ফারুক মঈনউদ্দীন সাহিত্যের বিবিধ শাখায় বিচরণ করেছেন। কথাসাহিত্য, ভ্রমণ-সাহিত্য, অনুবাদকর্ম, অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক লেখালেখি, প্রবন্ধ সহ শিল্পের নানা শাখায় তাঁর পদচারণা সমানতালে ঘটেছে। ভ্রমণ-সাহিত্য বিষয়ক লেখালেখিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ২০১৯ সালে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত জীবনানন্দের জীবন এবং সাহিত্য নিয়ে ক্লিন্টন বি সিলির গবেষণালব্ধ গ্রন্থ 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' এর বাংলা অনুবাদ -- 'অনন্য জীবনানন্দ’ গ্রন্থের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি 'আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার' লাভ করেন। অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক লেখালেখিতে লেখকের বিচরণের জায়গা পুঁজিবাজার এবং আর্থিক খাত।
ফারুক মঈনউদ্দীন নিজে ছোটগল্প লেখেন। স্বাভাবিকভাবে অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর কাছে ছোটগল্প প্রাধান্য পাবে। লক্ষণীয়, নিজের লেখা গল্পে যেমন, অনুবাদেও তিনি জটিল মনস্তত্ত্বের প্লটগুলো বেছে নেন। তাঁর অনুবাদকৃত গল্প নিয়ে 'দূর ভুবনের পাড়ে' চার মহাদেশের সাত গল্প নামে যে বইটি সম্প্রতি মলাটবন্দি হয়েছে, সেখানে মানব-মানবীর মনের গোপন অলিগলি, বাঁকাচোরা পথে সঞ্চরণ, অস্পষ্ট-ধূসর জিনিসকে আশ্রয় করে থাকা, দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, মানুষের যন্ত্রণা, তার হতাশা, স্বপ্ন-কল্পনাকে ঘিরে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠা গল্পগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। আমরা এখানে চারটি গল্প নিয়ে আলোচনা করব।

আমেরিকান কথাসাহিত্যিক স্টাইনবেকের ‘দ্য মার্ডার’ গল্পটি অনুবাদক ‘হনন’ নামে অনুবাদ করেছেন। জন স্টাইনবেক জীবদ্দশায় ১৬টি উপন্যাস এবং দুটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশ করেন। তাঁর লেখা 'দ্য গ্রেপস অব র্যাথ' উপন্যাসের জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এই বইটিকে তাঁর সেরা কাজের একটি বলা হয়। স্টাইনবেক আজীবন আমেরিকার সেন্টার ক্যালিফোর্নিয়াতেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানকার পারিপার্শ্বিকের যে-সমস্ত মানুষজন তিনি দেখেছিলেন, তাদের কথাই লিখে গেছেন নানান গল্প-উপন্যাসে। গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বিপুল ক্ষমতাধর এই লেখক নিজের অঞ্চলের লোকজনের গল্প বললেও তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। স্টাইনবেক ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
