পিতা স্বর্গীয় আবদুল মতিন চৌধুরীর হাত ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় আমার প্রথম পা পড়ে ১৯৫৭ সালে। এ বছরই আমাকে কেএল জুবিলী হাই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। জন্মেছি তৎকালীন পরগনা ভাওয়ালের দক্ষিণবাগ গ্রামে। বর্ষায় এখানকার খাল-বিল, জলাজমি ছাপিয়ে আসা পানিতে মাছ উজিয়ে আসার পাশাপাশি ডাকে জলচর পাখি। জোয়ারের ছোঁয়ায় পাতা ছাড়ে শাপলা, মামার কলা, ইচা গাছ, হিঙ্গা পোটকা ইত্যাদি কত কি জলজ উদ্ভিদ। আবার ঋতু পরিবর্তনের ধারায় কী কথা বোঝাতে সুরেলা কণ্ঠ শোনায় কোকিল! আসলেই দক্ষিণবাগে মাটি, গাছগাছালি, পাখপাখালি আর জলাজমিতে সারাক্ষণের মাখামাখিই তো ছিল নিজের বেড়ে ওঠার তাবৎ পারম্পর্য। ঢাকায় পৌঁছে দেখি মাটির নয়, পিচঢালা পথে চলছে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, রিকশা এবং হরেক যান্ত্রিক যানবাহন। চৌদিকে মাথা উঁচিয়ে আছে ইট, সুরকি, সিমেন্টের গাঁথুনি তোলা পুরনো দিনের কত না পাকা দালান। চেনা নয়, নগরের লোকজনও।
তাই বলি, অজানা পরিবেশে আমি প্রথম চিনেছিলাম সহপাঠী কায়েস আহমেদকে। তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে একটি সূত্র বুঝি বিদ্যমান। টিফিন পিরিয়ডে সব ছাত্র ছুটে গিয়ে জড়ো হতে মাঠে। কিন্তু কায়েস আহমেদ এই সময়টুকু ক্লাসে বসে গল্পের বইয়ে ডুবে থাকত। অমন দৃশ্যে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, কী পড়।
সেদিন আমার জিজ্ঞাসায় সে উত্তর করেছিল, 'শুকতারা' পত্রিকা।
আমার হ্যাংলা-পাতলা গড়ন। কায়েস আহমেদেরও তাই। অন্যদের তুলনায় সে যেমন পেয়েছে চুপচাপ স্বভাব, আমিও তেমন বিচারে এই দলেই পড়ি। গ্রামে থাকতে ঘরের আলমারিতে পাওয়া কিছু রূপকথার বইয়ে বারেক বারেক করেই চোখ বুলিয়েছি। সহপাঠীরও সেদিকে ঝোঁক আছে তাহলে। এসবে কায়েস আহমেদের সঙ্গে আপন সখ্য মিলিয়ে নেওয়ার সাধ জাগে। আর সেও আমার দিকে হাত প্রসারিত করায় সেদিনগুলোয় একে অপরের নিতুই সঙ্গী হই।
বয়সের ভারে কার না কমবেশি স্মৃতি বিভ্রাট ঘটে! ফলে অতীতে কায়েস আহমেদের সানি্নধ্য পাওয়ার চিত্রগুলো হুবহু এঁকে তোলা অসম্ভব। তাতে দুয়ের গভীর মেলামেশার ক্ষণগুলো হুবহু না হোক, আমার স্মৃতিতে তা জীয়ন্ত এবং অমোচনীয় অধ্যায় হিসেবে সমুজ্জ্বল। মনে পড়ে, পরিচয়ের প্রথম ধাপে সে রূপকথার কয়েকটি বই পড়েছি জেনে সে বলেছিল, আমার ঘরে অনেক রকম আছে। চাইলে তুমি নিতে পার।
অমন আহ্বানে বুঝে নিয়েছিলাম কায়েস আহমেদের পছন্দ আবদুর রউফ চৌধুরীর [পিতৃ প্রদত্ত নাম] দিকেও ধায়। তাকে অধিক কাছের করে নিতে আমাদের পূর্ণ ব্যানার্জি লেনের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার সহপাঠীর দিকে তাকিয়ে মা স্বভাবতই প্রশ্ন করেছিলেন, কী নাম তোমার।
উত্তর এসেছিল, কায়েস আহমেদ।
