শামিম আহমেদ ছকভাঙা এক গল্পকারঃপুরুষোত্তম সিংহ

সৈয়দ মুজতবা আলী ‘মুসলিম সংস্কৃতির হেরফের’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন –“কিন্তু প্রশ্ন উঠিবে এ সাহিত্য রচনা করিবে কে ? যাঁহারা ভালো বাংলা জানেনে তাঁহারা ইসলাম চিনেন না, যাঁহারা ইসলামের পূর্ণ সংস্কৃতির খবর রাখেন তাঁহারা বাংলা জানেন না।


কাজেই ব্যাপক সাহিত্য একদিনে গড়িয়া উঠিতে পারে না –বহু লেখকের, বহু দিবসের, বহু তপস্যার প্রয়োজন। এই সব লেখকের নির্মাণ করিব কি করিয়া? শিক্ষাপ্রণালীর সংশোধন ও পরিবর্ধন করিয়া –অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানকে সনাতন বাংলা শিখিতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের পূর্ণ সংস্কৃতির সহিত পরিচিতি হইতে হইবে।“ (মুসলিম সমাজ এবং এই সময়, সম্পাদনা মইনুল হাসান, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, পৃ. ২৬ ) সৈয়দ মুজতবা আলীর এই সংশয় আজ দূর হয়েছে। 
আজকের বাংলা কথাসাহিত্যে মুসলিম জীবনের ইতিবৃত্ত নিয়ে বেশ কিছু শক্তিশালী লেখকের আগমন ঘটেছে। এঁদের মধ্যে অন্যতম শামিম আহমেদ (১৯৭৩ )। মুসলিম মিথকেসামনে রেখেই তিনি সাহিত্য পরিক্রমায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই মিথকে ভেঙেছেন , নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিজস্ব বলয় গড়ে নিয়ে এসেছেন। মুসলিম জীবনকে সামনে রেখে তরুণ যে লেখকরা লিখতে এসেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী লেখক শামিম আহমেদ ও সাদিক হোসেন।
মিথ, বিজ্ঞান, মুসলিম ধর্মীয় জীবন ও সে জীবন থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘কুবাদ একজন হাজামের নাম’ গল্পটি। আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম সমাজের কাছে ধর্মীয় সংস্কার কীভাবে পরাজিত হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞান কীভাবে মানুষের মন থেকে ধর্মীয় ধারণা গুলিকে দূর করে দিচ্ছে তা এ গল্পে দেখান শামিম। তেমনি রয়েছে ফেলা আসা ধর্মীয় ধ্যান –ধারণা সর্ম্পকে এক বদ্ধ আত্মবিশ্বাস । ধর্ম ও বিজ্ঞানের যাঁতাকলে মানুষ কীভাবে পিষ্ট হচ্ছে , তেমনি পুরাতন ধ্যান–ধারণাকে পিছনে ফেলে রেখে নতুন সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে, পুরাতন বিশ্বাস নিয়ে কিছু মানুষ কীভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে তাই বড় হয়ে ওঠে। কুবাদ হল একজন হাজামের নাম, যিনি খৎনা দেন। কিন্তু কী এই খৎনা, পাঠককে সে ধারণা দেওয়া জরুরি। মুসলিম সন্তানকে যৌনঅঙ্গের পর্দাকে বাদ দেওয়া হয় ছোটবেলায়, এই পর্দা বাদ দিলে সে সন্তান প্রকৃত মুসলিম হয়। এই খৎনা দিতে ডাকা হয় হাজামদের। হাজামরা ব্যবহার করেন ধারালো ছুরি ও পর্দা কাটার পর লাগিয়ে দেওয়া হয় ছাই। দিন পরিবর্তনের

ফলে এই হাজমদের ব্যবসা উঠে যায়, এখন সবাই ডাক্তারের কাছে যায় খৎনা দিতে। ঘোতনের ছেলের খৎনাকে সামনে রেখে লেখক এই পরিবর্তিত জীবনের গল্পটি লিখেছেন। আসলে তারাশঙ্করের যে ঘরানা তা এখানে মুসলিম জীবনকে কেন্দ্র করে শামিম গড়ে তুলেছেন। পুরাতন বিদায় নিচ্ছে, নতুন কালের কাছে তার আক্ষেপ রেখে যাচ্ছে তেমনি নতুনকাল সব ফেলে দিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করলেও পুরাতনের দিকে উঁকি দিয়ে দেখছে। তাই আজ কুবেদ হাজামের জায়গা দখল করেছে ডাঃ সেন। তবে ডাক্তারকে দিয়ে খৎনা দিলেও সে লোককে খাইয়েছে। তবে পুজোর ছুটিতে গ্রামে গিয়ে সেই হাজম পাড়ায় গিয়েছে। সেই বুড়ো কুবাদ হাজামের সঙ্গে দেখা করেছে। তাঁর ছেলে আর হাজাম হয়নি, কেননা হাজামগিরি করে আর এখন পেট চলবে না। চোদ্দ পুরুষের জাতি ব্যবসার পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে –
“না ! খৎনা দিলে পেট চলবে না ব্যাটা।সবাই তো ডাক্তারের কাছে যায়। আমাকে ধরে আমার চোদ্দো পুরুষ

হাজাম। আমার ছেলে হাড় আর চুলের ব্যবসা করে।“ (ফেয়ারলেনে মধুবালা, অভিযান, প্রথম প্রকাশ

২০১৪, পৃ. ১৮ ) ঘোতনের এই হাজামের কাছেই খৎনা হয়েছিল, সে করুণা বশত একশো টাকা দিলেও সে নেয়নি। হাজাম সাহেব এক আত্মসম্মান বিশিষ্ট মানুষ, অপরের দান গ্রহণ করে না, বরং ঘোতনকে

আপ্যায়ন করেছে। ঘোতন সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে, কিন্তু মন ফিরে গেছে অতীতের বদ্ধমূল

ধারণায়। আর এখানেই লেখক কল্পনায় উড়ান দিয়েছেন। সার্থক ছোটগল্পের এক যথার্থ রূপ এখানে

আমরা দেখি। বাস্তব থেকে কল্পনায় ভেসে গিয়ে তিনি পাঠককে বিদায় দিয়েছেন। আর সে বিদায় অতীব মধুর, লৌকিক –অলৌকিকতায় মিশে গেছে –

“ঘোতনের আলো-আঁধারিতে মনে হল, কুবাদ বোধ হয় এখুনি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবেন। হাতে

তাঁর ন্যাকড়া –পোড়া ছাই, অন্য হাতে শলাকা। সেই নকল ঠান্ডা ঘরে তো আকাশ নেই, আছে

মিথ্যে সিলিং। তবে উড়োজাহাজ দেখাবেন কী করে তিনি ? কোথা সেই লাল-নীল এরোপ্লেন !

