রাধানাথ মণ্ডলের গল্প : চালে যখন কাক গলছে

আমাদের তখন খুবই দুঃসময়। বাড়ির অবস্থাটা হঠাৎ হঠাৎই খুব খারাপ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আষাঢ় থেকে ভাদ্র, এই তিনটে মাস আর চলতে চায় না। আমি তিন বছর বি-এ পাশ করে বসে আছি। কোনও চাকরি পাচ্ছি না। কুড়ি মাইলের মধ্যে যেসব ইস্কুল আছে তার প্রত্যেকটায় বারবার গিয়ে খবর নিয়ে এসেছি যদি কোনও সেকশন টিচারের পোস্টও খালি থাকে। কিন্তু সবাই ডোনেশন চায়। আট হাজার, দশ হাজার, কেউ বা পনেরো হাজার। এত টাকা আমি কখনও চোখে দেখিনি। ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে আজকাল বি-এড চায়, আমার কোনও ট্রেনিং নেই।

আমাদের বাড়িতে খাটবার লোকও নেই। বি-এ পরীক্ষা পর্যন্ত গঞ্জ শহরের আবহাওয়া আমাকে অলস করে দিয়েছে খুব। আমার বয়সী অন্যান্য ছেলেরা যখন লাঙল-জোয়াল কাঁধে মাঠে গিয়ে হাল চষেছে, আমি তখন রেডিওয় অনুরোধের আসর শুনেছি। বাবার বয়স হয়ে গেছে, এখন মাঠে ছাতা মাথায় আলের উপর বসে থাকে, টুকটাক নির্দেশ দেয় আর বাবার চেয়ে একটু কম বয়সী নিতাইকাকা যা পারে করে। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি নিতাইকাকা আমাদের বাড়িতে বছর-বাঁধা মুনিশ হয়ে আছে। আমাদের খুব যে ক্ষমতা আছে একজন বছর-বাঁধা মুনিশ রাখার, তা নয়। তবু নিতাইকাকাকে কখনও ছাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর নিতাইকা ছেড়ে গেলে যেটুকু-বা চাষবাস হয়, তা-ই বা কে করবে ? 

আমাদের গ্রামে যাদের অবস্থা ভালো, তারা ধান ধরে রাখতে পারে। ভাদ্রমাসে সবচেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়। আমরা তা পারি না। যেদিন ধান কাটা শেষ হয়, মানে নিতাইকাকা বা আমি মাথায় করে শেষ ধানের আঁটিটি নিয়ে আসি অর্থাৎ পৌষ ওঠে, তার পরের দিন বিশ্রাম। লক্ষ্মী ছুঁতে নেই। আমরা বড় জোর সেদিনটি অপেক্ষা করি। তারপরই ধান ঝেড়ে বিক্রি করতে থাকি। আলুও তাই। লোকেরা যখন কোল্ড স্টোরে আলু মজুত করে রাখে আমরা তখন মাটির দামে কিষ্টগঞ্জের গোলায় আলু ফেলে দিয়ে আলি। আর সেই আলুর টাকা ধারে কেনা পটাশ-গ্রোমোরের দাম মেটাতেই চলে যায়। সে বছর জষ্টি মাসে যেদিন বাবা আর নিতাইকাকা বিক্রির জন্যে চার বস্তা ধান গরুর গাড়িতে তুলছে, মা বড়ালিতে করে বাকি ধান মেপে বলল, চার বস্তা নিয়ে গেলে খোরাকিতে টান পড়বে। আমরা কেউই মায়ের কথা শুনিনি। কারণ, ইউরিয়া কিনতে হবে, দোকানের জিনিস চাই, অনেক টাকার দরকার। ধান বিক্রি হল। কিন্তু মায়ের কথা ফলে গেল কদিন আগে। ধান সিদ্ধ করতে গিয়ে মা দেখল মাত্র দু-বড়ালি ধান পড়ে। এতে বড় জোর শ্রাবণ মাসের আধাআধি পর্যন্ত যেতে পারে তারপর ভাদ্র মাস পর্যন্ত কেনা ধানের গোনা ভাত। 

