রুমা মোদকের অর্ধশতকে ভালোবাসা : রোদ্দুর ভালোবাসা ঘিরে থাকে তাঁর লেখালেখির জগত

নাহার তৃণা

একাধারে তিনি থিয়েটারকর্মী, লেখক এবং একজন শিক্ষক। এ তাঁর নিজস্ব পছন্দে বেছে নেয়া বহির্জগতের পরিচয়। সংসারবৃত্তে তিনি কন্যা-জায়া-জননী। প্রত্যেকটি মাধ্যমেই তিনি যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তবে বিশেষ একটি মাধ্যমের প্রতি রয়েছে তাঁর সুতীব্র আকর্ষণ। বলছি, কথাসাহিত্যিক রুমা মোদকের কথা। রুমা মোদক বর্তমানে গদ্য সাহিত্যে মগ্ন থাকলেও তার "নির্বিশঙ্ক অভিলাষ" শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিল কবিতার। বইটি ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়।
এরপর হবিগঞ্জের সৃষ্টিশীল মেয়েটি 'জীবন সংকেত' নামের থিয়েটার দলে যোগ দেন এবং একজন অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য হিসেবে তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রাখেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় কুড়িটি নাটক রচনা করেছেন, যার প্রত্যেকটির সফল মঞ্চায়ন হয়েছে। নাট্যকর্মী হিসেবে নিজের প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা। স্বাভাবিকভাবে মানুষের সহজাত প্রবণতা হচ্ছে যেখানে অধিকমাত্রায় সম্মান বা আদর পেয়ে থাকে সে বৃত্তেই নিজেকে সে আটকে রাখতে ভালোবাসে। রুমা মোদক এদিক থেকে ব্যতিক্রম। তিনি থিয়েটারের অনেক আলোর ঝলকানি, হাজারো দর্শকের সরাসরি বাহবা কুড়িয়ে নেবার তুমুল বাস্তবতাকে একটু পেছনে ঠেলে, কাছে টেনেছেন তাঁর লেখালেখির জগতটাকে। তাঁর লেখার টেবিল, খাতা-কলম, নোটপ্যাড তাঁর প্রিয়তম জগত। যদিও থিয়েটারে তাঁর কাজটা মূলত লেখক হিসেবেই। লেখালেখির প্রতি তাঁর এই রোদ্দুর ভালোবাসাই বুঝি তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নেয় - "থিয়েটার কর্মী নয় লেখক পরিচয়ই মুখ্য হোক আমার।"

বোঝাই যাচ্ছে তিনি নিজেকে একজন লেখক হিসেবে ভাবতে সবচে' বেশি স্বস্তিবোধ করেন। প্রচুর সময়, শ্রম, প্রতিকূলতার বিনিময়ে কব্জির অসামান্য জোরে আজকে কথাসাহিত্যিক রুমা মোদক নিজের একটি গ্রহনযোগ্য পরিচিতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এই পর্যায়ে পৌঁছানোর যাত্রা সম্পর্কে তাঁর নিজের বক্তব্যটুকু শুনে নেয়া যাক - "যে সমাজ পরিবেশে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা আর বাস, সেখানে সর্বোতভাবেই বাঙালি রক্ষণশীল মধ্যবিত্তের লক্ষ্মণগণ্ডি ভুক্ত এক নারী আমি। কী সামাজিক বাস্তবতা, কী আধাসামন্ত মূল্যবোধ কী সাধ্যের টানাপোড়েন—কোনো আবশ্যিক অনুষঙ্গই আমার লেখক হয়ে ওঠার পক্ষে ছিল না। উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল একটি পাঠের ভুবন প্রাপ্তিই ছিল আমার নিজেকে তৈরি করার নিয়ামক। মূলত আমার সমাজ বাস্তবতায় কোনো নারী লেখক হয়ে ওঠে না। সফল গৃহিণী হয়, সফল মা হয়, স্ত্রী হয়। লেখক হয় না। আমি লেখক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি মানে আমি আমার লালিত বাসনা ছুঁয়ে দেখতে পারছি।"

শিল্প-সাহিত্যচর্চার মতো সৃষ্টিশীল কাজে মানুষকে নিরন্তর লেগে থাকতে হয়। নিজের খামতি ভরাট করতে করতেই এগিয়ে যেতে হয় সৃষ্টিশীল ভুবনের সিংহ দরজার দিকে। রাতারাতি হুট করে এখানে সফলতা কারো পায়ে লুটিয়ে পড়ে না যে বলে ফেলা যাবে - "আমি এলাম, আমি দেখলাম, আমি জয় করলাম (Veni, Vidi, Vici)।” প্রস্তুতির একটা দীর্ঘ পদযাত্রা পেরিয়েই ধরা দেয় মহার্ঘ সফলতা। 

