মুদ্রাদোষ
স্মারক বৃক্ততার অনুষ্ঠান দুভাগে ভাগ করেছিল সে। যে একদা এবং এখনও পরিচয় বহন করছিল লেখক পত্নীর। এবং দুটি সন্তানের মায়ের। এবং লেখককে পালন করার দায়িত্বের। এসব পরিচয়ের কথা যারা তাদের খুব পরিচিত তাদের মুখ থেকে উঠে আসছিল যারা তাদের অতটা চেনে না তাদের জন্য। কারণ সকলের সকলকে সমানভাবে চেনার মেশিনটা তখনও ততটা ব্যাসার্ধ কভার করতে পারেনি। তাই সবটা শুনে আন্দাজ করার একটা পরিসর তখনও ছিল। যাইহোক নির্মেদ বিষয়টা হল স্মারক বৃক্ততা দুভাগে ভাগ হয়েছিল। খানিকটা শুনেই ইরাবান আরও খানিকটা জানতে ওর মোবাইলে টাইপ করল লেখকের নাম। যদি আরও কিছু জানা যায়।
কিন্তু কী জানতে চায় সে?
সেও জানে না। কারণ লেখক তো মৃত। তবু অভ্যাস বড়ো দায়। মনে পড়ে যায়, গড়িয়াহাটের রাস্তার দুধারের নীল-সাদা দাগের কথা ইরাবানের, আজ সকালেই অটো থেকে দেখেছিল সে। আর মনে মনে ভেবেছিল হয়ত পার্কিং-এর সুরাহার কথা মাথায় রেখে এ জ্যামিতি রাস্তার শোভা বাড়াচ্ছে(?) কিংবা নিছক মুদ্রাদোষ।
হেমলক
শহরের আর কোথাও এত চওড়া রাস্তা দেখেনি সে। এই চওড়া রাস্তায় একদিন চড়া রোদে সৌমাঞ্জন প্রেমে পড়ে যায় বোরখার আড়ালে থাকা দুটো কাজল চোবান চোখের। ভাগ্যিস তখন সিগনালে ২৩৪ বাসটা দাঁড়িয়েছিল। একদিন সন্ধ্যেবেলা বাসে দাঁড়িয়ে যখন খুব ঘামছিল সে আর সে গন্ধে সামনের সিটের ভদ্রমহিলা তিনবার ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে নাকে আঙুল ঘোষে বিরক্তি দেখাল তখন ওর হোয়াটস অ্যাপে একটা বার্তা এলো—পচাগলা মাংসের দলে শুয়োর নেই কেন?
কেউ অতটা ভরসা করে না এসব বার্তা পাঠিয়ে পাঠকের বুদ্ধির ওপর। তাই উত্তরটাও জি.কে. বইয়ের মতো খানিকটা বার্তা ওপর-নিচ করলে শেষে সেই জানিয়ে দেয়। এবেলায়ও ভুল হয়নি। কারণ প্রেরক জানত বোধহয় সৌমাঞ্জন বাসে সিট পাবে না, ওর ডিও অক্ষয় কুমারের মতো অক্ষয় সময় ধরে সঙ্গ দেবে না, 'সেলফি'র রামচন্দ্র গোয়েঙ্করের মতো সহযাত্রী ওকেও ঘৃণা করবে। তাই এসব অবস্থা থেকে বাঁচতে ফোনটাতেই প্যাটার্ন বোলায় সে। কিন্তু এই সে বার্তা। কেন শুয়োর পচা এল না খবরে? এলে নাকি আগুন জ্বলত। সৌমাঞ্জনের মনে পড়ে যায় সেই মেয়েটার চোখ। যার বুকটাতে একবারও মাথা না রেখে সে শুনেছিল গতির শব্দ, কেবল তার জন্যেই।
