হেলাল মহিদীনের গল্পঃ সে যদি জীবিত হয়...

মানবের এফোঁড় ওফোঁড় দীর্ঘশ্বাসও এঁকে ফেললে, ওমর আলী? হাহাকারও আঁকা যায় তাহলে?

তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম ওমর আলী। ঘুমঘুম রোদের মাঝে জেগে ওঠা একটি চর। বালুচর। তার কিনারে একটি প্রান্তর। জনমানবহীন বাতাসের শীষ আর বালুর আগুন ছাড়া তোমার আর কোনো প্রতিবেশি নেই। তুমি ব্যস্তসমস্ত আছো খুব নিচু একটি ছাপরার সামনে। একটি গাছের নীচে। খেজুর পাতা, নারকেল পাতা আর সুপারি পাতায় ছাওয়া ছাপরাটি। কারো কবর কি? ঘর? নাকি নিজেরই কবর তৈরি করেছো? কোনো একসময় তোমার মৃত্যু হয়েছিল কি? নিজেকে আরেকবার নিজের ছাঁচে গড়েপিটে নেবার জন্য বালু ফুঁড়ে উঠে এসে বসো নি তো?

আমি তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই প্রথম তোমার সাথে দেখা ‘সেই বিবিক্ত’ প্রান্তরে। তুমি বসে ছিলে কাঠফাটা রোদে শুকনো মাটির ওপরে। নিজের দেহ ছিঁড়ে খাচ্ছিলে শেয়াল কুকুর শকুন যেমন খায়। তোমাকে শুধালাম,নিজেকে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত করছ তুমি কেন এবং নিজেকে কেন খাচ্ছ বেকুব? তুমি বললে “নিজেকে খেতে স্বাদ লাগছে খুব।”

কেন, ওমর আলী? তুমি বললে—‘পারো’? বললাম, কী? ‘একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে?’ আরো বললে ‘সে আকৃতি, অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙিতে, পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’ কেন? আমি বললাম শুনে। তুমি বললে,“আমি সেটা পোড়াবো আগুনে”।

তোমাকে পিছু ছেড়ে আসছিলাম, ওমর আলী। হঠাত আকাশ ছাই মাখিয়ে ফেলল নিজের মুখে। দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে ঝড় ওঠালো লু হাওয়া। ভাবলাম ঝড় না থামা তক তোমার ছাপরার নিচে মাথাটি গুঁজে রাখা দরকার। কিন্তু অ্যাতোটা নিচু ছাপরা কেন? এটা কি কারো কবর? নাকি নিজের জন্যই আগ বাড়িয়ে কবর সাজিয়ে রেখেছো।? তোমাকে দেখলাম ধারালো কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে ফেলছো ওপরে। বললাম,‘মাটি খুঁড়ে কি করবে,কারো জন্য কবর বানাবে, কিংবা লুকানো কোনো ঐশ্বর্য তুমি খুঁজে পাবে?’ তুমি বললে, “মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ চাই, কবরে লুকিয়ে থেকে বেঁচে থাকবো,এজন্যই কবর বানাই।”

মনে হল তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিই বেঁচে কী হবে? বলো তো কতকাল কতো শতবর্ষ বসে আছো এই জমিনে—এই প্রাগৈতিহাসিক ছাপরার সামনে? তুমি বুঝি অনন্তকালই একা? ঘোর দুপুর তোমাকে পুড়বে, পোড়াবে। বরং তোমাকে জবরদস্তি সংগেই নিয়ে যাই। ইচ্ছে হলো বলি—ঝড় কখনো থামবে না। চলো আমার সঙ্গে ফিরবে। সর্বজ্ঞ তুমি। আমার মনের কথাটি পাঠ করে নিয়েছিলে চকিতেই। তাই তো মৃদূ হাসলে। কাছে বসিয়ে বললে—ঝড় হয় হোক। শোনো, কবিতার একটি পংক্তি শোনাই তোমাকে। আমার জন্য লিখেছেন নরেশ গুহ। বন্ধু আমার। লিখেছেন, “যদি তার এত কাল পর মনে হয়—দেরি হোক যায়নি সময়”।

