কুলদা রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস : কহে জ্ঞানদাস--পর্ব ২

পর্ব ১ পড়তে ক্লিক করুন--এখানে

৩. 

আজ একটু দেরী করে ঘুম ভেঙেছে জ্ঞানদাসের। তিনি দ্রুত নিমের ডাল নিয়ে ছুটলেন নদীতে। অনেক ক্ষণ আগেই জোয়ার এসে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাটাগোন ফিরে আসবে। মাঝিরা পাড় থেকে নৌকাগুলো নদীর মাঝখানে সরিয়ে নিচ্ছে। একটা ফুল্ল হাওয়া এসে তার পাকা বাম জুলফি নাড়িয়ে দিল। আর তখনি দেখতে পেলেন, বুক সমান জলে নেমেছিলেন। এখন তা কোমর অব্দি এসে গেছে। ঘাটে কে একজন নারী হাটুর উপর কাপড় তুলে মাজন করছিল। তার উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলে উঠল, ওরে মিনসা, দেরি করতি করতি তো বেহান গেল। নাহান করবি কুন সময়? গতর ঠাণ্ডা হলি?

জ্ঞানদাস একটু লজ্জা পেয়ে ফস করে ডুব দিলেন। ডুব দিতে দিতে তার মনে হলো, নারীটির বাম চিবুকটা দেখা দরকার। ডুব সেরে উঠে তার দিকে তাকাবেন, কিন্তু নারীটি তার দিকে ইঙ্গিত করে আবার হেসে হেসে বলে উঠল, আধা মিনিটেই তাগদ শ্যাষ? মাইয়াঝুত তো তোরে ঠেঙ্গা মারবেয়ানে মিনসা। 

নারীটি এবারে মুখের ভঙ্গিটি আরেকটু ব্যাঁকা করে বলল, রাইতের বেলায় আইসস পড়িস। তোর অঙ্গ আছে কিনা টেস্ট কইরা দেখবোয়ানে। 

এই কথা শুনে আর তার মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না। তিনি ভেজা গায়েই উঠে পড়লেন। বাড়ির দিকে যেতে যেতে মনে হলো, নারীটির বাম চিবুকেও একটি তিল আছে। সেটি তিনি দেখেছেন। কখন দেখছেন সেটা মনে করতে পারছেন না। তবে তার মনে আছে, আজ অব্দি কোনো রমনীর মুখপানে তাকিয়ে দেখার সুযোগ নেননি। 

ঘরে ফিরে জ্ঞানদাস দেখতে পেলেন, একটা পিঁড়ি পাতা আছে। সামনে ঝকঝকে কাঁসার থালায় গরম ভাত থেকে ধোয়া বেরচ্ছে। আর পরিপাটি করে তৈরি আছে ভর্তা। পাতের একপাশে একটু মাখন। আর দুটো কাঁচা মরিচ। একটু অবাক হলেন। তার ঘরে অন্য কেউ নেই। 

দুপুরে রান্না করেন তিনি নিজেই । সেটাই তিনি খান। রাতে দুটো চিড়ামুড়ি। 

তাছাড়া ভোরে ঘরে আহার করেন না। স্বর্ণপট্টিতে যেতে যেতে বাগান থাকে দুটো ফল তুলে নেন। 

এই ভোরে তাহলে তার জন্য খাবার কে রান্না করল? কেইবা তার জন্য বেড়ে দিল? 

তিনি গায়ে চিমটি কাটলেন। না। তিনি জেগে আছেন। স্বপনে নেই। তাহলে? আবার তাকিয়ে দেখলেন। ভাতের থালা ঠিক ঠিক মতো আছে। থালার কাছাকাছি তিনটে পিঁপড়ে ঘোরাফেরা করছে। 

অভ্যাস বশে তিনি গাছের কাছে গেলেন। দেখতে পেলেন ডালে ফল নয়, একটা বইয়ের পাতা লেগে আছে। তিনি সেটা তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন। দেখতে পেলেন সেখানে কোনো শায়ের লেখা আছে। কিন্তু তার অক্ষরগুলো বাংলায় নয়। লেখা আছে নাস্তালিক অক্ষরে। 

এলাকার বিশিষ্ট ইমাম মাওলানা মোফাচ্ছের আলী খানের কাছে গেলেন। তিনি নাস্তালিক অক্ষর জানেন। তিনি কাগজটি পড়ে হাসলেন। বললেন, কী জানতে চান বাবু? 