এরপর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই জ্ঞাত হয়েছিলাম, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিশোর সে। তার পিতা জন্মভূমিতে থাকা আপনজনদের ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় এসেছেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। সঙ্গে এনেছেন পুত্র কায়েস আহমেদকে। অমন কথনে সহপাঠীর দিকে আমার মমতা আরও গেড়ে বসেছিল। তবে সেই সমাপ্তি 'শেষ হয়েও হইল না শেষে'র মতো আজও অন্তরে জাগরূক। হ্যাঁ, কায়েস আহমেদের অনুপ্রেরণাতেই লেখক হয়ে আমি পত্রিকার পাতায় নিজের নাম ছাপবার স্বপ্ন-কল্পনা বুনেছিলাম। তারও আগে দুয়ের মেলামেশা আবছায়া কতেক ছবি মেঘ ভেসে যাওয়ার মতো মনে আকাশে মাঝে মধ্যেই ভেসে বেড়ায়। এ দিয়েই আমি বুঝি পেয়েছিলাম লেখনীর গড়ন-পেটন।
সেদিনে ঢাকায় দু'রকম পথে ছিল দুয়ের আগমন। নগরের আমরা নব আগন্তুক। তাতে কৌতূহলী বালক হয়েই আমরা কিন্তু শহরের বৈচিত্র্য নিরিখ করতে ঘুরে ফিরেছি নানা আনাচে-কানাচে। মূলত প্রতি বৃহস্পতিবার আধাবেলা স্কুল করার ছুটি মিলে যাওয়ার অবকাশে বিভিন্ন গলিতে আমাদের পদক্ষেপ পড়ত। সেবারে আমরা স্কুলের অনতিদূরের বুড়িগঙ্গা নদীর তীর লাগোয়া সদরঘাটে রাখা মীর জুমলার কামান [বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রক্ষিত] দেখতে গিয়েছিলাম। সামনের লঞ্চঘাটের দিকেও ফিরে ফিরে দৃষ্টি গেছে। কে বলবে সে কোত্থেকে শুনেছিল ঢাকা নাকি বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর। সেই হদিস খুঁজতেই আমরা ঢুকেছি অনেক অলিগলিতে। সেদিনে পুবে গেণ্ডারিয়া, উত্তরে পোস্তগোলা, পশ্চিমের বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে উত্তরের লালবাগ, আজিমপুর, রমনা এবং ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনই [বর্তমানে বঙ্গবাজার] ছিল শহরের সীমানা। ও রকম অনুসন্ধানী সময়গুলোতে কায়েস এবং আমি এখানকার ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন সেরে নিয়েছিলাম। তবে সবের মাঝে কিশোর বয়সে দুয়ের চলাফেরার দু'একটি দৃশ্যে বর্তমানেও হঠাৎ হঠাৎ মন সেঁটে যায়। একবার হয়েছিল কী, সদরঘাটের কামান পেছনে এবং লঞ্চঘাট হাতের বাঁয়ে ফেলে দু'জন এগিয়ে গিয়েছিলাম উত্তর দিকে নদীর তীরঘেঁষা পিচঢালা পথে। সেই দফায় বাকল্যান্ড বাঁধের পাশে থাকা নবাববাড়ি পরিদর্শন শেষে ঘরফিরতি মুখ করেছিলাম আমরা। চলতি পথে কানে এলো, 'দেখবেন নাকি মাকড়সা মাইয়া। ওর হাত-পা নাই। আছে খালি মাথা আর মুখখান। খায় খালি মধু। টিকিট মাত্র পঁচিশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা' ডাক।
চমকে তাকাতেই খেয়াল করি কী, বাকল্যান্ড বাঁধের কিনার ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর শুকিয়ে আসা অংশে বাঁশ এবং মুলির বেড়ায় ঘেরা একখানা আস্তানা। সেখান থেকে মাইকে এমন ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
এসব উনিশ শ' একষট্টি কি বাষট্টি সালের ঘটনা। এই সময়ে তিন পয়সা দিয়ে এক কাপ চা মিলত। আর নানির কাছে আবদার জানিয়ে নেওয়া কিছু পয়সাকড়ি সবসময়ই আমার পকেটে থাকত। তাই সামর্থ্যের কারণে মাকড়সা মাইয়াকে স্বচক্ষে পরখ করতে সে বারে পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে দু'খানা টিকিট কেটে এই আস্তানায় ঢুকি। দেখি কী, মানুষের মাথা সমান উঁচু একখানা বাঁশের মাচায় মাকড়সা মাইয়ার মস্তকই শুধু দৃশ্যমান। ওর গলা অবধি ঢাকা আছে কালো কাপড়ে। মেয়েটি কপালে নিয়েছে লালটিপ। ওর একরাশ কালো চুলও বিছানো আছে এই কালো কাপড়ের ওপর। বোধ করি, অনেক দর্শকের মাঝে দাঁড়িয়ে কায়েস এবং আমি সেদিকেই চোখ রেখেছিলাম। কিন্তু মনে হলো যেন মাকড়সাকন্যা আমার দিকে তাকিয়ে বিশেষ হাসি হেসে উঠল। পলকেই ভড়কে গিয়ে পাশ ফিরতেই খেয়াল হলো, কায়েস নেই।