জিম পিতামাতার একমাত্র সন্তান। ক্যালিফোর্নিয়ার লুসিয়া পর্বতশ্রেণির এক উপত্যকার কাছে জিমের বাড়ি। এটি পুরোনো বাড়ি। পরিত্যক্ত আর ভূতুড়ে। পুরোনো বাড়িটিতে এখন আর কেউ থাকে না। জিম তার যুগোশ্লাভ স্ত্রীকে নিয়ে নতুন বাড়িতে থাকে। পুরোনো বাড়িতে বসবাস না করলেও এখানে কারো আসা-যাওয়া জিম পছন্দ করে না। এই বাড়ি ঘিরে স্ত্রী জেলকা সেপিককে নিয়ে একটি অদ্ভুত অতীত আছে তার। জেলকা সুন্দরী। জিমের শ্বশুর বিয়ের প্রথম রাতে বলেছিল, জেলকা আমেরিকান নয়, স্লাভ, মেরে ভূত তাড়াতে হবে তার। জিম অস্বীকার করেছিল, স্ত্রীকে মারবে না। ভদ্র, সুগৃহিনী, নরম স্বভাব জেলকার। বাড়িতে জেলকার আচরণ ছিল অসাধারণ। গরু চরিয়ে ঘরে ফিরে এলে জিমের জন্য ডিনার গরম করে বসে থাকতো জেলকা। জিমের সমস্ত গল্প মন দিয়ে শুনতো। নিজে কোনো মন্তব্য করতো না। তবে জিম যত সহজে জেলকার শরীরের গভীরে প্রবেশ করতে পারত, মনের গভীর ততটা সহজে নয়। সেখানে যেন তার জন্য অপেক্ষা করত এক দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। বিয়ের আগে জিমের নারী সংসর্গ ছিল। বিয়ের পর একবছর জেলকার সঙ্গ তাকে বিভোর করে রেখেছিল। একসময় জেলকার মৌনতা তার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে যাবার ক্ষেত্রে তাড়না জোগায়। কোনো কোনো দিন কাজ সেরে জিম শহরে চলে যেত। সেসব দিনে জেলকা একাই বাড়িতে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হত। এভাবেই চলছিল জিম আর জেলকার জীবন। একদিন জিম শহরে যাচ্ছিল, পথে এক প্রতিবেশি জানাল, জিমের গরুকে কোনো এক আততায়ী মেরে ফেলেছে। কথাটি শুনে জিম ফিরে আসে। যেখানে গরুটিকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বাড়ি ফিরে জিম দেখে, ঘোড়ার আস্তাবলে একটি ঘোড়া। কার ঘোড়া! আগন্তুককে খুঁজতে গিয়ে তাকে জেলকার সঙ্গে এক বিছানায় আবিস্কার করে। সে জেলকার কাজিন। দৃশ্যটি দেখে জিম নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। সে গুলি করে জেলকার প্রেমিককে মেরে ফেলে। তখনকার দিনে আমেরিকার সেসব অঞ্চলে অবিশ্বাসী স্ত্রী কিংবা তার প্রেমিককে খুন করা বোধ হয় গৌণ ব্যাপার ছিল, কারণ পুলিশ বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না, উল্টো জানায়, যে কেসটি উঠবে ঠিকই, তবে খারিজ হয়ে যাবে। গল্পটি এখানেই শেষ হয়। তবে গল্পের শেষে দেখা যায়, জিম জেলকাকে প্রচুর মারধর করে। জেলকা জিমের কাছে জানতে চায়, জিম তাকে আর মারবে কী না। জিম বলে আর কোনোদিন সে জেলকাকে মারবে না।
স্টাইনবেক গল্পটিতে জিমের চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে মানুষের বহুনিরন্তর দ্বন্দ্বের স্বরূপ চিহ্নিত করলেন। পুরুষটি নিজে অন্য নারীতে আসক্ত, কিন্তু শঠতা, ছলনাকে ক্ষমতাগর্বলালিত মনে হয় তার, এবং সেটি প্রতিফলিত হয় আইনের প্রতি ঔদ্ধত্য দেখানোর এবং স্ত্রীকে নিজের সম্পত্তি মনে করার মাধ্যমে। পুরুষের মনস্তত্ত্ব এখানে সুনিপুনভাবে চিত্রিত করলেন স্টাইনবেক। জিম যৌনতায় বৈচিত্র্য আনাটা নিজের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে প্রয়োগ করলেও, স্ত্রীর ক্ষেত্রে সেটাকে চরম অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। এজন্য সে খুনেও প্রবৃত্ত হয়। স্ত্রীর আত্মিক অসন্তোষ, অতৃপ্তি কোথায় পরিব্যাপ্ত, মেয়েটিও যে কোনো অবলম্বন চায়, সেই অন্বেষায় প্রেমিকের কাছে সমর্পিত হবার পর যে পরিণতি মেয়েটি লক্ষ করলো, তাতে ছিল ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। মেয়েটি আবার সেই খুনী স্বামীর কাছেই আত্মসমর্পন করে। গল্পটিতে স্টাইনবেক জেলকার প্রেমের করুণ পরিণতির মাধ্যমে যৌনতায় নারীর ক্লিষ্ট ও পীড়িত অবস্থার সর্বজনীনতাকেও যেন ইঙ্গিত করলেন।

ইউকিও মিশিমা (১৯২৫-১৯৭০) নামে পরিচিত হলে তাঁর আসল নাম হিরাওকা কিমিতাকে। জাপানের এই কথাসাহিত্যিক- কবি, নাট্যকার, অভিনেতা এবং চিত্রপরিচালক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন জাপানের প্রভাবশালী লেখকদের মধ্যে একজন। ১৯৬৮ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম বিবেচিত হয়।
মিশিমার লেখা ‘থার্মোফ্লাক্স’ গল্পের চরিত্র কাওয়াসে একটি কোম্পানিতে কাজ করে। একটা কাজে সে সানফ্রান্সিসকো গিয়েছিল, কাজ শেষেও নিজের দেশ জাপানে ফিরে না গিয়ে সে সেখানে আরো ছয় মাস কাটিয়ে দেয়। এ সময় কাওয়াসে স্ত্রীর সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ রাখতো। শিগেরু নামে কাওয়াসের একটি পুত্র সন্তান আছে। থার্মোফ্লাক্সের চারপাশে বাস্প বের হলে সেখান দিয়ে যে শব্দ বের হয় দুষ্টুমি করলে সেই শব্দ দিয়ে শিগেরুকে শান্ত করা হত। শিগেরু, কাওয়াসে, তার স্ত্রী এই বিষয়টার সঙ্গে পরিচিত। কাওয়াসে তখন সানফ্রান্সিসকোতে, একদিন সকালে স্ত্রীর চিঠি পড়ে বাইরে বের হলে পূর্ব পরিচিত এক জাপানী মেয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। মেয়েটির সঙ্গে ছিল তার শিশু কন্যা। তাদের বহুদিন পর দেখা হল। মেয়েটি একজন রক্ষিতা। একদিন সে কাওয়াসের রক্ষিতা ছিল। রক্ষিতাদের কোনো নাম থাকে না। জাপানে বাইজীদের গেইশা বলে, মেয়েটির নাম রাখা হয় আসাকা। এর অর্থ বিবর্ণ সুগন্ধি।
কাওয়াসে আসাকাকে নিয়ে একটি রেস্তোরায় বসে। আসাকা যখন কাওয়াসের রক্ষিতা ছিল তখন তার ঘাড়ের পেছনের দিক, কোমরের বেশভূষা নিয়ে কাওয়াসে ভাবতো। আসাকা রুচিশীল। কিমোনো পরে নাইট ক্লাবে নাচতে পারে। কাওয়াসের স্মৃতি আর মুগ্ধতার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে আসাকার পোষাক, সাজগোজ ইত্যাদি। দুজনের গল্প শেষ হলে আসাকা কাওয়াসের সঙ্গে নিজের মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাচ্চাটির নাম হাসাকো। হাসাকো মায়ের মতোই খুব শান্ত। কাওয়াসে মনে করতে থাকে আসাকার সঙ্গে কাটানো রাতগুলোর কথা। স্মরণ করতে চেষ্টা করে আসাকার কাগজের রুমাল, কোমরবন্ধের কথা।
এ সময় দুজনে মিলে শিশু বাচ্চাটি সহ একটি প্রদর্শনির মধ্যে উপস্থিত হয়। আসাকা একটি থার্মোফ্লাক্স দেখে তার দিকে ইঙ্গিত করে হাসাকোকে জিজ্ঞেস করে, সে আগে এটা দেখে ভয় পেত, এখন কী ভয় পায়?
