কুলদা রায়ের গল্পপাঠের অনুভূতি : সাদিয়া সুলতানা

ডানা ছাড়া কি ওড়া যায়? উড়ে উড়ে যাওয়া যায় কি গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের বনে? ভেসে বেড়ানো যায় কি ঐ সেই দূর আকাশে? জলের বিদ্যা না জেনেও কি ভরপুর সমুদ্রে সাঁতার কাটা যায়? কূল উপচানো নোনতা পানির বুকে ভেসে থাকা যায়?


যায়। যায়-ই তো! লেখকের কলম যদি হয় মেঘের পালকের, লেখা যদি হয় জলের অক্ষরে-তবে পাঠক পরী, পাখি, মাছ হয়ে উড়তে, ভাসতে, সাঁতার কাটতে জানে। সত্যি, একজন লেখক যদি পাথরের ত্বকে খোদাই করতে জানেন জলের শিলালিপি তবে পাঠকও দিতে জানেন জলের দাম।

জলের দাম! অমূল্য; কষ্টে পাওয়া, অথচ অসম্ভব না তা হেলায় হারানো। এই যে দেশ ভাগাভাগি, দেশহারা মানুষের বুকের বেদনার উজান সবই তো জলের দামেই পাওয়া।

জল কিংবা পানি, হিন্দু কিংবা মুসলমান, ধর্ম কিংবা বর্ণ, এপার কিংবা ওপার...অভিন্ন আবার হয়তো ভিন্নই সব। সব ভিন্নতাকে পাশ কাটিয়ে মানুষে মানুষে জুড়ে থাকে সম্পর্ক। আর সম্পর্ক মানেই হলো ব্যাখ্যাতীত আনন্দ-বেদনার অনুভূতি। এইসব অস্পর্শী অনুভব বয়নের শিল্পী হলেন গল্পকার কুলদা রায়।

‘বৃষ্টি চিহ্নিত জল' গল্পগ্রন্থের ১৫ টি গল্প গল্পকার কুলদা রায় ইতিহাসের সূত্র ধরে লিখেছেন এবং নির্মাণ করেছেন ইতিহাসের বিকল্পপাঠ।

এই গল্পগুলোর কোনোটিতে বৃটিশ আমলের সুসমাচার প্রচারকারী খ্রিস্টান মিশনারীদের কেন্দ্র করে এসেছে গল্পকারের ঠাকুরদার কৃষ্ণপালা আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সফরসঙ্গী প্রখ্যাত বাইজী মতিবিবি, তার মেয়ে গন্নিবিবির আখ্যান। কোনোটিতে ১৯৬৫ সালে শত্রু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কালে ভূমিচ্যুত মানুষের দীর্ঘশ্বাসের আখ্যান আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব এসেছে। কোনো কোনো গল্পে ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ বা ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পীড়িত মানুষ উপজীব্য হয়েছে। গল্পের কাঠামোকে একঘেয়ে করে এখানে সেখানে ইতিহাসকে গুঁজে দেবার কাজটি কিন্তু করেননি কুলদা রায়। তার গল্পে পাঠক জাদুবাস্তবতার ঘোরে পড়ে ইতিহাসকে জানতে বাধ্য হয়।

জাদুবাস্তব কাহিনীর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এতে দৈনন্দিন ঘটনাবলী এমনভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে অসাধারণ ঘটনাবলি ঘটতে থাকবে বা লৌকিকের মধ্যে অলৌকিকের উপস্থাপন থাকবে। পরিষ্কার করে বললে, এই ধরনের লেখাতে থাকবে জাগতিক বিষয় বা বাস্তবতার সাথে জাদুর সংমিশ্রণ। কিন্তু জাদু থাকবে বলে কি সম্পূর্ণ কল্পকাহিনীর বিস্তার ঘটবে জাদুবাস্তবতার গল্পে? নাকি পার্থিব বিষয়বস্তুকে ধারণ করেই জাদুর ডালপালা গজাবে?
কুলদা রায়ের 'বৃষ্টি চিহ্নিত জল' গল্পগ্রন্থটি পড়লে এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে।

