সৎকার
শৈত্যপ্রবাহের কারণে হাসপাতালের ভাঙা জানালা দিয়ে শো শো করে বাতাস ঢুকছে। বিছানায় শুয়ে বাবা আমাকে জিগ্যেস করলোÑ
- জীড়েন রস পাওয়া যাবেরে মা? রস খেলে শরীর গরম হয়।
- খেজুরের রস, বাবা?
-হ্যাঁ।
-আমি বললাম, চেষ্টা করে দেখতে পারি, খেতে চাও?
-একটু হালকা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বাবা বললো, হ্যাঁ।
মোবাইল টিপে যোগেন কাকুকে ফোন দিলাম। উনি আমাদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর থাকেন। বাবার বন্ধু। তাঁর বাগানে ৬০টা খেজুর গাছ আর বেশ কয়েকটা চন্দনগাছ আছে। যোগেনকাকু গাছগুলোর খুব যতœআত্তি করেন। রসের ব্যবসাও মন্দ না। কেউ আজকাল তেমন একটা বাগান করতে চায় না। তার উপর মাটির যা অবস্থা, বারোটা খেজুর গাছ মিলে এক হাড়ি রসও হয় না। এসব কারণেই কাকুর ছেলেরা পেশা বদল করে অন্য ব্যবসায় নেমেছে। রতন কাকুই ছিল শেষ গাছি। গগনচারী মানুষ ছিলেন তিনি। তরতর করে সে গাছে উঠে যেত আবার তেমনি ছলাৎ ছলাৎ করে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে আসতো। আজকাল এই রকম গাছির বড়ই অভাব। নিতাই-রতন-যোগেন তিন বন্ধু ছিল হরে আত্মা। ওদের সকলেই এখন ষাটের কোঠায়। বন্ধুত্ব আগের মতন নেই। তবে গতানুগতিক যোগাযোগটা আছে।
বাবার কাছে গল্প শুনেছি, একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে রতন কাকুর কোমড় ভেঙেছিল। হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল প্রায় এক মাস। যোগেন মÐলই চিকিৎসার খরচ জুগিয়েছিল। বাবা আর রতন কাকু গ্রামের একই স্কুলে প্রাইমারি পড়েছে। খবর দিলে সে রস নিয়ে ছুটে আসবে। কিন্তু যোগেন মÐল পাক্কা হিসেবী। স্বার্থ ছাড়া সে এক টাকাও খরচ করবে না। তবে গুলপট্টি মেরে আনলেও আনা যেতে পারে তাঁকে।
মোবাইল থেকে যোগেন কাকুকে যখন ফোন দিলাম, তখন উনি হাটে যাবার আগে গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। গ্রামের মানুষ এখন আর বাজারের চা ছাড়া কাজ শুরু করে না। গুড়ের চা হারিয়ে গেছে কবে। এখন তারা স্যাকারিনের প্যাকেট ঢেলে দেয় চায়ে। ঘনীভ‚ত কৌটার দুধ হলে সেও লাগে না।
ফোনে চিৎকার করছি, কাকু... কাকু আমি মৃত্তি বলছি, নিতাই মÐলের মেয়ে, চিনতে পারছো?
- হ্যাঁ...হ্যাঁ...পারছি, পারছি... কেমন আছিসরে মা...?
- আছি, কাকু...বাবা হাসপাতালে, হার্ট এটাক করেছে। খেজুরের রস খেতে চাইছে। এখানে তো জোগাড় করা মুশকিল। তুমি কি পাঠাতে পারবে?
মনে মনে ভাবছিলাম, যে চালবাজ লোক, এখুনি হয়ত কোনো বাহানা দাঁড় করাবে।
- ওপাশ থেকে কণ্ঠ শোনা গেল, কোন হাসপাতালে?
- হার্ট ইন্সটিউট কাকু, আমি তোমাকে ঠিকানাটা টেক্সট করে দিচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি পারো, পাঠিয়ে দাও। যত টাকা লাগে আমি দেবো।
-আচ্ছা মা, চিন্তা করিস না... সব ঠিক হয়ে যাবে...