কেন যে দৃশ্য থেকে সে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল তা কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। ফের মনে পড়ে, কিছুদিন বাদে নবাববাড়ি হাতের ডানে ফেলে বাকল্যান্ড বাঁধ ধরে এগোতে এগোতে আমরা পেঁৗছেছিলাম বাবুবাজারে। কিন্তু কি বুঝবার উপায় ছিল, সেখানে মোগল আমলে প্রতিষ্ঠিত বেশ্যালয়টি আজও হতভঙ্গ টিকে আছে! কায়েস এবং আমি ডানদিকে ক'টা কলার দোকান পেরিয়ে গলির খানিকটা সম্মুখে যেতেই ঘটনা অন্যরকম ঠেকল। এ যে দু'দিকে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি মেয়েমানুষ। তাদের কেউ কেউ সামনে দু'বালকের উপস্থিতিতে কেমন যেন আওয়াজ করে ওঠে। তাতে হিমশিম খেয়ে পালাতে গিয়ে কায়েসকে পাশে পাই না। সেই সঙ্গে আমি আত্মরক্ষা করতেও ব্যর্থ হই। কেননা, কে জানে কী ভেবে ইয়া মোটা এক বেশ্যা বিড়াল যেমন ইঁদুর ধরে, তেমন করে আমাকে লুফে নিয়েছিল ওর দু'হাতের বেষ্টনীতে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে কায়েস আহমেদ আমার স্মরণের কোঠায় স্থায়ী আসন নিয়েছে বিশেষ কারণে। সে থাকত তাঁতীবাজারের গলিতে অবস্থিত দ্বিতলের একটি ছোট্ট কুঠুরিতে। মেঝের দু'পাশে পাতা দু'খানা চৌকিতে বাপ-ছেলে ঘুমাত। তার সানি্নধ্যে এসে পেয়েছিলাম কলকাতা থেকে 'শুকতারা' নামে প্রকাশিত কয়েক সংখ্যা শিশু-কিশোর পত্রিকা। তা ছাড়া সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু, সুখলতা রাওয়ের বাইরেও অনেক লেখক-লেখিকার বই তার সংগ্রহে ছিল। আমাকে সেধে সেধেই দিত, তা তো নয়-- একে একে সবই আমাকে দিয়ে যেন পড়িয়েও নিত। বইয়ের নেশা পাওয়ার দিনগুলোয় আমি আরেক সহপাঠী মনোয়ার আহমেদের কাছ থেকে নিয়ে শশধরের দস্যু মোহন সিরিজ এবং স্বপন কুমার সিরিজের বইগুলোও গোগ্রাসে গিলেছি। কায়েস সেদিকে হাত বাড়াবে কী, উল্টো আমাকে নিষেধ দিত। বলত, এসব কোনো ভালো বই নয়। জ্ঞানার্জন করতে হলে তোমাকে পড়তে হবে সাহিত্য।
তার কথাগুলো হুবহু এমন না হলেও মূলে ছিল এই সুর। প্রকৃত পাঠ শেখাতে কায়েস আহমেদ আমাকে নিয়ে প্রায় বিকেলেই চলে যেত আরমানীটোলা মাঠে। তৎকালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল একখানা পাবলিক লাইব্রেরি। ভেতরে কলকাতায় মুদ্রিত বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন গ্রন্থ শোভা পেত। ছিল পূর্ব পাকিস্তানে মুদ্রিত কবি জসিমউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, শওকত ওসমান, নাসির আলী ছাড়াও অনেক সাহিত্যিকের রচনা। মাঝে মধ্যে জুবিলী স্কুলের খুবই কাছে বাংলাবাজার এলাকায় গড়ে ওঠা বইয়ের দোকান নওরোজ কিতাবিস্তান, খান ব্রাদার্স, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্সে আমরা ঢুঁ মারতাম। কিনতাম পছন্দের বই। সম্ভবত উনিশ শ' তেষট্টি সালে স্কুলবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়েছিল কায়েস আহমেদের লেখা 'চোর' নামক গল্পটি। তাতে শুধু ভেবেছি, সে শুধু পাঠক নয়, সাহিত্যিকও হয়ে উঠছে নাকি!
