অবনী ধর 'এর গল্প : ভাতের জন্য শ্বশুরবাড়ি

দশটা টাকা জোগাড় করে দু’সপ্তাহ আগে রেশন তুলেছিলাম। গতকাল রেশন তোলার লাস্ট ডেট গেছে। ভাবলাম বউ-ছেলেমেয়েকে কয়েক মাসের জন্য শ্বশুরবাড়ি রেখে আসতে পারলে অন্তত দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাবে। বউ কিছুতেই যেতে চায় না। গত বছর যখন বাপের বাড়ি গিয়েছিল, গায়ে গয়না ছিল না দেখে কত কথাই নাকি শুনতে হয়েছে। ‘সোনা-লক্ষ্মী’ বলে অনেক করে বোঝাতে বউ রাজি হল। গাড়িভাড়া? বাসুর কাছ থেকে শুধু গাড়িভাড়া নিয়ে ভোরবেলায়ই রওনা হলাম। আমার টিকিট আর কাটলাম না। শিয়ালদা নেমে কিছু মিষ্টি কিনে আবার গাড়িতে উঠলাম।

গাড়িতে বসে বউকে বোঝালাম—কয়েকটা মাস বাপের বাড়ি থেকে যাও। দেখ, যদি ছেলেটার একটু চিকিৎসা হয়। বউ কোনো কথা বলছে না। আবার বললাম–এর মধ্যে নিশ্চয়ই আমার একটা কিছু হয়ে যাবে। মুখ শুকনো করে বউ বলে—‘সবই তো বুঝি। বাবা রিটায়ার করেছে। দাদাদের উপর সংসার। কোয়াটারও দাদার নামে। তারপর এখনও চারটে বোন ঘাড়ে। আর দাদার যা মুখ, না খেয়ে মরি সেও ভালো...।’ দশ পয়সার বাদাম কিনে বউয়ের হাতে দিয়ে বললাম—তোমার বাবাতো মাসে মাসে পেনশন পায়। তাছাড়া একসঙ্গে অনেক টাকাও পেয়েছে। তোমার দু'দাদাই চাকরি করে। অভাবতো আর নেই। বউ বাদাম খেতে খেতে বলল—‘বাবা আগে বাড়ি করে বোনের বিয়ে দেবে তারপর...। দাদারা বলে দিয়েছে, সংসারের খরচ ছাড়া আর একপয়সাও দিতে পারবে না’ 

মল্লিকপুর স্টেশনের গায়েই দোতলা কোয়ার্টার। উপর-নীচে দু'খানা গুহা আর একটা ছোটো রান্নাঘর। সূর্যের আলো আসে না। খাটা পায়খানা। পেট থেকে কীরকম মল পড়ে তা ডাক্তারকে জানাবার সাধ্য নেই। কোয়ার্টারের চারপাশে কাগজের নৌকা ভাসছে। 

বউ ছেলেমেয়ের পেছন পেছন ঘরে ঢুকলাম। গায়ে শুধু কাপড় জড়িয়ে বারান্দায় বসে শাশুড়ি কী যেন সেলাই করছিল। আমাকে দেখে মাথায় খানিকটা ঘোমটা টেনে দিল। গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম করলাম। ফ্রকপরা থলথলে ছোটো শালি এসে আমার ছেলেটাকে কোলে নিয়ে শাশুড়িকে বলছে—“দেখ মা, বুড়ো কী রোগা হয়ে গেছে।’ আবার বউ-এর দিকে তাকিয়ে বলল—‘খেতে দিস না’। ইতিমধ্যে অন্যসকলেও এসে জড়ো হয়েছে। সেজ শালি ঠোঁট টিপে টিপে বলে উঠল-- “তুই এখন খাইয়ে মোটা কর’। এইজন আবার বোনেদের মধ্যে ফরসা। দু’বার ফেল করে এইটে পড়ছে। শ্বশুরমশাই আমায় বলেছিলেন—ওর জন্য বি, এ পাস কুলিন ছেলে দেখতে। আমি ঘরে গিয়ে বসলাম। শুনছি, শাশুড়ি বউকে বলছে-- ‘জায়গা নেই বাসা নেই, হুট করে চলে এলি—একটু আক্কেল বিবেচনা তো থাকা দরকার।’ বউকে ইশারা করে মিষ্টির ঠোঙাটা শাশুড়ির হাতে দিতে বললাম। বাড়ি থেকে না খেয়ে বেরিয়েছি। কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে ইশারা করে বউকে পেট থাবড়ে দেখালাম। চৌকির তলায় বাটিতে দুধ গোলা ছিল। আমার ছেলেটা কী করে দেখতে পেয়ে সোজা চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলল। শাশুড়ি দেখে কপালে হাত দিয়ে বলে উঠল—‘হায় হায় কপাল আমার, চায়ের জন্য দুধটুকু রেখেছিলাম...'। সঙ্গে সঙ্গে এক শালি ছুটে এসে ছেলেটার হাত থেকে বাটিটা কেড়ে নিল। বউ বোধহয় ছেলেটার পিঠে দু'এক ঘা কষাল। চা রুটি খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর শুনি, শাশুড়ি বলছে—‘বিস্কুট তো ঘরে ছিল, দিলি না কেন।’ 

