শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকজীবন ১৯২৮ থেকে ১৯৫০ মাত্র বাইশ বছর। তাঁর চাকরিজীবন— স্কুলে পড়ানো, টিউশনি, বনাঞ্চলে জমির পাট্টা বিলি, নায়েবি আর গোরক্ষা সমিতির হয়ে শহরে গঞ্জে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো। ঘুরে বেড়িয়েছেন ঘাটশিলার জঙ্গলে সারেন্ডার ফরেস্টে। থেকেছেন কলকাতায় মেসে, ঘাটশিলায় আর রানাঘাট ও বনগাঁ লাইনের সংযোজক রেলপথের কাছাকাছি চালকি ব্যারাকপুরে। লিখেছেন প্রবাসী’, ‘বঙ্গশ্রী’, ‘বিচিত্রা’, আর শনিবারের চিঠি’তে। বন্ধু ছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী, পরিমল গোস্বামী, গোপাল হালদার, সজনীকান্ত দাস। ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বিশেষ স্নেহভাজন।
কবি কালিদাস রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সশ্রদ্ধ সম্পর্ক ছিল। নিজে স্নেহের চোখে দেখতেন ঔপন্যাসিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যকে। পড়তে যেতেন তখনকার ইমপিরিয়ল লাইব্রেরিতে। আড্ডা দিতেন মিত্র ও ঘোষ, শনিবারের চিঠি, এম সি সরকার, গোলদিঘিতে। রবীন্দ্রনাথের সামনেও একবার দুবার গেছেন। বিচিত্রার আড্ডায়। পড়ার বিষয় ছিল অভিযানের কাহিনি, মহাকাশ, গিবন, সংস্কৃতকাব্য। স্বাধীনতা আন্দোলনের জমজমাট দুটি দশক তার লেখকজীবনের সমসাময়িক। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র তো ছিলেনই-- চার্লি চ্যাপলিন, কানন দেবী, শিশির ভাদুড়ী, জওহরলাল নেহরু, উদয়শঙ্কর তাঁর কর্মময় সময়েই পূর্ণভাবে বিকশিত। লেখায় না এলেও এঁরা তাঁর চিন্তাভাবনার আকাশে নিশ্চয় দেখা দিয়েছিলেন।
কবি কালিদাস রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সশ্রদ্ধ সম্পর্ক ছিল। নিজে স্নেহের চোখে দেখতেন ঔপন্যাসিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যকে। পড়তে যেতেন তখনকার ইমপিরিয়ল লাইব্রেরিতে। আড্ডা দিতেন মিত্র ও ঘোষ, শনিবারের চিঠি, এম সি সরকার, গোলদিঘিতে। রবীন্দ্রনাথের সামনেও একবার দুবার গেছেন। বিচিত্রার আড্ডায়। পড়ার বিষয় ছিল অভিযানের কাহিনি, মহাকাশ, গিবন, সংস্কৃতকাব্য। স্বাধীনতা আন্দোলনের জমজমাট দুটি দশক তার লেখকজীবনের সমসাময়িক। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র তো ছিলেনই-- চার্লি চ্যাপলিন, কানন দেবী, শিশির ভাদুড়ী, জওহরলাল নেহরু, উদয়শঙ্কর তাঁর কর্মময় সময়েই পূর্ণভাবে বিকশিত। লেখায় না এলেও এঁরা তাঁর চিন্তাভাবনার আকাশে নিশ্চয় দেখা দিয়েছিলেন।
দুই মহাযুদ্ধের মাঝখানের সময়ে আমাদের ভাষায় যাঁরা প্রধান প্রধান কাজ করেছেন, তাদের মনোজগতে কী কী ঘটনা এসে ধাক্কা দিয়েছে— কী কী উপাদানে তাদের চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছিল-- তার একটা আন্দাজ বা আভাস পেতে চাই বলেই এসব কথা বললাম। আরও অন্যান্য উপাদানও ছিল। সেসব আর উল্লেখ করছি না। আমি নিজেও পথ খুঁজছি। সবটা বলে দেবার মতো পাণ্ডিত্য বা দখল আমার নেই।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগের বাংলা কথাসাহিত্যে অন্নচিন্তাকে কোথাও বিভূতিভূষণের মতো এতখানি প্রধান হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। আবার সেই অন্নচিন্তার পাশাপাশি একই সঙ্গে প্রকৃতিবোধ, সৌন্দর্যবোধকেও তাঁর আগেকার লেখকদের লেখায় এতখানি প্রধান হয়ে উঠতে দেখিনি। পথের পাঁচালী’র কথা বলছি। হরিহর পুজো-আচ্চা করে, কথকতা করে কিছু আনতে পারলে তবে সর্বজয়া-অপু-দুর্গার খাবার জুটবে নয়তো ভিক্ষা, উপবাস, জ্বর-- আর তার সঙ্গে সঙ্গে ও পাশাপাশি কাশফুলেভরা মাঠের ভেতর দিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া মানুষ যা-ই করুক বা মানুষের যা-ই ঘটুক নিসর্গের তাতে কিছু যায়-আসে না-- বিভূতিভূষণের এই দেখাটাই বাংলা কথাসাহিত্যের নতুন আধুনিকতা।
