মৃত্তিকা মাইতি'র গল্প : শোল মাছের জীবন

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। সারাদিনই। বিকেলের দিকে ধরেছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। সামনের রাস্তার খানিকটা জায়গা নিচু। জল জমে আছে। দাঁড়িয়ে চটিটা খুলে হাতে নিল বাবু। এই পেরিয়েই ঘর ফিরতে হবে। আসার সময়েও পেরোতে হয়েছিল। একেই মেজাজটা বিগড়ে আছে। তার ওপর এই।

এক ভাড়াটেকে সারদাময়ী লেনে ঘর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল বাবু দালাল। পছন্দ হয়নি ঘর। না হওয়ার কিন্তু কোনও কারণই ছিল না। স্বামী-স্ত্রী থাকবে। একটা ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম। আর কী চাই! ঘরের মধ্যে ফুটবল তো খেলবে না! তবু লোকটা বলল, ‘দেওয়ালগুলো ভিজে ভিজে কেন? ড্যাম্প আছে না কি?’ 

হ্যাঁ, ড্যাম্প যে আছে তা বাবুও জানে। বর্ষাকালে এদিককার অনেক বাড়ির দেওয়ালই জল টেনে নেয়। তা ভাড়াটে থাকবে তো এগারো মাস। গরমের সময় ওইটুকু স্যাঁতসেতে ভাব চলেও যাবে। তখন তো বলবে না দেওয়াল কেন শুকোল। তাছাড়া ভাল বাড়ির ভাড়াও ভাল। কম পয়সায় রাজার বাড়ি তো পাওয়া যাবে না রে বাবা। 

বাইরে এসে লোকটা বলল, ‘আর কিছু নেই আপনার হাতে?’ 

লোকটাকে হাতে রাখা দরকার। না হলে অন্য কোনও চিল মাছ তুলে নিয়ে যাবে। বাবু ভাবার ভান করল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ‘ওপরে অ্যাসবেস্টস তো চলবে না আপনাদের? ঘর কিন্তু ভাল ছিল। জল-কল সব সেপারেট।’ 

‘না না, অ্যাসবেস্টসে খুব গরম।’ 

‘হুঁ, আচ্ছা ঠিক আছে। ছাদের ঘর হলে হবে? তিনতলার ওপরে। এও সেপারেট। বাড়িওলা দোতলায় থাকে।’ 

‘দেখান না।’ 

‘ঠিক আছে। পরশু একবার ফোন করুন। খোঁজ লাগাচ্ছি।’ 

লোকটা চলে যাওয়ার পর একটা বাড়ির বারান্দার শেডের নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বাঁচিয়ে বিড়ি ধরিয়েছিল বাবু। আসলে অন্যদের মতো ব্যবসাটা ঠিক জমাতে পারছে না সে। তার চেহারা দেখেই লোকে আসে না কাছে। একে কালো তার ওপর মাংস শুকিয়ে চামড়া ঠেকেছে হাড়ে। সিঙাড়ার মতো চোয়াল। হাসলে অন্য লোক ভাবে ঠাট্টা করছে। বাবু নামটার পরে বিশ্বাস আছে। তবে সেটা কেউ মনে রাখে না। জানে না বললেই ঠিক হয়। দালাল কথাটা নামের ওপর কুঁজের মতো উঁচু হয়ে থাকে। তাতে বাবুর মনে করার কিছু নেই। দালালকে তো লোকে দালাল বলবেই। কিন্তু তাকে বোধহয় কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। চেহারার একটা ব্যাপার তো আছেই। 

