অনুবাদ : কণিষ্ক ভট্টাচার্য
গান্সেল্ট্রাসা নামে বার্লিনের এক মেট্রো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঝকঝকে দিনের আলোয় একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, সে নেহাত যুবক নয় আবার বৃদ্ধও নয়, ধোপদুরস্ত পোশাক পরে মন দিয়ে মেঝেতে পেচ্ছাপ করছে। অসুস্থ? মাতাল? কে জানে! অন্তত তাঁকে দেখে দুটোর কোনটাই বোঝার কোনও চিহ্ন নেই। সে স্যুট, টাই আর হ্যাট পরে দাঁড়িয়ে জার্মান টাইলসের মেঝেটা ভেজাচ্ছিল। তাঁকে কেউ কিচ্ছু বলল না। লোকজন ওর পাশ দিয়ে চলে গেল, শান্তভাবে পেচ্ছাপের ছিটে এড়িয়ে। মন দিয়ে পেচ্ছাপ করার এই সময়টা এত লম্বা ছিল যে আমার আর দেখার ধৈর্য ছিল না এর পরে কোন নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হবে বা নিশ্চিত ভাবেই ওখানে পুলিশ এসে উপস্থিত হবে।
পশ্চিমের বাকি লোকদের মতো জার্মানেরাও পরস্পরকে বলে না, আইন মেনে কী করা উচিত। সেসবের জন্যে পুলিশ আছে।
কিছু জার্মান আবার আমাদের লোকজনকে পুরো অবাক করে দেয়।
যদি একজন জার্মান তার জানলা দিয়ে দেখে যে আরেক জার্মান বে-জায়গায় বেকায়দায় গাড়ি পার্ক করেছে, তাহলে সে জানলার ছোটো পাল্লাটা খুলেও তাঁকে বলবে না, ‘অ্যাই, গাড়ি রাখা নিষেধ আছে দেখছ না?’ সে উলটে পুলিশকে ফোন করবে, তার নাগরিক কর্তব্য পালন করতে।
যদি তার ওপরতলার প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে রাত আড়াইটে অবধি নাচগান হয়, একজন জার্মান সে কখনওই নিজে উঠে গিয়ে তার সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝে নেবে না, আবার সে পুলিশ ডাকবে।
আমাদের দেশে এই ধরণের আচরণ অন্যের সম্পর্কে নালিশের মধ্যে পড়ে। আমাদের লোকজন হয় এটা সহ্য করে অথবা পরচর্চা করে এই নিয়ে। কিন্তু তারা অন্যের সম্বন্ধে অভিযোগ করে না। বিশেষত নালিশ ব্যাপারটাও বোকা বোকা।
আমাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রটাও অস্বাভাবিক শক্তিশালী নীতিমূলক ভাবনায় ভরা। সবাই সকলকে অক্লান্ত ভাবে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। (‘অ্যাই, তুমি কি বাড়ির মেঝেতেও এমন ভাবে কাগজ ছুঁড়ে নোংরা করো?’) এই স্থায়ী শিক্ষাপ্রণালী যেটা সকলের মধ্যে এসেছে – লাইনের মাসিমার থেকে টেলিভিশনের লেখক – কারোরই মূলত কোনও প্রকৃত লক্ষ্য নেই। এই নির্দেশ জ্ঞান দেওয়ার জন্যে দেওয়া হয়নি, এমনকি সংশোধনের জন্যেও নয়। সম্ভবত ঠিক তাঁর উল্টোটাই। বলা হয়েছে নিজের জন্যেই, কারণ সেখানে কোনও ছাত্র নেই কেবলই শিক্ষক।
আমার এক এস্তোনিয়ান বন্ধু আমার কাছে স্বীকার করেছিল যে, সেই মেয়েটি প্রথমবার মস্কোতে এসে মস্কোবাসীদের দ্বারা কেমন হেনস্থা হয়েছিল; মস্কোবাসীদের অন্যের বাচ্চার প্র্যামের দিকে কুটিল দৃষ্টিতে, এমনকি ঢিলেঢালা মাকে তারা তর্জনগর্জন করতেও ছাড়ে না। ‘তুমি ওকে অভাবে মুড়ে রেখেছ কেন? ওরম রাখে নাকি!’
সাধারণ নীতিশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা আসলে আপাতদৃষ্টিতে সভ্যভাবে আগ্রাসন আর হিংস্রতার প্রকাশ যেটা ব্যক্তিগত আর সামাজিক পরিবেশকে ভারী করে তোলে।
যত কঠোর ভাবে সম্পূর্ণ আক্রমণটা করা হয় তাতে যতটা আবেগ আর আশা থাকে, আমরা দেখি সেটা শান্ত ভাবে নানা জায়গায় ভেঙে পড়েছে। যাতে সেগুলো একেকটা আঞ্চলিক ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হয়।
আমার এক বন্ধু তরজোকের কাছে একটা ছোটো শহরে বেড়াতে বেরিয়ে তাঁর ওখানে চেনাশোনা কাউকে ফোন করতে একটা ফোন বুথে গিয়েছিল। নম্বরটা অনেকক্ষণ ধরে ব্যস্ত ছিল বলে ও চেষ্টা করে যাচ্ছিল, এর মধ্যে ও খেয়াল করে যে সেই টেলিফোন বুথটা একদল কমবয়সী ছেলে ঘিরে ফেলেছে। নিঃসন্দেহে তাদের একটা নির্দিষ্ট ধরন ছিল, সোয়েটের স্যুট পরা, মুখে সিগারেট। তারা ওর দিকে এমন করে তাকিয়ে ছিল সেটাকে ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ বলা কঠিন। ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকে ও জানে এমন একটা পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা নিজের হাতে নিতে কথা শুরু করা উচিত, বলার স্বরে আর মুখের ভাবে একটা সদিচ্ছা আর নির্ভাবনার ভাব এনে কেবল কথা শুরুর করার জন্যেই সে জিজ্ঞেস করে, ‘ছেলেরা কটা বাজে বলতে পারো?’