যোগেন মনে মনে ভাবে, এক হাড়ি কাঁচা রস ১০০ টাকা। তিন হাড়িতে মোট ২৪ কেজি। জাল দেয়ার পর সেই রসে ২ কেজি গুড় হবে। গুড়ের দাম না হলেও তিনশ থেকে চারশো টাকা। আসল পাটালি লন্ডন, কাতার, সৌদি আরব, এমনকি আমেরিকা পর্যন্ত যায়। চল্লিশ বছর ধরে তাঁর পাটালির ব্যবসা। এখন গাছ কমে গেছে বলে ব্যবসা সিকেয় উঠেছে। ঢাকায় রস পাঠানোতো আর কম ঝক্কি না। আসা যাওয়ার খরচ আছে। আর তাছাড়া পাঠাবার লোক কই? রতন ইদানীং আঙুলের দাগে দাগে টাকা গুনে। বাজারে দোকানও দিয়েছে একটা চৌরাস্তার মোড়ে। সেটা ছেড়ে কোথাও সে যাবে না। যোগেন তাঁর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি চুলকায় আর ভাবে। ছেলেপুলে তো একটাও লেখাপড়া করলো না। এমনকি ধান কেটে ফেলা জমিতে যে শীতের সবজি চাষ শুরু হয়েছে তাতেও ওদের মন নেই। একসময় নিতাই আর রতনই ছিল সব। ওরা চাষবাসে সাহায্য করত। নিতাই পড়াশুনা করে ঢাকায় চলে গেল। রতন গুড়ের ব্যবসা আর দোকান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিতাইয়ের এখন দুঃসময়। সাহায্য করাই উচিত। কিন্তু ওর কাছে কি আর খরচের টাকা নেয়া যাবে?
২.
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে পড়ছি। পলিটিক্যাল সায়েন্সে। মা গত হয়েছে অনেক আগে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি প্রাইমারি শিক্ষক। নাম নিতাই মÐল। তাঁর টাকা-পয়সার অভাব সবকালেই ছিল, এখনও আছে। বাবা আর আমি দুজনেই টিউশনি করে বাড়তি আয় করতাম। মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং এর ছোট্ট একটা ফ্লাটে আমাদের বাসা। পাশের পাড়ার অম্বিকা মাসি একবেলা এসে আমাদের বাড়িতে রান্না করে দিয়ে যায়। সেই খেয়ে বাপ-বেটির সংসারটা ভালোই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ বাবার হৃদপিÐে আক্রমণ হওয়াতে বিরাট একটা বিপদ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ল। ডাক্তার কিন্তু পই পই করে বলে দিয়েছিল, রক্তে সুগার লেভেল ঠিক না রাখতে পারলে কিন্তু অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু বাবার যে চার্বাকীয় একটা মন আছে, সেই মনটা সহজে কারো কথা শুনতে চায় না।
সরকারি হাসপাতাল। বাবার বিছানার পাশে আরো পাঁচ ছয়টি বিছানা। প্রতিটি বিছানার চারপাশ জুড়ে চাদর দিয়ে ঢাকবার ব্যবস্থা আছে। দালাল ছাড়া বা উচ্চপদস্থ সরকারি কেউ না হলে কেবিন পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। সাধারণ মানুষ বারান্দাতেই জায়গা পায় না। অম্বিকা মাসির সাথে হঠাৎই দেখা হলো হাসপাতালের বারান্দায়। বেশ কয়েকদিন ধরেই সে বাড়িতে আসছিল না। স্বামীর অসুখ। কোনো রকমে তোষক পেতে বারান্দায় শুইয়ে রেখেছে তাঁকে, সিট পায়নি, স্যালাইন চলছে। স্বামীর পাশে বসে পানের পাতায় চুন আর খয়ের ঘসছে। তারপর কৌটা থেকে হাকিমপুরী জর্দা আর সুপারি মিশিয়ে পুরো খিলিটা সে মুখে পুরে দিলো। আমাকে দেখেই চোখ বড় বড় করে দৌড়ে এলো। ময়মনসিংহের টানে সুরে সুরে জিগ্যেস করলো, “এইডা কিতা কও? হেই দিন না বালা মানুষটারে দেইক্যা আইলাম...! কিতা আর কইতাম, আমার স্বামীরও শইলড্যা বালা না”, বলে সে মাথা ঘুরিয়ে বারান্দার শেষ প্রান্তে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আমি বললাম, “কিছু জানাওনি কেন? কবে আসছো এখানে? কী হইসে উনার?”
