সৈয়দ মুজতবা আলী'র গল্প : পাদটীকা

গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। পাঠান-মোগল আমলে যে দুর্দৈব ঘটেনি ইংরাজ রাজত্বে সেটা প্রায় আমাদেরই চোখের সামনে ঘটল। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা ছেলেভাইপোকে টোলে না পাঠিয়ে ইংরেজি ইস্কুলে পাঠাতে আরম্ভ করলেন। চতুদিকে ইংরেজি শিক্ষার জয়-জয়কার পড়ে গেল-সেই ডামাডোলে বিস্তর টোল মরল, আর বিস্তর কাব্যতীর্থ বেদান্তবাগীশ না খেয়ে মারা গেলেন।

এবং তার চেয়েও হৃদয়বিদারক হল তাঁদের অবস্থা, যাঁরা কোনোগতিকে সংস্কৃত বা বাঙলার শিক্ষক হয়ে হাইস্কুলগুলোতে স্থান পেলেন । এঁদের আপন আপন বিষয়ে অর্থাৎ কাব্য, অলঙ্কার, দর্শন ইত্যাদিতে এঁদের পাণ্ডিত্য ছিল অন্যান্য শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশী কিন্তু সম্মান এবং পারিশ্রমিক এঁরা পেতেন সবচেয়ে কম।শুনেছি কোনো কোনো ইস্কুলে পণ্ডিতের মাইনে চাপরাসীর চেয়েও কম ছিল।

আমাদের পণ্ডিতমশাই তর্কালঙ্কার না কাব্যবিশারদ ছিলেন আমার আর ঠিক মনে নেই কিন্তু এ কথা মনে আছে যে পণ্ডিতসমাজে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রচুর এবং তার পিতৃপিতামহ চতুর্দশ পুরুষ শুধু যে ভারতীয় সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন তা নয়, তাঁরা কখনো পরান্ন ভক্ষণ করেননি-পালপরব শ্রাদ্ধনিমন্ত্রণে পাত পাড়ার তো কথাই ওঠে না।

বাঙলা ভাষার প্রতি পণ্ডিতমশাইয়ের ছিল অবিচল, অকৃত্রিম অশ্রদ্ধা- ঘৃণা বললেও হয়ত বাড়িয়ে বলা হয় না। বাঙলাতে যেটুকু খাঁটি সংস্কৃত বস্তু আছে তিনি মাত্র সেইটুকু পড়াতে রাজী হতেন-অর্থাৎ কৃৎ, তদ্ধিত, সদ্ধি এবং সমাস। তাও বাঙলা সমাস না। আমি একদিন বাঙলা রচনায় ‘দোলা-লাগা’ 'পাখী-জাগা’, উদ্ধৃত করেছিলুম বলে তিনি আমার দিকে দোয়াত ছুঁড়ে মেরেছিলেন। ক্রিকেট ভাল খেলা-সে দিন কাজে লেগে গিয়েছিল । এবং তার পরমু্হুর্তই বি পূর্বক, আ পূর্বক, ঘ্রা ধাতু ক উত্তর দিয়ে সংস্কৃত ব্যাঘ্রকে ঘায়েল করতে পেরেছিলুম বলে তিনি আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘এই দণ্ডেই তুই স্কুল ছেড়ে চতুষ্পাঠীতে যা। সেখানে তোর সত্য বিদ্যা হবে।'

কিন্তু পণ্ডিতমশাই যত না পড়াতেন, তার চেয়ে বকতেন ঢের বেশী, এবং টেবিলের উপর পা দু'খানা তুলে দিয়ে ঘুমুতেন সব চেয়ে বেশী। বেশ নাক ডাকিয়ে, এবং হেডমাস্টারকে একদম পরোয়া না করে। কারণ হেডমাস্টার তাঁর কাছে ছেলেবেলায় সংস্কৃত পড়েছিলেন এবং তিনি যে লেখাপড়ায় সর্বাঙ্গনিন্দনীয় হস্তীমূর্খ ছিলেন সে কথাটি পণ্ডিতমশাই বারম্বার অহরহ সর্বত্র উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতেন। আমরা সে কাহিনী শুনে বিমলানন্দ উপভোগ করতুম, আর পণ্ডিত-মশাইকে খুশী করবার পন্থা বাড়ন্ত হলে এ বিষয়টি নুতন করে উত্থাপন করতুম ।

