সাধু পরমানন্দ যেদিন জল হইতে উত্থিত হইলেন, সেদিন তিনি তাকাইয়া দেখিলেন আদিতে আকাশমন্ডল হইয়া আছে। বাতাস মণ্ডল হইয়া আছে। মৃত্তিকামণ্ডলও হইতে বাকি নাই। তিনি আকাশ হউক, বাতাস হউক কি মৃত্তিকা হউক বলিবার ফুসরত পাইলেন না। তাহা হইলে তিনি কেনো এ ভুবনে আবির্ভূত হইলেন তাহা ভাবিতে গিয়া দেখিলেন চারিদিক তমসাবৃত। অনন্তর তিনি উৎফুল্ল হইয়া বুঝিলেন তাহারও কার্য আছে।
তাহা কী?
তাহা হইল-- আলো হোক। কিন্তু এই আলো হোক কার্যটি করিতে সামান্য সামান্য বিলম্ব করায় তিনি দেখিলেন ইতিমধ্যে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠিয়াছে। রক্ত লাল। আর কে বা কেহ জুলফি দৃষ্টে বলিয়া উঠিয়াছে, বউ কথা কও। বউ কথা কও।
তাহাতে সাধু পরমানন্দ বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, ইহা একটি পাখি। পাখিটির রং কালো। সে একটা কদমগাছে উড়িয়াছে বসিয়াছে। তাহার অদূরে গ্রাম্যবধুরা গাত্র মার্জনা কর্মে রত। তাহাতে বাধা পাইয়া মুখ ঝামটা দিয়া উঠিল, যা মর মিনসে। সারারাত ধামসে ধামসে আর কিছু বাকি রাখো নাই। এর আগে মুখে একখান ভালো কথা নাই। ধামসাধামসি কইরাই আবার নাক ডাকতি লাগতিছে। অখন আবার বউ কথা কও?
সাধু পরমানন্দ বুঝিলেন এ জগতে প্রেম নাই। থাকিলে এই রমনীরা সুকথা কহিতেন। তাহাতে আনন্দ হইত। তিনি বুঝিলেন, ভালো কথা কহিবার মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্যেই তাহার আগমণ। তিনি কহিলেন, কবি হোক।
আর জগতে অমনি কবি হইল। তাহারা কব কব করিয়া উঠিল।
কব কব করিয়া তাহারা নদীতে গাত্র মার্জনারত রমনীদের প্রতি উর্ধ্বশ্বাসে ধাবিত হইল। তাহাদের কাহারো কাহারো দীর্ঘ কেশরাশি। তাহার আগায় শিখা চিহ্নিত টিকি। কেহবা শশ্রুমণ্ডিত। কেহবা গুম্ফরাজ। আবার কেহ কেহ মুণ্ডিত মস্তকপ্রায়।
তাহারা অনতিবিলম্বে নদীর পাড় হইতে রমনীদের আনীত বস্ত্রাদি হস্তগত করিয়া কদমগাছের ডালে ডালে উঠিয়া পড়িল। পাখি উড়িয়া তফাতে গেল । তাহার পালক পড়িয়া ঝরিয়া পড়িল রমনীর গায়ে।
তাহা দেখিয়া রমনীরা বুঝিল, এইবার তাহাদের স্নান সমাপন আসন্ন। আর অধিক বিলম্ব করিলে তাহাদের ভর্তাসকল কুপিত হইবেন। অচিরাৎ তাহারা জল হইতে উঠিতে যাইবেন। উঠিয়া বস্ত্রাদি পরিধান করিবেন। দেখিলেন, নদীকূলে তাহার তাহার বস্ত্র নাই।
কদম ডালে বস্ত্রহাতে নাগর হাসিতেছে। কহিতেছে,,
অয়ি তন্বী শিখরা মাগী
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ লাগি।।
শুনিয়া রমানীদিগের রোমহর্ষ হইল। কিন্তু অনতিবিলম্বে বুঝিল, তাহারা অনাবৃতা। লজ্জায় অধবদন হইয়া রহিল। বলিল, হা ঈশ্বর, এ কোন লম্পটের পাল্লায় পড়লাম। জাতি কূল আর বুঝি রইল না।
পাখি কহিল, উহারা শুধু লম্পট নয়।
-- তবে কি?
--কবি। কবি। কবিবর কানু।
নারীরা কহিল, কানু হারামজাদা।
এইক্ষণে পাখি নাচিয়া নাচিয়া গাহিতে লাগিল--
মা তুই জলে না যাইও.
মা ই হে হে হে হে কলংকিনি রাধা.
কদম গাছে উঠিয়া আছে কানু হারামজাদা.
সাধু পরমানন্দ প্রমাদ গনিলেন। অতপর তাহার লগবুক খুলিয়া লিখিলেন, কবি। উহাদের চিত্ত চঞ্চল। চির প্রেমিক। প্রেম ছাড়া জীবনে অন্য কিছু জানে না। নারী দেখিলেই প্রেমে পড়িবে। প্রেমে কাতর হইয়া প্রণয়কাব্য রচনা করিবে। নারীরা শুনিয়া প্রগলভ হইবে। কিন্তু বিবাহ করিবে না। করিলেও প্রেম নহে-- সান্দেহ করিবে। ফলে…..
