পুরুষোত্তম সিংহ
সোহারাব হোসেনের গল্প নিয়ে লিখতে বসে এ শিরোনাম কখনই সমীচীন নয়। কেননা একটি সমাজের, শ্রেণির মানুষ হিসাবে তিনি নিজেকে ভাবেননি। আমারই নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – গল্প উপন্যাসে এ বিভাজনে আমি বিশ্বাস করি না, গল্প উপন্যাসে আসলে লেখা হয় মানুষের কথা। সেই বিশ্বাস থেকেই লিখেছিলেন –“আমি প্রচলিত ধর্মমতে বিশ্বাস করি না ।.. লেখালেখির জগতে জীবন অনেক বড়ো, সেখানে অনেক দায়বদ্ধতা থাকে মানুষের জন্যে, সমাজের জন্যে কিছু করার।“ যদিও তাঁর গল্পের মুসলিম জনমানসই আমরা এ লেখায় অনুসন্ধান করব তাই এমন নামকরণ।
সোহারাব হোসেন (১৯৬৬ ) এসেছেন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটের অজ পাড়াগাঁ থেকে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। সোহারাবের মৃত্যু বাংলা ছোটোগল্পের জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। গল্প জীবনের প্রথম থেকেই তিনি নিজস্ব একটি ঘরানা তৈরি করে নিয়েছিলেন। নয়ের দশকে তিনি গল্প জীবনে প্রবেশ করেন। গল্পরচনার এক সহজাত জীবনতুলি নিয়েই তিনি এসেছিলেন। ফলে তাঁর গল্পগুলি এক অন্য জগতে আমাদের নিয়ে যায়। সময়ের রূপ থেকে রূপান্তর, লোকায়ত জীবন, রূপকথা –উপকথা, জাদুবাস্তব, পণ্যায়ন ও ভোগবাদ সমস্ত মিলিয়ে তিনি একটি এমন গল্পবলয় তৈরি করেন যেখানে তিন আজও একক। সোহারাবের প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পীকে পেতে বাংলা ছোটোগল্পকে আর কতদিন অপেক্ষা করতে তা আমাদের জানা নেই ! আমরা অনেক গুলি গল্পগ্রন্থ তাঁর হাত থেকে পেয়েছি – ‘দোজখের ফেরেশতা’ ( ১৯৯৬ ), ‘বায়ু তরঙ্গের বাজনা’ (২০০২), ‘আয়না যুদ্ধ’ (২০০৫ ), ‘আমার সময় আমার গল্প’ ( ২০০৮ ), ‘সুখ সন্ধানে যাও’ (২০০৯ ), ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ (২০১০ ), ‘নির্বাচিত গল্প’ (২০১১ ) ও ‘ভেজা তুলোর নৌকা’ ( ২০১৭ )।গল্পে প্রবেশের আগে তাঁর গল্প সম্পর্কিত ধারণা পাঠকের কাছে স্পষ্ট করা প্রয়োজন –
সোহারাব হোসেন (১৯৬৬ ) এসেছেন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটের অজ পাড়াগাঁ থেকে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। সোহারাবের মৃত্যু বাংলা ছোটোগল্পের জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। গল্প জীবনের প্রথম থেকেই তিনি নিজস্ব একটি ঘরানা তৈরি করে নিয়েছিলেন। নয়ের দশকে তিনি গল্প জীবনে প্রবেশ করেন। গল্পরচনার এক সহজাত জীবনতুলি নিয়েই তিনি এসেছিলেন। ফলে তাঁর গল্পগুলি এক অন্য জগতে আমাদের নিয়ে যায়। সময়ের রূপ থেকে রূপান্তর, লোকায়ত জীবন, রূপকথা –উপকথা, জাদুবাস্তব, পণ্যায়ন ও ভোগবাদ সমস্ত মিলিয়ে তিনি একটি এমন গল্পবলয় তৈরি করেন যেখানে তিন আজও একক। সোহারাবের প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পীকে পেতে বাংলা ছোটোগল্পকে আর কতদিন অপেক্ষা করতে তা আমাদের জানা নেই ! আমরা অনেক গুলি গল্পগ্রন্থ তাঁর হাত থেকে পেয়েছি – ‘দোজখের ফেরেশতা’ ( ১৯৯৬ ), ‘বায়ু তরঙ্গের বাজনা’ (২০০২), ‘আয়না যুদ্ধ’ (২০০৫ ), ‘আমার সময় আমার গল্প’ ( ২০০৮ ), ‘সুখ সন্ধানে যাও’ (২০০৯ ), ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ (২০১০ ), ‘নির্বাচিত গল্প’ (২০১১ ) ও ‘ভেজা তুলোর নৌকা’ ( ২০১৭ )।গল্পে প্রবেশের আগে তাঁর গল্প সম্পর্কিত ধারণা পাঠকের কাছে স্পষ্ট করা প্রয়োজন –