কুবাদের আলখাল্লায় যেন সেই উড়োজাহাজগুলো জিরিয়ে নিচ্ছে। সময় হলে উড়তে শুরু করবে।

কুবাদ যেন সেই অলৌকিক দেবদূত, যার কেরামতিতে সিলিংগুলো হাওয়া হয়ে যাবে। উবে যাবে

চিল-চিৎকার। একটার পর একটা খৎনা দিয়ে দেবদূত বলে উঠবেন, ‘পরের জনকে নিয়ে আসুন

বাপজানেরা !” (তদেব, পৃ. ১৯)
‘সবুরা বিবির পুত্রদর্শন’ গল্পেও মিথ, ইতিহাস, কল্পকথা ও জাদুবাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা কিন্তু চিরকালীন যে বদ্ধ সংস্কার তা আবার আটকে ধরে এই দুই দ্বন্দ্ব বড় হয়ে উঠেছে। সবুরা বিবির পুত্র নিয়াজ মৃত হয়েছে দু বছর হল। আজ শবে বরাতের রাত। মুসলিম সংস্কার অনুসারে এই রাতে আল্লা সমস্ত মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। এই রাতে গ্রামের মানুষরা প্রিয়জনের কবরে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে নানা প্রার্থনা করে। তবে সংস্কার অনুসারে কবর স্থানে নারীদের যাবার অধিকার নেই। কিন্তু মাতার মন তো পুত্রের জন্য ব্যাকুল। পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে পবিত্র হল মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক। কিন্তু সেই সন্তান মাতার আগেই চলে গেছে। তাই আজ সবুরা বিবি সমস্ত সংস্কার লোকাচারকে উপেক্ষা করে কবর স্থানে গিয়েছেন সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে। সবুরা বিবির একটিই আকাঙ্ক্ষা শুধু পুত্রকে একবার দেখবেন, তবে পুত্রকে আর এই সংসারের মায়ার বাধনে বাঁধবেন না। কিন্তু কবরে একটি মৃদু আলো দেখতেই তাঁর সব ধারণা ভেঙে যায়। এমনকি লৌকিক বিশ্বাস কবরের পাশে থাকা বট গাছে পিরবাবা থাকে। কবর স্থান থেকে বাড়ি ফেরার পথে সে পথ হারিয়ে ফেলে। এই পর্যন্ত এসে গল্পকার গল্পকে নিয়ে যান বিশ্বাস থেকে অবিশ্বাসের জগতে, লৌকিক থেকে অলৌকিকতার জগতে এক জাদুবাস্তবতার মধ্য দিয়ে। সবুরা বিবির কানে ভেসে আসে –“মৃতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায় না, তুমি বাড়ি যাও সবুরা, আপন মকামে। সবুর করো। তোমার ইন্তেকাল হলে তুমি তোমার ছেলের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে।“ (তদেব, পৃ. ৩৯) আজ সবুরা বিবির কাছে যেন মৃত্যুই প্রার্থিত । পথে নানা ফেরেশতার দল দেখতে পান। তাঁদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি নানা ফেরেশতার স্মরণ নেন। মনে মনে ভাবেন মাতা পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে গেছে এতে তো অপরাধ নেবার কথা নয় আল্লার।
কখনও মনে হয় পুত্রই বুঝি ফেরেশতার বেশে এসে মাতার সঙ্গে দেখা করতে চান। এখানে এসে শামিম গল্পকে নিয়ে যান জাদুবাস্তবতার জগতে। রাত্রির গভীর অন্ধকার অতিক্রম করে তিনি বাড়ি ফিরেছেন কিন্তু দেখেন বন্ধ দরজা খুলেছে পুত্র নিয়াজ। পুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন কিন্তু গল্পের শেষ চরণে লেখক পাঠককে একটি সংবাদ দিয়ে যান-পরের দিন দুপুর সবুরা বিবিকে দাফন করা হয় পারিবারিক কবরে। এক আশ্চার্য পরিণামের দিকে তিনি গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। জীবনের গভীর সত্য প্রকাশের জন্য অলৌকিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। শামিম আহমেদ উত্তর আধুনিক ছোটোগল্পের কথক। তাই পুরোপুরি বাস্তবতাকে সামনে রেখে তিনি গল্পের উত্তরণ ঘটাতে চাননা। গল্পহীনতার দিকে তাঁর যেমন ঝোঁক থাকে তেমনি লৌকিক-অলৌকিক, বাস্তব-অবাস্তবের মধ্যে কাহিনিকে দুলিয়ে জীবনের গভীর সত্যে উপনীত হন। আজ হয়ত মাতা পুত্রের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছে কিন্তু সেই পরলৌকিক জগতের কথোপকথন আমাদের জানা নেই। ছোটোগল্প সেই জানার অবকাশ পাঠককে দেয়ও না। এক আশ্চর্য মায়াবন্ধনে লেখক এ গল্পের ছক গড়ে তুলেছেন। অযথা কথা বা গল্পের শাখা প্রশাখা নয় শামিম বক্তব্য বা তাঁর লক্ষ বিন্দুকে সামনে রেখে গল্পকে নিটোল রূপ দিতেই ভালোবাসেন। সেখানে প্রয়োজনে জাদুবাস্তবতার পাশাপাশি মিথ, বিশ্বাস –অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব ও সমাজবদ্ধ মানুষের যে নানা লোকাচার ও সংস্কার সব মিলিয়ে এমন একটি গল্প বলয় তৈরি করেন যা নিজস্ব ঘরানার সাক্ষ্য বহন করে।
সংস্কার থেকে উত্তীর্ণ হওয়া মানুষকেও একসময় সংস্কারের বশবর্তী হতে হয়, গ্রামের সমস্ত কিছুতেই জড়িয়ে আছে স্বার্থ সিদ্ধ মানুষের কৌশল ও রাজনীতি। এই সমস্ত কৌশলকে অতিক্রম করে মানুষের পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়, তবুও বাঁচতে হয়, আর সেই বাঁচার জন্য অনবরত সংগ্রাম করতে হয় সমাজের সঙ্গে কখনোবা নিজের সঙ্গেই। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের নিয়মের কাছে ব্যক্তি মানুষের শক্তি কতটুকু ? ফলে সমাজের সেই নিয়মের কাছে পিষ্ট হতে হয় ব্যক্তি মানুষকে। তেমনই এক গল্প ‘ইন্তেকালের রাজনীতি’। আব্বাস মিঞা ছিল মদ্যপান ও সুদখোর ব্যক্তি। কিন্তু মুসলিম হাদিসে এই দুটিই পাপের কাজ। তবে সে অতিরিক্ত সুদ নিত না বা সুদের নামে দখলনামাও করেনি। ব্যবসায় লাভ হলে সেখান থেকে মানুষ আব্বাস মিঞাকে সুদ দিত। তাঁর এই কার্যকলাপ গ্রামের মৌলবী সমাজ ভাল চোখে দেখেনি। আব্বাসের এই কার্যকলাপের জন্য পিতা সমস্ত সম্পত্তি আব্বাসের কন্যা ও স্ত্রীর নামে লিখে দিয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই আব্বাসের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য খাট দেয়নি গ্রামের মৌলবীরা এমনকি কেউই কবরের নামাজ পড়তে চায়নি। এই পর্যন্ত এসেছে শামিম গল্পের দিক পাল্টে ফেলেন। লুকমান শেখ ছিল পার্টির লোক। তাঁর পার্টি কোনদিন আব্বাস মিঞার পাড়ায় জিততে পারেনি। কেননা পড়ায় আব্বাসের একটা সুনাম ছিল। আজ স্ত্রী এই মৃত্যুর কাজ সমাপ্তের জন্য গ্রাম্য নেতা লুকমানের কাছে গেছে। সে জানিয়েছে কবরের সব ব্যবস্থা হবে কিন্তু তাঁকে তাঁর পার্টির হয়ে ভোটে দাঁড়াতে হবে। এই দ্বিখণ্ডিত সময়ে দাঁড়িয়ে আব্বাসের স্ত্রীর এই শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না –

“এই ওয়ার্ডে আব্বাস মিঞাদের দাপট থাকায় কোনো দিন লুকমান শেখদের পার্টি জেতে না।

আব্বাস মিঞার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহল। তার উপর আব্বাস মিঞা মৃত। তার

বউ অবশ্যই প্রচুর ভোট পেয়ে জিতবে। সে যে পার্টির হয়ে দাঁড়াক না কেন ! আব্বাস মিঞা