এবং লিখিলেন--
প্রেমিক মিলিবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই
কিন্তু শান্তি পাবে না। পাবে না।। পাবে না।
কিন্তু ঝামেলা হলো অন্যত্র। তারা গাছে চড়েছে বটে। কিন্তু গাছের অবস্থা জানে না। গাছের ডালে ছিল মৌমাছির বাসা। আর গাছের গোড়ায় ছিল ডাইয়া পিপড়ার বাসা। কিছু পিপড়া গাছ বেয়ে ওঠে। তারা কানু কবিদের পায়ে,, গায়ে আর পাছায় প্রথমে সুড়সুড়ি দেয়। তাতে কবিদের কোনো কোনো চেতন না হওয়ায় তারা তাদের গুপ্ত প্রদেশে কুটুস করে কামড়ে দেয়। ফলে তারা নারীদের অনাবৃত শরীর হামলে পড়ে দেখার কাণ্ড থেকে চেতন ফেরে। এবং পিপড়ে দেখে ওরে বাপরে বলে ফাল দিয়ে পড়ে। পড়লে তো পড়ে গাছের গোড়ার পিপড়ের ঢিপির উপর। সেখানেও লক্ষ লক্ষ পিপড়ে তাদের তীক্ষ্ণ দাত নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে।
সেইক্ষণে অনাবৃত নারীরা ঝোঁপে ঝাড়ের আড়াল নেয়। কেউ কেউ গাছের পাতা দিয়ে দেহ ঢাকার চেষ্টা করে। কয়েকজন সাহসী হয়ে কদন গাছের কাছে আসে বটে। কিন্তু সেখানে উন্মত্ত পিঁপড়ে দেখতে পায়। আর গাছে ওঠার কায়দা জানে না বলে নিচে কিছুক্ষণ থেকে আবার ঝোঁপের আড়ালে চলে যায়। সন্ধ্যার অপেক্ষা করে।
সারা শহরে ব্যাপারটি আর গোপন রইল না। অতি দ্রুত রটে গেল। ফিসফিস হতে লাগল। কেউ বা আতঙ্কগ্রস্থ হলো। যারা একটু কট্টরপন্থী তারা সমাজের শৃঙখলা ভাঙার আশঙ্কা করল। তারা কবিদেরকে শহর থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টা করল। আর পুরোহিতরা সাধু পরমানন্দের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে লাগল যাতে শহরটি কবিদের আছর থেকে রক্ষা পায়। তার সাড়া না পেয়ে
আর আফলাতুন নামে এক ঋষি দার্শনিকের পরামর্শ মতে নগররক্ষক পরদিন কবিদের ধরে তাদের টিকিদাড়ি কেটে দেয়। কারো বা মাথে মুড়ে ঘোল ঢালে। এই কিম্ভুত কিমাকার চেহারার কবিদের সড়কে সড়কে ঘুরিয়ে নগরী থেকে বের করে দেয়। এবং চিরতরে নতর তোরণ তাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়।
এই ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে কখনো কোনো কালে। হয়তো ঘটে নাও থাকতে পারে। কোনো কোনো গবেষক বলেন, যদি কবিদের নগর থেকে বের করে দেওয়াই হয়ে থাকে, তবে কৃষ্ণ কানহাইয়া নামে যে লোকটি কদম গাছে উঠে বসেছিলেন স্নানরত রমনীদের বস্ত্রাদি চুরি করে তিনি কীপ্রকারে নগরীর প্রধান হয়েছিলেন? কীভাবে রাধা নাম্মী এক গোপ বিবাহিতা রমনীরত্নের সঙ্গে পরকীয়া করতেন? কী প্রকারে রুকমিনী, সত্যভামা প্রমুখ রমনীদের ভর্তা হতে পেরেছিলেন? তারা আরো প্রশ্ন করেন, কীবা কারণে নগরীর ষোলশত রমনী তাকে দেহমনপ্রাণ সপে দিয়েছিলেন? এতদ সত্ত্বেও কালে কালে তাকেই যাঞ্চা করে বালিকা কিশোরী তরুণী অথবা পক্ককেশ রমনীরা?
অতপর সঞ্জয় উবাচ --
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি র্ভবতু….
এসব তর্ক থাক। আমরা এসব ঘটনা যাদের কাছে শুনেছিলাম, যাদেরকে একদা ব্যাস নামে কহিত হতো, মনে পড়ে সেই মহা মহা ঠাকুরদা মেজো ব্যাসদেব একদা কথাচ্ছলে বলেছিলেন, নগর থেকে বহিস্কৃত হওয়ার পরে, কৃষ্ণ অথবা কানাই, তাকে যে নামেই ডাকা হোক না তিনি কবি, কবির্মনেষু সেই জন নগর দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন স্থানুবৎ। তিনি রোদে পুড়লেন। বৃষ্টিতে ভিজলেন। শীতে কালিয়ে গেলেন। হাওয়ায় হাওয়ায় হলেন ধূলিধুসরিত। বায়সপক্ষী নির্বিঘ্নে বাতকর্ম করে গেল সহস্র বছর ব্যেপে। শস্য আহরণকালান্তে ধেড়ে ইঁদুরেরা তাদের বাড়ন্ত দাঁত দিয়ে তার পায়ের আঙুল কুট কুট করে কামড়ে গেল। তাতে তিনি উচ্চস্বরে কাঁদতে পারেন না বলে তার চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হলো। সেই অশ্রুবিন্দু জড়ো হয়ে ফল্গুধারা একটি নদীধারার সৃষ্টি হলো। একটু কান পাতলেই সে ধারা থেকে বিনবিন করে হাহাকার উত্থিত হওয়ার শব্দ শোনা যেতে লাগল। ।
তবে সেজো ব্যাসমশাই ভিন্নমত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ইঁদুরে নয়, কৃষ্ণ কানহাইয়া যখন বুঝলেন তার আর সৃষ্টির ক্ষমতা নাই, অন্তকাল সমাগত, তখন তিনি ভূমি থেকে বায়ূ মণ্ডলে সামান্য আসীন হলেন। তখন মনন্তর হেতু ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর এক ব্যাধ বায়ূমণ্ডলে দুটি রক্ত বর্ণ পক্ষী দেখে সুতীক্ষ্ণ বান ছুড়ল। সেই বান লক্ষ্যভেদ করল। ব্যাধ সবিস্ময়ে দেখতে পেল তারা দূটি রক্তবর্ণ পক্ষী নয়, তারা একই ব্যক্তির দুটো পদতল মাত্র। বানবিদ্ধ সেই মহাজন ভূতলে পতিত হলেন।
সেজো ব্যাস আরো নিশ্চিত করে বললেন, সেটা ঠিল ভুতল নয়। জলতল। ফল্গু নদীর জলতলে তিনি পড়ে গেলেন। পড়ে তিনি অচিরাৎ গলে গলে জলের সঙ্গে মিশে গেলেন। এবং খরা প্রান্তর সুজলা হলো। শস্য নতভারে ভরে উঠল প্রান্তর। এই হেতু এক রমনী সেই ফল্গুধারায় নেমে কী ভেবে গণ্ডুশ ভরে জল পান করলেন। তার দীর্ঘকালের পূর্ণ আনন্দের পিপাসা মিটে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন আরো মোহনীয়। হলো তার বিলোল কটাক্ষ। তিনি কলসীপূর্ণ করে নগরীতে ফিরে গিয়ে জলের সংবাদ দিলেন।