“বিষয়কে শিল্পে রূপান্তরিত করার কাজে আমি যে গল্প –প্রকরণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধকরি তা মূলত দেশজ-লোকজ ঘরানা। গল্প-প্রকরণে আমি মান্য প্রচল রূপবন্ধনের থেকেও বেশিবেশি করে গুরত্ব দিই আমার দেশের লোকজ ধারাটিকেই। সেখানে তাই রূপকথা, উপকথা,ইতিকথা, ছড়া- ধাঁধা –প্রবাদ-প্রবচনের কোলাজজাত অভিঘাত, কথকথা,বৃত্তান্তধর্মিতা আর দেশীয় ‘টেল’ –এর রীতিটির সঙ্গে অধুনান্তিক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্পৃক্তিকরণ ঘটছে। বৃত্তান্তে –বৃত্তান্তে কিংবা কথকথার কাহিনিতে-কাহিনিতে যে ইন্টার –লক্ড্ ফর্ম তাকে আশ্রয় করেই আমি গল্পকে শিল্প করার সিঁড়ি বলে ভেবে নিয়েছি। এই সিঁড়িতে চড়েই আমার সময়ের সমস্ত অভিমুখ, সমস্ত প্রান্ত, সব মাত্রা, তার ধ্বংস ও গঠনশীলতা এবং বিশ্বাস ও স্ববিরোধকে নিয়ে আমি সাহিত্যের কালান্তক প্রান্তরে জরুরি চেষ্টা করি। যেতে পারি কিনা জানিনা!” (ভূমিকা, আমার সময় আমার গল্প, পুনশ্চ, প্রথম প্রকাশ ২০০৮ )
‘দোজখের ফেরশতা’ সোহারাব হোসেনের অন্যতম গল্প। কথক ও সাহেবালিকে কেন্দ্র করে এ গল্প উঠেছে। দরিদ্র সাহেবালি একদিন কথকের কাছে দেড় টাকা নিয়েছিল সামান্য গুড় কেনার জন্য। সাহেবালি বলিষ্ঠ পুরুষ হলেও এখন কর্ম ক্ষমতা হারিয়েছে, ফলে আর কেউ কাজে নেয় না। মোশারাফ দর্জির দোকানে কথক মাস্টারের সঙ্গে সাহেবালির বহু কথা হয়েছিল। মোশারফের সেলাই মেশিনে সাহেবালি জীবন যুদ্ধের চাকা ঘুরতে দেখেছিল। সে বেহেস্তো ও দোজোকের খবর দিতে পারে। সে কিছুদিন কবর খোড়ার কাজও করেছিল। কিন্তু সব মৃত্যুতেই সে দোজোকের গন্ধ পায়। ফলে আজ আর কেউ তাঁকে কবর খোড়ার জন্য ডাকে না। অভাবের জন্য স্ত্রীও চলে গেছে। কথক বহুদিন সাহেবালিকে দেখেনি, ফলে একদিন নিজেই গেছে সাহেবালির বাড়িতে। সেখানে শুনেছে তাঁর করুণ পরিণতির কথা। আজ সাহেবালি নিজের শরীর থেকেই দোজোকের গন্ধ পায়। কিন্তু সে গন্ধ পায় না কথক। আজ কথক সাহেবালিকে কিছু টাকা দিতে চাইলেও নেয় না। কেননা স্ত্রী চলে যাওয়ায় সে আরও উদাসীন হয়ে গেছে। তাঁর ভাবনা কীভাবে বেহেস্তে স্থান পাওয়া যাবে, টাকা দিয়ে তো বেহেস্তে স্থান পাওয়া যায় না, তাই আজ সে টাকা নিতে অস্বীকার করে।
এক অদ্ভুত চরিত্র সাহেবালি। আর তাঁকে আরও অদ্ভুত করে তুলেছেন লেখক এক অনবদ্য পরিবেশে। সোহারাব হোসেন এক দর্শনকে সামনে রেখেই গল্পের প্লট গড়ে তোলেন। সস্তা সাদামাঠা কাহিনির উৎসব তাঁর গল্প নয়। মানবজীবনে সবারই নরক বা বেহেস্তের ভয় থাকে। গল্পের প্রেক্ষাপট যেহেতু মুসলিম জীবন তাই বেহেস্তের ভয় বলা হয়েছে। আর সে ভয় থেকে বাদ যায়নি সাহেবালিও। পরলৌকিক জীবন সম্পর্কে যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসকে সামনে রেখেই গল্পের বিবর্তন রেখাটি গড়ে উঠেছে। আসলে এই গল্পের মত বহু গল্পকেই নির্দিষ্ট মুসলিম জীবনের গল্প বলে লেবেল সেটে দেওয়া যায় না। এখানে গল্প নদীর ঢেউয়ের মত সমতলে গড়িয়ে যায় নি। লেখক একটি নির্দিষ্ট দর্শনে পৌঁছতে চান বা কিছু বলতে চান, আর তা গড়ে তুলতে চরিত্রগুলিকে সাজিয়ে একটি প্লট রচনা করেন। আর লেখকের অভিজ্ঞতা যেহেতু মুসলিম জীবন সম্পর্কে প্রবল তাই চরিত্রগুলি মুসলিম হয়ে ওঠে। লেখকের মনে হয়েছে এই সাহেবালি ঈশ্বর প্রেরিত ফেরেশতা, কিন্তু সাহেবালি তা অস্বীকার করেছে। অতিকথন নেই, তিনটি পরিচ্ছেদে এক নিটোল গল্প রূপায়ন করেছেন লেখক। কখনও আত্মকথনে গিয়েছেন –
