শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প: সে

আষাঢ় মাসের সকালবেলায় ধুম বৃষ্টির ভেতর দেখি লম্বাচওড়া খালি গা, খালি পা একজন বেশ সুন্দর দেখতে মানুষ ডান হাতে ছাতা ধরে বাঁ হাতে রাখা একখানি ভালো বই মন দিয়ে পড়তে পড়তে-খানিক গানও গেয়ে রাস্তা দিয়ে আমাদেরই বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। চোখে চশমা। মাথাটি সাদা-কালো।
পরনের ধুতিখানি মালকোঁচা দিয়ে এঁটে হাঁটু অবধি তুলে পরেছেন। মফস্বল শহরের রাস্তায় শুধু একটি গরু দাঁড়িয়ে ভিজছে। কোনও লোক নেই। আকাশজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা।

আমাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা বললেন, ওই তোদের মোহিনীদাদা আসছে। 


মোহিনীদাদা কে মা? 

তোদের পিসতুতো দাদা-

অত বড় দাদা?

হ্যা। তোদের বড় পিসির ছেলে। তোদের সেই পিসি-পিসেমশাইকে আমিও দেখিনি। কবেই মরে গেছেন।

মোহিনীদাদা হইহই করে ভিজে পায়ে বারান্দায় উঠে এলেন। হাতের ছাতাটি বন্ধ করে বললেন, কোথায় ? মামিমা গেলেন কোথায় ?

মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, এই তো আমি ভাগ্নে। এদিকে কোথাও কথকতা ছিল বুঝি? 

হ্যা। বনগাঁয় ষষ্ঠীতলায় কাল দুপুর থেকে রামায়ণী গান গাইলাম। কথকতাও ছিল। সীতার পাতাল প্রবেশ। তা মামা কোথায় মামিমা ? তিনি গেছেন মোরেলগঞ্জে।

সে তো রূপসা নদী পেরিয়ে সেই অনেক দূরে বড়গাঙ---সমুদ্রের তীরে---আমাদের দেশে।

তুমি ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে কথকতা কতকথা করে বেড়াও। তাই তোমার মামা একাই লোক ধরে ধান রুইতে গেছেন। জমি কি ফেলে রাখতে আছে ভাগ্নে-

মোহিনীদাদা বড় বড় চোখ করে খানিকক্ষণ শূন্যে তাকিয়ে রইলেন। কোমরে বাঁধা পুটুলি থেকে গামছা বের করে গা মুছলেন। তারপর নিজে নিজেই বললেন, তা ঠিক। বাবা তো চৌকিদারি করে কম জায়গাজমি করে যাননি। সবই আমার মামাকে দেখতে হয় এখন।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে মোহিনীদাদা বারান্দায় পাতা মাদুৱে পদ্মাসন হয়ে বসে ফের সেই বইখানি খুলে গলা খুলে গান ধরলেন। দুরদরাজ গলা। বৃষ্টির থামা নেই। মোহিনীদাদার গলা যত ছড়িয়ে পড়ে, ততই চারপাশের বাড়ির বন্ধ দরজা-জানলা খুলে যায়। পড়শিরা যার যার বাড়ির বারান্দায় ভেসে ওঠে। কে গায়?

মা ঘরের ভেতর শাড়ি, কাপড়, জামা গোছাতে গোছাতে জানতে চাইল, কাল বনগাঁয় কথকতা শেষ হল কখন ভাগ্নে?

সন্ধেরাতে মামিমা। কিন্তু ট্রেন তো কম। যশোর রোড ধরে হাঁটা ধরলাম।

মা বারান্দায় বেরিয়ে এসে চোখ কপালে তুলে বলল, 'তাই বলে এতটা পথ হেঁটে এলে?

। সারাটা রাত হাঁটলাম-জিরোলে ঘুমিয়ে পড়তাম যে—কত আর পথ। মোটে তো তিরিশটা-পয়ত্রিশটা মাইল হবে। দশ-বারো ঘণ্টায় হেঁটে ফুরিয়ে দিলাম। এতটা রাস্তা ভাগ্নে মোটে হল তোমার কাছে? তারপর ঝড়জলের রাত-

তা বলতে পারেন মামিমা। ঝড়জল তো হলই সারা রাত। তার ওপর ছিল ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। তবে হ্যা-রাস্তার মতো রাস্তা একখানা যশোর রোড়। আগাগোড়া পিচ ঢেলে বাঁধানো। দু'ধারে কোম্পানির আমলে লাগানো বিরাট বিরাট মেহগনি, গুলমোহর সব ঝাকড়া-ঝাকড়া গাছের মাথা। আমার মাথার ওপর দু'ধার থেকে ডালপালা মেলে। একেবারে তোরণ করে দাঁড়িয়ে ছিল।

ভয় ডর নেই তোমার ভাগ্নে ? বয়স তো হচ্ছে— 

তা তো হচ্ছেই। আর দু'বছর বাদে যাট হবে। আমি মামার চেয়ে ন’ বছরের বড়। মা তো ছিলেন মামার চেয়ে পচিশ-তিরিশ বছরের বড় দিদি। মায়ের চেয়েও পঁচিশ বছরের বড় ছিলেন বাবা। তো আমার বয়স হোকগে মামিমা। নিজের লেখা গান গাইতে গাইতে হেঁটে রাত কাবার করে দিলাম।

আমি আর থাকতে পারলাম না। বলে উঠি, মোহিনীদাদা। তুমি গান লেখো?

হ্যা রে-গান লিখি। গান গাই। কথকতা করি। দুনিয়া দেখি। তুই কী করিস? আমি আর কী করব? ক্লাস ফোরে পড়ি। ভৈরব নদীতে সাঁতরাই-

বাঃ! বেশ বেশ। ডুব সাঁতার দিবি। চিত সাঁতার দিবি।

মা বারান্দায় এসে ফোড়ন কাটল।—ভাগ্নে! অনেক গুণ তোমার ছোট ভাইয়ের। এখনও দশ হয়নি। দিব্যি গাছে উঠে ডাব পেড়ে খায়। ইস্কুলে নাকি মাস্টারমশাইরা গল্পের ক্লাসে গল্প বলতে বললে—গল্প ও বলে?

তাই? এ তো মহা গুণের কথা।

আমি হাসির গল্প বলতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলি মোহিনীদাদা।

তাই? তা হলে দুঃখের গল্প বলার সময় কেঁদে ফেলিস? 

না। তবে চোখ ছল ছল করে ওঠে।

শোন তবে—তুইই বুঝবি ছোটভাই। মহাবীর কর্ণের রথের চাকা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ভেতর মাটিতে বসে গেছে।

সে তো মহাভারতেই আছে--মেদিনী গ্রাস করিল--

এই তো চাই ছোটভাই—বলে মোহিনীদাদা খুশি হয়ে আমার সারা পিঠ জুড়ে আদরের একখানি চাঁটি কষালো। হাতের কী থাবা! কী লম্বা পাঞ্জা রে বাবা!! শিরদাঁড়াটা। বেঁকে গেল বুঝি।

তিনি সেই মোটা বইখানি খুলে মেলে ধরলেন।

দেখি--সে তো বই নয়। হাতের লেখা খাতার পর খাতা একসঙ্গে মোটা করে বাঁধানো—বাইরে থেকে দেখতে ঠিক বই।

এসব কার লেখা?

আমার--বলেই সিধে হয়ে বসে একবার খাতায় চোখ বালোন মোহিনীদাদা। আর গলা মেলে দেন সারা পাড়ায়। সেই দরাজ গলার গান অঝোর বৃষ্টি এলোমেলো করে দিয়ে রাস্তার ওপারের বাড়িগুলোর বারান্দায় বারান্দায় যেসব পাড়াপড়শি কান পেতে ছিল—তাদের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে লাগল। তারা যে যারা বারান্দা থেকে আর একটু এগিয়ে এসে এবার বেশ স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠলো।

মহাবীর কর্ণের জানুতে প্রবেশিল মহাকীট 
অসীম যন্ত্রণা সহি নীরবে দেখেন তিনি রক্ত 
অস্ত্রগুরু পরশুরাম তখন নিদ্রায় সুপ্ত 
উঠে বসি দেখেন তিনি কর্ণের জানু ভাসে রুধিরে
অমনি ক্ষিপ্ত শুরু বলেন, তুমি তো ব্রাহ্মণ নও 
নিজের রুধির দেখি ব্রাহ্মণের হইত মহারাগ। 
অস্ত্রগুরু। নহি আমি ব্রাহ্মণ—আমি যে ক্ষত্রিয়।
শোন কর্ণ। ব্রাহ্মণ বিনে আমি শিখাই না অস্ত্র

বাকিটা বলি মোহিনীদাদা?

গান গেয়ে বল ছোটভাই-
আমি যে জানি না গান।

চেষ্টা করতে দোষ কি? গান তো মানুষের নিশ্বাস ছোটভাই-- 

বেশ—বলেই ধরে দিলাম গান--

বিপদে বেবাক ভুলিবে মোর দিব্যাস্ত্র।
আর তব রথচক্র গ্রাসিবে মেদিনী

ফের আমার সেই বয়সের ছোটমতো সারা পিঠ জুড়ে মোহিনীদাদার একখানি হাতের লম্বাই চওডাই ভালুক থাবার তারিফ এসে পড়ল। এবারে দম বন্ধ করে ধাক্কাটা সামলাই। মোহিনীসাদা তো পদ্মাসনে বসেই মাদুর থেকে মাথা অবধি পাক্কা প্রায় চারটি ফুট খাড়াই।

এসব কথা প্রায় ষাট বছর আগের। অত দিন পেছন থেকে মহাবীর কর্ণকে তুলে আনতে গিয়ে সেদিনকার মোহিনীদাদার কথকতা আর আমার চটজলদি গানের শব্দ আজ নিশ্চয় অনেকটাই বদলে গেছে, কল্পনায়। যাবেই যাবে। মোহিনীদাদাই তার মামা--মানে 'আমার বাবার চেয়ে ঝাড়া ন'বছরের বড় ছিলেন। বাবারই জন্মসন ১৮৯৩। আর পিসেমশাই তো বাবার চেয়ে পঞ্চাশ বছরের মতো বড়। তার মানে সিপাহী বিদ্রোহের সময় পিসেমশায় ছিলেন চোদ্দ বছরের কিশোর।

সেদিন সেই আষাঢ় মাসের সকালবেলায় মোহিনীদাদার গান থেকে দশ বছর পরে আমরা তখন চব্বিশ পরগনার দত্তপুকুরে থাকি। কলকাতার দিকে এগোলে এক স্টেশন বাদেই বারাসত। কয়েক স্টেশন পিছিয়ে গেলে হাবড়া। আমি ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় কলেজে পড়তে যাই। বছর তিনেক হল দেশটা ভাগ হয়ে গেছে।

চোত মাসের কাঠফাটা রোদে সারা তল্লাটের সব পুকুর শুকিয়ে তাদের চাতাল ফুটিফাটা। ভরদুপুরে হঠাৎ দেখি বড় কাঠামোর একজন মানুষ-~~-খালি গা—খালি পা--- চোখের চশমাটি সরু দড়ি দিয়ে গলায় ঝালোনো~-মালকোচা দিয়ে পরা ধুতি সামলাতে পারছেন না। সারাটা শরীর শুকিয়ে স্রেফ হাড়ের খাঁচা। তাও গনগনে রোদে ভাজা ভাজা। একটি দিশি গাই রেললাইনের পাশের বনঝাল, শেয়ালকাটায় ভর্তি বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হাবড়ার দিকে। তিনি খালি পায়ে ব্যথা পেয়ে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছেন। কিন্তু গরুর গলায় দড়ি ছাড়েননি।

আরে মোহিনীদাদা না? তাই তো মনে হল। পাশ থেকে একপলক দেখে। ছুটে যাব কি! ততক্ষণে তেষ্টায় গাইটা জলের সন্ধানে মরিয়া হয়ে এগিয়েই চলেছে।