ঝড় থামল। আমিও ফিরতির পথে নেমে পড়েছিলাম। তারপর কেটে গেছে বহু বছর; অনেক সময়। একবার পেরুতে হচ্ছিল একটি পরিত্যক্ত বন। প্রাণহীন, জনমানবহীন। শ্বাপদেরও অপছন্দ যে্রকম বন। সেদিনও চুল্লি জ্বালিয়ে রেখেছিল ঘোর দুপুর। দেখলাম তুমি বসে আছ দূরে। একটি গাছের নীচে। যত্ন সহকারে কি যেন দেখছ হাত দুটো নেড়ে বারে বারে। পরণে ছিন্নবেশ, এলোমেলো দীর্ঘ চুল বিশুষ্ক মাথায়। অস্থির পুরুষ এক মনে হলো, আমাকে দেখেই ইশারায় ডাকলে নিজের কাছে আদেশের মতো। নিকটে গেলাম আমি, দেখলাম, তুমি পরীক্ষারত। মৃত মানুষের সাদা হাত, পা, মাথার হাড় নিয়ে, সবুজ ঘাসের পরে রাখলে সাজিয়ে। বললে, “কবরে শুয়ে ছিল এই রূপবতী নারী, সে যদি জীবিত হয় আমি তাকে ফিরে পেতে পারি”। মানবীখন্ডাংশ জোড়া দিতে নামা ওমর আলী, তোমার প্রতীক্ষাবিধি মগজে ঝড়ের অনুরণন তুংগ করে দিয়েছে—“সে যদি জীবিত হয় আমি তাকে ফিরে পেতে পারি”।

কিন্তু তুমিও পারলে না ওমর আলী! তুমিও রয়ে গেলে আর দশজন কবির মতই! যে কংকাল, হাড়, হাত, পা, খুলি ও করোটি জুড়তে জুড়তে জপছ ‘সে যদি জীবিত হয়’ তুমি যাকে ফিরে পেতে পারো, সেওতো আসলে অনন্যা কেউ নয়!

- আসসালামু আলাইকুম। জনাবের নাম?

ওমর আলীকে ছায়া দিতে থাকা গাছটি ঝুপ করে ঘাড়ের ওপর ভেঙ্গে পড়ল যেন বা! মূহুর্তে ঘোর কেটে গেল মহিদীনের। দাঁড়াতে দাঁড়াতে অসহায় কাতরানি বেরুলো—“স্যার, স্যরি, স্যার...”

- না না না! ঠিইইক আছে। ডুইব্যা আছেন ভাবদরিয়ায়! ভাবদরিয়ায় নাও নাচাইলি রেএএ বন্ধু...

- স্যার, স্যরি, স্যার

- কইবেন্নি কিতা পড়াইতাছিলাম, কিতা কইতাছিলাম?

- খেয়াপারের তরুণী...মজা করে বলছিলেন...

- হুম! তরুণী আছে নাহ! এইডা না হুইন্যা কি পারা যায়! একদম হুইন্যা মোছলমান...

- স্যরি...

- নিলাম, খাতাডা নিলাম! না জানি আমার বিরূদ্ধে কিতা কিতা ল্যাকলেন খাতায়...

ফজলুল হক স্যার। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা পড়ান। ছোটখাটো মানুষ। বয়স্থ নারীর মত গলার স্বর। স্বরে ভাংতি-ভাংগনও বাড়তিই আছে। কান পেতে শুনতে হয় কী বলছেন না বলছেন। বয়স? রিটায়ারমেন্টের বয়সও যেন পেরিয়ে গেছে বছর দশেক আগেই। তবু রসিকতা করার কী আপ্রাণ চেষটাই না করে যান স্যার।! ইণ্টারের ছাত্ররা হোহো করে হাসে। হাসলে উনি খুশি হবেন তাই হাসে। কী রগড়-রসিকতা করেন না করেন তার আগামাথা ছিরিছাদনা থাকলেই কি, না থাকলেই কি! ‘খেয়ারপারের তরুণী’ বলে ঠোঁটে হাসি আনলেন, চশমার উপর দিয়ে ক্লাসের ছাত্রদের দিকে তাকালেন। এসবের একটিই অর্থ হয়—নির্দেশ দিয়েছি ‘হাসো’। ইন্টারের ছাত্ররা এ-ওর গায়ে ঠেকা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে হাসে।

