কুলদা রায়'এর ধারাবাহিক উপন্যাস : কহে জ্ঞানদাস --পর্ব ১

১. 

সাধু পরমানন্দ যেদিন জল হইতে উত্থিত হইলেন, সেদিন তিনি তাকাইয়া দেখিলেন আদিতে আকাশমন্ডল হইয়া আছে। বাতাস মণ্ডল হইয়া আছে। মৃত্তিকামণ্ডলও হইতে বাকি নাই। তিনি আকাশ হউক, বাতাস হউক কি মৃত্তিকা হউক বলিবার ফুসরত পাইলেন না। তাহা হইলে তিনি কেনো এ ভুবনে আবির্ভূত হইলেন তাহা ভাবিতে গিয়া দেখিলেন চারিদিক তমসাবৃত। অনন্তর তিনি উৎফুল্ল হইয়া বুঝিলেন তাহারও কার্য আছে।

তাহা কী? 

তাহা হইল-- আলো হোক। কিন্তু এই আলো হোক কার্যটি করিতে সামান্য সামান্য বিলম্ব করায় তিনি দেখিলেন ইতিমধ্যে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠিয়াছে। রক্ত লাল। আর কে বা কেহ জুলফি দৃষ্টে বলিয়া উঠিয়াছে, বউ কথা কও। বউ কথা কও। 

তাহাতে সাধু পরমানন্দ বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, ইহা একটি পাখি। পাখিটির রং কালো। সে একটা কদমগাছে উড়িয়াছে বসিয়াছে। তাহার অদূরে গ্রাম্যবধুরা গাত্র মার্জনা কর্মে রত। তাহাতে বাধা পাইয়া মুখ ঝামটা দিয়া উঠিল, যা মর মিনসে। সারারাত ধামসে ধামসে আর কিছু বাকি রাখো নাই। এর আগে মুখে একখান ভালো কথা নাই। ধামসাধামসি কইরাই আবার নাক ডাকতি লাগতিছে। অখন আবার বউ কথা কও? 

সাধু পরমানন্দ বুঝিলেন এ জগতে প্রেম নাই। থাকিলে এই রমনীরা সুকথা কহিতেন। তাহাতে আনন্দ হইত। তিনি বুঝিলেন, ভালো কথা কহিবার মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্যেই তাহার আগমণ। তিনি কহিলেন, কবি হোক। 

আর জগতে অমনি কবি হইল। তাহারা কব কব করিয়া উঠিল। 

কব কব করিয়া তাহারা নদীতে গাত্র মার্জনারত রমনীদের প্রতি উর্ধ্বশ্বাসে ধাবিত হইল। তাহাদের কাহারো কাহারো দীর্ঘ কেশরাশি। তাহার আগায় শিখা চিহ্নিত টিকি। কেহবা শশ্রুমণ্ডিত। কেহবা গুম্ফরাজ। আবার কেহ কেহ মুণ্ডিত মস্তকপ্রায়। 

তাহারা অনতিবিলম্বে নদীর পাড় হইতে রমনীদের আনীত বস্ত্রাদি হস্তগত করিয়া কদমগাছের ডালে ডালে উঠিয়া পড়িল। পাখি উড়িয়া তফাতে গেল । তাহার পালক পড়িয়া ঝরিয়া পড়িল রমনীর গায়ে। 

তাহা দেখিয়া রমনীরা বুঝিল, এইবার তাহাদের স্নান সমাপন আসন্ন। আর অধিক বিলম্ব করিলে তাহাদের ভর্তাসকল কুপিত হইবেন। অচিরাৎ তাহারা জল হইতে উঠিতে যাইবেন। উঠিয়া বস্ত্রাদি পরিধান করিবেন। দেখিলেন, নদীকূলে তাহার তাহার বস্ত্র নাই। 

কদম ডালে বস্ত্রহাতে নাগর হাসিতেছে। কহিতেছে,, 

অয়ি তন্বী শিখরা মাগী 

প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ লাগি।। 

শুনিয়া রমানীদিগের রোমহর্ষ হইল। কিন্তু অনতিবিলম্বে বুঝিল, তাহারা অনাবৃতা। লজ্জায় অধবদন হইয়া রহিল। বলিল, হা ঈশ্বর, এ কোন লম্পটের পাল্লায় পড়লাম। জাতি কূল আর বুঝি রইল না। 

পাখি কহিল, উহারা শুধু লম্পট নয়। 

-- তবে কি? 