‘বৃষ্টি চিহ্নিত জল' গল্পগ্রন্থের ১৫ টি গল্পের মধ্যে আমার অন্যতম প্রিয় গল্প ‘জন্মকাল।’ গল্পটি পড়ে একটা আস্ত বিকেল আর সন্ধ্যা নিশ্চুপ বসে থেকেছি। আনমনে ভেবেছি কীভাবে একজন লেখক মানুষের জীবনের জলছাপ এত নিখুঁতভাবে নির্মাণ করেন! প্রগাঢ় বেদনাকে আঁকেন অবয়বহীন রঙের তুলিতে!

‘জন্মকাল' গল্পের বিনোদিনীর মেজো ছেলে মধু পুরনো আলমারির ভেতরে থাকা একটি পুরনো ক্যাশবুকে ডায়েরি লিখতো। বিনোদিনী মাঝে মাঝে এই ডায়েরি বের করে যেখানে মধু তার দাদা সুধীরচন্দ্র ও আলো বৌদির ছেলে কৌশিকের জন্মকালের কথা, ঠাকুরদা শ্রী বিধুভূষণের নেশা যাত্রাপালার দলের সংকট ও জন্মভিটেতে বিধুভূষণের পাকা দালান করার স্বপ্নের কথা, ভূমিখেকোদের আগ্রাসনে নিজেদের ভিটেবাড়ি শত্রুসম্পত্তি হয়ে যাবার পূর্বাভাস, ভাইবোনদের নামে লাগানো গাছের কথা লিখে রেখে গেছে। বিধুভূষণের বাড়ির বাগান আগে জলা জায়গা ছিল। বিনোদিনীই প্রথম এই জলা জায়গাতে গাছ লাগিয়েছিল। এরপর প্রত্যেক সন্তানের জন্মের পর বিধুবাবুর বাগানে এক একটি আম, জামরুল, কতবেল, কুল বরই, সফেদা, কাঁঠালের চারা লাগানো হয়েছে। এভাবে এক একটি সজীব চারার মতো এই গল্পে ছোট ছোট বাক্যে সূক্ষ্ম সব অনুভূতির বীজ বোনা হয়েছে।

‘দেও তো বউ মা, অরে ফেলাইয়া আসি-কি বুঝল কে জানে, দুই দিনেই মেয়েটি চুপ করে গেল।’ অনাকাঙ্ক্ষিত মেয়ে সন্তানের জন্মের পর কান্নার একঘেয়ে প্রেক্ষাপটে এই একটিমাত্র বাক্য ব্যবহার যেন আরেকটি গল্পের আভাস দেয়। কুলদা রায়ের গল্পের স্বকীয়তা এটাই। তার একটি গল্প অনেক গল্পের আবহ তৈরি করে, নতুন গল্প নির্মাণের উসকানি দেয়।

মধুসুদনের বেগুনি শার্টের বুক পকেটে হলুদ সুতোয় সেলাই করে লেখা তার নাম। নীলার মাঠের মেলা থেকে ফেরার পথে সেই মধুসূদন হারিয়ে গেছে নাকি তাকে পরী ভুলিয়ে নিয়ে গেছে? নাকি ওসির কথিতমতে নিখোঁজ মধু দেশদ্রোহী হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর গগনের জানা, তবু সে সত্যিটা কাউকে বলে না। গগনের বুকের নিভৃতে কেবল ভাঙচুর হতে থাকে সেই না বলা সত্যির ভারে। এভাবে ‘জন্মকাল’ গল্পটি শুধু একটি হিন্দু পরিবারের জন্মভিটে হারানোর গল্পের পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে জীবনের সুখ-দুঃখ আর মায়ার ক্যানভাস। এই গল্পের ভাঁজে ভাঁজে মাটির ঘ্রাণ, মায়ার চোরাটান। সোজাসাপটাভাবে বললে হিন্দুদের সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি হবার ইতিহাসের খণ্ডচিত্র নির্মিত হয়েছে এই গল্পে। যেই গল্পের ছাঁচে প্রাণ পাওয়া চরিত্রগুলোর রূপায়ন বড়ো মনোরম।

