বেড়াল জিনিসটা সহ্য করতে পারিনা একদম ছোটবেলা থেকেই।
আব্বা যখন ছিলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে হৃদযন্ত্র দ্বিতীয়বার বন্ধ করে যন্ত্র নয় মানুষ প্রমান করায়, তখন সোহরাওয়ার্দীতে দেখা যেতো শয়ে শয়ে বিড়াল।
আমি ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসতাম আব্বার বিছানায়। ছোট ছোট বেড়ালের বাচ্চা আমার কাঁধে ঝাপ দিতো। পায়ের কাছে বসে উচ্ছিষ্ট খেতো। লাথি দিতে চাইলে ফুসে উঠতো মা বেড়াল।
সেইসব দিন থেকে বেড়াল ঘৃণা করি আমি।
সিলেটের ভাষাটা পছন্দ হলো না আমার। শুধু তৃতীয় দিন পুরো কুমার পাড়া খুঁজেও যখন একটা বেড়ালও পাওয়া গেলোনা তখন বাসা ভালোবেসে ফেললাম। ভাষার দুঃখ ভুললাম কিছু।
ততদিনে আমার বেড়াল ভীতি - ঘৃণা আম্মা আর বাবুর পুরো সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। বাসায় বেড়াল ঢুকলে আমি তারস্বরে চিৎকার করতে করতে বাসার সবচেয়ে উঁচু জায়গা ডাইনিং টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে থাকি। আম্মা বাবু ঝাড়ু - লাঠি হাতে তাকে তাড়া করে।
একটা বেহায়া বাদামী বেড়াল বারবার তবু আসছিলো। বুয়া তাকে বাজারের ব্যাগে ভরে ছেড়ে আসলো কোথায়। আমার বাদামী শার্ট একদিন পড়তে দেবার শর্তে বাবু ব্যাগের ওপর গরম চায়ের কেতলী খালি করে দিলো।
(পরে জেনেছি চা ছিল ঠান্ডা। আমার ভাইয়ের মন খুব নরম কিনা)
তো বাবু যখন প্রথম বেড়ালের মাংশ মুখে দিলো, আম্মা ছিলেন একটু ভয়ে। বমি টমি করে দেয় যদি। সে শুধু বললো পরেরবার কালো দেখে এনো তো। শাদা বলে বোধহয় মাংশ টা একটু নরম। আম্মা স্বস্তি পেলেন। ঝোল বেশী নেই দেখে আমি একটু রাগ দেখালাম।
শুধু বেড়ালে হচ্ছিলো না আর। ঝর্ণারপাড় তো আর সোহরাওয়ার্দী নয় যে লাখে লাখে বেড়াল চড়ে বেড়াবে। একটার বেশী দুটো পাওয়া যায়না একসাথে। এইটুকু খাবারে পেট ভরেনা তিনজনের। মাঝে মাঝে আম্মার লোভীর মতো খাওয়া দেখে বিরক্ত হই আমি। একদিন দেখি লুকিয়ে মাথাটা খাচ্ছে। ধরা পড়ে বলে, সারাদিন ঘরের কাজ করে খিদা লেগে যায় বাবা।
সেই আম্মা আর বাবুকে নিয়ে মহা সমস্যা। একটা ছোট কুকুর কাটবেনা কিছুতেই। সে নাকি কোনভাবে আম্মাকে মা বলে ডেকেছে। ছোটভাইও দেখি সুর মেলায়। আব্বা থাকলে...। আরে শুয়োর, আব্বা থাকলে তো তুই শিং মাছই খেতি।
তবু তাদের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। পকেটের শেষ টাকা শেষ করে সব্জি কিনে আনি। সাথে ভাত। হায় ভাগ্য। সেদিনই ছোটচাচী এসে হাজির হন। আম্মা বোঝান, রানা - বাবু কেউ তো মাংশ খেতেই চায়না। ছোটচাচী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ভাইজান বেঁচে থাকলে...
