আমাদের কথা সাহিত্যে গল্পকে দুভাবে উপস্হাপনের দৃষ্টান্ত আছে। একটি ধারায়, মনে হয় বুঝি পাশে বসেই লেখক গল্পটি বলে যাচ্ছেন, পাঠক গল্পটি শব্দ-বাক্যের ভাঁজ খুলে পড়ছেন না ঠিক, শুনছেন। আর অন্য ধারাটিতে গল্পটি লেখা হয়েছে এবং শব্দ বাক্যের ভাঁজ খুলে খুলে গল্পের গন্তব্যে পাঠককে পৌঁছে যেতে হয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখেরা প্রথম ধারায় দারুণ রকমের সফল কথা সাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত।
গল্প বলিয়ে হিসেবে এখানে আরো একটি নাম সাড়ম্বরে জায়গা করে নিতে পারে বলে মনে করি। যাঁর লেখা পড়ে অধিকাংশ সময়ই পাঠকের মনে হবে গল্পকার তার পাশে বসেই তাঁর পরিশীলিত উচ্চারণ আর ধীরস্হির ভঙ্গিতে গল্পটি বলে যাচ্ছেন। বাস্তবক্ষেত্রে মানুষটি বক্তা হিসেবেও শ্রোতার মনোযোগ কাড়তে জানেন। বহু পরিচয়ের ভিড় ঠেলে গল্পকার হিসেবে যাঁর উপস্হিতি আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে বেশ উজ্জ্বল। আর রহস্য না রেখে সরাসরি তাঁর নামটা বলে নেয়া যাক- তিনি হচ্ছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
গল্প বলিয়ে হিসেবে এখানে আরো একটি নাম সাড়ম্বরে জায়গা করে নিতে পারে বলে মনে করি। যাঁর লেখা পড়ে অধিকাংশ সময়ই পাঠকের মনে হবে গল্পকার তার পাশে বসেই তাঁর পরিশীলিত উচ্চারণ আর ধীরস্হির ভঙ্গিতে গল্পটি বলে যাচ্ছেন। বাস্তবক্ষেত্রে মানুষটি বক্তা হিসেবেও শ্রোতার মনোযোগ কাড়তে জানেন। বহু পরিচয়ের ভিড় ঠেলে গল্পকার হিসেবে যাঁর উপস্হিতি আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে বেশ উজ্জ্বল। আর রহস্য না রেখে সরাসরি তাঁর নামটা বলে নেয়া যাক- তিনি হচ্ছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
নিজেকে গল্প লেখক না বলে গল্পকথকের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি গল্পটা বলতেই পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে তিনি যতটা না গল্প লিখতে চান, তারচে' বেশি চান গল্পের সাথে পাঠকের সরাসরি একটা সংযোগ স্হাপন করতে। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সে সম্পর্কে শুনে নেয়া যাক - "আমার মনে হয়, গল্প বলার ভঙ্গিটি এমন হওয়া উচিৎ যাতে আমি মানুষকে স্পর্শ করতে পারি। সিরিয়াস গল্প আমি কখনো লিখতে পারিনি। আমাদের দেশে কিন্তু দুটো ঐতিহ্য আছে, গল্প বলার এবং গল্প লেখার। যে দেশে মাত্র কিছুদিন আগে ৬০% মানুষ শিক্ষিত হলো (আগে তো ১০-৩০% মানুষ শিক্ষিত ছিল)। সে দেশে তো গল্প লেখার বিষয়টা অনেক পরের। সেটা যে খুব পুরুষ্টু, তাও নয়। মানুষ গল্প তো বলে আসছে সেই অনন্তকাল ধরে। গ্রামের মজলিশে, উঠানে, ঘরের দাওয়ায়, বিছানায় দাদু বা হাবিব ভাইয়ের মতো মানুষ সেই কতকাল থেকে গল্প বলে আসছে। ফলে লেখার চেয়েও আমি কথনে বিশ্বাসী। লেখার বিষয়টা যদি প্রধান হয়ে ওঠে, তাহলে গল্প হয়ত আধুনিক পশ্চিমাদের মতো একটা খোলস পরে দাঁড়িয়ে থাকবে। যার ভেতরে প্রবেশ করাটা কঠিন। এই ধারার গল্প যে হয়নি, তা নয়। প্রচুর হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে সবার জন্য উৎকর্ষ অর্জন সম্ভব হয়নি।"