এই সেকশনটি আর্টস নিয়ে পড়ুয়া ছাত্রদের জন্য। স্যার শুরুর দিনই বলেছিলেন—“আন্নেরা তো কলার ছাত্র। কলার খোসা। সাইন্সের ভাইয়ারা তো ট্যাহাপইসা ঘরবাড়ি সুন্দরী নারী সাইরা গাড়ি হাকাইবো, আন্নেরা কীয়ার্বেন? প্যাম-ভালবাসার কাবিতা-টাবিতা ল্যাকবেন; যাত্রা-নাইট্যফাইট্য কইরবেন, নাটুক্যা অইবেন, নাউট্যা, নাউট্যা, অইবেন নাউট্যা! তো নাউট্যাই যদি অইবেন, সাহিত্য জিনিষটারে প্যামিকার মত কলিজার ভিতর খাঁচা বানাইয়া আটকাইয়া রাখবেন। ঠিক আছে? আর মন খুইল্যাটুইল্যা হাসবেন।” ইন্টারের ছাত্ররা ধরে নিয়েছে ক্লাসে উনি হাস্যকর রসিকতা করবেন। সকলে হাহাহাহিহিহোহো করবে। নইলে স্যারের সংগে অবিনয় হবে; স্যারকে অসম্মান করা হবে। ক্লাস তো নয়, যেন একটা সার্কাস!

মহিদীনের ক্লাসনোট-খাতা ফজলুল হক স্যারের কব্জায়। ভারি চশমা খাতার ওপর পড়েপড়ে অবস্থা। চোখ বড়বড় ডালের বড়া যেন বা।! সদ্য পড়তে শেখা শিশুর ভংগিতে তিনি শব্দের গায়ে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে পড়ে চলছেন—‘মানবের এফোঁড় ওফোঁড় দীর্ঘশ্বাসও এঁকে ফেললে, ওমর আলী? হাহাকারও আঁকা যায় তা’হলে? হাহাহাহাহা! কইছিলাম না নাউট্যা! ওরে ওরে নাউট্যারে… ইতান কিতা ল্যাকছেন বুঝান ত দেহি! হাহাহাহাহা!

পুরো ক্লাসজুড়ে হাহাহাহাহিহিহি কোরাস। ফজলুল হক স্যারের হাহাহাহার অর্থ—হাসেন না ক্যান? হাসেন।! জোরসে হাসেন! স্যার রগড় করেন—জনাব, বুঝান, এইডা কিতা? প্যামপত্ত নি? লাভ-লেটার?

— না স্যার, ওমর আলীর কবিতার...

— কার কবিতা?

— ওমর আলীর।

— হেই মিয়া আবার ক্যাডা?

— কবি।

— কী কন? কবি, আমি নাম জানিনা! ও আইচ্ছা আইচ্ছা, নাম হুনছি নাম হুনছি! বইডা দ্যান...

— বই সঙ্গে নাই, স্যার। পাবলিক লাইব্রেরির বই। গিয়ে পড়ি।

ফজলুল হক স্যার সিরিয়াস এবার। কেন কে জানে।! হাস্যকর রসিকতার চেষটা বাদ দিলেন মুহুর্তের জন্য। সিরিয়াস অবস্থায় চমৎকার শুদ্ধ বাংলাতেই তো কথা বলেন। বললেন—কথা আছে। ক্লাস শেষে দেখা করবেন।

ক্লাস শেষ। ফজলুল হক স্যার মহিদীনকে কাছে ডাকলেন। কানে কানে বললেন—শোনেন, আর মাত্র কয়েকদিন পর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। প্রেম-ট্রেমরে তিন মাসের জন্য ছুটি দেন! আমি সাজেশন দিয়া যাই, আপনার মন থকে অন্য দেশে। চতুর্থ আসমানে। প্রেমে পড়ছেন সেটা বুঝি...

—না স্যার...

—অসুবিধা নাইরে ভাই। সবাই পড়ে। আমিও পড়ছিলাম। মরছিলাম...

—না স্যার...

—তাইলে কিতা, স্বপ্না ম্যাডামের জন্য লিখছেন?

—না স্যার...

—তাইলে কিতা, কিল্লাইগ্যা ল্যাখলেন? শোনেন, প্রিন্সিপ্যাল স্যার আছিলেন না—আবদার রশিদ স্যার—নিজেও সাহিত্যিক! নইলে আন্নেরা ব্যাক্কে, সক্কলে, ঢুকতে না ঢুকতে স্বপ্না ম্যাডামরে প্রেমপত্র লেখার দায়ে টিসি পাইতেন...

—স্যার আমি...

—আইচ্ছা, আমারে কইতে তো দেন! স্বপ্না ম্যাডামরে আপনারা লিখ্যা পোস্ট করেন, কার্ড পাঠান, ফুল পাঠান, দরজার তলা দিয়া প্রেমপত্র পাঠান সব আবদার রশিদ স্যারের কাছে যাইত। স্যার সাহিত্যিক না হইলে...

