ভ্রমণ জার্নাল : অশ্রু ও ঘামে ভেজা রোমের গল্প--১

লুতফুন নাহার লতা 

দুরন্ত সে ট্রেনের গতি। মাইলের পর মাইল সমতলের সবুজ ফসলের মাঠ পেরিয়ে উন্মুক্ত নীলাকাশ সাথে নিয়ে সে ট্রেন ছুটে চলেছে ইতালির মিলান সেন্ট্রাল রেলস্টেশন থেকে রোমের দিকে। রোম টারমিনাল। ওদের ভাষায় রোমা তেরমিনি। যে ট্রেন রোমে যায় তার গতি কি শ্লথ হতে পারে! ধুলো উড়িয়ে, সূর্য ডুবিয়ে,ঘোড়ার ক্ষুরে রোমের রাস্তায় দামামা বাজিয়ে ছুটেছে জুলিয়াস সিজার। মার্ক এন্টোনিও। সেই রোম। ইতালির প্রথম রাজা রমুলাসের রোম। আমার জন্ম জন্মান্তরের স্বপ্নের রোম।

আমেরিকায় বসন্ত আসে অপেক্ষার চিরাগে শেষ সলতেটুকু পুড়িয়ে। সেবার বরফ ঠান্ডা পেরিয়ে অনেক অপেক্ষার পর যখন ধুম করে এক সকালে ফুটে উঠল গোলাপি চেরি ফুল। মাটির বুক থেকে আঁচল সরিয়ে রজনীগন্ধার মত বেরিয়ে এলো সাদা, বেগুনি, গোলাপি হায়াসিন্থ ফুল। আর গাছে গাছে উঁকি দিয়ে ডাকল টিয়া সবুজ পাতা, তখন আমার আড়মোড়া ভাঙা ডানা একটু একটু করে মেলবার সময় এসে গেল। এসময় প্রতি বছর বাংলাদেশ ডাক পাঠায়। এবার মনে হল যাই অন্য কোথাও অন্য কোনখানে।

আমার বন্ধু সঙ্গীত শিল্পী কাজী জাকারিয়া থাকেন রোমে। বহুবার তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি আমন্ত্রন। একসাথে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা জাকারিয়ার মত আমারো আনন্দের অনুষঙ্গ হতে পারে ভেবে যাবার ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু ঠিকঠাকমত সব মেলেনি। এবার সেই ইচ্ছে পুরনের আভাস যেন দেখতে পেলেম মনে। টিকেট হল কিন্তু কিছুতেই সরাসরি রোমে হল না। নিউইয়র্ক থেকে মিলান। মিলান থেকে ট্রেনে রোম। তো তাই সই, টিকেট নেয়া হল। বন্ধু বলেছে মিলানোতে আমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করবে। কে সে!

বাংলাদেশ থেকে বন্ধু অর্চনা আসবে আমার বাসায় আগস্টের শুরুতে। অতএব ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ করে আমাকে ফিরতে হবে জুলাইয়ের শেষেই। তা বেশ আমার হাতে সময় তো রইল কিছুটা। রোম থেকে বের হয়ে জার্মানীটাও ঘুরে আসা যাবে সহজেই। ইচ্ছে হলে দেখে আসব প্রাগ। প্রাহা। আমার প্রিয় কাফকার জন্মস্থান। একসময় ওর নাম ছিল চেকোস্লোভাকিয়া। ওরা এখন আলাদা। স্লোভাকিয়া আর চেক রিপাবলিক। কথা হল ফ্রাংকফুর্টে বন্ধু অপুর সাথে। বাংলাদেশের বন্ধুরা এসেছে ওর কাছেও, তাদের নিয়ে ওরাও আসবে রোমে। সবাই মিলে ঘোরার আনন্দের কথা ভেবে মন নেচে উঠল।

