আসতে দেরি হয়ে গেছে। কে-উ ঠিক সময়ে ফেরে না। 'ঘোড়া' নামধারী খচ্চরে টানা জরাগ্রস্ত টাঙাটি, যখন এসে থামল, তখন বিকেল। দিনের বুকে ফুরিয়ে যাওয়ার আগে, শেষবারের মত জ্বলজ্বল করছে বিদায়ী রোদ্দুর। রোদের জেল্লা কম, কিন্তু মুখটি তখনও রাঙা। সোনালি আর মেরুন রঙের এক অলৌকিক সংমিশ্রণ। মায়ামেদুর। ঈশ্বরের স্পর্শের মত অপার্থিব সেই আলোয়, সামনে, প্র-কা-ণ্ড এক প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের-ঘুমের মত দাঁড়িয়ে আছে, বিশালাকায় ইমামবাড়া...... পড়ন্ত রোদে, স্থাপত্যটির হলুদ শরীর, লালচে আভা নিয়ে ধিকিধিকি করে জ্বলছে!
টাঙা থেকে নেমে এগোতেই, সামনে চোখে পড়ল, প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান, বিশাল এক খিলান দেওয়া উন্মুক্ত ফটক। তার অর্ধবৃত্তাকার মাথায়, ঘষে যাওয়া প্রাচীন কারুকাজের, হালকা আভাস। ফটকের ওপরে, আকাশ ছোঁয়ার তীব্র অভিলাষ নিয়ে, ইট আর সুরকি আর লোহার-পর্দার ওপর ভর ক'রে, দু'টি সংযুক্ত মিনার, সিয়ামিজ়-জমজের গভীর নিঃসঙ্গতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাথার ওপর, শতাব্দীর শ্যাওলা পড়া গম্বুজ। ফটকের দুইদিকে, প্রশস্ত দ্বিতল দেয়াল জুড়ে, ছোট ছোট খিলান দেওয়া, বন্ধ দরজার টানা শৃঙ্খলা। সবক'টি দরজার অবস্থা, হাড্ডিসার ইতিহাসের পাঁজরের মত। কিছু কিছু দরজা ভালো করে নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায়, সেগুলোর গায়ে কোন এক দিন সবুজ রং ছিল। এক-মানুষ সমান প্রতিটি দরজায়, কাচের পাল্লা ছিল। সময়ের আঘাতের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে, বৃদ্ধ দরজার দল, এখন ভাঙা-চশমার কাচের অস্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে, দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জীর্ণ দেহে ঘন ধুলোর ধোঁয়াশা। মূল ফটকের মুখে, শান-বাঁধানো চিলতে রোয়াকে, ইতিহাসের দিকে পিঠ করে ব'সে, নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় মগ্ন, পরিচ্ছন্ন দু'টি বর্তমানের মানুষ। পেছনে ফিরে তাকাবার ইচ্ছে তাদের নেই; অথবা এও হতে পারে, প্রতিদিন ইমামবাড়ার দিকে তাকিয়ে, ইতিহাসের পাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে, একটা নিরাসক্তি এসে গেছে মনে। হয়ত স্থানীয় মানুষ। ইতিহাস অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে!
