বাংলা কথাসাহিত্যে এক ভিন্ন ধারার ঔপন্যাসিক রমাপদ চৌধুরী। রূপ থেকে রূপান্তরে, স্বর থেকে স্বরান্তরে যাত্রা করতে তিনি ভালোবাসেন। তাঁর একটি উপন্যাসকে অন্য উপন্যাসের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যায় না। ফর্ম নয় কন্টেন্ট নিয়েই তিনি উপন্যাসের ভূগোল সাজান।
ছোটবেলা থেকেই পাঠক হিসেবে তিনি ছিলেন অনবদ্য। ‘আনন্দবাজারে’ ‘বারো ঘোড়ার গল্প’ নিয়ে শুরু হয়েছিল এক অনন্ত যাত্রা। বারবার তিনি বলেছেন – আমি নিজের জন্য লিখি। গল্পহীন গল্প বলতে ভালোবাসেন। নিজের ভুল নিজেই আবিষ্কার করতে পারেন। এজন্যই পাঠক বা সমালোচকের প্রিয় উপন্যাসের সঙ্গে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব মেলে না। আবার কোথাও বলেন-“ হে সমালোচক, তুমি আমার ত্রুটি কতটুকু দেখতে পাও, আমার লেখার সব ত্রুটি আমার চোখে স্পষ্ট। তুমি তো গতানু-গতিকের মধ্যে বাধাঁ পড়ে আছো,তুমি কষ্টিপাথর হাতে নিয়ে সোনা যাচাই করতে চাও, আমি যদি রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে আসি, তুমি চিনতে পারবে না।“ ( প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রিয়া বুক হাউস, প্রথম প্রকাশ ২০১৭, পৃ. ২৯ )। তাঁর উপন্যাসের সমাপ্তিগুলি এবার আমরা দেখে নিতে পারি।
ছোটবেলা থেকেই পাঠক হিসেবে তিনি ছিলেন অনবদ্য। ‘আনন্দবাজারে’ ‘বারো ঘোড়ার গল্প’ নিয়ে শুরু হয়েছিল এক অনন্ত যাত্রা। বারবার তিনি বলেছেন – আমি নিজের জন্য লিখি। গল্পহীন গল্প বলতে ভালোবাসেন। নিজের ভুল নিজেই আবিষ্কার করতে পারেন। এজন্যই পাঠক বা সমালোচকের প্রিয় উপন্যাসের সঙ্গে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব মেলে না। আবার কোথাও বলেন-“ হে সমালোচক, তুমি আমার ত্রুটি কতটুকু দেখতে পাও, আমার লেখার সব ত্রুটি আমার চোখে স্পষ্ট। তুমি তো গতানু-গতিকের মধ্যে বাধাঁ পড়ে আছো,তুমি কষ্টিপাথর হাতে নিয়ে সোনা যাচাই করতে চাও, আমি যদি রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে আসি, তুমি চিনতে পারবে না।“ ( প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রিয়া বুক হাউস, প্রথম প্রকাশ ২০১৭, পৃ. ২৯ )। তাঁর উপন্যাসের সমাপ্তিগুলি এবার আমরা দেখে নিতে পারি।
রমাপদ চৌধুরী’র প্রথম উপন্যাস ‘প্রথম প্রহর’( ১৩৬১)। প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা হয় এ উপন্যাস। ইতিমধ্যেই গল্পকার হিসেবে খ্যাতি মিলেছে কিন্তু উপন্যাস লেখেন নি। সে সুযোগ করে দিলেন ডি. এম. লাইব্রেরী’র গোপালদাস মজুমদার। অগ্রিম টাকা দিয়ে আহ্বান করলেন উপন্যাস লেখার। লেখক চিন্তামগ্ন কী নিয়ে উপন্যাস লিখবেন। বেছে নিলেন নিজের শৈশবের শহর খড়গপুরকে কেন্দ্র করে রেল পত্তনের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের এই পর্বকে। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে তুলসী দাসের দোহা দিয়ে। মানুষের জীবনকে যদি চারটি পর্বে ভাগ করা যায় তবে প্রথম পর্ব নিশ্চয়ই শৈশব। এই শৈশবের স্মৃতিচারণা, আত্মকথা ও পরাধীন ভারতবর্ষে খড়গপুরে রেল পত্তন, ঔপনিবেশিক শাসন ও অত্যাচারকে সামনে রেখেই গড়ে তুললেন প্রথম উপন্যাস। দীর্ঘদিন কেটে গেছে। লেখকও শৈশব অতিক্রম করে চলে এসেছেন কোলকাতায়। আজ স্মৃতিচারণায় ফিরে গেছেন শৈশবে। তিমু নামে একটি চরিত্রের আত্মকথনের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৮ টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। ১৮টি পরিচ্ছেদের পরও লেখক ‘শেষকথা’ একটি পরিচ্ছেদ লিখেছেন। আসলে লেখক কাহিনির অন্তিমে পৌঁছতে চেয়েছেন। কিন্তু সে কাহিনির যে শেষ নেই। তবে লেখককে তো থামতেই হবে তাই ‘শেষকথা’ লেখেন। মধ্যজীবনে এসে শৈশবের নানা কথা মনেপড়ে আবার বহুকথা ভুলেও গিয়েছেন। একদিন ট্রেনে করে ফিরছিলেন নিজের শৈশবের ভূমির উপর দিয়ে। ট্রেনে দেখা একটি মহিলার সঙ্গে, এখানে তিনি আর মহিলার নাম উল্লেখ করেন নি। কিন্তু কাহিনি থেকে জানতে পারি এ মহিলা পান্না। যে লেখকের সমস্ত রচনা পড়ে। পান্না লেখককে বারবার প্রশ্ন করেছেন তাদের নিয়ে কোন লেখা কেন লেখেন না লেখক। তিনি আত্মকথনে সে উত্তরই দিয়ে গেলেন।