একজনের মৃত্যু বা একজনের উত্থানকে যদি এই ঘটমান পৃথিবীর নিয়ত ক্রিয়াশীল কাজকর্মে— এই পৃথিবীর গঠনের পটভূমিতে এঁকে তুলতে পারি তবে তা হয়ে ওঠে শিল্প। না পারলে তা অভিনব হতে পারে কিন্তু শিল্প হয় না। ‘অপরাজিত’ উপন্যাস শেষ করার সাত -আট পৃষ্ঠা আগে থেকে বিভূতিভূষণ যেন আচমকাই এই পৃথিবী কীভাবে গড়ে উঠেছিল সেই কথা বলতে শুরু করেন। তাঁর বলার উদ্দেশ্য একটিই। তার মগ্নচৈতন্যে তিনি অনুভব করতেন ধাতু, মাটি, গাছপালা, আকাশ, বাতাস, জল দিয়ে গড়া যে পৃথিবীর ভাবনা মানুষের মাথায় আছে তার ভেতর মানবপ্রবাহ যুগ যুগ ধরে এভাবেই আসছে চলেও যাচ্ছে আবারও আসবে। এই দেখার ভঙ্গি--- এই ভাবনাই আমাদের গত ৬০-৬৫ বছরের কথাসাহিত্যের প্রধান আধুনিকতা। এর সূচনা ‘পথের পাঁচালী’তে। তা ধীরে ধীরে বিভূতিভূষণের সমগ্র রচনায় পল্লবিত হয়ে একটি বনস্পতির চেহারা পেয়েছে শেষ অবধি। এই মহাজাগতিক বোধ বিভূতিভূষণের সমসাময়িক জীবনানন্দের আকাশ জুড়েও একটি মেঘ হয়ে ভেসে আছে।
স্যাকরাদের দোকানে একদল লোক সম্ববছরে একবার আসে। তারা এসে দোকানের মেঝে ঝাঁট দিয়ে যে স্বর্ণরেণু পায় তাই নিয়ে যায়। এজন্যে তারা দোকানিকে কিছু টাকা ধরে দেয়। আমাদের জীবনের নানা রেণু ঠিক এভাবেই নানান কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে—জীবনের খাঁজে খাঁজে লেপটে থাকে। কিছুই ফেলনা নয়। বিভূতিভূষণ এই জীবনরেণুর সংগ্রাহক ছিলেন। তাঁর এই সংগ্রহ থেকেই তাঁর নিজস্ব নির্মাণ গড়ে উঠেছে।
দুই জেলার মধ্যবর্তী সীমানার একটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে তিনি অভিভূত। কী আশ্চর্য! এখানেই দুই জেলার সীমানা? এ যেন ভোরবেলার প্রথম সূর্যালোক এসে পড়ার মতোই। বা তার চেয়েও বেশি কিছু। চিরাচরিত, স্বতঃসিদ্ধের ভেতরেও তিনি বিস্মিত বোধ করতে পারতেন। এই অপার বিস্ময়বোধের সামর্থ্য তাঁকে এমন এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যা সম্ভবত তার আগের বা পরের শিল্পীদের বেলায় এতটা ঘটেনি। ফলে তিনি নতুন নতুন দিগন্তের সামনে গিয়ে হাজির হয়েছেন। একটি মাঠও তাকে বিস্মিত করত। এই বিস্ময়বোধ কখনোই তাকে পুরোনো হতে দেয়নি। বরং তিনি সময়ের আগে আগে চলেছেন।
তাঁর উপন্যাসেই প্রথম দেখি পাশটাশ করে বাঙালি যুবক অপু ব্যবসা করতে গিয়ে মার খাচ্ছে-- চাকরি খুঁজছে। বিয়ে করে ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া করছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরেকার বাঙালি জীবনের এইসব লক্ষণ তিনিই সবার আগে চিনতে পারেন। আজকের উপন্যাসশিল্পেও এই সব লক্ষণ ধারাবাহিকভাবে আমরা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে আসছি। জমিকে কেন্দ্র করে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা। তার মাথায় ভূস্বামী। ধাপে ধাপে নেমে সেই সমাজের শেষ ধাপ ভূমিহীন খেতমজুর। আবার শিল্পবিপ্লবের দরুন একেবারে উঁচুতে বড় মালিক—যার শেষ ধাপে মজুর। এই দুই ভাগের মাঝখানে গত প্রায় দেড়শো বছরে গড়ে উঠেছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত সমাজ। যারা বই পড়ে—চাকরি খোঁজে-সামাজিক নীতির কথা বলে—স্বপ্ন দেখে। ইংরেজদের সঙ্গে সবার আগে সংযোগ হওয়ায় বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের বয়স সারা দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের চেয়ে বেশি। লেখক বিভূতিভূষণ এবং আমরা যারা তার পাঠক-দুই তরফেরই শেকড় এই সমাজে নিহিত। বিভূতিভূষণ এই সমাজের লক্ষণগুলি নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে বস্তুতান্ত্রিক ঠিকই কিন্তু বস্তুর ভার তিনি বয়ে বেড়াননি। বরং বস্তুর সামান্যতা থেকে তিনি আমাদের অসামান্য কল্পনায় নিয়ে গেছেন।
‘আরণ্যক’-এর শুরুই হচ্ছে – মেসের টাকা বাকি পড়া জীবনের কথা তুলে। কিন্তু সেই শুরু যে আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যেখানে অতি সামান্যে মানুষের পরমপ্রাপ্তির স্বাদ—তা আগে বোঝাও যায়নি। সেখানে অনন্তকালের পৃথিবী। অনন্তকালের পর্বতমালা। অনন্তকালের অরণ্য। তার ভেতর একজন মানুষ অরণ্যকে আয়ুষ্মন রাখতে গাছ পুঁতে চলেছে। এমন একটি ভাবনা সর্বার্থে চিরন্তন। আবার এর চেয়ে আধুনিক কিছু হতেই পারে না। বিভূতিভূষণের এইভাবে বিষয়-অনুসন্ধান-অভিযাত্রী মনন গত পাঁচ দশকের বিভিন্ন ঔপন্যাসিককে অভিযাত্রী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনিই আমাদের ভেতর খনন করে রাস্তা খুঁজে বের করার শৈল্পিক আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে দিয়েছেন।
বিষয়-অনুসন্ধানে তার রাস্তা দেখি আজও সর্বাধুনিক। শৈশব থেকে যৌবন অব্দি আজও যেন মনে হয় বাঙালি একজন প্রকৃষ্ট অপু। আজও বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে বাঙালির সার্বিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে অপুই একমেব। সেই বাঙালি কেমন ? পলকা ভবিষ্যৎ। স্বপ্ন দেখে।
যে-কোনো মানুষকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলে আজও কিন্তু সেই মানুষের শুরুর শুরু এই দুটি লক্ষণে আক্রান্ত – বা চিহ্নিত।
বঙ্কিমচন্দ্র থেকে হালের বাংলা কথাসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের সর্বাধুনিক চরিত্রলক্ষণ সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই আজও সেই ইছামতী’ উপন্যাসেই। সেখানে সময়ই প্রধান। প্রতাপী নীলকর সাহেব আছে বটে। তার পাশাপাশি প্রতিস্পর্ধী চরিত্র সাধারণ মানুষ। আর অমর মানবধারার মতোই ঘটনাপ্রবাহের ভেতর রয়েছে বহতা ইছামতী। লৌকিক কৌলীন্যপ্রথার ভেতর রয়ে গেছে নিত্যদিনের সুখদুঃখ। ‘ইছামতী' উপন্যাসের সময়কাল এখন থেকে একশো তিরিশ বছর আগের। সেখানে মানবসম্পর্ক দেখানোর ব্যাপারে বিভূতিভূষণ যেন আজকেরই ঔপন্যাসিক।
বিভূতিভূষণ সর্বদাই একটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছেন। তা হল মানবসম্পর্ককে খুলে ধরা। মেলে ধরা। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি একটা কাহিনির পাতলা : প্রলেপ সর্বদাই বজায় রেখেছেন। কিন্তু তার ভেতর থেকে উঠে এসেছে বাবা কী? মা-ই বা কী? আয়ু কী? মৃত্যু কী? নারী কী? জন্ম কী ? ভালোবাসা কী? এই পৃথিবীই বা কী?