ওই যে মোড়ের মাথায় বাক্সগাড়িতে মুরগির ছাল চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রি করে পঙ্কজ। সেও তো অন্যসময় দালালি করে। রক্তের ছিটে লাগা জামাকাপড় ছেড়ে দিব্যি সাফসুতরো হয়ে বেরিয়ে পড়ে। কেমন গোলগাল চেহারা। এমনভাবে ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা বলে যেন ঝুড়ির ভেতর থেকে মুরগি বের করে দেওয়ার মতো এক্ষুনি ঘরও বের করে দেবে। তার কাছে তো লোক আসে। আর ওই যে ভরতদা। দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে, ইস্ত্রি করা জামা-প্যান্ট পরে ঘোরে। মুখে মিটমিটে হাসি সবসময়। সেও তো দালালি করেই সংসার চালাচ্ছে। এছাড়াও আছে প্র‌সেনজিৎ। কলারের জায়গাটায় সাদা একটা রুমাল দিয়ে রাখে। যখনই দেখো, মোবাইলে কথা বলছে। ওক্কে ওক্কে। প্যান্টের ভেতরে চকরাবকরা জামা গোঁজা। পায়ে সাদা জুতো। তার আবার বাইক আছে। ভাড়াটেকে পিছনে বসিয়ে সাঁ করে বাড়িওলার বাড়ির সামনে নিয়ে পৌঁছে যাবে। এমন সব কায়দা বাবুর নেই। অন্য দালালরা তাকে পোঁছে না। নিজেরা জোট বেঁধেছে। একই ধান্দায় করে খাচ্ছে। বাবুকে দেখতে পেলেই শরীর টেনে সটকে পড়ে। যদি বা কখনও মুখোমুখি হয়ে যায়, মুখ-চোখের ভাব এমন করে, বাবুর মনে হয় ভেতরে অ্যাসিড জমেছে ওদের। ঠিক হজম করতে পারছে না। 

দু’একটা ফ্ল্যাট ভাড়া দেখে দিলেও কিছু টাকা আসে। কিন্তু হচ্ছে কোথায়? ন’মাসে ছ’মাসে একটা জোটে। সেখানেও গেরো আছে আজকাল। বাড়িওয়ালারা ফ্ল্যাটের ছবি তুলে ছেড়ে রেখেছে নেটে। সেখানেই দেখে নেয় ভাড়াটেরা। ডাইরেক্ট ফোন করে কি চলেই যায়। মাঝখানে কেউ নেই। এখন অবশ্য দালালরাও নেটে নিজেদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছে। পার্টি পেয়ে যায়। বাবুর ওসব নেই। বোতাম টেপা ফোনে শুধু কথা শোনা আর বলা। তার ভাগ্যে যেসব বাড়ি জোটে তার কোনওটায় জলের কল রাস্তায়, কোথাও খাওয়ার জল কিনে খেতে হয়, কোনও ঘরের সিলিংয়ে রং করা দরমা লাগানো, কোনও বাড়ির ছাদে রেগুলার হনুমানদের মিটিং বসে, কোথাও বাড়িওয়ালা অষ্টপ্র‌হর গামছা পরে ঘোরে। টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে, আদিগঙ্গা পেরিয়ে হরিদেবপুর, কবরডাঙার দিকে আসতে এরকম বাড়ি কম নয়। 

ভাড়াটিয়াগুলোও হয়েছে সেয়ানা। যা-ই দেখাক, পছন্দ হয় না। আলো ঢোকে না, জলের প্র‌বলেম, ইলেকট্রিকের ইউনিট দশ টাকা কেন? হাজার নখরা। আরে বাবা, থাকবি তো ভাড়া। অ্যাডভান্স কর, ঢুকে যা। তা নয় । মাঝখানে অন্য কেউ লোক ঢুকিয়ে দিলে দালালিটা মার যায়। 

ড্রেনের কালো জল রাস্তায় উঠে এসেছে। প্লাস্টিক ফেটে বেরিয়ে আবর্জনা, ছেঁড়া কাপড়, সিগারেট-বিড়ির টুকরো, চিপসের প্যাকেট, বাতিল কনডোম, ঘুরপাক খাচ্ছে। সেসব থেকে পা বাঁচিয়ে জল ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছে বাবু। এদিকটায় খানিকক্ষণের বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। তবু তো ফ্ল্যাট ওঠার বিরাম নেই। এরকম আরও কত জঞ্জাল জমতে জমতে তাদেরই ওপর একদিন নতুন বিল্ডিং তৈরি হয়। এই রাস্তার দু’পাশে তারা দাঁড়িয়ে। আলো জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে। কোথাও থেকে ভেসে আসছে টিভির আওয়াজ। ছপছপিয়ে জল পেরিয়ে যায় বাবু । 