“দীর্ঘকাল মাস্টারি করার অভিজ্ঞতার নিরিখে এতদিন দাবি করতুম যে, মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। এখন দেখছি আমার এই দাবি কুব একটা জমাট ভিতের উপর দাঁড়িয়ে নেই। অন্তত সাহেবালির ক্ষেত্রে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ এই কথা অবনত মস্তকে মেনে নিতে কোনো দ্বিধা নেই। বস্তুত সাহেবালিকে এখন যত দেখছি ততই আমি বিস্মিত হচ্ছি। এমনকী মনের মধ্যে এই চিন্তা বিশ্বাসের মতো প্রবেশ করেছে যে, সাহেবালি এই মর –জগতেএর কেউ নয়। স্বর্গীয় ঈশ্বর্য ও পরিবেশের কোনো বিশেষ কাজে ঈশ্বর তাকে নররূপে মর্ত্যে পাঠিয়েছেন – এমন ভাবনায় এখন আমি সাহেবালির প্রতি খানিকটা শ্রদ্ধাশীলও ।“ (শ্রেষ্ঠ গল্প, করুণা, প্রথম প্রকাশ ২০১০, পৃ. ৩৭ )
‘ছায়া প্রলম্বিত’ গল্পে রাকাছতুল্লার চেতন অবচেতন স্তরের মধ্য দিয়ে লেখক বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গার পরিস্তিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নিজস্ব দর্শন থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। দাঙ্গা হিন্দু বা মুসলিম বাধায় না, দাঙ্গা বাধায় কিছু দাঙ্গাবাজ মানুষ। তবে এইসব মানুষরা সাধারণ মানুষের মনে দাঙ্গার চেতনা সঞ্চার করে দেয়। প্রায় কিছু মানুষের মধ্যে ধর্মান্ধ চেতনা আছে তবে তা প্রকাশ পায় না প্রতিকূল পরিবেশের জন্য , কিন্তু মনে মনে তা লালন করে চলে, নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রস্তুত রাখে। রাকাছতুল্লা গ্রামে দাঙ্গা নেই, কিন্তু দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে এক ভয় মনে মনে কাজ করেছে। রাকাছতুল্লা আজ ফসল পাহাড়ায় গেলেও কিছুতেই ঘুম আসে না, চেতনে –অবচেতনে দাঙ্গার প্রেক্ষাপট ও পরিণতির চিত্র ভেসে ওঠে। দূর গ্রামে চিৎকার শুনে মনে হয় সন্তান আব্দুর রহিমও কি দাঙ্গা সৃষ্টি করতে গেল নাকি ! প্রতিটি মানুষই বাঁচতে চায়, বাঁচার স্বপ্ন দেখে এবং বাঁচার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে। তাই আজ রাকাছতুল্লাও বাঁচার জন্য ধারালো অস্ত নিজের কাছে রেখেছে। যে রাকাছতুল্লা বলেছিল –“হিন্দু –মোছলমানের আজীবন একসাথে বাস। মিটমাট করে নে সব। দাঙ্গাবেটি রক্তখাগি। মানুষখাগি। ঝ্যাঁটা মেরে পার কর। “ (তদেব, পৃ. ১৪ ) – এই মানুষই আজ মানুষকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছে। আর সে প্রতিদ্বন্দ্বী হল নিজেরই ছায়া। আসলে এক সুপ্ত দাঙ্গার চেতনা মনে মনে সঞ্চার হয়ে গেছে। সেই বোধ থেকে সমস্ত বিধর্মী মানুষকেই শত্রু বলে মনে হয়েছে। রাতের অন্ধকারে রাকাছতুল্লা নিজের ছায়াকে হিন্দু মানুষ ভেবে আক্রমন করতে গিয়ে নিজের ধারালো অস্তে ধান খেতে নিজেই পরে গিয়ে তল পেটে বিদ্ধ হয়েছে। এই মৃত্যুর ঘটনাকে সামনে রেখেই লেখক সোহারাব হোসেন এক বোধে উপনীত করেন পাঠককে। দাঙ্গার পরিবেশ নেই, তবুও যেন দাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। সকালে যখন রাকাছতুল্লার সন্তান বা প্রতিবেশী এই দৃশ্য দেখবে তখনই হয়ত আরও দাঙ্গা সৃষ্টি হতে চলবে। প্রকৃত সত্য কীভাবে মিথ্যার আড়ালে চাপা পড়ে যায়, আর সেই মিথ্যাকে কেন্দ্র করেই কীভাবে মরণ রহস্যের ফাঁদ সৃষ্টি হয় তাই দেখিয়ে দেন লেখক।