এতদিনে কী ছিল সেটির বিষয়বস্তু, কী ছিল চরিত্রের নাম-- সবটাই স্মৃতির মোছা হয়ে গেছে কবেই। তবে ইতিমধ্যে আমি বইয়ের পাতায় ছাপা কবি-সাহিত্যিকদের মুদ্রিত ছবির বাইরে জীয়ন্ত একজনকেও পায়নি। বার্ষিকীর পাতায় অনেক ছাত্র অনেক রকম রচনা করেছে। কিন্তু কেন জানি সবাইকে পেছনে ফেলে কায়েস আহমেদকে লেখক ঠাউরে নিতেই আমি স্বস্তিবোধ করেছিলাম। সেই সঙ্গে তার মতো লিখে কোথাও নিজের নাম ছাপবার খেয়ালেও ঘুরতে থাকি। ছোটবেলায় আমি খানিক লাজুক স্বভাবের হয়েই ঘোর-চক্কর খেয়েছি। ফলে আপন আকাঙ্ক্ষা কায়েসকে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে সলজ্জপনাই ধেয়ে আসে। তাও বুঝি ব্যাপারটা জানতে প্রশ্ন তুলেছিলাম, লিখতে হলে কী রকম যোগ্যতা লাগে।
সে ছিল খানিকটা যেনবা নিভৃতচারী। আমরা সাধারণত কাউকে সামনে পেয়ে বকবকিয়ে চলি। তার ছিল খুবই চুপচাপ স্বভাব। অনুচ্চ কণ্ঠ এবং প্রয়োজনীয় আলাপকেই সমধিক গুরুত্ব দিত। তবে তার দু'চোখ সামনের সবকিছুকে নীরবে অথচ একে একে পরখ করে নিতেই অভ্যস্ত ছিল। ফলে সেদিন আমার মনের ভাব ভবিষ্যৎ এই কথাসাহিত্যিক ঠিকই অনুমান করতে পেরেছিল। তাই সে প্রশ্ন করেছিল, তুমি কী লিখতে চাও।
উত্তরে নিশ্চয় সম্মতিসূচক মাথা নেড়েছিলাম। ছোটবেলাতেই কায়েস আহমেদের ধীর চলাফেরা লক্ষ্যভূত ছিল। কোনো বিষয়ে কথা উঠলে সে প্রকৃত শিক্ষকের মতো বিষয়টার কাটাছেঁড়া করে ছাড়ত। সে বারে আমার দিকে ফিরে কায়েস বলেছিল, লিখতে গেলে তোমাকে পড়তে হবে অনেক রকম বই। সত্যিকারের সাহিত্যে চাই বাস্তবতা। সেসব বুঝতে চাইলে তোমাকে চোখ মেলে তাকাতে হবে চারপাশে।
এই সাক্ষাৎকারে দুয়ের সাহিত্যে উত্থাপন হুবহু এমনটি ছিল তা কিন্তু নয়। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, বয়সের তুলনায় বাংলা সাহিত্যের খোঁজখবর ভালোই তার আয়ত্তে ছিল। সেসব পাঠে এবং আপনাতে লেখকসত্তা বিকশিত হওয়ার সম্মিলনে সে বড়দের মতো শিল্প বিচার টানতে পারত।
তারপর হলো কি, উনিশ শ' তেষট্টি সালে ক্লাস নাইনে উঠে ঘরের কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে আমি কয়েক মাস ঘুরে বেড়াই অজানার পথে। পরে ফিরে এলেও ওই বছর আমাকে স্কুলে যেতে দেওয়ার বদলে ঘরেই চোখে চোখে রাখা হয়েছিল। ফলে উনিশ শ' চৌষট্টি সালে কায়েস ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেও মাঝে ক্লাস না করার কারণে আমি স্কুলের গণ্ডি ডিঙ্গাই উনিশ শ' পঁয়ষট্টি সালে।
এই ঘটনায় অনেকদিনের কায়েসকে আমি অনেকাংশে হারিয়ে ফেলি। সে সময়গুলোয় তাকে হঠাৎ হঠাৎই পেতাম বাংলাবাজারে। কোনো নতুন বইয়ের সন্ধানেই তার ঘোরাফেরা। বলতাম, চলো আমার বাসায়।