টান টান উত্তেজনা। একটু একটু দুরু দুরু বুক। এয়ারপোর্ট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেছি। লাগেজ চেক ইন করে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভিতরে যেতে যেতে তাকিয়ে দেখি মার্ক এন্টনিও তখনো ক্লিওপেট্রার দিকে চেয়ে ছলছল চোখে অপেক্ষমান। আমার কিন্তু ভালই লাগল। মনে মনে সেই ভালোলাগাটুকু দুল দুল করে দুলছে। আমি একটু হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেলাম। একটা কফি নিয়ে বসে রইলাম প্লেনে ওঠার দরজার কাছাকাছি। একসময় সব যাত্রী বোর্ডিং করানো হলে প্লেন রানওয়েতে এসে দাঁড়াল। মাটি ছেড়ে যখন সে ঘন নীল আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আরো দূরের আকাশে চলেছে তখন জানালায় মাথা রেখে মেঘের দিকে চেয়ে মনে হল- দূরে না গেলে কেউ বোঝে না ভালোবাসার পরিমাপ। তাই কি আকাশ এত দূরে!!

ভোরের আকাশ ভরে গেছে কুসুম কুসুম লালিমায়। সেখানে বেজে চলেছে পূরবী রাগে এক মহাশূন্যের ধ্রুপদ সঙ্গীত। ধীরে, অতি ধীরে জেগে উঠছে ধ্যানমগ্না পৃথিবী। দিন রাত্রীর মিলন শেষে রাত্রী থেকে দিনের বিচ্ছিন্নতার এ এক অসামান্য সময়। রাতের জঠর থেকে জন্ম নিচ্ছে দিনের ভ্রুণ। সুদ্ধ সুন্দর পবিত্র। আকাশ পথে যেতে যেতে সেই স্বর্গীয় লালের আভায় ফুলের মত ছড়িয়ে দিয়েছি আমার ভালোলাগার চুম্বন রাশি। পরশে তার সূর্য উঠেছে জেগে। ঝলমল সেই সকালে আমার প্লেন স্পর্শ করেছে মিলানের মাটি। ইটালির মিলান শহর। ওরা যাকে বলে মিলানো।

সারা পৃথিবীর সকল শিল্প সম্ভার এই দেশকে করেছে তিলোত্তমা। ফ্যাশন, আধুনিকতা আর আভিজাত্য এর মাথায় পরিয়েছে মুকুট। ভূমধ্য সাগরের কোলে অভূতপূর্ব এক হিরের দুল হয়ে দুলছে ইতালি। 
খৃষ্ট পূর্ব ২২২ এর দিকে রোমান অধিকৃত এই অঞ্চল মেদিওলেনা (Mediolanum০) নামে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর অনেক পরে খৃষ্টপূর্ব ১৫'র দিকে সম্রাট অগাস্টাস, মিলানকে ত্রান্সপেদেনিয়া (Transpadania), কোমো, বেরগামো,পাভিয়া, এবং লোদি অঞ্চলের রাজধানী করেন।

ইতালির এই বানিজ্যিক অঞ্চল ও লোম্বার্ডির আশপাশ এলাকাসমূহ তাই অন্যান্য দেশ ও গোত্রের কাছে শত শত বছর ধরে একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বিষয় ছিল। মিলানের ইতিহাসে বারে বারে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের শাসন কাল। কেল্টস Celts, রোমান Romans , গথস Goths, লোম্বার্ডস Lombards, শপ্যানিয়ার্ডস Spaniards, এবং অষ্ট্রিয়ান্স Austrians এরা সবাই শাসন করেছে এই অঞ্চল। আর বেশীর ভাগ সময়েই এই শহর তার অবস্থানের কারনে ব্যবহৃত হয়েছে মুলধন হিসেবে। আজকের মিলানও সেই একই কারনে বিতর্কহীন ভাবে ইউনাইটেড ইতালির একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থিনৈতিক পাওয়ার হাউস হিসেবে পরিগনিত হয়।