‘বোবাযুদ্ধ’ গল্পে আমরা পাই বালক তরিকুলকে। আসলে গরিব মানুষকে বেঁচে থাকতে যুদ্ধ করতে হয় এই পৃথিবীতে। সে যুদ্ধ শ্রেণির সঙ্গে, খাদ্যের সঙ্গে, টিকে থাকার সঙ্গে। মেম্বারের কল্যাণে তরিকুলের কিছু পাউরুটি জুটত। এই মেম্বারের মৃত্যুতে সে বোবা হয়ে যায়। আসলে এই মৃত্যুই যেন তাঁর খাদ্যকে কেড়ে নেয়। তরিকুল বাজারে থাকে, সবার ফরমাইশ মত কাজ করে , ফলে কিছু খেতে পায় । কিন্তু যে তারিকুল অনবরত কথা বলত সে আজ বোবা হয়ে গেছে। এক মৃত্যু ও খাদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া এই তার কারণ। মৃত্যুর অনুসন্ধানে সে গেছে, গাছে ঝোলা বাদুরদের দেখেছে কিন্তু কোন সত্যে পৌঁছাতে পারেনি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে, কিন্তু তিনদিনেই ছেড়ে দিয়েছে। আজ আবার বাজারে ফিরেছে তরিকুল। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে চায়ের গ্লাস ভেঙে ফেলে বালক রবি ঘোষ। ফলে দুজনকেই প্রহার করে মালিক। আজ তরিকুলের প্রতিবাদী সত্তা জেগে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে সে ও রবি মাটির উনুন ভেঙে দিয়েছে। তরিকুলরা এই নশ্বর প্রজন্মের সন্তান, তাই তাঁর সঙ্গে তুলনা হতে পারে না রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ বা শরৎচন্দ্রের কোন চরিত্রের। আসলে তরিকুলদের আজ লড়াই ক্ষুধার সঙ্গে। এ সময়ে, এ সমাজে চুরি হচ্ছে, সরকারের বরাদ্দ অর্থ থেকে জনগনকে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে তবুও তরিকুলদের বাঁচতে হবে সামান্য ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেই। এই সুপ্ত চৈতন্য বালকের জাগরণ ঘটিয়ে দিয়েছেন লেখক। এ পৃথিবীতে কেউ কার নয়, নিজের পথ নিজেকেই করে নিতে হবে, ভালোবাসার দাম কেউ দেবে না, সেখানে বোবা মানুষের অভিমানের কোন মূল্য নেই। ফলে তরিকুল ও রবি ঘোষ আজ প্রতিবাদের নিশান হাতে উঠিয়ে নিয়েছে। সোহারাব হোসেন সময় সমাজ সত্যের কথাকার। তাঁর গল্পে বাস্তব রূপান্তরিত হয় অতিবাস্তবে বা পরাবাস্তবে। কিন্তু সেখান থেকেও তিনি কৌশলে নির্মম বাস্তবের মুখোমুখি পাঠকে দাঁড় করিয়ে দেন। আসলে প্রতিটি লেখকের একটি নিজস্ব কৌশল থাকে, যে পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তিনি গল্পের সত্যে পাঠককে পৌঁছে দিতে চান। সোহারাব হোসেনও নিজস্ব পথেই গল্পের সত্যে আমাদের পৌঁছে দেন।
‘আকাল যাযাবর’ গল্পে আমরা পাই ফরিদকে। এ গল্পে লেখক এক মুসলিম কসাইয়ের আশ্চর্য পশুপ্রীতির নিদর্শন স্থাপন করেছেন। বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসে পশুপ্রীতির নিদর্শন আমরা বহু পেয়েছি। তবে এত গল্পের পরও সোহারাব পশুপ্রীতির গল্প লিখতে গেলেন কেন নতুন করে ? আসলে সোহারবের গল্প ট্রিটমেন্টের দিক থেকে আলাদা। আর গল্পের মধ্যে জড়িয়ে আছে একটি সমাজের লোকাচার ও বিশ্বাস। ফরিদ কসাইয়ের কাজ করে, তবে তাঁর বাড়িতে বহু কুকুর ও পায়রা আছে, এদের