বেঁচে থাকার জন্য এই ওয়ার্ডটি কোনও দিনই লুকমান শেকরা জিততে পারেনি। তাছাড়া আব্বাস

মিঞার দাফনের ব্যাপারেও তার পরিবার লুকমান শেখের পার্টির প্রতি কৃতজ্ঞ। আব্বাস

মিঞার বেওয়া পার্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই এ বার ভোটে দাঁড়াবে।“ (তদেব, পৃ. ৮২)

আসলে take and give police এর রাজনীতি আজ মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও বিবেক বোধকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এই রাজনীতির কাছে মাথা নত করা ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার অন্য উপায় নেই। ফলে মানুষ নিজের প্রয়োজনে, সামাজিক মানুষ হিসেবে সমাজে টিকে থাকার দাবিতে নানা কৌশলের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হচ্ছে। আজ আব্বাসের স্ত্রী অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থনে ভোটে দাঁড়াবেন। এই দলের প্রতি আব্বাসের স্ত্রীর বিশ্বাস আছে কিনা তা আমরা জানি না, লুকমান শেখের মত সুযোগসন্ধানী মানুষরা সাধারণ মানুষের অসহয়তাকে কাজে লাগিয়েছে। আজকের দিনে বিবেকসর্বস্ব ও আদর্শবান মানুষকে ধ্বংসের জন্য দুটি বড় প্রতিষ্ঠান ধর্ম ও রাজনীতি, সেই সঙ্গে রয়েছে সামাজিক নীতি নিয়মের লাঞ্ছনা। এই ত্রিবিধ বন্ধনের কোলাজে মানুষ কীভাবে অপদস্ত হয় তা লেখক দেখিয়ে দেন।
‘সিদরাতুল মুনতাহা অথবা ধানগাছের গল্প’ গল্পে পুরাণের সঙ্গে বর্তমান সময়ে কৃষকের সমস্যাকে মিলিয়ে দিয়ে এক অশ্চর্য কোলাজ গড়ে তুলেছেন। শামিম আহমেদ গল্প বলতে বলতেই পুরাণের জগতে পাড়ি দেন, পাঠক যখন সেই জগতে হাবুডুবু খাচ্ছে তখনই তিনি পাঠককে গল্পের বাস্তব সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। সেই পুরাণকে ব্যবহার করতে তিনি কখনও চিত্রকল্প, প্রেক্ষাপট বা গল্প কথককে নিয়ে আসেন। বাস্তবতার দর্পণে গল্পের ধ্রুব সত্যকে তিনি সরাসরি পাঠকের কাছে নিয়ে যান না কৌশলে এক মায়ার আবরণ গড়ে তোলেন। আর সেই মায়ার আবরণের জন্যই বোধহয় তিনি পুরাণের ধূসর জগতে পাড়ি দেন ! এ গল্পে দুটি সমান্তরাল কাহিনিকে পাশপাশি রেখে আখ্যান গড়ে তুলেছেন। ধানু ফকির ফজলে সিদ্দিকিকে শুনিয়েছে সিদরাতুল মুনতাহার গল্প। ধানু ফকির নানা পুরাণের গল্প জানে কিন্তু কাউকে শোনানোর মানুষ পায় না তাই ফজলেকে শোনায়। অন্যদিকে আছে ফজলে সিদ্দিকির কৃষক জীবনের ট্র্যাজেডির গল্প। ধানে দাম নেই, অথচ ফসল উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, বাজারে চালের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ গল্পে লেখক এ বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করান। আজ সত্যি কৃষকের অবস্থা দূর্বিসহ। অন্যদিকে আছে সরকারের তরফ থেকে ধান কেনা। সেখানেও দলের লোক বা পরিচিত মানুষ একটু বেশি অর্থ পায়। এদিকে ধানের জন্য গোলার প্রয়োজন। নতুন গোলা করতে কাটতে হবে বাড়ির ডালিম গাছকে। কিন্তু মাতার ইচ্ছা সে গাছ যেন না কাটা যায়। এমনকি মাতা গাছ কাটার আগে সে গাছে আত্মঘাতী হতে চেয়েছিল। মাতাকে বাঁচাতে সে নিজের বাম হাতের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলেছে। এই ঘটনার সঙ্গে লেখক মিলিয়ে দেন মহাভারতের একলব্যের আঙুল কাটার প্রসঙ্গকে। কিন্তু পুরাণের সত্যের মর্যদা আজ আর নেই। এমনকি পুরাণে ঘটা সে সব ঘটনার সত্যতা কতটা বাস্তব তা আমাদের জানা নেই। সেই জগত সম্পর্কে পাঠকের যেমন অবিশ্বাস সঞ্চারিত হয় তেমনি আঙুল কাটার ফলে ফজলের বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন। আঙুল কাটা যাওয়ায় ফজলে আজ আর ধান মাপতে পারে না, তাঁর ভরসা সরকার। সেখানে ঠকলেও উপায় নেই। তবে সরকারের বাম হাত নেই, সেখানেও শামিম ব্যঙ্গ আনেন –
“সরকারের বাঁ হাত আছে কি না, তা জানে না ধানু ফকির বা ফজলে সিদ্দিকি। অতএব সেই

হাতের বুড়ো আঙুল আছে কি না, তা জানে না ধানু ফকির বা ফজলে সিদ্দিকি। অতএব সেই

হাতের বুড়ো আঙুল আছে কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর। তবে বুড়ো আঙুল থাকা বা না-থাকার

উপর নির্ভর করে না বেহেশত কিংবা দোজখের দুনিয়ায় যাওয়ার অধিকার। রোজ কিয়ামতের

দিনে আর সকলের মতো সরকারকেও তার বাম হাতের হিসাব দিতে হবে। সে দিন ফজলে

সিদ্দিকির মতো খুঁতঅলা বাঁহাতিরা ফিকফিক করে হাসবে আর সরকারেরও যে বাপ আছে তা

উপভোগ করে নিজের বুড়ো আঙুলের দুঃখ ভুলবে।“ (তদেব, পৃ. ১০২)
ধানু জানে মনগড়া বৃত্তান্ত বললে পাপ হয় তবুও সে নানা গল্প করে। আর তার মধ্যেই জড়িয়ে থাকে নানা ধানের গল্প। ধানের বিবর্তন, চাষ, নতুন প্রজাতির ধান সব মিলিয়ে এক নতুন আখ্যানভুবন গড়ে তোলেন শামিম আহমেদ। মুসলিম জীবনের এই ইতিবৃত্ত লেখায় শামিমের কোনো পূর্বসূরী নেই, সোহারাব হোসেনের সঙ্গে সামান্য মিল খুঁজে পেলেও তিনি আখ্যান ভুবনে দূরে সরে গেছেন। সোহারা যেখানে রূপকথা উপকথা, লোককথায় জোড় দেন শামিম সেখানে পাঠককে নিয়ে যান পুরাণের জগতে।
‘রইসুদ্দির রাত্রিবাস’ গল্পে ফ্যান্টাসি প্রাধান্য পেয়েছে, কল্পনা

ডানা মেলেছে। রাইসুদ্দির স্ত্রী খালেকা নিজেই তালাক নিয়েছে। এমনকি সে বিবাহও করেছে। তবে

রইসুদ্দির আর বিবাহ ইচ্ছা জাগেনি। আজ হঠাৎ বিবাহের বাসনা জাগে। ফলে রাতে সে ডুবে গেছে

পূর্বের দাম্পত্য জীবনে। সেই জীবনের ব্যর্থতা, অনুশোচনা, যন্ত্রণায় যেমন ভুগেছে তেমনি স্ত্রী

চলে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে। তাঁর একটিই দোষ ছিল সামান্য মিথ্যা কথা বলা। তবে সে যৌন

