কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা স্মরণে--

লুতফুন নাহার লতা

 ৫ ই জুন স্প্যানিশ কবি, নাট্যজন- লোরকার জন্মদিন। ১৮৯৮ সালের ৫ ই জুন স্পেনের গ্রানাডা শহর থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে ফুয়েন্তে ভাকুইয়েরোস নামে একটি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন তিনি।

বেড়ে উঠতে উঠতে দেখেছিলেন দিগন্ত জোড়া এসপ্যারাগাস ক্ষেতের আইল আর শুনেছিলেন জলপাই বনের উদাস হাওয়ায় আপেল ঝরার গান! স্প্যানিশ রীতি অনুসারে ওর পিতৃ বংশের পদবী আগে গার্সিয়া আর মাতৃ বংশের পদবী পরে লোরকা নিয়ে ওর নামকরন হয়েছিল। ফেদেরিকো দেল সাগ্রাদো কোরাজন দে জেসাস গার্সিয়া লোরকা। দীর্ঘ এই নামের জাল কেটে বেরিয়ে এসে পরিচিতি হয়েছিলেন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা নামে।

লোরকার বাবা ফেদেরিকো গার্সিয়া রদরিগেজ ছিলেন একজন শিল্পপতি। পাহাড়ী উপত্যকায় বিশাল জায়গাজমিতে নানা রকম চাষবাস ও বিশাল চিনিশিল্প গড়ে তোলেন তিনি। মা ভিসেন্তা লোরকা রোমেরো ছিলেন শিক্ষক।

সেসময়ে আধুনিক শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে, ইউরোপিয়ান মুভমেন্টের ফলে সুররিয়েলিজম, ফিউচারিজম ও সিম্বলিজম একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। স্পেনেও তৎকালীন কবিরা স্প্যানিশ সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই মুভমেন্ট করতে জেনারেশান ২৭ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সার্থকতার সাথে স্প্যানিশ সাহিত্যে এর প্রয়োগ শুরু করেন। এতে করে স্প্যানিশ সাহিত্য এই নতুন ধারায় ব্যাপক উৎকর্ষ লাভ করে। গার্সিয়া লোরকা জেনারেশান ২৭ এর সদস্য হিসেবে স্প্যানিশ সাহিত্যে তার অবদানের জন্যে বিশেষ ভাবে সম্মানিত হন।

প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করে ১৯১৫তে গার্সিয়া লোরকা ইউন্যুভার্সিটি অব গ্রানাডাতে ল, লিটারেচার এবং মিউজিক কম্পোজিশানের উপর লেখাপড়া করেন। সাহিত্য ও সংগীতের উপরে তার আকর্ষনের প্রাবল্য তাকে নিয়ে গেছে বিখ্যাত সব সঙ্গীতজ্ঞের কাছে। এন্তোনিও সেগুরা মেহা ছিলেন তাদের একজন। সংগীতের প্রতি নিবেদিত লোরকা ১৯১৬ তে তার সংগীতজ্ঞ গুরুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লেখালিখির জগতকে প্রাধান্য দেননি কিন্তু পরবর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের উৎসাহে এবং বাবার অর্থে ১৯১৮তে ইমপ্রেশানস এন্ড ল্যান্ডেস্কেপ্স নামে তিনি তাঁর প্রথম বই প্রকাশ করেন , Impresiones y Paisajes (Impressions and Landscapes) পরের বছর ১৯১৯ এর দিকে তিনি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শুরু করেন এবং মাদ্রিদের বিখ্যাত কবি শিল্পী সাহিত্যিকের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে এদের মধ্যে লুইস বানুয়েল, সাল্ভাদর দালি ও কবি উয়ান রেমন জিমেনেজ অন্যতম।

এই ১৯২০, ২১ এর দিকেই সম্পৃক্ত হন স্টেজ থিয়েটারের সাথে এবং লেখেন তাঁর প্রথম থিয়েটার প্লে, দ্যা বাটারফ্লাইস ইভল স্পেল। El maleficio de la mariposa (The Butterfly's Evil Spell). লোরকার কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। কবিতা, সংগীত সাহিত্য ও আইন এর পাশা পাশি নাটক লিখতে থাকেন নিরলস। ১৯২৭ সালে বার্সেলোনাতে সালভাদর দালির মঞ্চ ব্যাবস্থাপনায় তার দ্বিতীয় নাটক ‘মারিয়ানা পিয়েদা’ একটি বিশাল সাফল্য বয়ে আনে।