জ্ঞানদাস চিন্তিত মুখে বললেন, কী লেখা আছে? 

খুব সুর করে পড়লেন ইমাম সাহেব। বললেন, এই শায়ের পারস্য দেশের গায়করা গেয়ে থাকেন। শুনে লোকজন কবিকে নজরানা দেয়। 

"আগার আঁ তুর্কে শিরাজী, 
বদাশ্ত রাদ দিল-এ- মারা 
বখাল-এ হিন্দবশ বখশম 
সমরখন্দ ব বুখারারা।" 

এইটুকু শুনে জ্ঞানদাসের মনে আরাম হলো বটে। কিন্তু আনন্দ হলো না। আনন্দ না হলে প্রাণে শান্তি আসে না। এর তর্জমাটা শুনতে পারলে হতো। 

ইমাম সাহেব রসিকজন। তিনি বললেন, বাবু, এই বয়াতটা রচনা করেছেন পারস্যের কবি হাফিজ। তার বয়াতটা প্রকাশ হলে পারস্য সম্রাট তৈমুর লংএর কানে গেল। তিনি তো রেগে আগুন। এই বেয়াদব কবিকে ধরে আনার জন্য তিনি হুকুম দিলেন। 

কবিকে ধরে নয়-- বেঁধে আনা হলো। কবির বেশবাস মোটেই জুতসই নয়। গরীবী হাল। তার জন্যই রাজদরবার মলিন হয়ে আছে। 

সম্রাট বললেন, ওহে কবি, আমি কষ্ট করে যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করি। তিল তিল করে নগর গড়ি আর তুমি আমার কষ্টে গড়া দুই দুটো নগরকে দান করে দিতে চাইছ সিরাজ নগরের এক সুন্দরীর তিলের জন্য? সাহস তো কম না! এগুলো কি তোমার বাপের? 

সবাই ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল কবির বোধ হয় এবার গর্দান যাবে। আর রক্ষা নেই। 

গরীব কবি কিন্তু ভয় পেলেন না। ঘাড়টা সোজা রেখেই বললেন, জাঁহাপনা, এরকম অপচয়কারী বলেই আমার এই বেহাল। 

--বটে? 

তারপর কী হলো সেটা না বলে ইমাম সাহেব দরাজগলায় খাস বাংলায় শোনালেন-- 

গালে কালো তিল সেই সুন্দরী 
স্বহস্তে ছুঁলে হৃদয় আমার, 
বোখারা তো ছার, সমরখন্দও 
খুশি হয়ে তাকে দেব উপহার। 

তর্জমাটি বলে ইমাম সাহেব চোখ বুঝে বললেন, বাবুজী, ইশক না হলে তো এর মাজেজা বোঝা যাবে না। 

--ইশক? 

--মোহাব্বত। পেয়ার। তার ইশকে আশেক হলে আপনি দেওয়ানা হবেন। দেওয়ানা হলেই তখন দুনিয়াভি তুচ্ছ মনে হবে। তার একটি তিলের জন্য সব কিছু বিলিয়ে দিতেও মন চাইবে। পারস্য তো পারস্য, নিজেকে তখন সারা দুনিয়াভির সম্রাট মনে হবে। বোখারা আর খোরাসান কোন ছার, ইশকের জন্য সারা দুনিয়াকেও বিলিয়ে দিতে কসুর হবে না। 

-- কিন্তু কবির তো কিছুই নাই। তাইলে? 

-- নাই বলেই তো তিনি মনে মনে সব কিছুর মালিক হতে পারেন। সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই দিলন না। কিছু থাকলে তো দেবেন? কিন্তু তিনি দিলেন খোরাসান। বোখারা। সবকিছু। দিলেন মনে মনে। এসব মনের খেলা। দিলের খেলা। ইশকের খেলা। 

-- তাইলে মন চাইলে আমি যা খুশি তাই হতে পারি? 