কলকাতায় আসার পর আর ফিরে যাওয়া হয় নি শৈশবের শহরে।জীবনের প্রথম উপন্যাস মাতৃভূমিকে নিয়ে লিখে তিনি যেন জন্মঋণ শোধ করলেন। পান্নার মুখেই শুনেছেন শৈশবের শহর কিভাবে বদলে গেছে। তেমনি ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের চিত্র এঁকেছেন। এ উপন্যাস শুধু লেখকের শৈশবের ইতিবৃত্তই নয় এক সামাজিক ইতিহাসের দলিল। জন্মভূমিতে ফিরে না যাওয়ার আত্মযন্ত্রণাই যেন লেখককে দিয়ে উপন্যাস লিখিয়ে নিয়েছে। উপন্যাস শেষ হয়েছে পান্নার চিঠিতে। কথক কথা দিলেও পান্নার বাড়িতে আর যাননি। অথচ পান্না প্রতি শনিবারই অপেক্ষা করে থাকে তিমু আসবে। সেই তিমু যে আজকের প্রতিষ্ঠিত লেখক রমাপদ চৌধুরী তা পান্না জানে তবুও শৈশবের সঙ্গীর প্রতি একান্ত অনুরোধ। তা থেকেও বড় পান্না আজ লেখকের অন্যতম পাঠক। সে জানে চিঠি আসবে না, তবুও অপেক্ষা, এই অপেক্ষাতেই উপন্যাসের শেষ- “ আসবে কথা দিয়েছিলে। কত শনিবারের বিকেল তো অপেক্ষা করে কেটে গেল। আসবে না একদিন ? সত্যি, কত কথা ছিল তোমার সঙ্গে। এসো না একদিন। আসবে ?” ( উপন্যাস সমগ্র ২, আনন্দ, প্রথম সংস্করণ- ১৩৯৫, পৃ. ১৫৪ )
‘স্বজন’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘শারদীয় দেশ’ পত্রিকায় ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে। লেখক নিজেই জানিয়েছেন এ উপন্যাস বহুকাল আগেই লেখা প্রয়োজন ছিল।এ উপন্যাসে সমাজবাস্তবতার উপর জোড় দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাঁচি, হাজারিবাগ ও পালামৌ অঞ্চলে অনেক বন্দিশিবির ছিল। সেখানে বহু ইতালীয়দের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাদের দুর্দশাকে লেখক দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই বহু আগেই তিনি লিখেছিলেন ‘ভারতবর্ষ’ গল্প। এক ধূতি পাঞ্জাবী পড়া ইতালীয় যুবকে দেখে লেখকের মনে সহানুভূতি জেগেছিল। বঞ্চিত অসহায় মানুষের প্রতিনিধি বলে মনে হয়েছিল। বাঙালি পোশাক দেখে স্বজন বলে মনে হয়েছিল। যুদ্ধ পরিস্তিতি, সৈনিকদের যাতায়াত, অত্যাচার, বন্দিশিবির, মানুষের অসহায়তা নিয়েই গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস। লেখকের চোখে দেখা এক বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়েই এ আখ্যান। কিন্তু ভবিষ্যতের পাঠক যেন নিছকই কল্পনা না ভাবেন সে জন্য উপন্যাসের শেষে ফুটনোটে লেখেন –“ এই উপন্যাসে বর্ণিত সমকালে, যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, পালামৌয়ের বারোয়াড়ি স্টেশনে ধূতি- পাঞ্জাবি পরা বাঙালীর বেশে একজন পলাতক ইটালিয়ান যুদ্ধবন্দীকে ধরা পড়তে দেখেছিলাম। অপ্রকৃত চরিত্র ও কাহিনীর এই উপন্যাসের মূল সূত্র সেটুকুই।“ ( তদেব, পৃ. ৪০১ ) উপন্যাসটি সমাপ্ত হয়েছে দশম পরিচ্ছেদে। মানুষ কিভাবে মানুষকে রক্ষা করে এ উপন্যাসে সে কাহিনি ফুটে ওঠে। ইতালীয় যুবককে লেখকের মনে হয়েছিল স্বজন- তাই স্বজনকে স্বজনভূমিতে পাঠানোর মধ্য দিয়েই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে। চিরকালীন ধরে চলে আসা সংস্কার ধর্মের উর্ধ্বেও যে মানবতা তা লেখক দেখিয়েছেন। ইতালীয় যুবক রোবের্তোকে আজ বাঁচিয়েছে নীপা, অনুপম ও ইন্দ্র ডাক্তার। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোবার্তোকে পৌঁছে দিয়েছে বুরাণ্ডিতে। সেখানে থেকে ভুরকুণ্ডা হয়ে নিজের দেশে চলে যাবে।রেবোর্তোকে বাঁচানোর এই দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্য দিয়েই উপন্যাসের সমাপ্তি। তাঁকে বাঁচাতে হিন্দু নারী নীপা সমস্ত সংস্কার ধর্ম বিসর্জন দিয়েছে। নীপার মাতা চারুবালা সংস্কারমনা মানুষ হলেও নীপার সিঁদুর পড়ে যাওয়াতে আপত্তি করেনি। যদিও সে সিঁদুরের বদলে পড়েছিল আবীর। আজ স্ত্রী হিসেবে অভিনয় সেজে রোবার্তোকে নীপারা পৌঁছে দিয়েছে বুরাণ্ডিতে। রোবার্তো’র প্রতি ভালোবাসা আছে কিন্তু কখনই তাকে প্রেমিক হিসেবে মেনে নেয় নি নীপা। তবে সমস্ত সত্তার উর্ধ্বে লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন মানবতাকে। ভিন্নদেশের মানুষের পাশে আজ নিজেদের জীবন ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছে নীপা, অনুপমরা। আর লেখক যদি হন রমাপদ চৌধুরী তাঁর উপন্যাসের শেষ যে মানুষের উত্তরণেই হবে একথা বলাই বিধেয়।
