সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, "যার অভিজ্ঞতা পরিব্যাপ্ত নয় তার পক্ষে গল্পের অঞ্চলে বেশিদূর যাওয়াটা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। গল্পের আকর্ষণটা তখন আর তীব্র হয় না। গল্পে আকর্ষণ তৈরির জন্য বাস্তব জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। যে কারণে বিমূর্ত একটি গল্প যখন কেউ ছাপান তখন সেটি পড়ে পাঠক খুব আনন্দ পান বলে মনে হয় না। বিমূর্ত গল্পও লেখা যায়, শিল্পের একটা অঞ্চলে বাস্তবকে অস্বীকার করে গল্প লেখা সম্ভব— সেরকম গল্প লেখাও হয়েছে প্রচুর। কিন্তু আমি যে ধরনের গল্প লিখি সেখানে বাস্তব থেকে যদি খুব দূরে চলে যাই তাহলে মানুষ ভাববে ওই গল্পে কোনো অংশগ্রহণ নেই।" আর এ কারণে তিনি সহজিয়া ধারায় লেখেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্প লেখার চেয়ে গল্প কথনের দিকে বেশি জোর দেন বলেই হয়তো তার বর্ণনা ভঙ্গি পাঠকের কাছে আপন বলে মনে হয়। তার গল্প বলার নিজস্ব একটা স্বর আছে। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ তিনি পাঠকের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। এসব কারণে খুব সহজে গল্পের জটিল অংশের সঙ্গেও পাঠকের একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। গল্প পড়তে পড়তে পাঠক টের পান কতগুলো ঘটনা জুড়ে যাচ্ছে পরস্পর, চেনা আখ্যানে তৈরি হচ্ছে অচেনা এক পরিসর। তবে তাঁর গল্প বলার ঢং, গল্পের নির্মাণশৈলী আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও সেখানে অনায়াসেই ঢুকে পড়ে জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ, পরাবাস্তবতার অনুভব। আর বাস্তব, অবাস্তব, স্মৃতি-বিস্মৃতি, জাগতিক টানাপোড়নের আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করে অদ্ভুত এক স্বপ্নময়তার ভেতরে। কখনো কখনো পাঠককে ঘোরে রেখে তিনি সমাপ্তির ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দেন, কখনো বা গল্পের চূড়ান্ত সমাপ্তি টানেন।
একটি গল্পের সমাপ্তি যখন পাঠকের হাতে থাকে তখন চাইলেও পাঠক সহজে গল্পটি ভুলতে পারেন না। এমন জায়গাতে গল্পকথক থামেন যে পাঠকের মনে একটি দ্যোতনা তৈরি হয়, তার নিজের মতো ভাবার যথেষ্ট সুযোগ থাকে। ঠিক এই বিষয়টিই ঘটছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘আরামকেদারা’ আর ‘খড়ম’ গল্পে।
‘খড়ম’ গল্পে গল্পকথক কোনোরকম আতিশয্য ছাড়াই পাঠককে জানাচ্ছেন একজন বাবার দর্শন ও জীবনাচরণের প্রতি তার ছেলের বিদ্বেষ আর বিরক্তির কথা। বাবার সঙ্গে রাসেলের দূরত্ব বেড়েছে বাবার জীবনযাপন পদ্ধতির জন্য। আসলে "রাসেল বাম ছাত্র রাজনীতি করলেও, গরিবের রুটি-রুজি অধিকারের জন্য সংগ্রামী জীবন বেছে নিলেও কিছু ব্যাপারে ওর রুচি রয়ে গেছে নিতান্ত বুর্জোয়াসুলভ।"
গল্পের নামকরণের জন্য অবধারিতভাবে গল্পের অন্যতম টুল হবে খড়ম, তা ভাবতে ভাবতে গল্পপাঠ যখন এগোয় তখন অনেক পরে খড়মের দেখা পাওয়া যায়। রাসেলের দাদার একজোড়া খড়ম ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব মডেলের, পায়ের আকৃতির এক ইঞ্চি পুরু কাঠ, তাতে বুড়ো আঙুল আর প্রথমা যেখানে থাকার কথা ঠিক তার মাঝখানে কাঠের একটা উঁচু পেগ। এই খড়ম পরে রাসেলের বাবা যখন হাঁটেন তখন ডারউইনের বাঁদর তত্ত্বের প্রতিফলন দেখে রাসেল। ‘'বাবার যেসব বিষয় রাসেলের অপছন্দ, তার তালিকা করতে বসলে আসলেই বেশ লম্বা হয়ে যাবে।’' তবে সেই তালিকার একদম শুরুতেই থাকবে বাবার খড়মজোড়া।