--কবি। কবি। কবিবর কানু। 

নারীরা কহিল, কানু হারামজাদা। 

এইক্ষণে পাখি নাচিয়া নাচিয়া গাহিতে লাগিল-- 

মা তুই জলে না যাইও. 
মা ই হে হে হে হে কলংকিনি রাধা. 
কদম গাছে উঠিয়া আছে কানু হারামজাদা. 

সাধু পরমানন্দ প্রমাদ গনিলেন। অতপর তাহার লগবুক খুলিয়া লিখিলেন, কবি। উহাদের চিত্ত চঞ্চল। চির প্রেমিক। প্রেম ছাড়া জীবনে অন্য কিছু জানে না। নারী দেখিলেই প্রেমে পড়িবে। প্রেমে কাতর হইয়া প্রণয়কাব্য রচনা করিবে। নারীরা শুনিয়া প্রগলভ হইবে। কিন্তু বিবাহ করিবে না। করিলেও প্রেম নহে-- সান্দেহ করিবে। ফলে….. 

এবং লিখিলেন-- 

প্রেমিক মিলিবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই 
কিন্তু শান্তি পাবে না। পাবে না।। পাবে না। 

কিন্তু ঝামেলা হলো অন্যত্র। তারা গাছে চড়েছে বটে। কিন্তু গাছের অবস্থা জানে না। গাছের ডালে ছিল মৌমাছির বাসা। আর গাছের গোড়ায় ছিল ডাইয়া পিপড়ার বাসা। কিছু পিপড়া গাছ বেয়ে ওঠে। তারা কানু কবিদের পায়ে,, গায়ে আর পাছায় প্রথমে সুড়সুড়ি দেয়। তাতে কবিদের কোনো কোনো চেতন না হওয়ায় তারা তাদের গুপ্ত প্রদেশে কুটুস করে কামড়ে দেয়। ফলে তারা নারীদের অনাবৃত শরীর হামলে পড়ে দেখার কাণ্ড থেকে চেতন ফেরে। এবং পিপড়ে দেখে ওরে বাপরে বলে ফাল দিয়ে পড়ে। পড়লে তো পড়ে গাছের গোড়ার পিপড়ের ঢিপির উপর। সেখানেও লক্ষ লক্ষ পিপড়ে তাদের তীক্ষ্ণ দাত নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। 

সেইক্ষণে অনাবৃত নারীরা ঝোঁপে ঝাড়ের আড়াল নেয়। কেউ কেউ গাছের পাতা দিয়ে দেহ ঢাকার চেষ্টা করে। কয়েকজন সাহসী হয়ে কদন গাছের কাছে আসে বটে। কিন্তু সেখানে উন্মত্ত পিঁপড়ে দেখতে পায়। আর গাছে ওঠার কায়দা জানে না বলে নিচে কিছুক্ষণ থেকে আবার ঝোঁপের আড়ালে চলে যায়। সন্ধ্যার অপেক্ষা করে। 

সারা শহরে ব্যাপারটি আর গোপন রইল না। অতি দ্রুত রটে গেল। ফিসফিস হতে লাগল। কেউ বা আতঙ্কগ্রস্থ হলো। যারা একটু কট্টরপন্থী তারা সমাজের শৃঙখলা ভাঙার আশঙ্কা করল। তারা কবিদেরকে শহর থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টা করল। আর পুরোহিতরা সাধু পরমানন্দের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে লাগল যাতে শহরটি কবিদের আছর থেকে রক্ষা পায়। তার সাড়া না পেয়ে 