—স্যার, স্বপ্না ম্যাডামকে চিনি না, দেখিওনাই কোনোদিন! খালি নাম শুনছি!

—ওমা, ওমা, ওমা কন কি? আপনার জীবনের ষোলো আনাই তো তাইলে বৃথা...মাঝি নারে মাঝি না!

ভারি বিরক্তিকর বস্তু তো বুড়াটা! মহিদীনের বিরক্তি চোখেমুখে শিরা-উপশিরায় হাটতে শুরু করেছে ততক্ষণে। ফজলুল হক স্যারের ছানিপড়া চোখেও ধরা পড়ল সেটি। বললেন—শোনেন আপেল মাহমুদের বদদোয়া নিয়া স্বপ্না ম্যাডাম...

—আপেল মাহমুদ কে স্যার?

—অ্যাঁহ! কী বলেন না বলেন না! ওই যে আপনারা ‘তীরহারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব’ গানটা যে গান...

—ওহহো, হ্যাঁহ্যাঁ, উনাকে তো চিনি স্যার...

—উনি আরেকটা গান লিখলেন, তারপর কলিজার ভিতরেত্তে দুনিয়ার কান্না ঢাইলা গাইলেন ‘লিখেছ আর না আসিতে রজনী কেটে গেল ভাবিতে ভাবিতে...

—জ্বি স্যার, জ্বি স্যার, আমার খুব প্রিয় গান তো!

—কেন লিখেছেন, জানেন?

—না স্যার!

—হেহেহেহে! আপনি ভীষণ চালাক...

—না স্যার, আমি সত্যিই জানিনা!

—আইচ্ছা থাক বাদ দেন! আপনার বন্ধুবান্ধব, সারা দুনিয়ার মানুষ, রোনাল্ড রেগ্যানও জানে, আর আপনি জানেন না! বন্ধুবান্ধব আছে না আন্নের? নাকি হেইডাও নাই? আন্নে নিজে গিয়া হ্যাগোর কাছেত্তে জাইনা নিয়েন!

—বন্ধু নাই স্যার। কবিতার আলাপ করার কোনো বন্ধু...

—ধূর ভাই! আপনি বড় আনরোম্যান্টিক। কবিতার আলাপের না, প্রেমালাপের বন্ধুরা আছে না...

—কী স্যার, কীরকম স্যার?

— আপেল মাহমুদ স্বপ্না রায়। লাইলি-মজনু। বাংলায় পড়তেন দুইজনই। ঢাকা ভার্সিটিতে। পাশটাশও করলেন। স্বপ্না ফিরলেন কুমিল্লায়। পাথরহৃদয়িনী স্বপ্না। কুমিল্লায় ফিরে আপেল মাহমুদকে লিখে দিলেন ‘আমাকে ভুলে যাও। কখনই চিঠিও লিখবে না। আপেল আর ঘরই বাঁধল না...

একি! ফজলুল হক স্যার কাঁদছেন।! সত্যিসত্যিই কাঁদছেন। কাঁদছেন তো কাঁদছেনই। যেন আর কখনো থামবেন না। একজন বৃদ্ধ কাঁদছেন—মহিদীন অপ্রস্তুত। উশখুশ করছে সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে কেউ দেখে ফেলল কিনা। ফজলুল হক স্যার পাঞ্জাবির দুই খুঁট দুই হাতে গামছার মত তুলে মুখ চোখ রগড়ে রগড়ে মুছে নিয়ে বললেন— নারী নারী নারী! নারীরা তো অ্যামনই... আচ্ছা বাদ দেন, কাজের কথায় আসেন।

—কী কাজের কথা স্যার?

—ওই যে কিতা কিতা ওমর আলী, সে যদি জীবিত হয় আমি তাকে ফিরে পেতে পারি, সেওতো অনন্যা কেউ নয়! এইসবের শানে নুযুল বুঝান!