‘বনপলাশির পদাবলী’ ( ৭ ই অক্টোবর ১৯৬১ থেকে ৩০ শে জুন ১৯৬২ ) সাপ্তাহিক ‘দেশ’ এ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ র জুনে। উপন্যাস লেখার আগেই এ উপন্যাসের নামকরণ করা হয়েছিল। লেখক প্রথমে ‘পলাশবনির পদাবলী’ নাম দিলেও পরে দেন ‘বনপলাশির পদাবলী’। এ উপন্যাস লেখার একটি ইতিহাস আছে। ‘দেশ’ এ ধারাবাহিক উপন্যাস হঠাৎ ই একজন শেষ করে দেন। ফলে পরের কিস্তি থেকে উপন্যাস শূন্য।সাগরময় ঘোষ নির্দেশ দিলেন রমাপদ চৌধুরীকে আগামী সংখ্যা থেকেই ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে হবে, নামটা এক্ষুণি বলে যান বিজ্ঞাপন দিতে হবে। লেখক নিজেই জানিয়েছেন আগে কখনও গ্রামে যান নি, গ্রাম দেখেন নি।ফলে একটি কল্পনার গ্রাম নিজের মনের মধ্যেই গড়ে তোলেন। আবার কখনো লেখেন-“ এখন মনে হয় আমি বনপলাশি গ্রামটিকে উপন্যাসের বিষয় হিসেবে বেছে নেইনি, বনপলাশি গ্রামই যেন আমাকে তার লেখক হিসেবে বেছে নিয়েছিল।“ ( উপন্যাস সমগ্র-৪, আনন্দ, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৩, পৃ. ৫৯১ )। তবে পত্রিকায় প্রকাশকালে এ উপন্যাস সম্পর্কে তেমন কোন সাড়া পান নি। ফলে আমরা পেয়েছি একটি অন্যধারার সম্পূর্ণ নতুন উপন্যাস। গ্রামজীবনের পরিবর্তনের চিত্রকে লেখক নতুন ও পুরাতন কালের পটভূমিকায় রেখে কাহিনি বিন্যাস করেছেন। গ্রাম ও শহরের যাবতীয় ধারণাকে তিনি ভেঙে দিয়েছেন। প্রথাবদ্ধ জীবনের মধ্যেও যে মহানুভবতা তা দেখিয়েছেন। লৌকিক জীবনের পদাবলি রচনা করতে চেয়েছেন। ভেবেছিলেন গ্রাম্যজীবনের পটভূমিকায় প্রথাগত উপন্যাস লিখবেন। কিন্তু লেখক যদি হন রমাপদ চৌধুরী পাঠক যে ভিন্ন স্বাদের আখ্যান পাবেন তা অনুমান করা বিধেয়। লেখকের সমস্ত ধারণাই ভেঙে যায় বনপলাশিতে পা দিতেই। তাই উপন্যাস লেখার পরও মনে হয়েছে সে জীবনকে তাঁর জানা হয় নি, জানা সম্ভবও নয়। বনপলাশি যেন লেখকের কাছে অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে। উপন্যাসের ভূমিকা অংশটি আমরা প্রথমেই দেখে নিতে পার-
“ এমন হবে আগে ভাবিনি। ধারণা ছিল, উপন্যাস লিখব। সেই উপন্যাস – চিরকাল যা জেনে এসেছি, যা লিখতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বনপলাশিতে পা দেওয়ামাত্র জানা গেল, তা অসম্ভব। ছেঁটেকেটে বনপলাশিতে পা দেওয়ামাত্র জানা গেল, তা অসম্ভব।ছেঁটেকেটে বনপলাশিকে বৃত্তের পরিধিতে হয়তো ধরা যায়, কিন্তু তখন আর সেই মানুষ ও মৃত্তিকার উদ্বেলিত নিসর্গ থাকে না, তা সাজানো বাগানে পরিণত হয় মাত্র। অথচ আমার স্থির বিশ্বাস, বনপলাশি তা নয়,- জীবনের মতই যতি আছে হয়তো সেখানে, কিন্তু বিরতি- সে কখনও নয়।
বনপলাশি তাই শাস্ত্রীয় উপন্যাস না হয়ে শেষ পর্যন্ত লৌকিক জীবনের অনন্ত রহস্য নিয়ে – বনপলাশির পদাবলীই রয়ে গেল।“ ( তদেব, পৃ. ৯)
উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে ঊনচল্লিশ তম পরিচ্ছেদে। গিরিজাপ্রসাদের গ্রাম সম্পর্কে যাবতীয় ধারণা পাল্টে গেছে গ্রামে পা দিতেই। কন্যার বিবাহ নিয়ে মোহনপুরের বৌউ এর কাছে পরাজিত হয়েছে গিরিজাপ্রসাদ ও নিভাননীরা। সমস্ত প্রচলিত ধারণা ভেঙে যাওয়ায় এক অসুস্থ অস্বভাবিক মন নিয়ে আজ গিরিজাপ্রসাদ চলেছে শহরে। তাঁর মনে হয়েছিল গ্রাম্যজীবনের বুঝি সব পাল্টে গেছে। রীতি-নীতি, লোকাচার, পরিবর্তনের স্রোতে গ্রাম্য সমাজের বিবর্তন এলেও গ্রামের মানুষ পাল্টোয় নি। আজ এক অপরাধী মন নিয়ে গিরিজাপ্রসাদ ফিরে যাচ্ছে। তাঁর শহর থেকে গ্রামে আসার মধ্য দিয়েই কাহিনির জটিলতা শুরু হয়েছিল আজ তাঁর শহরে চলে যাওয়ার মধ্যেই কাহিনির সমাপ্তি ঘটেছে। গ্রাম বদলায় নি, গিরিজাপ্রসাদ নিজেই বদলে গেছে, মধ্যবিত্তের টানে সমস্ত আদর্শ সে কোথায় যেন নিজেই বিসর্জন দিয়েছে। আজ গ্রাম এসেছে তাঁকে বিদায় জানাতে। তাঁর গ্রামে আসার সংবাদ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে যে উৎসাহ ছিল তা আজ আর নেই তবে অভিমানও নেই। অট্টমা এসেছে তেঁতুল নিয়ে, সে ও টিয়া শেষ বাঁক পর্যন্ত এগিয়ে গেছে বিদায় দিতে। উদাস পৌঁছে দিচ্ছে আজ তাঁকে শহরে। গিরিজাপ্রসাদের মনে উঁকি দিয়েছে গ্রামের স্মৃতি। সমস্ত বদলে সে চলেছে শহরে, যাকে লেখক চিহ্নিত করেছেন ‘সময়ের রাজ্য’ বলে।
