ভিক্ষা কী ও কেন?
গল্পটা মূলত স্বপনের ছোট ভাই তপনকে নিয়ে। স্বপনকে অবশ্য চেনার কথা না; তাকে কেউ হয়তো মনে রাখে নি, বহুদিন আগে যে মায়ের জ¦ালায় বউ তালাক দিয়ে আবার ভালোবাসার টানে সেই মেয়েকেই বিয়ে করে নিয়ে ঢাকা চলে যায়, তার কথা মনে রাখার কথা না; যেমন মনে রাখার কথা না মিজান কানা খুন হয়ে যাবার পর তার যুবতী বউ আর কোলের বাচ্চার কথা, তারা কোথায় গেল ৩ লাখ টাকা জীবনের বিনিময়ে পেয়ে, তা আর কেউ মনে করে না; কারণ মনে করার মতো কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট নাই, তার ভিটায় আরেকজন বাড়ি তুেলছিল, সেই আরেকজন চলে যাবার পর আরেকজন বাড়ি করেছে; এতসব বাড়ি ভাঙা আর গড়ার ভেতর দিয়ে কানা মিজানের বাড়ির সব চিহ্ন মুছে গেছে, মুছে গেছে বলেই কেউ আর তা মনে করে না;
হয়তো কারো কারো মনে পড়ে: ভাঙা চাঁদের মতো অস্পষ্ট সেই স্মৃতির আলোয় দেখা যায়: হাড় কাঁপানো এক সকালে সকলে মিজান কানার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখছে বুকের ঠিক নিচে দুই ইঞ্চি ফাঁকা দিয়ে ফেপড়া বের হয়ে ভেংচি কাটছে; ডান হাতের দুই বাতির ভেতর দিয়ে যে আঘাতটা যেতে চেয়েছিল তা খুব বেশি গভীর না হওয়ায় গরুর মাংসের মতো, আসলে, ইলিশ মাছের ওপরের অংশটার মতো খয়েরি মাংস চেয়ে আছে; আর শিশ্নে যে আঘাতটা হয়ে ছিল তা বেশি লোকে জানে না বা দেখে নি, যারা জানে বা দেখে তারা তা বলে না; কেননা, তাদের কাছে সেটা বলার মতো বলে মনে হয় না-- না জানা আর জেনেও না বলার চর্চার ভেতর দিয়ে সবকিছুর অস্তিত্ব বিলীন হতে বাধ্য; তাই মিজান কানার সেই ছোট পরিবারও বিলীন হয়ে গেছে হয়তো সময়ের গহ্বরে, যেমন বিলীন হবার পথে আছে স্বপন; তবে শরীফের কথা সবাই মনে রাখে, যে শরীফ বহু বাসনায় বহু কুমারীকে ভুট্টার ক্ষেতে প্রথম সতীচ্ছেদে সাহায্য করেছিল আর তারপর এত বেশি ওই মহান কাজে মনোযোগ দিতে গিয়ে শরীরে কিচ্ছু অবশিষ্ট না থাকার কারণে বিলীন হয়ে যাবার পথে নেমে ছিল, সে একদিন সুস্থ হয় এবং শীঘ্রই ঢাকা চলে যায়; তার আগে অবশ্য সে ধর্মের দিকে মন দেয় আর নামাজ পড়া ও দাঁড়ি রাখার অভিজ্ঞতায় যে জ্ঞান লাভ করে তার কুফলতা বর্ণনা করে এবং সুস্থ হবার পরেই ঢাকা চলে যায়; কেননা, তার বাপের ততদিনে এত বেশি ঋণ হয়ে গেছে যে বন্ধক রাখার মতো ভিটা বাড়ি ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না; ফলে দ্রুত ঢাকা চলে যায় আর দুই বছরের মাথায় আবারও হারানো দিন ফিরে পায় সমস্ত ঋণ শোধ করে এবং নতুন উদ্যমে ঘর বাড়ি করা শুরু করে, তবে সমস্ত কিছু ফিরে পেলেও একদিন কলার খেপ মারতে গিয়ে ধেয়ে আসা একটা ট্রাকের ধাক্কায় জীবন সে ফিরে পায় নি; তবে সে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে করাতের মতো হা করা আর ফাঁক ফাঁক করা দাঁত আর পচা তরমুজের মতো ঘিলু