নআজু মাইয়ের শিথানে দুঃখ, পৈতানে সুখ।
আজু মাইয়ের ভিটের কাছে এসে বুজরুক বাগবাগের মানুষের পা সরে না। শরীর মাটিতে গেঁথে যায়। কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসে।
বন্ধুর হাত টেনে কাঞ্চন হিসহিস করে ওঠে,‘ওইদিকে যাইস না।’ এমন নাসূচক বাক্য শুনে এ গাঁয়ে সদ্য পা রাখা আগন্তুকও থমকে যায়। বড় বড় চোখ করে তাকায় নিষিদ্ধ পথের দিকে। এই পথে যাবে কি যাবে না দ্বিতীয়বার ভাবে। বারণ শুনে বড়রা দূরে থাক গাঁয়ের ছেলেছোকড়ার দলও কৌতূহলী হয় না। ওদিকটা এদের ঘুরে দেখা শেষ বিষয়টা তেমন নয়। শংকার ঢেউ কৌতূহলকে ছাপিয়ে গেলে দুঃসাহস দেখানোর সাধ্য থাকে না।
‘যাবি না খবরদার।’
কাঞ্চনের সাবধানবাণীতে ওর বন্ধুর বুকের ভেতরে ভয়ের চোরাস্রোত পাক খায় কিন্তু সে কাঞ্চনকে তা বুঝতে দেয় না। মা মরা ছেলে শাহীনের সাহস বেশি। সৎমায়ের ভয়-ডরও তার গায়ে লাগে না। মাঝেমধ্যে সে ঐ পথে পা বাড়াতে চায়। পরে কাঞ্চনের কসম শুনে ফিরে আসে।
কাঞ্চন শাহীনের গেঞ্জি ধরে টান দেয়, ‘আল্লার কিরা, যাইস না কইলাম। সবকিছুতে তোর খালি বেশি বেশি। ধরা খাইলে বুঝবি মজা।’
ঝোঁপের আড়ালে মড়মড় শব্দ হয়।
কাঞ্চন বন্ধুর হাত চেপে ধরে।
‘কে আসছে রে...।’
শাহীন ম্লান মুখে হাসে, ‘আজু মাই!’
জঙ্গল মাড়িয়ে আজু মাই এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাশফুল চুলের ঘোমটা খসে গেছে। সাদা সাদা চুল আর দুমড়ানো শরীর দেখে আজু মাইয়ের বয়স আন্দাজ করা যায় না। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে তারা জানে, এই দেশের জন্মসনে আজু মাই ছিল টানটান গড়নের এক কিশোরী। এখন তার ত্বকে বয়সের নির্মম রেখাচিত্র। কেউ না জানে না জানুক এই মাটি জানে, এইসব রেখা আদতে এ দেশের মানচিত্রে থাকা দাগ।
আজু মাইয়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বিচিত্র সেই হাসি দেখে হতচকিত বালকেরা নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।
শীর্ণ হাত দুটি পাটাতনের মতো সামনে ছড়িয়ে আজু মাই তাদের ডাকে, ‘আয় আয় ফুল বাবু, মোয়া খাবি, লজেন্স খাবি?’