এখনই’ উপন্যাসটি ‘দেশ’ পত্রিকায় ( ৭ ই ডিসেম্বর ১৯৬৮ থেকে ২২ শে মার্চ ১৯৬৯ ) প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। এ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল শারদীয় আনন্দবাজারে। কিন্তু সে বছর প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘটের জন্য শারদীয় আনন্দবাজার প্রকাশিত হয় নি। সাগরময় ঘোষ টেলিফোন করে এ উপন্যাস নিয়েছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপার জন্য। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এ উপন্যাস রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয়। প্রবীণ সাহিত্যিকরা ( তারাশঙ্কর, অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র মিত্র ) এর প্রশংসা করেছিল- যা লেখকের কাছে ছিল অত্যন্ত বিস্ময়ের। ‘প্রথম প্রহর’, ‘লালবাঈ’, ‘বনপলাশির পদাবলী’র লেখক ‘এখনই’ উপন্যাসে এসে কোথায় যেন পাল্টে গেলেন। কলেজ পড়া তরুণ- তরুণীর জীবনের আশা- আকাঙ্ক্ষা, জীবনস্বপ্ন নিয়ে লিখে ফেললেন এ উপন্যাস। উৎসর্গপত্রে লিখলেন-‘যুবকদিনের স্বপ্ন আশা আদর্শকে’। তবে লেখক এ উপন্যাসকে গুরুত্ব দেন নি। আসলে আত্মতুষ্টিতে ভোগা মানুষ তিনি নন। রমাপদ চৌধুরী মানেই নতুন লেখা, লেখার ফর্ম তিনি বারেবারে পরিবর্তন করেন। লেখকের মনে হয়েছে এটি একটি ‘প্রেম-অপ্রেমের গল্প’, যা যুবক-যুবতীর আশা- আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-ভালোবাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। লেখকের সময়ের কলেজ জীবন আর ১৯৬৭-৬৮ এর কলেজ জীবনে বিরাট পার্থক্য ঘটে গেছে। সেই পরিবর্তনের ইঙ্গিত তিনি ধরতে চেয়েছেন নরনারীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। টিকলু, অরুণ, রুণু, উর্মি সবাই যুবক যুবতী। এঁদের জীবন যেন ‘ফালতু’ নামক রোগে আক্রান্ত। বেকার সমস্যা, নতুন চাকরি, বেতন, প্রেম-প্রেমহীনতা সমস্তই যেন এঁদের কাছে নঞর্থক। বেকার অরুণের মনে হয়েছিল চাকরি পেলে ভালো হবে, আবার চাকরি পেয়ে বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়- মধ্যবিত্তের নানা সমস্যাকে লেখক দেখিয়েছেন। অরুণ ভালোবাসে রুণুকে। অরুণের যেমন মেয়ে বান্ধবী উর্মি, নন্দিনী আছে তেমনি রুণুরও ছেলে বন্ধু অয়ন আছে। দুজনই দুজনকে দেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে। কেউ ভালোবাসায় ভাগ বসাতে চায় না। অরুণের মনে হয়েছে রুণু হয়ত অয়নের হাত ধরে চলে যাবে। এই প্রেম- প্রেমহীনতা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে ইয়ারকি, ভৎসনা আছে। রুণুকে পরিপূর্ণ ভাবে না পেয়ে অরুণের মনে হয়েছিল- “ চোখ ঠেলে জল আসা কান্নায় ও প্রার্থনা করলে, রুণু তোমাকে আমি সমগ্রভাবে চাই না। আমাকে ঈর্ষা নিয়ে, টুকরো টুকরো সুখ নিয়ে, তোমার ভালোবাসার একটুখানি অংশ নিয়ে আমাকে বাঁচাতে দাও। আমি অয়নকে সহ্য করব, দিব্যকে সহ্য করব, সহ্য করতে করতে জ্বলব আর জ্বলব, তুমি আমাকে একটু সহ্য করো।“ ( উপন্যাস সমগ্র-৩, আনন্দ, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৩, পৃ. ১৩৯ )। অরুণের মনে হয়েছে তাঁরা যেন আগাছা। শুধু বৃক্ষ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে, বৃক্ষে বৃক্ষে মিলনসেতু গড়ে তুলে বনভূমি হতে পারে নি। যুবক সমাজের যে অন্তঃসারশূন্য জীবন লেখক সেখানে নজর দিয়েছেন। এখানে সময়পর্বও একটি বিশেষ বিষয়। রুণুকে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে অরুণ বাড়িতে বসে আছে। আজ ফিরে এসেছে রুণু। সমস্ত জেনেও আজ তারা মিলতে চেয়েছে। কিন্তু যেখানে মনের ব্যবধান বড় হয়ে যায় সেখানে মিলতে চাইলেও মিলন হয় না, সম্ভব নয়।দুজনেই মুখোমুখি, কিন্তু নীরব। আর এই দৃশ্যকে লেখক মিলিয়ে দেন বন ও বনভূমির সঙ্গে। সমাপ্তিতে এ উপন্যাস একটা গভীর ব্যাপ্তি পায়। আধুনিক প্রজন্মের মনন উপযোগী এক বিশেষ সময় চিহ্নিত অথচ চিরকালীন উপন্যাস উপহার দেন-