ছুটে যাওয়া হল না। তখন দেশভাগের পর কত পিসতুতো মাসতুতো ভাইবোন ছটকে এদিক ওদিক ছিটকে গেছি। সেটা খোঁজ নেবার দিন ছিল না। যে যাকে নিয়ে কোনওমতে টিকে থাকার দিন তখন। হারিয়ে যাবার দিন ছিল সেদিন। 

ক'দিন পরে কলকাতা থেকে ট্রেনে দত্তপুকুর ফেরার পথে বারাসত বার্তা' হাতে পড়ল। চার পাতার ছোট কাগজ। টেন্ডারের বিজ্ঞাপন আর বারাসত কোর্টের মামলার শুনানি পাতা জুড়ে।

তার ভেতর এক জায়গায় মোহিনীদাদাকে পেলাম। হাবড়ার নিজস্ব সংবাদদাতা বিতাং দিয়ে লিখেছেন।

বিখ্যাত কথকঠাকুর মোহিনীমোহন বেদজ্ঞ কলিকাতার কালীঘাটে কথকতা করিয়া কোনও এক শিষ্যার নিকট হইতে একটি গাইগরু উপহার পান। সেই গরুটি লইয়া তিনি পদব্রজে তাহার জন্মস্থান খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার মোরেলগঞ্জ রওনা হইয়াছিলেন। পাঠককে এইখানে বলিয়া দেওয়া দরকার মোরেলগঞ্জ এখন পূর্ব পাকিস্তানে পড়িয়াছে। খুলনা জেলার সমুদ্রসৈকতে বঙ্গোপসাগরের তীরে মোরেল সাহেবের নামে সেখানে শতবর্ষের উপর এই একটি বসতি গড়িয়া উঠিয়াছে। (দ্রষ্টব্য : সতীশচন্দ্র মিত্র প্রণীত খুলনা ও যশোহর জিলার ইতিহাস)

হাবড়ায় পৌছিবার আগে কথকঠাকুরকে বীড়া স্টেশনের স্টেশনমাস্টার অরবিন্দ ঘোষ সব দেখি্যা-শুনিয়া বলিয়াছিলেন—মোরেলগঞ্জ যাইবেন তো সেখানে যাইবার পাসপোর্ট কোথায়? ভিসা আছে আপনার? সে জায়গা তো এখন পাকিস্তান। বিদেশ- আপনি ওইসব কাগজপত্র বর্ডারে দেখাইতে না পারিলে সে দেশে ঢুকিতে পারিবেন না।

বেদজ্ঞ মহাশয় জানিতে চান, কেন?

স্টেশনমাস্টার ঘোষ মহাশয় বলিয়াছিলেন—আপনি যে হিন্দুস্থানের—ইন্ডিয়ার

তাহাতে কথকঠাকুর চটিয়া গিয়া বলিয়া ওঠেন, আমি ভারতবর্ষে আছি। ভারতবর্ষে যাইতেছি। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান? সে সব আবার কোথা হইতে আসিল?

স্টেশনমাস্টার মহাশয় বলিয়াছিলেন, সে ভারতবর্ষ আর নাই। 

তাহাতে কথক-ঠাকুর বলেন, মহাভারতের পেট হইতে ভারতবর্ষ পড়িয়াছে। মামার বাড়ির আবদার! চালাকির জায়গা পাও নাই।।

তারপর তিনি গাইগরুটির গলায় দড়ির হ্যাচকা টানে বনবাদাড় ভাঙিয়া বৃদ্ধ শরীরে প্রায় দৌড়াইতে থাকেন। বয়স অনুমান সত্তর তখন দ্বিপ্রহরের রৌদ্রে চারিদিক জ্বলিয়া যাইতেছিল।

হাবড়ার কাছাকাছি পৌছিয়া জলের সন্ধানে একটি পুকুরে নামিয়ে পড়ে গরুটি।

পুকুরে জল ছিল না। গরুর হ্যাচকা টানে তিনি পুকুরের শুকনা চাতালে পড়িয়া গিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রস্রাব করিতে থাকেন। কাছে গিয়া দেখা যায় তাহার প্রাণ নায়, বাহির হইয়া গিয়াছে। কথকঠাকুরের কোমরে গোজা একটি চোথা হইতে তাহার পরিচয় জানা যায়।

আষাঢ় মাসের সেই ধুম-বৃষ্টির সকালবেলা আর তার দশ বছর পরে চোতমাসের দুপুরের সেই ভাজা ভাজা দত্তপুকুরের মাঝখানে মা আমাদের একটি গল্প বলেছিলেন। গল্প বলা অন্যায়। বলা উচিত ঘটনা। অবশ্য মা সেই ঘটনা নিজের চোখে দেখেননি। শুনেছিলেন। তাও অন্তত আশি বছর আগে। তার বউবেলায়। নদীর পাড়ে শ্বশুরবাড়িতে। হয়তো কোনও- সন্ধেবেলায় দেড়খোর আলোয়। তার শাশুড়ির মুখে। মানে আমাদের ঠাকুরমার মুখে। শুনে মা আমাদের গল্পের মতো করে বলেছিলেন। যেমন মায়েরা বলে থাকে। জ্যোৎস্নার সন্ধেবেলায়। নারকেল গাছের পাতা দুলছে। আবছা বারান্দায়।

ঠাকুরমা মোহিনী-দাদার বাবার কথা বলেছিলেন মাকে। মানে তার বড় জামাইয়ের কথা। আমাদের বড় পিসেমশাইয়ের কথা। তিনি তার শাশুড়ির চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড়ই ছিলেন। তখনকার দিনে সেরকমই ঘটত। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও এরকম শাশুড়ির জামাই দেখেছি। মনে রাখতে হবে বড় পিসেমশায় আজ থেকে দেড়শো বছর আগে জন্মেছিলেন। কোম্পানির আমলে। নবাবি শেষ হয়ে গেছে। ইংরেজ হঠাৎনবাব হয়ে গিয়ে জ্বল ্জ্বল করে উঠছে। বালক বঙ্কিমচন্দ্র নৈহাটি থেকে নৌকায় চুচুড়ায পড়তে যাচ্ছে। কোম্পানির বেঙ্গলে তখন জঙ্গল বেশি, লোক কম। 

হিসেব কষে দেখেছি-পিসেমশায় যখন পিসিমার চেয়ে পচিশ বছরের বড় ছিলেন—তা হলে অন্তত দশ বছর বয়সের পিসিমাকে বিয়ে করলেও পিসেমশাইয়ের বয়স ছিল তখন পঁয়ত্রিশ। তখনকার দিনে পিসেমশাই কি আর পঁয়ত্রিশ বছর বয়স অবধি বিয়ে না করে ছিলেন। নিশ্চয় বিয়ে করেছিলেন। হয়তো ওলাউঠোয় সব ফোত হয়ে যাবার পর পিসিমাকে বিয়ে করেছিলেন। তখন খুব গুলাউঠো হত গ্রামদেশে। তার মানে ওঁদের বিয়েটা হয়েছিল ১৮৭৮ সনে। ট্রেনলাইন সে সময় হাওড়া থেকে দিল্লি অবধি চলে গেছে। দেশটা মহারানির শাসনে। ইলেকট্রিক আসেনি। কাজ-কারবার হাতিঘোড়া ছেড়ে ট্রেনের ওপর বর্তাচ্ছে সবে।। 

পিসেমশাইয়ের দেশটা ছিল বঙ্গোপসাগরের তীরে। খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমায়। পরে বই পড়ে জেনেছি—সেকালে বিলেতের মধ্যবিত্ত সাধারণ ঘরের ছেলেরা পরীক্ষায় বসে আই সি এস হয়ে ইন্ডিয়ায় চাকরি করতে আসত। তারা এসে হাকিম হয়ে-কমিশনার হয়ে যেমন এদেশ শাসন করত- থানা বসাত-- আইনের শাসন বজায় রাখত-তেমনই এদেশের ইতিহাস লিখত-=-দেশটা জরিপ করে ম্যাপ বানাত—ভাষার বিজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামাত-চাষবাসের হালহকিকত লিখত। এরকম সব সাহেব ছিলেন গ্রিয়ারসন, কটন, বেল—আরও অনেকে। তারা প্রথম যৌবনে এদেশে এসে মাথা সাদা করে বুড়োকালে দেশে ফিরে যেতেন।

মোরেল নামে এরকমই এক জবরদস্ত হাকিম, পিসেমশাইদের দেশে চাকরি করতে গিয়েছিলেন। থাকতেন তাঁবু কাটিয়ে। তখন ডাঙায় বাঘ। জলে কুমির। ওষুধ বেরোয়নি। কিন্তু ওলাউঠো আছে। মানুষ আছে। কিন্তু শাসন নেই। 

মা বলেছিলেন ঠিক এইভাবে--

তোদের পিসে, খুব জবরদস্ত বলশালী মানুষ ছিলেন। তখন তো মানুষ কম। ধান ছড়িয়ে দিলেই চলে যায়। দিব্যি চারা ঠেলে উঠত। গায়ে এক বাঘ এসে গরু নিয়ে। যেতে লাগল। শুনে ঠাকুরজামাই তো চটে লাল।।

শীতের রাত। তোদের পিসেমশাই একখানা কালো কম্বল গায়ে দিয়ে গোয়ালে গিয়ে অন্ধকারে কালোগাইয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন। অনেক রাতে বাঘের চাপ আওয়াজ শুনতে পেয়ে তাদের পিসিমা তো ঘরে বসে কেঁদে অস্থির। কী না—বাঘের কী হবে? আজ যে বাঘের বড় বিপদ!

মা যেভাবে তার শাশুড়ির মুখে শুনেছিলেন—ঠিক সেই ভাবেই আমাদের বলেছিলেন ! বিপদ কিন্তু তোদের পিসেমশায়ের নয়।

ভোর হল। দোর খুলে তোদের পিসি দেখেন—বাঘটার পা মুচড়ে পিঠমোড়া করে বেঁধেছেন তার স্বামী। আর বাঘের মুখের ভেতর আস্ত একখানা ছ'হাতি গামছা খুঁজে দিয়েছেন। বাঘ কোনও আওয়াজ করতে পারছে না। শুধু গো-গোঁ শব্দ করছে।

সেই দশাতেই কম্বল মুড়ি দিয়ে বাঘটাকে প্রায় কোলে নিয়ে ঠাকুরজামাই চললেন, মোরেল সাহেবের তাবুতে। সাহেব তখন এজলাসে বসেছেন।

ঠাকুরজামাই গিয়ে হাজির।

আর্দালি ঢুকতে দেবে না। তাদের পিসেমশাই কম্বলের ঘোমটা সরাতেই চৌকিদার তো অজ্ঞান হবার জোগাড়। জ্যান্ত বাঘ। গোঁ গোঁ করছে। মুখের ভেতর গামছা।

চৌকিদার ধপাস করে পড়ে গেল। ঠাকুরজামাই গিয়ে সিধে সাহেবের সামনে হাজির। মোৱেল বলল, হু আর ইউ?