তখন আমাদের খুবই দুঃসময়। বাড়িতে কোনও টাকা নেই। দুদিন পরে ধান কিনতে হবে মণ দুই। আমি পাশের গ্রামের ক্লাশ এইট আর নাইনের দুটি ছেলেকে পড়াতে যাই। কুড়ি টাকা করে পাই মাসে। বাবা এখানে-ওখানে ঘুরে এল যদি কারও কাছে ধার পাওয়া যায়। কিন্তু বর্ষাকালে কেউই ধার-হাওলাত দিতে চায় না। দিতে চায় না ঠিক নয়, বর্ষাকালে অনেকেরই হাত খালি। দু-পাঁচজন যারা বড়লোক, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই বিশেষ। শেষ পর্যন্ত বাবা বলল, তোর টিউশনি-ঘরে বলে দ্যাখ না, যদি দু-মাসের মাইনে আগাম দেয় ! কুড়ি-কুড়ি চল্লিশ টাকা, মানে এক মণ ধানের দাম। টিউশন-বাড়িতে কথাটা বলা খুবই লজ্জার কিন্তু এছাড়া যখন কোনও উপায় নেই তখন লজ্জার মাথা খেয়ে আমাকে কথাটা বলতেই হবে ভাবি। 

এমন সময় একদিন ঠাকুরপুরের গোপীনাথ ভটচাজ হঠাৎ দুজন লোক নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। 

তখন আমার দিনগুলি রেডিওর সময় ধরে চলে। সঙ্গীতাঞ্জলির সময় ঘুম ভাঙে, নটার খবরের সময় মুড়ি খাই, দেড়টার খবরের সময় ভাত। সন্ধেবেলা মজদুরমণ্ডলীর অনুষ্ঠানের সময় বেড়িয়ে ফিরি, রাত্রের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে ঘুমোই। আমাদের বাড়িতে একমাত্র সাচ্ছল্যের চিহ্ন এই রেডিও। আমার বেকার-জীবনের একমাত্র সঙ্গী। এই নিয়ে প্রায়ই বাবা বকাবকি করে। দিনরাত ব্যাটারি পুড়িয়ে রেডিও শোনার কোনও মানে হয়? আমি কান দিই না। টিউশনির মাইনে পেয়ে আর কিছু না হোক আমি ব্যাটারিটা কিনে আনি। 

রেডিওর দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলে আমি প্রতিদিন যেমন দেপুকুরে চান করতে যাই, তেমনই যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি হটমট করে তিনটে লোক নাছদুয়ার ঠেলে একেবারে আমাদের উঠোনের মাঝখানে চলে এল। মা রান্না করছিল। বিরিকলাইয়ের ডাল সঁতলাতে যাবে, তিন তিনটে লালোক চোখে পড়তে তাকিয়ে থাকল অবাক হয়ে। আমাকে বলল, বাবা মহিম, দ্যাখ তো কারা। গোপীনাথ ভটচাজকে আমি চিনি। এ-অঞ্চলের নামকরা ঘটক। একসময় আমরা একই স্কুলে পড়েছি কিছুদিন। আমি যখন সন্ধিপুর শিক্ষাসদনে ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন গোপীনাথ দুবার ফেল করে সিক্সে পড়ছে। আমি ক্লাস সিক্সে গিয়ে গোপীদাকে ধরে ফেলি। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর প্রায়ই খাওয়াতে বলত আমাকে। গোপীনাথ ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ, ওকে যত খাওয়াব তত পুণ্য হবে, এরকম একটা ধারণা আমাদের অনেকের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সে। ক্লাস সেভেনে উঠেই পড়া ছেড়ে দেয়, তারপর শুনেছি গোপীদা এখন ঘটকালি করে। নামও করেছে খুব। যেসব মেয়ের বিয়ে হবে কেউ কখনও ভাবেনি, তাদেরও ভাগ্য নাকি ফিরে যায় গোপী ভটচাজের হাতে পড়লে। আর এই করতে গিয়ে দু-পয়সা রোজগারও করছে গোপী। 

