
-কী করবে ? তুমি নয়াবাদে ফ্ল্যাট কিনে নাও । ওটাই বেস্ট হবে মনে হচ্ছে। কিনছে অনেকেই ।আমার পরিচিত মিসেস মজুমদারের মেয়ে থাকে ডালাসে। দেশে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে এই সেদিন। নয়াবাদেই কিনল। আবার ডালাসে একটা বাড়ি কিনেছে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে। বিরাট বাড়ি নাকি ! পেছনের খানিকটা জমি পড়ে আছে দেখে ওর শ্বশুর গিয়ে ছমাস ছলেন যখন,তখন পুরো ফসল ফলিয়ে এসেছেন। হা হা হা ! পুঁইমাচা,চাল কুমড়ো , শসা ...! প্রচুর সর্ষে শাক ! সে খুব গল্প করলেন ! মন খারাপ লাগছে ভদ্রলোকের। বলছিলেন-ফের কবে যাব ! জমিটা নষ্টই হয়ে গেল কিনা...! যাহোক,এসব থাক এখন,তুমি ফ্ল্যাট কিনেই নাও। বুঝলে ?
-না দিব্যদা , মাটি কিনব , বাবার মাটির সখ ছিল । পারেননি । আমি কিনব ।
দিব্যদা অল্প ভাবলেন – তুমি কত পারবে ? জমি কিনলেই হল না । এরপর তাতে ইট , বালি , সুরকি…খরচ ভেবে বল ।
ভাবতে বসে সময় নষ্ট করেনি অরুনাভ। । অবশেষে অনেক ঘুরে ফিরে মুকুন্দপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জমি পেয়ে গেল বাজেটের মধ্যেই । বলতে গেলে লটারি পাওয়া যাকে বলে । জমির মালিক বাংলাদেশে থাকেন মূলত । একাত্তর সালে এদেশে কিছু জমি কিনেছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে । স্বজনরা ওদেশেই আছে । তাই কিছু জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন । এ অঞ্চলে এখনও শহুরে ছাপ পড়েনি । দামও ওঠেনি সেই অর্থে । মেট্রো চালু হয়ে গেলে তখন হু হু দাম বেড়ে যাবে ভেবেছে অরুনাভ । ভেবে চিন্তে কিনেই ফেলল জমিটা । কাউকে বলেনি আগে থেকে । মা , বাবা , এমনকি রাখিকেও না । কাজটা মিটিয়ে খুশ মেজাজে বাসার দিকে যাচ্ছিল ও । আক্সিলেটর কন্ট্রোল করতে করতে মিষ্টির দোকান খুঁজছিল । বাসায় সবাই রয়েছে । শুনে কী বলবে রাখি ? মা ? বাবা ?
মিষ্টি দেখে সবাই অবাক । হইচই করে উঠল রিনরিন । মাও অবাক । নাতনির চুল আঁচড়ে দিতে দিতে থমকে গেলেন- কি রে ? কি ব্যাপার ?
-জমি কিনে ফেললাম মা । মুকুন্দপুরে । তিনকাঠা।
প্রাথমিক বিস্ময় কেটে গেলে রাখির চিমটি শুরু – জমি হল । বাড়ি হবে ?
-কেন , সন্দেহ আছে ?
-নাঃ , দেখছি , তোমার ম্যাজিক কতটা কাজ করে তাই দেখছি । হলে বাথরুমে বাথটব চাই ।
অনেক কিছু চাই এখন । এর জন্য টাকা চাই । প্রথমে প্ল্যান করা চাই । দিব্যদার সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে । অফিস থেকে লোন পাওয়া যাবে । ব্যাঙ্কে আপ্লিকেশন করতে হবে । কী করতে হবে দিব্যদা জানে । দিব্যদা জ্যান্ত কম্পিউটার ।
ভোরেই বাইক নিয়ে বের হল অরুনাভ । ক্ল্যাচটা টিপে গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে হাসি পেল ওর । এতদিন কেন মনে হয়নি কথাটা ? নিলয় বসুর দোতলার ফ্ল্যাটে থাকে দিব্যদা । ভাড়া নিয়ে । নিজের জমি হয়েছে । তাই যার জমি নেই , তার জন্য চিন্তা হচ্ছে !দিব্যদা এত জানে , বোঝে । নিজের জন্য কেন কিছু ভাবেনি ? এই চিন্তাটা গত পরশুও হয়নি । মানুষ কি নিজেকে দিয়েই সব অস্তিত্বকে স্বীকার করে ?