আমরা বেড়াল খাই, কুকুর খাই, ইঁদুর খাই। তেতো করলা পেলে শেয়াল খাই। কেন যেন এমনি খাওয়া যায়না এই মাংশ টা । ভাত কখনোই আমার তেমন পছন্দ না। এখন তো সহজ হিসাব। পাই না তাই খাইনা।
খুব যন্ত্রণা যাচ্ছে কদিন ধরে । খাদ্যযোগ্য কোনকিছুই সুলভ নয় আর। সেদিন দেখলাম হুজুর চাচার ছেলে মনজুর একটা মরা কাক নিয়ে চোরের মতো কোথায় যেন যাচ্ছে। আরে সবাই কি আমাদের রাস্তা পেয়ে গেলো নাকি?
রাতে খেতে বসে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল খুব। বস্তা বাধা তিনটা কুকুরের বাচ্চা পেয়ে নিয়ে এসেছিলাম। তিনটা কুকুরে এইটুকু মাত্র মাংশ হতেই পারেনা।
এরমধ্যে পায়ের একটা মাংশ নিয়ে বাবু আর আম্মার মাঝে বেঁধে গেল তুমুল ঝগড়া। আম্মা বলছেন এই টুকরোটা তিনিই আলাদা করে রেখেছিলেন খাবার জন্য। বাবু চেঁচাচ্ছে তোমাকে তো একঘন্টা হেঁটে কলেজে যেতে হয়না, তোমাকেই কেন খেতে হবে?
আমারো মাথা গরম হয়ে যায়। বাবু কত কষ্ট করে লেখাপড়া করে। আমার দম বের হয় ঘরের খরচ যোগাতে আর এই মহিলা ।
আমিও তর্ক শুরু করি বাবুর পক্ষে। তোমার লজ্জা করেনা কুকুরের মতো কুকুরের মাংশ খেতে?
আম্মা আমাদের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমরা লোভী চোখে চেয়ে থাকি আম্মার দিকে। কদিন পর হয়তো আমরা আম্মাকেও কেটেকুটে খেয়ে ফেলবো।
লেখক পরিচিতি:
গল্পকার।
ইংল্যাণ্ডে থাকেন।
আব্বা যখন ছিলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে হৃদযন্ত্র দ্বিতীয়বার বন্ধ করে যন্ত্র নয় মানুষ প্রমান করায়, তখন সোহরাওয়ার্দীতে দেখা যেতো শয়ে শয়ে বিড়াল।
আমি ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসতাম আব্বার বিছানায়। ছোট ছোট বেড়ালের বাচ্চা আমার কাঁধে ঝাপ দিতো। পায়ের কাছে বসে উচ্ছিষ্ট খেতো। লাথি দিতে চাইলে ফুসে উঠতো মা বেড়াল।
সেইসব দিন থেকে বেড়াল ঘৃণা করি আমি।
সিলেটের ভাষাটা পছন্দ হলো না আমার। শুধু তৃতীয় দিন পুরো কুমার পাড়া খুঁজেও যখন একটা বেড়ালও পাওয়া গেলোনা তখন বাসা ভালোবেসে ফেললাম। ভাষার দুঃখ ভুললাম কিছু।
ততদিনে আমার বেড়াল ভীতি - ঘৃণা আম্মা আর বাবুর পুরো সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। বাসায় বেড়াল ঢুকলে আমি তারস্বরে চিৎকার করতে করতে বাসার সবচেয়ে উঁচু জায়গা ডাইনিং টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে থাকি। আম্মা বাবু ঝাড়ু - লাঠি হাতে তাকে তাড়া করে।
একটা বেহায়া বাদামী বেড়াল বারবার তবু আসছিলো। বুয়া তাকে বাজারের ব্যাগে ভরে ছেড়ে আসলো কোথায়। আমার বাদামী শার্ট একদিন পড়তে দেবার শর্তে বাবু ব্যাগের ওপর গরম চায়ের কেতলী খালি করে দিলো।
(পরে জেনেছি চা ছিল ঠান্ডা। আমার ভাইয়ের মন খুব নরম কিনা)
