“অভিনয়ের শীর্ষবিদ্যাপীঠ হয়ে ওঠেছিল আমাদের যাপিত জীবন”— ইরফানের প্রতি স্ত্রী সুতপা শিকদারের নৈবেদ্য ঃ হেলাল মহিউদ্দীন

সুতপা শিকদার! ইরফানের অর্ধাংগিনী। নিজেও অসাধারণ গুণী একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। উঁচুমানের চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লিখেছেন, চিত্রনাট্য নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন টেলিভিশন নাটকের জন্য নিয়মিতই লিখেন।
১৯৬৭ সালে দিল্লীতে জন্ম। পরিবারসূত্রে অসমী বাংগালি পরিবার। ইরফানের সংগে জানাশোনা ৩৫ বছরের। দিল্লীর বিখ্যাত ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় সহশিক্ষার্থী ছিলেন দু’জনই। ১৯৯৫ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। তারপর দীর্ঘ পঁচিশটি বছরের যৌথ জীবন।


প্রয়াত ইরফানকে নিয়ে সুতপার লেখা ছোট্ট একটি নৈবেদ্য শিল্পকৃতির ঝলকে ঝলসে উঠেছে!নৈবেদ্যটি পাঠে ইরফানের জন্য সুতপার শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মূর্ততায় যে কারো হৃদয় আর্দ্র ও আপ্লুত হবে। এমন প্রাণাকুল লেখা দু’এক দশকে তেমন একটা দেখা যায়নি! কী হৃদয়াকুলতা-মূল্য, কী সাহিত্যমূল্য, কী নান্দনিকতামূল্য— এক কথায় শব্দের মুক্তোয় গাঁথা অনিন্দ্যসুন্দর একটি মতিহার যেন নৈবেদ্যটি!

সুতপার লেখাটির শিরোনাম ছিল না। স্ক্রল-ডট-ইন ম্যাগাজিন লেখার গভীর হতে একটি বাক্য তুলে এনে শিরোনাম করেছে—‘Our life was a masterclass in acting’। আমাদের জীবনটিই হয়ে ওঠেছিল অভিনয়ের শীর্ষবিদ্যাপীঠ!

সুতপার লেখা নৈবেদ্যটির ভাবানুবাদ পাঠকদের জন্য গ্রন্থিত হল—

“অভিনয়ের শীর্ষবিদ্যাপীঠ হয়ে ওঠেছিল আমাদের যাপিত জীবন”

—সুতপা শিকদার

যখন সারা দুনিয়ার মানুষ [ইরফানের প্রয়াণকে] একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষতি হিসেবে দেখছে, আমি তখন কীভাবে এই লেখাটিতে শুধুই একটি পরিবারের শোকের কথকতা বলে যেতে পারি? এই মুহুর্তে লাখো মানুষ যখন আমাদের শোকের সহযোগী, তখন কীভাবেই বা আমি নিজেকে একা অনুভব করি? আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই যে এই ক্ষতিতে আমরা আসলে ক্ষতিগ্রস্ত নই। আমাদের লাভই তো হয়েছে! ইরফানই আমাদের শিখিয়েছিল এসমস্ত ক্ষতি হতেও লাভের সন্ধান মেলে। আমরাও সত্যিকার অর্থে তার সেই শেখানো অভিজ্ঞানটিই বাস্তবায়ন করতে চলেছি। আমরাও ক্ষতিটির পথ ধরেই বিকশিত হতে শুরু করব। তবু কিছু কথা তো সকলেরই অজানা এখনো। আমি সেইসব না জানার শূণ্যতাই পূরণ করার চেষ্টা করব।

আমাদের কাছে ইরফানের বিদায় অবিশ্বাস্য। তবে আমি ইরফানের ভাষাতেই লিখব—‘[চিরবিদায়ও] যাদুকরী’। একমাত্রিক বাস্তবতাকে ইরফান কখনোই ভালবাসেনি। ইরফান আমাদের সঙ্গে আছে কি নাই, ‘চিরবিদায়ও যাদুকরী’ এই অভিজ্ঞান আমাদের সঙ্গেই আছে। তার প্রতি আমার একটিই ক্ষোভ—আমাকেও অনন্তকালের জন্য আমূল বদলে দিয়ে গেছে মানুষটি। নির্ভূলতার জন্য তার যে সুনিবিড় সংগ্রাম, সেটি আমাকেও আর কোনো কিছুতেই একজন ‘সাধারণ’ মানুষের মত থিতু হয়ে যেতে দেয় না! সব কিছুর মধ্যেই সে খুঁজে পেত ছন্দ। এমনকি বিশৃংখলা এবং হুজ্জোত-হাংগামার মধ্যেও ছন্দ পেত। সেই ছন্দে আমার মত কন্ঠহীন বেসুরোও গাইতে শিখে গেছে। দুটি পা-ই যেন বাম-পা, এরকম মুদ্রাহীন আমিও তার ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে নাচতে শিখে গেছি।