অকিঞ্চিৎকর মানুষের অস্তিত্ব উপেক্ষা করে, সে চোখ রাখল বিশাল বাড়িটির শরীরে। ঠিক বাড়ি বলা যায় কি? কে থাকে অন্দরমহলে? কারা হাঁটে? ........ নিঃশ্বাস নেয়? বাড়িটিও বিকেলের দোরগোড়ায়, হলদে-খয়েরি রঙের, বিধুর আলখাল্লা প'রে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়স অনেক হয়েছে তার...... অ-নে-ক ........ অ-নে-ক ........ শতাব্দীর পার....... সুঠাম শরীরের স্মৃতি থেকে, বাস্তবের বয়স্ক পলেস্তারা, খসে খসে পড়ছে জায়গায় জায়গায়। গাঁথনির গাঁটে গাঁটে, শিথিল সময়ের অসংলগ্ন দাবী! ঔজ্জ্বল্য মলিন। জঙ্গম সময়ের, সহস্র জল-হাওয়া-ঝড়, স্থবির স্থাপত্যের ওপর দিয়ে বয়ে গেলে, জৌলুস হারিয়েছে তার....... মুমূর্ষু শরীর তবু ধাত্রীর ক্ষমতা রাখে। অশীতিপর গাঁথনির গায়ে, ফাটলের বলিরেখা থেকে, রৌদ্রের দিকে চোখ মেলে তাকায়, কচি কচি সবুজ পাতাদের হাত....... নতুন জীবন..... অশথের, বটের, হয়ত বা মুথা ঘাসের...... পৃথিবীর বুকে, জীবনের আশ্চর্য প্রবাহ, টিকে থাকে জড় আর জীবিতের জারজ শরীরে!
ইমারতটির বিশালত্বের সামনে, নিজের ক্ষুদ্রতার ভারে নতজানু হয়ে, ইতস্তত পায়ে, মূল খিলানের প্রাচীনতার ভেতর দিয়ে, অন্দরে প্রবেশ করে সে। দু'-পাশে লম্বা লম্বা গোল থামের সারণী, টানা বারান্দাকে কয়েদ করে আটকে রেখেছে। বিকেলের পড়ন্ত আলো, একলা বারান্দার গায়ে, থামেদের ছায়ার, অবিরাম তির্যক দাগ কেটে বসে আছে। চারিদিক শুনশান। কেউ নেই। তারা কারা- যারা থাকে এইখানে? কারা থাকে! ডানদিকের বারান্দার বুকে পা রাখে সে। বাতাসের নিঃসঙ্গতা সঙ্গী ক'রে এগোয়...... একটা থামের পর আর একটা থামের, শীতল শরীর ছুঁয়ে হাঁটে। তার সঙ্গে ইমামবাড়ার দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে, হেঁটে চলে তার নিজের ঘোলাটে ছায়া.... চলমান ছায়া... বেঁকেচুরে অবাধ্য শিশুর মত, বারান্দার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কক্ষগুলির খিলান দিয়ে, ঘরের আবছায়ে ঢুকে পড়ে..... বেরিয়ে আসে... আ-বা-র পরের ঘরে ঢুকে, ভেতরের হলুদ আঁধারে হারিয়ে যায়! নিস্তব্ধ পায়ে হাঁটতে হাঁটতে, একটা ঘরের সামনে গিয়ে জমে যায় সে। ঘরটির আবছায়া অন্ধকারে, জ্বলজ্বল করছে একটি সাদা মূর্তি। সাদা ফেজ় টুপি, সাদা দাড়ি, সাদা জোব্বা। হাঁটু-মোড়া অবস্থায় বসে আছে মূর্তিটি। নমাজ় আদায়ের স্থির ভঙ্গিমায়। স্তব্ধতারও বুঝি শব্দ হয়!- মূর্তিটি ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়... কণ্ঠস্বরের শান্ততায় বলে ওঠে....
-"আনে মে... ব-ড়ি দের কর দি বেটি" ................
-থামের বধিরতায়, গমগম ক'রে ধ্বনিত হয় তার স্বর! সেই ধাক্কায়, ঘুম ভেঙে চকিতে, ঘরের অন্ধকার থেকে হাহাকারের মত ডানা ঝাপটিয়ে, হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে এক ঝাঁক পায়রা.... বারান্দায় পাথরের মত দাঁড়িয়ে পড়ে সে!
মূর্তিটি আবার ঘাড় ঘুরিয়ে, ঘরের অন্ধকার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। থামে থামে প্রতিধ্বনি হতে থাকে একটাই আওয়াজ-
"দে-র ক-র দি বে-টি"...
"দে-র ক-র দি বে-টি".....