আর আফলাতুন নামে এক ঋষি দার্শনিকের পরামর্শ মতে নগররক্ষক পরদিন কবিদের ধরে তাদের টিকিদাড়ি কেটে দেয়। কারো বা মাথে মুড়ে ঘোল ঢালে। এই কিম্ভুত কিমাকার চেহারার কবিদের সড়কে সড়কে ঘুরিয়ে নগরী থেকে বের করে দেয়। এবং চিরতরে নতর তোরণ তাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়। 

এই ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে কখনো কোনো কালে। হয়তো ঘটে নাও থাকতে পারে। কোনো কোনো গবেষক বলেন, যদি কবিদের নগর থেকে বের করে দেওয়াই হয়ে থাকে, তবে কৃষ্ণ কানহাইয়া নামে যে লোকটি কদম গাছে উঠে বসেছিলেন স্নানরত রমনীদের বস্ত্রাদি চুরি করে তিনি কীপ্রকারে নগরীর প্রধান হয়েছিলেন? কীভাবে রাধা নাম্মী এক গোপ বিবাহিতা রমনীরত্নের সঙ্গে পরকীয়া করতেন? কী প্রকারে রুকমিনী, সত্যভামা প্রমুখ রমনীদের ভর্তা হতে পেরেছিলেন? তারা আরো প্রশ্ন করেন, কীবা কারণে নগরীর ষোলশত রমনী তাকে দেহমনপ্রাণ সপে দিয়েছিলেন? এতদ সত্ত্বেও কালে কালে তাকেই যাঞ্চা করে বালিকা কিশোরী তরুণী অথবা পক্ককেশ রমনীরা? 

অতপর সঞ্জয় উবাচ 
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি র্ভবতু…. 

এসব তর্ক থাক। আমরা এসব ঘটনা যাদের কাছে শুনেছিলাম, যাদেরকে একদা ব্যাস নামে কহিত হতো, মনে পড়ে সেই মহা মহা ঠাকুরদা মেজো ব্যাসদেব একদা কথাচ্ছলে বলেছিলেন, নগর থেকে বহিস্কৃত হওয়ার পরে, কৃষ্ণ অথবা কানাই, তাকে যে নামেই ডাকা হোক না তিনি কবি, কবির্মনেষু সেই জন নগর দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন স্থানুবৎ। তিনি রোদে পুড়লেন। বৃষ্টিতে ভিজলেন। শীতে কালিয়ে গেলেন। হাওয়ায় হাওয়ায় হলেন ধূলিধুসরিত। বায়সপক্ষী নির্বিঘ্নে বাতকর্ম করে গেল সহস্র বছর ব্যেপে। শস্য আহরণকালান্তে ধেড়ে ইঁদুরেরা তাদের বাড়ন্ত দাঁত দিয়ে তার পায়ের আঙুল কুট কুট করে কামড়ে গেল। তাতে তিনি উচ্চস্বরে কাঁদতে পারেন না বলে তার চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হলো। সেই অশ্রুবিন্দু জড়ো হয়ে ফল্গুধারা একটি নদীধারার সৃষ্টি হলো। একটু কান পাতলেই সে ধারা থেকে বিনবিন করে হাহাকার উত্থিত হওয়ার শব্দ শোনা যেতে লাগল। । 

তবে সেজো ব্যাসমশাই ভিন্নমত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ইঁদুরে নয়, কৃষ্ণ কানহাইয়া যখন বুঝলেন তার আর সৃষ্টির ক্ষমতা নাই, অন্তকাল সমাগত, তখন তিনি ভূমি থেকে বায়ূ মণ্ডলে সামান্য আসীন হলেন। তখন মনন্তর হেতু ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর এক ব্যাধ বায়ূমণ্ডলে দুটি রক্ত বর্ণ পক্ষী দেখে সুতীক্ষ্ণ বান ছুড়ল। সেই বান লক্ষ্যভেদ করল। ব্যাধ সবিস্ময়ে দেখতে পেল তারা দূটি রক্তবর্ণ পক্ষী নয়, তারা একই ব্যক্তির দুটো পদতল মাত্র। বানবিদ্ধ সেই মহাজন ভূতলে পতিত হলেন। 