বের হওয়া মাথাসহ নতুন একটা আকৃতি আর নতুন একটা জগতে চলে যাবার অফার পেয়েছিল; আর এরপর থেকেই পরিবারের সব দায়িত্ব শরীফের ওপর পড়ায় সে প্রায় মাসে আসে আর যায়, শরীফের এই আসা যাওয়ার পথে অনেকের সাথে কথা হয়, শরীফ এটা প্রমাণ দিতে পারে যে সে আছে, নাই হয়ে যায় নাই; তবে কানা মিজানের বউ-বাচ্চা কোনোদিন আসে না, হয়তো আর কোনোদিন আসবেও না, যেমন আসে না স্বপন, তার মায়ের দিনরাত গালাগালির জন্য, সেও হয়তো আর কোনো দিন আসবে না; কেননা, বহুবার এসে বহুভাবে তার মাকে এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, সে যদি একটু ভারি হয় তাহলেই তাকে আর পরবাসে থাকতে হয় না; নিজের লোকদের সাথে থাকতে পারে; কিন্তু সে বারবার উপেক্ষিত হয়েছে আর গালাগালি করতে করতেই চোখে পানি নিয়ে অভিযোগ করতে থাকা তার মাকে দেখে সে আবারও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে এখানে তার আর আসা উচিৎ হবে না; অতএব স্বপন আর আসে না; আর যাদের এখানে আসা-যাওয়া নাই, যারা নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করতে পারে না তাদের ঠাঁই তাদের স্মরণ এই বিজ্ঞাপনের যুগে হবে না হয় না; হ্যাঁ, তাই স্বপন লোকেদের স্মৃতি থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আর জানা থাকা দরকার এখানে ওই স্বপনের ছোট ভাই তপনের গল্পই হবে।
হয়তো কারো কারো মনে পড়ে: ভাঙা চাঁদের মতো অস্পষ্ট সেই স্মৃতির আলোয় দেখা যায়: হাড় কাঁপানো এক সকালে সকলে মিজান কানার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখছে বুকের ঠিক নিচে দুই ইঞ্চি ফাঁকা দিয়ে ফেপড়া বের হয়ে ভেংচি কাটছে; ডান হাতের দুই বাতির ভেতর দিয়ে যে আঘাতটা যেতে চেয়েছিল তা খুব বেশি গভীর না হওয়ায় গরুর মাংসের মতো, আসলে, ইলিশ মাছের ওপরের অংশটার মতো খয়েরি মাংস চেয়ে আছে; আর শিশ্নে যে আঘাতটা হয়ে ছিল তা বেশি লোকে জানে না বা দেখে নি, যারা জানে বা দেখে তারা তা বলে না; কেননা, তাদের কাছে সেটা বলার মতো বলে মনে হয় না-- না জানা আর জেনেও না বলার চর্চার ভেতর দিয়ে সবকিছুর অস্তিত্ব বিলীন হতে বাধ্য; তাই মিজান কানার সেই ছোট পরিবারও বিলীন হয়ে গেছে হয়তো সময়ের গহ্বরে, যেমন বিলীন হবার পথে আছে স্বপন; তবে শরীফের কথা সবাই মনে রাখে, যে শরীফ বহু বাসনায় বহু কুমারীকে ভুট্টার ক্ষেতে প্রথম সতীচ্ছেদে সাহায্য করেছিল আর তারপর এত বেশি ওই মহান কাজে মনোযোগ দিতে গিয়ে শরীরে কিচ্ছু অবশিষ্ট না থাকার কারণে বিলীন হয়ে যাবার পথে নেমে ছিল, সে একদিন সুস্থ হয় এবং শীঘ্রই ঢাকা চলে যায়; তার আগে অবশ্য সে ধর্মের দিকে মন দেয় আর নামাজ পড়া ও দাঁড়ি রাখার অভিজ্ঞতায় যে জ্ঞান লাভ করে তার কুফলতা বর্ণনা করে এবং সুস্থ হবার পরেই ঢাকা চলে যায়; কেননা, তার বাপের ততদিনে এত বেশি ঋণ হয়ে গেছে