অলোক বসু'র গল্প : শীত কিংবা ভাত অথবা নিতাইদের গল্প

সে বার খুব শীত পড়েছিল। আর ঘরে ঘরে অভাবও ছিল খুব। আজকের মতো উন্নয়ন আর জিডিপির ছড়াছড়িও ছিল না। রায়পুর গ্রামে কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব ঘরে ঘরে। কাজ যদিবা মিলতো, তার উপযুক্ত মজুরি মিলতো না। নিতাইয়ের সংসারে ছয় জন মানুষ। কর্মক্ষম একা নিতাই। একার আয়ে নিতাইয়ের সংসার চলে না। তাছাড়া নিতাইয়ের নির্দিষ্ট কোনো কাজ ছিলো না। যখন যে কাজে তাকে কেউ ডাকতো তখন সেই কাজই সে করতো। কখনো চলাফাঁড়া, যাকে বলে কুড়াল দিয়ে মোটামোটা গাছ কেটে জ্বালানি কাঠ বানানো, কখনও জমিতে বদলা দেওয়ার কাজ, কখনোবা বন্দর থেকে নৌকা বোঝাই করে মুদি দোকানের মালামাল আনার কাজ করতো সে। এসব অনেক পরিশ্রমের কাজ।

নিতাই পরিশ্রমও করতে পারতো ষাঁড়ের মতো। কালো কুচকুচে রঙের ছোটখাটো গড়নের মানুষ হলেও শরীরটা ছিলো পেটা শরীর। লুঙ্গিতে কাছামেরে খালিগায়ে এসে সামনে দাঁড়ালে তার শরীরের শিরা উপশিরাগুলো গোনা যেতো। এমন বলশালী শক্ত-সামর্থ্য মানুষটাকে পারতপক্ষে কেউ কাজে নিত না। এমন না যে নিতাই মানুষ হিসাবে খারাপ কিংবা কাজে ফাঁকি দেয়। সে হাসি দিয়ে সবার সাথে কথা বলে, সমীহ করে, কখনো রেগে যায় না। সবাই তাকে পছন্দই করে। 

গাঁসুদ্ধ মানুষ তাকে জামাই বলে ডাকে। কারণ সে এ গাঁয়ে এসেছিলো ঘরজামাই হয়ে। তার বাড়ি কোথায় ছিলো, বাড়িতে কেউ আছে কিনা এসবও কেউ কোনোদিন জানতে চায়নি তার কাছে। কারণ কেউ কখনো তাকে সন্দেহের চোখে দেখার অবকাশ পায়নি। এত ভালো মানুষ খুব কমই হয়। তারপরও নিতাইকে কেউ কাজে নিতে চায় না। 

যে সময়ের কথা বলছি তখন অত্র রায়পুর ও আশেপাশের এলাকায় সারাদিনের জন্য কাজের মানুষ, যাকে এ অঞ্চলের মানুষ বদলা বলে, নিতে হলে তাকে মজুরির বাইরে একবেলা ভরপেট খাবার দিতে হতো। এই ভরপেট খাবার দেওয়ার ভয়েই নিতাইকে কেউ সেধে কাজে নিতে চাইতো না। কারণ নিতাই প্রচুর খেতে পারতো। পাঁচ ছয়জনের খাবার দিয়েও তাকে পেট পুরে খাওয়ানো সম্ভব না। তা ল্যাটকা খিচুড়ি হোক আর পান্তা ভাত হোক চার পাঁচ গামলা খেয়ে ফেলতে নিতাইয়ের বেগ পেতে হতো না। সাথে ভাজাভুজি বা তরকারির বালাই ছিলো না, দু-তিনটে পিঁয়াজ আর গোটা কয়েক শুকনা মরিচপোড়া হলেই হতো। তখনও আটার রুটি খাওয়া জনপ্রিয় হয়নি রায়পুরবাসীদের মাঝে। দুচারটা বাড়িতে আটার রুটি খাওয়ার চল শুরু হলেও সেসব বাড়ির কাজে নিতাইয়ের ডাক পরলে তারা হিমশিম খেয়ে যেতো। গামলার জলে লবণ মিশিয়ে কয়েকটা কাঁচা মরিচ ডলে পঁচিশ ত্রিশটি রুটি টুকরা করে ছিড়ে সাবার করে দিতে নিতাইয়ের খুব বেশি সময় দরকার পরতো না। সারা গাঁয়ের লোক নিতাইয়ের এই অতিভোজনের ব্যাপারটি জানতো বলেই বিপদে না পরলে কেউ তাকে কাজে ডাকতো না, যদিও সে অন্য যে কারো থেকে কাজ করতে পারতো বেশি।