সেজো ব্যাস আরো নিশ্চিত করে বললেন, সেটা ঠিল ভুতল নয়। জলতল। ফল্গু নদীর জলতলে তিনি পড়ে গেলেন। পড়ে তিনি অচিরাৎ গলে গলে জলের সঙ্গে মিশে গেলেন। এবং খরা প্রান্তর সুজলা হলো। শস্য নতভারে ভরে উঠল প্রান্তর। এই হেতু এক রমনী সেই ফল্গুধারায় নেমে কী ভেবে গণ্ডুশ ভরে জল পান করলেন। তার দীর্ঘকালের পূর্ণ আনন্দের পিপাসা মিটে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন আরো মোহনীয়। হলো তার বিলোল কটাক্ষ। তিনি কলসীপূর্ণ করে নগরীতে ফিরে গিয়ে জলের সংবাদ দিলেন। 

নগরীর লোকসকল এসে দেখতে পেল সেই জলধারা আর নাই। সকলই নিঃশেষিত। সেখানে এক অনিন্দ্যকান্তি পুরুষের কায়াপ্রায় এক ছায়ার চিহ্ন ফুটে আছে। তারা ছুটে গিয়ে সেই রমনীর সন্ধান করে দেখতে পেল, সে শহরের অন্যতম রূপোজীবী। কতিপয় বজ্জাত লোক তার কলসী থেকে ধেনো মনে করে সেই জল পান করছে। আর তারা হয়ে উঠেছে কান্তিময়। সুকণ্ঠযুক্ত। তারা ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় সংকীর্তন করছে পদাবলী। তা শুনে নগরীর মিলনানন্দবঞ্চিত নারী সকল স্ব স্ব গৃহের গবাক্ষ খুলে সন্ধান করতে লাগল সেই পদকর্তাকে। সেই পদকর্তার সংবাদ শুনেই তাদের দেহ মনে তরঙ্গ উঠেছে। আজ তাদের জীবন বল্লভ এসেছে। গোপন কান্নার দিন শেষ হবে। 

তারা দেখতে পেল, রূপোজীবীর জলপানে সদ্যকান্তিপ্রাপ্ত বজ্জাত লোক রমনীদের দেখে নানারবে খিস্তিখেউড় গাইতে লেগেছে। নানারূপ অঙ্গভঙ্গি করছে। তারা রূপোজীবীদের থানে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করতে লাগল। তারা নির্বিচারে একের পরে এক মুখচুম্বনে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। অনন্তর তাদের তাদের কদর্য ব্যবহারে রমনীরা কেউ কেউ ভীত হলো। কেউ কেউ শরমগ্রস্থ হলো। কেউ কেউ বিক্ষুব্ধ হয়ে গবাক্ষ আটকে দিল। 

তখন প্রধানা রূপোজীবী উচ্চস্বরে নগরীতে বলে চললেন, এরা ঠিক সেই পূর্ণ জীবন বল্লভ নয়। এরা হলো খণ্ড খণ্ড জৈবসত্ত্বা। ওঁ পূর্ণ⁠মদঃ⁠ পূর্ণ⁠মিদং⁠ পূর্ণা⁠ত্পূর্ণ⁠মুদ⁠চ্যতে । পূর্ণ⁠স্য 

পূর্ণ⁠মাদা⁠য় পূর্ণ⁠মেবাবশি⁠ষ্যতে ॥ 

যিনি পূর্ণ, পূর্ণ, পুর্ণ ছিলেন, পূর্ণ ছিলেন এবং পূর্ণরূপেই অবস্থান করেন সেই তিনি এর মধ্যে নগরে এসেছেন। তিনি আদিতে জল ছিলেন। এখন জল থেকে উত্থিত হয়েছেন। তিনি জলের রূপান্তর মাত্র। তিনি সমস্ত পিপাসা নিবারণ করবেন। তিনি অচিরেই নগরীতে আগমন করবেন। 

আফলাতুন তখন আবার তার কণ্ঠ উচ্চ করে বলছেন, এই অরাজক লোকদিগকে নগরী থেকে বহিষ্কার করে দাও। এরা নগরজীবনে বিশৃঙ্খলা এনে দেবে। 