যে বন্ধক রাখার মতো ভিটা বাড়ি ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না; ফলে দ্রুত ঢাকা চলে যায় আর দুই বছরের মাথায় আবারও হারানো দিন ফিরে পায় সমস্ত ঋণ শোধ করে এবং নতুন উদ্যমে ঘর বাড়ি করা শুরু করে, তবে সমস্ত কিছু ফিরে পেলেও একদিন কলার খেপ মারতে গিয়ে ধেয়ে আসা একটা ট্রাকের ধাক্কায় জীবন সে ফিরে পায় নি; তবে সে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে করাতের মতো হা করা আর ফাঁক ফাঁক করা দাঁত আর পচা তরমুজের মতো ঘিলু বের হওয়া মাথাসহ নতুন একটা আকৃতি আর নতুন একটা জগতে চলে যাবার অফার পেয়েছিল; আর এরপর থেকেই পরিবারের সব দায়িত্ব শরীফের ওপর পড়ায় সে প্রায় মাসে আসে আর যায়, শরীফের এই আসা যাওয়ার পথে অনেকের সাথে কথা হয়, শরীফ এটা প্রমাণ দিতে পারে যে সে আছে, নাই হয়ে যায় নাই; তবে কানা মিজানের বউ-বাচ্চা কোনোদিন আসে না, হয়তো আর কোনোদিন আসবেও না, যেমন আসে না স্বপন, তার মায়ের দিনরাত গালাগালির জন্য, সেও হয়তো আর কোনো দিন আসবে না; কেননা, বহুবার এসে বহুভাবে তার মাকে এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, সে যদি একটু ভারি হয় তাহলেই তাকে আর পরবাসে থাকতে হয় না; নিজের লোকদের সাথে থাকতে পারে; কিন্তু সে বারবার উপেক্ষিত হয়েছে আর গালাগালি করতে করতেই চোখে পানি নিয়ে অভিযোগ করতে থাকা তার মাকে দেখে সে আবারও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে এখানে তার আর আসা উচিৎ হবে না; অতএব স্বপন আর আসে না; আর যাদের এখানে আসা-যাওয়া নাই, যারা নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করতে পারে না তাদের ঠাঁই তাদের স্মরণ এই বিজ্ঞাপনের যুগে হবে না হয় না; হ্যাঁ, তাই স্বপন লোকেদের স্মৃতি থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আর জানা থাকা দরকার এখানে ওই স্বপনের ছোট ভাই তপনের গল্পই হবে।
ঠিক কী কারণে তপনের গল্পে স্বপন আসে তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এটা অনুমান করা যেতে পারে যে তপনের নাম কেউ জানে না; সে এমন একটা চরিত্র যার ব্যাপারে সবাই জানে, যে সবার চোখের সামনেই বিরাজ করে কিন্তু তার নাম কেউ জানে না; তপনের গল্পে স্বপন আসার আরো সব কারণের একটা কারণ: স্বপন-- তপনের বড় ভাই; এবং পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার কারণেই কি-না; এবং তার ভেতর লোকদের ঠাট্টা তামাশা কোনো জেদ জন্ম দিয়েছিল কি-না; নাকি সে এমন কোনো ধাতু দিয়ে গড়া যে তার পূর্ব পুরুষদের জীবিকাকে অস্বীকার করতে চায়, এবং তার বাপ মা কেউই তা না করলেও তারই ছোট ভাই তপনের ভেতর যে প্রতিভার জন্ম হয় যা তার পূর্ব পুরুষদের জীবিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তা নিয়ে ভাবতে গেলেও স্বপনের কথা আসে; কী কারণে এসেছে তার চেয়ে বড় কথা হল তার কথা এসেছে; তপনের নাম যখন কেউ নিজেদের স্মৃতি হাতড়ে পায় না তখন মনে পড়ে তপনের একটা বড় ভাই আছে স্বপন, আর স্বপনের নাম যখন স্মরণে আসে তখন তপনের নামও মনে আসে যে তার নাম আসলে তপন; কিংবা এমন কিছু যা স্বপনের সাথে মিলে যায়।