রাস্তাটা বেঁকে যেদিকে গিয়েছে , সেদিক থেকে চিৎকারটা আসছিল । অরুনাভ ব্রেক কষবে কিনা ভাবল । কী ব্যাপার ? চারপাশেই খুব গন্ডগোল চলছে । ওদিকে আবার কী হল ?
-সব বাড়ি ভেঙে ফেলব ! সব । স-অ-ব ! দেখবি ? বলতে বলতে থান ইট ছুঁড়ে মেরেছে পুবমুখো বাড়ির জানালা লক্ষ্য করে । কে লোকটা ? শতছিন্ন জামা কাপড় ! খলবলে প্যান্টটা এই খোলে কি সেই খোলে ! পায়ে আবার জুতো আছে । ইয়াব্বড় । সাধারনত এসব ক্ষেত্রে দু পায়ে দু রকমের জতো থাকে । লোকটা সেদিক দিয়ে পারফেক্ট । সাঙ্ঘাতিক টাইপের পাগল তো ! ওই ইট সত্যি যদি জানালায় পড়তো , তাহলে দেখতে হতনা । অরুনাভ পার্ক্ পেরিয়ে যেতে যেতে দেখল ভিড় জমে উঠেছে পাগলটাকে ঘিরে । রঙ্গ-তামাশার লোক আছে । বাধা দেওয়ার কেউ নেই । নাকি পাবলিক চাইছে ঝা চকচকে বাড়িটায় একটু খুঁত হোক ? এতেই আনন্দ ! কে পাগল নয় ?
দিব্যদা বাড়িতেই ছিলেন । কানে মোবাইল সেঁটে বেরিয়ে এলেন । ইশারায় দাঁড়াতে বলে কথা শেষ করে নিলেন ।
হেসে বললেন – কি অরুনাভ ! জমির খবর শুনে সবার রিয়াকশন কী ?
-কি আর ! খুশি খুব । আপনি মোবাইল নিলেন কবে ?
হাসে দিব্যদা – এখন তো মোবাইল ওয়্যার চলছে । এটা ছাড়া সব অচল ।
ঠিক । কত যে দরকার মানুষের !
-চা খাবে তো ?
-না , আপনার সঙে দরকার । প্ল্যান দিন বাড়ির ।
-ওয়াও ! গুড নিউজ । সাহসী ছেলে । কবে চাই বল । আমার চেনা জানা আছে । দাশগুপ্ত । আচ্ছা , চলো । অবাক হল অরুনাভ । চলো মানে এখনই ? এখনও লোন নিয়ে ভাবা হয়নি !
–হবে । সব হবে । চলো ।
দিব্যদার দিকে তাকিয়ে ভক্তি হয় অরুনাভর । এরকম উদ্যোগী না হলে জীবনে কিছু করা যায় না ।পেছনে দিব্যদাকে বসিয়ে উড়ে যেতে যেতে নিজেকে বেশ দায়িত্বশীল মানুষ বলে মনে হচ্ছিল ওর । যে মানুষ জমি কিনেছে । এখন বাড়ি তৈরির কথা ভাবছে । মা , বাবা , রাখি , রিনরিন …এদের নিয়ে বাসা বাড়িতে সুখের নীড় বানানো যায় ? সেই নীড় গড়বে ভেবেই না … ।
-একটা কথা বলছি । পেছনে বসে চেঁচিয়ে কথা বলছিলেন দিব্যদা –আমার যা ধারণা আর কি । বাড়ি বানাবে , এস্টিমেট করেছ কিছু ? মোটামুটি বাজেট একটা রাখতে হবে , বুঝলে ? নাহলে , প্ল্যানিং-এ গোলমাল থেকে যাবে কিন্তু । দিব্যদার কথাগুলো বাতাসে উড়ছিল । কিছু কানে আসছিল , সবটা নয় । ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু বর্ণ মাত্র । অরুনাভ চেঁচাল দিব্যদার মত করে – দাশগুপ্ত লোকটা কেমন ?