দেবতূল্য শিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির জন্ম হয় ১৪৫২ সালে। তিনি ছিলেন ইটালিয়ান রেনেসান্সের এক অকল্পনীয় প্রতিভা। শিল্পের সম্ভারে তিনি গৌরবান্বিত করেছেন সমগ্র ইতালিয় পেনিনসুলা। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন, একাধারে আবিস্কারক, স্থপতি, ভাস্কর, যন্ত্র শিল্পী, সংগীত শিল্পী, চিত্রকর, গনিতজ্ঞ, লেখক, সাহিত্যিক, উদ্ভিদ ও অস্থি বিদ্যায় মাস্টার, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং আরো বহু গুনের অধিকারী। তিনি তৈরি করেন এ শহরের আধুনিকতার নকশা। জল আগমন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ডিজাইন করেন এর নাগরিক জীবনের সব কিছু। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, পার্ক, বাগান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ট্রেন স্টেশন। তিনি এবং তার তৈরি শিল্পীরাই শিল্প সুষমায়, ভরে তোলেন এই শহর।

আমাকে নিতে আসবেন রানা ভাই। তিনি এক সময়ে ছিলেন রোমে। বর্তমানে ব্যাবসা ও বসবাস দুটিই এই শহরে। রানা ভাই অসাধারণ একজন মানুষ। একজন কমিউনিটি লিডার। দয়ালু, পরোপকারী। টিকেটের বিভ্রাটের কারনে আমার মিলান হয়ে রোমে যাওয়া। একথা জেনে জাকারিয়ার কথায় তিনি এসেছেন আমাকে নিতে। প্লেন থেকে নেমে একসাথে আসা লোকজনকে আর চিনতে পারা যায় না। সবাই হুড়মুড় করে দৌড়তে থাকে ইমিগ্রেশনের দিকে। ঝামেলা শেষ করে আমিও নির্ধারিত লাগেজ বেলট থেকে, আমার সুটকেস তুলে নিলাম। এবার তো একটা কল করা দরকার। এয়ারপোর্ট থেকে টাকা ভাঙিয়ে নিলাম সাথে ওয়াইফাই কোড নিলাম ফোন চালু করতে। রানা ভাইকে পাওয়া গেল একটা রিং হতেই। উনি বাইরে আছেন জানালেন। আমার পরনে কালো সিল্ক প্যান্টের সাথে সাদা সার্ট আর গলায় কালো স্কার্ফ। একথা জানাতেই জোরে হেসে উঠলেন তিনি, বললেন ওভাবে চেনাতে হবেনা আমি আপনাকে দেখলেই চিনব। মিলান এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চমৎকার সুন্দর সেই সকালে চললাম মিলান শহর ভ্রমনে। পথে একটু থেমে ভাবীকে তুলে নেয়া হল। এবার শুরু হল ভাবীর আপ্যায়ন। সবার আগে কফি আর সাথে ইতালির বিখ্য্যাত কেক ও কুকিস। তারপর সারাদিন ঘুরে ঘুরে শহর দেখতে বেরিয়ে গেলাম আমরা।

ড্যূমো ডি মিলানো বা মিলান ক্যাথিড্রালের সামনে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। ১৩৬৫তে এর কাজ শুরু করা হয়েছিল। তের শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় ছয় শ বছর ধরে কাজ করেছেন বহু শিল্পী। অবশেষে উনিশ শতকেরও শেষ ভাগে ১৯৬৫ তে এসে এর কাজ শেষ হয়েছে। মিলান ক্যাথিড্রালের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল আকাশের গায়ে এক অনন্যসাধারন নক্ষত্র খচিত সোনার পেন্ডান্ট হয়ে দুলছে ড্যুমো ডি মিলানো। কোনো মানুষ যে এর উদ্ভাবক, এর পরিকল্পক ও সৃষ্টিকর্তা হতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন। বরং স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন মুনি বা ঋষি এর উদ্গাতা। হয়ত কোন এঞ্জেল এসে গড়েছেন এই শৈল্পিক গথিক মাস্টারপিস। যেন সূচের আগায় সূক্ষ্ম সোনার কারুকাজে ভরা চোখ ধাঁধানো এক মহাকাব্য। এক অলৌকিক ইন্দ্রপুরী! কি যে সুন্দর তার শরীর ভরা অলংকরণ! যেন সাত আসমান থেকে নেমে আসা ফেরেশতারা চাঁদের কনা দিয়ে গড়েছেন এই শিল্প। এর সৌন্দর্য প্রকাশের ভাষা নেই আমার। কেবল মন হতে লাগল কেন আমি আরো আগে আসিনি এখানে!