মহিদীন বলতে শুরু করল। ওমর আলির কবিতা তাকে নেশায় ঠেলেছে। কবিতার নেশা। কী যে ঘোর লাগানো কবিতা লেখেন ওমর আলী। কবিতা তো নয় প্রাণজ গহণ গহীনে মানবের হাড়গোড় কাঁদে ভালবাসার জন্য। সে কান্না শোনে ওমর আলী। হাঁড়ের গহীনে মজ্জা কাঁদে। সে কান্নাও শোনে ওমর আলী। শুধু শোনেই না। শোনায়ও। যে শুনতে চায় তাকেই শোনায়। যেন কান পেতে শুনতে ডাকে। ওমর আলী দেখে ও দেখায় ‘অরণ্যে একটি লোক’ হাড় কংকাল খুলি জুড়তে থাকে অনন্তকাল। তার প্রতীক্ষাটি হৃদয়বিদারী—সে যদি জীবিত হয়, আমি তাকে ফিরে পেতে পারি! ফজলুল হক স্যারকে অতশত ঘোরের কথা বলা হয়ে ওঠেনা মহিদীনের। শুধু প্রশ্ন রাখে—স্যার, ওমর আলী “রূপবতী” শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন? কবির মত গভীর অনুভূ্তির মানুষ কেন বলবেন “কবরে শুয়ে ছিল এই রূপবতী নারী”। শব্দটি হতে পারত ‘গুণবতী’, ‘লীলাবতি’। অথবা একেবারেই অন্য কিছু! ‘রূপবতী’ শব্দটির কারণে অসাধারণ লাগতে লাগতেও ওমর আলীকে সাধারণই লাগছে। শুধু রূপসর্বস্ব নারীরাই কি কবিদের আরাধ্য? সব কবিরাই কি নির্লজ্জ্ব রূপান্ধই হন, স্যার!

বাহ! আপনি তো দারুণ পাঠক হে! হে ভাবুক কবি, নমঃ নমঃ নমঃ! বলতে বলতে ফজলুল হক স্যার চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলেন খানিক। যেন সারা পৃথিবীর সমস্ত সমস্যার কাঁটার সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। কিন্তু মনেপ্রাণে চটুল যুবক তিনি। সেকেন্ডেই তারঁ চোখেমুখে ডানপিটে কিশোরের দুষ্টবিদ্যুৎ ঝলকে উঠল। বললেন—স্বপ্না ম্যাডামের কাছে যান। পদ্যে উনিই স্বরস্বতি। তদুপরি অসামান্যা রূপবতি। রূপের আগুনে কতো কতো পতংগ যে পুড়িয়ে মেরেছেন। যান যান যান! পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উনি বেরিয়ে পড়বেন। এবার মিস করবেন তো কলেজ পাশটাশ করে বেরিয়ে কোথায় না কোথায় চলে যাবেন আপনারা, উনাকে কিন্তু আর পাবেন না বলে দিলাম।

মহিদীন ছুট লাগাল শিক্ষকদের কমনরুমের বারান্দার দিকে। দরোজায় পৌছাতে না পৌছাতেই দেখতে পেলেন একজন নারীকে। চশমাটি রুমালে মুছে চেয়ার ছেড়ে উঠছেন তিনি। শাড়িটি বিন্যস্ত করতে নিলেন মিনিটিখানেক সময়। হাতে তুলে নিলেন অনেকটা শান্তিনিকেতনি ধাঁচের একটি ঝোলা। পাশেই দামী বিদেশি ভ্যানিটি ব্যাগ। গুচ্চি ব্র্যান্ডের। গুচ্চির চকমকি তখনো ঠিকরে পড়ছে। কেমন যেন বৈপরিত্যে মাখামাখি গুচ্চি ও শান্তিনিকেতনি ব্যাগের কম্পোজিশন। তার আড়ালে নিজেকে খনিকটা লুকিয়েই নিলেন যেন! মুখাবয়বে সৌম্য দেবীমূর্তির আদল আছে। তাই বলে আসলেই মহারূপসী কি স্বপ্না ম্যাডাম? যেরকমটি বর্ণনা দিতে নেমে ফজলুল হক স্যার প্রগলভ হয়ে ওঠেছিলেন।! মহিদীনের চোখে তিনি আর দশজন পরিণতযৌবনা নারীদের একজন ছাড়া বিশেষ কোনো দেবিরূপে ধরা পড়তে ব্যর্থ হলেন। কী কারণে যেন মনে হল উনি শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রের অন্নদাদিদির শহুরে প্রতিরূপ।