লেখালেখির ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যিক রুমা মোদক নিজেকে প্রস্তুত করার দীর্ঘ যাত্রায় সম্পৃক্ত ছিলেন একনিষ্ঠ সাধকের মতো। নিজেকে প্রমাণের যাবতীয় কলাকৌশল পেরিয়ে আজ তিনি বহু পাঠকের আরাধ্য লেখক। এ সম্পর্কে তিনি কি বলেছেন জেনে নেয়া যাক-

"সেই স্বর্ণকুমারী দেবী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত নারী লেখকদের তো যুদ্ধ করেই নিজেদের জায়গাটা করে নিতে হয়েছে। বরং এই সময়ে এই পরিস্থিতিটা আরও সংকুল। সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশনার জগৎটা বিভক্ত হয়ে গেছে, লেখকেরা যে যাঁর বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন, সেখানে নারীদের প্রবেশাধিকার ততটাই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। " 
সংকুচিত পরিমণ্ডলেও বেশ দাপটের সাথেই লিখে যাচ্ছেন রুমা মোদক। এ পর্যন্ত তাঁর ৫টি গল্পগ্রন্থ, ২টি নাটক, ১টি মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি(ছোটদের জন্য) এবং ১টি কবিতার- মোট ৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও তাঁর বেশ কয়েকটি অর্জন রয়েছে।

থিয়েটার বা মঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতা জীবন ও তার চারপাশটাকে দেখার ক্ষেত্রে যে একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করে তাতে সন্দেহ নেই। আর পাঁচজন লেখকের তুলনায় এদিক থেকে জীবনকে অন্যভাবে দেখার এবং লেখায় তার উপস্হাপনার সুযোগটা তিনি পেয়েছেন। সেটিকে কাজে লাগানোর একটা চেষ্টাও তার লেখালেখিতে আছে। যার নজির তাঁর বিভিন্ন গল্পে ছড়িয়ে আছে। তাঁর গল্পগুলো (অনেক ক্ষেত্রে) আমাদের চেনা হলেও উপস্হাপনার নিজস্ব স্বতন্ত্রতায় একেবারেই অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা দেয় পাঠককে। সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নীতি তাঁর পছন্দ নয়। এক্ষেত্রে তিনি লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। নিজস্ব ভাষাশৈলি তৈরিতে রুমা মোদক বিশেষ যত্নশীল; কাহিনির নানান বিন্যাসও তাঁর লেখায় যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। ছোট গল্প নিয়ে প্রতিনিয়ত নিরীক্ষায় নামতেও তিনি যথেষ্ট উৎসাহী। এ বিষয়ে লেখকের বক্তব্য-

"প্রতিনিয়ত নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাই। পাঠক তো ভালোভাবেই নেয়। কেউ কেউ দুর্বোধ্য বলে অভিযোগ করেন বটে। সেক্ষেত্রে আমি একটু পাঠকের মনোযোগ দাবি করি। কারণ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানবিক অবস্থান ও বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে সাহিত্য কেবল পাঠের আনন্দে সীমাবদ্ধ থাকবে এটা বিশ্বাস করি না।"

রুমা মোদকের একনিষ্ঠ পাঠকমাত্রই তাঁর নিজস্ব ভাষাশৈলির সাথে পরিচিত। সামান্য ঘটনার আখ্যানটিকে তিনি দারুণ মুন্সিয়ানায় বয়ান করতে করতে গড়িয়ে নিয়ে যান এবং বাঁকবদলের শেষ পর্যায়ে নিবিষ্ট পাঠকদের উপহার দেন এক মোহনীয় চমক। রুমা মোদকের লেখা পাঠকের যথেষ্ট মনোযোগ দাবী করে। পাঠক হিসেবে ধৈর্যচ্যুতি ঘটা মানে অনেকক্ষেত্রেই তাঁর লেখনীর মূল রস্বাদন থেকে বঞ্চিত হওয়া। ব্যক্তিগত ভাবে রুমা মোদকের একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে তাঁর কিছু গল্পে( “মুহূর্তের গল্প”, “১৯৭৫”) বিস্তারের গভীরতার অভাববোধ করেছি। কিছু কিছু গল্প আছে যা পড়ে পাঠকের মনে আরো পড়ার তৃষ্ণা জেগে থাকে। এই গল্পগুলোর মধ্যে সেই সম্ভাবনা প্রবল ছিল। পাঠকের মনে খেদ রয়ে যায় গল্পটা শেষ করার পর। সময়ের টানাটানি সংশ্লিষ্ট গল্পে হুট সমাপ্তি টানতে বাধ্য করেছে বলে মনে হয়েছে। দশদিক দশহাতে সামলে তিনি লিখছেন এটা সত্যি, তারপরও স্বার্থপরের মতো চাইবো তিনি এদিকে আরেকটু মনোযোগী হবেন। বর্তমান বাংলা সাহিত্যের দুনিয়ায় আরো কিছু প্রতিভাবান লেখকের সাথে তিনিও একজন লম্বা রেসের ঘোড়া। যেহেতু তিনি একজন নিষ্ঠাবান লেখক, শানিত লেখার পাশাপাশি এবিষয়ে ভাববেন আশা রাখি।