-সম্বিৎ ফিরে পায় সে! ত্রস্ত পায়ে, কক্ষের সামনে থেকে সরে যায়। এগিয়ে যায়, থামেদের ধূসর ছায়াদের, বোবা দঙ্গলের ভিড়ে। কে এই একলা মানুষ???- মনে প্রশ্ন জাগে তার! জানবার তীব্র আকাঙ্ক্ষার পীড়া, তাকে উদ্বেল ক'রে তোলে........ উত্তেজিত হয় সে! শুয়ে-থাকা নির্জন বারান্দার বুকে, একটু জোরে, পায়ের নীচ থেকে খসখস আওয়াজ ওঠে- তাকিয়ে দেখে, পায়ের তলায় পিষে গেছে, এক গোছা খড়কুটো..... কঙ্কালের ভাঙা হাড়ের টুকরোর মত, ছড়িয়ে আছে তারা... নষ্টনীড়ের ছিন্নভিন্ন ধ্বংসাবশেষ! থামের মাথার অন্ধকার থেকে, মৃদু তীব্রতায়, বকম্ বকম্ ক'রে, বিরক্তি প্রকাশ করে পায়রাদের পরিবার। তাদের অস্তিত্ব আবছায়া... ছায়াময়... শুধু প্রেতযোনির চাপা কান্নার মত একটানা, একঘেয়ে, আছন্ন করা ডাক... অবিরাম ডেকে যাওয়া... গা ছমছম করে ওঠে তার!
কী যেন উড়ে যায় তার গালের পাশ দিয়ে! ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক লাগে। শিউরে ওঠে সে! গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় অজানার আশঙ্কায়!- কিছু একটা... কিন্তু কী?..... বুঝতে পারে না। দেখা যায় না। চারিদিকে গোধূলির গ'লে গ'লে পড়া, চাপ চাপ রক্তিম আঁধার..... সে শুধু অনুভব করে, এক তৃতীয় অস্তিত্বের.... তার সাথে সাথে হাঁটছে........ একটু তফাতে। দূরত্ব বজায় রেখে। কে হাঁটে তার সাথে... পায়ে পায়ে!! সে-ই বৃদ্ধ না কি! পেছনে ঘুরে তাকায়- কেউ নেই! কাউকেই দেখা যায় না.... শুধু দেখতে পায়, থামের ছায়ার সারির, 'দাঁত' বের ক'রে, বারান্দাটা যেন বিশ্রী ভাবে হাসছে!
-সে হাসি পিশাচের হাসির মত ....... কেবল কোনও আওয়াজ নেই !!!
দু'টো থামের মাঝে, এসে দাঁড়াল সে। থামের গায়ে অস্পষ্ট প্রাচীন লিপি- আরবি অথবা উর্দু...... দুর্বোধ্য সাংকেতিক চিহ্ন। মাকড়শার-জালের আড়ালে, আছন্ন হেঁয়ালির মত। লিপির মাথায়, সূক্ষ্ম-কারুকার্যের মলিন স্মৃতি। তখন সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। প্রকাণ্ড বাড়িটি আস্তে আস্তে, অশরীরী আত্মার মত জেগে উঠেছে। কোথা থেকে যেন একটা অপার্থিব আলো আসছে। মৃদু, খুব মৃদু- সংজ্ঞাহীন উদ্ভাস...... সেই আলোর নরম জ্যোৎস্নায়, জেগে উঠছে যেন, সমগ্র ইমামবাড়ার অন্দরমহল। অনতিদূরে, ওদিকের বারান্দায়, হঠাৎ দুলে উঠল বিশাল ঝাড়বাতি!-
-তার কাচের শরীর থেকে ভেসে এল সুরের মূর্ছনা........
টুং..... টাং......... কোমল-গান্ধার!
কীসের জলসা!
কী হল!
-হাওয়া নেই, তবু ঝাড়লণ্ঠন দুলে ওঠে কেন! কেন অনুপম বেলোয়ারি-ঝাড়ের কাচে, ঝিকিয়ে উঠল নরম আলো! ঝাড়ের নীচে ও কে... ধী-র পায়ে হাঁটে?... মাথায় পশমের লম্বা ফেজ়, পরনে আলখাল্লা... ঈষৎ ন্যুব্জ.......