ধরা যাক ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’-এ যেখানে বাবাকে পাগল হিসেবে তাড়া করে বের করে দেওয়া হচ্ছে আর তাড়া-করা-ভিড়ের ভেতর সেই বাবার ছেলের যন্ত্রণা। এ যেন পাঁজরের ভেতর থেকে ফর্ক দিয়ে হৃৎপিণ্ডটিকে তুলে আনা। আলাদা করে এনে কাচের পিরিচের ওপর রাখা। মা প্রসঙ্গ : অপু কলকাতায় কলেজে পড়ে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কলকাতার ট্রেন ধরতে ফিরে গেছে। ট্রেন ফেল করে ফিরে এসে দেখে--জ্বর গায়ে মা পড়ন্ত বিকেলে পুকুরে কাঁথা কাচতে বসেছে। পেছন থেকে মা বলে ডাকল অপু! অপুর গলা শুনে বিশ্বাস হচ্ছে না মায়ের। তিনি নিচু পাড় থেকে ওপরে তাকিয়ে দেখেন—অপু।
কিংবা মায়ের মৃত্যুতে অপু যেন সারা বিশ্বের মাঝে সব পিছুটান থেকে মুক্তি পেয়ে গেল।
এই দুটি ছবি পাশাপাশি রাখছি এই কারণে—দু দিক থেকে মাকে দেখার এই দুই ছবি বাংলা কথাসাহিত্যে আর আঁকা হয়নি। প্রথম ছবিটি বিরল নয়। কিন্তু দ্বিতীয় ছবির পটভূমিতে প্রথম ছবিটি যদি ভাবি তবে বুঝব মায়ের মৃত্যুতে পিছুটান থেকে মুক্তি ভাবার ও দেখবার দৃষ্টি কী অনন্য, কী নিষ্ঠুর, অথচ সত্য এবং সর্বাধুনিক। এ যেন সাহিত্য নয়—জীবন। শুধুই জীবন। জীবনের সত্য।
আয়ুর কথাই ভাবা যাক। অনুবর্তন’-এর যদুমাস্টার মারা গিয়েছেন। তার স্ত্রী তা বুঝতে পারেননি। তিনি বড়ি দিয়েছেন। শুকোতে দিতে যাচ্ছেন। যাবার সময় গুনছেন-কতগুলো বড়ি দিয়েছেন।
এই আধুনিকতার—এই অমোঘ সত্যের পথিক হয়েছে বাংলা কথাসাহিত্য। আমাদের আগেকার কথাসাহিত্যিকেরা এই ভারতীয় বাস্তবতাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। আমার সময়ের বেশ কিছু গুণী ঔপন্যাসিক এই আধুনিক সত্যের চর্চা করেছেন। সেই চর্চা বহুক্ষেত্রে আজ সাহিত্যের ইতিহাসে ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়েছে। আমিও চেষ্টা করেছি। কতটা পেরেছি জানি না। তাকিয়ে আছি নিত্যকালের সাহিত্যিকের দিকে—আমাদের পরে যাঁরা এসে এর ভেতরেই তাদের জায়গা করে নিয়েছেন তাদের জানাই স্বাগতম। আমি বলব—এই পথের শিক্ষক, দ্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘অশনি সংকেত’-এ মতির মৃত্যু আবার ‘পথের পাঁচালী’-তে ইন্দির ঠাকরুনেরও মৃত্যু। ইছামতী’-তে দেওয়ান রাজারামের নিহত হওয়ায় আবার ‘দেবযান’-এ যতীনেরও মৃত্যু। মৃত্যুকে কতভাবে দেখা। আমরা জানি মূল ছবি থেকে ছবির কাট-আউট আরও তীক্ষ্ণ হয়। কিন্তু বিভূতিভূষণে এই সব মৃত্যু দেখে মনে হয়েছে—মৃত্যুর ছবি থেকে বের করে আনা এইসব কাট-আউট যেন তীক্ষ্ণতর মৃত্যু নয়--বরং ছাক্কা জীবন।
‘অথৈ জল’ উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার যখন সাজানো সংসার, প্রতিষ্ঠা ছেড়ে স্বৈরিণীর আকর্ষণে কলকাতা পাড়ি দেয়—তার জন্যে কুপল্লিতে গিয়ে মাসির মুখোমুখি হয়—তখন প্রশ্ন জাগবেই—ভালোবাসা কী? নারী কী? আবার ‘দেবযান’-এ যতীনের স্ত্রী আশা যখন পা ফসকায় তখনও মনে হয়— নারী কী? ভালোবাসা কী? ‘দেবযান’-এ পুষ্প যখন যতীনকে বারবার হারায়—আবার পায়--তখনো এই দুটি প্রশ্ন জাগে।