সংগমে ব্যর্থ ছিল। এই ব্যর্থতা সে কোনদিন বোঝেনি। আজও বিছানায় সে কল্পনায় স্ত্রী খালেকা

নিয়েই রাত্রিবাস করে, গভীর স্বপ্নে মগ্ন হয় কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে তখনই মনে প্রশ্ন জাগে

পরস্ত্রীর সঙ্গে রাত্রিবাস অনৈতিক। তখন সে প্রায়শ্চিত্ত করে নেয় –
“ভোর হলেই রইসুদ্দি নামাজের আজান শুনতে পায়, আর সে খালেকাকে বিছানায় ঘুমন্ত রেখে উঠে পড়ে –তওবা পড়ে, তারপর ওজু করে বলে, ‘হে খোদা, আমাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে চলো। আমি যেন অমৃতলোকের দিকে হেঁটে যেতে পারি।“ (তদেব, পৃ. ৪৩ )
এই সংকটের পৃথিবীতে বিশ্বাস নামক আদর্শ আজ অলীক বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এক সংশয়ের বিশ্ব আজ মানুষকে গ্রাস করছে। দ্বিধান্বিত মানুষ সবাই নিজের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টায় ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে এক হানাহানির সত্য মানুষকে গ্রাস করেছে। সেই হানাহানিতে মেতে ভালো মন্দের বোধ মানুষের হারিয়ে গেছে, অনুশোচনা আছে অবশ্য কিন্তু যখন সে বোধের জাগরণ ঘটছে তখন ক্ষতি হয়ে গেছে। ‘হত্যাকারী’গল্পে পিতৃহত্যার গ্রামে আনারুল আর থাকতে চায়নি। যেখানে হত্যার লীলা সদা বিরাজ করে সেই গ্রামে আনারুলের মত মানুষের থাকা সম্ভব নয়। ফলে সে অন্য গ্রামে মামার কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু মামাও সেই হত্যালীলায় আসামীকে বাঁচানোর এক আসামী। মামার নাম ‘শমসুদ্দিন’, যার অর্থ বিশ্বাসের সূর্য। আসলে এ পৃথিবীতে বিশ্বাস নামক সূর্য আজ অস্তাচলে গেছে, এক অন্ধকারের সত্য আজ পৃথিবীতে বিরাজমান। এই জটিল সময়ে মানুষ কীভাবে বাঁচবে ? সে সত্যের সন্ধানে লেখক অগ্রসর হয়েছেন।
গল্পের শুরুতে দেখা যায় আনারুলের পিতা লালন খুন হয়েছে সুরুজের হাতে। লালন ও নীরোজ ছিল এক পার্টির লোক। সুরুজ ছিল বিরোধী পার্টির যুবক। সুরুজকে বলা হয়েছিল নীরোজকে বা দলের কোন একজনকে খুন করতে পারলে সে বড় অফার পাবে। ফলে সে বেঁছে নেয় লাললনকে। তবে খুন করেও সে কোন লাভ পায়নি, পার্টি তাঁকে কোন সুযোগ দেয়নি। বরং লালন তাঁকে জমি ভাগচাষের অধিকার দিয়েছিল। আজ সুরুজ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তাই সে আনারুলের কাছে যেমন ক্ষমা চেয়েছে তেমনি শবে বরাতের রাতে লালনের কবরের কাছে মোমবাতি জ্বালিয়ে ক্ষমা চেয়েছে, দুঃখে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত সত্য –


“আজকের এই পাক দিনে আমাকে ক্ষমা করে দেন আনারুল ভাই। পার্টির কথায় নেচে আমি

আপনার বাপকে খুন দিয়েছি।কেউ না জানুক খোদাতলা তো জানেন, আমি এখনও একটা পয়সাও

পাইনি। বিশ্বাস করেন ভাইজান, লালন চাচা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। মরার ছ মাস আগেও

তিনি আমার নামে তার সব জমির ভাগচাষের হুকুম দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই কাগজও আমার কাছে

আছে। আপনাকে জমিজায়গা নিয়ে ভাবতে হবে না। সব ফসল আপনার গোলায় আমি পৌঁছে দেব।“

(তদেব, পৃ. ৬২ )
এই হত্যালীলার গ্রামে আনারুল আর থাকতে চায়নি। সে চলে গেছে মামার বাড়ি। তাঁর মাতা বিবাহ করেছিল নানার কথাকে অমান্য করেই। নানা শামসুদ্দিন আজ নার্সিংহোম খুলেছে। সুরুজের উকিল সাক্ষি দিয়েছে লালন খুনের দিন সুরুজ এই নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল। এই মিথ্যা রিপোর্ট নানা শামসুদ্দিন নিজেই দিয়েছে। একদিকে বোনের প্রতি প্রতিশোধ ও অন্যদিকে ধর্মের বশ্যতার কাছে পরাজিত হতে হয়েছে শামসুদ্দিনকে –“আমি সুরুজকে ফেরাতে পারিনি ভাই, সে এমনই এক নামাজের শেষে আমার কাছে ভিক্ষা চেয়েছিল।“ (তদেব, পৃ. ৬৫) হত্যালীলার গ্রামে থাকবে না বলে আনারুল গ্রাম ছেড়েছিল আজ বিশ্বাসের প্রাচীর আরও ভেঙে গেল। আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আনারুল ? এ পৃথিবীতে আনারুলের বাসযোগ্য ভূমি আজ আর নেই। মিথ্যার কলঙ্কে ভরে গেছে সমস্ত ভূমি। বিশ্বাসের সূর্য হারিয়ে গেছে,এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। আজ ভরসা শুধুই কবির কবির বাণী –
‘’সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে –এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ ;

এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল ;-

প্রায় তত দূর ভালো মানব –সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেবো আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।‘’ ( সুচেতনা, জীবনানন্দ দাশ )
শামিম আহমেদ দর্শনের অধ্যাপক, ফলে চরিত্রের মননজাত দর্শনে তিনি খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন। মানবজীবনের রন্ধে রন্ধে যে অতল সমুদ্র বিরাজ করছে তা আবিষ্কার করেন। ‘দর্শন’ গল্পে চরিত্রের হ্যালিউসিনেশন বা অমূল প্রত্যক্ষের ওপর জোড় দেন। নরুলের স্ত্রী রেহেনা। স্ত্রী নিয়ে সে কিছুদিন হল সুখে সংসার করছে। নরুল বড় হয়েছিল মামার বাড়িতে, মামার পিরবংশ। ফলে সেখানে বারো বছরের বেশি বয়সি পুরুষকে বাড়ির মহিলারা মুখ দেখায় না। ফলে নরুল সারাজীবন নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এমনকি নারীদেরও সে এড়িয়ে চলেছে। আজ নরুল স্কুল যাওয়ার সময় একটি মেয়েকে প্রতিদিন দেখতে পায়, যে নারী প্রতিদিন নতুন পোশাকে নরুলকে মুগ্ধ করে, দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘মানসসুন্দরী’। এ সত্য নরুল; স্ত্রীর কাছে গোপন রাখেনি। তবে স্ত্রী কোনো ভৎসনা করেনি। শুধু জানিয়েছিল নারীর ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটলে তালাক ঘটত। পরে স্ত্রী নিজেই সে নারীকে দেখতে এসেছে নরুলের স্কুল যাওয়ার সময়। কিন্তু কিছু দেখেনি, সবই অদৃশ্য, আসলে কিছুই নেই, সব নরুলের ভ্রান্ত ধারণা। ফলে নরুলকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে প্রকাশ পেয়ে যায় প্রকৃত সত্য। লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কীভাবে মুসলিম জীবনে শৈশব মারা যাচ্ছে, শিশুর প্রকৃত বিকাশ অসম্ভব হচ্ছে –