ঠাকুরজামাই কোনও কথা না বলে কম্বলের ঘোমটাটি খুলে বাঘের চাঁদপানা মুখখানি দেখালেন এক ঝলক।

অমনি মোরেল তটস্থ হয়ে তার চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন।

ঠাকুরজামাই বললেন, এই হারামজাদা রোজ রাতে এসে গরু তুলে নিয়ে যায়। আপনি বিচার করে এর একটা বিহিত করুন।।

মোরেল সাহেব তখন নতুন বাংলা শিখেছেন। তিনি বললেন, বাঘের মুখ হইতে গামছাটি বাহির করো আগে। নহিলে তো দম বন্ধ হইয়া মারা যাইবে।

বাহির করি আর বাঘ তোমাকে হালুম করুক।

সাহেব মুগ্ধ। তোদের পিসের চাকরি হয়ে গেল। পাকা চাকরি। নতুন থানা। মোৱেলগঞ্জের চৌকিদার হয়ে গেলেন ঠাকুরজামাই। মাস গেলে সাত টাকা মাইনে। অত টাকা দিয়ে একটা লোক কী করে তাই দেখতে দূর দূর গাঁ থেকে লোক আসত। ঠাকুরজামাই তার মোটা মাইনে থেকে একটু একটু করে অনেক জায়গাজমি করলেন। সেই জমিজায়গাই এখন তোদের বাবা দেখেন। তাদের মোহিনীদাদার তো ওসবে মন নেই। কথকতা করে বেড়ায়। গান লেখে। গান বাধে।

এসবের শেকড় সন আঠারোশো তেতাল্লিশে। এখন সন দুই হাজার। মাঝখানে পড়ে আছে একশো সাতান্ন বছর। সেই সময়টার ভেতর একদিন ইলেকট্রিক এসেছে। মার্কস এসেছেন, ডুবেও গেছেন। গান্ধী ডুবে গিয়ে আবার একটু একটু ভেসে উঠছেন। মানুষ চাদে হেঁটে এসেছে। আমিও সত্তরে এসে ঠেকেছি। বুঝতে পারছি না পৃথিবীটার কী হবে শেষ পর্যন্ত। বায়ুমণ্ডলের সূর্যের দিককার ওজনের কোটিং ক্ষয়ে গিয়ে মাটির পৃথিবীতে গরম বেড়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়টাতেই বড় পিসেমশাই নেই। নেই মোহিনীদাদা। সত্তর বছরের লোকের কী আর বাবা-মা থাকে! অতএব একা একা সংসার সংসার খেলি। ওষুধ খাই। তবু ঘুম আসে না। নিশুতি রাতে বিছানায় উঠে বসে গুনে দেখি কে কে নেই। বড় পিসেমশাই, মোহিনীদাদা, বাবা, মা, বড়দা, মেজদা, বড়বউদি। কলকাতার কতকগুলো রাস্তায় যেতে পারি না। ইচ্ছে করে না। বিমল, কবিতা, মানস ওদিকটায় থাকত। গোবিন্দ আঢ্যি লেনে। আশুতোষ মুখার্জি রোডে। ওরা আর বেঁচে নেই। ওদিকে গেলে কার কাছে যাব? ল্যান্সডাউন রোডও তাই। শঙ্কর কবেই নেই। ওই রাস্তায় থাকত। তাই আমি টালিগঞ্জ থেকে ধর্মতলায় যেতে হলে পিছিয়ে গড়িয়া চলে যাই। সেখান থেকে পাঁচ নম্বর বাসরুট ধরে গড়িয়াহাট। সেখান থেকে মৌলালি হয়ে ধর্মতলায় যাই। বাড়ি ফেরার পথে ভবানীপুর, ল্যান্সডাউন এড়াই।

পাড়ায় একটি নতুন থানা হয়েছে। কসাই বলল, ও সি সাত কেজি মাংস নিয়ে গেছে। দাম দেয়নি। ঘুষ দিতে না হলে আপনাদের একশো টাকা কেজিতে মাংস খাওয়াতে পারতাম। 

তাহলে থানা হওয়ার আগে খাওয়াওনি কেন?

সেকথা বলছি না বাবু। এ তো ওসি-র জবরদস্তি। এছাড়া খাসি হাঁটিয়ে আনার সময় শেষরাতে পাঁচ থানায় পয়সা দিতে হয় যে--

কী আর বলব? মাইক হাতে পেলেই সবাই সৎ হতে বলছে। খোদ মন্ত্রী ভোটচোর। ঠিক এই সময়েই বড় পিসেমশাই নেই। তিনি বড় আগে এসে পড়েছিলেন এই পৃথিবীতে। একশো সাতান্ন বছর আগে। আজ যদি তিনি থাকতেন তাহলে নিশ্চয় ওসির টেবিলের নীচে কম্বল জড়িয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতেন। সময়মতো তার হাত দু'খানা পিছমোড়া করে বেঁধে কৱল ঢাকা দিয়ে মুখে আস্ত একখানা গামছা গুজে দিতেন। তারপর ওসিকে কাঁখে নিয়ে বড় পিসেমশাই জায়গা মতন যেতেন। গিয়ে কম্বলের ঘোমটা তুলে ওসি-র মুখখানি একঝলক দেখাতেন বড় পিসেমশাই। ওসি তখন গামছাগেলা গলায় গোঁ গোঁ আওয়াজ করত।

যে বড় পিসেমশায়কে কোনও দিনই দেখিনি- যার কথা মায়ের মুখে বালক বয়সে শুধুই শুনেছি -সেই দশ-বারো বছর বয়স থেকেই তার অভাব বোধ করে আসছি আমি। যতই বয়স বাড়ছে, ততই তার অভাবটা বড় হয়ে উঠছে। আর তার সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে তার ছেলের কথা। সেই মোহিনীদাদা। যে পদ্মাসনে বসলে মেঝে থেকে মাথা খাড়াই চার ফুট। 

আফসোস! আফসোস! বড় জিনিসের আর দেখা পাই না। ধুম বৃষ্টির ভেতর এক হাতে ছাতা—খালি গা--আর এক হাতে নিজেরই লেখা গানের মোটামতো বাঁধানো খাতা। বই বই দেখতে। সেই গান গাইতে গাইতে বনগাঁ থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসা। খালি পায়ে।

ও মোহিনীদাদা। একবার তোমার বাবাকে ডাকো না। বড় পিসেমশাই এলেই তো সব ঠিক হয়ে যায়।

কোথায় মোহিনীদাদা! তিনি তো কবেই-। হাবড়ার আগে বীড়া রেল স্টেশনের কাছে একটা শুকনো পুকুরের চাতালে গরুর দড়ির হ্যাচকা টানে পড়ে গিয়ে অবিরাম পেচ্ছাপ করতে করতে পঞ্চাশ বছর হল মরে গেছেন।

বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়ে ফিরছি।

দমদন জংশনে ভোরবেলা। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি গরমে। আলো ফুটি ফুটি ভোরেও গরমের চোটে গায়ের পাঞ্জাবি ঘামে সেটে বসেছে পিঠে। চোখ পোড়াচ্ছে। একটুও চোখ বুজতে পারিনি। টিকিট কাটার পর উলটোদিকের প্ল্যাটফর্মে যাব। কে আর অত উচু ওভার ব্রিজ দিয়ে ওপারে যায়! অতগুলো ধাপ ভেঙে উঠলে হাঁটুর মালাইচাকি টন টন করে।।

দুই প্ল্যাটফর্মের মাঝে অনেকগুলো লাইন কুয়াশায় বেশি দূর দেখা যায় না। বেঁটে প্ল্যাটফর্ম। দিব্যি লাইনে নেমে গিয়ে দু’পাশ দেখি। নাঃ! কোনও ট্রেন নেই। আট-দশটা লাইন টপকালেই ওপারের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে উঠব।

গোটা দুয়েক রেলের পাটি টপকালাম। আর গোটা ছয়েক লাইন টপকালেই ওপাশের প্ল্যাটফর্ম। দিব্যি হাতের ভর দিয়ে ওপরে উঠে যাব। হঠাৎ দেখি একটা চলন্ত ট্রেনের হলুদ-সবুজ ভোঁতা মুখ। আমারই দিকে এগিয়ে আসছে। | প্রাণপণে দুটো লাইন টপকালাম । তবু ট্রেনটা আবারও আমার আরও কাছে চলে আসছে। একটুও না থেমে। আমাকে না হলে ট্রেনটার চলবে না। একেবারে নাছোড়। এ-লাইন সে-লাইন খটাখট বদলে বদলে ভীমবেগে ছুটে আসছে। শুধু আমাকেই ফলে

চেঁচিয়ে উঠি।ও মোহিনীদাদা। তোমার বাবাকে ডাকো——শিগগিরি ডাকো-- বড়পিসে গো| আমার গলা চাপা পড়ে গেল ট্রেনের গজাঘং গজাঘং আওয়াজে। ঠিক আমার পায়ের গোড়ালির পেছন দিয়ে ট্রেনের চাকাগুলো খুব তাড়াতাড়ি শেয়ালদার দিকে ছুটে গেল।

আমি দু'হাতে ভর দিয়ে ওপারের প্ল্যাটফর্মে উঠছি। কয়েক পলক আগে পরিষ্কার। শুনতে পেয়েছি মোহিনীদাদার গলা--ভয় নেই। যাচ্ছি রে—যাচ্ছি। এই তো বাবাকে নিয়ে এলাম।

প্ল্যাটফর্মে উঠলাম। দু’হাতের ধুলো ঝাড়ছি। একজন প্যাসেঞ্জার এগিয়ে এসে বলল, ছিঃ! ছিঃ! ব্রিজ রয়েছে। এভাবে কেউ লাইন টপকায়—? গ্যালোপিং শান্তিপুর আসছে। জানতেন না? এখন পাঁচটা পঞ্চান্ন।

আমি তখন পরিষ্কার বলে ফেললাম—বড় পিসেমশাই ।

সেদিন ভোর থেকেই আমার বলভরসা সাহস—সবই বড় পিসেমশাই। যেন সব সময় তিনি আমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। দূরে থাকলে মোহিনীদাদা ছুটে গিয়ে তাকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে আসেন। তিনি আমার একটু দূরেই কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকেন সবসময়। শুধু ডাকলেই হয়। তেমন করে ডাকার অপেক্ষা মাত্র। আমি এখন নিজেকে বড় পিসেমশাইয়ের হাতেই ছেড়ে দিয়েছি। ভোরবেলা বিবিধভারতীর দরজা খুললে আমি কান পেতে থাকি। অশোকতরুর সেই ব্রহ্মসঙ্গীতের জন্যে

‘যদি ডাকার মতো পারিতাম ডাকতে-’ ডাকলে বড় পিসেমশাই ধেয়ে পেয়ে আসেন। দেড় খানা শতাব্দী পেরিয়ে। টপকে। ১৮৯২ সনের কলকাতার প্লেগ, ১৯১৪ সনের প্রথম মহাযুদ্ধ, ১৯৯১ সনের অসহযোগ আন্দোলন—এক হাইজাম্প দিয়ে পার দিয়ে আসেন একেবারে অবলীলায়। এখন আমার সাহস, আশা, আহ্লাদ, উৎসাহ, দম এমনই বেড়ে গেছে যে আমি নিজেই. নিজেকে সামলাতে পারি না। পায়ের জোর বেড়ে গেল গোড়াতেই। তারপর বাসে দিব্যি গুতিয়ে উঠতে লাগলাম। একটুও কষ্ট হয় না। একদিন পাড়ার ডাকাবুকো গয়া মস্তানকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ফুটপাথে টুপ করে নামিয়ে দিলাম। আলুর বস্তার মতোই। গয়ার মনের জোর সঙ্গে সঙ্গে বসে গেল। পথে দেখা হলে সে আমায় হেসে স্যালুট করে। মুখে বলে—সেলাম মিস্টার ইন্ডিয়া। আমার বয়সী পাড়ার বুড়োরা জানতে চাইল--আপনি কী কমপ্লান খান? আমি কিছু বলিনা। শুধু মিটিমিটি হাসি। আর মনে মনে বলি-বড় পিসে! আরও বহুদিন বেঁচে থাকো বড় পিসে!! তুমি অমর।

আমি মনে মনে ভাবি আমিই বোধহয় মিস্টার ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া আসলে কি? একটা আস্ত বড় কাঠাল। তার ভেতর অনেক রসাল কোয়া। কোয়ার ভেতর পুরুষ্ট বিচি। বিচিগুলোর নাম-বিহার, ইউ পি, ওয়েস্ট বেঙ্গল, রাজস্থান।

আমার ভয় কি ? আমার সঙ্গে বড় পিসেমশাই আছেন। আমাকে কে ঠেকায় ? আমার বয়স সত্তর নয়। আমার বয়স এখন আসলে আমার ছোট নাতির সমান। সাত বছর। রোজ ভোরে মনে হয় আজই পৃথিবীর শুরু। এই যে সূর্যের আলো এ তো আমারই জন্যে। কারণ, বড় পিসেমশাই যে আমার পাশে। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের কিশোর। সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষী হতে পারতেন সহজেই। মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলের যুবক। বঙ্গোপসাগরের তীরের বাগেরহাটের এক অখ্যাত গায়ের প্রবীণ। আমার বড় পিসিমার স্বামী। বাঘের যম! সাত টাকা মাস মাইনের চৌকিদার। কবে পটল তোলেন কেউ বলতে পারেন না। বাঘের মুখে আস্ত একখানা গামছা খুঁজে দেওয়া গৃহস্থ। তাঁর ইতিহাসকে এক বিশাল রবার দিয়ে ঘষে মুছে দিয়েছে। একেই কি বলে কালের গর্ভে বিলীন ?