সঙ্গে ফরিদের নিবিড় সখ্য। কসাইখানার ছাট মাংস সে যেমন কুকুরের জন্য আনে তেমনি এই পশুদের সঙ্গেই সে সারা রাত কাটায়। জিনাত হাজি এক সময় তাঁর সহযোগী ছিল কিন্তু হজ থেকে ফিরে জিনাতের সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ ফরিদের বিরুদ্ধে প্রধান অভোযোগ তাঁর শরীরে কুকুর ও পায়রার গন্ধ বলে কেউ মাংসা কিনতে চায় না। এই অভিযোগে ফরিদের সব কসাইখানার কাজ বাতিল হয়ে যায়। আজ সত্তর বছর বয়স্ক এই মানুষের আয় নেই বলে স্ত্রী সহ পুত্ররা অভিযোগ এনেছে। এ গল্পে সোহারাব দেখান অথনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা কী করে কমে যায়। স্ত্রী খায়রোনও ঠিক করে খেতে দেয় না, সবাই বলেছে এই পশুদের বিদায় দিতে, কিন্তু সে লক্ষ্যে অবিচল। আজ সে পশুদের জানায় –“তোয়ের থাক,, তোয়ের থাক সপ। আকাল এসতেছে !” অভিমানে সে আজ পশুদের ওপর আঘাত এনেছে। কিন্তু আবার পশুদের সঙ্গেই আনন্দ নিকতনে মেতে উঠেছে। আজ ফরিদ অন্য গ্রামে কসাইখানায় কাজ নিয়েছে। রাতের অন্ধকারে পশুদের নিয়ে যাযাবরের মত যাত্রা করেছে। তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেনি, শুধুমাত্র পরিস্তিতির সঙ্গে লড়াই করে গেছে –
“কুকুরগুলো এখন আস্তানার বাইরে। ফরিদ এবার পায়রার ঝাঁকে আঘাত করে। তারা এলোমেলো উড়ে আবার পূর্ব জায়গায় গিয়ে বসে। ব্যাপার দেখে ফরিদ একটু হেসে ফেলে –‘বুইছি, এমোন নিশ্চিন্দির সুক ছেড়ে যাতি চাচ্ছিস নে। কিন্তুক এই বুড়োডারে একলা পাঠানে কি ভালো হ্যারা ? চল । ঘর ছাড় ।
তারপর সেই অলৌকিক রাতে এক অতিকায় বৃদ্ধের পাশেপাশে, উপরে –নীচে কাফেলা করে এক দঙ্গল জীবজন্তু পাখ-পাখালির ঝাঁক ঘরে ছেড়ে পথে নামে। যাযাবরের মতন। (তদেব, পৃ. ৬৪ )
এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পাড়ি দেয় ফরিদ ও তাঁর দলবল। এ যাত্রার শেষ আছে কি না অথবা যাত্রা শেষে কোন স্থায়ী সুখের সন্ধান আছে কি না তা আমাদের জানা নেই। তবে সিদ্ধহস্ত গল্পরস বলতে আমরা যা বুঝি তা সম্পূর্ণ পাই এ গল্পে। আসলে তিনি গড়তে জানেন। আর যিনি নির্মাণ করতে জানেন তিনি যে অতি সহজ বিষয়কেও এক অনলসভঙ্গীতে উত্তীর্ণ করে দেবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি দায়বদ্ধ সময়ের প্রতি, সমাজের প্রতি। তাই এক শুভবোধ নিয়েই তিনি গল্প আসরে নামেন। মানুষের কুচেতনা ও নঞর্থক দিকগুলিকে ধ্বংস করে দিয়ে মানবতার এক নব আকাশে তিনি তাঁর চরিত্রকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। তাই সমালোচক মানস মজুমদার লেখেন –“তিনি দায়বদ্ধ শিল্পী! সামাজিক মঙ্গল কল্যাণ ও শুভবোধে তাঁর আস্থা। নিছক বিনোদনসর্বস্ব গল্প তিনি লেখেন না। ব্যবসাদার লেখক নন। সাহিত্যের আসরে শৌখিন মজদুরী করতে আসেন নি। সোহারাব ঘুমপাড়ানি গল্পকার নন, ঘুমতাড়ানি গল্পকার ।“ (সময়ের গল্প দুঃসময়ের গল্প, তদেব, পৃ. ৫)