“ডাক্তার হোসেন বললেন , ‘আপনার স্বামী যে মেয়েটিকে রোজ দেখছেন, তা এক ধরণের

হ্যালিউসিনেশন, বাংলায় এটাকে বলে অমূল প্রত্যক্ষ।‘ বিএ পড়ার সময় রেহেনার ফিলজফি

সাবজেক্ট ছিল। সে অমূল প্রত্যক্ষ কাকে বলে জানে। ডাক্তার হোসেন কথা বলতে থাকেন,

‘এই ধরনের হ্যালিউসিনেশন, বেশ বিরল। এটা সেন্সারি ডেপ্রিভেশন বা পারসেপচুয়াল

আইসোলেশন থেকে হয়। ছোটোবেলায় ও যেভাবে বড়ো হয়েছে, যে ঘেরাটোপের মধ্যে, তাতে ওর

খুব সহজাত চাহিদাগুলোকে গলা টিপে মারা হয়েছে। আর সেই গলা টিপে খুন করাটাকে ধর্ম দিয়ে

সাপোর্ট করা হয়েছে। আজ ওর চাক্ষুষ অমূল প্রত্যক্ষ হচ্ছে, এমন হতে পারে যে কাল ওর

ঘ্রাণজ, পরশু ওর শ্রবণগত অমূল প্রত্যক্ষও হবে। আমরা চেষ্টা করব সেটা যাতে না হয়।

পর্দা দিয়ে সব কিছু ঢেকে রাখতে নেই। পর্দার অন্য প্রান্তকে জানার ইচ্ছা সকলের থাকে।“

(তদেব, পৃ. ৮৮)

নতুন শতাব্দীতে এসে নবীন প্রজন্মের গল্প লিখেছেন শামিম আহমেদ। মুসলিম জীবনের ইতিবৃত্ত লিখতে গিয়ে বেশিরভাগ লেখকই গ্রামীণ জীবনকে প্রেক্ষাপট হিসেবে বেঁছে নিয়েছেন। শামিম আহমেদ গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি শহরের জীবন নিয়ে যেমন লিখেছেন তেমনি তাঁর গল্পে ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্ল্ডের প্রসঙ্গও এসেছে । আসলে মুসলিম জীবনেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় কীভাবে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, মুসলিম নারীরাও কীভাবে বোরখার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে তা তিনি দেখিয়েছেন। ‘মধুবালা’ গল্পে রায়হানের বয়স চল্লিশ। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে গেছে তবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেনি। 
এই রায়হান অবসর সময় অতিবাহিত করে ফেসবুকে বসে। এক সময় নারীসঙ্গের লোলুপতা জাগে,ফেসবুকেই নারীদের সঙ্গে পরিচয় হয় তবে কেউই পছন্দ হয় না। একদিন সে স্বপ্নে দেখে সাতাশ জন মহিলা এসে তাঁকে থাপ্পর মারছে। এ কথা বন্ধুকে জানাতেই সে এক পিরবাবার ঠিকানা দেয়। কিন্তু ধর্মের নামে ব্যবসা যে নিছকই ভণ্ডামী তাও লেখক দেখিয়ে দেন। এমনকি বন্ধু জানায় সেও তান্ত্রিককে সমস্ত বিষয়টা বলে সমাধন করেছে। বন্ধুই রায়হানকে পরামর্শ দেয় ফেসবুক প্রোফাইলে নিজের নাম পাল্টে দেবার। রায়হান হয়ে যায় আজাদ চৌধুরী। সেখানে পরিচয় হয় মাহমুদা বানু নামে এক মহিলার সঙ্গে। দুজনে সাক্ষাতও করে। কিন্তু মাহমুদা নিজেকে বোরখার আড়ালে বন্দি করে রাখে। এই মাহমুদাই ছিল রায়হানের পূর্বের স্ত্রী। দুজনের সাক্ষাতেই গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে। এ গল্পে নিয়তিবাদের প্রসঙ্গে যেমন এসেছে তেমনি প্রেমের ক্ষেত্রে যে দর্শনই প্রধান কথা নয় তাও লেখক দেখান। আজকের যুগে মানুষ যেকোন পরিস্থিতে অপরের প্রতি টান অনুভব করছে, সম্পর্কের বিচ্ছেদই যেন মানুষকে অপরের কাছে অতি দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে। বোরখা পড়া মাহমুদাকে যখন দেখতে পারছে না রায়হান, খেয়ে বিদায় নেবার জন্য ব্যস্থ হয়েছে তখনই মাহমুদা বলে ওঠে –“আচ্ছা, আপনার কি খুব খিদে পেয়েছে ? পেটের, না চোখের ? এই দেখুন।“ (তদেব, পৃ. ১০৮)
‘ঈশ্বরের কন্যা’ গল্পটি গড়ে উঠেছে এক অবলা নারী বাত্যকে নিয়ে, যে কম কথা বলে। একটি নারীকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মানুষের বিভিন্ন মানসিকতাকে লেখক তুলে ধরেছেন। আসলে গ্রামীণ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে খুব সহজেই বিষয় হয়ে ওঠে নারী। নারী হয়ে জন্মানো যেন সে সমাজে পাপ ! বাত্যকে কেউ সাহায্য করেনি, সে নিজেই ফুলুড়ি বিক্রি করে জীবন অতিবাহিত করে। তবে সে বিশেষ কথা বলে না, সমস্ত ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দেয়। এই বাত্যর দোকানে ফুলুড়ি কিনতে এসেছিল এক আলকাপের মাস্টার। সে বাত্যকে তাঁদের দলে নিতে চায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের মহিউদ্দিন, লালু, মুস্তাক সবাই গল্পের ডালি সাজিয়ে নিয়ে বসেছে। বাত্যর দোকানে যখন আলকাপ মাস্টার এসেছিল তখন উপস্থিত ছিল মুস্তাক। আজ গল্পের আসরে সেই বক্তা, অন্যরা শ্রোতা।