যাই হোক তপন এমন একটা মানুষ যার নামের চেয়ে কাম বড় হয়ে ওঠে; তার নাম মনে না রাখলেও তার কাম মনে থাকে, আর তার কামের ভেতর দিয়ে যেহেতু শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পারা ও কথা বলতে না পারা একজন অস্বাভাবিক মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় তাই তার নাম নির্ধারণ হয়ে যায় পাগলা; যদিও এটা নিশ্চিত করা যায় না যে তার এইসব বৈশিষ্ট্যের জন্য তার নাম পাগলা হওয়া উচিৎ কিনা; কেননা, তাকে কখনো উলঙ্গ দেখা যায় নি বা এমনও নয় যে তার কোনো বন্ধু বা শত্রু নাই, শত্রুকে শত্রু বলে চিনতে যেমন ভুল করে না, বন্ধুকে বন্ধু বলে চিনতেও ভুল করে না; যাদের বয়স এক থেকে একত্রিশ তারা কেউ কোনোদিন তাকে থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট আর গেঞ্জি ছাড়া দেখেছে, অথবা সে আরো ছোট ছিল-- এটা কেউ মনে করতে পারে না; একটা চিত্রই সবার মনে ভাসে, যেন সে এই অবস্থায় মায়ের পেট থেকে পড়েছে: ঘোর কালো একটা তরুণ যার ডান হাতটা বেঁকে পেছন দিকে মুখ করেছে, মাথাটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু চিকন, ডান দিকে সামান্য বাঁকা-- হেলে দোলে, চুলগুলো কাকতাড়–য়ার, নাক-মুখ-চোখ দিয়ে লালা বা শাদা জাতীয় কিছু না কিছু পড়ছে, হাঁটে টেঙ্গুস পেরে বা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে-- অধিকাংশ সময় বাজারে বা রাস্তায় আর সেটা কারো না কারো সাথে ঝগড়ারত অথবা ছোট বাচ্চারা পেছন থেকে ঢেলাচ্ছে আর সে তাদের তাড়িয়ে ফিরছে অথবা বাজারে বড় দোকানদারদের বা ঘাটে যাত্রীদের কারো কাছে ভিক্ষা করা অবস্থায়; আর তাছাড়া তার নাম পাগলা হওয়া নিয়ে সন্দেহ হবার আরো কারণ হল তার সচেতনতা বা হিসাবজ্ঞান; পাগলাকে কেউ ঠকাতে পেরেছে বা টাকা মেরে খেয়েছে এমনটা হয় নি, সে লোক সম্মুখে হাগে না মোতে না, যেখানেই থাকুক রাত হলে ঠিক বাড়ি ফিরে যায়; আর সবচে বড় কথা সে সিগারেট খাওয়া শিখেছে; পাগল সিগারেট খেতে পারবে না ব্যাপারটা ঠিক তেমন না; আবার সিগারেট খাওয়া ব্যক্তিমাত্রই পাগল-- তাও না; তবে এটা ধারণা করা যেতে পারে প্রত্যেক সিগারেট-খোরই তার সিগারেট খাবার পেছনে যুক্তি সাজায়, সে মূলত পিনিকের জন্য সিগারেট খায় বা দুঃখ ভোলার জন্য আরেকটা দুঃখ রচনা করে; আর ঠিক এই যুক্তি ধরেই তপনের ব্যাপারে প্রশ্ন জাগে, সে কেন সিগারেট খায়? সেকি তার এই অবস্থা সম্পর্কে অবগত, আর অবগত বলেই তার ভেতর দুঃখ জন্ম হয় আর সে এই দুঃখ ভোলার জন্য আরেকটা দুঃখ তৈরি করে?