“হার্ট এটাক করসেগো মা”, বলে আঁচল টেনে মুখের ঘাম মুছলো সে। পরিবেশটা একটু গুমোট হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাসি। আমার অপেক্ষা করার মতো অবস্থা ছিল না। বাবার দেখাশোনা করার ছেলেটাকে বাজারে পাঠাতে হবে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছেলেটা আঁশহীন গোপালভোগ আম নিয়ে এলো। বাবা সেই আম খুব তৃপ্তি করে খেলো। অম্বিকা মাসির স্বামীকেও দেয়া হলো। আম খাওয়ার সময় বাবা হাসিখুশিই ছিল। স্কুলের সহকর্মীরা তাঁকে দেখতে আসছে। ঘুরে ফিরে অম্বিকা মাসিও বার বার আসছে। পান খাওয়া লাল ঠোঁটের গোলগাল অম্বিকা মাসিকে দেখলেই বাবার মুখটা ঝলমল করে উঠছে। খাওয়া শেষ হলে বাবা বাথরুমে গেল। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে বিছানায় এলো। তারপর আমাকে জিগ্যেস করলো, “হ্যাঁরে মা... যোগেন কী রস পাঠাচ্ছে?”
আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম।
তারপর হঠাৎই বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। ডাক্তার এসে নেবুলাইজার ঠেসে ধরলো নাকের ওপর। বাবা কিছুতেই সেটি নিতে চাইছিল না। অস্থির অস্থির করে আমার ডান হাতটা চেপে ধরে থাকল। আমি রাগ হয়ে বললাম, “বাবা, ডাক্তার সাহেবের কথা শোনো।” বাবা কিছুই শুনছিল না। প্রচÐ রেগে নাক থেকে নেবুলাইজারটা সরিয়ে দিচ্ছিল বার বার। তারপর হঠাৎ লম্বা একটা টান দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। সেই শেষ।
আমি বোঝার চেষ্টা করলাম, দমটা আবার ফিরে আসে কিনা। নাকের কাছে হাত রেখে, বুকের মধ্যে মাথা পেতে দেখলাম। ধুক ধুক শব্দটা কি সত্যিই চলে গেল? ঠিক বুঝতেই পারলাম না একটু আগের সেই জীবন্ত মানুষটা কেমন করে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল! বাবা লাশ হয়ে পড়ে রইল বিছানার ওপর। থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার শরীর। ডাক্তাররা এসে নাড়ি ধরে তাঁকে মৃত ঘোষণা করল।
আমার শরীরের কাঁপুনিটা যেন বেড়ে গেল। ছুটে বারান্দায় গিয়ে দেখি অম্বিকা মাসির স্বামী বিছানায় পেশাব করে দেয়াতে সে মহাবিরক্ত হয়ে বিছানার কাপড় ঝাড়ছে। আমার দিকে তাকাবার সময় নেই তার। বাইরে তখন বিকেলের আলো মরে যাচ্ছে। আকাশে লালচে মেঘগুলো সরে যাচ্ছে দূরে। হাসপাতালের বয় এসে বাবাকে লাশঘরে নিয়ে গেল। অন্ধকার তালাবদ্ধ ঘুপচি ঘরে বাবার লাশ পড়ে থাকলো প্রায় ঘণ্টাখানেক। ডাক্তারের সার্টিফিকেট হলে তবে আত্মীয়স্বজনের হাতে তাঁকে তুলে দেয়া হবে। এর মধ্যেই অম্বিকা মাসি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে গেল।
৩.