কিন্তু সেই গোপী আমাদের এখানে কেন ? আমাদের বাড়িতে তার বিয়ের উপযুক্ত কোনও মেয়ে নেই। বাবা-মায়ের আমিই একমাত্র ছেলে। আর সেজন্যে মা-বাবার সমস্ত স্নেহ আমি ভোগ করে এসেছি দীর্ঘকাল, কেউ তাতে কোনও ভাগ বসায়নি। আর সেইজন্যে ধানজমি বিক্রি করেও বাবা আমাকে বি-এ পাশ করিয়েছে। আমার উপর অনেক আশা সকলের, যার কোনটাই আমি পূরণ করতে পারিনি। কিন্তু গোপীনাথ ভটচাজ কেন ? 

আমি তেল মেখে কাঁধে গামছা ফেলে পুকুরে যাচ্ছিলাম, ফিরে দাঁড়াই। কী ব্যাপার, গোপীদা যে! গোপীদা আমার দিকে এগিয়ে আসে, তারপর আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। এই পাত্র শঙ্করবাবু। যেমন দেখতে, তেমনি স্বভাবচরিত্র, প্রতি ক্লাসে এক চান্সে প্রোমোশন। কী ছাত্র ছিল আমাদের ইস্কুলের । আঃ যেন চাবুক। মাস্টারমশাইরাও খুব ভালবাসত। নিজের চোখে দেখা শঙ্করবাবু। বি-এ পাশ। এক চান্সে বি-এ ডিস্টিংশন। তাই না। মহিমভাই? 

আমি হতভম্ব খেয়ে যাই। কী বলছে গোপীনাথ ভটচাজ? আমি পাত্র, মানে আমার বিয়ে? যে-গোপীনাথ আমাকে মহে বলে ছাড়া ডাকত না, সে আমাকে বলছে মহিমভাই? আমি ক্লাসে কখনও ভাল ছাত্র ছিলাম না। মাস্টারমশাইরা রোশ লাস্ট বেঞ্চে বসে-থাকা আমাকে চিনতই না ভাল করে। আর বি-এ-তে ডিস্টিংশন পাওয়া অনেক দূরের ব্যাপার, আমি পাশ করেছি কোন রকমে। 

শঙ্করবাবু আমার দিকে তাকালেন। ওঁর গায়ে সাদা হাফসার্আর ফুলপাড় ধুতি। বুক-পকেটে অনেক কাগজপত্র, কলম গোঁজা। ক্লিপ দেখে বোঝা যায় রাইটার পেন। সুন্দর ওলটানো চুল, পায়ে চামড়ার স্যাণ্ডেল। বেশ শৌখিন ভদ্রলোক। ইনি নিশ্চয় মেয়ের বাবা। সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই আমার নিজের বাবার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কুঁচকোনো চামড়া, কপালে তিনটে ভাঁজ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এখন খালি গায়ে উত্তরের জমির আলে বসে আছে। শঙ্করবাবুর সঙ্গের ভদ্রলোক এতটা ফিটফাট নয়, আধময়লা জামা, খালি পা, হাতে বাঁশের বাঁটের ছাতা। সে-ই এগিয়ে আসে আমার দিকে। কী নাম বাবাজীবনের ? মহিম, মা-মানে ম-মহিম হালদার। আমি আচমকা দু-পা পিছিয়ে যাই। ইতিমধ্যে রান্নাশালের দিকে এগিয়ে গেছে গোপী। কই গো মা জননী, আপনার বেয়াই এসেছে মা, বসতে জায়গা দিন। আর মা, আপনি তো মহিমভাইয়ের মা, আমারও মায়েরই মতন। আপনার হাতের রান্না যে কতদিন খাইনি। আজ অনেক দিন পরে আবার সেই সুযোগ হবে। আঃ কী অপূর্ব সেই স্বাদ, আমার জিভে এখনও লেগে আছে। আসুন আসুন শঙ্করবাবু, আপনার বেয়ানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। সুপুত্রের জননী আপনার বেয়ান। সংস্কৃতে কি সাধে বলেছে যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম। 