‘আকাল যাযাবর’ গল্পে ফরিদ দলবল নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল আর ‘হরিয়াল হরিয়াল’ গল্পে সন্তানের দূরে চলে যাওয়ায় ইয়ার আলি নিজের প্রিয় ঘুঘু পাখিকে উড়িয়ে দিয়েছে। ফরিদ পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে হার মেনেছে আর ইয়ার আলি হার মেনেছে নিজের বিশ্বাসের কাছে। ফরিদের আছে আনন্দ তবে ইয়ার আলি বিষাদ গ্রস্থ। সন্তানের প্রতি কোন মায়া নেই ফরিদের কিন্তু সন্তান বাৎসল্যই ইয়ার আলিকে উদাসীন করে দিয়েছে। ‘হরিয়াল হরিয়াল’ গল্পে ইয়ার আলি পাখি বিক্রেতা। তাঁর একটি শিকারি ঘুঘু আছে যা হরিয়াল নামে পরিচিত। বাজারে পাখি বিক্রি করতে গিয়ে অনেক সময় ক্রেতার হাতাহাতিতে পাখি উড়ে যায় তখন এই ঘুঘু ছেড়ে দেয় ইয়ার আলি। এই ঘুঘুই ফিরিয়ে নিয়ে আসে অন্য পাখিদের। সে মাঠ থেকে পাখি ধরে বাজারে বিক্রি করে, তবে বর্তমানে পাখি ধরা নিষেধ, তবুও সে বিক্রি করে যায়। এই পাখি বিক্রি করা তাঁর তিন পুরুষের ব্যবসা তাই এ সম্পর্কে নানা গপ্পকথা আছে, যা সে বলে স্ত্রী মারুফাকে। তাঁর বড় সন্তান রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে, এ নিয়ে স্ত্রী চিন্তিত কিন্তু ইয়ার আলি জানায় এ ক্ষেত্রেও সে হরিয়ালের রীতি ব্যবহার করবে। হরিয়াল হিসাবে নিয়োগ করতে চেয়েছে ছোটো ছেলেকে। এই ছোটো ছেলেই ফিরিয়ে নিয়ে আসবে বড় ছেলেক। আজ ইয়ার আলি পাখি পায়নি, পাখি বন্যপ্রাণী বলে কিছু মানুষ উড়িয়ে দিতে বলেছে । বাড়ি ফিরে শোনে ছেলে খুনের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে পালিয়েছে, বাড়ি ফিরে এসেছে ছোটো ছেলে। এই দুঃখে সে নিজের প্রিয় হরিয়ালকেও উড়িয়ে দেয় –“তারপর দরজটা খুলে দেয়। হরিয়ালটাকে বাইরে আনে। আকাশে উড়িয়ে দেয়। পাখিটা উড়ে যায়। অন্ধকারের মধ্যে। তার ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে সে শব্দ মিলিয়ে যায়। চাপ-চাপ নৈঃশব্দ্য নামে। তারপর সেই শব্দহীন রাত্রি এক সময় ফালা –ফালা হয়ে যায়। ডুকরে-ডুকরে কাঁদছে ইয়ার।“ (তদেব, পৃ. ১৭৭ )
সোহারাব হোসেন এক দেশজ রীতিতেই গল্পের কাহিনি সন্নিবেশ করেন। ফলে তাঁর গল্পে রূপকথা, লোককথা বারবার ফিরে আসে। কিন্তু সেখান থেকেই তিনি গল্পের সত্যে বা বাস্তব সত্যে উপনীত হন। গল্পের ভিতরে এক গপ্প শোনাতে শোনাতেই তিনি কাহিনের ধ্রুব সত্যে পাঠককে পৌঁছে দেন। গল্পে এক মায়াজাল রচনা করে পাঠককে এক প্রান্ত সীমায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। আসলে প্রত্যেক লেখকেরই নিজস্ব একটি লেখার উপনিবেশ রয়েছে। সোহারাব হোসেন তাঁর গল্পের অন্তিমে পাঠককে ভাবার অবকাশ দেন না। তিনি পাঠককে এক বোধে এনে দেন, যেখানে পাঠক পায় এক মুক্ত আকাশ।
বিপন্ন সময় ও বিপন্ন মানুষরাই সোহারাব হোসেনের গল্প উপন্যাসের ভিত্তিভূমি। উচ্চবিত্তের আলগা প্রেম রোমান্স নিয়ে তিনি গল্পে প্রবেশ করেন না, আর করলেও জীবনের গভীর সত্যে পৌঁছে যান যেখানে এক বা একাধিক সমস্যা আমরা উপস্থিত হতে দেখি, যেগুলি সময়ের সমস্যা। ‘নূরবক্সের গাঁজাগাছ ও একটি প্রজাপতির গল্প’ এক দরিদ্র মুসলিম ও তাঁর পরিবারের জীবন সংগ্রাম ও টিকে থাকার গল্প। এ বাংলার গ্রাম প্রান্তরে বহু মানুষ ক্ষুধার্ত, যাঁরা আইনকে ঠিক মানে না। যেখানে ক্ষুধাই শেষ সত্য সেখানে আইনের চোখ রাঙানির মূল্য কতটুকু ! আর সোহারাব নিজেও গ্রামে বড় হওয়া মানুষ বলে মানুষের সমস্যাগুলি প্রবল ভাবে ধরেছেন। এ গল্পে নূরবক্সের তিনটি গাঁজাগাছ আছে। এই তিনটি গাঁজাগাছ নিয়েই নূরবক্সের স্বপ্ন। কেননা এই গাঁজার দাম বহু, আর তা দিয়েই তাঁর সংসারের হাল ফিরতে পারে। কিন্তু গাঁজা গাছ রাখা যে সরকারি ভাবে বেআইনি তা ধরা দেয় না নটেখালির নূরবক্সের চোখে। স্ত্রী সইফাতারা সহ পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর সাত জনের সংসার। আজ সংসারের অভাব ঘোঁচাতে সে রঙের কাজ করে, আজ সঙ্গে নিয়েছে বড় ছেলে হেলাতালিকে। মালিক হেলাতালির জন্য অতিরিক্ত পয়সা দেয় না, তবে দুপুরের খাবার দেয়, এটাই নূরবক্সের প্রাপ্য। সে ভালো বাঁশি বাজাতে পারে, মহুয়া পালার কাহিনি শুনাতে পারে, আর সন্তান হল শ্রোতা। বলে কাজের সময় গল্প থামাতে হয় –“নূরবক্সের গল্প থেমে যায়। যতবার সে তার দুঃখের সংসার ছাড়িয়ে কোনো এক অজানা দেশের মহুয়া সুন্দরীর রূপে নিজেকে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, ততবার ছেলে হেলাতালি যেন বিরুদ্ধতা করে এভাবে। তাই গল্প থামিয়ে নূরবক্স কাজে মন বসায়। তখন দু’বাপ-বেটায় চলে রঙের কাজে। তুলি টানা, সারা মন দিয়ে। সমস্ত চোখ দিয়ে। “ (তদেব, পৃ. ৭২)
আজ কাজে মালিককে তাঁরা সন্তুষ্ট করেছে। শ্রমের আনন্দ নিয়েই বাড়ি ফিরছে পিতা-পুত্র। ক্ষুধার তৃপ্তিতে মনে এসেছে রোমান্স। সোহারাব হোসেনের গল্পে শ্রেণিচরিত্র হিসাবে মুসলিম এলেও তিনি একটি বক্তব্যে পোঁছাতে চান। আসলে একটি বক্তব্য বা সময় বা প্রান্তিক ঘটনা, মানুষ ও তাদের সমস্যা নিয়ে তিনি গল্প লেখেন। সেখানে হিন্দু-মুসলিমের পৃথক কোন ভেদ নেই। এই বিপন্নতা হিন্দুর জীবনে যেমন সত্য তেমনি মুসলিমের জীবনেও সত্য। আমরা শুধু মুসলিম জীবন নির্ভর গল্পগুলিকে বেঁছে নিয়েছি।
দুই প্রতিবন্ধী মানুষকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘অ্যাক্ট’ গল্পটি। এ গল্প সম্পর্কে মানস মজুমদার লিখেছেন –“অ্যাক্ট’ গল্পটি অসাধারণ। বাংলা সাহিত্যে এর কোনও দোসর নেই।“ দুটি অসহায় মানুষের যন্ত্রণাকে সামনে রেখে সোহারাব এ বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের কার্যকলাপকে নিদারুণ ব্যঙ্গ করেছেন। কোন শ্রেণির রাজনীতিতে সোহারবের বিশ্বাস নেই। জনজীবনে রাজনীতি মানুষকে কীভাবে শোষিত করে লেখকের দৃষ্টি সেদিকে। এ গল্পে রয়েছে রহমতালি ও পুটে নামে দুই প্রতিবন্ধী মানুষ। রাজনৈতিক দল এই দুই প্রতিবন্ধী মানুষকে ব্যবহার করেছে জনসভায় মানুষের আনন্দ বিতরণে। রহমাত এক অসহায় মানুষ, বহু কষ্ট করে সে বিবাহ করেছিল কিন্তু আজ স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছে নইজুদ্দির। সে আজ ব্যথিত, ফলে জনসভায় কোন অভিনয়ে অংশ নেয় না। কিন্তু নেতার কথা রাখতে তাঁকে অভিনয়ে অংশ নিতেই হয়, আর আজ সে অভিনয় করে বিরোধী নেতার স্ত্রী কীভাবে অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছি। নিজের চোখের অশ্রু গোপন করে আজ মানুষকে হাসিয়ে গেছে রহমতালি ও পেটু।
এই যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষেরাই সোহারবের নায়ক। এই সব ভাঙাচোরা, দূর্বল মানুষকে নিয়েই সোহারাব গল্পভুবনে প্রবেশ করেন। সোহারবের কোনো গল্পই নিছক বিনোদন সর্বস্ব গল্প নয়, গল্পের ভিতরের সত্যকে আবিষ্কার করেন, গল্পকে শিল্পের সীমানায় নিয়ে যান। কেননা গল্পে তিনি নিছক গপ্প বলতে চান না, এক গভীর বোধ থেকে গল্পের ভিতরে প্রবেশ করেন। তাই কখনও বলেন –“নিছক মজা কিংবা বিনোদন সর্বস্ব, ব্যাওসা-মুখ্য, লেখালিখির পথটাকে চোরাবালি বলেই মানি। ও পথের সাহিত্যকে, তা যতোই জনমনোরঞ্জক এবং জনপ্রিয় হোক –না –ক্যানো, আমি শিল্প বলে মনে করিনে।“ (আমার সময় আমার গল্প, তদেব )