ঘোড়া বিষয়ক রূপকথা
এই গল্পটা হবে ঘোড়াঅলা নিয়াজের ছেলে তপনকে নিয়ে; এটা সেই নিয়াজ, যে নিয়াজের ঘোড়া পালা নিয়ে এলাকার লোকেরা মজা নেয়; নিয়াজকে সামনে পেলেই এলাকার লোকেরা ইশারা করে ঘোড়া কি খ্যাপ মারার জন্যই রাখে; নাকি বউয়ের জন্য; কেননা, ঘোড়া দিয়ে টাকা উঠুক আর না উঠুক, যত দুর্যোগ আর দুর্দিনই হোক ঘোড়া নিয়াজের নিত্যসঙ্গী, নিয়াজ আছে তো ঘোড়া আছে, ঘোড়া আছে তো নিয়াজ আছে; তাও আবার তাগড়া তাগড়া শক্তিশালী সব ঘোড়া; কিন্তু নিয়াজ, এক সময়, সাধের সেই ঘোড়াও ছেড়ে দেয়; কিন্তু ঘোড়া তো ছাড়লই, দুর্নাম রটার পর।
একবার হয়েছে কী, শরবানু গেছে ঘোড়াকে পানি খাওয়াতে; ঘোড়া কি করেছে কাম আর পায় নি, মনে হয় উঠেছে কুরকুরি, শরবানুর গালে দিয়েছে কামড়! আর যায় কোথায়? ঘোড়া কামড় দিলে সহজে ছেড়ে দেয় না; শরবানুও সহজে ছাড়া পায় নি; পাশের বাড়ির শফিক চাবুক নিয়ে এসে পেটানো শুরু করলে ছেড়ে দেয়; ঘোড়া ছেড়ে দিলেও ঘোড়ার দাঁতের দাগ তাকে ছাড়ে নি; এই দুঃখে এই রাগে এই ক্ষোভে নিয়াজ ঘোড়া ছাড়ে; কিন্তু এলার লোকেরা তাকে ছাড়ে না। রসিয়ে রসিয়ে নানান গল্প বানায় এবং এইসব গালগল্প বানাতে বানাতে তারা এক সময় ঘোড়ার দাঁত বিষয়ক রূপকথার দিকে যায়, যে রূপকথায় সমস্ত চতুষ্পদ প্রাণীকুলের এক মজলিসে যাবার কথা আছে; সেই মজলিসে ঘোড়া দাওয়াত খাবার আগে নিরীহ প্রাণী গরুর সাথে বেইমানি করে, যেহেতু গরু তার প্রতিবেশী, পাশাপাশি গোয়ালে তারা বাঁধা থাকে এবং গরু বিষয়ক রচনা তার জানা ছিল সে কারণে ঠকানোর জন্য গরুকেই বেছে নেয় এবং তারা একসাথেই বসে; সবাই সার সার হয়ে বসার পর সাইদারীরা সবাইকে দাঁত দেয়, প্রত্যেকের ভাগে সমান সমান করে দাঁত পড়ে; কিন্তু ঘোড়া গরুকে তিরস্কার করে বলে তোর খাবারের জন্য তো এত দাঁতের দরকার নাই, তুই কিছু দাঁত আমাকে দিয়ে দে; এত খেয়ে কী করবি, খেয়ে খেয়ে তো খালি নাদাস আর বাচ্চা বিয়াস, কাজের কাজ তো কিছু করতে পারিস না; দে আমাকে দে; নিরীহ গরু হাম্বা হাম্বা তো দূরে থাক টু শব্দটিও না করে ওপরের দাঁতগুলো দিয়ে দেয়;, এই কারণে গরুর ওপরের দাঁত নেই; গরু ত্যাগে শান্তি পায় ঠিকই; তবে মনে মনে আল্লার কাছে বিচার দেয়; কিন্তু ঘোড়ার হয় বিপদ সে তো দাঁত বেশি পায়, পাওয়ার পরই ঝামেলাটা বাজে; আল্লা ঠিক মতো বিচার করে: মাঝে মাঝেই তার দাঁত হ্যাং হয়ে যায়; কাজ করে না; বিশেষ করে মানুষকে কামড় দিলে আর ছেড়ে দিতে পারে না; আর তার সাক্ষ্য স্বরূপ আবারো প্রমাণিত হয় শরবানুর গালে।