তখনও খুব সংস্কৃত আওড়াত গোপীনাথ। মানে জানে না, কোথায় কী বলতে হয় জানে না, তবু কথায় কথায় সংস্কৃত বলত। হাসি পায় আমার। কিন্তু গোপীদা যে মাকে বলল, কতদিন যে আপনার হাতের রান্না খাইনি, সে তো আমাদের বাড়িতে এসে খায়নি কখনও।। 

আমার গা থেকে তিলতেলের গন্ধ বেরোচ্ছে। এই গন্ধটা আমি মোটেই পছন্দ করি না বলে আমার মাখবার মত সরষের তেল সব সময় বাড়িতে থাকে। কিন্তু অনেক দিন সরষের তেল ফুরিয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে তিল তেলই মাখতে হয়েছে আমাকে। আমাদের গ্রামে যারা পারে তারা তিল বিক্রি করে দিয়ে সরষের তেল কিনে আনে। আমরা তা পারি না। তাই ঘানিতে তিল মাড়িয়ে তেল বের করে আনি। সেই তিল তেলও শেষ হয়ে এসেছে। বানির অভাবে ঘানি চালাতে যেতে পারছে না। কলের ঘানি বসেছে কিষ্টগঞ্জে, তার বানি অনেক। শঙ্করবাবু নিশ্চয় গন্ধ পাবেন আমার গা থেকে, যাই চানটা করে আসি। মা মাদুর পেতে দেয় আর আমি দ্রুত পুকুরের দিকে পা চালাই। 

চান করতে যেতে যেতে গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন অসম্ভব আর অবাস্তব মনে হয়। আমার বিয়ে ? 

মাঝে মাঝে আমি নানারকম কল্পনা করি। ভাবি বালিশের তলায় । চার পাঁচখানা একশো টাকার নোট রেখে ঘুমোচ্ছি। কিংবা রেডিও খুললেই ভেসে আসছে আমার নিজের গলা—আকাশবাণী কলকাতা, এখন আধুনিক গান শুনবেন গ্রামোফোন রেকর্ডে, শিল্পী শ্রীমতী-- মনে হয় আমি এখন কলকাতায় থাকি, চাকরি করি অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে। এমন কি যখন খুব ছোটখাটো কল্পনা করি তখন আমি নিজেকে দেখি রামজীবনপুর বাবুলাল ইনস্টিটিউশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার, অ্যাটেনডান্স রেজিস্টার হাতে ক্লাসে যাচ্ছি, বাঁ হাতে ধরা সেনগুপ্ত ধুতির কোঁচা। কিন্তু আমি কখনও বিয়ে করার কথা কল্পনা করিনি। 

ভালো করে গামছা দিয়ে রগড়ে চান করতে থাকি আমি। এমন সময় নাইতে আসে আমাদের পাড়ার কানাই। কানাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে বছর দুই আগে। একটি ছেলেও হয়েছে। সে জলে নেমে আমার পাশে দাঁড়ায়। আমাকে বলে, মহিমদা, শুননু তোমাকে নাকি দেখতে এসেছে। গোবিন্দপুর থেকে ? আমি অবাক হয়ে যাই। দেখতে এসেছে ? দেখতে তো মেয়েদের আসে। আমি কি মেয়ে নাকি ? কোনও জবাব দিই না। আমি। একমনে স্নান করতে থাকি। কানাই আমার পাশ দিয়ে একগলা জলে নেমে পড়ে। বলে, গোপে ভটচাজকে দেখনু কিনা তোমাদের ঘরের পানে যাচ্ছে। গোবিন্দপুরের শঙ্কর হাজরা খুব বড়লোক মহিমদা, ধানভানা কল আছে। বেশ বড়লোক শ্বশুর হবে গো—বলতে বলতে কানাই সাঁতার কেটে দেপুকুরের ওপারে চলে যেতে থাকে। আমি লুঙ্গি খুলে গামছা পরি আর ভাবি, এত তাড়াতাড়ি এতসব খবর লোকেরা জানে কী করে। আমি তো শঙ্কর হাজরা বা তার ধানভানা কলের কথা শুনিইনি কখনও ! 