আমাকে পণ্ডিতমশাই একটু বেশী স্নেহ করতেন । তার কারণ বিদ্যাসাগরী বাঙলা লেখা ছিল আমার বাই; ঐ 'দোলা-লাগা, ‘পাখী-জাগা'ই আমার বর্ণাশ্রম ধর্ম পালনে একমাত্র গোমাংস ভক্ষণ । পণ্ডিতমশাই যে আমাকে সবচেয়ে বেশী স্নেহ করতেন তার প্রমাণ তিনি দিতেন আমার উপর অহরহ নানা প্রকার কটুকাটব্য বর্ষণ করে । ‘অনার্য’, ‘শাখামৃগ', 'দ্রাবিড়-সম্ভুত’ কথাগুলো ব্যবহার না করে তিনি আমাকে সাধারণত সম্বোধন করতেন না; তাছাড়া এমন সব অশ্লীল কথা বলতেন যে তার সঙ্গে তুলনা দেবার মত জিনিস আমি দেশবিদেশে কোথাও শুনিনি । তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে পণ্ডিতমশাই শ্লীল অশ্লীল উভয় বস্তুই একই সুরে একই পরিমাণে ঝেড়ে যেতেন, সম্পুর্ণ অচেতন,বীতরাগ এবং লাভালাভের আশা বা ভয় না করে । এবং তাঁর অশ্লীলতা মার্জিত না হলেও অত্যন্ত বিদগ্ধরূপেই দেখা দিত বলে আমি বহু অভিজ্ঞতার পর এখনো মনস্থির করতে পারিনি যে সেগুলো শুনতে পেয়ে আমার লাভ না ক্ষতি, কোনটা বেশী হয়েছে ।

পণ্ডিতমহাশয়ের বর্ণ ছিল শ্যাম, তিনি মাসে একদিন দাড়ি গোঁফ কামাতেন এবং পরতেন হাঁটু-জোকা ধুতি। দেহের উত্তমার্ধে একখানা দড়ি প্যাঁচানো থাকত-অজ্ঞেরা বলত সেটা নাকি দড়ি নয়, চাদর। ক্লাশে ঢুকেই তিনি সেই দড়িখানা টেবিলের উপর রাখতেন, আমাদের দিকে রোষকষায়িত লোচনে তাকাতেন, আমাদের বিদ্যালয়ে না এসে যে চাষ করতে যাওয়াটা সমাধিক সমীচীন সে কথাটা দ্বিসহস্রবারের মত ম্মরণ করিয়ে দিতে দিতে পা দু'খানা টেবিলের উপর লম্বমান করতেন। তারপর যে কোনো একটা অজুহাত ধরে আমাদের এক চোট বকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। নিতান্ত যে-দিন কোনো অজুহাতই পেতেন না--ধর্মসাক্ষী সে-কসুর আমাদের নয়--সেদিন দু'চারটে কৃৎ-তদ্ধিত সম্বন্ধে আপন মনে-কিন্তু বেশ জোর গলার আলোচনা করে উপসংহারে বলতেন, ‘কিস্তু এই মূর্খদের বিদ্যাদান করার প্রচেষ্টা বন্ধ্যাগমনের মত নিস্ফল নয় কি?’ তারপর কখনো আপন গতাস্থ চতুষ্পাঠীর কথা ম্মরণ করে বিড়বিড় করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অভিশাপ দিতেন, কখনো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে টানা-পাখার দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়তেন ।

শুনেছি, ঋগ্বেদে আছে, যমপত্নী যমী যখন যমের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাতুরা হয়ে পড়েন তখন দেবতারা তাঁকে কোনো প্রকারে সান্ত্বনা না দিতে পেরে শেষটায় তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই আমার বিশ্বাস, পণ্ডিতমশায়ের টোল কেড়ে নিয়ে দেবতারা তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য অহরহ ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। কারণ এরকম দিনযামিনী সায়ংপ্রাতঃ শিশিরবসন্তে বেঞ্চি-চৌকিতে যত্রতত্র অকাতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারাটা দেবতার দান-একথা অস্বীকার করার জো নেই ।