--আলবাৎ পারেন। আপনি আদেশ করবেন। আর তাই হয়ে যাবেন। যা গড়তে ইচ্ছে হবে তাই হয়ে যাবে। 

--যাদুকরের মতোন? 

-- যাদুকরের মতোন নয় বাবু। যাদুকরই। সবচেয়ে বড়ো যাদুকর। ঈশ্বর যাদুকর। 

জ্ঞানদাস অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ঈশ্বর!! 

ইমাম সাহেব তদগত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই বাবু। মানুষই ঈশ্বর। ঈশ্বরই মানুষ। কোনো ভেদ নেই। আনাল হক। 

তিনি যাদু করেন বলে আমরা মানুষ হয়ে আছি। আমরা যাদু করি বলে তিনি ঈশ্বর হয়ে আছেন। 


এবারে ইমাম সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন জ্ঞানদাসের দিকে। জ্ঞানদাস নিজের হাতের মধ্যে লুফে নিলেন এই হাত। 

ইমাম সাহেব বললেন, কেমন বোধ করছেন? 

--কোমল। জ্ঞানদাস উত্তর দিলেন, কোমল লাগছে আপনার হাত। সুকোমল। 

হাসলেন ইমাম সাহেব। উঠতে উঠতে বললেন, আপনি কোমল চাইছেন বলেই আমার হাত এখন কোমল। কেউ যদি কোমল না চায়, তবে তার কাছে অকোমল। 

এসব ইশক মোহাব্বত পেয়ার বা দেওয়ানা হওয়ার কোনো অবকাশ জ্ঞানদাসের জীবনে কখনো আসেনি। তিনি জানেন ব্লোয়ার দিয়ে সোনা বাঁকিয়ে নানা আকার দিতে। জানেন গয়না তৈরি করতে। কিন্তু নিজের হাতে কারো গায়ে গয়না পরান নি। সে রকম কেউ নেই। 

তিনি কাগজে টুকে নিলেন হাফিজের বয়াতটি। বারবার তিনি তিল শব্দটির দিকে ফিরে ফিরে চাইছেন। মনে হলো শব্দটি আর অক্ষরের সমষ্টি নয়-- সত্যি সত্যি একটি তিলে পরিণত হয়ে গেছে। সেই তিলের উপরে এক ফোঁটা জল এসে পড়ল। জল পড়ল তার চোখ থেকে। এ জল তুর পাহাড়ের চেয়েও ভারী। 

বাড়িতে ফিরে দেখতে পেলেন ভুলু কুকুরটি বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এ সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে না। দুজনে এক সঙ্গে খেয়ে শুয়ে পড়েন। 

আজ খিচুড়ি রান্না করবেন ভেবেছিলেন। সেজন্য তিনি মুগডাল নিয়ে এসেছেন। রান্নাঘরে হাড়ি ভর্তি খিঁচুড়ি। কিছুক্ষণ আগে রান্না হয়েছে। পাকা সরিষার তেলের ঘ্রাণ আসছে। কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার অগোচরে কে রান্না করে রাখছে এটা নিয়ে ভেবে কোনো কুল কিনারা পেলেন না। কী করবেন বুঝতে পারার আগেই তার ভুলু কুকুরটি ঘুম থেকে উঠে এসে পায়ের কাছে কুঁই কুঁই করতে লাগল। তার খিদে লেগেছে। আজ সারাদিন ভুলু কিছু খাইনি মনে হলো। তিনি সাত পাঁচ না ভেবে ভুলুকে খিচুড়ি বেড়ে দিলেন। তার ভুভুক্ষের মতো খাওয়া দেখে বুঝতে পারলেন তার নিজেরও খুব খিদে লেগেছে। গরম গরম খিচুড়ি নিয়ে নিজেও খেতে লাগলেন। স্বাদে অপূর্ব। বহুদিন পরে আয়েশ করে খেলেন। 