এসব ডাকে সে কমই সাড়া দিত। তবে সামনের কোনো চায়ের দোকানে নির্জনতা বুঝে আমাকে খানিক সঙ্গ দিয়ে তবেই সে বিদায় হতো। তার তাগাদাতেই আমি লিখে ফেলি 'জোনাকি ও সন্নিকট কেন্দ্র' নামে একখানা গল্প। এসবেরও আগে লেখালেখিতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে কায়েস আমাকে পিতৃপ্রদত্ত নাম বদলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিল। তা খেয়ালে নিয়ে ডাক নাম বুলবুলের সঙ্গে চৌধুরী উপাধি মিলিয়ে বুলবুল চৌধুরী নামে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করি।
কায়েস আহমেদ ভারি নিয়মের মধ্যে জীবনযাপন করত। অন্যদিকে নিজের জীবনযাপন ছিল অনেকখানি খামখেয়ালিতে ভরা। ওসব ডিঙিয়ে উনিশ শ' সাতষট্টি সালের এক বিকেলে তার সঙ্গে আমার দেখা। বলল, চল তোমাকে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে যাই। সেখানে অনেক কবি-সাহিত্যিক আসেন।
তার আমন্ত্রণে আমি প্রথম ঢুকি বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিংয়ে। কিন্তু জানা ছিল না যে, এখানে অনেক নবীন-প্রবীণ শিল্পী-সাহিত্যিকের যাতায়াত আছে। কায়েসের বদৌলতে সেখানে গিয়ে পাই কবি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ এবং কবি আবুল হাসানের বাইরেও অনেক কবি-লেখককে। তবে কেন জানি কবি হাসানের দিকেই আমার সবিশেষ ঝোঁক পড়েছিল। সে ছিল একান্তভাবেই বোহেমিয়ান। তার সঙ্গে উড়নচণ্ডিহয়ে ঢাকা শহরের ইতিউতি কত রাত পার করে দিয়েছি। মূলত এ সময়ে অমন সব সঙ্গ পেয়ে আমি লেখার দিকে হাত প্রসারিত করেছিলাম।
মনে পড়ে, এরপর কায়েস আহমেদের তাগাদায় আমার 'সমূহ অনুভব' গল্পটি জন্ম নেয়। সে প্রায়ই আমাকে লেখালেখির ব্যাপারে নানা উপদেশ দিত। এসবের মধ্যে মোদ্দা উক্তি ছিল লিখেই ছাপতে দেবে না। তাতে ক'মাস পর লেখাটা পড়তে গেলেই নিজের অনেক ভুল পাবে। কাটাকাটি দিয়েই লেখা বেশি রূপ পায়।
আজ লিখে লিখে যেটুকু পরিচিতি পেয়েছি, সেসবের আদিতে কায়েস আহমেদের নাম করতে হয়। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোয় বিউটি বোর্ডিংয়ে কায়েসকে নিয়মিত পেয়েছি। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের বাঁধন একেবারে আগল হয়ে পড়ে।
তারপর তো সে আত্মহননের ভেতর দিয়ে জীবনের ইতি টানল। অমন কি ঘুণাক্ষরেও আমার ভাবনায় কাজ করেছিল! আজ মনে হয়, তার অন্তরে গুমরে চলা কিছু বিষয় ছিল। সেসব আত্মস্থ করতে গিয়েই কি সে মৃত্যুকে নিজেতে একীভূত করল।
না পাই উত্তর। এ যে 'শেষ হয়েও হইল না শেষে'র মতো কথকতা। তবে তাকে হারানোর বেদন যেমন অনুভূত, তেমন তো সাহিত্যচর্চায় তার দেওয়া নির্দেশ মেনে চলছি আমি।
0 মন্তব্যসমূহ