লোকেরা ঘোড়া বিষয়ক রূপকথায় মজা পায়; আর তাই আরো বেশি বেশি রূপকথার আশ্রয়ে যেতে চায়; তারা আবার ওই রূপকথায় ঢুকে যায় যে রূপকথায় সমস্ত নর-প্রাণীকুলকে শিশ্ন বেছে নিতে বলা হলে ঘোড়া স্রষ্টার প্রিয় এবং অনুগত হবার কারণে সবচে বড় শিশ্নটা বেছে নেবার সুযোগ পায় আর তার এই আহম্মকির কারণে তার জীবনে খুব অল্প সংখ্যক বার সঙ্গমের সুখ লাভ হয়; এবং প্রত্যেক বারে তার মাথায় পানি ঢালার প্রয়োজন পড়ে; এবং শিশ্ন প্রধান সমাজে এই ঘটনা যুক্তি হিসেবে দাঁড়ায়, যদিও ঘোড়ার চেয়ে তাদের শিশ্ন অনেক ছোট তবুও তারা অনেক সঙ্গম করতে পারে; আর এই কারণেই তারা বলে বেড়ায়-- ছোট মরিচের ঝাল বেশি।
“ক্যা শালী ঘোড়া ছাড়লি ছাড়লি আগে ছাড়লে তোক কারা গুয়া মারত?” -- এমন সব বাক্য শোনার পর এবং তা আর না শোনার জন্য খুব দ্রুত নিয়াজ বাড়ি ভাঙে। বাড়ি ভাঙুক আর যাই করুক, পাগলার আনন্দ বাজার ছাড়া আর হয় না। সে বারবার ফিরে আসে। কেন কিসের টানে কে জানে। সে হয়তো বারবার ফিরে আসে তার শৈশবের কাছে। যদিও তার শৈশব এমন কোনো সুস্থ সবল আনন্দে হেসে গড়াগড়ি যাওয়া শৈশব নয়। তারপরও প্রত্যেকের কাছে তার সেই ভাঙা, তার সেই লালা ঝরা, তরকারির স্বাদ সামান্য বেশি পাবার জন্য তেছপাতা চাটা, মাছের চাকা কিংবা গোশতের একটা টুকরা নিয়ে মারামারি করা, আর মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফেরা শৈশবই শ্রেষ্ঠ শৈশব; আর তাই হয়তো সে তার শৈশবের কাছে ফিরে ফিরে আসে।
ইলেকশন সমাচার
বাস্তবে গল্পটা শরবানুর ছোট বেটা তপনকে নিয়ে; এটা সেই শরবানু যে প্রত্যেক ইলেকশনে প্রার্থী হয় এবং প্রত্যেক বারই হেরে যায়; শরবানু এমন মহিলাদের অন্তর্গত যাদের বাজারে যাতায়াত বেশি আর যারা ক্ষমতাবানদের সাথে সুসম্পর্ক রাখে। শরবানুর কিছুটা খ্যাতি আছে, আর তা যতটা না পাগলার জন্য তার চেয়ে বেশি নিজের ঈর্ষনীয় স্বাস্থ্য আর পুরুষসুলভ আচরণ ও বাজখাই গলার জন্য। এমন পুরুষ কমই আছে, যে শরবানুর সাথে সহজে লাগতে চাইবে; কেননা, এর আগে অনেকেই তার জাতা খেয়েছিল আর তার বেশির ভাগই পাগলাকে ট্যাংলানোর জন্য।