কৌতুকপ্রদই বটে! আমাদের জীবনটিই হয়ে ওঠেছিল অভিনয়ের শীর্ষবিদ্যাপীঠ! তাই যখন আমাদের জীবনে নাটকীয়ভাবে অনাহুত অতিথিদের [অসুখ] আগমন ঘটেছে, ততক্ষণে ঝঞ্ঝার মধ্যেও অনায়াসে একাত্মতার ঐকতান খুঁজে নিতে পারা শিখে গিয়েছি।ডাক্তারদের দেওয়া রিপোর্টগুলো যেন ছিল গল্পের স্ক্রিপ্ট। আমি যেন সেগুলোকে নিখুঁত করে তুলতে চেয়েছিলাম। সেরা অভিনয়টির জন্য ঠিক যেরকম নিখুঁত চাইত ইরফান। যেরকম চাইত যে সুক্ষ সুক্ষ বর্ণনাগুলোও আমি যেন উপেক্ষা না করি। সেরকম।

এই যাত্রায় আমরা কিছু অসাধারণ ব্যক্তির সাক্ষাত পেয়েছিলাম। তাঁদের তালিকাটি হবে সুদীর্ঘ। তাঁদের মাঝে এমন মানুষজন আছে্ন যাঁদের উল্লেখ করতেই হবে। তাঁরা হলেন অনকোলজিস্ট ডাঃ নীতেশ রোহতোগী (ম্যাক্স হস্পিটাল সেকেট)। আমাদের হাতে শুরুর দিক হতেই যাঁরা হাত রেখেছিলেন, ডাঃ ড্যান ক্রেল (ইউকে) ,ডাঃ শিদ্রবী (ইউকে);আমার হৃদস্পন্দন এবং অন্ধকারের আলোকবর্তিকা ডাঃ সেভন্তী লিমায় (কোকিলাবেন হাসপাতাল)। এই যাত্রাটি যে কতোটা বিস্ময়কর,সুন্দর,অপ্রতিরোধ্য,বেদনাদায়ক এবং উত্তেজনাপূর্ণ ছিল তা ব্যাখ্যা করা কঠিন।

আমার মনে হয় যে মাঝের দুই আড়াইটি বছর যেন দুইটি নাটকের মধ্যবর্তি বিরতকালীন নাটিকা। যেন তার নিজস্ব শুরু,মধ্যবর্তিতা এবং পরিণতিও ছিল। সেখানে ইরফান যেন নির্দেশনা-কাঠি হাতে অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টরের ভূমিকায়। আমাদের পঁয়ত্রিশটি বছরের সাহচর্যকে আলাদা দেখলে,বিবাহিত জীবন নয়, আমাদের ছিল একটি ইউনিয়ন—একাত্ম যুথসংঘ!

আমি আমার ছোট পরিবারটি নিয়ে একটি নৌকায় চড়েছি। সঙ্গে দুই পুত্র বাবিল এবং আয়ান। আমরা এগিয়ে এগিয়ে এসেছি,ইরফান তাদের পথ বাতলেছে—“ওদিকে নয়, এদিকে মোড় নাও”। তবে জীবন যেহেতু সিনেমা নয়, এবং এখানে পূণরায় দৃশ্যগ্রহণেরও কোনো সুযোগ নেই, অন্তরের অন্তস্থল জুড়ে আমার ভাবনা—আমার সন্তানরা তাদের বাবার দিকনির্দেশনার জাগরণী-সংগীত শুনে ঝড়ের মধ্য দিয়েও এগুবে। নৌকাটি নিরাপদেই ঘাটে ভিড়াবে। আমি আমার সন্তানদের বলে দিয়েছি—‘বাবার শেখানো যা কিছুই তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যদি সম্ভব হয়, সেগুলো জড়ো করে সংকলিত করে নিতে পারো’। [তখন তারা বাবার উপদেশ যা যা জানালো—]

বাবিল: "অনিশ্চয়তা নাচ করবে। তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে শেখো। মহাবিশ্বের প্রতি তোমার যে বিশ্বাস, তাতে আস্থা রেখো।”

আয়ান: "মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। তোমাকেই নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে দিও না মনকে”।

বিজয়যাত্রা সেরে আসা ইরফানকে যেখানে চিরবিশ্রামের জন্য সমাহিত করে এসেছি,সেখানে যখন তার ভীষণ পছন্দের একটি নিশিপদ্ম ফুলের গাছ লাগাব—ঝরঝর অশ্রুধারার প্রপাত নামবে আমাদের চোখে। সময় পেরোবে। এক সময় নিশিপদ্ম প্রস্ফুটিতও হবে। তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সবগুলো প্রাণকে স্পর্শ করবে, যে প্রাণগুলোকে আমি ইরফানের ভক্ত ভাবব না,বছরের পর বছর পরিবার বলে যাব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