শুয়ে পড়ার পরে তিনি টের পেলেন রান্নাঘরে শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন হাড়ি থেকে খিচুড়ি থাকায় ঢালছে। বারান্দায় ভুলু কুকুর শুয়ে আছে। অজানা কেউ হলে সে হাঁক দিয়ে উঠত। কিন্তু তারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। মনে হলো কেউ যেন থালায় করে ভাত খাচ্ছে। জল খাওয়ারও শব্দ হলো। উঠি উঠি করে উঠলেন না। মনে হলো তিনি খোয়াব দেখছেন। তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। তলিয়ে যেতে যেতে তার মনে হলো, সেই যেন কে এক মেয়ে ভুলু কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘরে উঠে আসছে। আর তার গা থেকে নীলচে মৃদু আলো মাটিতে ঝরে ঝরে পড়ছে। ফুলের মতো ফুটে আছে সেই আলো। সেই ফুলের গন্ধ তিনি পাচ্ছেন। যেন জুঁই। জুঁই ফুল। না, বেলী ফুল। বেলু রানী। একটু হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে। 


৪. 

সুবেদ সাদেকের আগেই জ্ঞানদাস আবার ছুটে গেলেন ইমাম সাহেবের কাছে। সবে তিনি নামাজ শেষ করে উঠেছেন। 

তিনি শুধালেন, তবিয়ত ভালো বাবু? 

মাথা নাড়লেন জ্ঞানদাস, ভালো। 

-- মন? 

--অস্থির। 

দূরের প্রান্তরের উপরে অস্থির মেঘ জমেছে। আজ বৃষ্টি হবে। ঘাসের মধ্যে বুনোফুলের কলি ফুটি ফুটি করছে। বৃষ্টি পেলে ঠিক ফুটে উঠবে। বললেন, এই মেঘ দেখেছিলেন পারস্য দেশের রুমি। রুমি বলেছিলেন, এই বৃষ্টি হলো ফুল ফোটার জন্য। বজ্রপাতের জন্য নয়। 

তারপর কিছুক্ষণ মৌনী থেকে বললেন, বাবু, আপনার মনে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। 

-- ক্ষত? আঁতকে উঠলেন জ্ঞানদাস। 

খুব কোমল করে তাকালেন তার দিকে। বললেন, ভয় পাবেন না। ক্ষতর মধ্যে দিয়ে দিয়েই ইশিকের রোশনী শরীরে ঢোকে। এই রোশনীর তেজেই আত্মা চলে। ক্ষত না থাকলে কি চলে! 

কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইমাম সাহেব শুধালেন, বয়স কত হলো আপনার বাবু? 

-- ষাট। 

-- শাদি করেছেন? 

-- না। রায়টে বাবা মারা গেল। মা আত্মঘাতী হলো। ভাইবোন কেউ নাই। একা একা থাকি। শাদি করার চিন্তা আসে নাই কখনো। 

এগুলো তিনি শুনলেন না। কয়েকটি এলাচদানা জ্ঞানদাসের হাতে দিলেন। আর কয়েকটি নিজের মুখে দিলেন। তারপর ভোরের মৃদু হাওয়ার মতো মৃদুমন্দ গলায় আবৃত্তি করলেন-- 

এ-জান খবারাত হাস্ত কে জানান-এ তো কিস্ত? 
ভা-এ দিল খবারাত হাত কে মেহমান-এ তো কিস্ত? 
এ-তান কে বে-হার হিলেহ রাহি মিজোই, 
ও মিকেশাদ-আত বেবিন কে জোয়ান- এ তো কিস্ত? 

'জানো কি, আত্মা, 
তুমি আশেক যে কার? 
জানো কি, হৃদয়, 
তুমি মেহমান কার? 

শরীর, মায়ার পথে 
তুমি শুধু যাও; 
দেখ, সে তোমাকে খোঁজে, 
তাঁরই টানে ধাও।' 

আবৃত্তি শেষ হলে ইমাম বললেন, ডেরায় ফিরে যান বাবু। বৃষ্টি আসবে। 
এখন তিনি দীর্ঘ সফরে যাবেন। ফুলের কলিগুলো এড়িয়ে পা ফেলে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলেন। 

চোখের সামনে থেকে ইমাম সাহেব অদৃশ্য হওয়ার পরে জোর বৃষ্টি এলো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তিনি হাঁটতে লাগলেন। তার মনে হলো, ইমাম সাহেবকে তিল নিয়ে একটি প্রশ্ন করার ছিল। সেটা করা হয়নি। 