( ২ )
শামিম আহমেদের ‘বিলকিস বেগমের পতনজনিত আখ্যান ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থটি ভাষাবন্ধন প্রকাশনী থেকে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। নাম গল্প –‘বিলকিস বেগমের পতনজনিত আখ্যান’। শামিম আহমেদ মিথের রাজ্যে বিচরণ করেন। ইসলাম জীবনের নানা পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মীয় মিথকে সামনে রেখে তিনি তাঁর গল্প বলয় গড়ে তোলেন। ফলে বিশ্বাস –অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, সামাজিক প্রথায় পিষ্ট মানুষের যন্ত্রণা ও প্রথাকে অতিক্রম করে ব্যক্তি মানুষ কীভাবে বেরিয়ে আসে তা তিনি দেখান। বিলকিস বেগম আনার গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছেন, এমনকি গাছের ডালও ভেঙে গেছে। এই কেন ধাক্কা খেলেন তা আবিষ্কার করতে গিয়ে নানা লোকবিশ্বাস উঠে এসেছে, যা বিলকিস অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। সমস্ত জিনের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তিনি নানা তাবিজ গড়ে রেখেছিলেন। বিলকিসের সংশয় প্রবল হয় পুত্র হুমায়ুনের বিবাহকে কেন্দ্র করে। বাড়ির সদর দরজায়, গাছে , শোবার ঘরে নানা তাবিজ ঝুলিয়ে রেখেছেন যেন জিন না আক্রমণ করতে পারে।
অথচ সে যখন পড়ে যায় তখন সদর দরজায় কোনো তাবিজ ঝুলতে দেখেনি। ফলে তাঁর সংশয় আরও প্রবল হয়। কেননা চল্লিশ বছর ধরে তিনি প্রতিনিয়ত নামজ পড়ার পরও কেন এমন পাপ হবে। আজ সে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে, অপারাশন হবে। আজ আর কোনো উত্তজেনা নেই বিলকিসের, কোনো সংশয় সে রেখে যেতে চায় না, জীবনের ইতিবৃত্ত যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে –“বিলকিস বেগমের দুচোখ বেয়ে নহরের ধারা নেমে আসে। পানিতে টইটম্বুর চোখের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখেন, বিলকিস বানু ডুবে যাচ্ছেন এক গভীর সমুদ্র, অতল সেই সাগরের নীচে বড়ো প্রশান্তি।“ ( বিলকিস বেগমের পতনজনিত আখ্যান ও অন্যান্য গল্প, সৃষ্টিসুখ, ২০১৬, পৃ. ১২ ) এক অনন্ত শান্তির খোঁজে এগিয়ে গেছে বিলকিস। শামিম গল্পে ছবি আঁকেন। প্রথম চৌধুরী লিখেছিলেন –‘’ সাহিত্য হচ্ছে অর্ধেক সঙ্গীত, অর্ধেক চিত্রকলা’ ( আত্মকথা )। গল্পেও সে ছবি ফুটে ওঠে। শামিম একটি ছবির মতো যেন সব ভাসিয়ে নিয়ে যান। তবে সেই ছবিতে পাঠক ডুবে যাননা। পাঠক যখন কাহিনিতে অর্ধমগ্ন হয়ে পরে তখনই তিনি একটি বাঁক আবিষ্কার করেন। জীবনের যে গভীর সত্যবলয় আবিষ্কারের জন্য তিনি কাহিনির উপনিবেশ গড়ে তুলেছেন সেই জগতে নিয়ে যান।
গ্রামীণ মুসলিম জীবনে প্রেম আজও তেমনভাবে স্বীকৃত হয়নি। আর সে প্রেম যদি অবৈধ প্রেম হয় তবে তা আরও ভয়ংকর। তবে যৌবন শেষ হলেই তো প্রেম মরে যায় না, মানুষের জৈবিক প্রবৃত্তিগুলি শেষ হয়ে যায় না, লেখক সেই প্রবণতার ওপর জোড় দিয়েছেন ‘রশিদা বেওয়ার কিস্‌সা’ গল্প। ভারতীয় সাহিত্যের যে ধারা লেখক সেদিকেই নজর দিলেন। ‘কিস্‌সা’ নামের অন্তরালে বাস্তবতার আখ্যান তিনি গড়ে তোলেন। কিন্তু সেই বাস্তবতাকে সরাসরি ফুটিয়ে তুলতে চাননা। রশিদা বেওয়ার স্বামী মৃত হয়েছে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। পুত্ররাও থাকে বাইরে। এই অবসর জীবনে সে প্রেমে পরে যায় লোহা মাস্টারের। লোহা মাস্টারও হাত বারিয়ে দেয়। কিন্তু এই দুই প্রৌঢ়ের প্রেম মেনে নিতে পারেনি সমাজ। ফলে গ্রাম থেকে বিতাড়িত হতে হয় লোহা মাস্টারকে। কিন্তু সময় কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে তা লেখক দেখান। ধর্মীয় বিশ্বাসের রন্ধে রন্ধে বর্তমান সময় প্রযুক্তি কীভাবে প্রবেশ করে যাচ্ছে তা দেখান। লোহা মাস্টার বিদায় নেবার সময় রশিদাকে দিয়ে গেছে এক ফোন। কেননা চিঠির দিন আজ শেষ। আজ রাতের অন্ধকারে রশিদা নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়েছে, আজ আর অভিসারে যাবার সুযোগ নেই। কিন্তু ফোন বুকে আক্রড়ে ধরেই সে যাবতীয় ইচ্ছা প্রকাশ করতে চেয়েছে। একদিকে গোষ্ঠী অন্যদিকে ব্যক্তি মানুষের প্রেম। গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়েছে ব্যক্তি প্রেম। তবে এর মধ্যেও জয়ের আভাস আছে। রশিদা হয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে যেতে পারবে। তবে অনুশোচনাও আছে। রশিদা ভেবেছে তাঁর জন্যই আজ গ্রাম থেকে উৎখাত হতে হয়েছে লোহা মাস্টারকে।
আজকের ছোটোগল্পে জাদুবাস্তব প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে। ব্যতিক্রম নয় শামিম আহমেদও। আসলে আজ এমন সময় এসেছে লেখকরা বাস্তবকে অতিবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। শামিম আহমেদের ‘কবর’ গল্প গড়ে উঠেছে ছবিলার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এ গল্প পড়তে গিয়ে মনে পড়ে মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের ভক্তপ্রসাদকে। তবে হানিফের শিষ্টাচার থেকে এ গল্পে রহিম হাজির শিষ্টাচার আরও প্রবল। ভোররাতে মারা যায় পাতুকির স্ত্রী ছবিলা। পাতুকি সেই মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে বার হয়েছে। সেই সঙ্গে তো স্ত্রীর দাফনও করতে হবে। ফলে সে যায় গ্রাম্য মাতব্বর রহিম হাজির কাছে। এই রহিম হাজির সঙ্গে ছবিলার একটি সম্পর্ক থাকলেও পাতুকি জানে রহিম আসে রাতে, আর ছবিলা মারা গেছে ভোর রাতে, ফলে রহিমের ওপর তাঁর ক্ষোভ নেই। এই রহিমই ছবিলার কবরের ব্যবস্থা করেছে। সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ায় পর পাতুকির মনে আবার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে নিবিষ্ট হয়। আর এই পর্বে এসেই লেখক গল্পকে জাদুবাস্তবতার আড়ালে মুড়ে দেন। মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য উঠে আসে পাতুকি ও বটপীরের সংলাপে। রহিম গাজি ছবিলার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে বাড়ি ফেরার সময় সঙ্গে গিয়েছিল ছবিলার বাড়ির সাধারণ পুরুষ কুকুর। সে কুকুর রহিম গাজির পোষা নারী কুকুরের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করেছিল, যা মেনে নিতে পারেনি রহিম গাজি। ফলে সে ছবিলা কুকুরকে মারতে বিষ নিয়ে এসেছিল। ছবিলা বাধা দিলে রহিম তাঁকে মুখ বন্ধ করে হত্যা করে, সেই সঙ্গে কোলের শিশুকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়, সেই টাকাতেই আজ ছবিলার কবর হয়েছে-

“পাতুকি ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। আর তার শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্য থেকে অজান্তে একটি

আওয়াজ বেরিয়ে আসে, ‘আচ্ছা পীরবাবা, ছবিলার ব্যাটার কী হল ? সে তো দুধের বাচ্চা, সে

কোথায় গেল ?’