রুমা মোদকের বেশ কিছু গল্প পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে। এখানে পঠিত পছন্দের ৩টি গল্প নিয়ে সামান্য পাঠপ্রতিক্রিয়া জানানোর চেষ্টা করা যাক।

সেলিব্রেটি অন্ধকারের রোশনাই: 

লাইট ক্যামেরার রঙিন ভুবনে একবুক স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে উঠে আসে দুজন মানুষ। নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই, ঘাম, অশ্রু, হতাশা আর সবার উপর মোহনীয় এক ভালোবাসার গল্প এটি। গল্পের মূল চরিত্রের একজন টিটু অন্যজন গল্পের কথক। ভাগ্যগুণে কথকের প্রথম কয়েকটি সিনেমা হিট হওয়ায় জৌলুশময় জীবনটা হাত ফস্কে যায়; হাভাতেপনার কারণে মুটিয়ে গিয়ে উঠতি ক্যারিয়ারটাকে মাঝপথেই দাঁড় করিয়ে দেয়। খাপখোলা তালোয়ারের মত শরীরের নায়িকা না হলে যাদের পোষায় না সেরকম পরিচালকেরা তার দিক থেকে মুখে ফিরিয়ে নেয়ায় ধ্বস নেবে আসে অনিবার্যভাবে। সেটা ঠেকাতে প্রেমিক টিটু আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়..তার বদৌলতে কথক নাটক ,বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে টুকটাক কাজের সুযোগ পায়। যে স্বপ্ন নিয়ে নিজে শহরে এসেছিল এবং নিজের প্রেমিকাটিকেও মা-নানিকে ছেড়ে আসতে প্রলুব্ধ করেছিল, সেই টিটুর ভাগ্যের চাকা আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ পায়না..অবস্হাপন্ন ঘরের ছেলে হয়েও বাধ্য হয়ে তাকে সামান্য প্রোকাডশন বয়ের কাজেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়... অন্যদিকে সফলতা এলেও কথক মেয়েটা নিজের গ্রাম্য সংস্কারের সবটুকু ধুয়েমুছে শহুরে বাতাসে গা ভাসাতে পারেনি। সংস্কারের পাশাপাশি অবশ্য তার ভাঁড়ারেও ছিল না পর্যাপ্ত মজুদ..যে কারণে টিকে থাকার দৌঁড়ে পেছনে পড়ে যায়। এটা তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। সে মেনে নিতে পারে না..অন্যদিকে পরিস্হিতি মেনে নেয়ার বিরল গুণ নিয়ে পরিস্হিতি যথাসম্ভব সামালের চেষ্টায় থাকে টিটু...ভাগ্যের থমকে যাওয়া চাকাটিকে সচল করার ইচ্ছায় টিটুর পরামর্শ মতো একদিন মেয়েটা মেধার যথার্থ মূল্যায়নে পারদর্শী পরিচালকের কাছে যায়। আর এখান থেকেই কাহিনিতে উঠে নতুন ঘূর্ণি। যা টিটু আর তার প্রেমিকা কে দাঁড় করিয়ে দেয় জীবনের নিষ্ঠুরতম সত্যের মুখোমুখি। পাঠকের সামনে পরিবেশিত হয় সেলুলয়েডীয় স্বপ্ন জগতের নোংরা স্বার্থপরতার নানা চালচিত্র। "সেলিব্রেটি অন্ধকারের রোশনাই" গল্পের কাহিনি একেবারে আনকোরা নতুন কিছু নয়, বরং আমাদের অনেকের হয়ত কাহিনিটিকে চেনা মনে হতে পারে। সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ একবার বলেছিলেন, "পৃথিবীর সব গল্প বলা হয়ে গেছে, এখন কীভাবে বলতে হবে সেটাই জানা প্রয়োজন।" চেনা কাহিনি একেবারে নিজস্ব ভঙ্গিতে বলবার কায়দা কথাসাহিত্যিক রুমা মোদকের মুঠোবন্দী। দারুণ এক দক্ষতায় রুমা মোদক যা পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন। বর্ণনার গুণে পাঠক যেন চোখের সামনেই ঘটে যেতে দেখেন দৃশ্যকল্পগুলো। ভীষণ জীবন্ত এবং স্বতন্ত্র গল্পের উপস্হাপনায়।