খুব ভোরেই আমরা শবদেহ নিয়ে রওনা হলাম পিরোজপুর, গ্রামের বাড়িতে। একটু পর পর অ্যাম্বুলেন্সের পেঁপু পেঁপু শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছিল। শীত এখনও জেঁকে বসেনি। কিন্তু ঘন কুয়াশায় ফেরি বন্ধ। এদিকে পেটেও ক্ষুধা। ড্রাইভার আর আমরা কয়েকজন মিলে ঘাটে গরম রুটি, সবজি আর মিষ্টি দিয়ে নাস্তা সাড়লাম। অ্যাম্বুলেন্সে লাশ শুয়ে আছে। ফেরিঘাট থেকে ওপার যেতে বড়জোর ২০ কি ৩০ মিনিট লাগে। কিন্তু ঘন কুয়াশায় পার খুঁজে পাওয়া না গেলে ঘণ্টা দুয়েকও লেগে যেতে পারে। আজ সে রকম কুয়াশা পড়েছে। হিমেল হাওয়ায় ভিজে যাচ্ছে গায়ের চাদর। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি গাছ। ছনের ঢিপি। নদীর ওপর দীর্ঘ ফেরিঘাট পেরিয়ে পরবর্তী গন্তব্য।
ফেরিতে জায়গা নেই। ওজন কমাবার জন্যে লাশ ড্রাইভারের সাথে একা একা গাড়িতে গেল। আমাদের নৌকোতে উঠতে হবে। আমি কয়েকজনকে নিয়ে ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকায় উঠলাম। যেতে যেতে দেখলাম ছোট ছোট নৌকায় করে মাঝিরা কাঁচা শাকসবজি, তরিতরকারি বিক্রি করছে। বড় বড় মিষ্টিকুমড়া পাশের ডিঙায় ভেসে ভেসে যাচ্ছে। কৌত‚হল আঁটকাতে না পেরে মাঝিকে জিগ্যেস করলাম,
- কিনবেন না বেচবেন?
- বেচমু, বলেই সে ‘মেয়েমানুষ এত প্রশ্ন করে’ এমন একটা টিটকারির ভাব করে তাকিয়ে রইল।
- নৌকায় ভাজাপোড়া বিক্রির আয়োজনও আছে। গুড়ের পিঠা, ডালের বড়া, চা সব ব্যবস্থাই আছে।
- আমি জিগ্যেস করলাম, “ও কাকা, খেজুরের রস আছে?”
উনি আঙুলের ইশারায় দূরের বাগান দেখিয়ে বললেন হুইযে... যোগেন মÐলের বাগানে খেজুরের রস পাইবেন। ম্যালা রস!
আমি দূরে যতদূর তাকানো যায় তাকিয়ে দেখি। খেজুর বাগান খোঁজার চেষ্টা করি। যোগেন কাকুকে খুঁজে বের করতেই হবে। বাবার শেষ ইচ্ছাটা সে পূরণ করেনি। রস পাঠায়নি। এলাকার সকলেই দেখছি তাঁকে এক নামে চেনে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে কেউ তার সাথে মেশে না।
৪.
বেলা প্রায় পড়ে গেছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। বাড়ির পেছনে খালপাড়ে শ্মশানঘাটে সব ব্যবস্থা শেষ। গ্রামের লোকেরা বাবাকে এমনভাবে সাজিয়ে গুজিয়ে তৈরি করেছে যেন শোকের কোনো ব্যাপারই নেই। যেন উৎসব লেগেছে, এমন ভাব। আত্মীয়স্বজনরা এসে ভিড় জমিয়েছে বাবাকে শেষবারের মতন দেখবে বলে। এরমধ্যে যোগেন মÐলও এলো। আমি তাঁকে কাছ থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। লোকটা দেখতে অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র প্রফেসর শঙ্কু টাইপ। শুধু একটু মোটাসোটা গাট্টা গোট্টা। মাথায় একটা বিশাল টাক। তাঁর হাতে ধরা ছিল এক হাঁড়ি খেজুরের রস। ভীষণ বিষণœ আর ভারাক্রান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। পকেটওয়ালা ঘিয়া রঙের ফতুয়া আর ধুতি পরে আছে সে। পায়ে প্লাস্টিকের চটি। ক্ষণে ক্ষণে তাঁর বা হাতটা দিয়ে বেজায়গায় ধূতিটাকে পুটুলি করে রাখছে। চেহারাটা বড্ড উসকো খুসকো। দেখে মনে হচ্ছে দুদিন কিছু খায়নি। ঠিক করেছিলাম অনেক কিছু বলবো তাঁকে। ভর্ৎসনা করবো। আবার ভাবলাম, কীই-বা হবে এসব বলে। যে চলে গেছে তাঁকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
