ডালিম গাছে মৌ
এত ডাকি তবু কথা
কসনা কেন বৌ-
এটাও লিমেরিক।
এটাও লিমেরিক।
এক লাইন বাদ দিয়ে দিয়ে অন্তমিলের ছড়া। নাকি প্রথম দুটো লাইন আর অসমান পঞ্চম লাইনের ছন্দ বা অন্তমিলের খেলা। আয়ারল্যান্ডের লিমেরিকে এক সেনাধিপতির এই অন্তমিলের পারমুটেশনের ছড়া ক্রমশঃ গানের মতো সৈন্যদের মুখে মুখে অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আমরা তো সুকুমারের হাত ধরে লিমেরিকের মজা পেলাম। জানলাম এডওয়ার্ড লিয়রের কথা। ক্রীতদাস প্রথা বা বর্ণবৈষম্যর কথা জানার আগেই হাতে পেয়েছি আঙ্কেল টমস্ কেবিন। হার্ড বাউন্ড নিউজপ্রিন্টে ছাপা অসংখ্য ভুলসহ, বাজে প্রচ্ছদের একটা বাংলা বই। কিন্তু গল্পটা যে মাথায় ঢুকে গেল। চিন্তাটাও। বা যদি বলি দেব সাহিত্য কুটীরের কমেডি অফ শেকস্পীয়র যার মলাটে এক সাদা দাড়িওয়ালা মুখে ছবি, যেটা আর যারই হোক শেকস্পীয়রের নয় বোধহয়। কিন্তু মার্চেন্ট অফ ভেনিস, মিড সামার নাইটস্ ড্রিম, কমেডি অফ এররস্ আমার নিজের হয়ে গেল। ক্রমশঃ চৈতালী রাতের স্বপ্ন দেখা শুরু, আমি একা দেখিনি, অজস্র ছেলেমেয়েকে অভিনয়ও শিখিয়েছে ঐ নাটক।
ন্যোতরদাম গির্জা পুড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ছেলেকে ফোন করেছিলাম। মনে হচ্ছিল আঁচটা আমার মনে লাগছে। আমার ছেলের মনেও কি লাগছে না? নিজে বাংলায় পড়েছি। ছেলেকে দিয়েছিলাম ইংরেজিটা। কিন্তু বইটা কে ফরাসীতে লিখেছিলেন ভিক্টোর হুগো মশাই। ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে মনে হলো, প্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক চিন্তাটা একই। একইভাবে আসছে মনে। ন্যোতরদাম গির্জার জলন্ত কাঠের বরগাগুলো, ঘন্টা ধরে ঝুল খাওয়া কদাকার কুঁজো মানুষটাকে বিপন্ন করে ফেললো কি? চরিত্রটা আজও জীবন্ত।
এই প্রসঙ্গগুলো কেন? আমরা তো এর পাশাপাশি মহাকাব্য পুরাণ পার হয়ে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এসেছি। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বিশ্বদরবারে নিজের চেষ্টায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর? আমরা তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মূখ্য দুই উপাধ্যায়েরই ভক্ত। প্রেমেন্দ্র মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, সন্তোষকুমার, নরেন মিত্র---এদের ছোটগল্প পড়ে কি আমরা ভাবতে বসি না? পঞ্চাশের দশকের কথাকার---সুনীল, শ্যামল, মতি---এরা যে প্রতিযোগিতার আগেই ডিসকোয়ালিফায়েড। নিতান্ত উন্নতিশীল দেশের রিজিওনাল ভাষার লেখক হয়ে রয়ে গেলেন। পরের প্রজন্মের লেখকদেরও একই হাল।
বাংলা তো সেই প্রাচুর্যময় ভাষাগুলোর একটি যার নিজের হরফ আছে। সেই হরফের বিবর্তন আছে। নিজস্ব সাহিত্য আছে। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস কি নেই? যা নেই তা অনুবাদ। বাংলা ভাষায় বিদেশী সাহিত্যের শুল্কহীন আমদানি আমাদের মন ভরিয়েছে। ঋদ্ধ করেছে। উল্টোটা তখনই হয় যখন কোনো নিজস্ব উদ্যোগে কেউ এগিয়ে যান।
মা এবং দুই নাতি নিয়ে চার প্রজন্ম----আমি দেখে যাচ্ছি। সব প্রজন্মই দেশ বিদেশের অনুদিত সাহিত্য বাংলা বা ইংরেজিতে পড়ে বড় হচ্ছি।
কিন্তু পৃথিবীতে কমবেশি একশো পঁচানব্বই টা দেশ।৭৫০ কোটি জনসংখ্যার মোট ৪৫ শতাংশ লোক শিক্ষিত, ঘরে ঘরে প্রযুক্তি। উচ্চশিক্ষার বিজ্ঞাপনে সব মিডিয়ার ঝলকানি। আমাদেরও দুটো সংস্থা আছে। সাহিত্য একাডেমী কেন্দ্রীয়, বাংলা একাদেমী রাজ্যের। এরা নিজেদের বানান আ,অ্যা না এ দিয়ে হবে তা নিয়ে যত চিন্তিত, সেমিনার নিয়ে যত চিন্তিত, অনুবাদ নিয়ে নয়। প্রকাশকদেরও অনুকম্পার পাত্রটি হলেন লেখক। ইংরেজি ভাষা এখন সারা বিশ্বের কাজের ভাষা। এই একটি ভাষায় অনুবাদেই তো সর্বত্র পৌঁছাতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন গ্রুপ খুললে এখনো জানা যায়---পাঠক নিতান্ত কম নয়।
আমার কন্যা যখন গর্ভস্থ, তখন আনা কারেনিনা পড়েছিলাম। দুটো খন্ড। অনুবাদ- ননী ভৌমিক।
রয়েসয়ে পড়তাম। কখনো নিজেকে আনা ভাবতা, কখনো লেভিন। পুরুষ চরিত্র তো কি! সেই তো টলস্টয়ের রিফ্লেকশন। বই শেষ করে মন বিষণ্ণ হয়ে গেলো।
কিন্তু ফ্রান্সের কোনো যুবক কি আরণ্যক পড়েছেন?
আমি তো কুন্দেরা পড়ছি ইংরেজিতে। কোনও রাশিয়ান বালক কি চাঁদের পাহাড় পড়ে নিজেকে শংকর ভেবেছে?
আমেরিকা থেকে ফেরার পর শুনেছি বাবার মুখে---- সল বেলোর সঙ্গে আলাপের সময় তিনি জানতে চান বাবা তাঁর লেখা পড়েছেন কিনা। বাবা বলেছিলেন, বাবা পড়েছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই বাবার নামও শোনেননি। ঠিক তাই, গল্প করতে করতে তিনি জানতে চান, বাবা কি চান তাঁর কাছে। বাবা বলেছিলেন, তিনি যেন তাঁর লেখার বিষয় যে জায়গা জুড়ে, তা গাড়ি চালিয়ে ঘুরে দেখান। সেটাই হয়েছিলো।
আসলে ভাষা ভাষা করে চেঁচিয়ে কি করবো,ইংরেজি ভাষা একটি মাল্টি কুইজিন রেস্তোরা, আমাদের সুখাদ্যগুলো কি আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে, সেখানে পরিবেশন করতে পারি না? ইবুকের কল্যাণে সব সাহিত্যলোভীই তা চেখে নিতে পারে। গ্লোবালাইজেশন শুধু চাকরির, বাসস্থানের, ডিগ্রির? আর কিছু আদানপ্রদানের দরকার নেই?
0 মন্তব্যসমূহ