-মানে ? রাগী কিনা ? লোভী কিনা ? সৎ না অসৎ ? ভেব না । খাটি মানুষ । দেখবে চলো ।
সত্যি তাই । হাসি খুশি মানুষ । ওরা চা খাবেনা বলাতেও ছাড়লেন না । চা এল । আড্ডার মেজাজে বাড়ি সংক্রান্ত নানা কথাও উঠল । খুচখাচ জিজ্ঞাসাও করলেন অরুনাভকে । একসময় মুচকি হেসে জানতে চাইলেন – মানুষ বাড়ি করে কেন বলুন তো ?
হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিল অরুনাভ – বাড়ি মানে মাথা গোঁজার জায়গা …একটা আশ্রয় …সম্পত্তিও হল ।
-আমার কাছে শুনুন । তিনটি কারণ আছে । হ্যাঁ , আপনি যা বললেন , তা ঠিকই , সেগুলো একনম্বর কারণের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে । দু নম্বর কারণ হল ব্যাক্তিগত বা সমষ্টিগত । যেমন ধরুন স্কুল কলেজ , মন্দির মসজিদ , হাসপাতাল …ইত্যাদি ইত্যাদি । তিন হল রাষ্ট্রগত কারণ । যেমন থানা , অফিস্ ডাকঘর । কিন্তু প্রথমটি ছাড়া অন্য দুটোয় মালিক একজন থাকতে পারছে না । অবশ্য প্রাইভেট কোম্পানি , স্কুল , হাসপাতাল একমাত্র মালিকানায় থাকতে পারে । সেটা কথা নয় । আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় এক নম্বর কারণ । তাই তো ? রাইট ?
ঘাড় নাড়ে অরুনাভ – রাইট ।
-বেশ । সন্তুষ্ট মুখে তাকালেন দাশগুপ্ত –এবার প্ল্যানিং এর কথা । প্রথমেই ওরিয়েন্টেশান । ঘরের মাপ , অবস্থিতি , বারান্দা , দরজা-জানালা , কিচেন , ওয়াশরুম …এসব কী হবে না হবে সে বিষয়ে আলোচনা…
দাশগুপ্তর ঠোঁট গাল , মাথা একই ভাবে নড়ে যাচ্ছিল । সব কথা বুঝতে পারছিল না অরুনাভ । তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা মনে এল । দাশগুপ্তর নাম কী ? সবাই কি দাশগুপ্তই বলে ডাকে ?
দিব্যদা ওর অবস্থা বুঝে উঠে দাঁড়ালেন – একটা প্ল্যান করতে হবে । অরুনাভর সঙ্গে আলাপ হয়েই গেল । ও আসবে । বাকি কথাবার্তা ওই বলে নেবে আজ আসি । দাশগুপ্তর অফিস থেকে বেরিয়ে দিব্যদার পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছিল অরুনাভ । দিব্যদা ঘাড় গুঁজে হাঁটেন । বললেন- একটা কথা বলি । আগে এস্টিমেট ঠিক কর । তাহলে প্ল্যানটা করতে সুবিধে হয় । নয়তো বেকার বাজে খরচ হয়ে যাবে ।
কথাটা মিথ্যে বলেনি দিব্যদা । অফিস থেকে লোন পাওয়া গেলে আন্দাজ হতো একটা । ব্যাঙ্কের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে ।
মা অবশ্য আশ্বাস দিলেন – হয়ে যাবে । ঘোড়া হয়েছে । জিনএর চিন্তা কী ? …বাড়ি কিন্তু দক্ষিণ মুখো করিস । খনার বচনে আছে দক্ষিন ছেড়ে উত্তরে বেড়ে / পুবে হাঁস পশ্চিমে বাঁশ ।
-মানে ? অরুনাভ ভ্রু নাচায় ।
-মানে , জমির উত্তর সীমানা ছেড়ে বাড়ি করা ভাল । তাহলে দক্ষিনে নিজের এক্তিয়ারের মধ্যেই খানিকটা খোলা জমি থাকবে । পুবে পুকুর থাকা ভাল । আর পশ্চিমের পড়ন্ত রোদ থেকে বাড়ি রক্ষা করতে ঘন বাঁশ ঝাড় লাগাতে হয় । মা বুঝিয়ে দিলেন ।
-ঠিক বলছ না । অরুনাভর বাবা নড়েচড়ে বসেন –আসলে কী হয় , কালবৈশাখী ঝড় সাধারণত পশ্চিম দিক থেকে আসে । অন্য কোন বড় গাছ ঝড়ে ভেঙে পড়লে সেটা পুবে অবস্থিত বাড়ির উপড়ে পড়বে । বাঁশগাছ ঝড়ে ভাঙে না । নুয়ে পড়ে মাত্র ।
বাঃ , বেশ লাগছে শুনতে । আসলে অভিজ্ঞতার একটা দাম আছেই । কিন্তু বাবার এত অভিজ্ঞতা হল কোথা থেকে ? সারা জীবন ভাড়া বাড়িতে থেকে এই অভিজ্ঞতা বাবা পেল কী করে ?