বউকে ইশারা করতে দু'খানা বিস্কুট এনে দিল। ছেলেমেয়ে দুজন তা কাড়াকাড়ি করে খেয়ে নিল।। 

শ্বশুরমশাই ঘরে এলেন। গিয়েই একটা প্রণাম করলাম। আমার পা থেকে মাথা অবধি ভ্রু কুঁচকে দেখে বললেন—‘চেহারাটা দেখি একেবারে বাগদিদের মতো করেছ। এখন করো কী?’ মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ‘হুম’ বলে আবার জিজ্ঞেস করলেন—“তোমার সোর্স অফ ইনকাম কী?” মিনমিন করে বললাম—নিল। ছেলেটাকে দেখে বলতে শুরু করলেন—‘এটাকে তো একেবারে মেরে এনেছ। ডাক্তার-টাক্তার দেখাও না?’ মুখ ফসকে বলে ফেলি—হা দেখিয়েছিলাম। মুখটা বাঁকিয়ে বলেন—‘ওষুধ কেনার পয়সা নেই?’ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন ‘ওদের এখন রোজ একসের করে দুধ আর শিং মাছের ঝোল খাওয়াবা...।’ বউকে ডাকলেন—‘ও-সাধনা, আয় দেখি, একটু দেখি।’ বউ এসে বাবাকে প্রণাম করে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন—“ওকে ডাক্তার দেখিয়ে একটা টনিক-ঠনিকও কিনে দিতে পারেনি’? বউ চলে গেল। আড়াল থেকে ফরসা শালি বাবাকে বলল—“তোমার তো আর টাকার অভাব নেই। এখন জামাই-মেয়ের চিকিৎসা করো।’ শ্বশুর এক ধমক দিয়ে বললেন—“চুপ থাক হারামজাদি।’ 

চৌকির তলায় সারিসারি চালের বস্তা। এক সময়ে বউকে দেখিয়ে বললাম—যদি এক থলে...। মুখ ভেটকি দিয়ে বউ চলে গেল। শ্বশুরমশাই কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে আমি চৌকিতে শুয়ে পড়লাম। সেজোশালি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাকে বলছে—“দাদা বলে দিয়েছে—লাইটের বিল আর দিতে পারবে না। গত মাসে পঁচিশ টাকা মিটার উঠেছে দেখে দাদা ভীষণ গালাগালি করেছে’। বউ এসে ফ্যানটা বন্ধ করে দিল। বাইরে চড়া রোদ। ঘরের মধ্যে আলো না জ্বালালে পরিষ্কার কিছুই দেখা যায় না। কোথায় যাই? চৌকিতে শুয়ে নাকে যেন ফ্যানা-ভাতের গন্ধ এসে লাগে। রান্নাঘর থেকে না চৌকির তলা থেকে ঠিক বুঝতে পারি না। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। 