কে?
কে?....
-কে পায়চারি করে ছায়ার বারান্দায়, নাছোড়বান্দা স্মৃতির মতন?.... ও কী শুনি!- ছায়া গান গায়! গুন গুন কলি ভাসে সন্ধের গায়ে.......
"কোই উম্মিদ বর নহী আতি
কোই সুরৎ নজ়র নহী আতি
মৌত কা ইকদিন মুয়াইয়ঁন হ্যঁয়
নিন্দ কিঁউ রাত ভর নহী আতি ..........."
-কে এই ধূসর সন্ধ্যায়, গ়ালিবের গ়জ়ল গলায় ঢেলে, মৃত্যুর হলফনামা শোনায়?...........
গা়লিব স্বয়ং!!!
এ মিথ্যা!
এ মিথ্যা!
এ কী করে হয়!! ............
-তাহলে যে ছায়ামানুষটি বারান্দায় ভাসে...... সে কে? কার অতৃপ্ত আত্মা? .... কার প্রা-চী-ন কণ্ঠস্বর, আজও ইমামাবাড়ার অন্দরমহলে, নশ্বর জীবনের পয়গা়ম পাঠ করে! অতর্কিতে তার পেছনের দূরের বারান্দার থেকে, বজ্রের মত একটা আওয়াজ গর্জে ওঠে-
"দে-র ক-র দি বে-টি"........
কানে তালা-ধরা আর্তনাদের মত গুমরে ওঠে সেই ধ্বনি-
"দে---র ক---র... দি... বে---টি" ....................
-চমকে ওঠে সে! তাকিয়ে দেখে, দূ-রে, অস্পষ্ট থামের ফাঁকে, ঝাপসা এক সাদা আকৃতির কুণ্ডলী, যেন তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে....... ভালো ক'রে ঠাহর ক'রে তাকাতেই বোঝা গেল.... কেউ নেই! কেউ কোত্থাও নেই! থামের ছায়াগুলোর কালো অন্ধকার মেখে, ধূসর বারান্দা, তখনও বিশ্রীভাবে হাসছে!!
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! মনে হল, শতাব্দী প্রাচীন ইমামবাড়ার চবুতরায়, যেন জেগে উঠেছে এক স্বপ্নপুরী...... প্রতিটা থামের আড়াল থেকে, প্রতিটা অন্ধকার কক্ষ থেকে, দোতলার অন্ধকার বারান্দার কড়িবর্গা থেকে- ধোঁয়ার মতন, বাতাসের কুণ্ডলীর মতন, নেমে আসছে অতীত, অতীতের অসংখ্য অখণ্ড মুহূর্তেরা... কাচের রিনরিনে শব্দ.... অস্পষ্ট আজানের আকুতি..... ধর্মভীরু মানুষের কোলাহল...... জেগে উঠেছে হাজার বছর আগের, ইমামবাড়ার থামের গায়ে আঁকা নক্কাশী- অপরূপ কারুকার্য..... ভাস্কর্য... মর্মর পাথরে বাঁধানো মেঝের বুকে, ইতিহাসের পায়ের শব্দ........ দেয়ালের গায়ে খচিত, পবিত্র কোরানের আয়াত, ফিরে পেয়েছে বিশ্বনবীর কণ্ঠস্বর....... কবরের অনন্ত শয়ন ছেড়ে, উঠে এসেছেন সাধকেরা....... 'জা়রি দালান'- নামের হর্ম্য প্রার্থনাঘরের দিকে, তারা ধীর-পায়ে হেঁটে চলেছেন, মৌন শবযাত্রার মত........ বিকেলের শুকনো ফোয়ারায়, হঠাৎ প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে.... তার পাশ দিয়ে কে যেন চলে গেল!- না কি তাকে ভেদ করে চলে গেল কেউ! যেতে যেতে, ফিস ফিস করে বলে গেল-
"দে.......র ক.......র ......দি...... বে.........টি" !!!!!!!!