কিন্তু বড় পিসেমশাই যে সব সময় আমার সঙ্গে আছেন। নইলে ওভাবে থ্রু শান্তিপুর গ্যালোপিং ট্রেন কেউ ঘুরিয়ে দিতে পারেন? ঠিক এক লাইন আগে ট্রেনটা আমাকে না কেটে লাইন বদলে ঘুরে গেল। বড় পিসেমশাই না থাকলে তো আমি ট্রেনের চাকায় দু'টুকরো হয়ে যেতাম। আমি সুশান্ত নামে একজন লেখকের বাড়িতে দোতলায় জ্যোৎস্নায় দমদমের নাগেরবাজারে গল্প করে রাম খেয়ে রাত কাবার করে দমদম জংশনে ভোর ভোর এসেছিলাম ট্রেন ধরতে। ব্রাশমূহুর্তে। এই লেখকটি অনেক কবিতা লেখেন। আবার উপন্যাস গল্পও লিখে থাকেন। সারা রাত ললিতা নামে এক জন নতুন বউ স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু আমি তার স্বামীর সঙ্গে নিশুতি রাত জুড়ে গল্প করছিলাম। আমার কোনও মাত্রাজ্ঞান ছিল না। আমার বন্ধুরও ছিল না। গরমে ঘামতে ঘামতে আমার পাঞ্জাবি ছিড়ে গিয়েছিল। এই লেখকটি খুব শিক্ষিত। রামতনু লাহিড়ির মতো। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতো।

ঘুরি ফিরি আর সব সময় হাসি। কী এক আনন্দের ঘোরে। একেবারে নেশার মতো। আনন্দে আমার মাথা ঘোরে থাকে। একদিন তো ভোররাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে বাথরুমে যাব। উঠে দাঁড়িয়েছি। সেই আনন্দের ঘোরে ডান দিকে হেলে গিয়ে দরজার খেলা কপাটে মাথা ঠুকে গেল। ব্যথা লাগল। অন্ধকারে নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু কল্পনা করে নিচ্ছি—হাসিতে, আনন্দে আমার মুখ ফাঁক হয়ে এক দলা হাসি প্রায় শ্লেষ্মার মতোই ঝুলে পড়েছে।

ঠিক এই সময় ঘরের সামনের খালো বারন্দায় মনে হল—একজন কেউ একহাত তফাতে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছেন। তিনি প্রায় তার ডান হাত তুলে ফেলেছেন। মাথার গুতো খাওয়া জায়গাটায় হাত বুলিয়ে দিতে চান যেন।

বুঝলাম--আর কেউ নয়। তিনি। তিনিই এসেছেন।

উঃ ! সে যে কী আনন্দ। যা কখনও হয় না—কারও জীবনে যা শেনওদিন ঘটেনি—ঠিক তাই আমার জীবনে ঘটতে চলেছে। খোলা বারান্দার মাথায় খালো আকাশ। তাতে আমার স্ত্রীর টবে বসানো টগরের চারটে ডাল ওপরমুখো হয়ে আনকোরা ভোরবেলাকে ধরবে ধরবে। আলো আর একটু ফুটলে বড় পিসেমশাইয়ের পায়ের পাতা দেখতে পেতাম। তবে তার পায়ে বড় মর্তমান বলার সাইজের বুড়ো আঙুলের ওপর নখের জায়গায় যে দশ কেজি সাইজের কাতলার বড় আঁশ বসানো—তার আভাস পাচ্ছি। তাহলে কত বড় পা রে বড় পিসের!

মুখ তুলে তাকালাম। নাঃ! কেউ নেই। আমার চোখের সামনে অদৃশ্য কিছু বাতাস শুধু। কোথায় গেলেন?

সেই ভোরবেলার পর থেকেই আজ প্রায় বছর খানেক হল এই একই কাণ্ড ঘটে চলেছে। সব সময়েই তিনি আমার খুব কাছে চলে আসেন। বুঝতে পারি এসেছেন। কিন্তু তাকালেই তাকে হারিয়ে ফেলি। বড় ছেলে তামেদাবাদ থেকে ড্রাফট করে মাসের গোড়ায় টাকা পাঠায়। ওর নামে এন এস সি কিনতে হয় গাদাগুচ্ছের। তাছাড়া আমার আর ইতির ওষুধই লাগে মাসে প্রায় তিন হাজার টাকার। বড় ছেলে আরব সাগরের চাতাল থেকে পেট্রল তালোর রিগ বসানো দেখ না করে। সমুদ্রের বুকে ভাসন্ত প্ল্যাটফর্ম থেকে রিগ নেমে যাচ্ছে আরব সাগরের তলপেটে! এজন্য ওকে অনেক সময় হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে সমুদ্রের মাথায় শূন্যে ভাসতে হয়—ভেসে সব দেখতে হয়। ওর। আবার ডাঙায় ফিরে আসে। হেডকোয়ার্টার আমেদাবাদ। ও কিন্তু আমেদাবাদে থাকে না। থাকে শাসনগিরে। মিটারগেজ লাইনে! কাছেই গির স্যাংচুয়ারি। গিরনার পাহাড়। সিংহরা থাকে। এশিয়ার শেষ সব সিংহ। বড় ছেলে লিখেছিল—বাবা একটা সিংহের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। বড় অলস সিংহটা। মাথাটা দেখে মনে হবে সিংহটা রোজ ওর কেশর শ্যাম্পু করে। 

ইতি সিংহর সঙ্গে তার বড় ছেলের এই মাখামাখির কথা শুনে ভয়ে কাটা হয়ে থাকে। হাজার হোক সিংহ তো! কতই বা অলস হবে? এক থাবাতেই তো-

আমি মিটি মিটি হাসি। 'ইতিকে কোনও অভয় দিই না। শুধুই মিটি মিটি হাসি। আর মনে মনে বলি-ভয়ের কি আছে? বড় খোকা তোর সঙ্গে তো আমার বড় পিসে রয়েছেন। যত ইচ্ছে প্রাণভরে বন্ধুত্ব করে যা। সিংহ, বাঘ, সাপ, ডাকাত-যার সঙ্গে তোর মন চায়। 

আমার ছোট ছেলেটি খুব হিসেবি। সে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার কোতলপুরের বিডিও। কাছাকাছি সন্ন্যাসী কাঠিয়াবাব-র জন্মগ্রাম। নিজের সাইকেলেই ও ঘুরে বেড়ায়। যদিও অফিসের জিপ আছে। একবার নাকি চমকাইতলা নামে একটা জায়গায় সাইকেলে গিয়ে খুব বিপদে পড়েছিল। মাসের গোড়ায় মানি অর্ডারে টাকা

পাঠিয়ে লেখে---টাকাটা জমাও বাবা। বাড়ি দোতলা কর। তেতলা কর। আমি বিয়ে করবো । দাদা বিয়ে করবে। আরও ঘর লাগবে।

একথায় আমি সেই একই হাসি-হাসি। ওরে বোকা, বড় পিসে এসে গেছেন। তিনিই এবার দোতলা করে দেবেন। তেতলাও করে দেবেন। তার পাঠানো ক'টা টাকায় কী হবে! এক বস্তা সিমেন্টের দামই তো একশো ছাপ্পান্ন টাকা।

সন্ধেবেলা টেবিলে বসে ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়েছি। জ্বেলে দিয়েছি টেবিল ল্যাম্প। প্যাড খুলে দোতলা করার হিসেব কষছি। টেবিল ল্যাম্পের আলোর ফোকাস শুধু আমার প্যাডের কাগজের ওপর। আর ঘরের বাকিটা সবই আবছা। হঠাৎ টের পেলাম সে এসেছে।

টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে। একটু ঝুঁকে আমার প্যাডের ওপর কষা হিসেবের অংকগুলো তিনি মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। রাইট হল, না রং? আমি চোখ না তুলেই বড় পিসের বুকের কাছটায় জড়ানো কম্বলটার ডিপ ব্ল্যাক রংয়ের আভাস পাচ্ছি। 

তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা চোখ খুলে তাকাই। কী করে যে টের পেয়ে যান বড় পিসে। তিনি নেই। বিলকুল ভ্যানিশ। একেবারে সময়মতো। পারফেক্ট টাইমিং সেন্স তাঁর।

যতই দিন যাচ্ছে, আমি তার ওপর খুব ডিপেনডেন্ট হয়ে পড়ছি। তিনিও আমার কাছাকাছিই থাকেন। একদিন তো পরিষ্কার দেখলাম--একখানি বালাপোশ গায়ে দিয়ে। এলেন। হয়তো বড় পিসি বানিয়ে দিয়েছিলেন। এসে টেবিলের পাশে রাখা ভিজিটার্স চেয়ারে বসলেন। বেশ আরাম করে। তার ডান হাতের কবজির ওপর দিকে বাঁধা বড় মতো ্তাগাটিও চোখ না তুলে দেখতে পাচ্ছি। যেই চোখ তুলেছি-~~-অমনি উধাও।

আজ চার-পাঁচদিন হল বর্ষা এসেছে। কলকাতায় বর্ষায় ময়ূর দেখা যায় না। তবু আমার আনন্দ--আমার আহ্লাদ হওয়ার কোনও খামতি নেই। সেই সঙ্গে আর একটা জিনিস দেখা দিয়েছে। আমি প্রায়ই আধো আধো স্বরে কথা বলছি। এই প্রায় সত্তর বছর বয়সে। কারণ, কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ছে—সন ১৮৪৩-বড় পিসের যে বছর জন্ম হয়—আর সন ১৯৩৩-যে বছর আমি জন্মাই। মাঝখানে নব্বইটা বছর বড় পিসের কাছে তো আমি শিশু।

ইতি একদিন বিকেলে বলল, এখন চা করি?

না। তুমি চা কাও। আমি এখন কাবো না।

ইতি তো অবাক। ও কি? আমন আবো-আধো গলায় কথা বলছ কেন? ওপরের পাটির বাকি দাঁতগুলোও পড়ে গেল নাকি!

কি বলব! ও তো জানেও না--আমি কার কাছে আছি। যার কাছে আছি--তার কাছে তো আমি শিশুই। আমাদের মাঝে ঝাড় নব্বইটা বছর পড়ে আছে। বড় পিসে তো খুব সহজেই প্রায় সত্তর বছরের আমাকে কাঁখে নিয়ে আকাশের তারা চেনাতে পারেন। গায়ে যা জোর ওর আমাকে-- দিব্যি শূন্যে ছুড়ে দিয়ে ফের লুফে নিতে পারেন।

আমি বলি, ওভাবে কথা বলছ কেন? আমার কী সব দাঁত পলে গেছে। ইতি চা করতে যাবার সময় বলে গেল, ভীমরতি! 