‘তোমার কি ঠিক টাইম চাই নাকি কাছাকাছি?’ ওদের সর্দার মতো ছেলেটি শান্ত হাড়হিম করা গলায় বলে।
‘কাছাকাছি হলেই চলবে।’ এমন পরিস্থিতি ছিল যে আমার বন্ধুর প্রসন্নতার ভাব দেখানো ছাড়া উপায় ছিল না।
‘অন্ধকার হয়ে আসছে।’ একঘেয়ে গলায় বলে ওদের চিফ। তারপরেই বাচ্চাদের মতো হেসে ফেলে। এক কথায়, গোটাটা ঠিকঠাক ভাবে মেটে।
অথবা ধরুন শহরতলির লোকাল ট্রেন। অর্ধেক কামরা গাজোয়ারি করে যারা ভরে রাখে তাদের মুখ স্পষ্টত অপরাধীদের মতো। স্বাভাবিক ভাবেই সব দিকে খিস্তিখাস্তা চলছে। আর লোকজন ওই একই রকম স্বাভাবিক মুখ করে চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ করে কোত্থেকে যেন এক বুড়ি থুত্থুরি মহিলা বেরিয়ে এলেন যিনি এটা মেনে নেবেন না।
‘অ্যাই ছেলেরা,’ মহিলা চিৎকার করেন অবাক করা পাইয়োনিয়ারের তীক্ষ্ণ গলায়, ‘এখানে বাচ্চারা আছে! তোমরা এমন অসভ্য ভাষায় কথা বলছ কী করে?’ আর কী শব্দচয়ন, ‘অসভ্য ভাষায়’ ... গাড়িটা একেবারে থেমেই গেছে, চোখ প্রায় বন্ধ, মিনিটখানেক আগে ঠিক কী হয়েছে তা দেখতে নয় বরং সেই বোমারু পাইলটের মতো অস্বাভাবিক সাহসী বৃদ্ধা মহিলাকে দেখতে। কিন্তু ঘটল পুরো ভিন্ন ঘটনা। ওদের দলের একজন খুব আপত্তিকর ভাবে মহিলার দিকে ফিরে খুব আন্তরিক গলায় অপরাধীর অশ্রু এনে বলে, ‘বুড়িমা, আমাদের ওপর রাগ কোরো না, ঠিক আছে? এই যে আমার ভাইয়েদের তুমি দেখছ ওরা এমনিতেই তেতে আছে। আমরা ভিসৎস্কির কবরের কারাগারের বন্দীদশা থেকে চলেছি।’
একজন তো প্রায় কেঁদেই ফেলছিল।
আরেকটা খুশির ঘটনা। অনেক দিন আগের, এটাও কিন্তু লোকাল ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত। আমি কোথা থেকে যেন বাড়ি ফিরছিলাম যথারীতি শেষ ট্রেনে। তখন ওই কামরায় আমি একাই ছিলাম। একটা স্টেশনে এক মোটা, মাতাল, ভয়ানক লোক কামরায় ঢুকল, তার চেহারা প্রায় একটা ট্যাঙ্কের মতো, গায়ের জামাটা নাভির কাছে ছেঁড়া, মুখে বেদম পেটানি খাওয়ার ক্ষত। সব দিকে চেয়ে দেখে আমার পাশেই বসল। আমাকে একটা আদ্ধেক গলা জড়িয়ে বিশ্বাসযোগ্য গলায় বলল, ‘শোনো বন্ধু! তোমার কী মনে হয় এখানে আমার কাকে খুন করা উচিৎ?’ একটা প্রশ্ন, মনে রাখতে হবে, এই পরিস্থিতিতে খুবই আগ্রহের।
আমার সত্যি মনে নেই আমি ওকে কী বলেছিলাম। সম্ভবত আমি ওকে কিছুই বলিনি। হয়তো আমি গানও করেছিলাম। খুবই সম্ভব যে যে সেটা একটা ঘুমপাড়ানি গান, আর তাতে আমার নারকীয় সহযাত্রী শিগগিরি কার্টুনের দৈত্যের মতো নাক ডাকতে শুরু করল। আমি উঠে প্ল্যাটফর্মে বেরিয়ে গেলাম আর যেটাকে এড়িয়ে এলাম সেটাকে একেবারেই প্রশংসা করতে পারলাম না। জনশূন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি বুঝতে চাইছিলাম যে শিল্প ব্যাপারটা ঠিক কীসের সঙ্গে যুক্ত : সেটা কি শয়তানের সঙ্গে একটা খোলাখুলি দ্বন্দ্বযুদ্ধ, অথবা পুলক, বা ঘুম, শিল্পীর ভঙ্গুর কাঁধে জোর করে প্রবল কিন্তু শক্তিহীন নাক ডাকানো সেটা?
এটাও একটা আগ্রহের ব্যাপার বটে।
0 মন্তব্যসমূহ