খানিক ঝাঁকুনিভাবনায়ও পড়েছিল মহিদীন—স্বপ্না ম্যাডাম কি বিষণ্ণ? তাঁর চোখের নীচে কি খানিকটা কালিকালি ভাব ছিল না? রুচিশীল হালকা মেক-আপের আড়াল হতে সেটি কি উঁকি দিয়ে দিয়ে উঠছিল না মেঘ সরে যাওয়া উঁকি দেওয়া চাঁদের কলংকের মত? সারারাত কি উনিও ওমর আলীতে ডুবেছিলেন? নাকি বারান্দায় ইজিচেয়ারের গায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে কেঁদে কাটিয়ে দিয়েছিলেন সারাটি রাত! কোনো একান্ত দুঃখে পুড়ে ছাই হয়েছেন বুঝিবা! সহকর্মীদের কাছ হতে হাসিমুখে বিদায় নিচ্ছিলেন, কিন্তু দরজার বাইরে মুখ রাখতেই একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ঢেউয়ের মত তাঁর মুখ হতে বুক হয়ে কেঁপে কেঁপে পায়ের কাছাকছি নেমে এসেছিল। মহিদীন পষ্ট দেখল দীর্ঘশ্বাসের উদাত্ত-অনুদাত্ত-ক্ষয়িত! দরজার বাইরে দু কদম রাখতে না রাখতেই মহিদীন মুখোমুখি হল স্বপ্না রায়ের!

—ম্যাডাম একটা মিনিট সময় হবে?

—জ্বি বলেন!

স্বপ্না রায় সটান থমকে দাঁড়ালেন। ঋজু। কপালে কুঞ্চন। বিরক্তি বা অপ্রস্তুত বিস্ময়ের মিশেল মুখে মাখিয়ে বললেন—

দেখুন, আমি তো ছুটিতে আছি...আপনি কি কখনো আমার কোনো ক্লাসে ছিলেন?

— না। আমি ওমর আলীর একটি কবিতা...

—দেখুন, আমি ছুটিতে আছি...

—তাহলে থাক ম্যাডাম!

—না না না! দেখুন, এক মিনিটে বলতে পারলে বলুন, প্লিজ! আমার তাড়া আছে!

—ম্যাডাম, ‘অরণ্যে একটি লোক’ কবিতাটি, ওমর আলী “কবরে শুয়ে ছিল এই রূপবতী নারী” লিখলেন। “রূপবতী” শব্দটি কেন? ‘গুণবতী’ও তো হতে পারত। ‘রূপবতী’ শব্দটি কি কবিতাটিকে দূর্বল করে ফেলল না? যেন কবিরা তো নারীর রূপ ছাড়া আর কিছুতেই মুগ্ধ হতে জানেনা!

স্বপ্না ম্যাডাম কি জ্বলে ওঠেছিলেন? তাঁর সমস্ত মুখে রক্ত উঠে আসাই শুধু নয়, আগুন ছল্কে ওঠতে দেখা গিয়েছিল সম্ভবত। প্রশ্নটি কি স্বপ্না ম্যাডা্মের কোনো দহনদগ্ধতাকে উসকে দিয়েছে।? অন্যরকম কোনো ঝড়।? গভীর কোনো অপমান গায়ে মেখে নিলেন কি স্বপ্না ম্যাডাম? মহিদীন দেখল তাঁর হাতের গুচ্চি ব্যাগটি আলগা হয়ে মেঝেতে পড়ল। তিনি আলতো হাতে তুলে নিতে গেলেন সিনেমার স্লো মোশনের মত। তুলতে না তুলতেই আবার খসে পড়ল ব্যাগটি। এভাবে পরপর তিনবার একইরকম হাতছূট। মহিদীনকে ভুল বুঝলেন না তো? অন্যসব রোমিওর মত নতুন একজন রোমিও নতুন ছুতা নিয়ে এসেছে ভেবে বসা অস্বাভাবিক তো নয়! তিনি কি হাতের ব্যাগ দিয়ে আঘাত করে বসবেন? চিৎকার করে উঠবেন না তো! মহিদীন বিভ্রান্ত! খানিকটা বিব্রতও।

মূহুর্তেই বৃষ্টিশেষের দীঘির কোমলতায় বদলে গেলেন স্বপ্না রায়। সৌম্য, কমনীয় ও ভীষণ মায়াবি একটি শিশুর মুখ ফিরে এল অবয়বে। কী যেন এক গভীর ক্লান্তি শিশুটির চোখেমুখে। মহিদী্নের ভেতর কে যেন বলে চলছিল স্বপ্না ম্যাডামের একটি গভীর ঘুম দরকার। কোনো এক পরম নির্ভরতার কাঁধে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়া গভীর ঘুম। যে ঘুম ভাঙ্গার পর আবারো সেই কাঁধে মুখ চেপে জোর করে ঘুমাতে যাবেন। আবারো। আবারো।

স্বপ্না ম্যাডাম মহিদীনের প্রশ্নের উত্তরে না গিয়ে অদ্ভূত খাপছাড়া একটি প্রশ্ন করলেন—এটা কোন সাল, কোন মাসের কয় তারিখ?