বিনোদিনীর মেজো খোকা মধুর হারিয়ে যাওয়া, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিষবাষ্পে মধুর প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় ইমাম সাহেবের মিলাদ মাহফিল করতে না পারা, মধুর ডায়েরির ছেঁড়া পাতা, গগন করাতির মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, কোহেকাফের পরীর গল্প বুকের ভেতরে হাহাকার তোলে।

কুলদা রায়ের ‘মার্কেজের পুতুল ও অন্যান্য’ গল্পগ্রন্থের ‘ফ্লাই উইদাউট উইংস’ গল্পে পাতা কথা বলে, ছায়া কথা বলে। পরী কথা বলে। কাঁদে। এই পরীর এক হাতে ম্যাপল পাতার মুকুট, আরেক হাতে পাখির লম্বা পালক, পরনে তামাটে গাউন। পরীটি পার্কে দাঁড়িয়ে থাকে। পার্কে ১৯৪৭ সালে রোপিত ৪১ টি গাছ আছে, ৬৫ টি কবুতর আছে। এক ঝাঁক কবুতর পরীর কাঁধ থেকে উড়ে এসে বুড়ো লোকটির কাঁধ-হাঁটুর ওপর বসে। সন্ধ্যা নামলে পরীর একা একা লাগে। তার ভীষণ কান্না পায়। পরীর ডানা দুটি গলে গলে ঝরে পড়ে। পার্কের বেদী ছেড়ে পরীটি উড়ে যায় দূর আকাশে...

বড় মনোরম এ গল্প। জাদুর কলমে লেখা। পড়তে পড়তে পাঠক কখন যে জাদুবাস্তবতার ঘোরে আটকে যায় তা সে নিজেও টের পায় না।

জীবনের আখ্যানের সঙ্গে কল্পনার আখ্যান জুড়ে থাকায় কুলদা রায়ের গল্প পাঠককে নিয়ে যায় এক জাদুময় জগতে। একই সঙ্গে প্রায় প্রতিটি গল্পে পাঠক ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হয়।

'দি র‌্যালে সাইকেল' গল্পটিতেও গল্পকার কুলদা রায়ের সঙ্গে পাঠক পরিভ্রমণ করে ইতিহাসের বিস্তীর্ণ পথে।

'দি র‌্যালে সাইকেল' গল্পে সাইকেলটি বেশ অভিনব ভাবে পাঠকের সামনে হাজির হয়। তারপর লোহা লক্কড়ের কঙ্কাল এই সাইকেলই হয়ে ওঠে ইতিহাসের আখ্যান নির্মাণের আকর্ষণীয় এক ‘টুল।’ একবার এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে মাটির নিচ থেকে উঠে আসে ভাঙ্গা সাইকেলটি আর এরই সাথে গল্পটি ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক উন্মোচন করে চলতে শুরু করে।

প্রকৃতপক্ষে বিস্মৃতির গহ্বর থেকে স্মৃতিকে খুঁজে বের করে আনার গল্প ‘দি র‌্যালে সাইকেল।’ গল্পের সাইকেলটির আসল মালিক খবিরুদ্দিন মুন্সির দাদাজান আয়েনুদ্দিন মুন্সি। সাইকেলটি যেদিন কোলকাতার বড়বাজার থেকে কেনা হয় সেদিন মুসলিম লীগ বাংলা ভাগ করার দাবীতে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দিয়েছিল। এর পরের দিন অপহৃত হয়েছিল আয়েনুদ্দিন মুন্সির বিবি। কোলকাতার সংবাদপত্রে আয়েনুদ্দিন মুন্সির বিবি অপহরণের সংবাদটি প্রকাশিত না হলেও ভোজেরগাতি গ্রামের রইসুল কবিয়াল তাদের দুজনকে নিয়ে একটি বিষাদাত্মক কাহিনি রচনা করেছিলেন যার দুটি চরণ হলো-
‘যখন চেতন ফেরে দেখে মিয়া ভাই
সাইকেল পড়িয়া আছে বিবি সেথা নাই।’