এই জঙ্গলের নাম বুড়ির জঙ্গল। মৌজা সুজ্জেরটুকি। এখানেই আজু মাইয়ের বসতি। আকাশমুখী দীর্ঘকায় গাছগাছালির পায়ের কাছে তার বাড়িঘর। আজু মাই মাটি সোহাগী, গাছ সোহাগী। মাটির বিবিধ ঘ্রাণ তার প্রাণ সঞ্জীবনী। ঝরাপাতার শোভাই তার বসনভূষণ। সবাই জানে, অতিকায় বৃক্ষ থেকে তুচ্ছ গুল্ম-লতা সবই আজু মাইয়ের বশ। আজু মাই এদেরও মা। অগুনতি গাছের জন্মবিত্তান্ত তারই হাতেই লেখা।
মাথার ওপর আততায়ী রোদ ঝলকায়। সেই ঝলকানিতে বাদামি চামড়ার ওপরে শীর্ণ নদীর মতো প্রবাহিত অসংখ্য শিরা-উপশিরার অধিকারী আজু মাইকে অদ্ভুতুড়ে দেখায়। কেউ কেউ বলে, আজু মাই ভুত-প্রেত পোষে। অশরীরীদের খাবারের যোগান দেয়। তাই ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে এই জঙ্গলে। রত্নপুকুরে রত্ন জ্বলে। ধরতে গেলে ডুবে-ভাসে। দুম করে কালসাঁঝ নামে। ঝুমুরঝুমুর মল পায়ে রাতভর নৃত্য করে কেউ। অমন রাত ফুরিয়ে ভোর এলে জঙ্গলে কচি কচি ছেলেপেলের হাড়গোড় পাওয়া যায়।
গেল শনিবারে আজু মাইয়ের ঘরের কাছে হাওয়ায় একটা মুণ্ডুকাটা শরীর লটকে ছিল। এসব নিজের চোখে কেউ না দেখলেও এই গাঁয়ের সকলেই সব জানে।
আজু মাই আবার ডাকে, ‘আয় আয় ফুল বাবু, আয়...।’
শিকারির হাতে ধরা পড়ার আগেই কাঞ্চন আর শাহীনের শরীর বাতাসে মিলিয়ে যায়। বাতাসের পিছু পিছু দৌড়ায় না আজু মাই। কোলে তার ফুল বিবি। যদি ব্যথা পায়। ফুল বিবিকে আঁকড়ে ধরে আজু মাই জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এই দিকেই মিত্তিরদের পুকুর। নাম তার রত্নপুকুর। আজু মাই পানিতে ডুব দিতে পা বাড়ায়। ফুল বিবি তার দুপা টেনে ধরে।
আজু মাই একবার পুকুরের গভীরে চলে গিয়েছিল। অতল পানিতে দিয়েছিল ডুব। ডুব ডুব ডুব। ডুবতে ডুবতে পাতালপুরীতে পেয়েছিল সুখের সংসার। ফিরে আসার আর পথ ছিল না। পা টেনে ধরেছিল এক রাজপুত্তুর। সেই রাজপুত্তুরের চোখজোড়া কাজলকালো, ত্বক সোনা জল দিয়ে ধোওয়া। সৌম্যদর্শন রাজা পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল আর মিটিমিটি হাসছিল।
রাজার সোহাগে সোহাগিনী আজু মাই খুশিতে বাকবাকুম হয়ে আর ফিরতেই চায়নি। কিন্তু মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনে আজু মাই ভু-উ-স করে ভেসে উঠেছিল, মায়ের আঁচলের খুঁট ধরেই। এক পেট পানি নিয়ে মাটির পৃথিবীতে ফিরেছিল সে। এরপর থেকে মা আর তাকে সহজে পানির কাছে যেতে দিতো না। তাই কি সে মায়ের বারণ শোনার পাত্র?
যে সংসার সে পাতালপুরীতে রেখে এসেছে তার খোঁজে আজও রত্নপুকুরে ডুব দেয় আজু মাই। পুকুরে রত্ন নেই। আছে পচা পানা। তবু আজু মাই ডুব দেয়। ডু-উ-ব। তলিয়ে যায় না। প্রতিবারই মায়ের আঁচলের খুঁট ধরে ভেসে ওঠে, ভু-উ-স। তাকে দেখে ফুল বিবিও স্বস্তি পায়।
এখন আর পানিতে নামবে না আজু মাই। তার মন পানির মতো স্থির। পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডালে ডালে, পাতায় পাতায় ঠোকাঠোকির বিচিত্র শব্দ হচ্ছে। আজু মাই কান খাড়া করে। কোলে ঝুলে থাকা ফুল বিবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করতে করতে হাত তোলে। কী এক ইশারা করে। তখনি সব কোলাহল থেমে যায়। থেমে যায় পাতার নাচন। শুনশান জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আজু মাই এদিকে-সেদিকে তাকায়। কী খোঁজে, কী পায় বোঝা যায় না।
শনশন পাতা দোলে, আজু মাইয়ের শরীরও দোলে। দুলতে দুলতে সে আকাশের দিকে তাকায়।