দিনে , রাতে , অফিসে , বাইক চালাতে চালাতে একটা বাড়ি বানাতে থাকে অরুনাভ । আপনজনদের নিয়ে মাথা গুঁজে থাকার আশ্রয় । এসব চিন্তার মাঝখানে হুটহাট দাশগুপ্ত এসে হাজির হয়ে যান । নানা পরামর্শ – ভাবছেন ভাবুন । নিয়ম করে ভাবুন । প্রথমে ভাবুন কী উদ্দেশে বাড়িটা হচ্ছে ।
-মানে ?
-কারা থাকবে বাড়িতে ?
-এটা আবার কী প্রশ্ন ? আপনজনেরা থাকবে !
-এবারে সেকেন্ড কোশ্চেন , বাড়ি তৈরি হচ্ছে কোথায় ? মাল মশলা , গৃহ নির্মাণের প্রচলিত রেওয়াজ কী ?
-তিন নম্বর ভাবনাও আছে নাকি দাশগুপ্ত ?
হাসে দাশগুপ্ত –আছে না ? সেটাই যে ভাইটাল পয়েন্ট । কোন জমির উপর বাড়ি বানাচ্ছেন ? জমির আকার , আয়তন , চারপাশের জমির অবস্থা , ভারবাহী ক্ষমতা । ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে । সমঝ গয়া ?
সমঝতে দেরি হয় নাকি ? অসব তো আছেই , কিন্তু বাড়িটা কেমন হবে ? রাখির বাথটব চাই , বাবার দক্ষিমুখো বারান্দা , মায়ের ঠাকুর ঘর । রিনের নিজের ঘর , আর সবার ঘরে বিল্ট ইন আলমারি চাই । ওয়াল ক্যাবিনেট …! নিলু কিছু সস্তা মেটিরিয়ালসের খোঁজ দেবে বলেছিল । বিকেলেই চলে গেল নিলুর ওখানে । নিলু হেল্প করল প্রচুর । ধীরে ধীরে একজন বাস্তু শিল্পী হয়ে উঠেছে অরুনাভ । রাখির অবশ্য এসবে বিশেষ উৎসাহ নেই । বাড়ি হবে কিনা এ নিয়ে ও যথেষ্টই সন্দিহান । বান্ধবীর বাড়ির গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন খেয়ে এসে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল – ইস , বাথরুমে বাথ টব থাকলে কি মজা , না ? রাখির ইচ্ছেটা ঝট করে বুকে এসে বিঁধেছিল সেদিন । মনটা বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল অরুনাভর । রাখির মনে ক্ষোভ আছে । বান্ধবীর বর শ্রাবণকে মনে মনে হিরো ভাবে ও । একজন সফল পুরুষকে নারী সম্ভ্রমের চোখেই দেখে । সেদিন শ্রাবণের সঙ্গে খুব রসিকতা করছিল রাখি । গ্রিলের ফাঁক দিয়ে রাখির হাসি দেখতে দেখতে একটুও অবাক হয়নি অরুনাভ । ঈর্ষা কি হয়নি ? এসব কথা কাউকে বলা যায় না । নিজেকে ছোট মনে হয় । কিন্তু দিব্যদা বলেছেন’এস্টিমেটিং! সেটা কী করে ঠিক করবে?ধুর,ব্রেন কাজ করছে না।অস্থির অরুনাভ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার উল্টোদিকের সদ্য শেষ হওয়া বাড়িটা দেখতে থাকে।ইদানং এই এক কাজ হয়েছে ওর। যেখানেই নতুন বাড়ি হচ্ছে বা হবে,ও গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।পরামর্শ করার লোকও দরকার। ফোন করে কি ডেকে নেবে রিমাকে? ধুস! রিমা কী পরামর্শ দেবে? তাও আবার গৃহ নির্মাণ কৌশলের ? পারিসও অরুনাভ !বড্ড একচোখো হয়ে গিয়েছিস।কী দেখলি ওই মহিলার মধ্যে?অরুনাভ ধমকায় অরুনাভকে।
-মানে? সুন্দরী নয়? বুদ্ধিমতীও। শিক্ষিতা।আধুনিক গ্যাজেট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।কম্পিউটারে ওস্তাদ।গান জানে।আর কী চাও সোনা?লালচাঁদ দেখতে চাও ?