‘তার ব্যবস্থাও রহিম করে দিয়েছে রে। হুব্বা রতনের কাছে তাকে চার হাজার টাকায় বেচে

দিয়েছে হাজি, সেই টাকাতেই তো দাফন হল ছবিলার , ছবিলার খানাপিনাও।‘ (তদেব, পৃ. ২৬ )

এক ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি লেখক আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন। এক নষ্ট সময়ের মধ্য দিয়ে আজ

মানুষের মূল্যবোধ পর্যবসিত হচ্ছে। ঘুণধরা সমাজে মানুষের বিবেক কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে

নেমে গেছে তা লেখক দেখান। যে রহিম অপরের স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গে মত্ত হতে পারে সেই

রহিমই নিজের কুকুরের যৌন সংসর্গ মেনে নিতে পারেনি। সে এ গ্রামের নামজাদা লোক। মধুসূদন

ভক্তপ্রসাদের শাস্তির ব্যবস্থা করলেও রহিমরা আজ রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। আসলে এক নষ্ট সময়ের

মধ্য দিয়ে আজকের সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে অপরাধী খুব সহজেই আশ্রয় খুঁজে নিতে পেরেছে।

মুসলমি শ্রেণিজীবনকে সামনে রেখে লেখক সময় যন্ত্রণাকে বড় করে তুলেছেন। ধর্মান্ধতার কাছে

পরাজিত হতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। এ থেকে উত্তরণের পথ বা প্রতিবাদ যে নেই তা নয়। কিন্তু সবাই

প্রতিবাদ করতে পারেনা, শ্রেণিকে অতিক্রম করে ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা ভয়ংকর, মৃত্যু হলে তা

আরও যন্ত্রণার। সেই যন্ত্রণার মর্মকথা লিখে যেতে হয় লেখককে।
সময় থেমে থাকে না, থাকা সম্ভবও নয়। যৌবন বসে থাকে না, কালের নিয়মে তা অতিবাহিত হবেই। আজকের বিশ্বয়নের যুগে মানুষ নিজের যৌবনকে নানা ভাবে ধরে রাখতে চাইছে। ভায়গ্রা স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাইছে। অমর মিত্রের ‘ব্ল্যাকম্যাজিক’ গল্পে দেখেছিলাম নবীন প্রজন্ম কীভাবে নিজের যৌবনকে ধরে রাখতে চাইছে। শামিম আহমেদের ‘মেহেবুব হাসানের যৌবন’ ব্যাঙ্গাত্মক ঢঙে লেখা সমাজ সত্যের বার্তাবাহক। তেমনি রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে আঘাতের চেষ্টা। মেহেবুব আজ নিজের যৌবন খুঁজে পেতে চেয়েছে। এজন্য সে নানা কবিরাজি চিকিৎসা ও মৌলবীদের পরামর্শ নিয়েছে। কিন্তু শেষে নিজেই উপলব্ধি করেছে এসমস্তই ধাপ্পাবাজি বন্দেবস্ত। কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসক রব্বানি হাকিমের কাছে গিয়ে সব ধারণা ভেঙে গেছে। আজ মেহেবুব নিজের হারানো যৌবনের কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে, তা নিয়েই এ গল্পের আখ্যান গড়ে উঠেছে।


লেখক পর্বে পর্বে তিনটি কারণ অনুসন্ধানে অগ্রসর হয়েছেন। প্রথমে ব্যবসায়ে ক্ষতি, পার্টনার

ইয়ার আলির শত্রুতা, দ্বিতীয়ত স্ত্রী রুকসনা বেগমের স্বামীকে অযন্ত্র, তৃতীয়ত স্ত্রীর অযত্নের

ফলে মেহেবুবের বাইরে থাকার ফলে জিনে পাওয়ায় শরীর ভেঙে যায়। মেহেবুব একসময় স্ত্রীর

অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েছিল আজ যৌবন হারিয়ে সে স্ত্রীকে নিজেই অত্যাচার করেছে। বাস্তবের

যৌবন হারিয়ে সে আজ কল্পনায় যৌবন ফিরে পেয়েছে-


“এই সুন্দর শহরের নাম কি মোরাদাবাদ ? মেহেবুব হাসানের মনে প্রশ্ন জাগে। জিনিয়া কোনও

উত্তর দেয় না, কেবল হাসতে থাকে। আর মাঝে মাঝে গান গাইতে থাকে। মেহেবুব হাসান শরাব

পান করতে থাকেন। জিনিয়া জিন নয়, জ্যান্ত হুরি। নেশার ঘোরে মেহেবুব জিনিয়াকে জড়িয়ে

ধরতে গেলেই, সে হিন্দি সিনেমার নায়িকার মতো পিছলে পিছলে যায়। শুধু তার প্রগলভ হাসি

বাজতে থাকে। জিনিয়া, ‘এ হল তৃতীয় আশমান, এখানে কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না, ধরতে পারে

না। শুধু সুরে সুরে শাদি মুবারক পালন করি।‘ মেহবুব হাসান নব বিবাহের আনন্দে বিহ্বল হয়ে

তৃতীয় আশমানে লুটিয়ে পড়েন।“ (তদেব, পৃ. ৩৩ )


শামিম আহমেদ সাধরণ কাহিনি নিয়ে গল্প লিখলেও তাঁতে মিথ, ধর্মীয় অনুসঙ্গ, লোকাচার বিশ্বাস এনে এমন এক আখ্যান গড়ে তোলেন যা বাংলা গল্পে বিশেষ দেখা যায় না। তবে মিথের ভারে গল্পের কাহিনিকে শিথিল করে তোলেন না। গল্পের মধ্যেই টুকরো টুকরো মিথের অনুসঙ্গ, বিশ্বাস-সংস্কারের দ্বন্দ্ব দেখিয়ে মুসলিম জীবনে পরিবর্তিত সময়কেই চিহ্নিত করতে চান। আর সে চিত্রণে তিনি যে সফল কারিগর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘আলাদিনের চেরাগ ও মাজারের দৈত্য’ গল্প গড়ে উঠেছে রজব আলির

বিবাহকে কেন্দ্র করে। পিতা হুরমান আলি দুই কন্যার বিবাহতে যা খরচ করেছিল তা তুলতে চেয়েছে

পুত্র রজব আলি ও মিরাজের বিবাহ দিয়ে। কিন্তু এ সংসারে কন্যার সঙ্গে কেউ অর্থ দিতে রাজি

হয়নি। ফলে রজব আলির বিবাহ হয়নি, এমনকি তাঁর বিবাহ নিয়ে গ্রামের লোক নানা লাঞ্ছনা করেছে।

গ্রামের অন্য ছেলেরা পরিবারের নির্দেশ উপেক্ষা করে বিবাহ করলেও রজব আলি পারেনি। আসলে

তাঁর সে সাহস ছিল না। ফলে দিনে দিনে তাঁর যৌবন যেমন অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে তেমনি নানা গঞ্জনা

শুনতে হয়। শেষে সে নামাজ পড়া শুরু করেছিল, কেননা আল্লা যদি তাঁর প্রতি দৃষ্টি দেয়। তবে কোন

কিছুতেই রজব আলির বিবাহ হয়নি। তবে বিবাহ না হওয়ার জন্য পিতা হুরমান আলির কোন অনুশোচনা নেই, তিনি বিবাহ মানে বোঝেন অর্থ। এই পর্যন্ত এসেই শামিম গল্পকে নিয়ে যায় জাদুবাস্তবতায়। এক অলৌকিক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে গল্পের পরিণতিতে পাঠককে উপনীত করেন। আজ রজব গাঁজা খেয়ে দশ টাকার নোট চিমটে খাদিমের কাছে দিয়ে বলেছিল ‘শাদির লাগি’। কিন্তু কার বিবাহ তা পরিস্কার নয় ! হয়ত নিজের বিবাহের জন্যই সে এই টাকা সঞ্চয় করেছিল। গ্রামের কেউ কেউ যেমন পরিবারের সঙ্গে বিদ্রোহ করে নিজের ইচ্ছাতেই বিবাহ করেছে তা রজব আলি না পেরে আজ যেন ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে। সে গাঁজা খেতে এক গান শোনে, যা তাঁর মনে হয়েছিল বিবাহের গান। কিন্তু আসলে তা ছিল মৃত্যুর গান। এই পর্যন্ত এসে পাঠকের মনে পড়তে পারে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘দুইবার
রাজা’ গল্পের কথা। সে গল্পের নায়কও দু’বার রাজা হয়েছিল এক বিবাহের সময় আর মৃত্যুর সময়। আসলে প্রতিটি মানুষই জীবনে দু’বার রাজা হয়। এ গল্পের রজব আলি বিবাহ না করে বিবাহের গান শুনেছে, যা ছিল প্রকৃত অর্থে মৃত্যুর গান। লেখক জীবন ও মৃত্যুকে জাদুবাস্তবতার মোড়েকে মুড়িয়ে দিয়েছেন, আর সেখানে উঁকি দিয়েছে মিথ। লেখক নিজেই এক মায়াজাল রচনা করেছেন যার মধ্য দিয়ে তিনি পাঠককে নিয়ে যান অন্তিম সত্যে । ভবিষ্যতের সন্তানের জন্য সে প্রার্থনা করেছে, যদিও তাঁর কোনো সন্তান নেই, আর কোনো পিতার সন্তান হয়েও সে বেঁচে থাকতে চায়নি-
“গাঁজার নেশায় বিভোর রজব আলি এ বার স্পষ্ট দেখে তার দিল খণ্ড –খণ্ড হওয়ার পর চালের