১৯৩০ এর দিকে মঞ্চস্ত হয় ‘দ্যা সু মেকার্স প্রডিজিয়াস ওয়াইফ' The Shoemaker's Prodigious Wife, ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত সালভাদর দালির সাথে একান্ত বন্ধুত্ব থাকলেও ১৯২৮ এরপরে জিপসি ব্যালাড যখন চুড়ান্ত সার্থকতা আনে তখন দুর্ভাগ্যক্রমে দালি ও লুইস বানুয়েল এর সাথে তার সম্পর্কের চিড় ধরে। এতে কবি মানষিক ভাবে বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েন। কবির পরিবার এসময় তার জন্যে আমেরিকায় এক দীর্ঘ সফরের ব্যাবস্থা করেন।

১৯৩০ এর শেষে তিনি আমেরিকা থেকে ফিরে আসেন স্পেনে এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে নাট্য নির্দেশক হিসেবে নিয়োগ পান স্টুডেন্ট থিয়েটার কোম্পানিতে। স্প্যানিশ ক্লাসিক থিয়েটার কে আধুনিক পোর্টেবল স্টেজ ও স্বল্প অভিনেতা ও প্রপস নিয়ে স্পেনের সাধারন মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে তাদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে বিনা মূল্যে নাটক প্রদর্শনের এই আয়োজন করা হয়েছিল যার অধিকাংশ নাটকের নির্দেশক ও অভিনেতা ছিলেন তিনি নিজেই।

এপ্রসঙ্গে কবি বলেন-"Outside of Madrid, the theatre, which is in its very essence a part of the life of the people, is almost dead, and the people suffer accordingly, as they would if they had lost their two eyes, or ears, or a sense of taste. We [La Barraca] are going to give it back to them"

সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে নাটককে তিনি দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ স্থান। নাটক দিয়ে মানুষের জীবনের ও সমাজের ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব বলে বিশ্বাস ছিল তাঁর, তিনি লিখেছিলেন- "The theatre is a school of weeping and of laughter, a free forum, where men can question norms that are outmoded or mistaken and explain with living example the eternal norms of the human heart"

নাটক নিয়ে মানুষের কাছে ঘুরে বেড়াবার সময় তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত নাটক গুলি the Rural Trilogy of Bodas de Sangre (Blood Wedding), Yerma and La Casa de Bernarda Alba (The House of Bernarda Alba), এসব নাটক ছিল প্রতিবাদী। তৎকালীন সমাজে ইউরোপিয়ান নাটকের জনপ্রিয় ড্রয়িংরুম কমেডি বদলের বা সমাজে নারীর গ্রহনযোগ্য অবস্থান প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রতিবাদ। জীবনের সাথে কোথাও তিনি কবিতা ও নাটকের অনুভবে একান্ত একাত্বতার কথা অনুধাবন করেছিলেন। তাই কবি তার কবিতা ও নাটক সম্পর্কে বলেন- “theatre is poetry that rises from the book and becomes human enough to talk and shout, weep and despair.”

১৯৩৬ পর্যন্ত মাঝে মাঝেই কবি ফিরে এসেছেন স্পেনে তার অতি প্রিয় নির্জন সামার হাউস’ উয়ের্তা দে সান ভিসেন্তে’ এখানেই তিনি লেখেন বিখ্যাত When Five Years Pass (Así que pasen cinco años) (1931), Blood Wedding(Bodas de sangre) (1932), Yerma (1934) and Diván del Tamarit (1931–1936)

গার্সিয়া লোরকার জীবন, কাব্য, নাটক, সংগীত ও ছবি আঁকা সকলি ব্যাহত হয়ে ওঠে ১৯৩৪ এ যখন স্পেনের রাজনৈতিক অঙ্গনে অশনি সঙ্কেত দেখা দেয়। সেখানে দক্ষিন পন্থী সরকার গঠিত হয়। এসময়ে কবি মেক্সিকোতে অভিবাসন নেবার কথা চিন্তা করেন। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই গার্সিয়া লোরকার ভ্রাম্যমান নাটকের দলটি একরকম বন্ধ হয়ে যায়। তারা ১৯৩৪ এর এপ্রিলের পরে আর কোন শো করতে পারেনি।