-না, মনে হচ্ছে মোহফাঁদে পড়েছ । রাখিকে ভুলে যাচ্ছ নাকি ?
-মনে আছে।তবে কি জান,বড্ড পানসে। পুরুষের একটু প্রেরণা টেরণা দরকার। রাখিকে দেখলে না জমি কিনেছি বলে চিমটি কেটে যাচ্ছে! শালা! হতাশা ছাড়া কিছুই জানে না। কিন্তু রিমা…। ওঃ,চুলে আলগোছে হাত বুলোয় অরুনাভ। রিমাকে মনে পড়লে আশ্রয়ের স্বাদ পাওয়া যায়। সেবার সুনতালেখোলা বেড়াতে গিয়ে রিমার সঙ্গে পরিচয়।সেই পরিচয় ক্রমে গহীন হয়ে উঠছে । কাঠের ছোট ব্রিজ পেরিয়ে ফরেস্ট ডেভলপমেন্টের নেচার রিভার ক্যাম্প।ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে আসার সময় রিমাকে দেখেছিল। সী গ্রীন কালারের পালাজো পরা রিমা রাখির থেকে একেবারেই আলাদা। ফ্যাশন ম্যাগ থেকে উঠে আসা মডেল যেন…।রিমাকে মনে পড়তে মন যেন পাগলপারা । ফোন করতে হবে এখনই।
ফোন বেজে যাচ্ছে।কী করছে রিমা এখন ? স্নান? ওর হলদে প্রজাপতি শরীর …সাবানের ফেনায়…!ফোন রিসিভ করেছে রিমা।
ফরফুরে মন নিয়ে মোড়ের চারমাথার মেডিকেল স্টোর্সের সামনে বাইক পার্ক করল অরুনাভ। আর তারপরেই একসঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটে গেল ।এরকমটা হয় কিনা বা হতে পারে কিনা সেটা নিয়ে অবশ্য ভাবতে হবে অরুনাভকে।এখন সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। ওর ডানচোখ ও বা চোখ একই সময়ে দুটো ঘটনা দেখে ফেলল ।এক নম্বর ঘটনা ঘটতে ঘটতে দু নম্বর ঘটনা ঘটে গেল ।রিমা সরু গলিটা থেকে বেরিয়ে এল,তাই মোড়ের মাথার বিরাট বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে এমন বিষয় ও সেভাবে খেয়াল করতে পারল না।এখন এক অলৌকিক নারি রাস্তা পার হচ্ছে।
-এস ,হাসল অরুনাভ।
-দূরেই দাঁড়িয়ে থাকবে ? অল্প হাসি মেলে প্রত্তুতর দিল রিমা। অরুনাভ বুঝল রিমা আসলে ওকে নিরীক্ষণ করছে। টি শার্টের বুকে মধুবনি পেন্টিং,চোখে হালকা ইয়েলো গ্লাস,ক্লিন শেভড মুখ…সবটা মিলিয়ে দারুণ !অরুনাভ দেখল জিওমেট্রিক শেপের বড় কানের দুলের সঙ্গে ম্যাচ করে ব্যাংগলস , নরম ফেব্রিকের কুর্তার সঙ্গে বোল্ড প্রিন্ট পালাজো পরা রিমার ঠোঁট ব্রাইট শেডের লিপস্টিকে টসটসে।
-অরুনাভর বাইকের পেছনে বসছিল রিমা-কোথায় যাচ্ছি?