তারপর বাস ছেড়ে দিয়েছিল। টাঙ্গাওয়ালা আব্বুর মতো ওর নীতিকে বলা হয়নি শহর সাক্ষী আমি তোমায় সোনায় মুড়ে রাখব। টাঙ্গা কিংবা প্রাণের ঘোড়া চান্নিকেও বেচে দেব তোমায় ভালো রাখতে। কিন্তু সে জানত নীতি কোথাও এশহরের কোন বাপের আদরের বাড়িতে আরশিতে নিজেকে দেখে সৌমাঞ্জনের কথা ভেবে আরও একবার সুরমা টানছে ও দুটো চোখে। রাঙা হয়ে যাচ্ছে নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধ হয়ে। সৌমাঞ্জন ভাবে তবু একদিন ঠিক দেখা হয়ে যাবে আবারও কারণ এশহরে সবধর্মের মানুষই নিজের মতো একপ্রকার আছে; যাকে খুব ভালো না থাকা বললেও ভালোই বলা যেত ততদিন যতদিন বাঙালি বাড়ির ছেলেমেয়েরা চল্লিশমন্ত্র পড়া আর পড়ন্ত বিকেলের রঙের আদলে টিপ পড়ে স্কুল যাওয়া শেখেনি। কিন্তু রোজ যদি যুক্তি করে বুদ্ধি করে এমন কটা তাজা হূল রোজ তোমার চেতনার পাতে, তোমার প্যান্টের পকেটের নিতান্ত সৌখিনতার যন্ত্রে কেউ বিলিয়ে দিতে পারে, কিংবা দেশ চালানোর আইনি বইটাকে কোঁত করে গিলে এক্কেবারে নতুন একটা নমুনা নামাতে পারে তখন শহরের রাস্তা যত চওড়াই হোক কিংবা সিগনালে ২৩০ অথবা ২৩৪ বাস যতই দাঁড়িয়ে যাক, তবু কোন নীতির সঙ্গে দেখা হবে না কোন সৌমাঞ্জনের। কারণ নীতি তখন মান্টোর সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যাবে।
ব্লটিং পেপার
আপনার মেয়ে পিরিয়ডে যতটা সহ্য করে ততটা বলে না। একথা কে বলে? বলে এক সেনিটারি ন্যাপকিন কোম্পানি। সোহিনীর মা ওর জন্ম মুহূর্তে মারা যায়। সোহিনীর বাবা এক রাজনৈতিক দলের হোলটাইমার ও কবি। সোহিনী বাবার অনুপস্থিতিতে স্কুলে যেত নিয়মিত একইধরনের মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে। ফিরেও একই ভাত ঝোল খেয়ে নিজের ঘরে ঘুমাতে যেত। তখনও তার বাবা থাকত না। তার বাবা সকাল আটটায় পার্টির সাদা অ্যাম্বাসেডরে বেরত ও রাত্রি দশটায় বাড়ি ঢুকত। ফিরে সোহিনীর সাথে মাংসের স্টু দিয়ে তিনটে রুটি খেত এবং রোজ জিজ্ঞেস করত সারাদিনে কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা এবং সে আজ নতুন কী পড়েছে। বয়স্ক হরির মা এতই শান্ত আর ভীতু ছিল যে তার সাথে কাররই অসুবিধা হওয়ার ছিল না। তাই প্রথম প্রশ্নটা বাদ দিয়ে সে দ্বিতীয়টার উত্তর দিতে বড়োই আগ্রহী থাকত। সে কখনও তার মাকে পায়নি কিন্তু মায়ের জিনটা তার মধ্যে ছিল। তাই সে তার মা সুবচনীর মতো বই পড়তে সবচেয়ে ভালোবাসত। আর তাদের বাড়িতে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো একটা রিডিংরুমও ছিল। ছুটি থাকলে তাকে হরির মায়ের ঝোলের হাত থেকে বাঁচাতেই বোধ করি তার ছোট মাসি তার বাড়িতে তাকে নিয়ে যেত। বাবা তাতে আপত্তি করত না। কারণ সুবচনীর সাথে বিয়ের পরপরই যখন পোস্ট ডক করতে ঋদ্ধিমান ইংল্যান্ডে তিনবছর ছিল তখন সুচেতনার সাথে একটা জগৎ বুনে ছিল সে। ফিরে সেকথা সুবচনীর দিনমানে ক্লিশে হয়ে যায়। তারপর সে তো মেয়ে