বহু বৎসর হয়ে গিয়েছে, সেই ইস্কুলের সামনে সুরমা নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে কিন্তু আজো যখন তাঁর কথা ব্যাকরণ সম্পর্কে মনে পড়ে তখন তাঁর যে ছবিটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটি তাঁর জাগ্রত অবস্থার নয়; সে ছবিতে দেখি, টেবিলের উপর দু'পা-তোলা, মাথা একদিকে ঝুলে-পড়া, টিকিতে দোলা-লাগা কাষ্ঠাসন শরশয্যায় শায়িত ভারতীয় ঐতিহ্যের শেষ কুমার ভীষ্মদেব। কিন্তু ছিঃ, আবার 'দোলা-লাগা’ সমাস ব্যবহার করে পণ্ডিতমশায়ের
প্রেতাত্মাকে ব্যথিত করি কেন?

সে-সময়ে আসামের চীফ-কমিশনার ছিলেন এন. ডি. বীটসন্‌ বেল্‌। সায়েবটির মাথায় একটু ছিট ছিল। প্রথম পরিচয়ে তিনি সবাইকে বুঝিয়ে বলতেন যে তার নাম, আসলে 'নন্দদুলাল বাজায় ঘণ্টা’ । ‘এন. ডি'তে হয় নন্দদুলাল’ আর বীটসন বেল্‌ অর্থ ‘বাজায় ঘণ্টা’ দুয়ে মিলে হয় 'নন্দদুলাল বাজায় ঘণ্টা’।

সেই নন্দদুলাল এসে উপস্থিত হলেন আমাদের শহরে ।

ক্লাসের জ্যাঠা ছেলে ছিল পদ্মলোচন । সেই একদিন খবর দিল লাট সাহেব আসছেন স্কুল পরিদর্শন করতে-পদ্মর ভগ্নিপতি লাটের টুর ক্লার্ক না কি, সে তাঁর কাছ থেকে পাকা খবর পেয়েছে।

লাটের ইস্কুল আগমন অবিমিশ্র আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নয়। একদিক দিয়ে যেমন বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ কসুর বিনা-কসুরে লাট আসার উত্তেজনায় খিটখিটে মাস্টারদের কাছ থেকে কপালে কিলটা চড়টা আছে, অন্যদিকে তেমনি লাট চলে যাওয়ার পর তিন দিনের ছুটি।

হেডমাস্টারমশায়ের মেজাজ যখন সক্কলের প্রাণ ভাজা ভাজা করে ছাই বানিয়ে ফেলার উপক্রম করেছে এমন সময় খবর পাওয়া গেল, শুক্কুরবার দিন হুজুর আসবেন।

ইস্কুল শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে আমরা সেদিন হাজিরা দিলুম। হেডমাস্টার ইস্কুলের সর্বত্র চরকিবাজীর মতন তুর্কিনাচন নাচছেন। যে দিকে তাকাই সে দিকেই হেডমাস্টার-নিশ্চয়ই তাঁর অনেকগুলো যমজ তাই আছেন, আর ইস্কুল সামলাবার জন্য সেদিন সব ক'জনকে রিকুইজিশন করে নিয়ে এসেছেন।

পদ্মলোচন বললে, ‘কমন রুমে গিয়ে মজাটা দেখে আয়।'

‘কেন কি হয়েছে?’

‘দেখেই আয় না ছাই।’