-জাহান্নামে।বলল অরুনাভ। গিয়ার চেঞ্জ করছিল ও । জাহান্নামে যাওয়ার জন্য। অনেক কথা আছে । তাই এখন চুপ করে থাক। এক সময় কবিতা লিখতো ও। ভেবেছিল সব ভুলে গেছে । যায়নি বোধহয় । রিমা সঙ্গে থাকলে কবি ছোকরা বেশ বেরিয়ে আসে প্রাণ ফুঁড়ে। খুব হাসছে রিমা। জলপরীর ডানার ঝাপটায় ভেসে যাচ্ছিল অরুনাভ । প্রথমে পরিচয় , তারপর ফ্রেন্ডশিপ , এখন ওরা কোন পর্যায়ে আছে?
-কী বলবে বলেছিলে?
-আমি জমি কিনেছি।
-বাঃ,বাড়ি করে ফেল।
চমকাল অরুনাভ। কত অমিল রাখির সঙ্গে রিমার! রিমা গড়তে জানে ।আর রাখি ?
-বাড়ি করব, পরামর্শ দাও।কুইক।
হেসে অস্থির রিমা-তুমি কি ভাব , আমি সব জানি ?
-জানো,জানো।তুমি যা জানো,আমার কাছে তাই যথেষ্ট। বল রিমার কোটে পাঠিয়ে দিচ্ছিল অরুনাভ।
-একটা এস্টিমেট করে নাও আগে। পরের গুলো তুমি ইঞ্জিনীয়ারের হাতে দাও।
বাঃ ! ঠিকই বলেছে রিমা। এ ব্যাপারে দাশগুপ্তই তো আছে। ভিষণ হালকা লাগছিল। যেন উড়ে যাবে মহাশুণ্যে।রিমার সঙ্গে মাত্র দু ঘন্টা কাটাল। যদি দু ঘন্টা অনন্তকালের অন্য নাম হত।
ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাবে রিমা। মেট্রোতে বসে তাকাল ও । দুটো যুবক সোজা তাকিয়ে রিমার দিকে । সেদিকে ইশারা করাতে হেসে ফেলে রিমা। অরুনাভ পার্ক স্ট্রিটে যাবে। ছেলেগুলো ঝামেলা না করে রিমার সঙ্গে।
অফিসে দেখা হয়ে গেল মাইতিদার সঙ্গে। বছরখানেক হল বাড়ি করেছেন।লোন সংক্রান্ত আলোচনা চলছে ।মাইতিদার যা এক্সপিরিয়েন্স জমেছে, তাতে পুরো ধরণীকে স্কোয়ার ফিটে মেপে দেখাতে পারবেন। তাঁর পরামর্শ মনে ধরল । শুনেটুনে দিব্যদাও তুষ্ট – ভালই বলেছেন। ইঞ্জিনীয়ার না হলে তুমি যদি ভাল কোন ঠিকাদারের পরামর্শ নাও, তাহলেও খারাপ নয়।মাল মশলার খরচ, লেবার-কস্ট, দেখাশোনা…তিনটি দিক রয়েছে। কিন্তু,আমার মনে হয় ওভাবে না করে শিডিউল অফ কোয়ান্টিটি থেকে বাড়ি তৈরির মোট এস্টিমেটিং ভাল । এখন ধর, তুমি যদি ঠিকাদারের সঙ্গে আইটেম রেট কন্ট্যাক্টকরো, তবে ঠিকাদারই এস্টিমেট করবে।আর যদি লেবার রেট কন্ট্যাক্ট করো,তবে তুমি মাল মশলা দিচ্ছ,মিস্ত্রি-মজুর দিচ্ছে ঠিকাদার।তাহলে ধর…
মাথা ঝিমঝিম করছিল। একসময় খিঁচিয়ে উঠল-ধুত্তোর বাড়ি !