হাসাকো বলে, 'না।'
কাওয়াসে জানতে পারে বিষয়টা। আসাকা জানায়, ভেতরে চা না থাকলে চারপাশে মজার বুদবুদ হলে কথা না শুনলে হাসাকো এসব দেখে ভয় পেত।
সেদিন সন্ধ্যায় আসাকা একাই আসে। কাওয়াসের স্মৃতি-বিভ্রমে কেবল সকালের থার্মোফ্লাস্কের ঘটনা ঘুরছিল। বিষয়টাতে সে যে ধাক্কা খেয়েছিল ততক্ষণে সেটি কাটিয়ে উঠেছে। নিজেকে তার অর্থহীন মোহের শিকার মনে হতে থাকে। নিজের কল্পনাবিলাসকে এর জন্য দায়ী করে সে। তার নিজের স্ত্রীর কথা মনে হয়। মনে হয়, আসাকা আর তার মেয়ের চাইতেও তার স্ত্রী আর ছেলেটি দুঃখী। স্মৃতির জাবর কাটে কাওয়াসে এবং পাঠক জানতে পারে কন্যাটির পিতা কাওয়াসেই।
যখন সম্পর্কিত অবস্থায় আসাকা বলেছিল সে সন্তান ধারণ করেছে, সেদিন কাওয়াসে বিরক্ত হয়েছিল, তার মনে হয়েছিল এটা একটা সস্তা কৌশল। এরপর আসাকার সঙ্গ এবং স্মৃতি ফেলে কাওয়াসে জাপানে তার স্ত্রী আর ছেলের কাছে ফিরে আসে।
কিন্তু কাওয়াসে যেন ফ্লাস্কের ঘোর থেকে বের হতে পারে না। বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীকে বলে ফ্লাস্কটি তার কাছে নিয়ে আসতে। স্ত্রী, কিমিকো জবাব দেয় না। কাওয়াসে আবার ফ্লাস্কের কথা বললে, স্ত্রী জানায় সেটি ভেঙে গিয়েছে। কাওয়াসে জানতে চায়, ওটা কে ভাংলো? স্ত্রী কোনো জবাব দেয় না, বরং কান্নায় ভেঙে পড়ে।
কাওয়াসে আবার জানতে চায়, সেটা কে ভেঙেছে।
স্ত্রী বহু কষ্টে বলে ফ্লাস্কটা সে নিজেই ভেঙেছে।
স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখতে দ্বিধা বোধ করে কাওয়াসে।
তার মনে হয় সে নিজেই এখন থার্মোফ্লাস্ককে ভয় পাচ্ছে।
গল্পটিতে ইউকিও মিশিমা কাওয়াসের পাপবোধকে তার অমিতাচারের সঙ্গে মিলিয়ে পারিবারিক সম্পর্কের মর্মান্তিক বাস্তবতার রূপ চিত্রিত করেছেন। দুটো নারীর সঙ্গে দুটো সন্তান, তারা আবার ফ্লাস্কের বুদবুদকে ভয় পেত। কাওয়াসের স্খলন, তার পাপবোধ, তার সজাগ এবং সতর্ক হওয়া, নিজের অতীতচারণ, কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে সেই স্মৃতি রোমন্থন, স্ত্রী-সন্তানের জন্য দুঃখবোধ, শেষে স্ত্রী সবকিছু টের পেয়ে গেছে এই অনুভব, এসব তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। জীবন যেন এখানে নিষ্ঠুর। ক্ষমাহীন। এই নির্মমতা অনুভব করে কাওয়াসে স্তব্ধ হয়ে যায়। অতীতের অনস্বীকার্য ও অনতিক্রম্য প্রভাব থেকে মানুষ কখনোই মুক্ত নয়। গল্পটিতে প্রতীকের ব্যবহার হলো থার্মোফ্লাস্ক। থার্মোফ্লাস্ক সম্পর্কে কাওয়াসের নিঃসন্দিগ্ধ সচেতনতা নিজের অসহায় নিয়তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অল্পকটি চরিত্র, দৃশ্য নিয়ে মিশিমা গল্পটিতে যে দ্বন্দ্ব তৈরি করেছেন তা পারিবারিক জীবনের আলেখ্য হিসেবেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অলিভার ফ্রিজেইরির (১৯৪৭) জন্ম দক্ষিণ এশীয় দ্বীপ দেশ মাল্টায়। তিনি বিশেষত কবি, ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্য সমালোচক। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা দশটি এবং গল্প সংকলন দুটি। ‘ছয় মাস এমন কিছুই না’ গল্পটি জীবন-চিত্র বা লাইফ-স্কেচ হিসেবে খুবই জীবন্ত।