শ্বশুরমশাই এসে ডেকে তুললেন। তার পাশেই খেতে বসলাম। খেতে খেতে শ্বশুর বলেন—‘একটা ব্যবসাপাতিও তো কিছু করতে পারো। তোমার মামা ব্যবসা করে। কেমন গাড়ি-বাড়ি করে ফেলেছে। লোককে বলেও আনন্দ পাই...।’ খেয়ে উঠে আর যেন নড়তে পারি না। অনেকদিন পর পেট ভরে ভাত খেলাম। বউ সুপারি দিতে এলে বললাম—তোমার বাবার কাছ থেকে গোটা দশেক টাকা ম্যানেজ করে দিও। বাড়িতে মা রয়েছে...। বউ জিজ্ঞেস করল—‘কী বলে চাইব?’ বললাম—বলবে, ওর একটা চাকরি-বাকরির ব্যাপারে..., যা হয় একটা বলে দিও। আর বললাম—আমি আজই চলে যাই। খানিক বাদে বউ এসে বলল—‘মা আজ তোমায় থাকতে বলেছে। সন্ধ্যের সময় কে এক সাধু আসবে, তার কাছ থেকে তোমাকে একটা মাদুলি নিয়ে দেবে’। শুনে ভাবলাম—যাক তাহলে বউকে এখানে কিছুদিন রাখবে মনে হচ্ছে। 

বিকেলে একা একা প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছি। স্টেশনের চারদিকে দেখি, লাল-নীল-কালো...কালি দিয়ে লেখা ‘বন্দুকের নলই—শক্তি..বিপ্লব..সশস্ত্র বিপ্লবই—মুক্তির—ঝাঁপ দাও...।' পড়তে পড়তে মনে একটু উত্তেজনা বোধ করছিলাম। একটা বেঞ্চিতে কয়েকজন যুবক বসে ইলেকশন নিয়ে তর্ক করছিল। পরনে প্যান্ট-শার্ট। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখ গোল গোল করে ওরা আমাকে লক্ষ করছিল। আমি দূরে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। খানিক বাদে চাষাপানা একটা লোক এসে আমার পাশে বসল। দূর থেকে ওই ছেলেগুলো আমার দিকে চেয়ে দেখছে। মনে মনে হাসিও পাচ্ছে। আবার একটু ভয় হচ্ছে। লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করল— 

কোথায় থাকেন? 

অশোকনগর। 

আপনাদের ওখানে ইলেকশনের খবর কী? 

জানি না। 

সে কী! ইলেকশনের খবর জানেন না ? 

মানে, ঠিক ওখানে থাকি না—বাইরে থাকি। 

খানিকক্ষণ টেরিয়ে টেরিয়ে আমার দিকে দেখে একের পর এক সমস্ত পার্টিকে খিস্তি 

শুরু করল। মুখ-চোখ শক্ত করে বলে উঠল—‘এবার এখান থেকে একটা ভোটও বাক্সে পড়বে না। তবুও আমি কোনো কথা বলছি না দেখে একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল—‘এখানে কোথায় এসেছেন?’ রেল-কোয়ার্টারটা দেখিয়ে বললাম—ওইটে আমার শ্বশুরবাড়ি। ‘ওঃ—আপনি অমুকের জামাই? তাই বলুন। আমি ভেবেছিলাম...। বোঝেনই তো, এখন যা অবস্থা, নতুন লোক দেখলেই সন্দেহ হয়। যাক আপনি তাহলে আমাদের দেশের লোক।’ একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল—‘খান’। মুখটা বেজার করে লোকটা নিজে নিজেই বলতে শুরু করে—‘এবার চাষের অবস্থা খুব খারাপ। যাওবা হয়েছিল, নিজেরা নিজেরা মারামারি করে তাও শেষ করে দিয়েছে। বুঝলেন যে যাই বলুক, এইসব পাট্টিপুট্টি আমাদের মতো গরিবদের জন্য না।’ ওই ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে কে যেন সিটি মারল। আমার ডাক পড়েছে বলে লোকটা উঠে চলে গেল ওদের কাছে। 

সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কোয়ার্টারে গিয়ে দেখি, শালারা অফিস থেকে ফিরেছে। ছোটো শালা বই দেখে আমার ছেলেটাকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাওয়াচ্ছে। বড়ো শালা নোটবুকে হিসেব লিখছে আর ছোটো শালাকে বলছে—“চিনিতে তোকে কুড়ি পয়সা ঠকিয়ে দিয়েছে...।’ আমি ঘরে ঢুকতেই থেমে গেল। 