কবির বন্ধু উয়ান ডুভাল লেখেন ১৯৩৬ এর সামারে গার্সিয়া লোরকার সাথে তার দেখা হয় ফ্রান্সের লিয়নে। তিনি তখন মেক্সিকো থেকে ফিরেছেন তাঁর মিউজিক্যাল থিয়েটার কোম্পানি সাথে নিয়ে। যা কিনা স্পেনের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। স্পেনে তখন স্প্যানিশ রেভুল্যুশান শুরু হতে চলেছে। আপন স্বদেশ আর তখন নিরাপদ নয় কবির জন্যে। কিন্তু তিনি খুব ক্লান্ত থাকায় স্পেনে ফিরে কিছুদিন রেস্ট নিতে চেয়েছিলেন। ফ্রান্স ও স্পেন বর্ডারে কবির পাসপোর্ট চেকিং এর সময় দক্ষিনপন্থি সরকারের চর কবিকে চিহ্নিত করে, কবি সক্ষম হন সেযাত্রা স্পেনে না গিয়ে আবার ফ্রান্সে ফিরে আসতে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন স্পেনে নিজের বাড়ীতে ফেরার জন্যে। যদিও গার্সিয়া লোরকা জানতেন নব্য দক্ষিনপন্থি সরকারের হাতে বহু মুক্তমনা মানুষ ও নেতা নিদারুন হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন এবং তিনিও হবেন তাঁর লেখার ভেতরে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রকাশের জন্যে।

এসময় গ্রানাডার অবস্থা ভয়াবহ। গ্রানাডার মেয়রকে হত্যা করা হয়েছে। শহরে মেয়রহীন দিন কাটছে প্রশাসনের। হত্যা করা হচ্ছে অগনিত সমাজতান্ত্রিক নেতাকে। তারই মধ্যে কবি জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে ফ্রান্স থেকে গ্রানাডায় তার নিজ বাড়িতে ফিরে যান। ধরে নেয়া হয় বাড়ি ফেরার দুই একদিন পরেই কবির সামার হাউস থেকে ন্যাশনালিষ্ট মিলিশিয়া বাহিনী কতৃক ১৮ই আগষ্ট গার্সিয়া লোরকাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৯ শে আগষ্ট মাত্র ৩৮ বছর বয়সে কবিকে হত্যা করা হয়। কিন্তু কবিকে হত্যার সকল আলামত তারা নিশ্চিনহ করে ফেলে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি কবির দেহাবশেষ। ১৯৩৬ থেকে আজো পর্যন্ত কোন তদন্তই বের করতে পারেনি কবিকে কোথায় কিভাবে হত্যা করা হয়েছে।

হ্যাঁ কবিকে হত্যা করা হয়েছিল তার কবিতার জন্যে। কবিকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর নাটকের জন্যে। কবিকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার জন্যে। তাঁর মুক্ত চিন্তার জন্যে।

যুগে যুগে কালে কালে যে সকল মহামানবেরা দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্যে একটি নতুন সত্যের সন্ধান দিতে চেয়েছেন তাদেরকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। শত বিপরীত স্রোতে ভেসে জীবনের দামে মানুষকে জানিয়েছে অধিকার আদায়ের মন্ত্র।

কবিকে হত্যা করা হবে। কোথাও কোনদিন তাঁর দেহাবশেষ্টুকুও পাওয়া যাবে না তা কি কবি জানতেন! নইলে কেন লিখেছিলেন এ কথা!-----------

"Then I realized I had been murdered.
They looked for me in cafes, cemeteries and churches
.... but they did not find me.
They never found me?
No. They never found me."

রেফারেন্সঃ------------

From "The Fable And Round of the Three Friends",

Poet in New York (1929), Garcia Lorca

রেফারেন্সঃ----




লেখক পরিচিতি
লুতফুন নাহার লতা
অভিনেত্রী। গল্পকার। কবি। প্রবন্ধকার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