নগরীর লোকসকল এসে দেখতে পেল সেই জলধারা আর নাই। সকলই নিঃশেষিত। সেখানে এক অনিন্দ্যকান্তি পুরুষের কায়াপ্রায় এক ছায়ার চিহ্ন ফুটে আছে। তারা ছুটে গিয়ে সেই রমনীর সন্ধান করে দেখতে পেল, সে শহরের অন্যতম রূপোজীবী। কতিপয় বজ্জাত লোক তার কলসী থেকে ধেনো মনে করে সেই জল পান করছে। আর তারা হয়ে উঠেছে কান্তিময়। সুকণ্ঠযুক্ত। তারা ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় সংকীর্তন করছে পদাবলী। তা শুনে নগরীর মিলনানন্দবঞ্চিত নারী সকল স্ব স্ব গৃহের গবাক্ষ খুলে সন্ধান করতে লাগল সেই পদকর্তাকে। সেই পদকর্তার সংবাদ শুনেই তাদের দেহ মনে তরঙ্গ উঠেছে। আজ তাদের জীবন বল্লভ এসেছে। গোপন কান্নার দিন শেষ হবে।
তারা দেখতে পেল, রূপোজীবীর জলপানে সদ্যকান্তিপ্রাপ্ত বজ্জাত লোক রমনীদের দেখে নানারবে খিস্তিখেউড় গাইতে লেগেছে। নানারূপ অঙ্গভঙ্গি করছে। তারা রূপোজীবীদের থানে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করতে লাগল। তারা নির্বিচারে একের পরে এক মুখচুম্বনে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। অনন্তর তাদের কদর্য ব্যবহারে রমনীরা কেউ কেউ ভীত হলো। কেউ কেউ শরমগ্রস্থ হলো। কেউ কেউ বিক্ষুব্ধ হয়ে গবাক্ষ আটকে দিল।
তখন প্রধানা রূপোজীবী উচ্চস্বরে নগরীতে বলে চললেন, এরা ঠিক সেই পূর্ণ জীবন বল্লভ নয়। এরা হলো খণ্ড খণ্ড জৈবসত্ত্বা।
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ॥
যিনি পূর্ণ, পূর্ণ, পুর্ণ ছিলেন, পূর্ণ ছিলেন এবং পূর্ণরূপেই অবস্থান করেন সেই তিনি এর মধ্যে নগরে এসেছেন। তিনি আদিতে জল ছিলেন। এখন জল থেকে উত্থিত হয়েছেন। তিনি জলের রূপান্তর মাত্র। তিনি সমস্ত পিপাসা নিবারণ করবেন। তিনি অচিরেই নগরীতে আগমন করবেন।
আফলাতুন তখন আবার তার কণ্ঠ উচ্চ করে বলছেন, এই অরাজক লোকদিগকে নগরী থেকে বহিষ্কার করে দাও। এরা নগরজীবনে বিশৃঙ্খলা এনে দেবে।
কিন্তু তাদেন হৈহট্টগোলে আফলাতুলের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল। তাকে লোকসকল জঞ্জাল মনে করে হটিয়ে দিল। হটিয়ে দেওয়ার আগে তার টিকি দাড়ি আর কুল কেটে ফেলে দেওয়া হয়। তার মুখে কিছু চুন ও কালিমা লেপেও দেওয়া হয়। শোনা যায়, তিনি তাতে সকাতরে কেঁদে উঠেন।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি দেখতে পেলেন, তারা প্রধানা রূপোজীবীকে টেনে হিচড়ে নগরীর অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে টেনে নিয়ে গেল। সেখানে তারা তার বস্ত্রাদি খুলে ফেলল। উর্ধ্বে তুলে হৈ হৈ রবে রগড় করতে লাগল। যারা যারা প্রধানা রূপোজীবীর নাগাল পেলো তারা তাকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারল। আর যারা নাগাল পেলো না তারা কেউ কেউ তার বস্ত্রাদি ছিড়ে ছিড়ে চারিদিকে ওড়াতে লাগল। তাদের হল্লারবে নগরীর দুয়ার সকল রুদ্ধ হয়ে গেছে। শিশুরা ভয়ে কেঁদে কেঁদে উঠছে। আর কিশোরীরা খাটিয়ার নিচে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। তাদের বাবা কাকারা অসহায় হয়ে ক্রোধে রাষ্ট্রশক্তিকে শাপশাপান্ত করছে। আর তাদের মায়েরা আর্তস্বরে সাধু পরমানন্দের স্মরণ করার চেষ্টা করছে।
২.
এক্ষণে বিপনীসকল বন্ধ ছিল। কিন্তু স্বর্ণপট্টির এক কোণে একটি ঘরে একজন মধ্যবয়স্ক লোক ঘাড় নিচু করে একটি গয়না গড়ানোর কাজে বিভোর হয়ে ছিলেন। ব্লোয়ার পাইপে ফু দিয়ে সোনার পাতকে নরম করে একটি টিকলিতে রূপ দিচ্ছিলেন। ঠিক এসময়েই তিনি দেখতে পেলেন সোনার বর্ণ আগুনের হাওয়ায় লাল নয়, ক্ষণে ক্ষণে কালো হয়ে যাচ্ছে। কখনোবা হয়ে যাচ্ছে সবুজ। ক্ষণে ক্ষণে স্বর্ণ পিণ্ড হয়ে পড়ছে পিণ্ডাকার। কখনোবা সর্পিলাকার। এরপরকম আগে কখনো হয়নি। এই প্রথম এ রকম রঙ বদলে যেতে দেখে তিনি একটু অবাক হলেন। তার কিছুটা ভয়ও হলো। তার কপালে কিছুটা ঘামও দেখা দিল। তিনি ব্লোয়ার পাইপটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে রাখলেন। ঠিক এসময়েই কাছেপিঠেই খুব হৈ হট্টগোল শোনা গেল। শোনা গেল নারীকণ্ঠের চিৎকার। দরোজার বাইরে তার ভোলা কুকুরকে ঘেউ ঘেউ করতে শুনলেন।
তিনি তখন বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেখতে পেলেন, তার ভোলা কুকুরটির সামনে স্বর্ণপট্টির কুকুরগুলো দূরের এক অন্ধকারকে লক্ষ করে তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে। কিন্তু সামনে এগোতে পারছে না। তাকে দেখে ভোলা কুকুরটি লেজ তুলে সেদিকে ছুটে গেল। তার পিছনে পিছনে ছুটে গেল অন্য সব কুকুরেরাও।
স্বর্ণপট্টি তখন সাপা হয়ে আছে। লোকজন নেই। এতো রাত হয়ে গেছে তিনি বুঝতে পারেননি। এই ভোলা কুকুরটিকে নিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফেরেন। এখন ফেরার সময় অনেক আগেই উবে গেছে। তিনি ভোলা কুকুরটিকে নাম ধরে ডাকলেন। ডাকতে ডাকতে সামনে এগিয়ে গেলেন।
তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন, নগরীর অনুষ্ঠান মঞ্চে একটি নগ্ন মেয়েকে নিয়ে হুটোপুটো খেলছে কতিপয় উন্মাদ লোক। মেয়েটির রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। কুকুরগুলো উত্তেজিতভাবে তাদের উপরে ঝাপিঁয়ে পড়েছে। কুকুরগুলোর আক্রমণের মুখে তারা কিছু হতচকিত হয়ে পড়লেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু টিকতে না পেরে তারা কে বা কোথায় অন্ধকারের মধ্যে পালিয়ে গেল।
অনন্তর লোকটি তখন দেখতে পেলেন, আকাশজুড়ে কালপুরুষ জেগে উঠেছে। বৃশ্চিক রাশি অস্তগামী। আঁধখানা চাঁদ বিষণ্ণ চোখে ভূমিদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আর দূর থেকে একটা শীতল হাওয়া এসে জনশূন্য স্বর্ণপট্টির ভেতরে পাক খেয়ে খেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আর কেউ নাই। তিনি একা। এবং নিঃসঙ্গ।
অচিরাৎ এই নিঃসঙ্গতাকে ভেদ করে একটি কাতর কণ্ঠ উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি চমকে উঠলেন। সামনে পিছনে তাকালেন। তাকালেন বাঁয়ে আর ডানে। কাউকেই দেখতে পেলেন না। শুধু অন্ধকার থেকে তার কুকুরটি পা ঘষটে ঘষটে আরেক অন্ধকারের দিকে যাত্রা করছে। ভালো করে নজর করে বুঝতে পারলেন কুকুরটির একটি পা আহত। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে।
তার মর্মে হাহাকার জাগল। এই কুকুরটি ছাড়া এ জগতে তার কেউ নেই। সেই তার পিতা মাতা। সেই তার ভ্রাতা ভগ্নি। আহা ভুলু আহা ভুলু বলতে বলতে তিনি তার কাছে ছুটে গেলেন। ততক্ষণে আহত কুকুরটি নিকটস্থ অন্ধকার ঝোপের কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি ঝোপের কাছে এসে দেখতে পেলেন, ঝোপের আড়ালে একটি মনুষ্য দেহ পড়ে আছে। দেহটি নগ্ন। এবং নারীর। এবং মৃত।
সোমত্ত নারী দেহ তার অজানা। তবু নারী দেহ। তিনি স্বভাব বশে চোখ বুঝলেন। তখন তার মনে হলো দেহটি মৃত। মৃতের আবার নারী বা পুরুষ কী? মৃতের আবার লজ্জা শরম কী? তিনি চোখ খুললেন। ভুলু কুকুরটিকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু ভুলু কুকুরটি সেই মৃত দেহের গায়ে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে লাগল।
তিনি ডাকলেন, আয় ভুলু।
ভুলু আসবে না। কিন্তু সেখানে আর দাঁড়ানো যাবে না। কেউ দেখে ফেললে খবর আছে। হয়তো তাকেই অপরাধী ভেবে পুলিশে ধরিয়ে দেবে। তিনি ভুলুকে জোর করে নিতে যাবেন ঠিক তখনই দেখতে পেলেন, মৃত দেহটি নড়ে উঠেছে। আধস্ফূট স্বরে বলছে, না। না। না।
কেন যেন তিনি শুনলেন, মা। মা। মা।
শুনে তার চোখ জলপূর্ণ হলো। তিনি সহসা মাতৃস্নেহ বোধ করলেন। মেয়েটির দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, কাঁদে না। কাঁদে না সোনা।
অনাবৃত মেয়েটি তার হাতের মধ্যে মুখ লুকালো। সেই মুখের বাঁদিকে একটি রাঙা তিল আছে। তিনি দেখতে পেলেন।
৩.
আজ একটু দেরী করে ঘুম ভেঙেছে জ্ঞানদাসের। তিনি দ্রুত নিমের ডাল নিয়ে ছুটলেন নদীতে। অনেক ক্ষণ আগেই জোয়ার এসে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাটাগোন ফিরে আসবে। মাঝিরা পাড় থেকে নৌকাগুলো নদীর মাঝখানে সরিয়ে নিচ্ছে। একটা ফুল্ল হাওয়া এসে তার পাকা বাম জুলফি নাড়িয়ে দিল। আর তখনি দেখতে পেলেন, বুক সমান জলে নেমেছিলেন। এখন তা কোমর অব্দি এসে গেছে। ঘাটে কে একজন নারী হাটুর উপর কাপড় তুলে মাজন করছিল। তার উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলে উঠল, ওরে মিনসা, দেরি করতি করতি তো বেহান গেল। নাহান করবি কুন সময়? গতর ঠাণ্ডা হলি?
জ্ঞানদাস একটু লজ্জা পেয়ে ফস করে ডুব দিলেন। ডুব দিতে দিতে তার মনে হলো, নারীটির বাম চিবুকটা দেখা দরকার। ডুব সেরে উঠে তার দিকে তাকাবেন, কিন্তু নারীটি তার দিকে ইঙ্গিত করে আবার হেসে হেসে বলে উঠল, আধা মিনিটেই তাগদ শ্যাষ? মাইয়াঝুত তো তোরে ঠেঙ্গা মারবেয়ানে মিনসা।
নারীটি এবারে মুখের ভঙ্গিটি আরেকটু ব্যাঁকা করে বলল, রাইতের বেলায় আইসস পড়িস। তোর অঙ্গ আছে কিনা টেস্ট কইরা দেখবোয়ানে।
এই কথা শুনে আর তার মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না। তিনি ভেজা গায়েই উঠে পড়লেন। বাড়ির দিকে যেতে যেতে মনে হলো, নারীটির বাম চিবুকেও একটি তিল আছে। সেটি তিনি দেখেছেন। কখন দেখছেন সেটা মনে করতে পারছেন না। তবে তার মনে আছে, আজ অব্দি কোনো রমনীর মুখপানে তাকিয়ে দেখার সুযোগ নেননি।
ঘরে ফিরে জ্ঞানদাস দেখতে পেলেন, একটা পিঁড়ি পাতা আছে। সামনে ঝকঝকে কাঁসার থালায় গরম ভাত থেকে ধোয়া বেরচ্ছে। আর পরিপাটি করে তৈরি আছে ভর্তা। পাতের একপাশে একটু মাখন। আর দুটো কাঁচা মরিচ। একটু অবাক হলেন। তার ঘরে অন্য কেউ নেই।
দুপুরে রান্না করেন তিনি নিজেই । সেটাই তিনি খান। রাতে দুটো চিড়ামুড়ি। তাছাড়া ভোরে ঘরে আহার করেন না। স্বর্ণপট্টিতে যেতে যেতে বাগান থাকে দুটো ফল তুলে নেন।
এই ভোরে তাহলে তার জন্য খাবার কে রান্না করল? কেইবা তার জন্য বেড়ে দিল?