মিলানে ভোরবেলা পৌঁছে হাতে সময় ছিল মাত্র পাঁচ ছয় ঘন্টা। ফলে ক্যাথিড্রাল চত্তরে আমার হাতে কাঁধে মাথায় কবুতর এসে যতই বসুক, তারা ভালোবেসে মুখে মুখ ঘষে জানাক না সম্ভাষণ, কোন লাভ নেই। আমার হাতের তালুতে ওদের চঞ্চু ভরে গম খাওয়ার ছবি তুলেই ছুটেছি ট্রেন ধরতে। যে ট্রেন আমাকে নিয়ে যাবে বৈকুন্ঠের দিকে। আর আমি আমার আলইটালিয়া ট্রেন ধরতে পেরে আনন্দে আটখানা হতে পারব!

মিলান ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়ে এক ছুটে ট্রেন ধরে এসেছি যেখানে রানা ভাইয়ের গাড়ি রেখে গিয়েছিলাম। গাড়ি নিয়ে এবার শহরের অলিগলি পার হয়ে চমৎকার এক বাঙালী রেস্টুরেন্টে এলাম। সেখানে আমাকে দেখে পড়ে গেল মহা হৈ চৈ। বাঙালি মালিক, স্ত্রীকে ফোনে বললেন, মিস মিলি এসেছেন এখানে, আমাদের রেস্টুরেন্টে তাকে দেখতে হলে এক্ষুনি গাড়ী নিয়ে দোকানে চলে আসতে। তারপর নানান পদের খাবার পরিবেশন করে মহা যত্ন করে খাওয়ালেন। একসাথে ছবি টবি তুলে ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হল। এবার এলাম মিলানের বিশাল সেন্ট্রাল রেল স্টেশন। এই রেল স্টেশান স্থাপত্যকলার আরো এক বিস্ময়!

রোমে যেতে লাগবে মাত্র তিন ঘন্টা। রানা ভাই স্লট মেশিনে টাকা ঢুকিয়ে টিকেট কেনার কায়দা শিখিয়ে দিলেন। টিকেট নিয়ে ভিতরে ঢোকার মুখে ওনাদেরকে আটকে দেয়া হল। অথচ আগে নাকি ওনারা ট্রেনের দরজা পর্যন্ত যেতে পারতেন। অসহায় আমরা ওখানেই বিদায় নিতে বাধ্য হলাম। ওরা মায়ামায়া দৃষ্টিতে অসহায় আমার দিকে চেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নিল। আমি চললেম একা।

ভিতরে ঢুকে সত্যিই খুব একা হয়ে গেলাম। বিশাল এলাকা। এত ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। এত ট্রেন আসছে! জন অরন্য আর কাকে বলে! আমি কেমন খেই হারা হয়ে গেলাম। ঘড়ি দেখে বুঝলাম আমার হাতে আরো কিছুটা সময় আছে। একবার ডাইনে একবার বায়ে দৌড়াদৌড়ি করে বহুজনকে জিজ্ঞেস করেও কোন কুল কিনারা করতে পারলাম না। কি আশ্চর্য কেউ ইংরেজী বলছেনা। এমন কি গেটে দাঁড়ানো নিরাপত্তা রক্ষীরাও বলতে পারেনা। এত সুন্দর পোশাকআশাক পরা স্টাইলিশ মানুষজন অথচ তারা ইংরেজী জানেনা! নাকি জেনেও বলছে না!