মহিদীন বলল—১৯৮৫।

মাস-দিন জানতে চেয়েছিলেন, জানানো হয়নি স্বপ্না ম্যাডামকে। মহিদীনের মনেই হয়নি তার প্রশ্নটি উত্তর না-দেওয়া জগতে আটকে রয়েছে। স্বপ্না ম্যাডামকে মাস-দিন না জানানোও সেরকমই লৌহোম মহফুজে আটকে আছে। চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না মহিদীন। বিব্রত। অপ্রস্তুত ভাবটি এড়াতে মহিদীন উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করল। রূপবতী বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরটিও জানা হলোনা। বেশ কিছুদুর চলে গিয়ে যখন বাঁক ঘুরছিল বুঝেওনি কিভাবে যেন নিজের অজান্তেই চোখ ঘুরে নামল সেই সুর্যাস্তপ্রায় বিকেলের সোনারোদে মাখামাখি বারান্দায়!। স্বপ্না ম্যাডা্ম তখনো ঠায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে। চশমার আড়ালের চোখ দুটো মেলে রাখা মহিদীনের হাটাপথে। দৃষ্টিখানি পলকহীন সম্ভবত! মহিদীনের প্রশ্নের উত্তরটি কি হবে সেই ভাবনাতেই ডুব দিয়েছেন কি? নাকি উত্তরটি নিয়ে অপেক্ষা করছেন মহিদীন যেন ফিরে আসে। ধ্যানি বুদ্ধের মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়েই বা আছেন কেন?

ড. স্বপ্না রায় আর নেই।

মহিদীনের হাত খসে পত্রিকাটি পড়ে গেল মেঝেয়। তুলতে না তুলতেই আবার খসে পড়ল। এভাবে পরপর তিনবার একইরকম হাতছূট। সিনেমার স্লো মোশনের মত। মহিদীন কাঁদছে।! সত্যিসত্যিই কাঁদছে। কাঁদছে তো কাঁদছেই। যেন এই কান্না আর কখনোই থামবে না। ফজলুল হক স্যারের কান্না থেমেছিল। মহিদীনও পাঞ্জাবির দুই খুঁট দুই হাতে গামছার মত তুলে মুখ চোখ রগড়ে রগড়ে মুছেই চলল। মহিদীনের কান্না থামছে না।

গতরাতেই স্বপ্ন হয়ে ফিরেছিলেন স্বপ্না ম্যাডাম।

সেই একই বারান্দা। সেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা।

সেই একই প্রশ্ন—এটা কোন সাল, কোন মাসের কয় তারিখ?

মহিদীন বলল—২০১২।

স্বপ্না ম্যাডাম বললেন—সাতাশটি বছর বুকে আগলে রাখা শব্দটি দিচ্ছি। কলম থাকলে লিখে নাও! তারপর আর আমাদের কথা হবেনা, বিদায়!

মহিদীন কোনোভাবেই মনে করতে পারছিল না সেই একমাত্র দিনটি ছাড়া কবে কখন কোথায় স্বপ্না ম্যাডামের সঙ্গে পূণরায় কথা হয়েছিল। তাহলে আর কথা না হবার কথা আসে কেন? তবু ‘বিদায়’ শব্দটি মহিদীনকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে কেন? স্বপ্না ম্যাডাম ‘আপনি’ হতে ‘তুমি’ সম্বোধনই বা শুরু করলেন কখন? মহিদীন তাঁর মতামতই তো চেয়েছিল শুধুমাত্র। কোনো শব্দ সন্ধানের অনুরোধও তো করেনি সেই ক্ষণিকের দেখায়! তাহলে তিনি কেন শব্দসন্ধানে নামলেন? মহিদীন নিজে কত চেষ্টাই না করেছে যুতসই লাগসই একটি বিকল্প শব্দ বসিয়ে ওমর আলীর প্রণয়িনীকে ‘রূপবতী’র খাঁচাবন্দিত্ব্ব হতে মুক্ত করে দেবার। কতো কবি-সাহিত্যিককেই তো একটি শব্দ আবিষ্কারের অনুরোধ উপরোধ করেছিল সে। কেউ কি কখনো সামান্য গা-টুকুও করেছে কখনো? করেনি। মহিদীনের ভাবনাকে কেনইবা তাঁরও ভাবনা বানিয়ে বুকে পুষে রাখলেন তিন তিনটে যুগ?