নির্বাচন করে শরবানু এলাকায় কোনো উন্নতি করতে পারবে বা করে ব্যাপারটা সেরকম না হলেও প্রতি বারই নির্বাচন করে এবং হেরে যায়; হারা জেতা বড় কথা নয়--নির্বাচনে অংশ গ্রহণই বড় কথা বলেই মানে সে, আর এ ব্যাপারে হয়তো তার কোনো ধারণাও নেই যে নিজে উন্নত না হলে কেউ উন্নয়ন করে দেয় না; বা করে না দিলেও উন্নয়নের জন্য সহায়ক হয় তার রাস্তায় বাধা হয় না,-- এতসব হয়তো তার বোঝার কথা না; আর বোঝা-না-বোঝার ধার না ধেরেও যেহেতু নির্বাচন করা যায় আর তার অধিকাংশই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা আর ছোট জাত থেকে বড় জাতে ওঠার চেষ্টা, সেই হিসেব ধরে হয়তো শরবানুও নির্বাচন করে। কেননা, শরবানু যদিও স্বামী সংসার নিয়ে সচ্ছ্বল; কিন্তু তার শরীরে বয় সরদার বংশের রক্ত যা কিনা তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় নদীভাঙা কটাপুইর্যা ভিক্ষুক, সে হয়তো তার এই অপমানজনক উপাধী বদলাতে চায়, কারণ তার দেখা হয়ে গেছে আগে গোয়াল ছিল এখন চেয়ারম্যান, আগে ম্যাথর ছিল এখন মেম্বার-- আর এসবই নির্বাচনের কেরামতি; গোয়ালকে আর কেউ গোয়াল ডাকে না, চেয়ারম্যান সাব ডাকে; ম্যাথরকে আর কেউ সুইপার কয় না, মেম্বার সাব কয়।
সব পাগলে হল মেলা
গল্পটা হওয়ার কথা আনন্দ বাজারের একমাত্র পাগল তপনকে নিয়ে; কিন্তু গল্পের এ পর্যায়ে এসে বিপদে পড়তে হচ্ছে; ঠিক কীভাবে গল্পটা এগিয়ে নেওয়া যাবে সেটা ভেবে; কেননা যে গল্পের জন্য গল্প, সেই গল্পটা ঠিক কীভাবে শুরু হল কার হাত ধরে সেটা বলা সম্ভব না; সম্ভব না কারণ, আনন্দ বাজার বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের বাজারের মতোই বাজার-- এখানে সব ধরণের জিনিসের জন্য আলাদা আলাদা সারি সারি এওড়া কেওড়া দোকান বাদেও এক দুটা বটগাছ, টিনের দোচালা আর মেঝে পাকা সরকারি দুটা ভিত্তিসহ আরো যেসব বৈশিষ্ট একটা বাজারের থাকা দরকার তা আছে; এবং আরো একটা জিনিস বেশি আছে-- যোগাযোগের জন্য ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল; আর গল্পটা মূলত এই মোটর সাইকেলঅলাদের হাত ধরেই; যেহেতু অন্তত ৩০ টা মোটরসাইকেল প্রতিদিন যাতায়াত করে, এবং শত শত মানুষের নিত্য আসা যাওয়া, সুতরাং এই কারণেই কোন মোটরসাইকেলে কার সাথে কবে থেকে গল্পটা শুরু হল সেটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না।