একবার জেনেভা'তে হয়েছিল এমনি ঘটনা। শাশুড়ীমাকে সাথে নিয়ে আমি আর মার্ক যাচ্ছি সুইজারল্যান্ডে। দরজায় উস্টা খেয়ে মা পড়ে গেলেন জেনেভা এয়ারপোর্টে। তাঁকে এম্বুলেন্স এসে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এম্বুলেন্সের ভিতরে মায়ের সাথে আমি। মার্ক রেন্ট করা গাড়ীতে আমাদের লাগেজ টাগেজ নিয়ে পিছনে পিছনে আসছে। আমি যা কিছু বলি, যা কিছু জানতে চাই কেউ কিছু বলে না। বার কয়েক নো ইংলিছ বলে নার্সরাও চুপ। সেই রকম আবারো এই বিষম বিপদে পড়ব তা তো ভাবিনি!

আমার ট্রেন যদি আমাকে না নিয়ে চলে গিয়েই থাকে তা হলে কি হবে! আমি কি ফিরে যাব রানা ভাইয়ের বাসায়? কিন্তু কেমন করে আমি তো ঠিকানা জানিনা! আর তাছাড়া কিছুক্ষনের মধ্যেই রাত্রি নেমে আসবে আর তখন আমি কোথায় যাব! আবার কি টিকেট নিতে হবে! এরা তো ইংরেজী বলে না! আমার হাতে ছোট বড় দিয়ে গোটা তিনেক লাগেজ, একবার ডাইনে একবার বামে টেনে নিতে নিতে ক্লান্ত আমি! আসার আগে সিদ্ধার্থ কিন্তু বলেছিল, 'বেশী কিছু নিও না মা, হালকা ভাবে যাও যাতে হাটাহাটি করতে গিয়ে ক্লান্ত না হও।' কিন্তু কে শোনে কার কথা! রোমে যাব, ছবি টবি তোলা হবে, আর আমি ফকিরনির মত যাব! মোটেই না, তা হচ্ছে না। নানা রকম সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় কিনে গুছিয়ে নিয়েছি অথচ ভুলে গেছি আঙুলে নেইল পলিশ লাগাতে। আমার বন্ধুরা কোথাও গেলে সবার আগে যায় পার্লারে, চুল আর নেইল সেটিং না হলে তো হয়না! এসব ভাবনা আসছে মনে আবার মুহূর্তে তা উধাও।

মাথাটা কাজ করছেনা। দর দর করে ঘামছি আমি, ঠিক বুঝতে পারছিনা আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। কোন দিকের প্লাটফর্ম থেকে ট্রেন যাবে রোমে! আমার মাথা এবার সত্যিই বন বন করছে। কোথায় কার কাছে জানতে পারব! এর মধ্যে একটু পর পর ঘন্টা বেজে উঠছে আর একটা করে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। লোকজন আমার পাশ কাটিয়ে আমাকে ঠেলে ঠুলে চলে যাচ্ছে। আচ্ছা সত্যি সত্যি আমার ট্রেন চলে যাচ্ছে নাতো! সময় তো হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের অন্যমাথা পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে একজন রেলওয়ে কর্মীকে পেলাম সে স্প্যানিশের মত খানিকটা কি কি বলে আমাকে আঙুল দিয়ে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকটা দেখাল। আমি আবারো দৌড়ে ওদিকে গেলাম। এবার বয়সে তরুন একটি ছেলেকে দেখে আমার টিকেট দেখিয়ে মরিয়া হয়ে জানতে চাইলাম। টিকেটের দিকে চেয়ে সে বলল এই তো তোমার ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে!----- বলে কি! বাজনা বাজিয়ে ট্রেন দুলে উঠেছে! ওই ওই --ট্রেন চলে যাচ্ছে! আরে হেইইই ট্রেন চলে যাচ্ছে! চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে আমার মাথা গুলিয়ে উঠছে ওহ ! আমার হার্ট এটাক হয়ে যাচ্ছে।