-ছিঃ,মা মাথায় কবিরাজি তেল ঠেসে দিতে এঘরে এসেছে-বাড়ি হল লক্ষী,ধুত্তোর বলতে আছে ? চিন্তা করিস না। বাজে চিন্তায় মাথা গরম হয় , তা জানিস ?অরুনাভ মনে মনে ভাবে , কাকে বাজে চিন্তা বলে ? চিন্তার কি ভাল মন্দ হয় ?
ভাল বলেছে মা। চিন্তা করিস না ! একথা বলেনি কিভাবে ছেড়ে দেবে ! রাতে শুতে গিয়ে দেখে ঘুমিয়ে পড়েছে রিন।রাখি মুখে ক্রিম ঘষছে। আয়নাটা বড্ড পুরনো । স্যাঁতস্যাঁতে । নিজেকে অন্য লোক বলে মনে হয়।যেন অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আয়নার ভেতরে। ।অন্ধকারে সাঁতরে মরছিল অরুনাভ।
প্রথমে সোয়েটার , তারপরে শার্ট খুলতেই ম্যাজিক আলো জ্বলে উঠল যেন । রাখি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল-এই! কী হল গো ?
বুঝতে পেরে মজা পেল অরুনাভ । শার্টটা একটু ঘষাঘষি করতেই ফের ঝকমক করে উঠল আলো। রাখি ত্রস্ত –ও মা ! খুব তৃপ্তি পেল অরুনাভ। রাখি যে কিছুটা অজ্ঞ,তার জন্য কৃতজ্ঞ হচ্ছিল ও। এই অন্ধকারে সাঁতরে মরতে মরতে রাখির ওই বিস্ময় তাপ দিচ্ছিল ওকে ।
-জা ন না ? সব জিনিসের মধ্যেই ইলেকট্রিক আছে । ঘর্ষণে ইলেকট্রিক একটিভ হয় । ব্যাস !
বিছানায় দুটো মানুষ আর অন্ধকার নিজেদের মধ্যে বিদ্যুতের খোঁজ করে চলে । চেনা গল্পের রমণীটিকে নিজের বলে ভাবতে থাকে অরুনাভ । হয়তো সজ্ঞানে নয়অ।বশংবদ একটি প্রাণীর ভেতরে বিদ্যুতের খোঁজ করতে করতে দাশগুপ্তর কথা ভাবে ও।
সকাল একবার যেতে হবে । প্ল্যানটা করতে হবে। রিমাকে নিয়ে যেতে হবে ডাক্তার নাগের নার্সিং হোমে।এবারের মত ঝামেলাটা মিটে গেলে বাঁচা যায়। অথৈ জলের ভেতরে হাবুডুবু খেতে খেতে চিৎকার করে ওঠে অরুনাভ –বাঁচাও , মা …ও মাগো…!
ঘুম ভেঙ্গেও ত্রাস মুক্ত হতে পারছিল না ও। মা ঠিকই বলেন।বাজে চিন্তা !একদিকে রিমা,অন্যদিকে নানান ঝামেলায় মাথা বিগড়ে যাওয়ার দশা।
আজ সকালে মধুশ্রী এসেছিল।মাসিও আসতো। বাড়ি পাহারা দিতে রয়ে গেছে। শরিকি ঝামেলায় নাজেহাল অবস্থা ওদের। এক মুহূর্ত বাড়ি ছেড়ে থাকা যায় না।
-ছুটকিকে বলিস,একটা জমি কিনে বাড়ি করে নিতে। আমার অরুও তো তাই করছে। ভাড়া বাড়িতে আর ভাল লাগছে না। তৃপ্তিতে মাখামাখি কমলা ভটচাযের গলা।মাকে এত পরিতৃপ্ত আর কখনও দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না অরুনাভ।মধুশ্রী হতাশায় ঠোঁট ওল্টাল-ওসব আর আমাদের…!