পদ্ম আর যা করেকরুক কখনো বাসি খবর বিলোয় না। হেডমাস্টারের চড়ের ভয় না মেনে কমন রুমের কাছে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখি, অবাক কাণ্ড। আমাদের পণ্ডিতমশাই একটা লম্বা-হাতা আন্‌কোরা নূতন হলদে রঙের গেঞ্জি পরে বসে আছেন আর বাদবাকি মাস্টাররা কলরব করে সে-গেঞ্জিটার প্রশংসা করছেন। নানা মুনি নানা গুণ কীর্তন করছেন; কেউ বলছেন পণ্ডিতমশাই কি বিচক্ষণ লোক, বেজায় সস্তায় দাও মেরেছেন (গাঁজা, পণ্ডিতমশায়ের সাংসারিক বুদ্ধি একরত্তিও ছিল না ), কেউ বলছেন আহা, যা মানিয়েছে (হাতী, পণ্ডিতমশাইকে সার্কাসের সঙের মত দেখাচ্ছিল), কেউ বললেন, যা! ফিট করেছে ( মরে যাই,গেঞ্জির আবার ফিট-অফিট কি?)। শেষটায় পণ্ডিতমশায়ের ইয়ার মৌলবী সায়েব দাড়ি দুলিয়ে বললেন, ‘বুঝলে ভশচায, এ রকম উম্দা গেঞ্জি স্রেফ দু'খানা তৈরী হয়েছিল, তার-ই একটা কিনেছিল পঞ্চম জর্জ, আর দুসরাটা কিনলে তুমি। এ দুটো বানাতে গিয়ে কোম্পানী দেউলে হয়ে গিয়েছে, আর কারো কপালে এরকম গেঞ্জি নেই।’

চাপরাসী নিত্যানন্দ দূর থেকে ইশারায় জানাল, ‘বাবু আসছেন ।' তিন লম্ফে ক্লাসে ফিরে গেলুম।

সেকেন্ড পিরিয়ডে বাঙলা। পণ্ডিতমশাই আসতেই আমরা সবাই ত্রিশ গাল হেসে গেঞ্জিটার দিকে তাকিয়ে রইলুম | ইতিমধ্যে রেবতী খবর দিল যে শাস্ত্রে সেলাই-করা কাপড় পরা বারণ বলে পণ্ডিতমশাই পাঞ্জাবী শার্ট পরেন না, কিন্ত লাট সায়েব আসছেন, শুধু গায়ে ইস্কুলে আসা চলবে না তাই গেঞ্জি পরে এসেছেন। গেঞ্জি বোনা জিনিস, সেলাই করা কাপড়ের পাপ থেকে পণ্ডিতমশাই এই কৌশলে নিষ্কৃতি পেয়েছেন ।

গেঞ্জি দেখে আমরা এতই মুগ্ধ যে পণ্ডিতমশায়ের গালাগাল, বোয়াল-চোখ সব কিছুর জন্যই আমরা তখন তৈরী কিন্ত কেন জানিনে তিনি তাঁর রুটিন মাফিক কিছুই করলেন না। বকলেন না, চোখ লাল করলেন না, লাট আসছেন কাজেই টেবিলে ঠ্যাং তোলার কথাও উঠতে পারে না। তিনি চেয়ারের উপর অত্যন্ত বিরস বদনে বসে রইলেন।পদ্মলোচনের ডর ভয় কম। আহ্লাদে ফেটে গিয়ে বললে, ‘পণ্ডিতমশাই, গেঞ্জিটা কদ্দিয়ে কিনলেন ? আশ্চর্য, পণ্ডিতমশাই খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন না, নির্জীব কণ্ঠে বললেন, 'পাচ সিকে।’

আধ মিনিট যেতে না যেতেই পণ্ডিতমশাই দু'হাত দিয়ে ক্ষণে হেথায় চুলকান ক্ষণে হোথায় চুলকান। পিঠের অসম্ভব অসম্ভব জায়গায় কখনো ডান হাত, কখনো বা হাত দিয়ে চুলকানোর চেষ্টা করেন, কখনো মুখ বিকৃত করে গেঞ্জির ভিতর হাত চালান করে পাগলের মত এখানে ওখানে খ্যাঁস খ্যাঁস কবে খামচান।একে তো জীবন-ভর উত্তমাঙ্গে কিছু পরেননি, তার উপর গেঞ্জি, সেও আবার একদম নুতন কোরা গেঞ্জি।

বাচ্চা ঘোড়ার পিঠে পয়লা জিন লাগালে সে যে-রকম আকাশের দিকে দু' পা তুলে তড়পায় শেষটায় পণ্ডিতমশায়ের সেই অবস্থা হল। কখনো করুণ কে অস্ফুট আর্তনাদ করেন, 'রাধামাধব, এ কী গব্ব-যন্তণা, কখনো এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরে, দাঁত কিড়িমিড়ি খেয়ে আত্মসম্বরণ করার চেষ্টা করেন- লাট সায়েবের সামনে তো সব্বাঙ্গ আচড়ানো যাবে না।