নদীর নাম ভেড়ামোহনা: 
মুক্তিযুদ্ধের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো যখন গল্পের মধ্যে নতুন করে জীবন ফিরে পায় তখন যেন একাত্তর সালটা আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে দাঁড়ায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জগতজ্যোতি দাসের বীরত্বগাঁথা আমরা ইতিহাসের পাতায় যেটুকু পড়েছি সেই অংশটি আরো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন রুমা মোদক তাঁর ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে তুলে আনেন নতুন একটি গল্প, যেখানে জগতজ্যোতির রেখে যাওয়া পরিবারের বর্তমান চিত্রটা ভেসে ওঠে এবং বাস্তবতার নির্মম সে চিত্রটি আমাদেরকে ভীষণভাবে আহত করে। সাত কোটি মানুষের জন্য একটি মানচিত্র তৈরী করতে গিয়ে যে বীর নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন অকাতরে, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার বংশধর কী নিদারুণ যন্ত্রণায় জীবনের পথ পাড়ি দেয়, স্বাধীনতা বিরোধীদের আক্রোশের শিকার হয়, ধনে প্রাণে মারা পড়ার উপক্রম হয়, এই বাস্তবতা পাঠকের জন্য অপ্রিয় একটি অভিজ্ঞতা। যারা ইতিহাস থেকে জগতজ্যোতি দাসের বীরত্বগাথা পড়েছেন, তাদের অনেকেই হয়ত জানেন না সেই বীরের পরিবার এই স্বাধীন দেশে কতটা নিগৃহীত জীবন যাপন করছে। রুমা মোদক অতি প্রয়োজনীয় একটি দায়িত্ব পালন করেছেন; সেই গল্পটি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন 'নদীর নাম ভেড়ামোহনা'র মাধ্যমে। এই গল্পটি রুমা মোদকের সাহিত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। 


প্রসঙ্গটি বিব্রতকর:
আমার দেশ 'অসাম্প্রদায়িক' এমনটা বুকে কিল মেরে বর্তমান সময়ে বলবার সাহস কেউ দেখাবেন বলে মনে হয় না। পৃথিবী থেকে এই শব্দটি এখন নির্বাসিত। সোনার পাথরবাটি সম্ভব হলেও ভেদাভেদ ভুলে এক মানুষ অন্য মানুষে মেশার ক্ষেত্রে পাঁচিল হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। অতীতেও এটি ছিল, তবে এতটা প্রকট হয়ে নয়, কিন্তু ছিল। খোলা চোখে আমরা সেসব দেখিনা, তাই ইতিহাসে পড়ি সব ধর্মের মানুষ ভাইয়ের মতো, পরম আত্মীয়ের মতো মিলেমিশে বাস করতেন। বাস্তবতা অন্য কথা বলে ফিসফিসিয়ে। 

তারই উৎকট প্রকাশ ঘটতে দেখি ভোট পরবর্তী সময়গুলোতে; দুর্বলের উপর নেমে আসে সবলের নিষ্ঠুর খড়গ। সংখ্যাগুরুর দাপটে ঘুঘু চড়ে সংখ্যালঘুদের ভিটায়, নিরীহ নারী শরীর ঘিরে পাশবিকতার উল্লাসের খবর জমতে থাকে ইতিহাসের পাতায়। সংখ্যাগুরু মুসলমানের বাংলাদেশ থেকে আজন্মের ভিটেমাটি ছেড়ে সংখ্যালঘু হিন্দুরা প্রতিবছর পাড়ি জমান পাশের দেশে। সংখ্যাতত্ত্বের খতিয়ানে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হবে আজকের সময়ে বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর এই কমতিটা। 

এসব বড্ড চর্বিতচর্বণ। বহুবার বলা, শোনা এবং পঠিত বিষয়। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লেখা হয়েছে প্রচুর গল্প উপন্যাস, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ। 