তো গল্পটা বলবার ক্ষেত্রে সে মাত্রার উৎকর্ষতা অর্জনের লক্ষ্য তৈরিতে, প্রথম গল্পটি লেখার পরপরই তিনি মোটামুটি একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেন নিজেকে নিয়ে গেছেন। বিদেশে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষা(পিএইচডি ডিগ্রি) গ্রহণের পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্য পাঠের অবাধ সুযোগ, নিজের শৈশবে পাড়াতো বৃদ্ধা দাদি আর গৃহকর্মী হাবিব ভাইয়ের কাছ থেকে গল্প বলে যাওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, এবং দেশীয় গল্পকথন প্রীতি কাজে লাগিয়ে সে প্রক্রিয়াটা তিনি নিজের ক্ষেত্রে স্হির করেছিলেন বলে মনে করি।
এটি হয়ত খুব আতিশয্য হবে না যদি বলি এই প্রক্রিয়ার পথে তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল ১৯৭৩ সালে লিখিত প্রথম গল্প “বিশাল মৃত্যু” নিয়ে গল্পকথক হিসেবে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “ভালো লাগলো না” এর ছোট্ট অভিঘাত। কেননা এ বক্তব্যের অনুরণন শোনা যায় স্বয়ং সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কথায় - “তখন আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ভাবলাম যে, এতবড় একজন লেখক যখন আমাকে এভাবে নাকচ করে দিলেন, তখন আমার আর লেখার দরকার নেই, আপাতত।”
ভাগ্যিস, সিদ্ধান্তটি তিনি ‘আপাতত’ শব্দবন্ধ দিয়ে শেষ করেছিলেন। নইলে বাংলা সাহিত্য একজন প্রতিভাধর লেখকের গল্প শোনা থেকে বঞ্চিত হতো। পাঠক তাঁর নিজস্ব কথন/রচনা শৈলী, নির্মেদ বাক্যের ব্যবহার, অনন্য মৌলিকতা আর পরাবাস্তবতার চমৎকারীত্বে বুঁদ হবার সৌভাগ্য হারাতেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যে গল্পটি পাঠককে শোনাতে বা বলতে চান, তার ভাষায় কোন চটকদার আড়ম্বরের বালাই থাকে না। সহজিয়া ভাষায় তিনি যে কোনো গল্প পাঠককে বলেন বা বলতে চান। এটি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের ভাষায়, "অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম সাধারণ ভাষায় কথা বলেন এবং বলতে পারেন। এই লেখকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি সহজ করে বলতে পারেন।" একই মুগ্ধতা বেজে ওঠে শ্রদ্ধেয় ডঃ আনিসুজ্জামানের বক্তব্যে - “ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশের বিশিষ্ট গল্পকার। তিনি মৌলিকতায় অনন্য। তার গল্পে পরাবাস্তবতার ঝোঁক আছে। এক ধরনের ভয়, ক্ষোভ, ত্রাস, শঙ্কায় তার চিত্রকল্পের দিকটি খুবই সমৃদ্ধ। যা পাঠককে গল্পের অন্যকিছু রেখে সেগুলোতেও ভাবাতে পারে।”
বিদগ্ধজনদের সমীহ আদায় করে নেয়া এমন একজনের গল্প/উপন্যাস বিষয়ে সীমিত জ্ঞান নিয়ে কিছু লিখতে বসা শুধুমাত্র দুঃসাহসের কাজ নয় কিছুক্ষেত্রে ধৃষ্টতাও হয়ত। নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের পঠিত কিছু গল্প/উপন্যাস নিয়ে এই আলোচনা এগিয়ে নেবার চেষ্টা থাকবে।
“বাংলা সাহিত্যের মতো লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রয়েছে গল্প বলার ঐতিহ্য। সৈয়দ ইসলাম বাংলা সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরে বিদ্যমান ঐ গল্প বলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন। তাই তাঁর গল্প একঘেয়েমি বর্ণনা নয়।” তুষার তালুকদারের এ বক্তব্যের সাথে পূর্ণ সহমত জানিয়ে আরেকটু যোগ করা যেতে পারে, নিবিড়ভাবে লাতিন সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা, দেশীয় সাহিত্যের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার একটি সূক্ষ্ণ অথচ ঘনিষ্ঠ আমেজ পাওয়া যায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পের ভঙ্গিতে- যা বিশেষভাবে পাঠকের মনোযোগ কাড়ে।
বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত আধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রগণ্য কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সম্পর্কে সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত বলেছিলেন - “নীরেন্দ্রনাথ জনপ্রিয় কবি, জনপ্রিয়তার কবি নন।” সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকেও আমার সেই শ্রেণিভুক্ত লেখক বলে মনে হয়েছে। সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দও এ শ্রেণিতে পড়েন। কেননা গল্পকার/ঔপন্যাসিক হিসেবে পাঠকমহলে এঁদের নাম খুব বেশি উচ্চারিত হতে শুনিনা। এক শ্রেণীর পাঠকেরাই খুঁজেপেতে তাঁদের লেখা পড়তে আগ্রহী হন।
মূলধারার গণমাধ্যমে তাঁর লেখাজোকা নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি হলেও সোশ্যাল মিডিয়ার বই পড়ুয়া গ্রুপগুলোর ব্যস্ত মানুষের পাঠ তালিকায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নাম খুব বেশি দেখা যায় না। তাই ধরে নিতে হয় তিনি হুজুগে পাঠকের পংক্তিভুক্ত লেখক নন বরং বোদ্ধা পাঠকের লেখক হিসেবে বিবেচিত। তবে কমল কুমার মজুমদারের মতো ১৯জন পাঠকে তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় না বলাই বাহুল্য। তাঁর একটি বিশেষ পাঠক শ্রেণি আছে। সৈয়দ মনজুরুলের লেখা দুর্বোধ্য নয় মোটেও, তবে তাঁর লেখন বা কথন ভঙ্গি আপাত দৃষ্টিতে সহজবোধ্য মনে হলেও অনেক গল্পের ইনার টোন চট করে ধরে ফেলাটা খুব সাধারণ মাপের পাঠকের পক্ষে সব সময় সহজ নাও হতে পারে। তাঁর গল্প পাঠককে যেমন ভাবায় একই সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে - যেটির উত্তর ঠিক জানার নয়, উপলদ্ধির। অবশ্য এটি একান্তভাবেই এই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে দ্বিমতের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে(নাকি শুনতে?) বিশ্বসাহিত্যের স্বনামখ্যাত এক লেখককের কথা মনে উঁকি দিয়ে যায়। সমালোচকদের বিবেচনায় উত্তর আধুনিক সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রভাবশালী লেখক হারুকি মুরাকামির লেখন ভঙ্গিতে যেভাবে জাদুবাস্তবতা-পরাবাস্তবতা, ব্যক্তির অর্ন্তগত বিষন্নতা, বিচিত্র বিষয় কেন্দ্রিক কাহিনি আর উইটি মুখ ডুবিয়ে থাকে, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পের আখ্যানেও যেন সেরকমটা দেখা যায়। হারুকামির গল্পের কোনো কোনো চরিত্রের একাকীত্বে ভরা উন্মাদনা, শূন্যতা ও অর্থহীনতায় ভরা কার্যকলাপ ঘটতে দেখা যায় সৈয়দ মনজুরুলের কিছু গল্পে।
হারুকামির ছোটো গল্প ‘ক্রীম’ বা ‘মেন উইদাউট ওমেন’ গল্পের কথকের উন্মাদনার ছায়া বুঝি নিঃশব্দে হেঁটে বেড়ায় সৈয়দ মনজুরুলের ‘লোকটা’ গল্পের আখ্যান জুড়ে। ‘অল্টার ইগো’র পিতৃহৃদয় জেগে থাকে ‘ড্রাইভ মাই কার’ এর পঞ্চাশ উর্দ্ধ অভিনেতা কাফুকুর ভেতরে। গাড়ি চালক হিসেবে নারীদের ভীষণ ভাবে অপছন্দ করা কাফুকু নিজের অক্ষমতার কারণে যখন মিসাকি নামের এক তরুণীকে বহাল করে তখন সে নিজেও ভাবেনি একসময় অবচেতনে মেয়েটির ভেতর সে তার মৃত মেয়ের ছায়া খুঁজবে। সেই