গল্পের শুরু থেকে বাবা ও ছেলের মধ্যে দূরত্বের যে আবহ তৈরি করা হয় তা ঘনীভূত হয় এই খড়মজোড়াকে ঘিরে। আবার হাজতে বন্দি ছেলের কান উদগ্রীব হয়ে ওঠে খড়মজোড়ার খট খট খট শব্দের নৈকট্যে, যা পিতা-পুত্রের মধ্যকার সীমারেখা ভেঙে ফেলতে চায়। গল্পের এই সমাপ্তিলগ্নেই পাঠকের দর্শন ও কল্পনার মধ্যে একটা সেতু তৈরি হয়। পাঠক চোখের সামনে দেখতে পান যা ঘটার কথা নয় তা ঘটছে, তৈরি হচ্ছে এক স্বপ্নময়তা যেখানে, ‘‘পায়ের বুড়ো আঙুল এবং প্রথমা দিয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে কেউ যেন চেপে ধরেছে খড়মের পেগ অথবা কিলক, এবং অসম্ভব ক্ষমতায় এবং তীব্রতায় খড়মদুটি উঠছে, নামছে, নামছে, এগিয়ে আসছে, যেন এক্ষুনি তারা ভেঙে পড়বে জগৎসংসারের ওপর, পিটিয়ে তক্তা করে দেবে বন্দুক আর সঙ্গিনওলা হাতগুলিকে, ক্ষমতার তেল লেপা মাথাগুলিকে, লাঠি হাতে ভয়ানক দৈত্যগুলিকে। রাসেল আরও দেখল, খড়মপরা পায়ের ওপর তীব্র আক্রোশে নাচছে একটি সাদা লুঙ্গির পাড়, সফেদ একটা ঘূর্ণি উঠছে সেখান থেকে, যার শক্তির নিচে অসহায় হয়ে পড়ছে খাকি প্যান্ট আর ভারি বুটগুলো। রাসেলের অভিমান বাষ্প হয়ে চোখ ঢেকে দেওয়ার আগে সে দেখলো পিতামহের পায়ের ছাপ লাগানো দুটি খড়ম যেন টিপু সুলতানের দুই কামানের মহিমায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশের সব দেয়াল গরাদ।’’
‘আরামকেদারা’ গল্পে মাস্টারপাড়ার তকদির সাহেবের বানানো আরামকেদারাটা জুয়া খেলার টাকা জোগাড় করতে তার ছোট ছেলে যখন বিক্রি করে দেয় তখন সেটা মঈনের বাবা কিনে আনেন। এই কেনা-বেচার সঙ্গে যে একটি পরিবারের সম্ভ্রমের ঐতিহ্য লুকানো থাকে তা গল্পকথক পাঠককে জানান অবলীলায়, ‘‘জুয়ারি ছেলে থেকে মঈনের বাবা যেন তকদির সাহেবের বনেদিপনাটাও কিনলেন। তার চালচলন বদলে গেল।’’ এই গল্প বলার স্বর এত স্বাভাবিক যে পাঠকের মনে হয় তিনি গল্পকথকের পাশে বসেই গল্পটি শুনছেন।
‘খড়ম’ গল্পের মতো এই গল্পেও বাবার প্রতি বিদ্ধ থাকে ছেলে মঈনের অভিমানের তীর। ‘‘বাবা তুমি মাকে খুন করেছ’’—মঈনের এই অভিযোগের গভীরে লুকানো অর্থ খোঁজার ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিতে দিতে গল্পকথক পাঠকের কাছেই জানতে চান, ‘‘ঠিক কিনা বলুন?’’ এতে পাঠক নিজের অজান্তেই গল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আখ্যানের ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপর গল্পটি মঈনের বাবার গল্প না হয়ে মঈনের মায়ের গল্প হয়ে ওঠে, ছোট ছোট আনন্দ চুরি হয়ে যাওয়ায় যেই মানুষটা একদিন খুনই হয়ে গেছেন। যার বর্ণনা লেখক কোনো উচ্চকিত আবেগ ছাড়াই দিচ্ছেন, ‘‘মঈনের ছেলেবেলার স্মৃতিতে যে মা, তাঁর মুখখানি হাসিতে ভাসত; গলায় ছিল গান, তাঁর কথায় সুর উঠত; সেই মা যখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, তাঁর হাসি ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসে, আনন্দও বিদায় নিয়েছে। মঈন একবার একটা প্রজাপতি ধরে কাচের বয়ামে রেখেছিল। ভেবেছিল, প্রজাপতিটার ওড়াওড়ি খুব কাছ থেকে দেখবে। দুদিন পর বয়াম হাতে নিয়ে দেখল, প্রজাপতিটা স্তব্ধ পড়ে আছে—মরা। আর বয়ামের কাচের গায়ে লেগে আছে তার ডানার সব রেণু।’’