তো বাবু যখন প্রথম বেড়ালের মাংশ মুখে দিলো, আম্মা ছিলেন একটু ভয়ে। বমি টমি করে দেয় যদি। সে শুধু বললো পরেরবার কালো দেখে এনো তো। শাদা বলে বোধহয় মাংশ টা একটু নরম। আম্মা স্বস্তি পেলেন। ঝোল বেশী নেই দেখে আমি একটু রাগ দেখালাম।
শুধু বেড়ালে হচ্ছিলো না আর। ঝর্ণারপাড় তো আর সোহরাওয়ার্দী নয় যে লাখে লাখে বেড়াল চড়ে বেড়াবে। একটার বেশী দুটো পাওয়া যায়না একসাথে। এইটুকু খাবারে পেট ভরেনা তিনজনের। মাঝে মাঝে আম্মার লোভীর মতো খাওয়া দেখে বিরক্ত হই আমি। একদিন দেখি লুকিয়ে মাথাটা খাচ্ছে। ধরা পড়ে বলে, সারাদিন ঘরের কাজ করে খিদা লেগে যায় বাবা।
সেই আম্মা আর বাবুকে নিয়ে মহা সমস্যা। একটা ছোট কুকুর কাটবেনা কিছুতেই। সে নাকি কোনভাবে আম্মাকে মা বলে ডেকেছে। ছোটভাইও দেখি সুর মেলায়। আব্বা থাকলে...। আরে শুয়োর, আব্বা থাকলে তো তুই শিং মাছই খেতি।
তবু তাদের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। পকেটের শেষ টাকা শেষ করে সব্জি কিনে আনি। সাথে ভাত। হায় ভাগ্য। সেদিনই ছোটচাচী এসে হাজির হন। আম্মা বোঝান, রানা - বাবু কেউ তো মাংশ খেতেই চায়না। ছোটচাচী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ভাইজান বেঁচে থাকলে...
আমরা বেড়াল খাই, কুকুর খাই, ইঁদুর খাই। তেতো করলা পেলে শেয়াল খাই। কেন যেন এমনি খাওয়া যায়না এই মাংশ টা । ভাত কখনোই আমার তেমন পছন্দ না। এখন তো সহজ হিসাব। পাই না তাই খাইনা।
খুব যন্ত্রণা যাচ্ছে কদিন ধরে । খাদ্যযোগ্য কোনকিছুই সুলভ নয় আর। সেদিন দেখলাম হুজুর চাচার ছেলে মনজুর একটা মরা কাক নিয়ে চোরের মতো কোথায় যেন যাচ্ছে। আরে সবাই কি আমাদের রাস্তা পেয়ে গেলো নাকি?
রাতে খেতে বসে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল খুব। বস্তা বাধা তিনটা কুকুরের বাচ্চা পেয়ে নিয়ে এসেছিলাম। তিনটা কুকুরে এইটুকু মাত্র মাংশ হতেই পারেনা।
এরমধ্যে পায়ের একটা মাংশ নিয়ে বাবু আর আম্মার মাঝে বেঁধে গেল তুমুল ঝগড়া। আম্মা বলছেন এই টুকরোটা তিনিই আলাদা করে রেখেছিলেন খাবার জন্য। বাবু চেঁচাচ্ছে তোমাকে তো একঘন্টা হেঁটে কলেজে যেতে হয়না, তোমাকেই কেন খেতে হবে?
আমারো মাথা গরম হয়ে যায়। বাবু কত কষ্ট করে লেখাপড়া করে। আমার দম বের হয় ঘরের খরচ যোগাতে আর এই মহিলা ।
আমিও তর্ক শুরু করি বাবুর পক্ষে। তোমার লজ্জা করেনা কুকুরের মতো কুকুরের মাংশ খেতে?
আম্মা আমাদের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমরা লোভী চোখে চেয়ে থাকি আম্মার দিকে। কদিন পর হয়তো আমরা আম্মাকেও কেটেকুটে খেয়ে ফেলবো।
লেখক পরিচিতি:
গল্পকার।
ইংল্যাণ্ডে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
প্রয়োজনও রুচি নির্ধারণ করে। এই যে অন্যভাবে ভাবা- চমৎকার ঘুমচোখ খুলে দিল।
উত্তরমুছুন