-শিরদাঁড়া দিয়ে, ঠাণ্ডা একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল তার.... প্রার্থনাকক্ষের দিকে তাকাতেই, আরও এক অভূতপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ল!- সুশোভিত কক্ষের দেয়ালের গায়ে, খচিত জা়ফরির ভেতর থেকে, তির্যক এক আলো এসে পড়েছে, ঘরের এক প্রান্তে রাখা, একটি মনোরম কাঠের সিংহাসনের ওপর.... সিংহাসনটি দুলছে.... আস্তে আস্তে তার মাঝে ফুটে উঠছে একটি অবয়ব...... সাদা আকৃতি....... সাদা ফেজ় টুপি! সাদা দাড়ি! সাদা জোব্বা........ সে-ই বৃদ্ধ মানুষটি! তার রুদ্ধশ্বাস চোখের সামনে, ঘটে চলেছে, জন্ম-জন্মান্তরের অলৌকিক ঘটনাবলী....... বৃদ্ধ'র সামনে খোলা, 'পবিত্র কোরান'....... মানুষটি পাঠরত... পড়তে পড়তে একবার, বই থেকে মুখ তুললেন তিনি... একদৃষ্টে তার দিকে তাকালেন... তাঁর চোখ থেকে জ্যোতি বেরচ্ছে যেন! মণি দুটো জ্বলছে.... প্রশান্ত সৌম্য তাঁর মুখখানি..... আবার বইয়ের পাতায় চোখ নামিয়ে নিলেন.....
কে এই পবিত্র মানুষটি!
-তার ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে যায় ওই ঘরে, মানুষটার সামনে নতজানু হয়ে জিজ্ঞেস করে... "কে আপনি?".... ঠিক তখনই, গোটা ইমামবাড়ার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে, ঢং...... ঢং.......... ক'রে, ঘণ্টা বেজে ওঠে ওপরের ঘড়ি-ঘর থেকে। ঘণ্টার প্রতিটি প্রহরের প্রহার, যেন তার নিজেরই দমবন্ধ করা হৃদপিণ্ডের অস্থির স্পন্দন! তীব্র প্রতিধ্বনির আঘাতে, এক-লহমায় চুরমার হয়ে যায় স্বপ্নের ঘোর... ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে যায় ছায়াময় সাধকেরা! শুভ্রকান্তি প্রৌঢ়! নিভে যায় ঝাড়লণ্ঠনের রোশনাই! থেমে যায় ফোয়ারা!
সে তাকিয়ে দেখে চারিদিকের ঘন অন্ধকার.......
শুধু চাপ চাপ আলকাতরার মত ঘন অন্ধকার............
কিন্তু ভয় হয় না আর। তার মনে হয়, সে যেন এই ইমামবাড়ার বারান্দায়, যুগে যুগে এসেছে। বসেছে। উঠোনের এক পাশে রাখা মহরমের তাজিয়া, সাজিয়ে গেছে বছরের পর বছর...... হাসান আর হুসেনের করুণ নাম- ঠোঁটে নিয়ে, রক্তাক্ত করেছে ব্যাকুল হৃদয়!! জন্মের পর জন্ম পেরিয়ে পেরিয়ে, থামের শীতল শরীরে পিঠ রেখে বসে, আজানের ডাক শুনে এসেছে...... ইমামবাড়ার নিস্তব্ধ হাওয়ায়, সে নিজের অস্পষ্ট চেহারা দেখতে পায়... অ-নে-ক অ-নে-ক যুগ আগেকার কথা, ব-হু-যু-গ আগেকার ছবি সেইসব... জন্ম, মৃত্যু, স্মৃতির- এই অদ্ভুত ঐশ্বরীয় খেলায়....
মনে হল-
এইখানে... এখানেই তো আসার ছিল তার.....
নিজের এক বিস্মৃত অন্তরাত্মার!
এতদিন আসা হয়ে ওঠেনি যে তার!
ইতিহাস বিচ্ছিন্ন দুহিতার........