মেয়েটির কাছে অকপটে বলবে নিজের গোপন গহীণ অতীত কাহিনি। ‘অল্টার ইগোর’র নিষ্ঠুর খুনী দাউদও ভাবেনি তার জেলবাসের কারণ বিচারক খোন্দকার সাহেবকে চরমভাবে শাস্তির চিন্তা বাদ দিয়ে তার কথা মতো মেয়েকে নিয়ে সিনেমা দেখার জন্য টিকেট কিনবে। নিহত দাউদের পকেটে টিকেট দুটোর হিসাব কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার মিলাতে ব্যর্থ হলেও দাউদের ভেতর জেগে ওঠা চিরন্তন পিতৃহৃদয়ের খোঁজ পেয়ে “বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল খোন্দকার সাহেবের, যেরকম দীর্ঘশ্বাস তিনি শেষ কবে ফেলেছেন, মনে করতে পারলেন না।”
‘টাউন অফ ক্যাটস’ গল্পের তেংগোর অসংলগ্নতা সৈয়দ মনজুরুলের ‘প্লেটোর পাঠশালা’ এর ফুয়াদকেও ছুঁয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ! তেংগোর মতো ফুয়াদের মনোজগত যেন বাস্তব আর অবাস্তবের বেড়াজালে আটকে যায়; তাই সে বলে, “এই দুনিয়াটা প্রকৃত নয়, এটি নকল মাত্র।” কিংবা ‘ব্লাইণ্ড উইলো, স্লিপিং ওম্যান’ গল্পের অতি আজগুবি ভাবনার নজির দেখি ‘প্রাণীজগতের গল্প’ সহ ‘আজগুবি রাতের’ আখ্যান জুড়ে! ‘ইন দ্য ইয়ার অফ স্প্যাগেটি’ গল্পের কথকের মনোজগতের অনেকটা জুড়ে যেমন স্প্যাগেটি রাজত্ব করে যায়। সৈয়দ মনজুরুলের ‘কাঠপোকা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আসলামের মনোজগতেও কাঠপোকাদের জবরদখল চলে। মুরাকামির গল্পে বিষন্ন সময় আঁকড়ে থাকা কথক ক্রমাগত স্প্যাগেটি রাঁধে আর একাকী খায়, অন্যদিকে কৃতকর্মের কারণে বেডরুম থেকে বহিষ্কৃত আসলাম তার স্ট্যাডিরুমে রাত্রি যাপন করে আর একাকী কাঠপোকাদের “করর করর্ করর্” অর্কস্ট্রা শোনে, “যে গানে চিৎকার নাআছে সুর নেই; ত্রাস আছে, নিস্তার নেই।” দুটো গল্পেই দৃশ্যমান আপাত সমস্যার ভেতর নিপুণ কায়দায় গোজা আছে আখ্যানের সুগভীর বক্তব্য। ‘আফটার ডার্ক’ উপন্যাসের ‘আমরা’ আর ‘আজগুবি রাত’ উপন্যাসের কানা রইসু, এই দুই সত্তার সৃষ্টিতে একটা গণ্ডীকাটা সীমানা বেঁধে দেয়াছিল; ঘটনাকে শুধু দুই চোখ দিয়ে দেখার সুযোগ দেয়া হয়েছে তাদের, ঘটনার ভেতর ঢুকে যাওয়ার তেমন কোনো স্বাধীনতা ছিলো না। অবশ্য ‘আজগুবি রাত’ এ ঘটনার মীমাংসা টানতে ইকবালুর রহিমের স্বপ্নে কানা রইসু হানা দিয়ে কাটা হাতের হদিশ জানিয়ে দিয়েছিল। আফটার ডার্কে ‘আমরা’ কে সেরকম ভূমিকায় দেখা যায়না।
‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসে কাফকার উপর যে ভবিতব্যের ইঙ্গিত, হুবহু সেরকম না হলেও ‘বাজ’ গল্পের সামারা আয়াজের প্রেমের পরিণতিতেও ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে যাওয়ার ইঙ্গিতে পাঠকের “কাফকা অন দ্য শোর” উপন্যাসের অভিশপ্ত কাফকার কথা মনে উঁকি দিয়ে গেলে সেটাকে খুব বেশি বিচিত্র কিছু মনে নাও হতে পারে।
মুরাকামির ছোটো গল্পগুলো তাঁর উপন্যাস থেকে ভিন্ন ধাঁচের, বিশেষ করে সমাপ্তি। তাঁর ছোটো গল্পগুলোর সোজাসাপ্টা সমাপ্তি আমরা তেমন একটা দেখিনা। সমাপ্তিটা নিজের মতো করে ভেবে নেবার সুযোগ করে দেন তিনি পাঠককে। গল্পকার তিনি হলেও পাঠক যেন গল্পটিকে নিজের মতো করে গ্রহণের স্বাধীনতা ভোগ করে এমন ভাবনা থেকেই হয়ত তিনি গল্পের সমাপ্তিটা ওপেন ইন্ড রাখতে পছন্দ করেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সব ছোটো গল্পের পরিণতিতে ওপেন ইন্ড’এর আধিপত্য না থাকলেও বেশ কিছু গল্পে সেরকম ভেবে নেবার একটা লক্ষণ দেখা গেছে। সম্ভাবনার একটা বীজ তিনি রেখে দিতে পছন্দ করেন বলে মনে হয়েছে। এটি হয়ত তাঁর শৈশবের সেই গল্প দাদির প্রভাব কিংবা তাঁর নিজস্ব ভাবনার ফসল যা মুরাকামির সাথে কোথাও কোথাও অদ্ভূতভাবে মিলে গেছে বলে মনে হয়েছে। এখানে কোনোভাবেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাথে হারুকি মুরাকামিকে তুলনা করছিনা। শুধু এঁদের দুজনের লেখার সাথে চমৎকার মিলটুকু প্রকাশের দুর্বল চেষ্টা করেছি মাত্র। তবে এই দুজনের লেখাজোকায় মিল থাকলেও একটা জায়গাতে আছে নব্বই ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার মতো অমিল। মুরাকামি লেখালেখি বিষয়ে কোনো ঐতিহ্যের ধার ধারেন না। কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের রয়েছে ভীষণ রকমের ঐতিহ্যপ্রীতি।
সেই রীতি মেনেই তিনি সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মগ্ন থাকতে ভালোবাসেন। প্রবন্ধ গবেষণাধর্মী লেখালেখির পাশাপাশি সৈয়দ মনজুরুল লিখেছেন প্রচুর গল্প এবং বেশ কয়েকটি উপন্যাস। তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনার স্বকীয়তার পাশাপাশি বিষয় বৈচিত্রে অনেক সময়ই গল্পের কাহিনি গতানুগতিক ছাঁচের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। “কাঁঠাল কন্যা” গল্পটার কথা ধরা যেতে পারে। গল্পটি, কথক আর কেন্দ্রীয়চরিত্র আফসারের হাত ধরে যত গড়াতে থাকে সাদামাটা বর্ণনার পলেস্তরা খসে গিয়ে পরাবাস্তবতার জাদু ভর করতে থাকে। আজগুবি বিষয়ের অবতারণা ঘটে শৈল্পিক উপস্হাপনার মধ্যে দিয়ে। কর্মসূত্রে কাঁঠাল প্রজেক্টের তদারকীতে গিয়ে উপহার হিসেবে পাওয়া কাঁঠালের সাথে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটির চূড়ান্ত সখ্যতা হয়। কেন্দ্রীয় চরিত্র আফসার দাবী করে কাঁঠাল চিড়ে বেরিয়ে আসা নারীর সাথে তার দৈহিক সম্পর্ক ঘটেছে। যা তার বৈবাহিক জীবনের সমস্যা জনিত মনোবিকারে আক্রান্ত মনের প্রপঞ্চ বলেই পাঠকের ধারণা। বাংলা সাহিত্যে এমন অভিনব কাহিনির সাক্ষাত পাঠক খুব বেশি পেয়েছেন বলে মনে হয় না।
সৈয়দ মনজুরুলের সব গল্প এমন আজগুবি বর্ণনায় ঠাসা এমনটা ভাবলে খুব ভুল হবে। সমকালীন সমাজের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক ব্যক্তির লড়াই, রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, মানবিক- অমানবিক সম্পর্ক, ইত্যাদি সবকিছুই তাঁর গল্পের আখ্যান জুড়ে থাকে। সমাজের নানা পেশা, নানা শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায় তার গল্পকে। কাহিনির প্রয়োজনে সামাজিক স্তরকে একটানে সবার জন্য সমান হতেও দেখা যায় তাঁর ‘আজগুবি রাত’ উপন্যাসে। সংসার জীবনে দুঃখী নিখাদ মনের নারী নূর বানুর কাটা হাতের টানে ক্ষমতাশালী সচিব, হাজার মন মাতানো নায়ক লাকি খান, পুলিশ,সাংবাদিক, শিক্ষক, মাঝির ছেলে, ঘড়ি সারাইয়ের দোকানি সবাই কেমন এক কাতারে চলে আসে। নূর বানুর কাটা হাতটি যেনবা পরশ পাথর, যেই সেটি ছুঁয়েছে তার ভেতর বাড়িতে ঘটে গেছে আমূল পরিবর্তন। বিপদ সংকেতের তোয়াক্কা না করে, ‘সারিকা’ নামের ভীষণা সাইক্লোনের ঘনিয়ে আসা বাতাবরণের ভেতর চরিত্রগুলো যেন নিজের মধ্যে জমে থাকা বাঁধা পেরিয়েছে সে হাতেরই শুভ স্পর্শে। নিষ্পাপ কথক কানা রইসুর মাধ্যমে বলেশ্বরী দিয়ে ভেসে আসা বেওয়ারিশ কাটা হাতটা পায় তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের হদিশ।
‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’ গ্রিক পুরাণের চরিত্রের নামে গল্পটির শিরোনাম। পুরাণে নিয়তিকে একমাত্র নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় দেখার নিয়ম ছিলো। এ গল্পের নিয়তি কোনো দেবতার ইশারা মেনে চলেনি, সামাজিক কাঠামোর ভেতর জেগে থাকা সিস্টেম সেটি নির্ধারণ করে দেয়। গল্পটিতে সমকালীন সমাজের প্রায় যাবতীয় উপকরণের উপস্হিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রকট শ্রেণিবৈষম্য,অবাধ শিশুশ্রম, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, নগর জীবনের একাকীত্বের চাপা দীর্ঘশ্বাস, আইনের নামে অন্যায় চাপিয়ে দেবার নির্লজ্জতা সবই এসেছে গল্পে। গল্পটিতে সৈয়দ মনজুরুল সমকালীন সমাজ-রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তৃণমূল দুজন কিশোর কিশোরীর প্রতিনিধিত্বে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর নিজস্বতা দিয়েই পাঠককের মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম হন। বিষয় বৈচিত্রে তিনি রাখতে জানেন মৌলিকত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর ‘প্রস্তরযুগ’, রেশমি রুমাল’, ‘আরাম কেদারা’ ‘বাজ’, ‘অল্টার ইগো’,’হোমিওপ্যাথি’, ‘কাঠপোকা’, ‘ছায়া’, ‘উজানিবেলা’, ‘গুম’, ‘প্রস্তরযুগ’, ‘ফাইভস্টার’, ব্রিফকেস’, ‘লোকটা’, ইত্যাদি গল্পগুলো তাঁর মৌলিকত্বের দারুণ নিদর্শন।
আসলে এই গুণী লেখককের সাহিত্যকর্ম নিয়ে ছোট্ট পরিসরে সবটা বলা সম্ভব নয়। সবিস্তারে আলোচনা করার মতো জ্ঞানও নেই এই আলোচকের। তাছাড়া একজন সবটা নাই বলে নিলেন। তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠকদের অনেকে বিস্তারে সমৃদ্ধ হবার মতো আলোচনা করবেন সন্দেহ নেই। কাঁচাহাতে লেখা এই আলোচনার সুতো গুটানোর আগে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি অনবদ্য গল্প নিয়ে সামান্য একটু বলে ইতি টানবো।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত কম গল্প/উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই,”তালপাতার সেপাই” বইয়ের অর্ন্তভুক্ত ‘একাত্তর’ গল্পের আখ্যানে তিনি এমন এক কাহিনির নির্মোহ বর্ণনা দিয়ে গেছেন, পাঠশেষে পাঠকমাত্রই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বনের হিংস্র বাঘটিকে মনে মনে বীরের আসনে বসিয়ে কুর্নিশ জানাতে দ্বিধা করবেন না।
সুন্দর বনে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নৌ-কমান্ড দলের সংক্রিয় হয়ে ওঠার খবর পেয়ে পাকিস্তানি হানাদারেরা সেখানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলে সে খবরে বনে আশ্রয় নেয়া ফরেস্ট অফিসারের পরিবারসহ অন্যান্যরা বিপন্ন বোধ করবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে পাকিবাহিনীর হানা দেয়াটা ছিলো গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো। কেননা বনের এক হিংস্র বাঘ ইতিমধ্যেই অফিসারের পরিবারটিকে ভয়ে কাবু করে রেখেছিল। এমন অবস্হায় হানাদারদের আক্রমণের খবরে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রাত পেরিয়ে গেলেও বুড়ি গোয়ালিনী পর্যন্ত হানাদারদের বোট আসতে পারেনি। বাঘটাই আসতে দেয়নি!