কিন্তু তাদেন হৈহট্টগোলে আফলাতুলের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল। তাকে লোকসকল জঞ্জাল মনে করে হটিয়ে দিল। হটিয়ে দেওয়ার আগে তার টিকি দাড়ি আর কুল কেটে ফেলে হয়। তার মুখে কিছু চুন ও কালিমা লেপেও দেওয়া হয়। শোনা যায়, তিনি তাতে সকাতরে কেঁদে উঠেন। 

কাঁদতে কাঁদতে তিনি দেখতে পেলেন, তারা প্রধানা রূপোজীবীকে টেনে হিচড়ে নগরীর অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে টেনে নিয়ে গেল। সেখানে তারা তার বস্ত্রাদি খুলে ফেলল। উর্ধ্বে তুলে হৈ হৈ রবে রগড় করতে লাগল। যারা যারা প্রধানা রূপোজীবীর নাগাল পেলো তারা তাকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারল। আর যারা নাগাল পেলো না তারা কেউ কেউ তার বস্ত্রাদি ছিড়ে ছিড়ে চারিদিকে ছিড়ে ছিড়ে ওড়াতে লাগল। তাদের হল্লারবে নগরীর দুয়ার সকল রুদ্ধ হয়ে গেছে। শিশুরা ভয়ে কেঁদে কেঁদে উঠছে। আর কিশোরীরা খাটিয়ার নিচে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। তাদের বাবা কাকারা অসহায় হয়ে ক্রোধে রাষ্ট্রশক্তিকে শাপশাপান্ত করছে। আর তাদের মায়েরা আর্তস্বরে সাধু পরমানন্দের স্মরণ করার চেষ্টা করছে। 


২. 

এক্ষণে বিপনীসকল বন্ধ ছিল। কিন্তু স্বর্ণপট্টির এক কোণে একটি ঘরে একজন মধ্যবয়স্ক লোক ঘাড় নিচু করে একটি গয়না গড়ানোর কাজে বিভোর হয়ে ছিলেন। ব্লোয়ার পাইপে ফু দিয়ে সোনার পাতকে নরম করে একটি টিকলিতে রূপ দিচ্ছিলেন। ঠিক এসময়েই তিনি দেখতে পেলেন সোনার বর্ণ আগুনের হাওয়ায় লাল নয়, ক্ষণে ক্ষণে কালো হয়ে যাচ্ছে। কখনোবা হয়ে যাচ্ছে সবুজ। ক্ষণে ক্ষণে স্বর্ণ পিণ্ড হয়ে পড়ছে পিণ্ডাকার। কখনোবা সর্পিলাকার। এরপরকম আগে কখনো হয়নি। এই প্রথম এ রকম রঙ বদলে যেতে দেখে তিনি একটু অবাক হলেন। তার কিছুটা ভয়ও হলো। তার কপালে কিছুটা ঘামও দেখা দিল। তিনি ব্লোয়ার পাইপটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে রাখলেন। ঠিক এসময়েই কাছেপিঠেই খুব হৈ হট্টগোল শোনা গেল। শোনা গেল নারীকণ্ঠের চিৎকার। দরোজার বাইরে তার ভোলা কুকুরকে ঘেউ ঘেউ করতে শুনলেন। 

তিনি তখন বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেখতে পেলেন, তার ভোলা কুকুরটির সামনে স্বর্ণপট্টির কুকুরগুলো দূরের এক অন্ধকারকে লক্ষ করে তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে। কিন্তু সামনে এগোতে পারছে না। তাকে দেখে ভোলা কুকুরটি লেজ তুলে সেদিকে ছুটে গেল। তার পিছনে পিছনে ছুটে গেল অন্য সব কুকুরেরাও। 

স্বর্ণপট্টি তখন সাপা হয়ে আছে। লোকজন নেই। এতো রাত হয়ে গেছে তিনি বুঝতে পারেননি। এই ভোলা কুকুরটিকে নিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফেরেন। এখন ফেরার সময় অনেক আগেই উবে গেছে। তিনি ভোলা কুকুরটিকে নাম ধরে ডাকলেন। ডাকতে ডাকতে সামনে এগিয়ে গেলেন। 

তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন, নগরীর অনুষ্ঠান মঞ্চে একটি নগ্ন মেয়েকে নিয়ে হুটোপুটো খেলছে কতিপয় উন্মাদ লোক। মেয়েটির রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। কুকুরগুলো উত্তেজিতভাবে তাদের উপরে ঝাপিঁয়ে পড়েছে। কুকুরগুলোর আক্রমণের মুখে তারা কিছু হতচকিত হয়ে পড়লেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু টিকতে না পেরে তারা কে বা কোথায় অন্ধকারের মধ্যে পালিয়ে গেল। 

অনন্তর লোকটি তখন দেখতে পেলেন, আকাশজুড়ে কালপুরুষ জেগে উঠেছে। বৃশ্চিক রাশি অস্তগামী। আঁধখানা চাঁদ বিষণ্ণ চোখে ভূমিদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আর দূর থেকে একটা শীতল হাওয়া এসে জনশূন্য স্বর্ণপট্টির ভেতরে পাক খেয়ে খেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আর কেউ নাই। তিনি একা। এবং নিঃসঙ্গ। 

অচিরাৎ এই নিঃসঙ্গতাকে ভেদ করে একটি কাতর কণ্ঠ উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি চমকে উঠলেন। সামনে পিছনে তাকালেন। তাকালেন বাঁয়ে আর ডানে। কাউকেই দেখতে পেলেন না। শুধু অন্ধকার থেকে তার কুকুরটি পা ঘষটে ঘষটে আরেক অন্ধকারের দিকে যাত্রা করছে। ভালো করে নজর করে বুঝতে পারলেন কুকুরটির একটি পা আহত। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। 

তার মর্মে হাহাকার জাগল। এই কুকুরটি ছাড়া এ জগতে তার কেউ নেই। সেই তার পিতা মাতা। সেই তার ভ্রাতা ভগ্নি। আহা ভুলু আহা ভুলু বলতে বলতে তিনি তার কাছে ছুটে গেলেন। ততক্ষণে আহত কুকুরটি নিকটস্থ অন্ধকার ঝোপের কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি ঝোপের কাছে এসে দেখতে পেলেন, ঝোপের আড়ালে একটি মনুষ্য দেহ পড়ে আছে। দেহটি নগ্ন। এবং নারীর। এবং মৃত। 

সোমত্ত নারী দেহ তার অজানা। তবু নারী দেহ। তিনি স্বভাব বশে চোখ বুঝলেন। তখন তার মনে হলো দেহটি মৃত। মৃতের আবার নারী বা পুরুষ কী? মৃতের আবার লজ্জা শরম কী? তিনি চোখ খুললেন। ভুলু কুকুরটিকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু ভুলু কুকুরটি সেই মৃত দেহের গায়ে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে লাগল। 

তিনি ডাকলেন, আয় ভুলু। 

ভুলু আসবে না। কিন্তু সেখানে আর দাঁড়ানো যাবে না। কেউ দেখে ফেললে খবর আছে। হয়তো তাকেই অপরাধো ভেবে পুলিশে ধরিয়ে দেবে। তিনি ভুলুকে জোর করে নিতে যাবেন ঠিক তখনই দেখতে পেলেন, মৃত দেহটি নড়ে উঠেছে। আধস্ফূট স্বরে বলছে, না। না। না। 

কেন যেন তিনি শুনলেন, মা। মা। মা। 

শুনে তার চোখ জলপূর্ণ হলো। তিনি সহসা মাতৃস্নেহ বোধ করলেন। মেয়েটির দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, কাঁদে না। কাঁদে না সোনা। 

অনাবৃত মেয়েটি তার হাতের মধ্যে মুখ লুকালো। সেই মুখের বাঁদিকে একটি রাঙা তিল আছে। তিনি দেখতে পেলেন।


--------------------------------------------------------------
পর্ব ২ পড়তে ক্লিক করুন : এখানে
সব কটি পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন : এখানে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