হুট করে একদিন একটি গল্পপাঠের সুযোগ ঘটে যায়। মূলত গল্পের শিরোনামই কৌতূহলী করেছিল গল্পটা পড়তে। গল্পটা পড়া শুরু করতে গিয়ে মনে হলো, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আরো একটি গতানুগতিক গল্প বুঝি। প্রাথমিক বর্ণনার অস্বস্তি কাটিয়ে মূল গল্পে ঢুকে পড়লে জানা যাবে সেখানে পাঠকের জন্য আরো বড় দগদগে এক বাস্তবতা অপেক্ষা করছে। সাদামাটা ভাবে গল্পের সাজানো আখ্যান, যেখানে পাঠক জানবেন ঢাকা থেকে তিনজন তরুণী মফস্বলের এক বনেদী হিন্দু পরিবারের অতিথি হয়ে এসেছে সে বাড়ির বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটির সূত্রে। পরিবারটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তাদের গ্রহন করে। আপ্যায়ের কোনো ত্রুটি থাকে না। কিন্তু যেহেতু আগত তিন তরুণীর একজন মোনা এ বাড়ির ছেলে সমীরের সাথে হৃদয় বিনিময়ের সাথে সাথে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে, তাই সে তার ধর্মীয় অবস্হান থেকে এ বাড়ির সাথে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামায়। আর সেটি করতে গিয়ে তার সামনে চলে আসে এক নির্মম বাস্তবতা। 

যে বাস্তবতা প্রকাশ পায় মোনার খোয়া যাওয়া সামান্য একটি প্যান্টিকে ঘিরে। যা সে কথা প্রসঙ্গে সমীরের সাথে আলোচনা করে। গৃহকর্মী পার্বতী বিষয়টি গৃহকর্ত্রী রাজলক্ষীর কানে তুলে দেয়। রাতারাতি বদলে যায় আন্তরিকতার ইতিহাস ভূগোল। বেরিয়ে পড়ে সযত্নে আড়াল করা প্রাচীন সংস্কার। মোটা দাগের সাম্প্রদায়িকতার ভাষ্য পাঠন পাঠনের অভ্যস্হ মন সাক্ষী হয় এক নীরব মানসিক সাম্প্রদায়িকতার। 

সংখ্যালঘু হিসেবে নিজেদের সংস্কৃতি-সংস্কার খোয়ানোর ভয়ের নীরব প্রকাশ ঘটায় পরিবারটি। এ বিষয়ে লেখকের বক্তব্যটি এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করি- “মূলত মানসিকতায় এ সমাজ কিন্তু এখনও আধা সামন্ততান্ত্রিক। সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী কিংবা স্ব স্ব বিশ্বাস সংস্কার নিয়ে নির্বিবাদে সহাবস্হান করার মতো সভ্য সাংস্কৃতিমান কোনটাই এই সমাজ এখনো হয়ে উঠেনি।”

সমাজ যেহেতু সে অনুশীলনে অভ্যস্ত নয়, তাই অনিবার্যভাবেই মোনা আর সমীরকে মুখোমুখি হতে হয় কাঙ্খিত বাস্তবতার। যাকে চাইলেই মোনা কিংবা সমীর এড়াতে পারে না। সে সাহস দেয় না তাদের স্ব স্ব পারিবারিক সংস্কারাচ্ছন্ন মন কিংবা পরিস্হিতি। একটা সম্ভাব্য বিচ্ছেদ বিষন্নতার রেশ কাহিনির এই অংশ ছড়িয়ে দিয়ে, মর্মান্তিক এক বাস্তবতার বয়ানের মধ্যে দিয়ে গল্পের ইতি ঘটে। যে বয়ান সভ্য হিসেবে আমাদের ব্যথিত করে, বিব্রত করে। সম্প্রদায়িকতার বিষ মানুসিকভাবেও মানুষকে কতটা আক্রান্ত করে এ গল্পটি তার উজ্জ্বলতম নির্দেশন।

“প্রসঙ্গটি বিব্রতকর” গল্পের গোটা আখ্যান জুড়ে একটা শান্ত শীতল আমেজ নিয়ে গড়িয়েছে। অথচ তার টান টান ভাবে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। কী ঘটতে যাচ্ছে সে ভাবনায় পাঠক দারুণ উৎকণ্ঠায় পড়েন। গল্পকার হিসেবে এজন্য রুমা মোদক কুর্নিশ পাওয়ার যোগ্য। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি “প্রসঙ্গটি বিব্রতকর” গল্পটি বাংলাসাহিত্যের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মানবিক গল্প।

কথা সাহিত্যিক রুমা মোদকের জন্য শুভকামনা নিরন্তর। তাঁর শক্তিশালী কলমে রচিত হোক আরো বহু উল্লেখযোগ্য লেখা। সমৃদ্ধ হোক আমাদের মনন, এটাই একান্ত চাওয়া। 












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