বাবার মৃত্যুর পর মঈন নিজের ফ্লাটে বাবার আরামকেদারা নিয়ে আসে। অদ্ভুতভাবে একদিন মঈন সেই কেদারা থেকে ঘ্রাণ পেতে শুরু করে, যে ঘ্রাণ তার বাবার নয়, মায়ের। একদিন চাঁদের আলোয় মঈন বাবা আর মাকে আরামকেদারার সামনে দেখে, শোনে তাদের কথোপকথন। এভাবে একটা আরামকেদারা কী করে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতার রূপক হয়ে ওঠে, কী করে মানবিক সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল তুলে ফেলে সেই গল্পই মৃদুলয়ে বলে যান গল্পকথক।
‘মেয়ে’ গল্পে একটি শব্দ আছে, ‘পরাসাধারণ।’ গল্পটি সাধারণ-অসাধারণের বাইরের এক ‘পরাসাধারণ’ গল্প। গল্পটি একটি মেয়েকে নিয়ে। যে পৃথিবীতে এসেছে আবার আসেওনি। এদিকে অন্তঃসত্ত্বা লিপি জন্য বরাদ্দকৃত বাড়ির সব ভারি ভারি কাজগুলো কে যেন করে দিচ্ছে। সাফসুতরো করে উঠান ঝাঁট দেওয়া, রান্না-বান্না করা, কলসিতে করে পানি তোলা ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজকর্ম চোখের নিমিষেই হয়ে যাচ্ছে। লিপির শাশুড়ি লুৎফা বেগম যে কিনা ‘‘সনি বা জিটিভির সিরিয়ালের শাশুড়ির’’ মতো তিনি কোনো ভুল ধরার সুযোগই পাচ্ছেন না। বিহ্বল লিপি তার এই সৌভাগ্যের ভেতরেও সিঁটিয়ে যাচ্ছে একটা কথা ভেবে যে আর কেউ না জানুক সে তো জানে তার পেটের সন্তানটি মেয়ে। স্বামী শাশুড়ির কাঙ্ক্ষিত ছেলে সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে তার কী দুর্দশা হবে সেটি ভেবেই লিপি আতংকিত। লিপি দেখছে, পরির মতো সুন্দর, চাঁপাকলির মতো আঙুল আর হরিণচোখের একটি মেয়ে তার পেটের ওপর থেকে বেরিয়ে আসছে। ঘটছে অভিনব সব ঘটনা। চেনা আখ্যানের এই গল্পটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠক আটকে থাকে গল্পে বর্ণিত খণ্ড খণ্ড ঘটনার অভিনবত্বের কারণে। এমন বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে গল্প এগিয়ে যায় যে, লিপির পেটের ভেতরে থাকা বেতমিজ মেয়ে লাথি দিয়ে দাদার হাত ভেঙে দিলেও পাঠক বিষয়টা আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়ার ফুরসৎও পায় না।
‘নোলক’ গল্পের জ্যোৎস্না একজন সুকণ্ঠী রূপসী গায়িকা। হাতেম আলি চেয়ারম্যানের বাড়িতে গানের আসরে গান শুনতে এসে এসডিও কাজেম শেখ সারারাত ঠায় বসে গান শুনে মশার কামড় খান। তিনদিন পর তার ম্যালেরিয়া হয়, এগারোদিন পর তিনি মারা যান। এই হলো জ্যোৎস্নার কণ্ঠসুষমা, রূপমাধুর্যের এক টুকরো ইঙ্গিত। এই গল্পের ভাষা সহজ, সরল কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক। প্রথম বাক্যই যেন পাঠককে টেনে ধরছে, ‘‘বারই গ্রামের জ্যোৎস্নাকে কে না চিনতো?’ পাঠকের মনে হবে, কেন তাকে চিনতে হবে। ওদিকে বুড়োবাঘের আক্রমণে হাত নুলো হওয়া সিরাজুদ্দিনের ছেলে মকনের নামোল্লেখ করে কোনো এক ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েই যখন গল্পকথক থেমে যান আর পাঠক উৎসুক হয়ে ওঠেন। বাঘের সঙ্গে বাঘিনীর সম্পর্ক, এদের দাম্পত্য, যৌনজীবন সম্পর্কে দেওয়া খুচরো তথ্যগুলো কীভাবে গল্পের আখ্যান নির্মাণে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তা জানার জন্য পাঠক উদগ্রীব হন যখন গল্পকথক বলেন, ‘‘‘সঙ্গিনী বাঘিনীর গা থেকে একটা বিশেষ ঘ্রাণ বেরোয়, বিশেষ করে জোছনার রাতে, যার টানে বাঘ বেহুশ পর্যন্ত হয়ে যায়।’’ ধীরে ধীরে পাঠক ঢুকে যায় গল্পের ভেতরে। পোলিও আক্রান্ত জ্যোৎস্নার পা ‘নুলা’ তাই তার বিয়ে হয়নি। জ্যোৎস্নাকে ঘিরে আসা চরিত্রগুলো একটি গায়ক মাক্কু শাহ যিনি জ্যোৎস্নাকে শিষ্য হিসেবে পেতে উদগ্রীব ছিলেন। মাক্কু শাহ জ্যোৎস্নাকে নিজের হাতে একটি নোলক উপহার দেন যা পরে ‘‘শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে, অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর’’ গানটি গাইলে শ্রোতার অঙ্গও জ্বলে উঠবে।
এই গল্পটির উপভোগ্য বিষয় হলো গল্প বলার ভঙ্গিটি কখনো কখনো সরস হয়ে যায়। কৌতূহল জাগায়। মাঝেমধ্যে কিছু বর্ণনায় পাঠকের টান টান মেজাজ শিথিল হয়। বেহালাবাদক জ্যোতির্ময় পালের অপার্থিব বেহালা বাদনে কোনো এক আষাঢ়ের দিনে শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুরের চোখে জল এসেছিল, ‘‘তবে সে জল বৃষ্টির ফোঁটাও হতে পারে।’’ এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সরস বাক্য আছে এই গল্পে।
মকনকে ঘিরে যেই গল্পের আভাস শুরুতে দেওয়া হয়েছিল সেটাই গল্পের ক্লাইমেক্স হিসেবে চলে আসে। মকন জ্যোৎস্নার প্রেমিক। সে জ্যোৎস্নার প্রেমে এতোই বিভোর হয় যে জ্যোৎস্নার শরীরের ঘ্রাণ পায় তার অনুপস্থিতিতে, অথচ জ্যোৎস্না পাঁচ দিন আগে নদীতীর দিয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে গিয়েছিল চানমিয়ার বাড়ি। একদিন মকনের মতো তার বাবা সিরাজউদ্দিনও বাড়ির বাতাসে চমৎকার ঘ্রাণ পায়। আর পায় জ্যোৎস্নার সেই ‘নোলক’ যার সঙ্গে জ্যোৎস্নার নাকের নরম অংশের মাংস লেগে থাকে। জ্যোৎস্না তার ‘নুলা’ পা দিয়ে তার আর মকনের মাঝখানের দেয়ালকে ডিঙাতে পারেনি—এমন কোনো সমাপ্তি বা অভিনব কোনো সমাপ্তি না টেনে গল্পকথক ‘নোলক’ গল্পের সমাপ্তি টেনেছেন। যদিও পাঠক হিসেবে মকনের চূড়ান্ত পরিণতির মাধ্যমে এই গল্পের সমাপ্তি টানা আমার কাছে অনাবশ্যক মনে হয়েছে।
"ডিডেলাসের ঘুড়ি" গল্পে হোসেন মিয়ার সঙ্গে ইমানের জীবনের সংযোগ পরগাছার মতো। হোসেন মিয়ার বড় ভাইয়ের ঘুড়ি ওড়ানোর নেশার যোগানদার ছিল ইমানের বাবা সেতু মিয়া যার ঘুড়ির সুনাম ছিল চারখাঁন পুল থেকে দয়াগঞ্জ, দক্ষিণ মৈশন্ডি থেকে ছোট কাটরা। বাপ-বাপ মরা নয় মাসের শিশু ইমান কীভাবে বড় হলো তা গল্পকার জানেন না বলে হেঁয়ালি করে বলেন, "পৃথিবীতে সত্যধর্ম কোথাও কিছু অবশিষ্ট আছে নিশ্চয়, ইমানের বড় হওয়া তার প্রমাণ।" মৃত্যুর দু’দিন আগে ইমানকে কোলে নিয়ে ঘুড়ি উড়িয়েছে সেতু মিয়া। একদিন তার মাথায় ইমানকে ঘুড়ির সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়ার অদ্ভুত চিন্তা এসেছিল। সেতু মিয়া ভেবেছে, "কী পল্কা ছেলেটা, ওজনহীন, যেন পাখির পালকে ভর্তি তার ভেতরটা। সেতু মিয়া মনে মনে একটা ঢাউস ঘুড়ি তৈরি করে ফেলেছে, যাতে বেঁধে দিলে ছেলেটা আকাশের অনেক দূরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু সেই মুহূর্তে ইকারুসের কথা মনে পড়েছে তার, এবং নিজেকে আবিষ্কার করেছে হতভাগা ডিডেলাসের জায়গায়। অথবা, এ রকম হয়তো মনে পড়েনি বা পড়া সম্ভব ছিল না তার, হেতু তার শিক্ষার অভাব। আমরাই তার ওপর আমাদের চিন্তাটা চাপিয়ে দিয়েছি। সে যাই হোক, সেতু মিয়া শিউরে উঠেছে।''