“বনের মধ্যে দুটি নিঃসঙ্গ গাছের মত ওরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। পাশাপাশি, কাছাকাছি। কিন্তু কেউ কোন কথা বলবে না, বলতে পারবে না। কেউ কারও ভাষা বুঝবে না। ওরা শুধু নিজের সঙ্গে কথা বলবে। সুখে দুঃখে ব্যথায় বঞ্চনায়। কখনও হয়তো একজনের শিকড় আরেকজনের শিকড় ছোঁবে।
বনের মধ্যে অনেক গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ, নিঃশব্দ। ঝড় উঠলে মনে হয় তারা কথা বলছে। শুধু কথা। ‘কোজি নুকে’র হট্টগোলের মত শুধুই আওয়াজ। কান পেতে শুনলে একটা কথাও বোঝা যায় না । ( তদেব, পৃ. ১৪০ )
‘খারিজ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘শারদীয় দেশ’ পত্রিকায় ১৩৮১ বঙ্গাব্দে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রকাশের পরই এ উপন্যাস বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দুমাসের মধ্যেই দুই হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। বাংলা উপন্যাসকে আধুনিক থেকে আধুনিকতর ক্ষেত্রে তিনি নিয়ে এলেন এ উপন্যাসের মাধ্যমে। মধ্যবিত্তের অসহায় জীবন ষন্ত্রণার আখ্যান এ উপন্যাস। লেখক ব্যক্তি চরিত্র অপেক্ষা শ্রেণি চরিত্রকেই বেশি প্রাধান্য দেন। তবে জনজীবন নয় সেই শ্রেণি চরিত্র ফুটে ওঠে একটি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই। পালন সেই মধ্যবিত্ত দরিদ্র বালক শ্রেণির প্রতিনিধি, যার নিজেরেই পড়ার কথা অথচ দারিদ্র্যতার কারণে সেই অপরের বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যায়। তাই লেখক উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে গভীর স্নেহবশত লেখেন –“ পালান / তোরা যেদিন পড়তে শিখবি / সেদিনের আশায়”। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে সপ্তম পরিচ্ছেদে। দরিদ্র মধ্যবিত্তের পতন কিভাবে ঘটে তা তিনি দেখিয়েছেন। মধ্যবিত্তের লড়াইয়ের জন্য কেউ নেই। পালানের মতো দরিদ্র কিশোরা কিভাবে হারিয়ে যায় তা তিনি দেখিয়েছেন। পালানের মৃত্যু উপলক্ষে আদালতে আজ উপস্থিত হয়েছে অদিতি, জয়দ্বীপ ও রাধানাথ বাবু। সবার সাক্ষী শুনে জজ সাহেবের মনে হয় – “ ইট ওয়াজ এ কেস অফ প্লেন অ্যান্ড সিম্পল্ অ্যাকসিডেন্ট। অ্যান্ড হেন্স দি কেস ইজ ক্লোজ্ড্ ।“ ( উপন্যাস সমগ্র-১, সপ্তর্ষি প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃ. ৬৬ )আজ জয়ী হয়েছে অদিতি, জয়দ্বীপরা, নিজেরা যে দোষী নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এক অপরাধপ্রবণ মন নিয়ে ফিরেছে জয়দ্বীপ। তাঁর কানে বেজে চলেছে জজ সাহেবের সেই ঘোষণা। শুধু লজ্জিত নয়, অন্তরে ক্ষত-বিক্ষত। সেই আত্মঅনুশোচনাতেই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে।
‘বীজ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ১৩৮৪ বঙ্গাব্দে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে। মানুষের শিকড়ের সন্ধানে অগ্রসর হয়েছেন লেখক এ উপন্যাসে। শিকড় থেকে বিচ্যুত মধ্যবিত্তের যে ফাঁকা আত্মঅহংকার তা যে নিছকই মূল্যহীন তা লেখক দেখিয়েছেন। ঘটনার পরম্পরা নয় কতগুলি এলোমেলো ঘটনাকে নিয়ে সাজিয়ে উপন্যাসের কাঠামো গড়ে তুলেছেন। আজ আর উপন্যাসে নিছক বর্ণনায় প্রয়োজন নেই, এজন্যইতিনি এই ‘মিশ্ররীতি’ গ্রহণ করেছেন। লেখকের অত্যন্ত প্রিয় এ উপন্যাস। আত্মকথায় জানান- “এ উপন্যাস লিখে মনে হয়েছিল, কার জন্যেলিখছি, কাদের জন্যে ? এখন ভাবছি যা কিছু লিখেছি, যতগুলিউপন্যাস, তার মধ্যে এই ‘বীজ’ লিখতে পারার জন্য আমি গর্বিত।