ফিরবে শরৎপল্লি। হেঁটেই মারবে সে। নামেই বাবু। বাবুয়ানা কিছু নেই। থাকে কলোনিতে। ওপার বাংলা থেকে এসে সেই কোনকালে যারা জমি দখল করেছিল তাদের সকলেরই ঘরদোর হয়ে গেছে এতদিনে। তার বাপ এখানকার লোক হয়েও কিছু করতে পারেনি। চিরকাল ভাড়াবাড়িতেই কেটে গেল। একসময় ফ্যান তৈরির কারখানায় কাজ করত। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখানকার বাজারের কোনায় ছোট্ট দোকান। যেসব জিনিস অন্য কেউ রাখে না তার বাপ সেইসব জমিয়েছে। দেড় টাকার শ্যাম্পুর পাতা, দু’টাকার টমেটো শস, ছোট পেস্ট, ছোট সাবান, প্লাস্টিকের কৌটোয় গুঁড়ো মশলা। তাতে কাঠের গুঁড়ো মেশানো। বলতে গেলে সারাদিন মাছি তাড়ায়। অন্য সব রানিং দোকান ছেড়ে ওই টিন চাপানো ঝুপড়িতে কখনও লোক যায়! যারা যায় তারাও বাবুদেরই মতো হবে। ভেজাল কেনে। কিন্তু বড় বড় দোকানে কি ভেজাল জিনিস বিক্রি হয় না! হয়, ভেজাল ছাড়া জীবন চলে না। দোকানটা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে পারে না বাবু। তবু যা হোক কিছু হাতে আসে। বছর দশেক আগে মা মরে যাওয়ার পর ওই দোকান। 

তবে মাঝে মাঝেই বাপটা দোকানে না গিয়ে ঘরে বসে থাকে। ঠিক ঘরে নয়। বারোয়ারি উঠোনের এক কোণে একটা টুলের ওপর ঝিমোয়। বাবুর বউ তো সুবিধের নয়। তখন তার মুখনাড়া চলতে থাকে সমানে। এখনও কাচ্চাবাচ্চা হয়নি। হলে হয়তো তার দিকে মন পড়ে থাকত। বাবু জানে, ব্যাপারটা নিয়ে বউকে আশপাশের কথা হজম করতে হয়। সেজন্যই বোধহয় তার মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে থাকে। তাছাড়া সারাদিন ঘরের কাজও আছে। বাসন ধুতে গেলেও পুকুরে যেতে হয় বউটাকে। ঘরে জলের ব্যবস্থা নেই। টাইমের জল। রাস্তা থেকে ধরতে হয়। রাগের অনেক কারণ আছে পুতুলের। দু’কথা শোনালেও নিজের মুখে তালা এঁটে চুপ করে থাকে বাবু। কিন্তু ঘরে গেলেই বউটার ক্যাচক্যাচানি শুরু হবে। প্র‌থমে বলবে, এটা নেই, ওটা নেই। তারপর বলবে, ‘তোমার বাবা আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করছে।’ ‘তোমার বাবা কুলকুচি করে এঁটো জল উঠোনে ফেলেছে।’ 

মাসের আট তারিখ। বাড়িওয়ালা আসবে। কলোনির জমিতে যে ঘর তুলেছিল সেই ঘরে ভাড়া বসিয়ে নিজে অন্য জায়গায় থাকে। মাসের শুরুতে বাতেলা ঝাড়তে আসে। ওই তো শালার একটা ঘর। ইটের ওপর ইট বসিয়ে সিমেন্ট গোঁজা। ওপরে টালি দিয়ে কাজ সেরেছে। বাপকে শুতে হয় সরু বারান্দায়। প্লাস্টিক দিয়ে জায়গাটা ঘিরে দিয়েছে বাবু। বর্ষা এসে গেছে। তেড়ে বৃষ্টি এলে রাতে ঘরের এ কোনা থেকে কোনা বিছানা টানতে হয়। শালা সেই ঘরের ভাড়ার আবার তাগাদা। সারাতে বলে বলে মুখে থুতু উঠে গেলে তবে যদি কাজ হয়। আর ভাড়ার বেলায় বাড়িওয়ালা চটির ফিতে ছিঁড়ে ফেলবে তবু দু’দিন সবুর করবে না। 

মোবাইলে ঘড়ি দেখল বাবু। ন’টা বাজে সবে। কোনও লোক হাঁটছে না রাস্তায়। মাঝে মাঝে অটো, বাইক, সাইকেল চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে জল ছিটিয়ে। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সে। একটাই ছাতা। ঘরে রেখে বেরোতে হয়। শুধু মাথা বাঁচাতে একটা প্লাস্টিকে ভরে দিয়েছে সেটা। 