একটা হিংস্র পশুও কতটা মহান দৃষ্টান্ত রাখতে পারে পাকিস্তানি জানোয়ার বাহিনীর সামনে,’একাত্তর’ গল্পে সে কথাই চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তাঁর চমৎকার বয়ানের গুণে বনের একটা হিংস্র পশু কেমন সপাটে বীরের জায়গায় গিয়ে পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়।
সাহিত্যে ভাষা একটি বিশেষ স্তর যার সাহায্যে একজন লেখক পাঠক মনে প্রথম টোকাটি দিতে সক্ষম হন। সৈয়দ মনজুরুলের নিজস্ব যে ভাষাশৈলী তা একই সঙ্গে সরল এবং নির্মেদ। পরের ধাপে আসতে পারে লেখকের বর্ণনা ভঙ্গি। প্রত্যেক সাহিত্যিকের চেষ্টা থাকে নিজের মতো করে পাঠককে গল্প শোনাবেন। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর সে চর্চায় অনেকেই নিয়োজিত ছিলেন, আছেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেন আলাদা? বাংলা সাহিত্যের প্রচুর লেখালেখির ভিড় ঠেলে পাঠক কেনই বা তাঁর লেখা পড়তে আগ্রহী হবেন? শুরুতে বলা হয়েছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্প লেখার চেয়ে বলতে ভালোবাসেন। তাঁর কথন ভঙ্গিতে লেখক-পাঠকের একটা নীরব মিথস্ক্রিয়ার বাতাবরণ তৈরি হয়ে যায়, পাঠককে সঙ্গে নিয়েই তিনি গল্পটা বলতে থাকেন; খানিক পর তিনি পাঠকের কোনো কৌতূহলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন 'যদি জানতে চান' ইত্যাদি। সৈয়দ মনজুরুলের সাহিত্য পাঠের এটি একটি চমকপ্রদ প্রক্রিয়া। এটি পাঠকের মনোযোগ কাড়ে, গল্পটি পড়ার আগ্রহ বাড়ে। পাঠককে যুক্ত করে গল্প বলার এই বৈশিষ্ট্যটি বাংলা সাহিত্য অভিনব। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গদ্যচর্চায় এমন বৈশিষ্ট্য বহুমাত্রিক। সেসব বৈচিত্রময় বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যজগতকে আলোকিত করে যাচ্ছেন কয়েক যুগ ধরে। প্রথাসিদ্ধ গদ্যচর্চার বাইরে গিয়ে নিজস্বতার আরোপ যে কোনো লেখককে অন্যদের চেয়ে অনন্য করে তোলে। এই অনন্যতাই একজন সফল সাহিত্যিকের প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সাধারণ একটি সংলাপও বেঁচে থাকে বহুযুগ ধরে। সেদিক থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন সার্থক সাহিত্যিক। ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে যিনি নিজেকে প্রকাশে স্বস্তি পান। বাংলা সাহিত্যে ঐতিহ্যের যে নিজস্বতার স্বাক্ষর তিনি রেখে যাচ্ছেন, সেটির সাথে পরিচিত হতে হলে পাঠককে তাঁর সাহিত্যের কাছে যেতে হবে।
1 মন্তব্যসমূহ
সমৃদ্ধ হলাম। পাঠ-প্রতিক্রিয়া পড়ে বুঝলাম লেখক নাহার তৃণার পাঠের ব্যাপ্তি অনেক।
উত্তরমুছুন