-পরম মমতায়, থামের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে, অনিচ্ছাজড়িত নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে, বেরিয়ে আসতে থাকে ইমামবাড়ার অন্ধকার গহ্বর থেকে... ফিরতে হবে! ফিরতে হবে তাকে.....
খিলান-দেওয়া ফটকের কাছে, অন্ধকারে তার পা, কীসের সঙ্গে ঠোক্কর খেল যেন! থমকে দাঁড়াল সে- কী ওটা? পড়ে আছে....! নীচু হয়ে কুড়িয়ে, হাতে তুলে নিতেই, শিহরণ খেলে গেল তার সমস্ত শরীরে! শরীরে! মন্ত্রমুগ্ধের মত ওখানেই জমে গেল সে...
একটা পুরোনো সাদা ফেজ় টুপি!
অনেকটা, সেই বৃদ্ধের মাথায় যেমন দেখেছিল সে.......
-টুপিটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে, কাঁপতে কাঁপতে, সে ফটক ছেড়ে বেরবে- এমন সময়, ইমামবাড়ার ধূসর চিরে, মনে হল, যেন গমগম করে, ভেসে এল সেই স্বর....
" ..........বড়ি...... দের....... কর....... দি........বেটি..............."
- ফিরে তাকাতে... অন্ধকার ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা গেল না!
মৌলীনাথ গোস্বামী:- পরিচিতি
Email: moulinathgoswami@gmail.com
জন্ম- ১৯৭০। আজন্ম বসবাস আসানসোলে। স্কুলজীবন কেটেছে আইরিশ মিশনারিদের মাঝে। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে, রাজ্য সরকারের আধিকারিক।
দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা ও গল্প, উপন্যাসের চর্চা করে চলেছেন। বিশ্বাস করেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বস্তু নিয়ে কবিতা এবং গল্প রচনা করা সম্ভব। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে প্রেম, বিচ্ছেদ, মানুষের সামাজিক অবস্থান এবং গভীর মৃত্যু-চেতনা। একাধিক পত্র-পত্রিকায়, তাঁর কবিতা, গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ- "দয়াল"- প্রকাশকাল, বইমেলা, ২০২০, প্রতিভাস প্রকাশনা।
লিখবেন, যতদিন জীবন লেখাবে তাঁকে দিয়ে...
11 মন্তব্যসমূহ
বড় ভালো লাগল মৌলী... এ গল্প এক মোহ, এক অতন্দ্র আবহ, এক আকস্মিক বিস্ময় দেয় প্রতিটি মাত্রাকে.. লেখ মৌলী লেখ, লিখে যা এমনভাবেই...
উত্তরমুছুনচেষ্টা করে যাই....
মুছুনদম চাপা উত্তেজনায় পড়া গেলো শেষ পর্যন্ত... দারুন একটা লেখা পড়লাম... এতো নিখুঁত ভাবে দেখেন আপনি... দারুন...🙏
উত্তরমুছুনআপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। আমার কৃতজ্ঞতা জানবেন।
মুছুনভীষণ ভালো লেখা। একদম গদ্য কবিতার মতন । রহস্য,মায়া,নিপাট ভালোবাসা গল্পের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে অত্যন্ত যত্নসহকারে জড়ানো ।
উত্তরমুছুনভীষণ ভালো লাগল আপনার মন্তব্য পড়ে। আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনঅদ্ভুত মাধুর্যময় লেখা, খুবই উপভোগ করলাম। ধন্যবাদ লেখকে।
মুছুনসময় নিয়ে পড়েছেন, এটাই আমার পরম প্রাপ্তি। অনেক ধন্যবাদ জানবেন।
মুছুনপড়লাম। শিহরিত হতে হতে ডুবে গেলাম ইতিহাসের অতলে। নিপুণ বুননে একটি অসাধারণ গল্প। লেখককে জানাই অঢেল শুভেচ্ছা!
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি আপনাকে আকৃষ্ট করেছে জেনে আনন্দিত হলাম। ভালো থাকবেন।
উত্তরমুছুন