জীবনে নারী ও ভালোবাসাকে বিভূতিভূষণের এভাবে দেখাই কি গত পঞ্চাশ বছরের বাংলা কথাসাহিত্যে নারী ও ভালোবাসার প্রশ্নে পরবর্তী ঔপন্যাসিকদের ভাবায়নি? অবশ্য বিষয়টি সব লেখকই নাড়াচাড়া করেছেন। নিখাদ নারী, বর্ণময় ভালোবাসা সব শিল্পেরই বিষয়। আমরা কি এই জটিল ও মনোহারী গোলকধাঁধায় বিভূতিভূষণের সেই মায়াজাল থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পেরেছি? শুধু সময়ই এ কথার জবাব দিতে পারে।।
‘পথের পাঁচালী’তে সর্বজয়া, দুর্গা আর ইন্দিরা ঠাকরুণের চোখ দিয়ে অপুর জন্মানো দেখানো হয়েছে। নতুন শিশুর পদার্পণ বিভূতিভূষণের কলমে যেন কোনো নতুন রাজার আবির্ভাবের মতো করে আঁকা হয়েছে। এই শিশু যেনবা জীবনেরই রাজা। ইছামতী’-তেও ভবানীচরণের পুত্রের জন্ম যেনবা এক আবির্ভাব। খুবই রাজকীয়।
এই পৃথিবী কী? কিংবা—কী এই পৃথিবী? এই জিজ্ঞাসার অনুসন্ধানী বিভূতিভূষণ ফেলে যাওয়া ভিটেবাড়িতে নিশুতি রাতের জ্যোৎস্না পড়ে থাকার কথা বলেছেন। কখনো বা বলেছেন--বাবা বাড়ি করে—তার ছেলে সেখানে থাকে—তারপর তার নাতি উঠে গিয়ে আরেক জায়গায় বাড়ি করে। এইভাবে যেখানে আমরা বারবার বাস রাখি—সেটাই আমাদের পৃথিবী। বিভূতিভূষণের পৃথিবীকে দেখার এই দুটি ভাব আজকের বাংলা কথাসাহিত্যে আরও সূক্ষ্মভাবে স্থায়ী চেহারা পেয়েছে।
আমাদের হৃদয়ের অন্তর্গত কথা—আমাদের চেতন-অচেতনের শেকড় যেখানে-সেই জায়গার কথা বাঙালি কথাকার একসময় নিজেই তার লেখায় লেখকের মন্তব্য, জবানি হিসেবে গুঁজে দিতেন। তিরিশের দশকের কথাকারদের ভেতরেও এই লক্ষণ দেখা যায়। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের লেখকদের ভেতরেও এই প্রবণতা আছে।।
সংলাপের আন্তঃসংঘর্ষ যেমন, তেমনই লেখকের দেখার দৃষ্টি থেকে জাত চিন্তার ঘোরাফেরার ভেতর দিয়ে বিভূতিভূষণ এই অন্তর্গত কথাবার্তা বলেছেন। তিনি কদাচ বিবৃতিমূলক হয়েছেন। তার চিত্রল ভঙ্গিই বিবৃতি বা মন্তব্যের দিকে যায়নি। লেখার এই ভঙ্গিই আজও সমসাময়িক মনে হয়। তিনি কখনোই উঁচু গলায় কথা বলেননি। এই রাস্তা আজকের বাংলা কথাসাহিত্যের ভালো লেখকের প্রার্থিত রাস্তা।
একসময় বলা হয়েছে—তিনি তাঁর সমসময়ের রিয়ালিটি খেয়াল করেননি। তার মানে রাজনৈতিক ও অন্য উত্তাল ঘটনাবলি তার লেখায় আসেনি। আসেনি নানান বাদ-প্রতিবাদ, ক্ষোভের কথা। এটা একসময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগও ছিল। কংগ্রেসের জাতীয় আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টির উঠে আসা, বিপ্লবী সহিংস আন্দোলন কোনোকিছুই তার লেখায় আসেনি।