চিৎকার করে এক দৌড়ে একশ গজ পার হয়ে গেছি। ট্রেন চলছে সাথে আমিও। একটা অলৌকিক হাত আমার সুটকেস সহ আমাকে টান দিয়ে এক ঝটকায় তুলে নিলো রথে! তোমা হতে বহুদূরে ! মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম! 
আমি যাচ্ছি রোমে।

ট্রেনে তো উঠে বসেছি। বুক ধড়ফড়ানি এবার একটু বন্ধ হয়েছে। চারিদিকে চেয়ে দেখতে ভাল লাগছে। এমন সুন্দর ট্রেন! চমৎকার বসার সিট, পরিস্কার ঝকঝকে। যাত্রীরা ভদ্র আবার অনেক গুলো সিট খালিই পড়ে আছে। এরি মধ্যে সীটের সামনের দিকে নীচে আউটলেট পেয়ে ফোনটাও চার্জে দিয়ে দিয়েছি। বসেছি খালি একটা সারিতে। ঠিক মুখোমুখি দুই সারি ওই পাশে বসেছেন ইটালিয়ান এক ভদ্রলোক। চোখাচোখি হতেই সে মিষ্টি করে হাসে, একবার দুবার আমিও হাসি। এই সৌজন্যতার খাতিরে হাসি আর কি। তারপরে আর তাকাইই না।

ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাত দেখি কোন এক স্টেশান থেকে লোকজন উঠে ভরে গেছে সব সারিগুলো। টিকেট সহ আমার সিটের প্যাসেঞ্জারও হাজির। বাংলাদেশে বাস বা ট্রেনের কথা মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে 'সরি' 'সরি' বলে দাঁড়িয়ে গেলাম। আসলে তড়িঘড়ি করে আর নিজের টিকেটের দিকেই তাকাইনি। একটু লজ্জাই পেলাম অন্যের সীটে আরামসে বসে ঘুমিয়ে পড়ার মত কান্ড করেছি আমি! উহ আমার বোকামীর আর শেষ নেই।

এবার সেই ভদ্রলোক ডেকে বললেন তাদের সারিতে একটা সিট খালি আছে চাইলে সেখানে বসতে পারি। আমার টিকেট চেক করে দেখি ওটা আসলে আমারই টিকেট নাম্বার। তো আর কি করা, আবারো সেই হাসি! হ্যাঁ সেই হাসি দিয়ে ওখানেই বসলাম। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে ব্যাগ ট্যাগ টেনে আবার ওখানেই আনলেন। এইবার তিনি হাসি হাসি মুখে গল্প জুড়ে দিলেন। কেন আমার অমন লেট হল ট্রেন ধরতে, জানতে চাইলে আমি ভালো করে ওনার দিকে চেয়ে দেখি আরে! এই তো সেই লোক যিনি আমার বাক্স পেট্রা সহ আমায় টেনে তুলেছিলেন। এইবার হাসতে হাসতে ইটালিয়ান ভাষায় কি যেন বললেন! আমি না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে বললেন 'আমার ধন্যবাদ কই।' এতক্ষনে আমি জোরেই হেসে উঠলাম। কি লজ্জার কথা। তুমি আমাকে টেনেটুনে এই জয়রথে না তুল্লে তো আমার যাওয়াই হত না আজ। আর আমি কিনা তোমাকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেলাম! বাকি পথ ওনার সাথে গল্প করে করে চললাম। জানলাম উনি ইতালির একজন কবি! আহা আনন্দে মন ভরে গেল বললাম কবিতা শোনাও, ইতালীয় ভাষায় তার কবিতা শোনালে আমিও স্মৃতি থেকে আমার কবিতা 'ও যমুনা' পড়ে শোনালাম।