আমাকে দেখতে এসেছে ? বাড়ি ফিরতে একটু লজ্জা লজ্জা করে আমার। ভাল করে গায়ে ভিজে লুঙ্গি জড়িয়ে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকি। দেখি মা জল এনে দিয়েছে গাডুতে সকলের পা ধোওয়ার জন্যে, উঠোনে সবাই পা ধুচ্ছে একে একে। আর গোপীনাথ বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছে আমাদের সকলের, কত বড় বংশ আমাদের ? আটঘরার হালদারবাড়ি যাব বললে পাঁচ ক্রোশ দূর থেকে দেখিয়ে দেয়। আমি ঘরে ঢুকে গামছা ছাড়ি। লুঙ্গি পরে একটা গেঞ্জি গায়ে দিই। দেয়ালের জলুইয়ে ঝোলানো হাত-আরশিটা পেড়ে আনি। মুখটা দেখি ভাল করে। আমাকে দেখতে এসেছে ? কেমন দেখতে আমি ? আমি তন্নতন্ন করে দেখতে থাকি আমার বাইশ বছরের চেহারা। আমার চোখ, নাক, মুখ । কানের কাছে একটা আঁচিল, এখানে আঁচিল থাকলে কি ভাল লাগে ? গলার কাছের হাড় দুটো উঠে আছে, এজন্যে বেশ রোগা দেখায় আমাকে। এ সপ্তাহে এখনও দাড়ি কামানো হয়নি বলে খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়ে আছে গালে। আমি 'ভালকরে টেরি কেটে চুল আঁচড়াই তারপর একটা ব্লেড খুঁজে এনে দাড়ি কামাতে থাকি। মা ঘরে এসে ফিসফিস করে বলে, বাবা, যা। না একবার জেলেপাড়ায়, যদি মাছটাছ কিছু পাস। না হলে অন্তত গোটা দুই ডিম। 

আমি চমকে উঠি। তাই তো, এমন অসময়ে তিন তিনজন অতিথি বাড়িতে। আমাদের এখন তো একটাই তরকারি, বিরি আছে। আর গোপীনাথ নানা কথা বলে যাচ্ছে। বাবার তেমনই খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত তোলা ধুতি। বাবা কি একখানা গেঞ্জিও গলাতে পারত না গায়ে ? আমার রাগ হয়। আমাকে দেখে সবাই একবার মুখ তুলে তাকায়। আমি তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ি। গোপীনাথের কথা আমার কানে ভেসে আসে। আর বলবেন না কাকাবাবু, এ মেয়ের কোনও জুড়ি নাই সাতখানা গায়ে। যেমন দুধে আলতায় গোলা গায়ের রঙ, তেমনি কাজে-কন্মে একেবারে দশভুজা। গোটা সংসারের কাজ তো মেয়ে একাই করে। আঃ এমন গুণবতী মেয়েকেই সংস্কৃতে বলেছে, দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা। 

মা ঘরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী রে, কিছুই পাসনি ? আমি ঘাড় নাড়ি। মাকে চিন্তিত দেখায়। কী দিয়ে তিন তিনটে লোককে ভাত বেড়ে দিই বল্ তো? তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলে, এক কাজ কর, মাঠে গিয়ে তোর নিতাইকাকাকে বল্ ঘরে চলে আসতে। একবার গাঁতিটা নিয়ে বেরোক। দুটো ঘুসে মাছও যদি পায় ! ঘরে দুটো লৰাত পর্যন্ত নাই যে লোকগুলোকে জল খেতে দুবো! 

আমি আবার বেরোই। উত্তরের মাঠে দুটো সাদা হেলে গরু, দূর থেকে দেখেই চিনতে পারি নিতাইকাকা। আমি কাছে যাই। নিতাইকাকা সব শুনে বলে, তাহলে তো হাল ছেড়ে দিতে হবে । তুমি তো আবার কলেজে-পড়া বাবু, একবার যে লাঙ্গলের বোঁটাটা ধরবে সে আশা নাই ! যখনই সুযোগ পায় নিতাইকাকা আমাকে কলেজে পড়া বাবু বলে ঠাট্টা করে । আমি হাসি। বলি, কী যে তুমি বলো না নিতাইকা, আমাকে আজ গোবিন্দপুর থেকে দেখতে এসেছে আর আমি লাঙ্গল করব মাঠে! লোকে কী বলবে ? নিতাইকাকা বলে, ঠিক আছে লাঙ্গল না ধরলে যদি দু-হাজার টাকা বেশি পাও তো ভালো। আমি হাল ছেড়ে দিয়েই যাচ্ছি। ভরাভত্তি পুকুর সব, কোথা । যে মাছ পাব ভগমানই জানে! 