“ ( তদেব, পৃ. ৪৩৭) আদর্শবাদ বা নীতিকথা নয় তিনি আসলে লিখতে চেয়েছেন মানুষের পরাজয়ের গল্প। এই সমাজে শশাঙ্কশেখরের মতোমানুষ কিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে- সেই আখ্যান এ উপন্যাস। সমাজের সর্বস্থরে আজ পঙ্কিলতা, সেখানে আদর্শবাদ নিছকই একটি উপমা কিন্তু লেখক জানেন সেই শিকড় সন্ধান ছাড়া মধ্যবিত্তের অন্য কোন গোত্রান্তর নেই- লেখক সে কাহিনি শোনাতে চেয়েছেন। তাই উপন্যাসের শেষে বৃষ্টিতে সমস্ত ধুয়ে দিতে চেয়েছেন। এ বৃষ্টি যেন ইঙ্গিতবাহী। নতুন মানসিকতা নতুন ধারণা গড়ে দেবার কারিগর। বিশ্বাস, আদর্শ ছাড়া সভ্যতা টিকতে পারে না লেখকের দৃষ্টি সেদিকে। কিন্তু মধ্যবিত্ত জীবনে মূল্যবোধ কিভাবে ভেঙে যাচ্ছে, বিশ্বাসে সংকট দেখা দিয়েছে সেই কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন। ঝুমার আজ বিবাহ, তাঁর বিশ্বাস বাবা ফিরে আসবে।মাতা সুধাময়ী জানেন তা কোনদিন সম্ভব নয় তবুও তিনি কন্যার এই বিশ্বাসকে ভেঙে দেন নি-কেননা বিশ্বাস ছাড়া একটি সভ্যতা টিকতে পারে না। আসলে শিকড়ের সন্ধান ছাড়া অন্তঃশূন্য হয়ে একটি সভ্যতা থাকতে পারে না, সেই বোধ শশাঙ্কবাবু গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সন্তানদের মধ্যে। ঝুমা ভেঙে দিয়েছে বোন রুমার ভালোবাসা। অথচ আজ সে নিজেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। সমস্ত কিছুর মূলেই আছে বিশ্বাস- অবিশ্বাসের স্পন্দন। সেই বিশ্বাস ছাড়া মানুষের সভ্যতা টিকতে পারে না, শিকড়ের সন্ধান ছাড়া মধ্যবিত্তের আত্মরক্ষার অন্য কোন পদ্ধতি নেই- তাই শেষে বৃষ্টিতে সমস্ত ধুয়ে দিয়ে মানুষকে এক নতুন ক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে দেন ঔপন্যাসিক।
রমাপদ চৌধুরীর অন্যতম উপন্যাস ‘বাড়ি বদলে যায়’ প্রকাশিত হয় ‘শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল ‘সহধর্মিনী সুষমা চৌধুরীকে / বাড়ির বদলে’। বাড়ি বদলে যায় কোন বাড়িবদলের কাহিনি নয় তা হল ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালাদের কাহিনি। এখানে দুটি শ্রেণি সমাজের দুটি বিশেষ দিকের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এ উপন্যাস ‘সাহিত্য অকাদেমি’ তে ভূষিত হল। কিন্তু লেখকের ইচ্ছা ছিল ‘খারিজ’, ‘বীজ’ বা ‘বাহিরি’ উপন্যাস এ পুরস্কারে ভূষিত হলে খুশি হতেন। এ থেকেই বোঝা যায় লেখকের প্রিয় উপন্যাস তালিকায় এ উপন্যাসের নাম নেই। এমনকি ‘আকাশপ্রদীপ’ উপন্যাসের নাম ছিল তবুও পুরস্কার পায় ‘বাড়ি বদলে যায়’ নামক ৭১ পৃষ্টার একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস। ক্ষুদ্রতা- বড় নয় লেখকের নিজস্ব প্রিয়তাই বড় কথা। এই অভিমান বশতই তিনি পুরস্কার নিতে যান নি, তবে প্রত্যাখ্যান করেন নি- অপরের মাধ্যমে নিয়েছেন। প্রীতি, ধ্রুবের জীবন পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী এ উপন্যাস। এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে উত্তরণের কাহিনি এ উপন্যাস। ধ্রুব ও প্রীতির আজ চিন্তা ছেলে টিপুকে মানুষ করে তোলা।ধ্রুব আজ আর বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। আবার ভাবে বাড়ি ভাড়া দিলে ধারদেনা তাড়াতাড়ি শোধ হবে, আবার ভাড়াটেদের যে দখলদারি –সেকথাও মনে নাড়া দেয়- এই দ্বন্দ্বে সে ক্ষতবিক্ষত। সে নিজে ভাড়াটে ছিল কিন্তু আজ আর ভাড়াটাদের সে সহ্য করতে পারে না, তাই প্রতিবেশী সুখেনবাবু ও তাঁর স্ত্রী আজ ধ্রুবের কাছে অসহ্য। বাড়িওয়ালাদের অত্যাচার ও ভাড়াটেদের অত্যাচারে দুইই এ উপন্যাসে এসেছে। তাদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও এসেছে। ভাড়াটে ধ্রুব আজ বাড়িওয়ালা, ফলে বাড়ির ওপর মায়া জন্মেছে, সন্তানসম স্নেহধন্যা বলে মনে হয়েছে বাড়িকে। ধ্রুবের মনে হয়েছে – “ ধ্রুব মনে মনে বললে বদলে যেতেই তো চাই। আমি বাড়ি বদল করেছি। বাড়ি বদল মানে তো শুধু একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়িতে যাওয়া নয়।“ ( উপন্যাস সমগ্র-৬, সপ্তর্ষি প্রকাশন, প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃ. ৭৭ )। এই উত্তরণই লেখকের লক্ষ্য। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিভাবে পাল্টে যায় অর্থনীতির সঙ্গে তা লেখক দেখালেন। ধ্রুব আজ অফিস থেকে এসে বাড়িতে সুখেনবাবুর স্ত্রীকেদেখে রাগাম্বিত হয়েছে। বাড়িওয়ালা হিসেবে ভাড়াটের এই মেলামেশা আজ সে মেনে নিতে পারেনি। আসলে তাঁর আজ পৃথক শ্রেণি হয়ে গেছে, প্রীতির মনে হয়েছে বাড়িটা সত্যি বদলে গেছে। অর্থনীতি পরিবর্তনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিভাবে পাল্টে যায় লেখক তাই দেখিয়েছেন সার্থক ভাবে।