তিনি গায়ে চিমটি কাটলেন। না। তিনি জেগে আছেন। স্বপনে নেই। তাহলে? আবার তাকিয়ে দেখলেন। ভাতের থালা ঠিক ঠিক মতো আছে। থালার কাছাকাছি তিনটে পিঁপড়ে ঘোরাফেরা করছে।
অভ্যাস বশে তিনি গাছের কাছে গেলেন। দেখতে পেলেন ডালে ফল নয়, একটা বইয়ের পাতা লেগে আছে। তিনি সেটা তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন। দেখতে পেলেন সেখানে কোনো শায়ের লেখা আছে। কিন্তু তার অক্ষরগুলো বাংলায় নয়। লেখা আছে নাস্তালিক অক্ষরে।
এলাকার বিশিষ্ট ইমাম মাওলানা মোফাচ্ছের আলী খানের কাছে গেলেন। তিনি নাস্তালিক অক্ষর জানেন। তিনি কাগজটি পড়ে হাসলেন। বললেন, কী জানতে চান বাবু?
জ্ঞানদাস চিন্তিত মুখে বললেন, কী লেখা আছে?
খুব সুর করে পড়লেন ইমাম সাহেব। বললেন, এই শায়ের পারস্য দেশের গায়করা গেয়ে থাকেন। শুনে লোকজন কবিকে নজরানা দেয়।
"আগার আঁ তুর্কে শিরাজী,
বদাশ্ত রাদ দিল-এ- মারা
বখাল-এ হিন্দবশ বখশম
সমরখন্দ ব বুখারারা।"
এইটুকু শুনে জ্ঞানদাসের মনে আরাম হলো বটে। কিন্তু আনন্দ হলো না। আনন্দ না হলে প্রাণে শান্তি আসে না। এর তর্জমাটা শুনতে পারলে হতো।
ইমাম সাহেব রসিকজন। তিনি বললেন, বাবু, এই বয়াতটা রচনা করেছেন পারস্যের কবি হাফিজ। তার বয়াতটা প্রকাশ হলে পারস্য সম্রাট তৈমুর লংএর কানে গেল। তিনি তো রেগে আগুন। এই বেয়াদব কবিকে ধরে আনার জন্য তিনি হুকুম দিলেন।
কবিকে ধরে নয়-- বেঁধে আনা হলো। কবির বেশবাস মোটেই জুতসই নয়। গরীবী হাল। তার জন্যই রাজদরবার মলিন হয়ে আছে।
সম্রাট বললেন, ওহে কবি, আমি কষ্ট করে যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করি। তিল তিল করে নগর গড়ি আর তুমি আমার কষ্টে গড়া দুই দুটো নগরকে দান করে দিতে চাইছ সিরাজ নগরের এক সুন্দরীর তিলের জন্য? সাহস তো কম না! এগুলো কি তোমার বাপের?
সবাই ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল কবির বোধ হয় এবার গর্দান যাবে। আর রক্ষা নেই।
গরীব কবি কিন্তু ভয় পেলেন না। ঘাড়টা সোজা রেখেই বললেন, জাঁহাপনা, এরকম অপচয়কারী বলেই আমার এই বেহাল।
--বটে?
তারপর কী হলো সেটা না বলে ইমাম সাহেব দরাজগলায় খাস বাংলায় শোনালেন--
গালে কালো তিল সেই সুন্দরী
স্বহস্তে ছুঁলে হৃদয় আমার,
বোখারা তো ছার, সমরখন্দও
খুশি হয়ে তাকে দেব উপহার।
তর্জমাটি বলে ইমাম সাহেব চোখ বুঝে বললেন, বাবুজী, ইশক না হলে তো এর মাজেজা বোঝা যাবে না।
--ইশক?
--মোহাব্বত। পেয়ার। তার ইশকে আশেক হলে আপনি দেওয়ানা হবেন। দেওয়ানা হলেই তখন দুনিয়াভি তুচ্ছ মনে হবে। তার একটি তিলের জন্য সব কিছু বিলিয়ে দিতেও মন চাইবে। পারস্য তো পারস্য, নিজেকে তখন সারা দুনিয়াভির সম্রাট মনে হবে। বোখারা আর খোরাসান কোন ছার, ইশকের জন্য সারা দুনিয়াকেও বিলিয়ে দিতে কসুর হবে না।
-- কিন্তু কবির তো কিছুই নাই। তাইলে?
-- নাই বলেই তো তিনি মনে মনে সব কিছুর মালিক হতে পারেন। সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই দিলন না। কিছু থাকলে তো দেবেন? কিন্তু তিনি দিলেন খোরাসান। বোখারা। সবকিছু। দিলেন মনে মনে। এসব মনের খেলা। দিলের খেলা। ইশকের খেলা।
-- তাইলে মন চাইলে আমি যা খুশি তাই হতে পারি?
--আলবাৎ পারেন। আপনি আদেশ করবেন। আর তাই হয়ে যাবেন। যা গড়তে ইচ্ছে হবে তাই হয়ে যাবে।
--যাদুকরের মতোন?
-- যাদুকরের মতোন নয় বাবু। যাদুকরই। সবচেয়ে বড়ো যাদুকর। ঈশ্বর যাদুকর।
জ্ঞানদাস অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ঈশ্বর!!
ইমাম সাহেব তদগত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই বাবু। মানুষই ঈশ্বর। ঈশ্বরই মানুষ। কোনো ভেদ নেই। আনাল হক।
তিনি যাদু করেন বলে আমরা মানুষ হয়ে আছি। আমরা যাদু করি বলে তিনি ঈশ্বর হয়ে আছেন।
এবারে ইমাম সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন জ্ঞানদাসের দিকে। জ্ঞানদাস নিজের হাতের মধ্যে লুফে নিলেন এই হাত।
ইমাম সাহেব বললেন, কেমন বোধ করছেন?