টাকা ! বুকের মধ্যে ছাত করে ওঠে। টাকা পাব আমি বিয়ে করলে ? তারপরই মনে পড়ে, হ্যাঁ তাই তো ! আমাদের গ্রামে এবং গোটা অঞ্চলে তাই নিয়ম! এখানে যে চার বিঘে ধান জমির মালিক তার ছেলেও পাঁচ-ছ হাজার টাকা বরপণ পায়। যারা অন্যের বাড়িতে মুনিশ থাকে, তারাও। আমারও তো পাওয়ার কথা। কিন্তু নিতাইকাকা বলার আগে পর্যন্ত আমার টাকার কথা মনে হয়নি। 

নিতাইকাকা লাঙল জোয়াল খুলে ফেলে। হেলে গরুগুলোর মুখে জালি পরিয়ে দিয়ে আমাদের বাড়ির রাস্তা ধরিয়ে দেয়। আমাকে বলে তুই চ, আমি ঘর থেকে চুনো জালটা নিয়ে যাচ্ছি। নিতাইকাকার জাল বোনার খুব শখ। বড় টানা জাল, মাথা ঘোরানো, চুনো জাল, নানা ধরনের জাল আছে বাড়িতে। আমাদের যখন মাছ ধরার দরকার হয় নিতাইকাকা নিজের হাতের জাল নিয়ে আসে। 

আমি ফিরে আসি। দেখি বাবার সঙ্গে খুব সম্ভ্রম নিয়ে কথা বলছেন শঙ্করবাবু। আমি অবাক হই। মেয়ের বাপ বলে তাঁর মতো অভিজাত চেহারার মানুষকেও এমনভাবে কথা বলতে হবে ? ঘরের মধ্যে ঢুকে আমি দরজা বন্ধ করে দিই। তবু কানটা খাড়া রাখি বাইরের দিকে। একটু পরে দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। দরজা খুলে দেখি গোপীনাথ ভটচাজ। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয় গোপীদা। বালিশে হেলান দিয়ে আমার বিছানার উপরে বসে পড়ে। বলে মহে, আগে একটা বিড়ি দে। আমি মনে মনে বেশ চটে আছি। গোপীনাথের উপর। বলি, বিড়ি কোথায় পাব ? আমি কি বিড়ি খাই ? 

—খাস না? গোপী আমাকে ধমকায়। তুই শালা তেমনি কিপটে আছিস, ব্রাহ্মণকে একটা বিড়ি দান করলে কত পুণ্যি হয় জানিস ! 

—হোক। পুণ্যে আমার দরকার নেই। কী বলবে বলল, আমি ঝাঁজিয়ে উঠি। 



গোপীনাথ আমার দিকে এগিয়ে এসে বসে। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে, এভাবে বলে, এমন সম্বন্ধ তুই পাবি ? তোর কী উপকার কচ্চি তুই এখন বুঝবিনি মহে, আগে বিয়েটা হোক তারপর এই ব্রাহ্মণের কদরটা বুঝবি। 

-ছাড়ো তো, কে বিয়েটা করছে কে ? চাকরি নাই, পয়সা রোজগার নাই, আর আমি বিয়ে করতে যাব ? বলে নিজে পায় না খেতে মধু কোথা শুবি রে ? 