বড়োশালার সঙ্গে অনেকদিনই আমার কথা বলা বন্ধ! খাওয়া-দাওয়া করে উপরতলায় গিয়ে বসলাম। নীচ থেকে বড়োশালা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে...’বলে দিও, এখন আর সেদিন নেই—গুষ্টিসুন্ধু আসবে আর বসিয়ে বসিয়ে গেলাব। রোজগার করতে গাঁঢ় চিরে যায়’। বউকে বলল--“তোর বাচ্চাদের আলাদা শোয়া। ওইসব সর্দি কাশি ছোঁয়াচে রোগ। আমি আর ওষুধে টাকা খরচ করতে পারব না’। শ্বশুরমশাই বলে ওঠেন—‘যাকগে এখন চুপ ক’র’। বড়ো শালা আবার খেঁকিয়ে উঠে বলতে শুরু করে—‘পাড়ায় আড্ডা মেরে বেড়ালে কী আর চাকরি পাওয়া যায়। লোকের হাতে-পায়ে ধরে তেল মাখাতে হয়। বাল ফেলার ক্ষমতা নেই...পোঙায় লাথি মেরে বার করে দিতে হয়।’ 

খুব ভোরেই ঘুম ভাঙল। ...বউ আমার আগে উঠে পড়েছে। কলতলায় ঝি-রা বাসন মাজছে। আমি উপর বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ কানে এল এক ঝি কাকে যেন বলছে— ‘বড়ো সেয়ানা হয়ে গেছিস না? রস মেরে গুড় করে দেব...।' শুনে ফিক করে হেসে ফেললাম। বলতে ইচ্ছে করছিল—সুপ্রভাত সুপ্রভাত। 

বউ মুখ ধুয়ে এসে আমাকে বলে..‘চলো সকালেই চলে যাই।’ 

আমি বউ-র হাত দুটো ধরে বললাম—লক্ষ্মীটি কয়েকটা দিন থেকে যাও। আমার জন্য একটু সহ্য করো। আরে আমাদেরও দিন আসবে...। কিন্তু কিছুতেই শুনবে না। আরও বুঝিয়ে বললাম ওদের কথায় রাগ করার কী আছে...কই আমি তো রাগ করিনি। আর যাই হোক ওরা তো আমাদের পর নয়। থেকে যাও লক্ষ্মীটি, কথা শোনো। থেকে যাও। কিছুতেই রাজি হয় না দেখে শেষে বউকে বললাম—“বাবার কাছে টাকাটা নিয়ো’। শালারা যে যার কাজে চলে গেল। বউও গোছগাছ করে ফেলেছে। দেখলাম বউ বাপের ঘরে ঢুকল। আমার ফরসা শালি দরজার আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখছে...বাবা দিদিকে কী দেয় বা বলে। আমি আহ্‌ আহ্‌ করে কেশে উঠতে শালিটা সরে গেল। খানিক বাদে বউ হাত মুঠো করে বেরিয়ে এল। শালিটাও পেছন পেছন আসছে। বউকে ইশারা করছি, বুঝতে পারছে না। তখন শালির নাম ধরে ডেকে বললাম...’যেয়ো আমাদের বাড়ি, বেড়াতে’। বউ বুঝতে পেরে চলে গেল। 

শ্বশুরই টিকিট কেটে দিল। গাড়ি ছাড়ার পর বউ হাসতে হাসতে আমাকে বালতি ব্যাগের তলাটা দেখায়। হাত দিয়ে দেখি চাল। বউ চৌকির তলা থেকে সরিয়ে এনেছে। ইচ্ছে করছিল, বউকে সাপটে ধরে চুমু খাই। অত লোকজনের মধ্যে কী আর তা হয়! বউকে হাতটা শুধু চেপে ধরে বললাম...’শাবাশ শাবাশ!’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. বুকের ভেতরটা কেমন যে করলো গল্পটা পড়ে! সহজ সরল, সরাসরি বুকে এসে ঘা দেবার মতো লেখা।

    উত্তরমুছুন
  2. গল্পটা পড়তে পড়তে বুকে মোচড় দিয়ে উঠল।বাস্তবিক এক অনন্য দলিল।

    উত্তরমুছুন
  3. জীবনের বাস্তবতাকে চরম ভাবে ছুঁয়ে আছে এই গল্প!

    উত্তরমুছুন
  4. একটুর জন‍্য যে জীবনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়নি তার ছবিটি একদম ঠিকঠাক ধরেছেন।

    উত্তরমুছুন