‘বাহিরি’ উপন্যাসটি ‘শারদীয় দেশ’ এ ১৩৮৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দে। লেখক নিজেই বলেছেন ‘বাহিরি’ আমার প্রিয় উপন্যাস। মধ্যবিত্তের আত্মযন্ত্রণার আখ্যান এ উপন্যাস। বংশী শুধু শ্রেণি চরিত্র নয় সমগ্র ভারতবর্ষের নিপীড়িত শোষিত মানুষের প্রতিনিধি। যাদের প্রতি পদে পদে বাধা। সঞ্জয় মনে মনে বংশীকে শ্রদ্ধা সম্মান করলেও নিজের থেকে উচ্চ পদে কোনদিন বংশীকে দেখতে চায় নি। দরিদ্র মানুষের জন্য আমাদের সমবেদনা, সহানুভূতিবোধ আছে ঠিকই কিন্তু সেই নিম্নবিত্তের মানুষ যখন শিক্ষা- খ্যাতিতে আমাদেরকে ছাপিয়ে যায় তখনই মধ্যবিত্ত আত্মযন্ত্রণায় দ্বগ্ধ হয়। মধ্যবিত্তের এই আত্মযন্ত্রণাকেই লেখক ধরতে চেয়েছেন সঞ্জয় চরিত্রে। উপন্যাসের শেষ হয়েছে অষ্টম পরিচ্ছেদে। বংশী ছিল ভিখারী অৎছুতের ছেলে। সঞ্জয়দের সহানুভূতি ছিল বংশীর প্রতি কিন্তু সে যখন বিদ্যায় সঞ্জয়দের ছাপিয়ে গেছে তখন আর মেনে নিতে পারে নি। অন্যের প্রতিভাকে জাত, দারিদ্র্যতা দেখিয়ে পিছিয়ে দেবার যে প্রবণতা তা লেখক দেখিয়েছেন। আর. এম. রেজিগনেশন দেওয়ায় ওই পোষ্টে অফিসের সঞ্জয়েরই যাওয়ার কথা। সে মনে মনে পরিকল্পনাও করে নেয় সেই আর.এম হবে। ইতিমধ্যেই খবর আসে ওই পোষ্টে অন্য লোক আসবে। জি.এম. নিজের ঘরে নতুন আর. এম.( বি ডি অধিকারী, আসলে বংশী ) সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সঞ্জয়ের। আর. এম. হয়ে বংশী আসার সংবাদ শোনার পরই সঞ্জয়ের মধ্যবিত্তসত্তা নাড়া দিতে থাকে। বংশীর সে জাতকূল, ইতিহাস তুলে ধরতে থাকে।নিজের বস হিসেবে বংশীকে সে মেনে নিতে পারে না। তবে বংশী সে পদে আসেনি। কেন এল না সে কারণ লেখক ফুটিয়ে তোলে নি। কিন্তু শুভা, ঝুমারা নিজেরাই না আসার কারণ আবিষ্কার করে নিয়েছে-
“ শুভা হাসল। বললে, তুমি কিচ্ছু বোঝোনি। আসলে ও তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছে। আসলে ভাবেইনি, তুমি ওখানে আছ।
শুভা আবার হেসে উঠে বলল, ও তো আমাদেরও ওর মতই ভাবে। আমরা যে ভদ্রলোক, অত নীচ হতে পারি না, তা ও জানবে কি করে ।“ ( তদেব,পৃ. ৩৬২)
বংশী না আসার নানা কারণ খুঁজে চলেছে শুভা, ঝুমা ও সঞ্জয়। ইতিমধ্যেই কলিংবেল বেজে ওঠে। কিন্তু কেউ দরজা খোলে নি। এ বেল আসলে মধ্যবিত্তের চেতনাকে নাড়িয়ে দেওয়া। বংশী অফিসে যোগ না দিলেও সে সঞ্জয়দের চেতনাকে নাড়া দিয়েছে যে আমরাও পারি। লেখকের মতে এ শুধু বংশীর গল্প নয় ভারতবর্ষ নামক দেশের নিম্নবিত্ত নিপীড়িতদের গল্প। যাদের চলার পথে নানা বাধা অথচ সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করেও মানুষ ধ্রুব লক্ষ্যে পৌছায় সেই জীবনবোধের আখ্যান।
‘আশ্রয়’ উপন্যাসটি ‘শারদীয় দেশ’ এ ১৩৯৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ এ। এ উপন্যাস আসলে আশ্রয়চ্যুতির গল্প। মধ্যবিত্তের আত্মখননের আখ্যান। প্রচলিত সমাজে নিজের আত্মমর্যদা ধরে রাখতে মধ্যবিত্ত কিভাবে বিবেকবর্জিত হয় সে আখ্যান। প্রচলিত ছক বাঁধা জীবনে ‘আমি সর্বস্ব’ মধ্যবিত্তের আত্মঅহংকার, মর্যদা বাঁচাতে চরিত্র হননের কোন পর্যায়ে নামতে হয় এ উপন্যাস তা ফুটে ওঠে। যুমনা আশ্রয় পেয়েছিল হিরন্ময় ও শুভার বাড়িতে। কিন্তু সামান্য ঘটনায় নিজেদের আত্মমর্যদা বাঁচতে বিবেককে বলি দিয়ে শুভা বিদায়, দিয়েছে দরিদ্র যমুনাকে। সহায় –সম্বলহীন যমুনা কোথায় গেল সে খোঁজ রাখেনি শুভা হিরন্ময়রা। কিন্তু বিদায় নিতেই তাঁরা আত্মযন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। আসলে মধ্যবিত্ত কী নিয়ে বাঁচতে চায় লেখক সেখানে আঘাত করেছেন। নিজেকে বাঁচানোর জন্য মানুষ কত নির্মম হতে পারে, বিবেক কিভাবে বিসর্জিত হয় তাই লেখকের লক্ষ্য। সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী বলে চিহ্নিত তারা যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বুদ্ধিহীন তা লেখক দেখিয়েছেন। আসলে বুদ্ধিজীবী নাম চিহ্নিত মধ্যবিত্তের গালে এ এক চাপেটাঘাত। উপন্যাসের শেষে দেখা যায় যমুনাকে বিদায় করে আত্মযন্ত্রণায় দ্বগ্ধ হয়েছে শুভা ও হিরন্ময়।আজ আর কিছুই করার নেই আত্মযন্ত্রণা ও অনুশোচনা ছাড়া। এক অপরাধবোধ কাজ করেছে হিরন্ময়ের মধ্যে। এই অপরাধ, আত্মযন্ত্রণা, অনুশোচনা নিয়েই মধ্যবিত্তের বাঁচা তাই দেখিয়েছেন লেখক।