—শোবে আলবাত শোবে ব্রাহ্মণের কথা কখনও মিথ্যে হয়। দেখেছিস? মধু এসে এই বিসনাতেই শোবে। গোপীনাথ এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়াল পর্যন্ত আমার তক্তপোশের বিছানাটা দেখায়। তারপর একটু হেসে বলে, আঃ কী রূপ! কী রঙ! সংস্কৃতে একেই বলেছে অস্তি গোদাবোরীতীরে বিশাল শাল্মলী তরুঃ । 

আমি হেসে ফেলি। বলি, গোপীদা তোমার সংস্কৃত থামাবে ? মানে জানো না কিছুই, খালি যেখানে সেখানে যা তা বলে যাচ্ছ । গোপীদা বলে, কলেজে পড়ে তোর এই বুদ্ধি হয়েছে মহে? সংস্কৃতের আবার মানে কীরে? দেবভাষা, তা জানিস ? এই যে এই সাবডিভিশনে একশো আঠারো জোড়া হাত এক কল্লুম, সে তো শুধু সংস্কৃতের জোরে ! এই যে তুই দুদিন পরে ছাদনাতলায় বসবি, তোকে তো সংস্কৃতেই মন্ত্র বলতে হবে, না কি ? সে যাকগে, তুই কবে মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস বল্। 

মেয়ে দেখতে? বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি শিরশির করে ওঠে। আমাদের স্কুল সন্ধিপুর শিক্ষাসদনে কোনও মেয়ে পড়ত না। কলেজে আমাদের ক্লাসে কয়েকজন মেয়ে পড়ত। প্রফেসার ঢোকার সঙ্গে তারা ক্লাশে আসত, প্রফেসার বেরিয়ে গেলে বেরিয়ে যেত। আরড গ্রামের ছেলে আমি সেইসব মেয়েদের সম্পর্কে কখনও কিছু কল্পনা করার সাহসই করিনি। এখন গোপীনাথ ভটচাজের কথা শুনে সম্পূর্ণ একটি মেয়ের চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার বাইশ বছরের জীবনে এই প্রথম নিজের মতো একটি মেয়েকে ভাবতে পারি। মনে মনে ভাবি, দেখতে যাব, অবশ্যই দেখতে যাব মেয়েটিকে এবং যত তাড়াতাড়ি পারি। 

আমি গোপীনাথকে জিজ্ঞেস করি, কত বয়স মেয়েটির ? গোপীনাথ বালিশে হেলান দিয়ে বসে। গম্ভীরভাবে বলে, উহু, আগে বিড়ি চাই। আমি উঠে গিয়ে খুঁজে পেতে কুলুঙ্গি থেকে একটা বিড়ি আর উনুন থেকে একটা আঙরা এনে গোপীদাকে দিই। গোপীদা বিড়িটা ধরিয়ে জুত করে একটা টান দেয়। বলে, ষোল। একেবারে প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রমিত্র বদাচরেৎ। 

- রঙ? 

-ফর্সা। যাকে বলে দুধে-আলতা। 

-চুল? 

-কোমর ছাপিয়ে যায় একেবারে। 

-গান জানে ? 

-হা হা, গান জানবে না? গান কে না জানে ? ঘরে হারমনি, ডিগি তবলা, কী নাই ? শঙ্কর হাজরা কত বড়লোক জানিস ? ধানভানা কল আছে গোবিন্দপুর বটতলায়। ওই যে সঙ্গে দেখছিস, ওই লোকটা ওর কর্মচারী। দেড়শো টাকা মাইনে দেয় মাস গেলে। তোকেও দেবে থোবে ভালো। 

দেবে থোবে ভালো, মানে কী দেবে? নগদ টাকা? কত? একটা সেকশন টিচারের পোস্টের জন্যে যত ডোনেশান লাগে, সব ? আমি মনে মনে একটু অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু গোপীনাথের কাছে গোপন করে বলি, আর মেয়েটির পড়াশুনো ? 