--কোমল। জ্ঞানদাস উত্তর দিলেন, কোমল লাগছে আপনার হাত। সুকোমল।
হাসলেন ইমাম সাহেব। উঠতে উঠতে বললেন, আপনি কোমল চাইছেন বলেই আমার হাত এখন কোমল। কেউ যদি কোমল না চায়, তবে তার কাছে অকোমল।
এসব ইশক মোহাব্বত পেয়ার বা দেওয়ানা হওয়ার কোনো অবকাশ জ্ঞানদাসের জীবনে কখনো আসেনি। তিনি জানেন ব্লোয়ার দিয়ে সোনা বাঁকিয়ে নানা আকার দিতে। জানেন গয়না তৈরি করতে। কিন্তু নিজের হাতে কারো গায়ে গয়না পরান নি। সে রকম কেউ নেই।
তিনি কাগজে টুকে নিলেন হাফিজের বয়াতটি। বারবার তিনি তিল শব্দটির দিকে ফিরে ফিরে চাইছেন। মনে হলো শব্দটি আর অক্ষরের সমষ্টি নয়-- সত্যি সত্যি একটি তিলে পরিণত হয়ে গেছে। সেই তিলের উপরে এক ফোঁটা জল এসে পড়ল। জল পড়ল তার চোখ থেকে। এ জল তুর পাহাড়ের চেয়েও ভারী।
বাড়িতে ফিরে দেখতে পেলেন ভুলু কুকুরটি বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এ সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে না। দুজনে এক সঙ্গে খেয়ে শুয়ে পড়েন।
আজ খিচুড়ি রান্না করবেন ভেবেছিলেন। সেজন্য তিনি মুগডাল নিয়ে এসেছেন। রান্নাঘরে হাড়ি ভর্তি খিঁচুড়ি। কিছুক্ষণ আগে রান্না হয়েছে। পাকা সরিষার তেলের ঘ্রাণ আসছে। কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার অগোচরে কে রান্না করে রাখছে এটা নিয়ে ভেবে কোনো কুল কিনারা পেলেন না। কী করবেন বুঝতে পারার আগেই তার ভুলু কুকুরটি ঘুম থেকে উঠে এসে পায়ের কাছে কুঁই কুঁই করতে লাগল। তার খিদে লেগেছে। আজ সারাদিন ভুলু কিছু খাইনি মনে হলো। তিনি সাত পাঁচ না ভেবে ভুলুকে খিচুড়ি বেড়ে দিলেন। তার ভুভুক্ষের মতো খাওয়া দেখে বুঝতে পারলেন তার নিজেরও খুব খিদে লেগেছে। গরম গরম খিচুড়ি নিয়ে নিজেও খেতে লাগলেন। স্বাদে অপূর্ব। বহুদিন পরে আয়েশ করে খেলেন।
শুয়ে পড়ার পরে তিনি টের পেলেন রান্নাঘরে শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন হাড়ি থেকে খিচুড়ি থাকায় ঢালছে। বারান্দায় ভুলু কুকুর শুয়ে আছে। অজানা কেউ হলে সে হাঁক দিয়ে উঠত। কিন্তু তারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। মনে হলো কেউ যেন থালায় করে ভাত খাচ্ছে। জল খাওয়ারও শব্দ হলো। উঠি উঠি করে উঠলেন না। মনে হলো তিনি খোয়াব দেখছেন। তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। তলিয়ে যেতে যেতে তার মনে হলো, সেই যেন কে এক মেয়ে ভুলু কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘরে উঠে আসছে। আর তার গা থেকে নীলচে মৃদু আলো মাটিতে ঝরে ঝরে পড়ছে। ফুলের মতো ফুটে আছে সেই আলো। সেই ফুলের গন্ধ তিনি পাচ্ছেন। যেন জুঁই। জুঁই ফুল। না, বেলী ফুল। বেলু রানী। একটু হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে।
৪.
সুবেদ সাদেকের আগেই জ্ঞানদাস আবার ছুটে গেলেন ইমাম সাহেবের কাছে। সবে তিনি নামাজ শেষ করে উঠেছেন।
তিনি শুধালেন, তবিয়ত ভালো বাবু?
মাথা নাড়লেন জ্ঞানদাস, ভালো।
-- মন?
--অস্থির।
দূরের প্রান্তরের উপরে অস্থির মেঘ জমেছে। আজ বৃষ্টি হবে। ঘাসের মধ্যে বুনোফুলের কলি ফুটি ফুটি করছে। বৃষ্টি পেলে ঠিক ফুটে উঠবে। বললেন, এই মেঘ দেখেছিলেন পারস্য দেশের রুমি। রুমি বলেছিলেন, এই বৃষ্টি হলো ফুল ফোটার জন্য। বজ্রপাতের জন্য নয়।
তারপর কিছুক্ষণ মৌনী থেকে বললেন, বাবু, আপনার মনে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
-- ক্ষত? আঁতকে উঠলেন জ্ঞানদাস।
খুব কোমল করে তাকালেন তার দিকে। বললেন, ভয় পাবেন না। ক্ষতর মধ্যে দিয়ে দিয়েই ইশিকের রোশনী শরীরে ঢোকে। এই রোশনীর তেজেই আত্মা চলে। ক্ষত না থাকলে কি চলে!
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইমাম সাহেব শুধালেন, বয়স কত হলো আপনার বাবু?
-- ষাট।
-- শাদি করেছেন?
-- না। রায়টে বাবা মারা গেল। মা আত্মঘাতী হলো। ভাইবোন কেউ নাই। একা একা থাকি। শাদি করার চিন্তা আসে নাই কখনো।
এগুলো তিনি শুনলেন না। কয়েকটি এলাচদানা জ্ঞানদাসের হাতে দিলেন। আর কয়েকটি নিজের মুখে দিলেন। তারপর ভোরের মৃদু হাওয়ার মতো মৃদুমন্দ গলায় আবৃত্তি করলেন--
এ-জান খবারাত হাস্ত কে জানান-এ তো কিস্ত?
ভা-এ দিল খবারাত হাত কে মেহমান-এ তো কিস্ত?
এ-তান কে বে-হার হিলেহ রাহি মিজোই,
ও মিকেশাদ-আত বেবিন কে জোয়ান- এ তো কিস্ত?
'জানো কি, আত্মা,
তুমি আশেক যে কার?
জানো কি, হৃদয়,
তুমি মেহমান কার?