ফের ঝেপে বৃষ্টি এল। এখন বিকেলবেলা। এই কলকাতা থেকে মোরেলগঞ্জ কত কত দূরে। খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার যেখানটায় বঙ্গোপসাগরকে ছুঁয়ে আছে--সেখানটায় মোরেল সাহেবের নামে গঞ্জ। কোম্পানি, মহারানি, পাকিস্তান তারপর বাঙলাদেশ। সেই কবে একশো, সওয়াশো বছর আগে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, ইংল্যান্ডের সাধারণ পড়ুয়া সব মেধাবী বাড়ির গ্রিয়ারসন, কটন, বেল, স্লিম্যান, মোৱেলের মতো ছেলেরা যৌবনে পা দিয়েই কাঁচা বয়সে এদেশে চাকরি করতে এসেছিল। রিটায়ার করে দেশে ফিরে গিয়েও বুড়ো বয়সে তারা মাথা থেকে বেঙ্গল, ইন্ডিয়া ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। বই লিখেছে। বড় পিসে ওঁদের চেয়ে বয়সে দশ-পনেরো বছরের বড় ছিলেন। তাঁর মোরেলগঞ্জ এখন হয়তো বাঙলাদেশের এক উপ-জেলা। হয়তো এখন ইলেকট্রিক লাইনও চলে গেছে সেখানে। তাই দেখে সেই বাঘটা হয়তো খাড়ি সাঁতরে, নদী পেরিয়ে সুন্দরবনের আরও গহিন জঙ্গলে গিয়ে সেঁধিয়েছে। অথচ তখন ঘোর বর্ষার ভেতর রাতের বেলায় ঝিঁঝিঁ ডাকছে। বাঁশবাগঝ জোনাকির ওড়াউড়ি। গ্রিয়ারসন কাঠের দেড়খোর মাথায় বসানো লম্ফের আলোয় দেড়খো শব্দটির রুট খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলেন দীপবৃক্ষ শব্দটি। পেয়ে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরের গরিব ঘরের পড়ুয়া গ্রিয়ারসন আনন্দে আটখানা। মোরেল হয়তো তখন হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর বাঁকা গতিপথ আঁকছিলেন। তাবুর ভেতর টেবিলে বসে। নতুন খালো কয়লা খাদানে লাগে এমন একটি ল্যাম্প জোগাড় করে আগেই তাঁবুর ভেতর বুলিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। বেলসাহেব তদ্ভব, তৎসমের ফারাক টানছেন মনে মনে। আবার ওদের হাত দিয়েই মহারানির মাথায় বসানো মুকুটে-- ক্রাউনে ইন্ডিয়া দিনে দিনে জুয়েল হয়ে উঠছে। আর বড় পিসেমশাই কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে গোয়ালে কালো গাইয়ের গা ঘেঁষে ঘাপটি মেরে পড়ে আছেন। বেয়াদপ বাঘটার অপেক্ষায়। ইতি চা দিতে আসার সময় গুন গুন করে গেয়ে উঠল---

তুমি যে আমারে চাও-ও-ও

সে আ-আমি জানি ই --

কী ব্যাপার? অবাক হই। এ গান তো ইতির চল্লিশ বছর আগে গাওয়া উচিত। ছিল। তখন গাইতে বললে-বলত, গলা ভাল নেই। বিয়ের জন্যে দু'চারখানা গান শিখেছিল নিশ্চয়। তার ভেতর এই গানখানি ছিল কি? ঠিক মনে পড়ছে না। ফের গেয়ে উঠল ইতি। আমার সামনে টেবিলে চায়ের কাপ রাখতে রাখতে

কেন-ও যে-আ-আমাকে কাদাও

সে আমি জানি-ই - 

চায়ের কাপ হাতে তুলে নিতে গিয়ে চা চলকে গেল। বড় পিসে নেই তো কাছাকাছি--সত্যি! ইতিও তা হলে জানতে পেরেছে? এ কী আর চাপা থাকে! বড় পিসেমশাইকে বুঝতে পেরেছে ইতি তাহলে। নিশ্চয় আমারই মতো বড় পিসেকে চোখ তুলে দেখতে গিয়ে হারাচ্ছে। কিন্তু ওকে কি আমি কখনও বড় পিসের চৌকিদারি পাওয়ার কথাটা বলেছি? নিশ্চয় বলে থাকব। তাই বড় পিসশ্বশুরকে টের পেয়েছে ইতি।

একবার টের পেয়ে থাকলে আর তো এই পৃথিবী নিয়ে কোনও চিন্তা থাকে না। থাকার কথা নয়। তাই নিশ্চয় বিয়ের পর চল্লিশ-বেয়াল্লিশটা বছর টপকে আজ সত্যি কথাটা গানে গেয়ে উঠতে সাহস পেল।

মনটা আমার খুশিতে ভরে যাচ্ছে। কলকাতার এই ঘরবাড়ির ভেতর রোজকার

খুলে খুলে পড়ে যাওয়া বেজোড় এই জীবনে বড় পিসের এই এসে পড়া ইতিও ধরতে পেরেছে তাহলে! আর আমাদের চিন্তা কীসের? মনের ভেতরে বসে আমিও গান গাই।

যদি ডাকার মতো পারিতাম ডাকতে--

আর গরম চায়ে ঠোট ছোঁয়াই। বড় পিসের ক্ষমতা, সামর্থ, তার পায়ের মর্তমান কলা সাইজের বুড়ো আঙুল স্পষ্ট দেখতে পাই—দুই বুড়ো আঙুলের ওপর বড় কাতলার দুখানি আশ বসানো। নখের জায়গায়। স্পষ্ট দেখছি। তিনি কারও তোয়াক্কা না করে য়ামার টেবিলের ওপারে এসে দাঁড়ালেন। এইমাত্র।—তুমি যে আমারে চাও সে আমি জানি—জানি--

পায়ের কাপটি মাথা নিচু করে শেষ করি। তারপর রীতিমতো উত্তেজনায় কেঁপে উঠ চাপা গলায় ইতিকে বলি, তিনি এলেন—দেখেছ?

কে? বলে অবাক হয়ে তাকাল ইতি।।

আরও চাপা গলায় বলি, মাথা তুলো না। তা হলে তিনি চলে যাবেন--

কে? পাগলের মতো কী বলছ? কে আবার আসবে এখন?

মাথা তুললে কেন? তিনি চলে গেলেন--

কে?

আমি আর কিছু বলিনা। শুধু মিটি মিটি হাসি। এখন গোড়ায় গোড়ায় ইতির এমনই হবে। ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না। আমারও যে এমনিই হয়েছিল।

ঘরে বসে থাকতে থাকতে তোমার মাথাটা গেছে! বলতে বলতে ইতি খালি দুটি কাপ তুলে নিয়ে খাবার ঘরে গেল। আমি কিছু আর ভাঙলাম না। তুমিই বুঝে নাও নিজে নিজে। একা একা। একটু সময় লাগবে তোমার ইতি। যখন বুঝতে পারবে বুঝতে শিখবে--তখন আর তোমার এই চাপা আনন্দ ধরে রাখার জায়গা থাকবে না। তখন নিশ্চিন্ত সুখে ভাসবে সব সময়। জানতে পারবে তোমার জন্যে সব সময় কেউ আছে। সে তোমাকে দেখবে।

বর্ষা যায় যায়। রাস্তাঘাটের মতোই আকাশ ভিজে ভিজে। তার ভেতর দিনের বেলায় বদরাগী এক সুর্য দেখা দেয় মাঝে মাঝে। রাতের দিকে এক একদিন যে চাঁদখানা ভেসে ওঠে তা বুঝি ফিকে সেলোফেন ব্যাগে ভরা--পাছে বৃষ্টিতে ভিজে যায়-তাই। সেলোফেন কাগজের বাইরে চাঁদের হলুদ আভা ফুটে ওঠে। ওরই ভেতর কলকাতায় বাস-ট্রামের চলাফেরায় কোনও থামা নেই। একটা চটচটে আঠালো গরম সব জায়গায়। হিমসাগর, ল্যাংড়া পর পর চলে গেল। ফজলি হাজির।

ঘরে বসে থাকার বদনাম ঘোচাতে আমি এরই ভেতর রোজই বেরিয়ে পড়ি। বাসে উঠতে আমার বেশ ভালই লাগে। বিশেষ করে ভিড়ের বাসে। কারণ, ভিড়ের ভেতর অনেক লোক আমাকে চারপাশ থেকে চাপ দেয়। আমিও ব্যালান্স রাখতে মাথার ওপর দু’হাতে লোহার রড ধরি। এর ফলে আমার দু'হাতের বাইসেপের ব্যায়াম হয়ে যায়। আর লোকের চাপে স্যান্ডউইচ হয়ে যাওয়ায় আমার সারা গা ম্যাসাজ হয়ে যায়। বেঁকেচুরে গিয়ে কোমরের ব্যায়ামটাও একেবারে ফ্রিতে সেরে ফেলতে পারি। শুধু নাকটা উচু করে বাতাস নেওয়া-দেওয়ার প্যাসেজ ঠিক রাখি—যাতে দম বন্ধ না হয়ে যায়। মাসাজম্যান এসে গা টিপে দিলে দিতে হয় পঁচিশ টাকা। 

বুঝতে পারি আমার ঠিক পিছনেই বড় পিসেমশাই দাঁড়িয়ে আছেন। সব লক্ষ রাখছেন। ফলে আমি নিশ্চিত।

উপরন্তু আমার যেটা সুবিধা-ভিড়ের বাসে টিকিট কাটার কোনও ঝামেলা থাকে । কন্ডাক্টর আমার কাছে পৌঁছতেই পারে না। যদি ভিড় ফুটো করে এগিয়ে আসে কাজে-আঠা কোনও কন্ডাক্টর--আমি তাকে ওয়াচ করে ভিড়ের পেটে আরও সেধিয়ে যাই। পেছনের কন্ডাক্টর হয়তো আমাকে সন্দেহ করে বলেই বসল, টিকিট।

আমিও মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়ি। মানে টিকিট কাটা হয়ে গেছে আমার। হে ভারত ভুলিও না ভঙ্গিতে যেভাবে ছবিতে বিবেকানন্দ তাকিয়ে থাকেন। সেই ভঙ্গিতে বড় বড় চোখে আমি কন্ডাক্টরের মুখে তাকাই। তাতে কাজ হয়।

এ ব্যাপারে আমার একটা অঙ্ক আছে। গত বিশ বছরে বাসের ভাড়া এমনই বেড়েছে যে টিকিটের দাম ছিল দু আনা বা দশ পয়সা-তা হয়েছে এখন দু'টাকা। ফলে দিনে চারটে বাসের ট্রিপ মারলেই আট-দশ টাকা সেভ হয়। মাসে আড়াইশো তিনশো টাকা। সারা বছর ধরলে শুধু বাস বাবদেই না-কাটা টিকিটের দরুন তিন হাজার টাকা জমে যায়। আর তার চেয়েও বেশি জমে যায় গা টেপানো থেকে। মানে ম্যাসাজ। একদম ফ্রি-তে! তা মাসে জমে যায় সাড়ে সাতশো টাকা। সারা বছর ধরলে ন'হাজার টাকা। মোট এই বারো হাজার টাকা খরচ না হওয়া মানেই তো জমে যাওয়া। একজন বাঙালি প্রৌঢ় গৃহস্থের একেই তো বলে স্বল্প সঞ্চয়।।

শনি-রবিবার অবশ্য এই ভিড়টা পেতে কষ্ট হয়। ও দুদিন কিছুটা সময় স্টপে দাঁড়িয়ে থেকে তবে দু'এক রুটে ভিড়ের বাস পেয়ে যাই। যেমন কোলে মার্কেটে যাবার জন্যে সবজিওয়ালাদের বাস। নয়তো রবিবার বেলা তিনটে নাগাদ কাটোয়া লাইনের বাজার-সাউ ট্রেনটা ধরাতে একটা বাস যায়। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই। বেদম ভিড়। এই বাসের ভিড়টা আমার খুবই পছন্দ। কোনও চিন্তা নেই তো আমার। পেছন পেছন বড় পিসেমশাইও তো উঠছেন বাসে। কিংবা কোনও কোনওদিন তিনি এক স্টপ আগে থেকেই বাসটায় উঠে ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকেন। একদম দম ফেলা যায় না এমন ভিড়ের ভেতর। আমি আভাস পাই তাঁর। কিন্তু দেখতে পাই না বড় পিসেকে। যদি ডাকার মতো পারিতাম ডাকতে--

ইতি ও দিন বিকেলবেলায় যখন বলল, ঘরে বসে থেকে থেকে নাকি আমার মাথাটাই গেছে—তখন সন্ধে নামতে না-নামতেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে চোখের সামনে যে বাস পাই উঠে পড়ি। খেয়ালই করিনি যে বাসটা প্রায় ফাঁকা।

এখন অফিসপাড়ামূখে বাস তো কিছু ফাঁকা হবেই। সিট খালি থাকলেও বসলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আমারই মতো আরও জনা ছয়েক দাঁড়িয়ে। গুনে দেখি চারটি সিট ফাকা। ওই ছ’জনের মধ্যে কে আমার বড় পিসে হতে পারেন? 