শেষ পর্যন্ত আজু মাইয়ের নজর আকাশের দিকেই আটকে যায়। আশ্বিনের আকাশের রূপ এখন বড় বেয়াড়া। এ প্রান্ত থেকে সেই প্রান্তে ভয়াল মেঘের সাজ। কে বলবে খানিক আগেও রোদের ঝলকে চোখ পাতা দায় ছিল।
আজু মাই এবার মেঘ গুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক-দুই-তিন-চার...গুনতে গুনতে সে আকাশের সিঁড়ি ভাঙে। আকাশজুড়ে উদগ্র ডানার মেঘ। মেঘের কৃষ্ণবর্ণ দেখে বৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়। মেঘ কাল বৃষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমন বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে যায় সব, সময়ে সময়ে প্লাবন হয়। ভাসিয়ে নেয় রাবণরাজ্য। ভীষণ মজা হয় তখন।
তবু আজু মাইকে বিমর্ষ লাগে। আকাশের বিষাদ ভঙ্গি দেখে তার মাথা অবনত হয়। কী একটা মনে করে সে ছুটতে থাকে। নিষিদ্ধ পথই তার লক্ষ্য। পথিমধ্যে তার দেখা হয় শাহেনশাহর সঙ্গে। শাহেনশাহ রাজাকার আজমের ছেলে। বাপের কলংক শাহেনশাহের পিছু ছাড়ে না। আজু মাইকে দেখে সে খিস্তি করে।
আজু মাই খুশি হয়ে ওঠে। অগুনতি দাঁত বের করে হাসে, ‘রাজাকারের পুত, আল্লাহ-খোদার নাম নাই, মরলে হবি ভুত।’
শাহেনশাহের নেশা এখন চরমে। আগ্রাসী সুখে বিভোর সে। থই পায় না। মাথার ভেতরে পিলপিল করে ধোঁয়ার ঘূর্ণি ঢুকে পড়ছে। মুখোমুখি বসে থাকা নেশার সঙ্গীর কথাও বিস্মৃত হয়েছে শাহেনশাহ।
হাত উঁচু করে ঘুরিয়ে নবাবি কায়দায় শাহেনশাহ ‘হাট হাট’ বলে মাছি তাড়ায়। ডুমো নীল মাছিটা যায় না। পচা খেয়ে উড়ে উড়ে বাঁচে। দেখে আজু মাই হাততালি দেয়। তালিতে মুখরিত বাতাস ধাক্কা দেয় শাহেনশাহকে। সে থড়বড় থড়বড় করে। বৃষ্টি লাগা কচি ঘাসের বিছানায় শাহেনশাহের শরীর নেতিয়ে পড়ে।
শাহেনশাহের বেহাল দশা দেখতে দেখতে জলা থেকে শাপলা তুলে ঘরে ফেরে আজু মাই। গোলাপি শাপলা থেকে ফুলগুলো আলাদা করে ডাটা কেটেবেছে নেয়। খুশিমনে দুই কানের পাশে লাল-সাদা ফুল গোঁজে। ফুল বিবির চুলেও ফুল গুঁজে দেয়। তারপর মাটির চুলায় চ্যালা কাঠ ঠেলে আগুন দিতে দিতে গুনগুন করে।
একার সংসারে আজু মাইয়ের খাবারের ঝামেলা নেই। পোটলা থেকে চাল বের করে মাটির হাঁড়িতে গলা পর্যন্ত পানি দিয়ে ভাত চড়ায়। ভাতের মধ্যে দুটো আলু ছেড়ে দেয়। সেভেন আপের ছোট প্লাস্টিকের বোতল থেকে সয়াবিন তেল থেকে অর্ধেকটা নিয়ে মাথায় ঢালে। ভেজা চুল হাতড়ে উকুন বাছতে বাছতে গুনগুন করে।
কাজ সেরে খেয়েদেয়ে ফুল বিবিকে কোলে নিয়ে পুরো জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। জঙ্গলের শত্রু তাড়ায়। গাছ-গাছালিকে বিপদমুক্ত করে। বীজ ছড়ায়, ডাল লাগায়।
মাটির মায়ায় দিন কেটে যায় যেমন তেমন। আজু মাইয়ের রাত আর কাটে না।
বিষ বেদনায় রাতে আজু মাইয়ের ঘুম আসে না। সারা শরীরে কালগোখরা ছোবল দেয়। বিষে বিষে নীল আজু মাই না চাইলেও রোজ দিন ফুরিয়ে যায়। ঝুপঝুপিয়ে রাত নামে। রাত মানেই অমাবস্যার আঁধার। মাথার ওপর ঝুলতে থাকা মস্ত চাঁদ হাওয়া হয়ে যায়। আকাশের অন্ধকার জমিনে তারারা দিশা হারিয়ে শনের চালায় টুপটাপ খসে পড়ে, আলোর বিস্ফোরণ হয়। আজু মাই চমকে চমকে ওঠে। যে কারণে-অকারণে দাবড়ে বেড়ায় ভয়কে, সেই ভয়ই তাকে দশ হাতে ধরতে আসে।
ভয় তাড়াতে কথা বলে ফুল বিবির সঙ্গে।
‘ফুল বিবি, ফুল বিবি, ঘোষাল বাড়ি যাবা? মোয়া লাড়ু খাবা?