কিন্তু এই প্রশ্নটি তিনি ভুলে যেতে পারলেন না। বারবার তার মনে খোঁচা দিতে লাগল। এজন্য তার মাথা অসহ্য যন্ত্রণায় ফেটে যেতে লাগল। আর সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসে গেল। তিনি এপাশ ওপাশ করতে করতে তিল তিল বলে চিৎকার করতে লাগলেন। কিন্তু তার মুখে গো গো শব্দ ছাড়া আর কোনো হলো না। তিনি ঘেমে চেমে যেতে লাগলেন। মাঝে মধ্যে টের পেলেন কে যেন তার কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। সারা গা মুছিয়ে দিচ্ছে। চামচ দিয়ে হালকা তরল খাইয়ে দিচ্ছে। তার হাত সুকোমল। তার চুল এসে মুখের পরে পড়ে। মাঝে মাঝে চোখের ঝিলিক এসে পাপড়িতে লাগে। এরমধ্যেই তিনি তার চোখ খুলে এই মুখটিকে দেখতে চান। সেই মুখ মায়াময়ী। সেই মুখে কোনো তিল আছে কিনা দেখতে চান। কিন্তু চোখ খুলতে পারেন না। কিন্তু চোখ ফেটে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। 

যখন তিনি চোখ খুলতে পারলেন, তখন সকাল গড়িয়ে গেছে। দুপুর হবে হবে করছে। বাইরে কয়েকটি পাখি ডাকছে। একটা শান্ত হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। তিনি সেই মায়াময় মুখ দেখতে পাবেন। এই জন্য মনে একটা দোলা জেগেছে। তিনি চোখ খুললেন অতি ধীরে ধীরে। ধীরে-- অতি ধীরে চোখ খুলে দেখতে পেলেন একটি মুখ। অতি চেনা। মায়া মাখা। সে মুখ বিষ্ণুবাবুর। বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী তিনি। অন্য কোনো মায়াময়ীর মুখ নয়। জ্ঞানদাসের মন মিইয়ে গেল। আবার চোখ বুঝলেন। আর খুলতে ইচ্ছে করছে না। হায়, মায়াবিনী। উচিত কি তব এই কাজ!! 

বিষ্ণুবাবুর মুখটি হাসি হাসি করে উঠল। পকেট থেকে এক বোতল দিশি মদ বের করে ঢক করে গিললেন। ঢোক গিয়ে হাতের চেটোয় মুখ মুছলেন 

বললেন, বাওয়া, তুমি যা দেখালে বাপ। তিনদিন ধরে কারখানায় তোমার পাত্তা নাই। খুঁজতে এসে দেখি তুমি চিৎপটা। কোনো মতে প্রাণটা ধুকেপুকু করতে লেগেছে। খাচা ছেড়ে যায় যায় অবস্থা। ভাগ্যিস মেয়েটা ছিল। 

মেয়ের কথায় এবারে জ্ঞানদাস আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারল না। চোখ খুলে বিষ্ণুবাবুর হাসি হাসি মুখের দিকে চেয়ে শুধালেন, মেয়ে? 

-- হু হু। মেয়ে। জলজ্যান্ত মেয়ে মানুষ। তারপর আরেক ঢোক গিয়ে হা হা করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন বিষ্ণুবাবু। বললেন, এই যে বাবুমশাই, মেয়ের কথায় একদম মৃত্যুশয্যা থেকে সটান উঠে বসলে। তোমার কৌমার্যগিরি আর পরমহংসগিরি সব ফক্কিবাজি হয়ে গেল বাপ!! 