অরুনাভ ভেবেছিল আজ অফিস কাটবে।দিব্যদার সঙ্গে দাশগুপ্তর ওখানে যাবে।কিন্তু যা ভাবা যায়,তা হয়না সবসময়।অফিসে পৌঁছে ঘন্টা খানেক ছিল।বাবুলাল এসে খবর দিল,এক মেডাম ডাকছেন। রিমার ব্যাপারটা বেমালুম হাপিস হয়ে গিয়েছিল মন থেকে।ওকে দেখে অপ্রস্তুত অরুনাভ-আজ তো তোমাকে ডাক্তার দেখাতে…
-থাক,তোমাকে আর কষ্ট করে…আমি একাই পারব যেতে। রিমা থরথর।দ্রুত চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল অরুনাভ-কী হয়েছে?
-আর কী হবে?
-আঃ,চল,চল,এত ভাবনার কিছু নেই।ডাক্তার সরকারের নার্সিং হোমে গিয়েও ভাবনা দূর হলনা।বিষণ্ণ রিমাকে নিয়ে আইসক্রিম পার্লারে ঢুকতে যাচ্ছিল।,বাধা দিল রিমা-থাক,ভাল লাগছে না।আর শূণ্যে হাঁটতে পারছিনা।দাঁড়িয়ে পড়েছে রিমা। এই স্তব্ধতা দেখে ভেতরে ভেতরে কাঁপুনি উঠল। ঝড় ওঠার আগে নাকি পৃথিবী এমন শান্ত হয় !কোন দিক দিয়ে ঝড় আসবে? সেদিকে কি বাঁশঝাড় আছে? ঝড়ে ক্ষতি করবেনা,এমন গাছ?
সারারাত ঘুম হলনা।রাখি ঘুমিয়েছে। ঘরের ভেতরে জমাট অন্ধকার। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অরুনাভ। এখানেও মাটি নেই। কোথায় দাঁড়াবে ও !কোথায় খুঁজবে মাটি?
রাত জাগা চেহারা নিয়ে ভোরে বেরিয়ে পড়ল অরুনাভ। সবাই ঘুমোচ্ছে। ওর কেনা জমি শিশির ভেজা হয়ে পড়ে আছে।এইখানে বাড়ি উঠবে।এই খানে কিচেন,ওইখানে বারান্দা,এদিকে শোবার ঘর, ওই জানালাগুলো দিয়ে দূরের রাস্তা, মাথ দেখা যাবে…এইখানে বাথরুম।বাথরুমে বাথটব…এই ঘরে লাইম পানিং করবে…বিম,স্নোপড রুফ,আর্চ,লিন্টেল,…ফুলবাগানে বাইপাস সার্জারি করে লন বের করে নেবে ।এইখানে…এইখানে… দৌড়োদৌড়ি করে এক বাস্তুসাপ। রচনা করতে থাকে একটা গর্ত। আবিষ্কার করতে করতে চিৎকার করে বাস্তুশিল্প বর্ণনা করতে থাকে।
রাখির জন্য বাথটব, বাবা-মায়ের জন্য মাটি, রিমার জন্য পোক্ত জায়গা…সব যদি ম্যাজিক করে আনতে পারতো অরুনাভ ! সেই বিদ্যুত যদি আবিষ্কার করতে পারতো ? রাখির বান্ধবীর বর কুয়াশার ভেতরে ছুটিয়ে বেড়ায় ওকে। অরুনাভ চেঁচাতে থাকে-দেখেছি।আমি দেখেছি আপনাকে। দেখবেন,রাখিকে বাথটব এনে দেব। বান্ধবীর বরের পাশে পাশে ছোটে রাখি…রিমা…কমলা ভটচায… । হাঁপিয়ে পড়ছিল অরুনাভ।জমিটা কোথায়?কোথায় বাড়ি করবে ও ? দাশগুপ্ত বলেছিল জমির ভারবাহী ক্ষমতার খোঁজ নিতে।সেটা কি নেওয়া হয়েছে?আশেপাশের জমির খোঁজও নেওয়া হয়নি। কী করবে অরুনাভ ? কিভাবে নির্মাণ করবে ওর বাস্তু?
মাটি খামচে খামচে নিজস্ব জমির খোঁজ করতে থাকে এক বাস্তুকার । হিম ঝরা ভোর ছাড়া কেউ তার সঙ্গী ছিল না।
0 মন্তব্যসমূহ