এই অভিযোগের জবাব সময়ই দিয়েছে। কনটেমপোরারি রিয়ালিটি বলতে তিনি বুঝতেন ইচু ফকির, রুপোকাকা, দ্রবময়ীর কাশীবাস, কিন্নরদল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিংবা ‘অনুবর্তন’ উপন্যাসে টেক্সটবুক বিক্রির সেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ক্যানভাসার।
যেসব লেখক সমসাময়িক বিপ্লব, আন্দোলন আর ঘটনাকে তাদের কনটেমপোরারি রিয়ালিটি জ্ঞানে লেখার বিষয় করেছিলেন—তারা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। নিশ্চিহ্ন তাদের সেইসব গল্প-উপন্যাস। সময়ের দূরত্বে দেখা যাচ্ছে কনটেমপোরারি রিয়ালিটি হল গিয়ে মানুষের অবস্থা—তার বুকের ভেতরের স্বপ্ন, যন্ত্রণা, আনন্দ। বিভূতিভূষণের রাস্তা আমাদের সময়ে যে যে লেখকের কাছে প্রাসঙ্গিক বোধ হয়েছে তাদের লেখা দিনকে দিন আরও সমসাময়িক হয়ে উঠেছে বলে আমার মনে হয়। ‘পথের দাবী’ ‘চার অধ্যায়’ বা ‘ঘরে বাইরের সমসাময়িক বাস্তবতা আজ বড়ই ফিকে। অপুর বোতল ধোয়ার চাকরিতে লাগা কিংবা নীলকরকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে মাথায় বোঝা নিয়ে নীলু পালের পাট খেতে নেমে পড়া অনেক বেশি সমসাময়িক অনেক বেশি বাস্তব বলে মনে হয়। একজন শিল্পীর পক্ষে সমসাময়িক বাস্তবতাকে চেনা বড়ই দুরূহ। যিনি সেই সমসাময়িককে সঠিক নির্ণয় করতে পারেন—শুধু তিনিই তার নিজের সমসাময়িক সত্যকে চিরায়ত করে তুলতে পারেন। এই দুরূহ পরীক্ষায় বিভূতিভূষণ সার্থক ভাবে উত্তীর্ণ। এজন্যে তিনিই সেই বিরল বাঙালি লেখক—যাঁর মৃত্যুর চুয়াল্লিশ বছর পরেও তার লেখার বেশির ভাগই বাঙালি পাঠকের কাছে আজও আগের মতোই সমান আদরের।
মহাকাশ থেকে চেঁকিঘর-বিজ্ঞানের আবিষ্কার থেকে উপনিষদের অতিজাগতিক চিন্তা-তিৎপল্লা লতায় ফুটে ওঠা একটি বৈকালীন ফুল থেকে মহালিখা পাহাড়ের মাথায় সূর্যাস্ত-প্রেম থেকে প্রেমহীনতায় যাতায়াত—সবই ছিল তার সময়ের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা এই স্নিগ্ধ দৈত্য-সমান শিল্পীর মানস-খেলা মাত্র। যত দিন যাচ্ছে বিভূতিভূষণের প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশি করে ফুটে উঠছে। বাঙালিয়ানায়—ভারতীয় বাস্তবতায় তাঁর জায়গা অমোঘ—অনিবার্য। যত দিন যাবে—তার শিল্প-ব্যক্তিত্বকে শুধুই লেখক হিসেবে নয়—একজন সার্বিক দ্রষ্টা হিসেবেও আমরা সানন্দে মেনে নেব। আরেকটি কথা বলতে ভুলেই গেছি। বিভূতিভূষণের সমসাময়িক বাস্তবতার সঙ্গে যে পরিমাণ স্বপ্ন আর জাদু-সম্মোহন জড়িত ছিল—যা কিনা লেখাগুলি ছাপা হওয়ার সময় অনেকেই মনে করেছিলেন, এ আবার কী? – তা কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে বহু আলোচিত বিস্ময়কর এক ম্যাজিক রিয়ালিটি—যা লেখাকে অদ্ভুত এক পথ দিয়ে লেখকের অভীষ্টের দিকে পৌঁছে দেয়। এ বিষয়েও তিনি পুরোধা লেখক।।
..........................................................................
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪, ভাষণ, সাহিত্য অকাদেমি
0 মন্তব্যসমূহ