের খেলনাপাতিগুলো ধরে নিয়ে এসে রাখে সকলের সামনে। দুজনেরই বয়স ছয় কি সাত করে হবে। দড়ি বাঁধা প্যান্টে কারো দড়ি নেই, দুজনেই মুচড়ে পরেছে । খোকার ছেলের খুলে গেছলো, সে একটা হাত দিয়ে প্যান্টের মাথানি দুটো ধরে দাঁড়িয়ে আছে ।
আমাদের খেলাপাতিগুলা ভাগ করে দাও গো !
একবার নয়, দু’বার বললো। প্রথমবার না-শোনা হয়ে ছিল, দ্বিতীয়বার শুনে সকলে হেসে উঠলো হো-হো করে।
সকলে খেলনাপাতিগুলোর দিকে তাকালো। আছে নারকেলের খোল ভাঙা, তাল কুরের আঁটি, দুটো ছেড়া প্লাসটিকের পুতুল, আধখানা রবারের বল, পুরানো দুটো তাস, একটা ভাঙা কুলুপ...
পরিবেশটা হঠাৎ অন্যরকম থম্ হয়ে গেলো । দ্রুত বেরিয়ে এলো সকলে। একটা ঘরে তিনটে উনুন জ্বলছে একসঙ্গে। গরমে-ধোঁয়ায় প্রত্যেকটা লোকেরই দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
3 মন্তব্যসমূহ
পড়তে পড়তে বাস্তব সমাজ চিত্র অবলোকন করলাম ।
উত্তরমুছুনবাবা চলে গেলেন ১৯ ডিসেম্বর,জীবদশায় উনি উনার প্রাপ্য সম্মান পান নি,উনার আরো লেখা পোস্ট করার আশা রাখছি
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো।এই লেখকের আরো গল্প চাই।
উত্তরমুছুন