সে ছিল তার বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র। বেশ আদর আহ্লাদে বেড়ে উঠেছে। একটি প্রেমিকা আছে। বেশ সুন্দরী সে। তাকে কল্পনা করে কেটে যাচ্ছিল ছেলেটির সময়। এ সময় তার মনে আসে বিয়ের কথাও। কিন্তু তার মা পুত্রের প্রতি ভালবাসার আধিক্যেই ছেলের কাছে বলতে থাকে, বিয়ে করিস না। সে বুঝতে পারে ভালবাসার জন্যই মা এসব বলছে কিন্তু একসময় এসব শুনতে অসহ্য মনে হয়, কারণ তার স্বপ্ন কল্পনার মেয়েটিকে বিয়ে করতেই হবে। মা ছেলেকে প্রেমিকার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বিয়েতে বাধা দিচ্ছে, এটা সে ঠিক বিশ্বাস করে না, তবুও মায়ের এই অনুশাসন তাকে বিরক্ত করে। সে সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করবেই। মা তাকে এবার অন্য অনুরোধ করে। সে যেন তার বিয়েটা ছয় মাস পিছিয়ে দেয়। মায়ের অনুরোধ সে শোনে না। বিয়ের প্রস্তুতি নেয়।
বিয়ের দিন সে দেখে মা তার সব ছবিতে ঢুকে পড়তে চাইছে। এতে সে বিরক্ত হয় এবং মাকে এককোণে নিয়ে বলে, তিনি কেন সব ছবিতে ঢুকে পড়ছেন। মা বিব্রত হয়। তিনি সরে যান তখুনি।
তার বিয়ের মাস দশেক পর মা মারা যায়।
এখানেই গল্পটি শেষ হতে পারত। ফ্রিজেইরি মাতা-পুত্রের ভালোবাসার এক মর্মান্তিক দ্বন্দ্বের দিক উন্মোচন করবেন বলে অন্তিমে দেখালেন, আসলে মায়ের মৃত্যু নির্ধারিত ছিল। ডাক্তার তাকে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন এবং তিনি মায়ের মরণব্যাধির কথা পরিবারের কাউকে বলেননি, কারণ মা তাকে নিষেধ করেছিলেন। মা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, ছেলে যদি আর কিছুদিন পর বিয়ে করে মা তবে তার সান্নিধ্য আরো কিছুদিন পাবে।
একজন যুবকের জন্য ছয় মাস কিছুই না। কিন্তু একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ, যাকে প্রতিটি দিন গুনতে হচ্ছে, তার কাছে সেটি অনেক কিছু। মা চেয়েছিলেন অনেক ছবি রেখে যেতে, যেন ছেলে মায়ের অবর্তমানে ছবিগুলো দেখতে পারে। কিন্তু এখন সবই অর্থহীন। মা সবকিছুরই উর্ধ্বে এখন।
ফ্রিজেইরি গল্পটিতে মমতাভরে পারিবারিক সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে মানুষের সহচার্যকে প্রাণ দিতে চেষ্টা করেছেন। মায়ের দুর্বলচিত্ততা পুত্রের মনে এক ধরনের অবজ্ঞা জাগিয়ে তোলে। মা চলে যাবার আগে একটি জিনিসই চেয়েছিলেন, সন্তানের সঙ্গ। নিজের নির্মম নিয়তি নিশ্চিত হয়ে যাবার পর মা চেয়েছেন পীড়িত মনটাকে, মুমূর্ষু জীবনটার শেষ দিনগুলোকে নির্মল করতে। কতকটা গ-ারের মতো মানুষরা অনেককিছু অনুভব করতে পারে না। পারে না, মায়ের চিরন্তন ভালোবাসা উপলব্ধি করতেও। ছেলেটিও পারে নি।
মানুষের নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থতা নিয়ে লেখা ফ্রিজেইরির ‘ছয় মাস এমন কিছুই না’ আমাদের সমাজের লঘুতা, অস্বচ্ছতা, চাপের প্রতিচ্ছবির একটি বাস্তব চিত্রও নিপুনভাবে তুলে ধরেছে। মানুষের জীবনে পারিবারিক সম্পর্কগুলো জটপাকানো বিভ্রম তৈরি করে অনেকসময়। বস্তুত এ গল্পটি যেন একরকম ইলিউশনও তৈরি করেছে। মায়ের প্রতি সন্তানের মায়া তো রয়েছেই, কিন্তু যথাসময়ে সেটি প্রদর্শন না করা জনিত সঙ্কট মানুষের জীবনকে যে নিরঙ্কুশ দুঃখের মধ্যে পতিত করে সে বাস্তবতাও গল্পটি মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, কখনো কখনো মৃত্যু জীবনের নতুন গ্রন্থিবন্ধন করে।

কেনজাবুরো ওয়ে (১৯৩৫) জাপানের প্রধান লেখকদের অন্যতম। জাপানী ইতিহাসকে সমসাময়িক ইতিহাসের আলোকে উপস্থাপন করে তিনি বহুল আলোচিত হন। ঔপন্যাসিকা ‘দ্য ক্যাচ’ এর জন্য তিনি মর্যাদাপূর্ণ ‘অর্ডার অব কালচার’ পুরস্কার লাভ করেন এবং সেই সঙ্গে তাঁর প্রতিভা প্রকৃতপক্ষে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৪ সালে কেনজাবুরো ওয়ে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
‘দ্য ক্যাচ’ বা ‘শিকার’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা। ইতিহাসের সাক্ষ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী সেনারা ছিল তৎপর। জাপান তীব্র আক্রমণে আমেরিকার পার্ল হারবারে হামলা চালায়, এর পরম্পরায় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। পুরো যুদ্ধে জাপান আত্মঘাতী বিমান হামলার এক রণ-কৌশল অবলম্বন করে। কৌশলটি ফলপ্রসু হয়েছিল অনেকটা। জাপানী সেনারা অনেক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত করে। যুদ্ধের এসব অভিঘাত কেনজাবুরো ওয়েকে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়াও ছোটবেলায় কেনজাবুরো ওয়ে জাপানের সম্রাট হিরোহিত দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। যুদ্ধোত্তর জাপানের প্রচলিত মূল্যবোধের অনেককিছুই তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওয়ে তাঁর পিতাকে হারান। সেইসঙ্গে তাঁর দেশও আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। প্রত্যক্ষ করতে হয় হিরোশিমা ও নাগাসাকির নির্মম পরিণতি। তাদের স্বপ্ন ভেঙে যায়, অল্পবয়সে আত্মার দ্বন্দ্ব থেকেই হয়ত সরলতার অনুভূতি হারিয়ে ফেলেন কেনজাবুরো ওয়ে। একবার তাঁর শিক্ষক জানতে চান, রাজা যদি তোমাকে মরতে বলে তুমি কী করবে? ওয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি পেট কেটে মরে যাবেন। এই সংকল্প নিয়ে যদিও তিনি পরে বিভ্রমে