শরীর, মায়ার পথে
তুমি শুধু যাও;
দেখ, সে তোমাকে খোঁজে,
তাঁরই টানে ধাও।'
আবৃত্তি শেষ হলে ইমাম বললেন, ডেরায় ফিরে যান বাবু। বৃষ্টি আসবে।
এখন তিনি দীর্ঘ সফরে যাবেন। ফুলের কলিগুলো এড়িয়ে পা ফেলে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলেন।
চোখের সামনে থেকে ইমাম সাহেব অদৃশ্য হওয়ার পরে জোর বৃষ্টি এলো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তিনি হাঁটতে লাগলেন। তার মনে হলো, ইমাম সাহেবকে তিল নিয়ে একটি প্রশ্ন করার ছিল। সেটা করা হয়নি।
কিন্তু এই প্রশ্নটি তিনি ভুলে যেতে পারলেন না। বারবার তার মনে খোঁচা দিতে লাগল। এজন্য তার মাথা অসহ্য যন্ত্রণায় ফেটে যেতে লাগল। আর সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসে গেল। তিনি এপাশ ওপাশ করতে করতে তিল তিল বলে চিৎকার করতে লাগলেন। কিন্তু তার মুখে গো গো শব্দ ছাড়া আর কোনো হলো না। তিনি ঘেমে চেমে যেতে লাগলেন। মাঝে মধ্যে টের পেলেন কে যেন তার কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। সারা গা মুছিয়ে দিচ্ছে। চামচ দিয়ে হালকা তরল খাইয়ে দিচ্ছে। তার হাত সুকোমল। তার চুল এসে মুখের পরে পড়ে। মাঝে মাঝে চোখের ঝিলিক এসে পাপড়িতে লাগে। এরমধ্যেই তিনি তার চোখ খুলে এই মুখটিকে দেখতে চান। সেই মুখ মায়াময়ী। সেই মুখে কোনো তিল আছে কিনা দেখতে চান। কিন্তু চোখ খুলতে পারেন না। কিন্তু চোখ ফেটে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।
যখন তিনি চোখ খুলতে পারলেন, তখন সকাল গড়িয়ে গেছে। দুপুর হবে হবে করছে। বাইরে কয়েকটি পাখি ডাকছে। একটা শান্ত হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। তিনি সেই মায়াময় মুখ দেখতে পাবেন। এই জন্য মনে একটা দোলা জেগেছে। তিনি চোখ খুললেন অতি ধীরে ধীরে। ধীরে-- অতি ধীরে চোখ খুলে দেখতে পেলেন একটি মুখ। অতি চেনা। মায়া মাখা। সে মুখ বিষ্ণুবাবুর। বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী তিনি। অন্য কোনো মায়াময়ীর মুখ নয়। জ্ঞানদাসের মন মিইয়ে গেল। আবার চোখ বুঝলেন। আর খুলতে ইচ্ছে করছে না। হায়, মায়াবিনী। উচিত কি তব এই কাজ!!
বিষ্ণুবাবুর মুখটি হাসি হাসি করে উঠল। পকেট থেকে এক বোতল দিশি মদ বের করে ঢক করে গিললেন। ঢোক গিয়ে হাতের চেটোয় মুখ মুছলেন
বললেন, বাওয়া, তুমি যা দেখালে বাপ। তিনদিন ধরে কারখানায় তোমার পাত্তা নাই। খুঁজতে এসে দেখি তুমি চিৎপটা। কোনো মতে প্রাণটা ধুকেপুকু করতে লেগেছে। খাচা ছেড়ে যায় যায় অবস্থা। ভাগ্যিস মেয়েটা ছিল।
মেয়ের কথায় এবারে জ্ঞানদাস আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারল না। চোখ খুলে বিষ্ণুবাবুর হাসি হাসি মুখের দিকে চেয়ে শুধালেন, মেয়ে?
-- হু হু। মেয়ে। জলজ্যান্ত মেয়ে মানুষ। তারপর আরেক ঢোক গিয়ে হা হা করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন বিষ্ণুবাবু। বললেন, এই যে বাবুমশাই, মেয়ের কথায় একদম মৃত্যুশয্যা থেকে সটান উঠে বসলে। তোমার কৌমার্যগিরি আর পরমহংসগিরি সব ফক্কিবাজি হয়ে গেল বাপ!!
শুনে এই দুর্বল অবস্থায়ও বাদ সাধতে গেলেন জ্ঞানদাস। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিষ্ণুবাবু ঠোঁট চুকচুক করে বললেন, উহু, কোনো কথা হবে না। শোনো বাপধন, এসে দেখি তোমার বাড়ির দোর বন্ধ। তার মধ্যে দিয়ে একটা মিটমিটে আলো আসছে। সামান্য ঠেলা দিতেই খুলে গেল। দেখি, বিছানায় তুমি পড়ে আছ। কাছেই ভুলুবাবু মাখ ব্যাজার করে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে ল্যাজ নাড়ল। আর বিছানায় বসে বসে একটি জলজ্যান্ত মেয়ে বসে বসে তোমার সেবা করছে। আমাকে দেখে বলে উঠল, ওনার তিনদিন যাবৎ জ্বর। রতিকান্ত ডাক্তার মশাই এসেছিলেন। ওষুধ দিয়ে গেছেন। এখনো চেতন ফেরছে না। কী করি বলেন তো?