শেষটায় থাকতে না পেরে আমি উঠে বললুম, ‘পণ্ডিতমশাই, আপনি গেঞ্জিটা খুলে ফেলুন । লাট সায়েব এলে আমি জানালা দিয়ে দেখতে পাব। তখন না হয় ফের পরে নেবেন ।' বললেন, ‘ওরে জড়ভরত, গব্ব-যন্তণাটা খুলছি নে, পরার অভ্যেস হয়ে যাবার জন্য।’

আমি হাত জোড় করে বললুম, ‘একদিনে অভ্যেস হবে না পণ্ডিতমশাই, ওটা আপনি খুলে ফেলুন ।’

আসলে পণ্ডিতমশাইয়ের মতলব ছিল গেঞ্জিটা খুলে ফেলারই; শুধু আমাদের কারো কাছ থেকে একটু মরাল সাপোর্টের অপেক্ষায় এতক্ষণ বসেছিলেন । তবু সন্দেহ-ভরা চোখে বললেন, ‘তুই তো একটা আস্ত মর্কট--শেষটায় আমাকে ডোবাবি না তো? তুই যদি হুঁশিয়ার না করিস, আর লাট যদি এসে পড়েন?'

আমি ইহলোক পরলোক সর্বলোক তুলে দিব্যি, কিরে, কসম খেলুম।

পণ্ডিতমশাই গেঞ্জিটা খুলে টেবিলের উপর রেখে সেটার দিকে যে দৃষ্টি হানলেন, তার টিকিটি কেউ কেটে ফেললেও তিনি তার দিকে এর ঠেয়ে বেশী ঘৃণা মাখিয়ে তাকাতে পারতেন না। তারপর লুপ্ত-দেহটা ফিরে পাওয়ার আনন্দে প্রাণভরে সর্বাঙ্গ খামচালেন। বুক পিঠ ততক্ষণে লাল লাল আঁজিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।

এর পর আর কোনো বিপদ ঘটল না। পণ্ডিতমশাই থেকে থেকে রাধামাধবকে স্মরণ করলেন, আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলুম, আর সবাই গেঞ্জিটার নাম, ধাম, কোন্‌ দোকানে কেনা, সস্তা না আক্রা, তাই নিয়ে আলোচনা করল। আমি সময়মত ওয়ার্নিং দিলুম। পণ্ডিতমশাই আবার তাঁর ‘গব্ব-যন্তণাটা'। উত্তমাঙ্গে মেখে নিলেন।

লাট এলেন, সঙ্গে ডেপুটি কমিশনার, ডাইরেকটর, ইনসপেক্টর, হেডমাস্টার, নিত্যানন্দ-আর লাট সায়েবের এডিপি ফেডিপি না কি সব বারান্দায় জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ‘হ্যালো! পানডিট্’ বলে সায়েব হাত বাড়ালেন। রাজ-সম্মন পেয়ে পণ্ডিতমশারে সব যন্ত্রণা লাঘব হল । বার বার ঝুঁকে ঝুঁকে সায়েবকে সেলাম করলেন--এই অনাদৃত পণ্ডিত শ্রেণী সামান্যতম গতানুগতিক সম্মান পেয়েও যে কি রকম বিগলিত হতেন তা তাঁদের সে-সময়কার চেহারা না দেখলে
অনুমান করার উপায় নেই ।

হেডমাস্টার পণ্ডিতমশায়ের কৃত-তদ্ধিতের বাই জানতেন; তাই নির্ভয়ে ব্যাকরণের সর্বোচ্চ নভঃস্থলে উড্ডীয়মান হয়ে ‘বিহঙ্গ' শব্দের তত্বানুসন্ধান করলেন। আমরা জন দশেক একসঙ্গে চেচিয়ে বললুম,

‘বিহায়স পূর্বক গম ধাতু খ'।

লাট সায়েব হেসে বললেন, ‘ওয়ান এ্যাট এ টাইম, প্লীজ'। লাট সায়েব আমাদের বলল 'প্লীজ', একী কাণ্ড! তখন আবার আর কেউ রা কাড়ে না। হেডমাস্টার শুধালেন ‘বিহঙ্গ’', আমরা চুপ,তখনো প্লীজের ধকল কাটেনি। শেষটায় ব্যাকরণে নিরেট পাঁঠা যতেটা আমাদের উত্তর আগে শুনে নিয়েছিল বলে ক্লাসে নয় দেশে নাম করে ফেললে- আমরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম।