ফুল বিবি খাবে বললে আজু মাই খুশি হয়। নিজের হাতেই মোয়া মুড়কি বানায়। আদর-যত্ন করে ফুল বিবির জন্য পাত পাতে।
রাত বাড়ে। ফের তাড়া করে ভয়। বুটের খটখট শব্দ। টানা-হাঁচড়ার আওয়াজ। বিকট শব্দের আহাজারি। তারপর নামে অখ- নীরবতা। নৈঃশব্দ্যের ভাষা পড়তে পড়তে আজু মাই কাঁদে। মা, মা করে কেঁদে কাতর হয়।
সমস্ত বুজরুক বাগবাগ যখন ঘুমে নিজের এক খণ্ড জমিনে কেবল তড়পায় নির্ঘুম আজু মাই। রাত গাঢ় হয় আর ভীষণ তোলপাড় শুরু হয় বুকের ভেতর। মাথার চাঁদি গরম হয়ে আসে। ফাত ফাত করে জ্বলে সমগ্র শরীর। শরীরের জ্বালায় আজু মাই মাটিতে গড়ায়। পাশে চুপটি করে থাকে ফুল বিবি। মাইয়ের দুঃখ দেখেও সাড়া দেয় না।
আজু মাইয়ের কষ্ট দেখে জঙ্গলের বৃক্ষরাজি শোকতপ্ত রাত্রি কাটায়। আকাশের বুকে লটকে থাকে বিষাদমাখা চাঁদ। পাতার ঝনঝনানি, বাতাসের কানাঘুষায় বোঝা যায় ওরাও কষ্টে আছে। ওরা জানে, সুখের দেখা পেতে আর মাত্র ক’প্রহর অপেক্ষা করতে হবে। তবেই জুড়াবে তাদের মায়ের গা।
আজু মাইয়ের শরীরের এই জ্বালা-যন্ত্রণার বয়স আটচল্লিশ বছর। ঘুমহীন শরীরের প্রতিটা অঙ্গ তাকে শেষ রাত পর্যন্ত কাতর করে রাখে। শেষ রাতেরই অপেক্ষায় থাকে আজু মাই। ঐ সময়ে তার পৈতানে সুখ গড়াগড়ি খায়। তার শরীরের শিথিল চামড়া নারীত্বের গৌরবে টানটান হয়। ডালিমের টানের শরীর ফেটে রক্তলাল দানা ছড়িয়ে পড়ে। ঋতুবতী আজু মাই ডালিমের দানা খুটে ভরে তোলে আঁচলের নদী। নদীর জোয়ারের পানি সব বাঁধা ডিঙিয়ে প্লাবিত করে তার শরীর। আজু মাই মাতৃত্বের সুখে কাতরায়। তার স্তনবৃন্ত কোমল পুষ্পের মতো ফুটে ওঠে। কুলকুল করে দুধের স্রোত বয়। দুধের ফেনিল সমুদ্র আজু মাইয়ের পায়ে লুটায়।
সুখে বিভোর আজু মাই গুনগুন করে,
ফুলে ফুলে নাচানাচি
গাঙের জলে ঢেউ
ফুলি বিবি নাওয় আইল
সুখে উজাল গাঁও...