শুধু তাঁকে ডেকে বললাম, “কাকু, রসের হাঁড়িটা একটু দূরে সরিয়ে রাখো।”
উনি খুব গম্ভীর স্বরে মিনমিন করে বললো, “সৎকারে লাগাবো।”
আমি কোনো দিন সরাসরি চিতায় পোড়ানো দেখিনি। মেয়েদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ না দেওয়ার একটা রেওয়াজ আছে এই এলাকায়। অবশ্য অন্য এলাকার কথা আমার জানা নেই। মা, মাসিরাও দেখেছে বলে শুনিনি। তবে বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান রাজনীতিবিদের দেহ যখন চন্দনকাঠে শুইয়ে পোড়ানো হচ্ছিল, তখন ইউটিউবে সেই ভিডিওটা দেখেছিলাম। সে কি ভয়াবহ দৃশ্য! লোহার চত্বরে চন্দন কাঠের উপর মাথাটা উপুত করে দিয়ে শরীরটা নিচের দিকে শুইয়ে দেয়া। তারপর মুখাগ্নির পরই এক এক করে হাত পা মুখ সব পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া।
বাবার শরীরটা সেই রকম পটপট শব্দ তুলে জ্বলবে, ভাবতেই প্রচÐ কষ্ট হচ্ছিল আমার। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে, জীবিত অবস্থায় যোগেন কাকু বাবাকে রস পান করায়নি, এখন তাঁর মৃতদেহ নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন?
রাগ সামলাতে পুকুরপাড়ে মুক্ত জায়গায় একটু হাঁটতে গেলাম। মা গত হয়েছেন অনেক আগে। আমি ওঁদের একমাত্র সন্তান। প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনেরা বিলাপ করছে, করুক। সেই শব্দ আমার কানে পৌঁছোচ্ছে না। এরা কেউ জীবিত অবস্থায় বাবার জন্য কিচ্ছু করেনি। এসবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। সবাই বলল, দাহের আগে ঘি মাখিয়ে বাবাকে স্নান করানো হবে। তারপর চন্দনকাঠে পোড়ানো হবে। চন্দন কাঠ শুনে একটু বিস্ময় প্রকাশ করলাম! বাবা কি এতকিছু চেয়েছিল? তাহলে চন্দন কাঠ কেন? রতন কাকু আমাকে বলল, যোগেন কাকুর খেজুরের বাগানে দুর্লভ কয়েকটা চন্দন গাছ আছে। এই গাছ চুরির বহু চেষ্টা করেছে প্রতিবেশীরা। কিন্তু মÐলের কড়া নজর। কিছুদিন আগেই নাকি দুটো গাছ রাতে চোর এসে কেটে দিয়ে গেছে। কিন্তু সময়মতো সরাতে পারেনি। সেই গাছ কেটে টুকরো টুকরো করে যোগেন মÐল মাচায় তুলে রেখেছে। কিপটা যোগেনের ঘাড় ভেঙে সেই কাঠ নামাবে গ্রামের লোকেরা।
এসবই যোগেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে এসব টুকটাক কথা শুনে খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম।
দেহ চিতায় স্থাপন করার অপেক্ষায়।
হঠাৎ দেখি, যোগেন কাকু লাশের কাছে গিয়ে বাবার মুখ বরাবর মাটির হাড়ি থেকে রস ঢালছেন। খেজুরের রস।
আমি চিৎকার করে উঠলাম...।
সর্বনাশ! কাকু কী করছো এসব? কী করছো?