একজন তো মহিলা। তাকে বাদ দিলাম। দু’জন ছোকরা মতো। তারাও বাদ গেল।

একজন খুব গম্ভীর। কিন্তু একদম খেকুরে মার্কা। তাকে বড় পিসে ভেবে নেওয়া খুবই কঠিন।

বাকি দুজনের একজন ষন্ডামার্কা। সাদা মাথা। প্রায় বাসের ছাদে লাগে লাগে।

“স্পোর্টস গেঞ্জির নীচে রিংকল ফ্রি প্যান্টালুন। পায়ে ছাই রঙা ভেলভেট সু। একদম অন্য দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এর বয়স কি ১৫৭ বছর হবে?

হতেও পারে। বলা যায় না। বড় পিসে হয়তো এভাবেই শরীরটা রেখে চলেছেন। কি এই বাইরেটা আগাগোড়াই ওর ছদ্মবেশ হতে পারে। টিকিট।

আমিও সঙ্গে সঙ্গে বিবেকানন্দের “হে ভারত ভুলিও না’ ভঙ্গিতে বড় বড় চোখ করে কন্ডাক্টরের মুখে স্থির হয়ে তাকাই। সেকেন্ড তিনেক একদম স্তব্ধ থেকে বা দিকে মাথা হেলাই। তার মানে টিকিট কাটা হয়ে গেছে।

তবু কন্ডাক্টর বলল, দেখান। 

বাস তখন বেকবাগান নিয়ে ছুটছে। এদিকে আসি না বহুকাল। কারণ, ক্লাসফ্রেন্ড সোমনাথ এখানে থাকত। সে মারা গেছে আট বছর। এদিকে আমাকে কেউ চেনে। । বাসের কয়েকজন প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি টিকিট কাটিনা কারণ—আমার অফিস হঠাৎ ক্লোজার ডিক্লয়ার করে মালিক বন্ধ করে দেয়। তার সঙ্গে ইউনিয়ন নেতার সাঁট ছিল। পি এফ, গ্র্যাচুইটি কোনও টাই পাইনি। আমি সবসময় খারাপ সময়ের কথা ভেবে সব কিছু বাঁচাই। টাকা। আলু। জামাকাপড়। চিনি। একটু রিফু করলে যদি পাঞ্জাবিটা আরও তিন মাস গায়ে দেওয়া যায়, তাহলে রিফ করিমেয়। নেব না কেন, তেমনি দু’আনার টিকিট দু টাকায় ঠেলে তুলেছ ।একদল লোক ভাল দল পাকাতে পারে বলে তাদের জন্যে গত বিশ বছরে মাইনে দফায় দফায় বাড়িয়ে মোট আট হাজার কোটি টাকার বোঝা আমাদের কাঁধে চাপিয়েছো---'আর তাদের চেয়ে আরও অনেক অনেক বেশি লোক একদম দল পাকাতে পারে না বলে তারা ঘাড় নিচু করে টিউশানি করে যাচ্ছে বছরের পর বছর—ট্রেনে ট্রেনে লজেন্স ফিরি করছে গলা চিরে-বর্ডারে গরু, নুন পাচার করতে গিয়ে একদিন বি এস এফ-এর হাতে চাঁদমারি হয়ে যাচ্ছে—আর আমি দু'টাকার একখানা টিকিটের দাম ফাঁকি দিতে পারব না? গুলি মারো গান্ধীজিকে। ট্রেনে সবাইকে টিকিট কাটতে বলছেন না যেন গীতায় একটি নতুন শ্লোক অ্যাড করছেন। জাতির পিতা আবার কি জিনিস? নিজের পিতা ঠাই পাচ্ছে না। জাতি তত অবিরাম তৈরি হতে থাকা একটা কেমিস্ট্রি। তার বাবা যুগে - যুগে বদলায়।

ঠিক এই সময় বড় পিসেমশাই - হ্যাঁ, বড় পিসেই হবেন—সেই ছাই রঙের ভেলভেট সু পায়ে ঢ্যাঙা, তাগড়া লোকটা যেন নিজের স্টপ পেরিয়ে যাচ্ছেন—এইভাবে কন্ডাক্টরকে ধাক্কা দিয়ে এক লাফে পাদানিতে। তারপরেই রাস্তায়।

কন্ডাক্টারের কাৰে স্ট্র্যাপে ঝালোনো চামড়ার ব্যাগটা উলটে গিয়ে সব খুচরো বাসের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল! সে আবার টিকিট দেখবে কী! চেঁচাতে চেঁচাতে উবু হয়ে বসে খুচরো কয়েনগুলো কুড়োতে লাগল। ড্রাইভার বাস থামাল। আমি ধীরেসুহে নেমে গিয়ে। রাস্তায় দাঁড়াই। 

কোথায় বড় পিসে?

প্রায় এক স্টপ পিছিয়ে তাকে অনেক খুঁজলাম। ভিড়। ভিড়। কোথায় মিশে গেছেন। আর কী পাওয়া যায় বড় পিসেকে! কিন্তু জানি—তিনি এখুনি আমার কাছে চলে এসে কাছাকাছি হাঁটবেন--আমি বসলে বসবেন। আমি দাঁড়ালে উঠে দাঁড়াবেন। তাহলে বড় পিসেকে এরকম দেখতে ? না, ওটা তার ছদ্মবেশ ? এমন কি আমার কাছাকাছি থেকেও আমার চোখে চোখ রেখে সিধে তাকাবেন না। তাকালে আমি ১৫৭ বছর আগে কেমন চোখ নিয়ে মানুষের জন্ম হত তা দেখতে পেতাম। কিন্তু তিনি টেবিলের ওপারে দাঁড়িয়ে পুরো চোখ খুলে আমায় দেখতে থাকবেন—যদি আমার চোখ বইতে কিংবা চিঠিতে বা অন্য কিছুতে নামানো থাকে। আর ওর এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার আভাস আমি টের পেতে থাকব।

কিন্তু আমি তো বড় পিসেমশায়ের আন্ডারে আছি। তিনি দেড়শো বছর ক্রস করে। 'আমাকে বাঁচাতে ছুটে আসেন। ধেয়ে পেয়ে। লবণ আন্দোলন, ভারত ছাড়ো মাড়িয়ে।

কিন্তু একদিন বড় পিসেমশাই আর আমাকে বাঁচাতে পারছেন না। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আঠারো বছরের বড়। তাকে তো দেড়শো বছর সাঁতরে পার হয়ে আমার কাছে আসতে হয়। মাঝখানে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মহম্মদ আলি জিন্না, দেশবন্ধু, সোহরাওয়ার্দি, ফজলুল হক, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু আছেন। তারপর আমি।

এর দু'দিন বাদেই মেট্রোর ভেতর ব্যাপারটা একদম অন্যরকম হল। অফিস টাইমের ভিড়। মেট্রোয় চড়া শুরু করেছিলাম এক টাকা আর দেড় টাকার টিকিটে। তখনও দমদম অবধি পাতাল রেল যেয়ে উঠতে পারেনি। যাবার পর টিকিটগুলো দু'টাকা, তিন টাকা, পাঁচ টাকা, সাত টাকা হয়ে গেল।

মেট্রোতেও আমি টিকিট কাটব না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ঢোকার গেট এত উঁচু যে এই বয়সে লাফিয়ে টপকানো যায় না। হলিউডের একটা ইংরেজি ছবিতে দেখেছিলাম-ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা নিগ্রো ছোকরারা টিকিট না কেটেই, দিব্যি হাইজাম্প দিয়ে উঁচু গেট টপকে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে পড়ছে আর ট্রেনে উঠে যাচ্ছে।

টালিগঞ্জ থেকে গিরিশ পার্ক যাচ্ছি। সাউথ থেকে নর্থ-এ। সব স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম পড়ে ডান হাতে। শুধু পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম বাঁয়ে। বাঁয়ের স্লাইডিং ডোরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন গল্প করতে করতে যাচ্ছি। ঠিকই করে রেখেছি ময়দান স্টেশনের পরেই বাঁয়ের স্লাইডিং ডোর থেকে সরে দাঁড়াব। পরের সেশন পার্ক স্ট্রিটে বাঁ দিকে স্লাইডিং ডোর খুলে গেলে লোকজন নামবে।

গল্প করছি আর দেখছি—মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক আমার চেয়ে তা পনেরোষোলো বছরের ছোটই হবেন-আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছেন মাঝে মাঝে। আমিও পাল্টা তাকালে তিনি মুখ একদম ঘুরিয়ে নিয়ে কামরার গায়ে সাঁটা এল আই সি-র বিজ্ঞাপন মন দিয়ে দেখেছেন।

ভদ্রলোকের চেহারাটি বেশ। মাথায় চুলে ঢেউ। পায়ে নাগরা। কালো ধাক্কা পাড় ধুতির ওপর দারুণ পাঞ্জাবি। টিকালো নাকের নীচে গোঁফেও ঢেউ। হাতে একখানি ছড়ি থাকলেই ভদ্রলোককে আগেকার জমিদার বলে চালানো যেত।

ময়দান স্টেশন আসার আগেই স্লাইডিং ডোর আচমকা পাতাল রেলের অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর খুলে গেল। তখন রবীন্দ্রসদন ছেড়ে ট্রেন ভীষণ পিডে ময়দান স্টেশনের দিকে ছুটছে। সারা কামরা চেঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে। আমি আমার পেছন দিককার অন্ধকার শূন্যে টলে পড়তে পড়তে এক পলকে সবটা দেখতে পেয়েছি। আমার তখন কিছু করার নেই। বুঝতে পেরেছি-মৃত্যুর আগেকার শেষ দৃশ্যটি আমার চোখের সামনে। সবাই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল এইমাত্র।

মনে হল সেই সাবেক জমিদারের পাঞ্জাবির ঢালো হাতার ভেতরে রাখা তার ডান হাতখানি এমনি পাবলিকের হাতের চেয়ে লম্বায় অনেক বড়। তিনি নিজের জায়গায় দাড়িয়েই ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে ফলপাকুড়ের মতোই পেড়ে ফের কামরার ভেতর নিয়ে এলেন। তখন ট্রেন ময়দান স্টেশনে ঢুকছে।

আমি কামরার ভেতরে ফিরে এসে যেন ফিরে জন্মালাম। কিন্তু সবাই উঠে দাঁড়ানোতে আমি ফাঁকা সিটে শুয়ে পড়লাম। আমার ঠিক উলটোদিকে লেডিজ সিটে এক মহিলা শুয়ে পড়ে ভয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদছেন। তাই দেখে আমার বুকের ভেতর হাপরের মতোই বাতাস ওঠানামা করতে লাগল।

শুয়ে শুয়েই দেখতে পাই বিশাল নাগরায় ঢাকা বড় বড় পায়ে বড় পিসেমশাই পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে নেমে গেলেন। আমি ধুতির বাইরে তাঁর পায়ের কাফ মাসল দেখতে পাচ্ছি। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো। রবীন্দ্র রচনাবলীতে একটা ছবিতে দেখেছি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ধুতির ওপর ফতুয়া গায়ে বেরিয়েছেন। পেছন থেকে তোলা ছবিতে রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাফ মাসেল অনেকটা বড় পিসের মতোই। রীতিমতো তাগড়া।