পড়েন। কয়েকবছর পর তিনি একটা লেখায় লেখেন যুদ্ধটা তার জীবনে বিশাল প্রভাব এনেছিল। কেনজাবুরো ওয়ে তাঁর লেখায় প্রতীক নিয়ে কাজ করেছেন। জাপানের অনেক প্রতীক সেখানে স্থান পেয়েছে। বস্তুত এটুকুতেই তাঁর পরিচয় নিঃশেষিত নয়। কল্পনার বিস্তার, আঙ্গিকের নৈপুণ্য তাঁর লেখার অন্যতম গুণাবলী। কেনজাবুরো ওয়ের জীবনের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে আমরা ‘দ্য ক্যাচ’ বা ‘শিকার’ গল্পটির গভীরে যেতে পারি।
জাপানের একটি পাহাড়ী অঞ্চল, যেটি অনেকটা দুর্গম, সেখানে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে একজন বিমান যোদ্ধা প্রাণে বেঁচে যায়। সেই বৈমানিককে উদ্ধার করে রাখা হয় একটি কুঠুরিতে। সেখানেই এক কিশোর আর তার ভাই সেই বন্দীর সঙ্গে গড়ে তোলে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক। তাদের বিবিধ মনোরঞ্জনের বিষয় হয়ে ওঠে সেই বন্দী। শিশুরা সারাক্ষণ তাকে নিরীক্ষণ করে। ভাষার দূরত্ব অনুভূতির নৈকট্যর কাছে দূর হয়ে যায় যেন। কিশোরদের দল মেতে থাকে বন্দীকে নিয়ে। সমাজ সংসারের জটিলতার সঙ্গে বিবর্জিত আচরণ যেন শুধু শিশুরাই করতে পারে, এবং শুধু শ্রেয়োবোধের মাধ্যমেই নির্মল হয়ে ওঠে তাদের যোগাযোগ। হৃদয়হীন বিবেককে আশ্রয় করে বাকীরা বন্দীকে যেমন হিংস্র পশুর দৃষ্টিকে দেখত, কোমল বাচ্চাগুলো তেমন নয়, তাদের কাছে সে হয়ে উঠেছিল বন্ধুর মতো।
দিনগুলো একরকম থাকে না। সে জানতে পারে এই নিরাপদ আশ্রয় থেকে তাকে কতৃর্পক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে। এই নির্দেশের জন্যই এতদিন অপেক্ষা করে ছিল গ্রামের মুরুব্বিরা। সৈন্যটি কর্তৃপক্ষের কাছে যুদ্ধবন্দী হতে চায় না। বন্দীটি সেই কিশোরকে জিম্মি করে ফেলে। জিম্মি নাটকের অবসান হয় স্থানীয় মানুষদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে বন্দীকে হত্যা করার মাধ্যমে। গল্পটি পরিণতি পায়।
গল্পটি যেমন একজন নিঃসঙ্গ বন্দীর দুঃসহ এবং যন্ত্রণাদায়ক জীবনকে তুলে ধরে, আবার যুদ্ধের অভিঘাতে সুস্থ মানবসমাজ থেকে নির্বাসিত বন্দীর ভাষাগত, জাতিগত বিরোধকেও স্পষ্ট করে তোলে। আমরা সবাই তো এক অর্থে শিকার। কারো না কারো কাছে। কোনো না কোনো পরিস্থিতির কাছে। দুর্বলকে পেলে সবল হয়ে ওঠে বলশালী। হয়ে ওঠে দৈত্যসম।
শেক্সপিয়র সতর্ক করেছিলেন--
It is excellent
To have a giant’s strength, but it is tyrannous
To use it like a giant
কিন্তু এই মহাসত্যটিকে ক্ষমতাবানরা কখনো কখনো তাদের ক্ষমাহীনতার তুষারে ঢেকে দেয়, ভুলে যায় ইতি আর নেতির ব্যবধান।

লেখক পরিচিতি
লীনা দিলরুবা
ঢাকায় থাকেন।
লেখালেখির জায়গা মূলত প্রবন্ধ। বুক রিভিউ করতে পছন্দ করেন। কাজের জায়গা ব্যাংকিং। বর্তমানে একটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।
0 মন্তব্যসমূহ