আটার মতো গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে, আর তারপর সেই সফেদ কাফন –রঙা হৃদয় গাঁজায় ধোঁয়ার

ভিতরে সে দেখে, এই মাজার যেন আলাদিনের চেরাগ, আর চিমটে খাদিম এই চেরাগের ভিতরের

দৈত্য। ওই আশ্চর্য দৈত্য তাকে নিয়ে যাচ্ছে সাদা থান-পরিহিতা এক রমণীর কাছে, যার সঙ্গে

তার বিয়ে হবে মরণের পারে। না-জন্মানো সন্তানের জননীকে দেখে রজব আলি বেশ মুষড়ে পড়ে।

তার নিঃশব্দ কান্নার ভেতর থেকে, মা বটের ঝুরির নিঃসঙ্গতা থেকে সে জানে না, তার আজ

–সন্তানের উদ্দেশ্যেই ভেসে আসে একটা স্বর, না আয়াত-‘লাম ইয়া আলিদ, ওয়ালাম

ইউলাদল।‘ না তার কোনও সন্তান আছে, আর না সে কারও সন্তান।“ (তদেব, পৃ. ৮৯ )
এক ভয়ংকর জীবন সত্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় এ গল্প। কাহিনি হারিয়ে যায় এক আশ্চর্য রূপকে। গল্পহীনতার দিকে লেখকের প্রবল ঝোঁক। যেন তিনি গল্পহীন গল্প নির্মাণ করতে চান। শামিমের গল্পগুলির একটি ভিন্নপাঠ আবিষ্কার করা যেতে পারে। আমরা যেহেতু মুসলিম জীবন নিয়ে আলোচনায় অবগত হয়েছি ফলে সেই জীবনকে বারবার ধরার চেষ্টা করেছি। সেই জীবনকে সামনে রেখেও শামিম এগিয়ে গেছেন গল্পের এক নতুন পথে। জমির লড়াই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক

মানচিত্রে একটা বড় রকম পরিবর্তন দেখা গেছে। সরকার কৃষকের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছাকেই কায়েম করতে চেয়েছে। পক্ষ-বিপক্ষ বা সত্য-মিথ্যা নয় বিষয় হল রাষ্ট্র সবসময় প্রজার ওপর অত্যাচার চালায়। নিজের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে বলি দিতে হয় প্রজার স্বার্থ। ভারতবর্ষে এই শোষণ হয়ত চিরদিনই চলবে, মাঝে মাঝে প্রজা রুখে দাঁড়ায়, শুরু হয় বিদ্রোহ। স্বাধীন ভারতেও এই প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ রয়েছে, কৃষক আন্দোলন রয়েছে। শামিম আহমেদের ‘জিহাদ’ গল্প গড়ে উঠেছে জমি দখলের লড়াইকে কেন্দ্র করে। তবে কৃষকের জয়ে গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে। গ্রামে কাল ইদ উৎসব। সবাই উৎসবে মত্ত। ইতিমধ্যেই ডাকপিওন খবর দিয়ে যায় দক্ষিণ মাঠের সব জমি সরকার নিয়ে নেবে। সবার নামে চিঠি আসে। কিন্ত সবুর আলি ভাগচাষি বলে তাঁর নামে কোনো চিঠি

আসেনি। হয়ত সে জমি হারাবে। রকত, নাসির কেউই জমি দিতে চায়নি। আসলে ‘চাষার জমি চাষার হৃদয়’। হৃদয় থেকে সে ভালোবাসা নিমূল করতে চায়না। পরেরদিন সকলে মসজিদে মিলিত হয়েছে, মৌলবী সাহেব সকলকে পরামর্শ দিয়েছে যে সবার অধিকার। আর সেই অধিকার লড়াইয়ে মুসলিম পুরাণকে প্রবেশ করিয়ে দেন লেখক। দোজখ, ফেরেশতা, আজরাইলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মৌলবী জানান মুসলমান কেতাবের শুরুতে থাকে ‘আলিফ’ অক্ষর, যা দেখতে একটি লাঠির মত, তা বিদ্রোহের প্রতীক।

দ্বিতীয় অক্ষর হল ‘বেরাদারে ইসলাম’ এর ‘বে’। এই ‘বে’ অক্ষরকে উল্টিয়ে ধরলে হয় কুঁড়ে ঘর। তাই মৌলবীসাহেব সকল কৃষককে পরামর্শ দিয়েছেন লাঠি নিয়ে জমির পাশে কুঁড়ে ঘর তৈরি করে থাকতে, নিজের অধিকার রক্ষা করতে –“আপনারা আমাদের জমির পাশে কুঁড়েঘর বানান। বিবি-বাচ্চাকে ছেড়ে জমিতেই থাকুন। কোনও মালাউন আপনাদের জমি কাড়তে পারবে না। ওই মাঠেই আপনাদের অনেকের বাপ-দাদোর কবর। শবেবরাতে ওই মাঠেই জ্বলে ওঠে সার-সার চিরাগ আর লুবান কাঠি। আপনারা লড়াই ছাড়বেন না। এই লড়াই আল্লা পথে লড়াই। আর এটাই হল জিহাদ, আস্‌লি জিহাদ। আসুন আমরা সকলে মোনাজাতে বসি।“ (তদেব, পৃ. ৯৫ )
ধর্মহীন কোন মানুষ হতে পারেনা। ব্যক্তির সত্তা ধর্মীয় বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও সমষ্টি তা নানাভাবে আক্রড়ে ধরে, অত্যাচার চালায়। এই সমষ্টির বাইরে কোন মানুষ নয়। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ। সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তির যে আত্মযন্ত্রণা তা লেখক ধরতে চেয়েছেন। প্রত্যেক লেখকের একটি নির্দিষ্ট গল্প বলয় বা গল্প বলার কৌশল থাকে। শামিম আহমেদেও গিয়েছেন মিথের জগতে। সেখান থেকে নিজস্ব গুণে গল্পের উড়ান দিয়েছেন। প্রয়োজনে জাদুবাস্তব, অধবাস্তব ব্যবহার করেছেন। মুসলিম জীবনে এত মিথ আছে, ধর্মের এতো রহস্যজাল আছে যার সঙ্গে বঙ্গীয় পাঠকের তেমন পরিচয় নেই। শামিম আহমেদ সেই জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়েছেন। নিজে দর্শনের মানুষ বলেই ব্যক্তির আত্মাভিমুখী সত্তাকে আবিষ্কার তাঁর পক্ষে খুব সহজ হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