মেট্রো থেকে নামি। এসক্যালেটরে চেপে ওপরে উঠছি—গুন গুন করে গান এসে গেল। কথা নয়। আমি তো তখনও মৃত্যুর ঘোরে। শুধুই সুর এসে যাচ্ছে।

যদি ডাকার মতো পারিতাম ডাকতে--

বড় পিসে। আজ যে আমি তোমারই জন্যে ফিরে জন্মালাম। শুধু তোমারই জন্যে। নয়তো এতক্ষণে পাতাল রেলের অন্ধকার সুড়ঙ্গে লোহার খাম্বায় মাথা ঠুকে গিয়ে ঘিলু ছটকে যেত। একবারই ব্যথা পেতাম। মোক্ষম ব্যথা। তারপর তো আর কিছুই টের পেতাম না।

মেট্রো থেকে ওপরে ভেসে উঠে ভিড়ে তাকাই। আজ বড় পিসেমশাই জমিদার সেজে এসেছিলেন। কিংবা পরগনাদার। বড় পায়ে ওই নাগৱা—নাকের নীচে ওই বাহারি গোফ-গায়ে ওই পাঞ্জাবি। শুধু কি আমার জন্যে? তিনি কেন আমাকে বাঁচাতে আসেন? তার কি আর কোনও কাজ নেই? পৃথিবীর হাড়ে ঘুণ ধরছে। জলে আর্সেনিক। গাছ কমে যাওয়ায় কারবন ডাই অক্সাইড তার পায়ের নীচে সারা দুনিয়াকে গোড়ালি দিয়ে থ্যাতলাচ্ছে। অথচ বড় পিসের বালক বয়সে অঢেল গাছ, জল সরলশুদ্ধ, দুনিয়ার গাছে গাছে আতা, ধানের গোছে পুরুষ্ট ধানের দানা। সেই সময়কার তিনি এতকাল থেকে গিয়ে আমাকে চোখে চোখে রেখেছেন। হারাতে চান না। অথচ তার নিজের ছেলে মোহিনীদাদা কবেই হারিয়ে গেছেন।

আমি বড় পিসেকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি।

যে বাস সামনে পাই, তাতেই উঠে পড়ি। চমৎকার বাস। মানুষ গরু-ছাগলের মতো লাদাই হয়ে চলেছি। ধাম, গরম, দুর্গন্ধ। নিশ্বাস ফেলতে, টানতে নাক— নাকের ফুটো উঁচু করে রাখি। এত চমৎকার বাস—ভিড়ের ভেতর কন্ডাক্টর এগোতেই পারে না। সে রীতিমতো ঘাবড়ে গেছে। বুঝতেই পারছে না—কার টিকিট কাটা হয়ে গেছে কার হয়নি-- তাই আন্দাজে সবার কাছেই টিকিট চাইছে। প্র্যাকটিকালি কেউই টিকিট কাটছে না। সবাই মাথা নাড়ছে। আমিও মাথা নেড়ে দিয়ে বউবাজার চিত্তরঞ্জন ক্রসিংয়ে

নেমে পড়ি। হাসফাঁস করতে করতে । আঃ! কী চমৎকার বাতাস বাসের বাইরে। আগে পেছনে পুলিশের গাড়ি। মাঝে একখানা বড় গাড়িতে একজন মন্ত্রী। হেলান দিয়ে বসেছেন।

এসব জায়গাই বড় পিসেকে খুঁজে বের করার আদর্শ জায়গা। রে রে করে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারদিকে গিজগিজে ভিড়। তার ভেতর বড় পিসে কখনও পায়ে ছাই রং ভেলভেট সু পরে, নয়তো বিশাল পায়ে বিরাট নাগরা জুতো গলিয়ে লুকিয়ে ঘুরে বেড়ান? তিনি তো আসলে গভৱনর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির আমলের বালক, রবীন্দ্রনাথের বালক বয়সের যুবক, সারা দেশে রেল লাইন ছড়িয়ে পড়ার সময়কার সাক্ষী, বঙ্গভঙ্গের সময়কার বৃদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গী অতিবৃদ্ধ, দেশভাগের সময়কার অতিজীবী এবং এখনকার অমর। যখন তখন যেমন তেমন ছদ্মবেশের আড়ালে চলে যান। সুবিধামতো। নয়তো ওভাবে কেউ পরগনাদার সেজে মেট্রোয় ওঠে? আমাকে বাঁচাতে? কিসের এত টান আমার ওপর ? চৌকিদারি করে সে আমলে প্রচুর জমিজমা। আমি দুনিয়ায় আসার আগে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু কেন যেন মনে হয় এক গুপ্ত চুক্তির দরুন বড়পিসে আমাকে তুরিয়ে দিচ্ছেন-বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। নিজে আড়ালে থেকে। বেরিয়ে পড়ছেন আমার বিপদের সময়। বাঁচিয়ে দিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন তার নিজের আড়ালে। যে-আড়াল আমি কিছুতেই ফুটো করতে পারি না। অথচ আমাদের দুজনের মাঝখানে শুধু কিছু অদৃশ্য বাতাস। সে বাতাসের ওপার থেকেই তিনি আমাকে চোখে চোখে রেখে চলেছেন।

সন্ধে হয়ে এসেছে। রাস্তায় হ্যালোজেন আলো দিলেও কেমন ম্যাটম্যাটে চেহারা চারদিকে। ফিরিঙ্গি কালিবাড়ির কাছাকাছি এসে বুঝি—এদিকে খানিক আগেও বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির তো ফুরিয়ে যাবার কথা। আকাশ ফেটে বৃষ্টি গেছে ক'মাস। হয়তো কলকাতার কোনও কোনও পাড়ার মাথায় আকাশের কোনও কোনও ড্রয়ারে মেঘের গুড়োগাঁড়া পড়ে ছিল।

হাঁটছি আর উলটোদিক থেকে আসা এক একজনের মুখে তাকাচ্ছি। এদের ভেতর কেউ যদি বড় পিসে হয়ে থাকেন। এক জন তো যেতে যেতে ফিরে ফিরে আমাকে দেখল। আমিও ঘুরে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়ার পেছনটা দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কী অস্বাভাবিক বড় জুতো পায়ে। নিশ্চয় অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছেন বড় পিসে। লোকটি সন্ধেরাতের আবছা আলোয় এক রকম উবেই গেলেন।

আমি তো ভবানীপুর দিয়ে ফিরতে পারব না। ওদিকে মানস থাকত। সে আর নেই। হরিশ মুখার্জি দিয়েও ফিরতে পারব না। এদিকে বিমল আর তার বউ কবিতা থাকত। দু'জনের কেউই আর নেই। ল্যান্সডাউন দিয়েও আমার ফেরা হবে না। সে রাস্তা ছিল শংকরের। সে আজ নেই চব্বিশ বছর হয়ে গেল। 

তাই ঠিক করেছি—শেয়ালদা গিয়ে সাউথ স্টেশনে বজবজের ট্রেন ধরব। রেল লাইনের গায়ে আমার চেনাজানা কেউ মরেনি। টালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে বাড়ি অবধি হেঁটে যাব। একটুখানি রাস্তা। 

পুরনো ঝামা পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা চিরে ইস্পাতের ট্রাম লাইন! দুধারে ফার্নিচারের দোকান। হাঁটতে গিয়ে ভিজে রাস্তায় কাবলি জুতোর রবার সোল হড়কায় ।

এই রাস্তাটা—এই এলাকাটা দুশো, সওয়া দুশো বছর আগে গড়ে ওঠা ইংরেজদের টাউন ক্যালকাটার পুবদিকের টুকরো। তখন নিশ্চয় ঝামা ইট দিয়ে বাঁধানো ছিল না। কাছেই রাইটার্স। কোম্পানির বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস নিজে ঘোড়ার পিঠে বসে-পাশের ঘোড়ায় সুপ্রিম কোর্টের নবীন বিচারপত স্নেহভাজন উইলিয়াম জোন্সকে বসিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এই রাস্তা দিয়ে টাউন ক্যালকাটায় ফিরে যাবার পথে—হয়তো কোনওদিন আচমকাই বলেছিলেন-বুঝলে জোন্স-আর বেশি দিন তোমার সুপ্রিম কোর্টে আইনের কচকচি নিয়ে পড়ে থাকতে হবে না। তোমার মনের মতো একটা কাজে তুমি এবার যোগ দেবে। আমরা এশিয়াটিক (সোসাইটি গড়ে তুলছি। তুমি হবে তার চিফ!

আমি ইতিহাসের কচকচি একদম জানি না। একদিন শীতের বিকেলে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে গিয়ে পড়েছিলাম। সেখানে নিশীথ রায় নামে একজনের লেকচার শুনে এ সব কথা কানে ঢুকে গিয়েছিল। ভুলতে পারিনি। তাই মাথার ভেতর সময়ে সময়ে চিড়বিড় করে ওঠে। মাথা থেকে বের করে দিতে পারিনি।

আর হাঁটতে পারছি না বড় পিসে। আপনি যেখানেই থাকুন, চলে আসুন। বারবার পা স্লিপ করছে। এসব ভাবতে না-ভাবতেই একজন তাগড়া মতো রিকশাওয়ালা হাতের ঘন্টি ঠুং ঠুং করে এসে তার গাড়ি আমার সামনে থামালো।—চলিয়ে বাবু- পৌঁছা দেগা--

আমার কোনও সন্দেহ রইল না-ইনিই আমার বড় পিসে। আমি উঠে বসি। বলতেও হল না কোথায় যাব। কোন দিকে যাব। রিকশা শেয়ালদার দিকে চলেছে। পেছন থেকে দেখছি-বড় পিসের শোল্ডার। দৌড়ন্ত মানুষটার পায়ের কাফ মাসল। এই কাফ মাসল আমার চেনা। হাতরিকশার হাতল ধরেছে যেন কোনও হাত নয়-- স্টিলের দুখানি পিস্টন। ফজলির আঁটি, খোসা, বৃষ্টির অকালকাদা, ময়রার দোকানের ন্যাতানো শালপাতা চারদিকে ছড়ানো। বড় পিসের পা যে কোনও সময় হড়কাতে পারে। এত পুরনো লোককে এতখানি পরিশ্রম করতে দেখে লজ্জা পাচ্ছিলাম।

কিন্তু একটা জিনিস দেখে মুহুর্তে সব ভুলে গেলাম। শেয়ালদার প্ল্যাটফর্মের মাথার ওপরের শেডের পেছন থেকে একখানি হলদে, গোল, বড় চাদ উঠে এল। এতক্ষণ যেন উঁকি দিয়ে কলকাতাকে দেখছিল। এবার পুরো চেহারা নিয়ে সন্ধেরাতের কলকাতার মুখোমুখি ভেসে উঠল। আজ কি পূর্ণিমা?

আমি তো অবাক।চাঁদও অবাক।

ঘোর কাটলো বাঁ হাত ধরে কে টানায়। তাকিয়ে দেখি অল্পবয়সী একটি মেয়ে--পচিশ-তিরিশ হবে—আমার রিকশার পাশেপাশে ছুটতে ছুটতে আমার বাঁ হাত ধরে টান মেরেছে। 

আশ্চর্য! কী ব্যাপার? এভাবে কেউ টানতে পারে—তাও একজন মেয়ে---চমকে যাই।

মেয়েটির মাথার চুল খালো। বুকের কাপড় সরে গেছে। ভিজে রাস্তায় খালি পায়ে রিকশার পাশে দৌড়চ্ছিল। পাগল নাকি? 