মহিদীনের দৃষ্টি যেন এক ঝাপ্সা চাদর। তার মনে পড়তে শুরু করেছে। সেইদিন আগুনচোখা স্বপ্না রায় যখন মূহুর্তেই বৃষ্টিশেষের দীঘির কোমলতায় বদলে গেলেন, বিস্ময়মাখা গভীর চাহনির শব্দহীন ভাষায় বলে দিয়েছিলেন—বালক, তোমার মতই শব্দসন্ধানের কাতর কাতরানি নিয়ে আমি নিঃস্ব হতে নিঃস্বতর হয়েছি। একজনও শব্দসন্ধানী পাইনি। তুমিও কি পাবে কখনো? সম্ভবত পাবে না।

আস্তে আস্তে মহিদীনের মনে পড়তে লাগল স্বপ্না ম্যাডাম আগেও স্বপ্ন হয়ে এসেছিলেন। অদ্ভূত আধিভৌতিক স্বপ্ন। সবগুলো স্বপ্ন একই রকম। একটি মধ্যবিত্ত ড্রয়িং রুম। চারপাশে বেতের বুকশেলফে গাদাগাদি বইয়ের স্তুপ। যুবক বয়সের ফজলুল হক স্যার বসে আছেন। সামনে অসংখ্য খোলা বই উল্টেপাল্টে রাখা। স্বপ্না ম্যাডাম বোধ হয় জানেনই না ফজলুল হক স্যারের সামনে বসে আছে মহিদীন। তিনি পর্দার আড়ালে, অন্দরমহলে। যেন তাঁর কুষ্ঠরোগের মত ছোঁয়াচে কোনো রোগ হয়েছে। কারো সামনেই আসেন না। স্যার একে একে বলে চলেন—কবরে শুয়ে ছিল এই প্রেমবতী নারী। স্বপ্না ম্যাডাম পর্দার আড়ালে শব্দ করে হাসেন—‘প্রেমবতী’? হয়নি স্যার, উঁহু! মহিদীনের ভাবনার সংগে যায়না। স্যার এবার বলেন—‘লায়লার মত নারী’।? স্বপ্না ম্যাডাম আবারো বলেন—নাহ! সেকেলে! মহিদীনের ভাবনা আরো কাব্যিক! স্যার বলেন—‘অনূদিত’? ধরুন ভিন অচিন ভাষার মত প্রেমাষ্পদকে নিজের মত করে অনুবাদ করে নিচ্ছেন কবি। স্বপ্না ম্যাডাম বললেন—খুব আরবান কনোটেশন পাই যে, স্যার! মহিদীন খুঁজছে সেই শব্দটি যেটি কবিতার আরণ্যক আবহের খাঁজে বসে যেতে পারে। তাহলে ‘উপহৃত’ শব্দটি? ধরুণ নারীটি যেন ছিল স্রষ্টার উপহার। উপহারটি হারিয়ে গেছে। সে যদি জীবিত হয়, প্রেমাষ্পদ ফিরে পেতে পারে।প্রিয় উপহার? স্বপ্না ম্যাডাম বললেন—শব্দটি মন্দ নয়, কাছাকাছি ভাবের। কিন্তু মহিদীনের ভাবনায় তো শুধুই সেই নারী যার গভীরে ডুব দিয়ে বেঁচে থাকে ওমর আলী। অ্যামনই সে স্বজন যেন সে ওমর আলীর নিজেরই সৃজন!

মহিদীন ঘোরের পাতালে তলিয়ে যেতে থাকে। বিস্ময়ের ঘোর! এও কী সম্ভব? কীভাবেই বা সম্ভব? ফজলুল হক স্যারের প্রতিটি প্রস্তাবিত শব্দের বিপরীতে মহিদীনের অনুভুতিগুলোই হুবহু কীভাবে বলে দিতে পারলেন স্বপ্না ম্যাডাম? মহিদীনের অস্তিত্ব্বের গহীন গোপনে কখন অ্যামন ঘাঁটি গেঁড়ে বসে গেলেন স্বপ্না ম্যাডাম?

গত রাতের স্বপ্নে স্বপ্না ম্যাডাম চলে যাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেছিলেন। বললেন—“কলম খুঁজতে হবে না, বুকে ধরলেই হবে। শব্দটি হতে পারত ‘স্বরচিত’! ওমর আলী লিখতে পারতেন—‘কবরে শুয়ে ছিল এই স্বরচিত নারী; সে যদি জীবিত হয় আমি তাকে ফিরে পেতে পারি!’ বিদায়!




লেখক পরিচিতি
হেলাল মহিউদীন
গল্পকার। কবি।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