ভূমিকা : মৌসুমী কাদেরের গল্প

দীপেন ভট্টাচার্য

আমরা কেন গল্প পড়ি? আমার কাছে গল্প পড়ার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে বিশ্বকে অন্য একটি প্রেক্ষাপটে, আর একটি বিন্দু থেকে দেখা। অন্য একটি জগতের কল্পনা করা যা কিনা আমার মনোজগতকে ঋদ্ধ করে।
এর মধ্যে কি বিনোদন নেই? অবশ্যই আছে। মহৎ গল্প বিনোদনের মাত্রাটি নিয়েই মহৎ। এটি মৌসুমী কাদেরের প্রথম ছোট গল্পের বই। প্রবাসী এই মানুষটির গদ্য শিল্পের সঙ্গে অনেকেই এখনো পরিচিত নন, কিন্তু আমার বিশ্বাস তাঁকে বাংলা পড়ুয়ারা একজন বলিষ্ঠ লেখক হিসেবে চিনবেন। গল্প লেখাকে সহজভাবে নেননি তিনি, এজন্য অপেক্ষা করেছেন, নিজের জন্য নির্মাণ করতে চেয়েছেন গল্প, পাঠকের জন্য নিরীক্ষা করেছেন, নতুন পথ বাছতে চেয়েছেন। গল্প পড়া একটি আর্ট, পৃথিবীর সবকিছুর মত সেই আর্টকে করায়ত্ত করার মধ্যেই পাঠকের কৃতিত্ব। আমার বিশ্বাস সিরিয়াস পাঠককে তিনি আশাহত করবেন না, তাঁদের মনোজগতে গল্পগুলি নতুন প্রেক্ষাপট, নতুন বিন্দু গড়বে।

মৌসুমী কাদের কানাডা থাকেন। তাঁর গল্পে কানাডার কথা থাকবে তাই স্বাভাবিক, প্রবাস জীবনের টানাপোড়েনের কাহিনী বলতে তিনি স্বচ্ছন্দ, স্বচ্ছন্দ কানাডার তুষারাবৃত পথে চলতে, আবার স্বচ্ছন্দ বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের পরিবেশের সূক্ষ্ণ উপস্থাপনায়। কিন্তু তিনি যেখানেই থাকুন না কেন তাঁর গল্পে ফুটে উঠেছে নারীর স্বাতন্ত্র্যবোধ ও অস্তিত্বের মূল্যের কথা। লিখছেন বাংলাদেশের গ্রাম্য রাজনীতির ঘেরা টোপে সরল শ্রমজীবী মমতাজের কথা। সেই কথা বাস্তব কারণ তা লেখক দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ‘মমতাজ’ গল্পে বলছেন মমতাজের কথা, চিংড়ির পোনা ধরে মমতাজ দক্ষিণ বঙ্গের এক নদীতে – 

“পোনার আরেক নাম ঘনা। বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ বছর ঘনা ধরা শুরু হয়েছে। এটা চলবে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত। পূর্নিমার চাঁদের আলোয় দল বেঁধে সব মায়েরা গাদা গাদা পোলাপানের দঙ্গল নিয়ে পোনা ধরতে যায়। মমতাজ বেগমও তাদের সঙ্গে দূর দূরান্তে পাড়ি জমায়। সারারাত ধরে খালে বিলে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। তবে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঘনার সংখ্যা কমতে থাকে। তখন আর মেয়েরা এ কাজে যেতে চায়না। এ বছর গরম পড়েছে অনেক। পোলাপানের জ্বালায় রাতে ঘুম হয়না মমতাজের। তার উপর কোন কোন দিন ভোর না ভাঙতেই অথবা রাত থাকতেই ছুটতে হয় ঘনা ধরতে। এই আষাঢ়ে জলাশয়গুলো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাই মাছ ধরার ফূর্তিটাই আলাদা। আজ খুব ভোরে পদ্মফুল আর কচুরিপানার ভিড়ে কোমর পানি ভাঙতে ভাঙতে পোনা ধরছিল সে। তাদের দলে জমে গেছে অনেক লোক। এত লোকের ভীড় দেখে পোনারা দৌড়ে পালাচ্ছে। জালে তারা বন্দি হবে কি!”

ধীরে ধীরে আমরা জড়িয়ে পড়ি মমতাজের জীবন সংগ্রামে, তাঁর শিক্ষিত হবার স্বপ্নে, গ্রামের তরুণ যুবকদের সাথে কাজে, চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিতণ্ডায়। মৌসুমীর কুশলী কলমে অনেক ভুলে যাওয়া কাহিনী মূর্ত হয়ে ওঠে।

“মমতাজ ভ্যান এর পেছনে উঠে বসে পা ঝুলিয়ে বড় সুখ পায়। কতটা পথ হাঁটতে হলো না। ভ্যানতো না যেন পঙ্খীরাজ। হাওয়ার উড়ে ভেসে যাচ্ছে সে। বাজারে বিজলী বাতি এলেও এখনও তার পরিধি ততটা বিস্তৃত হয় নি। চারদিকে অন্ধকার, গাছের ফাঁকে ফাঁকে হারিকেনের আলো ঝিকমিক করে জ্বলে উঠছে। আকাশজুড়ে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া, যেন কতকাল ধরে হুক্কো টেনে চলছে গ্রামবাসী। মোটা লাল চাল আর পাটশলা পোড়া ঘ্রাণ। ভাতের খিদায় পেট চনমন করতে থাকে মমতাজের। বাড়ি গিয়ে নিশ্চয়ই দেখবে জরীটা ঘুমিয়ে গেছে। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে পড়ে।”