আগে জেনে আসা গেছে আনন্দ বাজারে আর নিয়াজের বাড়ি নাই; তবে বাড়ি যেখানেই থাক, পাগলার মন সেখানে নাই; তার মনে পড়ে থাকে আনন্দ বাজারে, তাই পাগলা প্রতিদিনই আনন্দ বাজারে আসে এবং রাত হলে বাড়ি ফিরে যায়; কিন্তু কোন একদিন আনন্দ বাজারে আসে; তবে বাড়ি আর ফেরে না, কোন এক মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে বসে এবং কোন এক রাত কোথায় যেন কাটিয়ে দেয়; যে-রাত কোনো এক অজানা জায়গায় কাটিয়ে দেয় সেই রাত বাদে দিনে আনন্দ বাজারের লোকেরা খুব আনন্দ পায়; তারা কোনোভাবে জানতে পারে পাগলা গত রাতে কোথায় ছিল; তারপর সবাই গল্প উদ্ধারে নেমে যায়; যদিও এটা ভাসা ভাসা সবারই জানা; পাগলারই চাচাতো বোনের সাথে পাগলার বিয়ের কথা ছিল; এবং সেই চাচার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াতও ছিল; কিন্তু বিয়ে হবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না; বিয়ে না হবার আশঙ্কা একদিন সত্যি হয়ে যায় এবং পাগলার চাচাতো বোনের বিয়ে হয়ে যায় আর পাগলা ঠিক এই সময়ে পাগলা হয়ে যায় আর তার গল্পও এখান থেকেই শুরু হয়।
পাগলা কীভাবে পাগলা হয়ে যায় তা কেউ টের পায় না; তবে চাচাতো বোনের বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে তাকে আর আগের মতো হাসি খুশি দেখা যায় না; আগের মতো আর ভিক্ষাতেও মনোযোগী হয় না; কেউ কিছু দিলেও আর খেতে চায় না কিংবা কারো সাথে মারামারিও করে না; ধুম মেরে বাজারের এককানিতে বসে থাকে; এ সময় মোটরসাইকেলঅলাদের কারো চোখে পড়তে পারে, ঠিক মোটরসাইকেলঅলাদের চোখেই পড়তে হবে তাও না, কারো চোখে হয়তো পড়েছিল কিংবা কারো খটকা লেগেছিল; কাছেও হয়তো গিয়েছিল, আর তার হয়তো জানাও ছিল, চাচাতো বোনের সাথে পাগলার কিছু ছিল, সে হয়তো একটু ফইসক্যা টাইপের ছিল; তাই হয়তো বাম হাতের দুই আঙ্গুল গোল বানিয়ে ডান হাতের এক আঙ্গুল দিয়ে বিষয়টা বোঝাতে চেয়েছিল, সেই সময় হয়তো পাগলার মুখে হাসি দেখা গিয়েছিল, সেটা কি লজ্জার, না বুঝতে পারার বা স্বীকার করার তা জানা হয়তো সম্ভবও না; আর সেই ব্যক্তি, বা মোটরসাইকেলঅলা বা কোনো ফইসক্যা বা ভাদাইম্যা টাইপের কেউ তাকে চিন্তা থেকে মুক্ত করার নিমিত্তে হয়তো মোটর সাইকেলের পেছনে তুলে দিয়েছিল আর কোন এক মোটরসাইকেলঅলা হয়তো জেলা সদরের শুঁটকিহাটে নিয়ে গিয়েছিল এবং এরপর থেকে পাগলাকে আবারো স্বাভাবিক লাগছিল।
পরিচিতি:
হুসাইন হানিফ
জন্ম: ০২/০১/১৯৯৯
সারিয়াকিন্দ, বগুড়া
0 মন্তব্যসমূহ