কলোনির পুকুরে পা ধুয়ে শরৎপল্লির গলিতে ঢুকে পড়ল বাবু। এখানে এখনও একটা পুকুর টিকে আছে। আগে গোয়ালারা গরু-মোষ ধোয়াতে নিয়ে আসত বলে বোধহয় নাম মহিষপুকুর। এই সময়টায় জলে টইটুম্বুর হয়ে থাকে। ঘাটের দুটো ধাপ বাদে বাকিগুলো জলের তলায়। চারপাশে অনেক পুকুরই তো ভরাট হয়ে বাড়ি উঠে যেতে দেখল সে। কোনটা যে ভাল তা বুঝে উঠতে পারে না বাবু। পুকুরটায় সকালে কিছু লোক স্নান করে, বিকেলে গা ধোয়। বুড়োরা পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করে। গরমকালে জলেভেজা হাওয়া বয়ে যায়। কিন্তু অনেক লোকের থাকার জন্য তো অনেক বাড়ি দরকার। অনেক বাড়ির জন্য অনেক জমি চাই। পুকুরের জলের নীচে জমি আছে। তাও চাই। জমির দালালি হয়, বাড়ির দালালি হয়। এসব না থাকলে দালালরা যাবে কোথায়? করবে কী? 

ল্যাম্পপোস্টটা বাঁয়ে রেখে এগিয়ে গিয়েছিল বাবু। দু’পা পিছিয়ে আসতে হল। আরে! আর একটু হলেই চোখ থেকে ফসকে যেত। এ যে জ্যান্ত একটা শোলমাছ! তুই ব্যাটা এখানে? পুকুর থেকে উঠে এসেছিস? নেচে উঠে মন নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করেছে। তিনজনের হয়ে যাবে। এক টুকরো বেশিও হতে পারে। দিনটা যত খারাপ মনে হয়েছিল ততটা তো নয় তাহলে। 

নর্দমার জলে শোলমাছটা লেজ নাড়ছে। চারপাশে নজর ঘুরিয়ে নিল বাবু। কেউ কোথাও নেই। পোস্টের হলুদ আলোয় বৃষ্টির রং হলুদ। ঝুঁকে পড়ে বার দুয়েক চেষ্টার পরেই খপ করে ধরে ফেলল মাছ। হাতের মধ্যে পাকাচ্ছে সেটা। হড়কে যাওয়ার চেষ্টা? শরীরের ভেতরে রক্ত শিরশির করছে বাবুর। 

এখন যদি লঙ্কা, টমেটো দিয়ে ঝাল করে খাই তোকে? কেমন লাগবে? তোর ভাল লাগবে না জানি। আমাদের লাগবে। কিন্তু তাই বা খাব কী? লঙ্কা একশো, টমেটো পঞ্চাশ টাকা কিলো। আগে তো সেসবের জোগাড়। তারপর তোর ঝাল। এই বাজারে শ্বাস ফেলতে গেলেও টাকা লাগে। 

বউটা আজ খুশি হয়ে যাবে। কিন্তু বাপটাকে দেবে কি? ওই হচ্ছে তার দোষ। সারাদিন খিটখিট। আমার ওপর রাগ বাপের ওপর ঝাড়ে। যেখান থেকে যাই এনে দিই, বুড়োটাকে দেয় না। বাপের বাড়ি থেকে এনে খাওয়াচ্ছে? তবে আজ বাবু বলবে। ঝগড়া হলে হবে। মাছ নিয়ে তাহলে ঘরেই যাবে বাবু? 

এখনও তড়বড় করছে শোল মাছটা হাতের মুঠোয়। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে সে জিজ্ঞেস করল, ‘নালায় এলি কেন মরতে?’ তারপর নিজেই উত্তর দিল, ‘না, তুই আর কী করবি! নাকের ওপর জল উঠে গেলে কতজন ছটফটাচ্ছে এদিক ওদিক নর্দমায় পড়ে। চল দেখি।’ 

মাছটা নিয়ে আবার পুকুরে ফেরত গেল বাবু। উবু হয়ে বসল ঘাটে। দুটো হাতই বাড়িয়ে দিল জলের ওপর। খানিকটা যেন হেসে উঠল। ‘তোর তো নিজের বাড়ি। ছেড়ে দিলে দালালিও পাব না। কী আর করি! যাঃ, নিজের ঘরে যা।’ 

গুব। একটা শব্দ এল। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