শুনে এই দুর্বল অবস্থায়ও বাদ সাধতে গেলেন জ্ঞানদাস। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিষ্ণুবাবু ঠোঁট চুকচুক করে বললেন, উহু, কোনো কথা হবে না। শোনো বাপধন, এসে দেখি তোমার বাড়ির দোর বন্ধ। তার মধ্যে দিয়ে একটা মিটমিটে আলো আসছে। সামান্য ঠেলা দিতেই খুলে গেল। দেখি, বিছানায় তুমি পড়ে আছ। কাছেই ভুলুবাবু মাখ ব্যাজার করে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে ল্যাজ নাড়ল। আর বিছানায় বসে বসে একটি জলজ্যান্ত মেয়ে বসে বসে তোমার সেবা করছে। আমাকে দেখে বলে উঠল, ওনার তিনদিন যাবৎ জ্বর। রতিকান্ত ডাক্তার মশাই এসেছিলেন। ওষুধ দিয়ে গেছেন। এখনো চেতন ফেরছে না। কী করি বলেন তো? 

কাঁদতে লাগল ফুলে গুলে মুখে আঁচল গুঁজে। বুঝলি বাপা, ভেবেছিলাম একা মানুষ তুমি। হয়তো আজ রিপুর ফেরে বলে কাউরে ধরে টরে আনছ। মেয়ে মানুষ তো কম দেখলাম না। কিন্তু মেয়েটার কান্না দেখে বুঝলাম, এ কোনো মাল টাল নয়। সতি সাধ্বী মেয়ে। মেয়ে কেনো-- বৌ মানুষ। একে নিয়ে ফাইজলামো চলে না। 

ফলে দেরি না করে সোজা রতিকান্ত ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এলাম। তিনি তোমার নাড়ি টেপেন। গাল টানেন। চোখ দেখেন। বলেন, আশা নাই। দিন শ্যাষ। অষুধ দিয়ে কাম নাই। 

শুনে ভেতর থেকে মেয়েটি হায় হায় কেঁদে ওঠে। বলে, দোহাই ডাক্তারবাবু, যে করেই হোক ওনাকে বাঁচান লাগবে। 

ডাক্তারবাবু ভেতর ঘরের দিকে তাকালেন তাকে দেখার জন্য। কিন্তু সে আড়ালেই রইল। লাজলজ্জা আছে। পরপুরুষের সামনে আসে না। 

ডাক্তার বললেন, তাইলে আমি ওষুধ দিচ্ছি। চেষ্টা করে দেখো। আর উপরওলাকে ডাকো। কাজ হলে হবে। নইলে কিন্তু আমার দোষ নিও না জননী। 

সেই থেকে সে আছে। রাত্রি দিন তোমার পাশে থেকে এই ওষুধ খাওয়ায় তো, মাথায় জলপট্টি। আবার ছুটে গিয়ে পথ্য বানিয়ে আনে। চামচে করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এই যাত্রায় তার কারণে বেঁচে গেলে হে বাপা। তোমার সাত জন্মের পূণ্যির ফল। 

শুনে জ্ঞানদাসের চোখ জলপূর্ণ হয়। বলতে যায়, আহা, কই সে মেয়ে? জিহবা থেকে এই স্বর ফোটার আগেই বিষ্ণবাবু আবার বোতলটি বের করেন। আরেক ঢোক গিয়ে বলেন,, আ হা হা, তাকে বললাম, মা জননী, অনেক কষ্ট করেছ। এখন আমি দেখছি। তুমি যাও। নদী থেকে ডুব দিয়ে আসো। চাট্টি মুখে দাও। তারপর ঘুমিয়ে নাও। আছি আমি। 

কখন, কোন সময় স্নানে গেছে, সেখান থেকে ফিরেছে কিনা, চাট্টি কী খেয়েছে, কোথায় ঘুমিয়েছে এসব প্রশ্ন করতে যাওয়ার আগে বিষ্ণুবাবুর মাথা এলিয়ে গেছে। জড়ানো গলায় বলছেন, যেতে কি চায় মেয়ে। তবু পাঠালাম। ঘর থেকে লালপেড়ে শাড়ি আর ঝালকাঠির গামছা নিয়ে হেঁটে হেঁটে গেল। একবার পিছন ফিরে বলল, দাদাগো, হাড়িতে ঝাউ রাখা আছে। ঝিনুকে করে খাইয়ে দিয়েন। এর মধ্যে আমি এসে কাঁচা কলা দিয়ে দীঘা ধানের ভার রেঁধে দেবো। 

মেয়েটি হেঁটে হেঁটে গেল। আর উঠোন ভরে তার পায়ের চিহ্ন পড়ে রইল। বুঝলি, পদ্ম পাপড়ির মতো সেই পা। এই পায়ের নিচেই কৃষ্ণ কি কানহাইয়া বুক পেতে দিতে চেয়েছিল। বলেছিল, দেহি পল্লবমুদারম। 

অচিরাৎ বিষ্ণুবাবু নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। তার নাসিকা গর্জন হতে লাগল। 


৫. 