কাঁদতে লাগল ফুলে গুলে মুখে আঁচল গুঁজে। বুঝলি বাপা, ভেবেছিলাম একা মানুষ তুমি। হয়তো আজ রিপুর ফেরে বলে কাউরে ধরে টরে আনছ। মেয়ে মানুষ তো কম দেখলাম না। কিন্তু মেয়েটার কান্না দেখে বুঝলাম, এ কোনো মাল টাল নয়। সতি সাধ্বী মেয়ে। মেয়ে কেনো-- বৌ মানুষ। একে নিয়ে ফাইজলামো চলে না।
ফলে দেরি না করে সোজা রতিকান্ত ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এলাম। তিনি তোমার নাড়ি টেপেন। গাল টানেন। চোখ দেখেন। বলেন, আশা নাই। দিন শ্যাষ। অষুধ দিয়ে কাম নাই।
শুনে ভেতর থেকে মেয়েটি হায় হায় কেঁদে ওঠে। বলে, দোহাই ডাক্তারবাবু, যে করেই হোক ওনাকে বাঁচান লাগবে।
ডাক্তারবাবু ভেতর ঘরের দিকে তাকালেন তাকে দেখার জন্য। কিন্তু সে আড়ালেই রইল। লাজলজ্জা আছে। পরপুরুষের সামনে আসে না।
ডাক্তার বললেন, তাইলে আমি ওষুধ দিচ্ছি। চেষ্টা করে দেখো। আর উপরওলাকে ডাকো। কাজ হলে হবে। নইলে কিন্তু আমার দোষ নিও না জননী।
সেই থেকে সে আছে। রাত্রি দিন তোমার পাশে থেকে এই ওষুধ খাওয়ায় তো, মাথায় জলপট্টি। আবার ছুটে গিয়ে পথ্য বানিয়ে আনে। চামচে করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এই যাত্রায় তার কারণে বেঁচে গেলে হে বাপা। তোমার সাত জন্মের পূণ্যির ফল।
শুনে জ্ঞানদাসের চোখ জলপূর্ণ হয়। বলতে যায়, আহা, কই সে মেয়ে? জিহবা থেকে এই স্বর ফোটার আগেই বিষ্ণবাবু আবার বোতলটি বের করেন। আরেক ঢোক গিয়ে বলেন,, আ হা হা, তাকে বললাম, মা জননী, অনেক কষ্ট করেছ। এখন আমি দেখছি। তুমি যাও। নদী থেকে ডুব দিয়ে আসো। চাট্টি মুখে দাও। তারপর ঘুমিয়ে নাও। আছি আমি।
কখন, কোন সময় স্নানে গেছে, সেখান থেকে ফিরেছে কিনা, চাট্টি কী খেয়েছে, কোথায় ঘুমিয়েছে এসব প্রশ্ন করতে যাওয়ার আগে বিষ্ণুবাবুর মাথা এলিয়ে গেছে। জড়ানো গলায় বলছেন, যেতে কি চায় মেয়ে। তবু পাঠালাম। ঘর থেকে লালপেড়ে শাড়ি আর ঝালকাঠির গামছা নিয়ে হেঁটে হেঁটে গেল। একবার পিছন ফিরে বলল, দাদাগো, হাড়িতে ঝাউ রাখা আছে। ঝিনুকে করে খাইয়ে দিয়েন। এর মধ্যে আমি এসে কাঁচা কলা দিয়ে দীঘা ধানের ভার রেঁধে দেবো।
মেয়েটি হেঁটে হেঁটে গেল। আর উঠোন ভরে তার পায়ের চিহ্ন পড়ে রইল। বুঝলি, পদ্ম পাপড়ির মতো সেই পা। এই পায়ের নিচেই কৃষ্ণ কি কানহাইয়া বুক পেতে দিতে চেয়েছিল। বলেছিল, দেহি পল্লবমুদারম।
অচিরাৎ বিষ্ণুবাবু নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। তার নাসিকা গর্জন হতে লাগল।
৫.
ধীরেন বাবুর মাথার চুল কমে গেছে। তাতে সারাক্ষণ মগজ কিলবিল করে। ঘুমও ঠিক মতো হয় না। কিছুদিন ধরে ঘৃতকুমারীর জেলি তালুতে মাখছেন। তাতে মাঝে মাঝে সর্দি লাগলেও ঘুম আসতে চায় না।
তিনি একদা খাটরা বার্তা নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন। তাতে অত্র এলাকার সংবাদাদি প্রকাশ করতেন। যেমন গরু ছাগলের হাটে বিক্রিবাটা সুবিধাজনক নয়। গোসাইর খালে কচুড়িপানার বিস্তার। মশা মাছির উৎপাত। সঙ্গে ভেষজ উদ্ভিদের পরিচয়ও দিতেন। থানকুনির উপকারিতা। গুলঞ্চ লতার কাজ। কিছু পদ্যও থাকত। তবু তিনি লিখতেন পছন্দ করতেন আখ্যান।
তার একটি ছাপাখানা ছিল। নাম আদর্শ ছাপাখানা। নিজেই টাইপ করতেন পাইকা অক্ষর দিয়ে। এলাকার মানুষজন পেপার পত্রিকা বিশেষ জানত না। তিনি শুরুতে ফ্রি বিতরণ করতেন। যারা পড়তে পারত না তাদেরকে তিনি পড়ে শোনাতেন। ইচ্ছে ছিল লোকের নেশা ধরলে তিনি দাম ধরবেন। কিন্তু সেটা হচ্ছিল না দেখে একটি রমরমা কাহিনী লিখতে শুরু করেছিলেন। লিখেছিলেন, লঞ্চঘাটে হোটেল ব্যবসার আড়ালে মধুমক্ষিকার আগমন।
এই খবরটি প্রকাশ হওয়ার পরে, স্থানীয় কালীবাড়ির বিশিষ্ট ব্যক্তি মধুসূদন মিত্র বাবু তার কলার চেপে ধরেছিলেন। রাগে গজগজ তোঁতলাতে তোঁতলাতে বলেছিলেন, আমি বেশ্যা বাড়ি যাই? বেশ্যাদের সঙ্গে রাত কাটাই?
তখন হরেকেষ্ট সা তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সব সত্যি লিখতে নেই। ওনার টাকা আছে-- উনি বেশ্যা বাড়ি যেতেই পারেন। তাতে আপনার কী?
এরপর খাটরাবার্তা আর প্রকাশ করেননি। তার স্ত্রী পায়ে পড়ে বলেছিলেন, এইসব ছাপা করলে তিনি গলায় দড়ি দেবেন।
স্ত্রীকে তিনি বড়ো ভয় খান। বেচারীর বাপের টাকায়ই এই ছাপাখাবা কিনেছিলেন। এ ঘটনার পর তিনদিনের মাথায় শালা সম্বন্ধিরা এসে নৌকায় করে ছাপাখানি তুলে নিয়ে গেল।
তিনি কিছুদিন গোজ হয়ে থাকলেন। কিছুদিন আগানবাগান দিয়ে ঘুরে বেড়ালেন। কিছুদিন বড়শি পেতে মাছও ধরলেন। তারপর কী মনে হতে তাদের বাড়ির আড়ার উপরে উঠলেন। সেখানে একটা পুরনো কাঠের বাক্স আছে। কেউ কোনোকালে তা খোলেনি।
(ক্রমশ)
(ক্রমশ)
2 মন্তব্যসমূহ
একটা মাস্টারপিস হতে চলেছে। সাধু সাধু...
উত্তরমুছুনপড়লাম। অসম্ভব ভালোলাগা। আপনার লেখার আমি রীতিমত ভক্ত। অনেকদিন ধরে পড়ছি। এটা আজ পড়লাম। অপেক্ষা রইল পরের পর্বের।
উত্তরমুছুনঝর্না বিশ্বাস