সুখের পরে আবার দুঃখ আসে। বুকের ঘরে দুঃখ উপচে উঠলে আজু মাইয়ের মস্তিষ্ক স্মৃতির দ্বারস্থ হয়। কখন তার স্নায়ুকোষ বিস্মৃতির গহ্বর খুঁড়ে স্মৃতি বের করে আনে সে টের পায় না।
মেয়ের শিথানের দুঃখের আভাস পেয়ে কত যে টোটকাটাটকি করেছে মা। মা-ই তো, আজুর মায়ের নাম ‘মা’। মায়ের চেহারা-ছবি ফুল বিবির মতো। অতল চোখ দুটো কাজল আঁকা, মুখে নিশ্চিন্তপুরী জর্দা মেশানো পান, খোঁপাভাঙা মাথায় তেল চুপচুপে সিঁথি।
আজু মাই ময়লা দাঁত বের করে হাসে। ফুল বিবিকে আদর করতে করতে কোলে নেয়। তারপর মায়ের মতো মা সেজে ফুল বিবিকে পশ্চিমমুখী করে বসায়, ডগমগ হয়ে কপালে-গালে চুমু খায়, ডাবের খোলে করে পানি পড়া খাওয়ায়।
মা দশ গাঁয়ের কবিরাজের খোঁজখবর রাখে। ন্যাংটাকাল থেকে অসুস্থ মেয়ের জন্য মা যে কত কবিরাজ ধরে তার কোনো ঠিক নেই। বড় পীরের দরগা থেকে পানি পড়া আনে, বিছানা বান্ধার দোয়া পড়ে অসুস্থ মেয়ের জন্য ঘুমের আয়োজন করে। আসমানের রোদ যখন মাটিতে লুটায় তখন মা গৃহস্থালি কাজকর্ম সারে। তারপর উজানদিঘীতে ডুব দেয়, মেয়েকেও নাইয়ে-ধুইয়ে উঠানে দাঁড় করিয়ে নিজ হাতে পানি পড়া দেয়। মায়ের নির্দেশমতো মেয়ে বিসমিল্লাহ বলে তিন ঢোকে খেয়ে ফেলে জাগ্রত পীরের পানিপড়া।
এই করে করে মেয়ে ডাগরডোগর হয়। মেয়ের লতানো শরীর দেখে মায়ের মুখে হাসি ফোটে। রাত নামলে সুখের আবেশে মা-মেয়ের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। একদিন রাতে গোলাগুলির শব্দে দুজনে ধড়ফড়িয়ে ওঠে। মা দেখে, মেয়ের শিথানে দুঃখের গড়াগড়ি। মা কাঁদে না। মেয়েকে বুকে নেয়। মায়ের কুসুম কুসুম বুকে ঢুকে মেয়ে ভোরের অপেক্ষা করে।
ভোর আর আসে না বুজরুক বাগবাগে। আসে অন্ধকার রাত্রি। এই রাত্রির পরিভ্রমণকাল দীর্ঘ, পথও শ্বাপদসংকুল। নয় মাস ভীষণ অন্ধকারে মা-মেয়ে সময় কাটে। তারপর মা একদিন চলে যায় ফুল বিবির কাছে। আজু উথাল-পাতাল কাঁদে। তার শিথানে দুঃখ বিনবিন বিনবিন করে।
একদিন শেষ রাতে পৈতানে সুখের গড়াগড়ি দেখতে পেয়ে আজুর বুকে সুখ উথলায়, দুঃখের প্রহর সংকুচিত হয়ে আসে। আর আজু থেকে সে হয় আজু মাই। পাগলা হাওয়া দোলে উদাম ঘরে। অন্ধকার নামে। তবু সব দেখতে পায় আজু মাই। থৈ থৈ অন্ধকারে আজু মাইয়ের পৈতানে ঝুমুরঝুমুর রুপার নুপূর পায়ে নাচে ফুল বিবি। ফুল বিবির নাচন দেখে আজু মাই সুখের সাগরে খাবি খায়। আজু মাইও খুশিতে নাচে। এ সুখের শেষ নেই, সীমা নেই। শেষ রাত ছাড়া ফুল বিবি যে প্রাণ পায় না!
আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ কেড়ে নিতে একদিন আসে রাজাকার আজম। আজমের নামের পূর্বে ব্যবহার করা বিশেষণ দেখে তার বাড়তি পরিচয় জানতে চাওয়া অনুচিত। বুজরুক বাগবাগের অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণিরা না জানলেও আজু মাই জানে, এক থেকে আটচল্লিশ একে একে যত বছরই পার হোক না কেন হারামি রাজাকার আমৃত্যু রাজাকারই থাকে।
শান্তি কমিটির সদস্য আজম আজো মানুষের শান্তি খায়। কড়কড় করে মোয়া-মুড়কির মতোন মানুষের ভিটে খায়, মাটি খায়।
সেদিন রাজাকার আজম আজু মাইয়ের চকটানা মাটিতে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তুমুল বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির ভাগ্যে ইতর প্রাণিটি আজু মাইয়ের হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। প্রাণে বেঁচে গেলে কী হবে নিজের বাড়ির উঠানে গিয়ে আছাড় খেয়ে রাজাকার আজমের মেরুদণ্ড মুড়মুড়িয়ে ভেঙে যায়। বিছানায় শুয়ে এখন চোখের পানির ফোঁটা গুণে সময় কাটে তার। আর তার পুত্র শাহেনশাহ গোণে টাকা। কড়কড়ে টাকা, বাপের তৈরি জমিদারী বিক্রি করে আর জঙ্গলে বসে চোলাই গেলে, পাতা ছাই করে ধোঁয়া উড়ায়।
সময়টা খারাপ। বুড়ির জঙ্গল ধোঁয়ায় ডুবে গেছে। একটা আগুনের শিখা তেড়েফুঁড়ে উঠছে। কোথায় জ্বলছে আগুন ধোঁয়ার যন্ত্রণায় ভালো করে দেখা যায় না। পটপট শব্দে পাঠকাঠির বেড়া, শন-পাতার ছাউনি পুড়ছে। গাছে গাছে ঠাসাঠাসি করে থাকা অন্ধকার আলোর স্বেচ্ছাচারিতায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।
আজু মাইয়ের ঘর পুড়ে ছাই। ফুল বিবিকে কোলে করে সে আগুনপথে হাঁটে। এ আগুন আজু মাইয়ের চেনা। আটচল্লিশ বছর আগে ঘোষাল বাড়ির বুড়ো দাদার ঘর পুড়েছিল এ আগুনে। লক্ষ্মী কাকীর সংসার লোপাট হয়েছিল।
আজু মাই ধীরস্থির হেঁটে চাঁদের নিচে এসে দাঁড়ায়। চাঁদ হতদরিদ্র্য চেহারায় আগুনআলো দেখছে। পুড়ে যাচ্ছে সব। পুড়ে যাচ্ছে আজু মাইয়ের সোনার সংসার।
সংসার পোড়া বেদনা বুকে আর সয় না। আজু মাই কাঁদে। ফুল বিবির অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে সেই কান্নার শব্দে। দুপেয়ে জীবের হুড়োহুড়ির শব্দ মিলিয়ে যায় দূরে। দূরাগত শত্রুর দিকে তাকিয়ে আজু মাইয়ের চোখে আগুন জ্বলে।
রাত ফুরিয়ে দিন ফুটেছে অনেকক্ষণ। আজকের দিনের ভাব-গতিও ভালো না। রাতভর আগুন জ্বলেছে। বৃষ্টি এসে জুড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গলের ক্ষত।