আমি রিকশায়। বড় পিসে তাঁর গাড়ির হাতলে। প্রায় ছুটন্তু। আকাশে গোল, হলুদ চাঁদ। মেয়েটি আমার দিকে মুখ তুলে ছুটতে ছুটতেই চেঁচিয়ে বলল, আকাশের চাঁদ পেড়ে নিন বাবু-- পেড়ে নিন—এই যে—আকাশের চাঁদ—খুব সস্তায়—তিরিশ

টাকায়—মাত্তর তিরিশ---

বড় পিসে রিকশা থামালো। আমি নামলাম। কতদিন অল্পবয়সী কারও সঙ্গে মিশিনি। মন্দ কি। রিকশা ভাড়া দিতেও ভুলে গেলাম। বড় পিসেরও কোনও চাড় নেই।

মেয়েটি আমার হাত ধরে ভিজে ফুটপাথ পার হয়ে একটা সোনার দোকানের গা ধরে গলি—তস্য এক গলিতে ঢুকে পড়ল। পড়ে বলল, কেমন নিয়ে এলাম। তোমার টাকা আছে তো?

মাথা নাড়ি।।

সরু ফালি ঘর। নিচু পাওয়ারের ইলেকট্রিক ডুম। মেয়েটি পলকে চার প্রস্থ জামাকাপড় খুলে ফেলে একদম মাগুর মাছ হয়েই বলল, খোল---

আমি সব খুলে ফেলৰ ফেলব করতে—দশ সেকেন্ডও ওয়েট করিনি—ঠিক এই সময় বড় পিসে নিজের হাতে হোল এলাকায় পলকে লোডশেডিং করে দিলেন।

আমি একদম সময় নষ্ট না করে পুরনো পচা সব সাতপুরনো বাড়ির নোনা দেওয়ালে ঠোকর খেতে খেতে বড় রাস্তায় এসে পড়ি। চাঁদের আলোই সম্বল। কোথায় রিকশা! হাঁটতে হাঁটতে শেয়ালদা। বজবজ লোকাল। টালিগঞ্জ স্টেশন। 

আমাদের পাড়ার আকাশেও সেই একই চাঁদ। এদিকে লোডশেডিং হয়নি। চারদিক আলোয় ফট ফট করছে। বলা ভাল থইথই। আজকাল ও জিনিস এদিকে খুব কম হয়। এক যদি বড় পিসের ইচ্ছে হয় তো সে কথা অন্য—তিনি সবই পারেন।

বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখি রাস্তার উলটো দিকে নতুন থানার সাইনবোর্ড নিওনে কাচে ঝক ঝক করছে। থানার গেটে কিছু তাগড়া লোকের ভিড় সব সময়। তারা নিজেদের ভেতর খুব হাসির কথা বলে ঝকঝকে দাঁতে হাসে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাচের গ্লাসে চা খায়। সিভিল ড্রেসে কারও হাতে থাকে বেতের মোটা লাঠি। ওদের ভেতর কে পুলিশ, কে তালোবাজ, কে গুণ্ডা বোঝা যায় না। সব এক চেহারার।। 

আমাদের বাড়ির সামনের বাস স্টপের ফুটপাথে তিন মহিলা বসে। মর্জিনা বেগম ধাপার ভুট্টা এনে চুলোয় সেঁকে নুন-লেবু মাখিয়ে বিক্রি করে। ওর স্বামী ওয়াহেদকে চিনি। রাজমিস্ত্রি। ভারা থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ঘরে বসে আছে।

পার্বতী তেওয়ারি ভাগলপুরের কাছাকাছি গাঁয়ের বিধবা। নিজের দুটি কিশোর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তালো উনুনে আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি ভাজে---বেঁচে। আর নুরজাহান তার দ্বিতীয় পক্ষের বুড়ো স্বামীর একমাত্র ফনফনে একটা ছেলেকে নিয়ে রোলের দোকান করে।

মর্জিনা, পার্বতী, নুরজাহান-তিনজনই আমাকে খুব ভদ্দরলোক ভাবে। তিনজনই আমাকে বাবা ডাকে। মর্জিনা মিলাদুন্নবির দিন বাড়িতে রান্না সিনাইয়ের পায়েস দেয়। দিয়ে বলে—খাও বাবা। আজ নবিজির জন্মদিন। তোমার জামাইয়ের ভাঙা পা যদি জোড়া লাগত! একটু দোয়া কর।

জামাই মানে মর্জিনা বেগমের স্বামী রাজমিস্ত্রি ওয়াহেদ।

পার্বতী মিটি মিটি হাসে শুধু। আর মাঝে মাঝে বিকেলবেলা বড় ছেলেকে দিয়ে গরম পেঁয়াজি পাঠায়।-চায়ের সঙ্গে খাইবেন বাবা

নুরজাহানকে তার স্বামীর আগের পক্ষের ছেলেরা একদিন খুব পেটায়। আমি মাঝখানে পড়ে সালিশি হয়ে তাদের খুব শাসাই। সেই থেকে নুরজাহান আমাকে বাবা ডাকে।

তার ছেলে ডাকে দাদু। নুরজাহান আমাকে তার সেরা রোল কাগজে মুড়ে পাঠৰেই। আমি সে রোল গোপনে তার ছেলেকে দিয়ে দিই।

এই মর্জিনা বেগম, পার্বতী তেওয়ারি আর নুরজাহান আমার বাড়ির সামনের বড় রাস্তার মোড় আর তার চার দিককার গেজেট।

বাড়ির সামনে আসা মাত্র নুরজাহান জানাল, থানার সাঙ্গে ঠিক হয়ে গেল--দিনে দশ টাকা করে নিলেই হয়ে যাবে। আর ওরা ঝামেলা করবে না। বাকি খাবে না। যাক বাবা, শান্তি তো কেনা গেল! তাই না বাবা?

শুনি আর আমার গায়ের রক্ত গরম হয়। কিন্তু বুড়ো তো। রক্ত তাড়াতাড়ি বরফ মেরে যায়। তখন বুকের ভেতর সাউন্ড বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে গাই--যদি ডাকার মতো পারিতাম ডাকতে; মুখ দিয়ে একটা কথাই বেরিয়ে আসে। বড় পিসে-~

আজ সারাটা দিন যে কী যাচ্ছে। প্রথমে মেট্টোর স্লাইডিং ডোর খুলে গেল আচমকা। যা কিনা কখনও খোলে না। বাসে চমৎকার ভিড়। ফিরিঙ্গি কালিবাড়ি পেরিয়েই শেয়ালদার দিকে ঝামা ইটের হড়হড়ে ভিজে রাস্তায় বড় পিসের হাতরিকশায় উঠে পড়লাম। তার পর তো আকাশের চাঁদ পেড়ে ফেলি। মোক্ষম সময়ে বড় পিসে হোল শেয়ালদা এলাকা অন্ধকার করে দিলেন। আকাশের চাঁদ তখন ফালি মতো ঘরে মরা ডুমের আলোর ভেতর একেবারে মাগুর মাছ।

নুরজাহান বলল, শুনেছেন বাবা?

আজ শেষ রাতে তোলাবাজ গয়াকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।

কী

পার্বতী বলল, হ্যাঁ, বাবা। থানাই তো গয়াকে তোলাবাজ বানাইল। ফিন তোলার টাকা আধাআধি বখরা ছিল থানার সহিত।

তাহলে গয়াকে মারল কেন?

গয়ার যে বহুত বদনামী হো গইল। তাই গয়াকে খতম করে দিল! এবার গয়ার ছোটাভাইকে তোলাবাজ বানাইবে দেখবেন।

গয়ার ছোটভাই আছে নাকি? তবে কি! সেও তো ইখন আধা-তালোবাজ। কী বেয়াদব। ছেলিয়াটা দেখতে খুব সুরত।

আর এক পা এগোই। মর্জিনা বেগমের হাতে পড়ি।

নাও। এই ভুট্টাটা খাও।

না। খাব না। দাঁত নেই সাতটা। কামড়াতে পারি না।

তুমি এর একটা বিহিত কর বাবা। সেদিন ষোলোটা ভুট্টা পুড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। দাম চাইতে গিয়ে ধমক খেলাম।

তাই নাকি?—বলে আর সামলাতে পারি না। সিধে রাস্তা পেরিয়ে—ট্রাম-বাস দেখে নিয়ে-ওপারের ফুটপাথে উঠি।

কয়েক মাস আগে থানায় এসেছিলাম। রক্তদান শিবির হয়েছিল। সব অচেনা ইয়া ইয়া লাশ পর্দার পেছনে লোহার খাটে শুয়ে রক্ত দিচ্ছিল। ট্রানজিস্টারের হিন্দি ছবির গান। সব ডি সি, এ সি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কে কি তা জানি না। সি পি এলেন। সবাই তটস্থ। আমাকে নাগরিক হিসেবে এক কাপ চা দেওয়া হয়েছিল। আমার পাশে পাড়ার কোচিং সেন্টারের ক্লার্ক কাচুমাচু হয়ে বসেছিলেন।

আমার সে পরিচয় দেখলাম থানায় কেউ মনে রাখেনি। ও সি রোদে বেরিয়েছেন ? অ্যাডিশনাল ও সি খুব মধুরভাষী। ষোলোটা ভুট্টার কাহিনী গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন! |

পেছন পেছন গেলাম। দু'পাশের ঘরের ভেতর মাঝখানে সরু করিডর। হঠাৎ অ্যাডিশনাল ও সি লোহার গারদ খুলে আমাকে নিয়ে বাঁ পাশের একটি ঘরে ঢুকলেন ।

মনে মনে বলি, এ ঘরে কেন ? ঘরের দরজা কেন লোহার গারদের ? 

ফাঁকা ঘর। একটি টেবিল। তার দু'পাশে দু'খানি চেয়ার!

জানতে চাই, এ ঘর এত ফাঁকা কেন?

এখানে আমরা ইনটারোগেট করে থাকি-বলতে বলতে অ্যাডিশনাল ও-সি-র ঠোঁটে চাপা হাসির সঙ্গে কয়েক ফোটা মধু ঝরে পড়লো।

তো আমাকে এ করে নিয়ে এলেন কেন?

ওদিকটায় রাস্তার গোলমাল। অফিসে ফোর্স আসছে যাচ্ছে। তাদের বুটের শব্দ। হাসি। হই-হল্লা। -আপনি এখানে বসে আপনার কথা গুছিয়ে বলুন! পয়েন্ট বাই পয়েন্ট।

ভদ্রলোক ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে গেলেন। | 'টাইগার নামে লোকটি ঘরে ঢুকতেই চিনতে পারলাম। বিশেষ করে খালি পা বলে । স্পষ্ট দেখি—মর্তমান কলার সাইজের মতো মোটা বড় বড় বুড়ো আঙুল। তার ওপর নখের জায়গায় দশ কেজি সাইজের কাতলা মাছের আঁশ।

আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছি। চেঁচিয়ে উঠি বড় পিসেমশাই!

সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখের ওপর ঘরের ছাদ থেকেই যেন একটা চাড় ভেঙে পড়ল । দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ছিটকে একদম মেঝের ওপর ।

বড় পিসেমশাই আমাকে হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেললেন। তার হাতের থাবার ভেতর আমি পায়রার পালকের মতোই।

কোনও ্মতে ফের বলতে পারি, বড় পিসেমশাই | বড় পিসেমশাই হাসতে হাসতে বললেন, এবার যাচাই হোবে--আমি তুহার পিসামশাই না, বহনাই!

খুবই অবাক হলাম। বড় পিসেমশাই হিন্দিতে কথা বলছেন কেন? তখন আমার নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত পড়ছে। তবু শেষবারের মতো চেঁচিয়ে বলতে চেষ্টা করি-বড় পিসে—

নিজেই শুনতে পেলাম নিজের গলা। রক্তে, ব্যথায় ভিজে জবজবে কয়েকটা ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরবর্ণ আগোছালভাবে কোনও ঘোলা টানে ভেসে যাচ্ছে। কোনও কথা হয়ে উঠতে পারছে না। শুধু বুকের ভেতর সাউন্ড বন্ধ করে দিয়ে গেয়ে চলেছি--- 

যদি ডাকার মতো ডাকিতে পারতাম-- 

গানের লাইনও গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