রেখে মরেও যায়। আর সুচেতনা অধ্যাপক মিত্রর স্ত্রী হয়েই দেশে ফেরে। সোহিনীর জীবন আশিসের সাথে দেখা হওয়ার আগে তেমন আলাদা কিছু ছিল না। মাসির বাড়িতে গিয়েও সে মায়ের আহ্লাদ কিংবা যত্ন কোনটাই পায়নি। হ্যাঁ, দুপুরগুলোতে অসাধারণ খাবার আর গীতাঘটক, খুকু, রাজেশ্বর ভট্টাচার্যের গলায় রবীন্দ্রনাথের গান কিছু শুনেছে। কিন্তু কষ্টও একটা জমেছে যখন দেখেছে মাসি পাভেলকে ছুটির দিনে হাতে করে খাওয়ায়। আর ছিল একটা গভীর যন্ত্রণা সেদিন থেকে যেদিন স্টাফ রুমে চক নিতে ঢুকে শুনেছিল আচমকাই নূপুর মিস বাবলি মিসকে বলছে এত বড়ো একটা চেহারা হয়েছে মা দেখেও না নাকি? একটা ব্রা পরতে বলবে না? মিলি মিস ইশারায় চুপ করিয়েছিল সাময়িক আর বলেছিল ওর তো মা নেই, আপনিই বুঝিয়ে বলে দিন না। এরপর সোহিনী সুচেতনাকে একদিন বলে সেকথাটা। কিন্তু তারও বছর চারেক পরেও সে এভাবেই কটনের টেপ ফ্রকের ওপর স্কুল ড্রেস পরে কাটায়। কারণ সুচেতনা যে ব্রাটা নিয়ে এসেছিল তা এত বড়ো ছিল যে তা পরে একদিন বাসে ওঠায় একটা লোক গায়ে উঠে বলেছিল মাপ জান না, আমার দোকানে এসো। মেপে দিয়ে দেব। ও ভয়ে পরের স্টপেজে নেমে হেঁটে বাড়ি এসেছিল।
এসব কথা শুনে জয়া হাসে। হাসে এই ভেবে যে যার ঘরে মা নেই তার জীবনটার অনেকটা বুঝি শুকিয়ে থাকে। অনেক অভাব থাকে। অনেক কষ্ট থাকে যা তার ঘর পেরিয়ে পাশের ঘরে তার বাবাও টের পায় না। কিন্তু যার সে থাকে কিন্তু থেকেও সন্তানদের ভালো মন্দের হদিশ রাখে না, তাদের প্রোটেক্ট করাটা কর্তব্য ভাবে না, তাদের জন্য ন্যায্য লড়াইটা হলেওবা স্বামী, তার সাথেও করতে অনীহা প্রকাশ করে সে মেয়ে তখন কী করে?
কী করে জানেন, ন্যাপকিন কোম্পানির অ্যাসাইন্মেন্টটা হাতে আসতেই আধা ঘন্টাতেই নামিয়ে ফেলে স্ক্রিপ্টটা।
লেখক পরিচিতি
শাশ্বতী মজুমদার
কোলকাতা পড়াশুনা করেছেন।
এখন দিল্লী থাকেন।
গল্পকার।
প্রকাশিত গল্পের বইঃ স্থানীয় সংবাদ (অক্টোবর, ২০১৮)
শাশ্বতী মজুমদার
কোলকাতা পড়াশুনা করেছেন।
এখন দিল্লী থাকেন।
গল্পকার।
প্রকাশিত গল্পের বইঃ স্থানীয় সংবাদ (অক্টোবর, ২০১৮)
4 মন্তব্যসমূহ
বাঃ।খুব সুন্দর।
উত্তরমুছুনএমন ঋজু, ন্যাকামি-বর্জিত, সপ্রতিভ লেখা বাংলা সাহিত্যে ক্রমেই বিরল হয়ে উঠছে। লেখককে ধন্যবাদ। পোর্টাল-কে শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুনএমন ঋজু, ন্যাকামি-বর্জিত, সপ্রতিভ লেখা বাংলা সাহিত্যে ক্রমেই বিরল হয়ে উঠছে। লেখককে ধন্যবাদ। পোর্টালকে শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুনস্বল্প পরিসরে গল্পটার ব্যাপ্তি অনেকখানি
উত্তরমুছুন-অলোকপর্ণা