ততক্ষণে রসের হাড়ি শেষ। বাবার মুখটা হা করা খোলা। রস ঢুকেছে মুখের ভেতর। আমি দেখলাম, লোকজন উত্তেজিত হয়ে রেগেমেগে যোগেন মÐলকে শক্ত করে ধরে শ্মশানঘাট থেকে বের করে দিচ্ছে। আমি দেখছি হৈ চৈ পড়ে গেছে চারদিকে। সকলে মিলে যোগেন কাকুকে টেনে টেনে শ্মশানের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। উনি ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছেন পশ্চিম দিক বরাবর।
এর পরপরই হঠাৎ শুনি চিতার আশেপাশে হৈ চৈ! সবাই বলছে লাশ কই? লাশ কই? আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি বাবা নেই। মানে, বাবার দেহ নেই। এবং এর পরপরই লোকজন ভয়ে ছুটে পালাতে শুরু করলো। কে কোনো দিক পালাবে তার হিসেব নেই! সে এক অদ্ভুত দৃশ্য বটে। পুরোহিত মন্ত্র পড়া ফেলে দিলো একটা লম্বা ভোঁ দৌড়! আমি এমন ঘটনা শুনেছি যে, সুন্দরবনের জঙ্গলে ছেলের সামনে মায়ের লাশ তুলে নিয়ে যায় বাঘ। কিন্তু এই বাড়ির আশেপাশে তো একটি কাঁকড়া পর্যন্ত নেই! তাহলে? এটা কী করে সম্ভব হলো?
৫.
গল্পটা এখানেই শেষ করা যেত।
বাবা কোথায় হারিয়ে গেল সেসব কিছুই না বললে আপনারা হয়ত নিজেদের মতো করেই গল্পের শেষটা সাজিয়ে নিতে পারতেন। অথবা গল্পটা আরো দুঃখজনক হতো যদি লিখতাম, আমি দূরে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি দেখছি। পুরোহিত নির্লিপ্তভাবে চোখ বুঁজে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য কল্পনায় দেখছি। দাহের সময় আগুনের উত্তাপে দুমড়ে-মুচড়ে দেহটা বার বার শোয়া থেকে উঠে বসছে, আর অস্থির অস্থির করছে। মনে হচ্ছে, বাবা যেন চিৎকার করে বলছে, “আমাকে পোড়াসনে, পোড়াসনে! মৃত্তি... ওদের থামা! থামা!” বাবার হাতে পুজোর লাল সুতোটা তখনও জ্বলছে! আর পুরোহিত বলছে, “মৃতদেহ আগুনে সৎকারই উত্তম। আপনি গতকাল মারা গেছেন। এটা মেনে নিন। এ সময়ে কথা বলা অন্যায়।”
কিন্তু গল্পটাকে আমি শোক বানাতে চাইনি। এটা শোকের গল্প নয়।
আসল ঘটনা যা হোলো সেটি না বললে গল্পের প্রতি অন্যায় করা হবে।
খালপাড়ে শ্মশানঘাটে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর শেষপর্যন্ত বাবাকে পাওয়া গেল আমাদের মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে, উঠোনের কোণায়, রান্নাঘরে। শবের কাপড় পড়ে খালি গায়ে বাবা একটা চৌকিতে বসে আছে। চোখ দুটো ফুলে ঢোল হয়ে আছে। ল্যাপ্টানো ভেজা চুল। আর পাশেই মাটির চুলোয় শলা ঢুকাতে ঢুকাতে ব্যস্তভাবে মাছ ভাজি করছে অম্বিকা মাসি। সর্ষে তেলের উপর মাছ ভাজার শ শ শব্দ ছাড়া ওই ঘরে আর টু শব্দটি নেই। আগুনের শিখায় জ্বলজ্বল করছে অম্বিকা মাসির লাল সিঁদূরের চুল।
2 মন্তব্যসমূহ
শেষাংশ দারুণ, বিস্ময়কর ও অভিনব। আরেকটু এদিকে সেদিকে কিছু কথা থাকলে পাঠকের মানসিক চাপ বোধ হয় কম হত! বর্ণনা অসাধারণ, পুরো দৃশ্য গুলো দেখা যায়, লাল সিঁদুরের চুল পর্যন্ত!
উত্তরমুছুনভালো লিখেছেন। পড়তে পড়তে ঘোর এসে গিয়েছিল।
উত্তরমুছুন