"ডিডেলাসের ঘুড়ি"র রহস্য বুঝতে এবার একটু গ্রিক মিথলজির দিকে যাওয়া যাক। গ্রিক পুরাণে আছে, ডিডেলাস ছিলেন এথেন্স এর বিখ্যাত স্থপতি, ভাস্কর ও আবিস্কারক। ইকারুস ছিল ডিডেলাসের একমাত্র ছেলে। একবার রাজা ডিডেলাসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ডিডেলাস ও তার পুত্র ইকারুসকে বন্দী করেন গোলক ধাঁধার ভেতর। ডিডেলাস পালানোর জন্য পাখির পালক, মৌচাক থেকে মোম সংগ্রহ করে ছেলে ও নিজের জন্য দুই জোড়া পাখা তৈরি করেন। ওড়ার আগে তিনি ইকারুসকে সাবধান করে দেন যাতে সে সূর্যের কাছে না চলে যায় কিন্তু ইকারুস বাবার সাবধান বাণী ভুলে সূর্যের কাছে যায় এবং সূর্যের উত্তাপে তার পাখার মোম গলে পাখা খুলে যায়। আর করুণ পরিণতি হয় ইকারুসের।
ইকারুসের মতো করুণ পরিণতি ঘটবে গ্যারেজ শ্রমিক ইমানের তার আভাস পেয়ে গল্পের ভেতরে পাঠক ঢুকে পড়তেই গল্পের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যায়। ঘটে যায় একটি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। গল্পের এই পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক কিছু চরিত্র আসে—অবসরপ্রাপ্ত দারোগা কলিমুল্লাহ, তার স্ত্রী, সাংবাদিক আবদুল মুয়ীদ তালুকদার, সাবরিনা নীনা, অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী। পরিমিত মাত্রায় চরিত্রগুলোকে চিত্রণ করে গল্পকার নির্বিকারভাবে দেখাতে থাকেন "ওপরওয়ালা''র নির্দেশে কী কী ঘটতে থাকে। সত্যধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন দেখে ধর্ষণ মামলার একজন চাক্ষুষ সাক্ষী ইমান আলী কী করে নিজেই দারোগা সাহেবের ঘরের মূল্যবান সামগ্রী চুরির মামলায় অভিযুক্ত হয়। রাজনীতির পাঁকচক্র, ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনের ফারাকসহ গল্পকথক নির্বিকারভাবে দেখাতে থাকেন আমাদের সমাজের পচন আর নতজানু মস্তকের মানুষদের। যারা ভাবলেশহীনভাবে প্রত্যহ দেখে চলে কী করে ইকারুসের রূপকে ইমান আলীর মতো মানুষের মোমডানা সূর্যের উত্তাপে গলে গলে যায়।
"ডিডেলাসের ঘুড়ি" গল্পটি উপলব্ধি করায় কখনো কখনো মিথ্যে সত্যের অধিক, সত্যের ছাঁচে ফেলা এসব মিথ্যের হাতে সত্যের মৃত্যু ঘটে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পে জলের মতো প্রবাহিত হয় ভাষার গতি, কোনো রকমের বাহুল্য ছাড়াই ধীরে ধীরে পল্লবিত হয় গল্পের আখ্যান। আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া তুচ্ছ একটা বস্তু বা ঘটনা তার গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। যা সাধারণ চোখে আমরা হেলায় হারাই সেসবই মুক্তোর মতো খুঁটে তোলেন গল্পকার, যার সঙ্গে মিশিয়ে দেন মানবিক সম্পর্কের অতলস্পর্শী অনুভব, পরাবাস্তবতা আর জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ।
0 মন্তব্যসমূহ