জানালায় বসেছি কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখছি ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আদিগন্ত খোলা মাঠ সূর্যমুখীর হাসিতে হিল্লোল তুলে। ফসলের শেষে মরা হলুদ রঙ বুকে নিয়ে শুয়ে আছে ক্ষেত। কখনো ছুটছে সবুজে ভরা নবীন প্রান্তর, ইলেক্ট্রিক তারের পোল গুলো ছুটছে দ্রুত কোথাও যাবার আছে বলে। আর আকাশ! ছুটছে নীলাকাশ, অনন্ত অসীম। ট্রেন চলছে কিন্তু আমি যেন শুনতে পাচ্ছি জুলিয়াস সিজারের ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ আর দেখছি সন্ধ্যার আকাশ। রোমের রক্ত করবির রঙে রেঙেছে সে আকাশ।

সহযাত্রী ভদ্রলোকের ফোন চেয়ে নিয়ে একবার জাকারিয়াকে কলও করলাম। আমার বেশ আগেই উনি নেমে যাবার সময় পই পই করে বলে গেলেন ঠিক আর কয়টা স্টেশান পরে আমাকে নামতে হবে।

রোমের রেল স্টেশনে নামব আমি। রোম টারমিনাল। ওদের ভাষায় রোমা তেরমিনি। এই তেরমিনি শব্দটি আমাকে হাসিয়ে ফেলল। আমার ছোট বেলার বন্ধু ছিল দু'জন মিনি। বাড়ির সামনে একজন আর কয়েকটা বাড়ির পরেই আর একজন, দুইমিনি হলেও হত, তা না তের মিনি! আবার তেরোমিনিও নয়। তেরমিনি।৷ মনে মনে ঐ একমিনি,দুইমিনি, ফেরমিনি, তেরমিনি করতে করতেই চললাম।

এই রোম রেল স্টেশানের ইতিহাসের সাথে জড়ানো আছে, ইতালির কুখ্যাত স্বৈরশাসক মুসোলিনির নাম। ১৯২২ সালে যখন মুসোলিনি ৩৯ বছর বয়সে ইতালির প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি কিন্তু ইতিহাসের এই ভয়ংকর মুসোলিনি হন নাই। পার্লামেন্টারি সিস্টেম বিলুপ্ত করে আবার যখন সে নিজেকে ড্যুক হিসেবে ঘোষনা করে একনায়ক তন্ত্রের মুকুট মাথায় পরেন তখনই তার অধঃপাতের শুরু। তো সেই শুরুর দিকের মুসোলিনি চেয়েছিলেন সারা ইতালিকে আবার নতুন ভাবে সাজাতে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে একে যুক্ত করতে। আসলে বিশ্বকে দেখাতে ইতালির সাথে সাথে তার নিজের উত্থান। বিশাল এই রেল স্টেশন তখন আবার নতুন করে সেজে ওঠে। তৈরি হয় বিখ্যাত পাঁচটি মার্বেল পাথরে তৈরি ইতালির ম্যাপ। তোম তেরমিনি এক সুবিশাল স্টেশান। অনেকে মনে করেন মুসোলিনি এদেশের নাগরিকদের অনুভব করাতে চেয়েছিলেন ওরা কত ক্ষুদ্র। বিশালের পায়ের কাছে দিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে যাতে ক্ষুদ্র মনে হয়, জনগনকে দিতে চেয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্রতার অনুভব।

এইতো! ট্রেন এসে গেছে রোমা তেরমিনিতে। আমি নেমেছি ট্রেন থেকে। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে চির বন্ধু জাকারিয়া। সাথে ওর পরির মত মেয়েটা। এইবার কিন্তু আনন্দে আমার কন্ঠ বুজে আসছে। আমার চোখ শিশিরে ভিজছে।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