-সেদিক দিয়েও ফাসক্লাশ। গাঁয়ে কলেজ নাই, তাই। থাকলে দেখতিস। ইস্কুল ফাইনাল পর্যন্ত পড়েছে। আট কোশ দূরের ইস্কুলে সেনটার পড়েছিল বলে পরীক্ষা দিতে পাঠায়নি মেয়েকে। পরীক্ষা দিলে নিঘঘাত ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করত। 

এত দূর বলে গোপীনাথ হঠাৎ আমার হাত দুটো ধরে ফেলে। মহিম ভাইটি, এই বিয়েতে অমত করিসনি। আমি বলছি তোর ভাল হবে। দেখিস, আমি ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের কথা কখনও মিথ্যে হয় না। খুব বিব্রত বোধ করি আমি। তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নিই। আমার এক সময়কার সহপাঠী গোপীনাথ ভট্টাচার্যকে হঠাৎ খুব বয়স্ক মনে হয়। গায়ে মলিন একটা হাফশার্ট, দুটো তালি দেওয়া, রুখু চুল, বোধ হয় বহুদিন তেল পড়েনি। এই অসহায় ব্রাহ্মণটির প্রতি খুব মমতা হয় আমার। বলি, আমি অমত করার কে গোপীদা? আগে দ্যাখো শঙ্করবাবু তাঁর মেয়েকে আমাদের ঘরে দিতে চান কিনা! 

-দেবে না মানে? আলবাত দেবে। হঠাৎ সোজা হয়ে বসে গোপীনাথ ভটচাজ, এমন বংশ পাবে ? আটঘরার হালদার বংশ। দশ কোশ দূর থেকে লোকেরা দেখিয়ে দেয়। তুই এমন হীরের টুকরো ছেলে। আরও অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দরজায় ঠকঠক শব্দ হয় আর বাবার গলা শুনতে পাই, বাবা মহিম, গোপীনাথবাবুকে ডেকে দাও, ভাত বাড়া হয়েছে। 

বড়ঘরের মেঝেয় আসন পেতে খেতে দেওয়া হয়েছে সকলকে। ব্রাহ্মণ গোপীনাথের জন্যে কম্বলের, অন্য দুজনকে দেওয়া হয়েছে মার হাতে তৈরি ফুলতোলা কাপড়ের আসন। মা কারও বাড়ি থেকে পটল এনেছে গোটা কয়েক, তার তরকারি আর ঘুসো মাছের পোস্ত। আমি রেডিওটা এনে খাবার ঘরের সামনে জোরে চালিয়ে দিই যাতে শঙ্করবাবু ভালো করে শুনতে পান। তার সামনে ভাতের থালার ছবিটা রেডিও শুনিয়ে খানিকটা পুরিয়ে দিতে চাই। 

বিকেলবেলা শঙ্করবাবু চলে গেলেন। সঙ্গে গেল তাঁর ধানভানা কলের কর্মচারী আর ঘটক গোপীনাথ ভটচাজ। ঠিক হল আমরা গোবিন্দপুরে মেয়ে দেখতে যাব সামনের হপ্তায়। বুধবার ভালো দিন আছে। যাবার সময় বারবার গোপীনাথ বলে গেল বাবাকে, আমরা যেন কিছুতেই দেরি না করি। কারণ সংস্কৃতে কথাই আছে, শুভস্য শীভ্রম্ । আমার ভালো লাগল যে, গোপীনাথ একবার অন্তত ঠিক কথাটা বলেছে সংস্কৃতে।। 

আমাদের তখন খুবই দুঃসময়। তবু বেশ কয়েকদিন আমাদের কাটল গোবিন্দপুর যাওয়া-আসায়। বাবা গেল দুবার, শঙ্করবাবু আবার একবার এলেন। দেওয়া-থোওয়া নিয়ে কথাবার্তা হল। আমাকে বারবার বলা হল মেয়ে দেখতে যেতে। কিন্তু আমি গেলাম না। আমি শুধু সারা বর্ষাকাল ভেবে ভেবে কাটালাম, আমাদের এই অভাবের সংসারে সেই দুধে-আলতা গায়ের রঙকে কোথায় রাখব। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. রাধানাথ মন্ডলের এই গল্পটি যথেষ্ট ভালো। আমার নিজের ছেলেবেলার গ্রাম কিষ্টগঞ্জের(কৃষ্ণগঞ্জ)উল্লেখ দেখে সেই ছোটবেলার দিনগুলি মনে পড়ল। অকালপ্রয়াত এই লেখককে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

    উত্তরমুছুন