লাট সায়েব ততক্ষণ হেডমাস্টারের সঙ্গে ‘পণ্ডিত’ শব্দের মূল নিয়ে ইংরেজিতে আলোচনা জুড়ে দিয়েছেন। হেডমাস্টার কি বলেছিলেন জানিনে তবে রবীন্দ্রনাথ নাকি পণ্ডিতদের ধর্মে জড়শীলতার প্রতি বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, যার সব কিছু পণ্ড হয়ে গিয়েছে সেই পণ্ডিত।

ইংরেজ শাসনের ফলে আমাদের পণ্ডিতদের সর্বনাশ, সর্বস্ব পণ্ডের ইতিহাস হয়ত রবীন্দ্রনাথ জানতেন না,- না হলে ব্যাঙ্গ করার পূর্বে হয়ত একটু ভেবে দেখতেন।

সে কথা থাক। লাট সায়েব চলে গিয়েছেন, যাবার পূর্বে পণ্ডিতমশায়ের দিকে একখানা মোলায়েম নড্‌ করাতে তিনি গর্বে চৌচির হয়ে ফেটে যাবার উপক্রম। আনন্দের আতিশয্যে নূতন গেঞ্জির চুলকুনির কথা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছেন। আমর দু'তিনবার ম্মরণ করিয়ে দেবার পর গেঞ্জিটা তাঁর শ্রীঅঙ্গ থেকে ডিগ্রেডেড, হল।

তিন দিন ছুটির পর ফের বাঙলা ক্লাস বসেছে। পণ্ডিতমশাই টেবিলে উপর পা তুলে দিয়ে ঘুমুচ্ছেন, না শুধু চোখবন্ধ করে আছেন ঠিক ঠাহর হয়নি বলে তখনো গোলমাল আরম্ভ হয়নি ।

কারো দিকে না তাকিয়েই পণ্ডিতমশাই হঠাৎ ভরা মেঘের ডাক ছেডে বললেন,

‘ওরে ও শাখামৃগ!’

নীল যাঁহার কণ্ঠ তিনি নীলকন্ঠ-যোগারূঢ়ার্থে শিব। শাখাতে যে মৃগ বিচরণ করে সে শাখামৃগ, অর্থাৎ বাদর-ক্লাসরূঢ়ার্থে

আমি উত্তর দিলুম, 'আজ্ঞে।’

পণ্ডিতমশাই শুধালেন, 'লাট সায়েবেব সঙ্গে কে কে এসেছিল বল তো রে।’

 আমি সম্পূর্ণ ফিরিস্তি দিলুম। চাপরাসী নিত্যানন্দকেও বাদ দিলুম না।

বললেন, ‘হল না। আর কে ছিল?’

বললুম, ‘ঐ যে বললুম, একগাদা, এডিসি না প্রাইভেট সেক্রেটারি না আর কিছু সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা তো ক্লাসে ঢোকেননি।’

পণ্ডিতমশাই ভরা মেঘের গুরু গুরু ডাক আরো গম্ভীর করে শুধালেন, ‘এক কথা। বাহান্ন বার বলছিস কেন রে মূঢ়? আমি কালা না তোর মত অলম্বুষ?’ আমি কাতর হয়ে বললুম, ‘আর তো কেউ ছিল না পণ্ডিতমশাই ; জিজ্ঞেস করুন না পন্মলোচনকে, সে তো সবাইকে চেনে।’

পণ্ডিতমশাই হঠাৎ চোখ মেলে আমার দিকে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘ওঃ উনি আবার লেখক হবেন। চোখে দেখতে পাসনে, কানা, দিবান্ধ-রাত্র্যন্ধ হলেও না হয় বুঝতুম। কেন? লাট সায়েবের কুকুরটাকে দেখতে পাসনি? এই পর্যবেক্ষণ শক্তি নিয়ে_’

আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি। ও তো এক সেকেণ্ডের তরে ক্লাসে ঢুকে ছিল।’

পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘মর্কট এবং সারমেয় কদাচ একগৃহে অবস্থান করে না। সে কথা যাক। কুকুরটার কি বৈশিষ্ট্য ছিল বল তো।’

ভাগ্যিস মনে পড়ল । বললুম, ‘আজ্ঞে, একটা ঠ্যাং কম ছিল বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।'

'হুঁ’ বলে পণ্ডিতমশাই আবার চোখ বন্ধ করলেন।

অনেকক্ষণ পর বললেন, ‘শোন। শুক্রবার দিন ছুটির পর কাজ ছিল বলে অনেক দেরিতে ঘাটে গিয়ে দেখি আমার নৌকোর মাঝি এক অপরিচিতের সঙ্গে আলাপ করছে । লোকটা মুসলমান, মাথায় কিস্তিটুপী। আমাকে অনেক সেলাম-টেলাম করে পরিচয় দিল, সে আমাদের গ্রামের মিম্বর উল্লার শালা; লাট সায়েবের আরদালি, সায়েবের সঙ্গে এখানে এসেছে, আজকের দিনটা ছুটি নিয়েছে তার দিদিকে দেখতে যাবে বলে । ঘাটে আর নৌকা নেই । আমি যদি মেহেরবানি করে একটু স্থান দিই।’

পণ্ডিতমশায়ের বাড়ি নদীর ওপারে, বেশ খানিকটে উজিয়ে। তাই তিনি বর্যাকালে নৌকোয় যাতায়াত করতেন আর সকলকে অকাতরে লিফট দিতেন।পণ্ডিতমশায় বললেন, ‘লোকটার সঙ্গে কথাবার্তা হল। লাট সায়েবের সব খবর জানে, তোর মত কানা নয়, সব জিনিস দেখে, সব কথা মনে রাখে। লাট সাহেবের কুকুরটার একটা ঠ্যাং কি করে ট্রেনের চাকায় কাটা যায় সে-খবরটা ও বেশ গুছিয়ে বলল।’

তারপর পণ্ডিতমশাই ফের অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আপন মনে আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আমরা আটজন।’

তারপর হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে ফেলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মদনমোহন কি রকম আক শেখায় রে?'
মদনমোহনবাবু আমাদের অঙ্কের মাস্টার__পণ্ডিতমশায়ের ছাত্র। বললুম,

‘ভালই পড়ান।'

পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘বেশ বেশ। তবে শোন। মিম্বর উল্লার শালা বলল, লাট সায়েবের কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয় । এইবার দেখি, তুই কি রকম আক শিখেছিস। বল তো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাংয়ের জন্য কত খরচ হয়?’

আমি ভয় করেছিলুম পণ্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকমের আক কষতে দেবেন। আরাম বোধকরে তাড়াতাড়ি বললুম,

‘আজ্ঞে, পচিশ টাকা।’ পণ্ডিত-মশাই বললেন, ‘সাধু, সাধু!’

তারপর বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাক্ষণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবাপিসি, দাসী একুনে আটজন, আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাংয়ের সমান?’ আমি হতবাক ।

‘বল না।'

আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।

পণ্ডিতমশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, 'উত্তর দে।’

মূর্খের মত একবার পণ্ডিতমশায়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে--কেউ বাদ যায়নি-পণ্ডিতমশাই আত্ম-অবমাননার কি নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে ।

পণ্ডিতমশাই যেন উত্তরের প্রতীক্ষায় বসেই আছেন। সেই জগদ্দল নিস্তব্ধতা ভেঙে কতক্ষণ পরে ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজেছিল আমার হিসেব নেই। এই নিস্তব্ধতার নিপীড়নস্মৃতি আমার মন থেকে কখনো মুছে যাবে না।

‘নিস্তব্ধতা হিরন্ময়’ ‘Silence is golden’ যে মূর্খ বলেছে তাকে যেন মরার পূর্বে একবার একলা-একলি পাই ।





                                                                             
















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. রম্যরসের ভেতর দিয়ে জীবনের রুঢ় বাস্তব সত্য বলার এই ঢং আলী সাহেবের,আমার বড় প্রিয়।

    উত্তরমুছুন
  2. প্রত্যেক বার পড়ার সময় কান্না আসে!

    উত্তরমুছুন