ধীরেন বাবুর মাথার চুল কমে গেছে। তাতে সারাক্ষণ মগজ কিলবিল করে। ঘুমও ঠিক মতো হয় না। কিছুদিন ধরে ঘৃতকুমারীর জেলি তালুতে মাখছেন। তাতে মাঝে মাঝে সর্দি লাগলেও ঘুম আসতে চায় না। 

তিনি একদা খাটরা বার্তা নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন। তাতে অত্র এলাকার সংবাদাদি প্রকাশ করতেন। যেমন গরু ছাগলের হাটে বিক্রিবাটা সুবিধাজনক নয়। গোসাইর খালে কচুড়িপানার বিস্তার। মশা মাছির উৎপাত। সঙ্গে ভেষজ উদ্ভিদের পরিচয়ও দিতেন। থানকুনির উপকারিতা। গুলঞ্চ লতার কাজ। কিছু পদ্যও থাকত। তবু তিনি লিখতেন পছন্দ করতেন আখ্যান। 

তার একটি ছাপাখানা ছিল। নাম আদর্শ ছাপাখানা। নিজেই টাইপ করতেন পাইকা অক্ষর দিয়ে। এলাকার মানুষজন পেপার পত্রিকা বিশেষ জানত না। তিনি শুরুতে ফ্রি বিতরণ করতেন। যারা পড়তে পারত না তাদেরকে তিনি পড়ে শোনাতেন। ইচ্ছে ছিল লোকের নেশা ধরলে তিনি দাম ধরবেন। কিন্তু সেটা হচ্ছিল না দেখে একটি রমরমা কাহিনী লিখতে শুরু করেছিলেন। লিখেছিলেন, লঞ্চঘাটে হোটেল ব্যবসার আড়ালে মধুমক্ষিকার আগমন। 

এই খবরটি প্রকাশ হওয়ার পরে, স্থানীয় কালীবাড়ির বিশিষ্ট ব্যক্তি মধুসূদন মিত্র বাবু তার কলার চেপে ধরেছিলেন। রাগে গজগজ তোঁতলাতে তোঁতলাতে বলেছিলেন, আমি বেশ্যা বাড়ি যাই? বেশ্যাদের সঙ্গে রাত কাটাই? 

তখন হরেকেষ্ট সা তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সব সত্যি লিখতে নেই। ওনার টাকা আছে-- উনি বেশ্যা বাড়ি যেতেই পারেন। তাতে আপনার কী? 

এরপর খাটরাবার্তা আর প্রকাশ করেননি। তার স্ত্রী পায়ে পড়ে বলেছিলেন, এইসব ছাপা করলে তিনি গলায় দড়ি দেবেন। 

স্ত্রীকে তিনি বড়ো ভয় খান। বেচারীর বাপের টাকায়ই এই ছাপাখাবা কিনেছিলেন। এ ঘটনার পর তিনদিনের মাথায় শালা সম্বন্ধিরা এসে নৌকায় করে ছাপাখানি তুলে নিয়ে গেল। 

তিনি কিছুদিন গোজ হয়ে থাকলেন। কিছুদিন আগানবাগান দিয়ে ঘুরে বেড়ালেন। কিছুদিন বড়শি পেতে মাছও ধরলেন। তারপর কী মনে হতে তাদের বাড়ির আড়ার উপরে উঠলেন। সেখানে একটা পুরনো কাঠের বাক্স আছে। কেউ কোনোকালে তা খোলেনি। 



-------------------------------------------------------------
সব কটি পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন : এখানে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. মনে হয়, অনেক দিন পর পর পড়ছি। উপন্যাসটার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।
    এটা দু'মাস অন্তর না করে আরেকটু তাড়াতাড়ি প্রকাশ যায় না?

    উত্তরমুছুন