গম্ভীর আকাশে এখনো গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ। রোদের নিশানা নেই। শাহেনশাহ বাপের মতোন সিনা বাঁকিয়ে আজু মাইয়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কুৎসিত বুড়ির ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ঝুলতে দেখে শাহেনশাহের চোখে-মুখে ফস করে আগুন জ্বলে ওঠে।
‘ওই বুড়ি, এই জঙ্গল ছাড়বি। আমরা এইখানে ক্লাবঘর করুম। কাল সকালে য্যান দেখি পাখি উইড়া গেছে।’
ঘরপোড়া ছাই মাখা শরীরে আজু মাইকে অদ্ভুত দেখায়। সে হাসে। হাসির দমকে তার ঘোমটা খসে যায়। আকাশে মেঘ গর্জে ওঠে, গুড়ুমগুড়ুম। আজু মাইয়ের সামনে দাঁড়ানো শাহেনশাহী মেজাজের মানুষটাও গর্জে ওঠে।
‘আমার বাপ না তোরে পাক মিলিটারির মুত খাওয়াইছে। এবার তোরে আমি আমার মুত দিয়া গোসল করামু।’
খিস্তি করতে করতে শাহেনশাহ সামনে এগোয়। খিস্তিতে অভ্যস্ত আজু মাইয়ের কানজোড়া বাঁশপাতার মতো প্রসারিত হয়। শরীর সচকিত হয়ে ওঠে। ফুল বিবি মায়ের কোলে নড়েচড়ে।
এবার শাহেনশাহ হাসে। ওর হাসি বন্ধ হয় না। হাত-পা নেড় কদর্য ভঙ্গিতে শাহেনশাহ অভিনয় করে দেখায় নর-নারীর সঙ্গমদৃশ্য। ধূপছায়া মেঘ নেমে এসে আজু মাইকে আড়াল করে।
ফুল বিবিকে কোলে নিয়ে আজু মাই অনঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।
আচমকা এক কাণ্ড ঘটে যায়। আজু মাইয়ের কোলে থাকা খড়-বিচালির তৈরি ফুল বিবি নড়েচড়ে ওঠে। দেখতে দেখতে ফুল বিবির দুবলাপাতলা শরীর জেগে ওঠে। শাহেনশাহ বিমূঢ় হয়ে দেখে ফুল বিবি একটা প্রকাণ্ড বাজপাখি হয়ে গেছে।
আজু মাই গান গায়,
ফুলে ফুলে নাচানাচি
দ্যাখলো না তো কেউ
ফুলি বিবি নাওয় আইল
লাগলো সুখের ঢেউ...
আজু মাইয়ের মাথার ওপরে এক চক্কর কেটে শিকারি ভঙ্গিতে আকাশের দিকে উর্ধ্বমুখী হয় বাজপাখিটি।
প্রকাণ্ড বাজ ওড়ে, দেয় চক্কর...চক্কর... চক্কর। এরপর ঝট করে নেমে এসে শাহেনশাহের চোখে-মুখে ঠোক্কর দিতে থাকে। আজু মাই সন্তুষ্টচিত্তে দেখে ‘রাজাকারের পুতের’ শরীরে বিষ নামে। বিষের রং লাল। লাল লাল বিষে চরাচরের বিষক্ষয় হয়।
জঙ্গল কাঁপিয়ে আজু মাই হাসে। বড় দুর্লভ সেই হাসি। শিথানে আর পৈতানে অঢেল সুখ গড়াগড়ি খেলেই কেবল মানুষ এই হাসি হাসতে পারে।
লেখক পরিচিতি
সাদিয়া সুলতানা
গল্পকার। প্রবন্ধকার।
বাংলাদেশে থাকেন।
গল্পকার। প্রবন্ধকার।
বাংলাদেশে থাকেন।
5 মন্তব্যসমূহ
সুন্দর একটা গল্প পড়া হলো। আজু মাইয়ের কাশফুল চুল আর শীর্ণ নদীর মতো শিরা উপশিরা যেন চোখে ভাসছে। নিটোল নধর ফুলবিবির বাজপাখি হয়ে ওঠার দৃশ্যটাও ভীষণ চমকপ্রদ।
উত্তরমুছুনভালোবাসা
মুছুনএমন অসাধারণ একটা গল্পের জন্যে সাদিয়া সুলতানাকে টুপি খোলা অভিনন্দন জানাচ্ছি।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনতুমি পড়লে খুব ভালো লাগে।
উত্তরমুছুন