গাছের ফাঁকে ফাঁকে হারিকেনের আলোয় মুহূর্তে সেই রাতের গ্রাম আমাদের কাছে মূর্ত হয়ে ওঠে। এরপর অন্য গল্পে গ্রামবাংলা থেকে মমতাজ যেন প্রবাসে এসেছে, তার সংগ্রাম ফুরোয়নি। গৃহবধু, চাকুরি জীবী, স্ত্রী, মা সব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লেখক বুঝতে চাইছেন শেষাবধি নিজের সত্তা।

মৌসুমী কাদের লেখায় একধরণের রহস্যের অবতারণা করছেন, ‘ৎ’ আর ‘যা নেই তা আছে’র মত গল্পের শেষে পাঠককে দ্বন্দ্বের মধ্যে রাখছেন। আবার অন্য গল্পে তিনি নদীর স্রোতের মত ভেসে যান, সেই স্রোতে পাঠকের মনের মধ্যে ভেসে যায় জীবনদর্শন, পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চান অস্তিত্বের গূঢ় দ্বন্দ্ব।

প্রথম ধারার লেখায় পাঠক ধরেই নিতে পারেন লেখক তাকে নিয়ে খেলছেন, পাঠক বুঝতে চাইছেন গল্পটির যবনিকা হল কিনা, উত্তরের বদলে প্রশ্ন নিয়ে ফিরে আসছেন। দ্বিতীয় ধারাতেও পাঠককে চ্যালেঞ্জ করছেন, তবে সেখানে রয়েছে মনস্তাত্বিক সংশয়। আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে এমন নারীকে জিজ্ঞেস করছেন-

“আপনি বলছেন, এই মেয়ে, মরার আগে তারকভস্কির ‘স্টকার’টা আরেকবার দেখে নিলে হোত না! তুমি ওকে ভালোবাস।” (তেলাপোকা)

কিন্তু সেই নারী এখন সবকিছুর উর্ধে। সেই নারী বাঁচতে চেয়েছে, কিন্তু তার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে পুরুষ ‘ইতিবৃত্তে’, ‘নিমপাতা’য়, ‘স্যুটকেসে’। আবার ‘তেলাপোকা’য়, ‘আমায় লাবণ্য দাও’ গল্পগুলোতে ব্যবহার করেছেন যাকে আমরা বলি stream of consciousness, নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন সেই চেতনার ফল্গুধারায়, আমাদের মনে হচ্ছে লেখকের অন্তরস্থলকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমি বলি সেই লেখাই সার্থক যা কিনা আন্তরিক, খাঁটি, যেখানে লেখক নিজের কাছে সত্য দাবি করেন। বর্তমানের অন্যতম মার্কিন গল্পকার জর্জ স্যান্ডার্সের মতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মস্তিষ্কের যে অংশটা আমরা ব্যবহার করি না, সেটাই আবার লেখার সময় প্রাধান্য পায়। তিনি বলছেন, অনেক সময় অবচেতন মন অনেক সময় সচেতন মনের চাইতে দ্রুত যৌক্তিকভাবে কাজ করে, সেটাই লেখার টেবিলে আসে। মৌসুমী কাদেরের গল্পে এই সক্রিয় অবচেতনকে পাঠক আবিষ্কার করবেন প্রতিনিয়ত, তাঁর লেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে যে গভীর আন্তরিকতা তা উপলব্ধি করবেন।

সেই সত্যতার তন্তু ধরে বাংলার গ্রামের হারিকেনের আলো থেকে পৌঁছে যাই টরন্টোর কোনো পানশালায় যেখানে বাংলারই ট্র্যাজেডি আবার অভিনীত হয় অন্য মাত্রায়। করবীদির কাহিনী শুনি স্তব্ধ হয়ে যাই ‘আইরিশ পাবে’। কিন্তু লেখক অতৃপ্ত, বলছেন,

“সত্যেরা আটকে পড়েছে দেয়ালে, খুঁজে পাচ্ছেনা পথ... আমি আমার অনুভূতির জায়গায় প্রবল সৎ হতে চাই, আর বলতে চাই যে, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস আর আস্থার যে ছায়া গায়ে মেখেছি, তার কোনটা মিথ্যে ভান নয়। তুমি বিশ্বাস করো, অনুভূতিগুলোকে ধূলোয় মিশে যেতে দিও না।” (আমায় লাবণ্য দাও)

এই স্বীকারোক্তি পাঠকের কাছে, এটি যেন পাঠকের উদ্দেশ্য নিক্ষিপ্ত এক চ্যালেঞ্জ। পড়া শেষে একটা কিছু শাশ্বত থেকে যায়, প্লটের উর্ধে, ঘটনার মার প্যাঁচের, চমকপ্রদ যবনিকার বাইরে। মৌসুমী'র গল্প থেকে সেই নির্যাস পাঠক নিয়ে যাবেন এই আমার বিশ্বাস।

‘আমায় লাবণ্য দাও’ গল্পে লেখক এক জায়গায় লিখেছেন, “আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই একদিন এরকম একটি বই ছাপা হবে আমার। সেই মুখবন্ধ লিখবেন এমনকি কেউ আছেন? জানি না।”

জীবন আর্টকে নকল করে, কত বছর আগে লেখক এটি লিখেছেন জানি না, তবে মুখবন্ধটি লিখতে গিয়ে এই বাক্যটি দেখে চমকিত হয়েছি, চমৎকৃত হয়েছি, আত্মশ্লাঘাও হয়েছে। তাঁর জীবনের সঙ্গে কোনো সমাপতনও পাঠক হয়তো গল্পগুলোতে খুঁজে পাবেন। সেই সমাপতনের অভিলাষ জানিয়ে, চেতনার স্রোতধারায় অভিষিক্ত হবার জন্য পাঠককে মৌসুমী কাদের এর লেখা পড়তে আহ্বান জানাচ্ছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