বিবিকে হারিয়ে বর্ধমান ছেড়ে আয়েনুদ্দিন মুন্সি পূর্ববঙ্গে চলে এলেও তিনি নিজেও একদিন রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যান। একদিন একটা চিঠি আসে আয়েনুদ্দিন মুন্সির অন্তর্ধান রহস্যের সূত্র ধরে। ওদিকে বহু বছর আগের ‘দি র‌্যালে সাইকেল’ এর সন্ধান পাবার খবর জেনে এর অন্তরালের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন সাংবাদিক মোজাম্মেল হক মুন্না। মোজাম্মেল হক মুন্না সাইকেলের রডের ওপর গুপ্ত থাকা কিছু শব্দ ঘষে বের করার পর তার সঙ্গে পাঠক দ্বিচক্রযানে চড়ে ইতিহাসের পথে পরিভ্রমণ করতে শুরু করেন। ক্রমশ বৃটিশ ভারতীয় সমাজ, তৎকালীন রাজনীতি, ক্ষুদিরাম, নমশুদ্র সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা নেতা বরিশালের যোগেন মন্ডল, মুসলীম লীগ, পূর্ববঙ্গের সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন ইত্যাদি বিষয় গল্পে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৪৬, ১৯৪৭ সাল-এসব সংকটকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার সন্ধান পাবার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে আরও দুইটি সাইকেল রহস্য। বিধু বাবুর ফোনিক্স সাইকেল আর রতন মোল্লার র‌্যালে সাইকেলটি পাঠককে নতুন সব আখ্যানের মুখোমুখি করায়। সেই সঙ্গে হদিশ পাওয়া যায় একজন হিন্দু বিধবার অশ্রুগাথার।

"রজনীগন্ধা ফুলটি যেদিন ফুটেছিল" গল্পের বৃদ্ধ আব্দুস সামাদ ও তার বিবি শরিফুন্নেছার ঘরে থাকা টবের রজনীগন্ধা গাছে কখনো ফুল ফোটে না। কুঁড়ি এসে পচে যায়। এই ফুল না ফোটার ইতিহাস আর "রজনীগন্ধা ফুল তুমহারি..." গানের সন্ধান করার সঙ্গে সঙ্গে এই গল্পে ভয়ংকর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কালপর্ব বর্ণিত হয়েছে। গল্প নির্মাণের কৌশলে কুলদা রায় স্বতন্ত্র। পাঠক রজনীগন্ধা ফুল আর শেফালিকার সঙ্গে গল্পকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজের অজান্তেই ইতিহাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একটি শহরে রূপকার্থে এ দেশে কী ঘটেছিল তা নিয়ে লেখা হয়েছে এই গল্পটি। গল্পকারের ভাষায়, এই গল্পটি শুধু নিহত বঙ্গবন্ধুর গল্প নয়, এই গল্পটি সেদিনে নিহত একটি শহরের গল্প। একটি জনগোষ্ঠীর গল্প।

কুলদা রায় মানুষের গল্প লেখেন। ইতিহাসের গল্প লেখেন। মাটির গল্প লেখেন। তার গল্পের ছোট ছোট বাক্যে দেশের মাটির সুঘ্রাণ উথলে ওঠে; দীঘাধানের মুড়ি, দুখণ্ড মুছি পাটালি, শামুকগেড়ি-কচুরিপানার মিলিত গন্ধ, ছাও-পোনাসমেত হাঁস, নলেন গুড়ের পায়েস...কত কিছুর দেখা যে মেলে! কুলদা রায়ের গল্পের পাঠ শেষে তাই অনিবার্যভাবে চোখের কোণে বৃষ্টি চিহ্নিত জল নিয়ে বসে থাকতে হয়।

গল্পগ্রন্থ-'বৃষ্টি চিহ্নিত জল'
প্রকাশনী-নালন্দা (বাংলাদেশ,)
গল্পগ্রন্থ-'মার্কেজের পুতুল ও অন্যান্য গল্প'
প্রকাশনী (কোলকাতা, ২০১৯)- সোপান
প্রকাশনী (বাংলাদেশ, ২০২০)- নালন্দা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