সেবার এত বেশি শীত আর কুয়াশা পড়েছিলো যে রায়পুর গাঁয়ের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। কয়েকদিন ধরে সূর্যের দেখা নাই। মানুষ ঘরে থেকে বের হচ্ছে কম।

শীতের সময় চুলার লাকড়িও লাগে বেশি। বিশ্বাস বাড়ির সুনীতি জেঠিমা পড়েছেন বেজায় মুশকিলে। কতদিন ধরে তার ছোট ছেলেকে রান্নাঘরের বাড়বাড়ন্ত লাকড়ির কথা বলেছেন কিন্তু তার সময় হয়না একজন বদলা ঠিক করে গাছ কাটিয়ে লাকড়ির বন্দোবস্ত করে দেওয়ার। সময় হবেইবা কী করে। শীতের মৌসুম যে, চারিদিকে যাত্রাপালার প্যান্ডেল পড়েছে। সারারাত যাত্রা দেখা আর দিবানিদ্রা যাওয়া ছাড়া অন্যকোনো কাজ করার সময় নাই তার। 

ওদিকে ঢাকা থেকে সুনীতি জেঠিমার বড় ছেলে আর মেয়ে চিঠি লিখে জানিয়েছে তাদের সন্তানদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। ছুটিতে সবাই বাড়ি আসছে। নাতিপুতিদের ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াতে হবে, পিঠাপায়েশ বানিয়ে খাওয়াতে হবে। এসময় লাকড়ি না থাকলে কি চলে? ছোট ছেলেকে বলে কয়ে কাজ না হওয়ায় সুনীতি জেঠিমা খবর পাঠালেন নিতাইকে। নিতাই এসে সকাল থেকে বাড়ির পাশের মান্দার গাছ কেটে চলা ফাঁড়তে লেগে গেল। নিতাইয়ের হাত যেমন চালু তাতে লাকড়ি ফাঁড়ার কাজ শেষ করতে তার সারা দিন লাগর কথা না। নিতাইকে যেহেতু পুরো দিনের মজুরি দিতে হবে আর একবেলা পেটভরে খাওয়াতে হবে, তাই তাকে দিয়ে যতটা কাজ পারা যায় করিয়ে রাখাই উত্তম।

গত কদিন ধরেই কনকনে শীতের সাথে ঘন কুয়াশা পড়ছে। এই কুয়াশার কারণে সুনীতি জেঠিমা পুকুরের মাছ সব ভেসে উঠতে শুরু করেছে। রামপুরের লোকজন একে বলে মাছ-গাবানো। মাছ গাবানোর সময় অনেক মাছ মরেও যায়। এসময় যতটা পারা যায় সবাই মাছ ধরে ফেলে। সুনীতি জেঠি তার পুকুরের মাছ কীভাবে ধরাবেন তাই ভাবছেন। মনে মনে একটা বুদ্ধিও পেয়ে গেলেন। নিতাইকে দিয়ে মাছ ধরালে কেমন হয়। কিন্তু নিতাই কি রাজি হবে মাছ ধরে দিতে? তাকেতো ঠিক করা হয়েছে চলা ফাঁড়ার কাজের জন্য। তারপরও চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

দুপুর হওয়ার আগেই নিতাইকে খেতে ডাকলেন সুনীতি জেঠিমা। নিতাই খেতে এলে তিনি বুদ্ধি করে বললেন--

নিতাই তুমিতো আমাদের জামাইয়ের মতোই। তোমার জন্য খিচুড়ি রান্না করছি কিন্তু খালি খিচুড়ি কেমনে পাতে দিই?

-- কোনো অসুবিধা নাই জেঠিমা। আপনে আমারে দুই তিনটা পেয়াজ দেন আর কয়ডা শুকনা মরিচ পোড়া দেন, ওইতেই হইবে।

-- না বলছিলাম যদি গরম গরম মাছ ভাজা কইরা দিতে পারতাম তাইলে তুমি খাইয়া মজা পাইতা।

নিতাই ভাবে জেঠিমা মাছ ভাজার জন্য সময় চাইছেন। তাই বললো- আচ্ছা আপনে যহন মাছভাজা দিয়া খাওয়াইতে চাইছেন, তাইলে বসি আর একটুক্ষণ।

-- একটুক্ষণ বসি বললেতো চলবে না নিতাই। চটজলদি বলে ফেলেন জেঠিমা।

-- তাইলে কী করতে হবে? নিতাই জানতে চায়।

জেঠিমা বলেন- গাদলা কুয়াশায় পুকুরে মাছ গাবাইছে। আমি ঝাঁকিজাল বাইর কইরা দিতাছি। তুমি মাছ ধইরা আনো।

নিতাই বেকায়দায় পড়ে যায়। শীতের ঠাণ্ডা সে সইতে পারে কিন্তু পুকুরে নেমে ঠাণ্ডা জলে স্নান করা পর্যন্ত সে সহ্য করতে পারে না। আর সুনীতি জেঠিমা কিনা তাকে মাছ ধরতে বলছেন। নিতাই বলতে যায়, জেঠিমা আমার মাছ ভাজা না হলেও চলবে। কিন্তু বলে উঠতে পারে না। তার আগেই জেঠিমা বলেন- অনেক মাছ পাওয়া যাইবে। আমরা একদিনে এত মাছ দিয়া কী করমু। আমাদের কিছু দিয়া বাকিটা তুমি বাড়িতে নিয়া যাইও। নিতাইয়ের চোখমুখ চকচক করে ওঠে। মনে মনে ভাবে, অনেকদিন হইছে বাড়িতে বৌ পোলা মাইয়া লইয়া মাছ দিয়া ভাত খাওয়া হয় নাই। এই সুযোগ আইজ হাতছাড়া করা ঠিক হইবে না। হোক না ঠাণ্ডায় একটু কষ্ট।

নিতাই জেঠি মার কথায় রাজি হয়ে পুকুরে মাছ ধরতে যায়।

ঠাণ্ডায় পুকুরের জল থেকে ধোঁয়ার মতো বের হচ্ছে। নানা রকমের মাছ জলের ওপর ভেসে উঠে ঠোঁট নাড়াচ্ছে। মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে আবার বের করে দিচ্ছে। তাতে মাছের মুখের চারপাশে ছোটছোট বৃত্তাকারে জলের সন্তরন হচ্ছে। সমস্ত পুকুর জুড়ে মাছ ভাসছে। মাছগুলো খুব নরম হয়ে পড়ছে। ইচ্ছে করলে হাত দিয়েও দু'চারটা ধরে ফেলা যায়। নিতাই ভাবে, এত মাছ! এত মাছ দিয়ে জেঠিমা কী করবেন। তিনিতো বলেছেন তাকে বাকি মাছ দিয়ে দেবেন। বাড়িতে নিয়ে বৌ ছেলে মেয়েকে নিয়ে মজা করে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া যাবে। এসব ভাবতেই নিতাইয়ের পেটে খিদেটা চাগিয়ে ওঠে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। গাছ কেটে লাকড়ি করার কাজে অনেক মিন্নত। এই মিন্নতে খিদাও লাগে বেশি। পেটে খিদা থাকলে শীতেও বেশি ধরে। ঝাঁকিজাল কনুইয়ের প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে নিতাই। সুনীতি জেঠিমা একটা খালুই নিয়ে পুকুর পাড়ে আসতে আসতে বলেন - কী বলছিলাম না অনেক মাছ। দেখো কত্ত মাছ। তোমার বৌ পোলা মাইয়ারাও সাধ মিটাইয়া খাইতে পারবে। 

জেঠিমার কথায় নিতাই পুকুরের ধোঁয়া ওঠা জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। পুকুরটাকে তার মনে হতে থাকে চুলার উপরের ভাতের পাতিল আর মাসগুলোকে মনে হতে থাকে উথলে ওঠা গরম ভাত। পেটে খিদা নিয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে নিতাই। তার পেটা শরীরে যেন একটুও শক্তি অবশিষ্ট নাই আর। হাতপা কাঁপছে। জেঠিমা চেঁচিয়ে ওঠেন - জাল মারো না ক্যান নিতাই?

 নিতাই সম্বিত ফিরে পেয়ে জাল ছুড়ে মারে পুকুরে। জালের সাথে সাথে কাঁপতে কাঁপতে সেও পড়ে যায় পুকুরের জলে। কিছুক্ষণ জলের তলে দাপাদাপি দেখতে পাওয়া যায়। তারপর আস্তে আস্তে সব স্থির হয়ে যায়। নিতাই আর ওঠে না। নিতাইকে কি মাছেরা ধরে আটকে রেখেছে নাকি মাছ হয়ে নিতাই চিরদিনের জন্য জলের তলে ঘাঁটি বেঁধেছে? আজও জানা হলো না। অথচ এবারও তেমনি শীত পড়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