লেখক রমাপদ চৌধুরী উপন্যাস শেষ করেন গভীর ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে। তিনি পাঠককে ভাবান, পাঠকের চেতনাকে অন্য বলয়ে নিয়ে যান। পাঠক যেন নিজেই ভেবে নিতে পারেন কোনটা কাম্য মানুষের। মধ্যবিত্তের আত্মক্ষয়, আত্মযন্ত্রণা দেখেছি ‘আশ্রয়’ উপন্যাসে। সামাজিক বলয়ে নিজেদের বাঁচাত হিরন্ময়রা যে নিজেরাই নিচে নেমে গেলেন তা ব্যঙ্গ নিপূণ ভাবে দেখালেন। বিবেক বর্জিত মানুষের আত্মহননের কাহিনি এ উপন্যাস। তেমনি বংশী শুধু ব্যক্তি নয় সমগ্র ভারতবর্ষের বিশাল জনসমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কাহিনি। এ যেন ভারতবর্ষ নামক দেশের প্রকৃত স্বরূপ দেখার এক জলজ দর্পণ। তেমনি ‘বনপলাশির পদাবলী’ শেষ হয় সময়ের ইতিকথা দিয়ে। কেননা শহর মানেই সময়ের ঘেরাটোপ বন্দি এক রহস্যজাল- লেখকের ইঙ্গিত থাকে সেদিকে।
‘রূপ’ উপন্যাসটি ‘শারদীয় দেশ’ পত্রিকায় ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। মানুষের দুটি রূপ বিদ্যমান- একটি নিতান্ত পরিচিত সহজ সরল, অন্যটি তার কল্পনার জগৎ। যে জগতে হরিপদ কেরণীর বিবাহের ইচ্ছা জাগে। এই দুটি রূপ নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। স্বপ্ন কল্পনা ছাড়া মানুষের পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয় লেখক সেটিই দেখিয়েছেন। তবে উপন্যাসটি আঙ্গিকের দিক থেকে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথম পরিচ্ছেদটি লেখা প্রথম পুরুষে আর পরবর্তী পরিচ্ছেদটি উত্তম পুরুষে লেখা। ধূর্জটিপ্রসাদ, উষা, অঞ্জলী, করবী, নিখিলেশ ও তনুশ্রীকে কেন্দ্র করে উপন্যাস বলয় গড়ে উঠেছে। ছদ্মনামের আড়ালে যে যন্ত্রণা বা মানুষের ছদ্মবেশে যে আত্মবিড়ম্বনা তাই লেখক দেখিয়েছেন। ধূর্জটিপ্রসাদ জানতেন সত্যকে কখনই জানা যায় না, সত্যকে খুঁজে বেড়াতে হয়। সত্যের বদলে সেটা পাওয়া যায় সেটা কল্পনা বা ইমেজ। আজ তাঁর মনে পড়েছে জাল কল্যাণসুন্দরের কথা। আসলে সে একটা ধারণা, একটা ইমেজ। এজন্যই তো লেখক নাম দিয়েছেন কল্যাণসুন্দর। সেই ভালোবাসা শিখিয়েছিল ধূর্জটিপ্রসাদকে অথচ সে ভালোবাসা পায় নি। আজ তাঁর কল্পনায় ভেসে উঠেছে সুন্দর তনুশ্রীর মুখ। অথচ তিনি জানেন তনুশ্রী কল্যাণসুন্দরের মিথ্যা রূপেই মুগ্ধ হবে। আসলে মানুষ সত্যকে নয় ভালোবাসে ইমেজকে। সে অনুসন্ধানই লেখকের লক্ষ্য, আর তা ফুটে ওঠে ধূজর্টিপ্রসাদ ও তনুশ্রীর ভাবনার মধ্য দিয়ে। উপন্যাসওশেষ হয়েছে ধূর্জটিপ্রসাদের সত্য সন্ধানের মধ্য দিয়ে যা আসলে কল্পনার অনুসন্ধান।
বাংলা কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্রধারার ঔপন্যাসিক রমাপদ চৌধুরী। তিনি জানেন কোথায় থামতে হয়। তাই ‘বাড়ি বদলে যায়’, ‘বাহিরি’, ‘খারিজ’ এ সামান্য পরিসরে বৃহৎ জীবনবোধের গল্প শুনিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে তিনি ভারতবর্ষের কথা বলতে চান, ভারতবর্ষের মানুষের কথা বলতে চান, আর তা প্রকাশ পায় কোন চরিত্রকে কেন্দ্র করে। পিছিয়ে পড়া ভারতবর্ষের যে মধ্যবিত্ত জীবন তা নিয়েই তিনি আখ্যান গড়েন। কিন্তু উপন্যাসের পরিশেষে তিনি জীবনের গভীর তলদেশে পৌঁছান, যা পাঠককে নতুন করে ভাবতে শেখায়, দেখতে শেখায়- এখানেই তাঁর অনন্যতা।
নাম- পুরুষোত্তম সিংহ
সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর
পিন- ৭৩৩১৩৪
ফোন-৬২৯৭৪৫৮৫৯১
ইমেল- purusattamsingha91@gmail.com
3 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর আলোচনা।
উত্তরমুছুনখুব ভালো
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি আলোচনা জন্য
উত্তরমুছুন