গ্রাম্য জীবনের কোন্দল, ভাতৃ বিচ্ছেদ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘বরাভয়’ গল্পটি। গ্রামীণ মানুষের স্বার্থপরতা, কুবুদ্ধি যে কত নীচ হতে পারে তা এ গল্পে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন সোহারাব। আসলে গ্রামীণ জীবনের একরাশ অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি গল্পজীবনে প্রবেশ করেছিলেন, ফলে গ্রামীণ জীবন ও মুসলিম জীবন নিয়ে লেখা গল্পগুলি তাঁর হাতে চমৎকার ভাবে ফুটে ওঠে। নটেখালির দুই ভাই ফজের আলি জোহর আলি। দুজনেই ইঁটভাটায় কাজ করে কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলে না। বিবাহের পরেই এই বিচ্ছেদ প্রবল হয়েছে। নটেখালির মন্ত্রী জালাউদ্দিন এ সময় এসেছে গ্রামে। মন্ত্রী যখন গ্রামে আসে তখন যাঁর মুখ প্রথম দর্শন করে সে যা চাইবে তাই পায়। এবার প্রথম মুখ দেখেছে ফজর ও জোহর আলির। কিন্তু দুজনেই বাড়িতে ফিরলে একে অপরের সর্বনাশ সাধনে মেতে ওঠে। দুজনেরই ইচ্ছা এই সুযোগ থেকে ভাই যেন বঞ্চিত হয়। গ্রামীণ মানুষ কত বোকা, নীচ, কুবুদ্ধি সম্পন্ন তা লেখক দেখান। অপরের সর্বনাশ সাধনে প্রবৃত্ত হয়ে নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনেন । অদ্ভুত নাটকীয় বিন্যাসে লেখক গল্পের উপসংহারে পৌঁছেছেন -
“তেমাথা নীরব। সভাস্থল নীরব। কী চাইবে ফজের ? সবার কান তার দিকে। ফজের এগিয়ে আসে। মানুষ কৌতূহলী হয়। এবং সব্বাইকে অবাক করে দিয়ে ফজের জানায় তার প্রার্থনা –‘আমার এক্টাই চাবা মুনতিরি ভাই ! জোহর আলি যা চাবে তা যেন না পায়।“
..... ..... ...... ...... ....... ......
“ফজেরের কথায় যেন বাজ পড়ে সভাস্থলে। বাজ পড়ে জোহরের মাথায়। সেই চাওয়ায় মন্ত্রীও যেন স্তব্ধ হয়ে যান। অবধারিত ভাবেই তাঁর দৃষ্টি জোহর আলির মুখের উপরে পড়ে। সমস্ত পরিমণ্ডলে তৈরি হয়েছে রহস্য। এবার জোহর ওঠে। মুখে –চোখে তার ভয়ঙ্কর বিষাক্ত ছায়া। সে চিৎকার করে বলে –‘আমিও তাই চাই মুনতিরি ভাই। ও শত্তুর যেদি ভবিষ্যতে কোনো দিন তোমার সামনে পড়ে, তবে যা চাবে তা যেন না পায়।“ ( আয়না যুদ্ধ, পৃ. ২৮৬ )
সোহরবের হোসেনের সামগ্রিক গল্পের প্রেক্ষিতে মুসলিম জীবন নিয়ে লেখা গল্পের সংখ্যা নিছকই কম। আসলে তিনি হিন্দু –মুসলিম শ্রেণি বিভাজনে বিশ্বাসী নন, তেমনি গল্প উপন্যাসে এক শ্রেণির জীবন তুলে ধরার পক্ষপাতীও নন। সে বোধ থেকেই প্রথম গল্পসংকলন ‘দোজখের ফেরশতা’র উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন –‘পশ্চিমবঙ্গের, ভারতের, পৃথিবীর দাঙ্গাবিরোধী মানুষকে’। গল্পে তিনি নিয়ে এসেছিলেন এক বিশেষ প্রকরণ, বক্তব্যরীতি ও আখ্যান। আর আঞ্চলিক জনজীবন চিত্রণে বসিরহাটের বাগরি অঞ্চলের মানুষদের। সেই জীবন চিত্রণেই মুসলিম জীবন এসেছে। তবে মুসলিম অন্তঃপুরে না গিয়ে তিনি সময়ের চিত্রণে, মিথের ভেলায় মানুষের উত্তরণে, জাদুবাস্তবতায় বৃহত্তর সময় ও সমাজের কাহিনি লিপিবদ্ধ করে যান।
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ লিখেছেন স্যার।পড়ে মুগ্ধ হলাম।সমৃদ্ধও হয়েছি।ধন্যবাদ স্যার।
উত্তরমুছুন